Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Subhashish Chakraborty

Action Inspirational Thriller

3  

Subhashish Chakraborty

Action Inspirational Thriller

যুগপুরুষ

যুগপুরুষ

11 mins
210


আলোটা সোজা এসে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছুটে আসতে লাগলো।

মালগাড়ি। ধারেকাছেই কোথাও যাচ্ছে -- সারিবদ্ধভাবে কলকারখানাগুলো মোটামুটি এখান থেকে বলতে গেলে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই পড়ে যে।

আনসারী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দীর্ঘস্বাস ফেললো।

আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে, জানো? বৃষ্টি পড়লেই মনে পড়ে। তোমার সেই ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো -- "ভালো করে ছাতাটা ধরো না?"

কিংবা শীত পড়লেই বেড়ালের মতন যুবুথুবু হয়ে বসে থাকা। কথার উত্তরে কথা না বলা। আবার গরম পড়লেই প্রত্যেক তৃতীয় কথায় 'মাগো, মরে গেলাম, মাগো মরে গেলাম" করে কাঁদা।

তুমি চিরকালই ভীষণ অধৈর্য, অসহিষ্ণু। কোনো কিছুই বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। একটুতেই ভীষণ রাগ, একটুতেই মনমালিন্য। একটুতেই চোখ জল।

আর সে জলের ঠেলা সামলাতে আমি নাকের জলে-চোখের জলে। কে জানে -- তোমার ওই সবুজ-অবুঝ মন দেখেই হয়তো তোমার প্রেমে আমি পড়েছিলাম। জড়িয়ে আছো তুমি আমার শিরায় শিরায়। আধা আধা ভাবে কাটা আমার হৃৎপিন্ডটা আজ ও নেতিয়ে নেতিয়ে তোমার নামই উচ্চারণ করে।

আজ তুমি কত দূরে।

মুছে গেছো ফিরে না যাওয়ার সমস্ত পিছুটানের ওপারে। আমায়...আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমায় ভিকিরি করে তুমি চলে গেলে। এমনকি আমার বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটুকুও তুমি নিংড়ে যেটুকু তুমি ফেলে রেখে গেলে তা এক চলন্ত লাশ মাত্র।

মসলা মুড়ি ওয়ালা ঝুঝুনি নুপুরের শব্দ তুলে প্ল্যাটফর্ম ক্রস করলো। সম্বিৎ ফিরলো আনসারীর।

আট বছরের লম্বা একটা লাইন। কতবারই তো বলেছো চলে যেতে। দূর হও চোখের সামনে থেকে। আমি চলে যাইনি। জানতাম রাগ পড়লে আবার আমায় কল করবে। আবার আসবে ফিরে।

আজ সেই লাইনটা ভেঙে গেলো, জানো?

"এতবার তারে, গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি"....

পিঠের ব্যাগটা খুব ভারী মনে হচ্ছিলো। স্টেশন প্ল্যাটফর্মের ইনকোয়ারি রুমের জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছে, ক্লান্ত পাখাটা হাঁফাতে হাঁফাতে চলতে চলতে একসময় বোধহয় থেমেই গেলো। ঝিন্ঝিনি ঝিঁঝি পোকার ক্যাকোফোনি আর মাঝে মাঝে উড়ে বেরিয়ে যাওয়া দু-একটা মালগাড়ি ছাড়া বোধকরি স্টেশনটায় বেঁচে থাকার আর কোনো লক্ষনই নেই।

আনারা জংশন। পরের স্টপেই পুরুলিয়া। আজ সকালেই এসেছিলাম কলকাতা থেকে। তোমার -- তোমার বাবা ডেকেছিল।

আমি আমার বাড়ির কাউকে না জানিয়েই এসেছি। জানালে আসতে দিতো না হয়তো।

আনসারী বসলো রুগ্ন স্টেশনের বেঞ্চিটায়। মোটে সাড়ে বারোটা বাজে।

পরের এক্সপ্রেসটা আসতে এখনো ঘন্টা দুয়েক বাকি আছে। আদ্রা-রাঁচি এক্সপ্রেস। এখানে দাঁড়ায় না -- ধা করে বেরিয়ে যায়।

আমার আর কিছু করতে হবে না বিশেষ -- ওটা আসার ঠিক আগে -- একটা লাফ....

বাকিটা বিধাতা আর আমার ভাগ্গ্য় বুঝে নেবে।

গলায় তাবিজটায় হাত বুলিয়ে যেন অজানা কোনো এক অজ্ঞাত সত্ত্বার কাছে ক্ষমা চাইলো আনসারী।

বেশ ক্লান্ত লাগছিলো -- অনেকটা রাস্তা হাটতে হয়েছে যে আজ ওকে। সেই রঘুনাথপুর থেকে টানা স্টেশন। আসার সময় কি ভাগ্গি একটা অটো দাঁড়িয়েছিল। বলে কয়ে, কিছু পয়সা দিয়ে রাজি করতে পেরেছিলো। ফেরার পথে কিছু পাচ্ছে না।

একে ওই কথা কানে বাজছে -- তার ওপর এতটা রাস্তা হেঁটে।

তবে কি জানো -- হাঁটতে হাঁটতেই যা ভাবার ভেবে নিয়েছিলাম। হিসেবটা। একটু গুগল করে জানতে পারা গেলো স্টেশনের আসা-যাওয়া ট্রেনের টাইম টেবিল। লাস্ট আসা ট্রেন ওই রাত আড়াইটে -- আদ্রার থেকে। তারপর প্রায় ঘন্টা দু-একের বিরাম -- ভোরের আলো ফুটলে আবার কলকাতা পুরুলিয়া: রাঙামাটি এক্সপ্রেস।

সকালে...ভোরের আলো ফুটলে এ কাজ কখনোই করা যাবে না। যা করার ওকে রাতের আঁধারেই করতে হবে।

প্ল্যাটফর্মে বসে একটা জলের বোতল কিনে একটানে শেষ করলো। হ্যাঁ -- হিসেবে তো তাইই বলছে ট্রেনটা এই প্ল্যাটফর্মেই যাবে। গুগল করলো কিছুক্ষণ, আম্মির সাথে কথা বললো। আম্মি ব্যস্ত দিদির বাচ্ছা মেয়েটাকে নিয়ে -- বেশি কথা আম্মি আজকাল বলে না ওর সাথে। এখন দিদিই আম্মির ধ্যানজ্ঞান। আব্বু বাড়ি নেই -- ফিরতে রাত হয়। ধর্মতলায় ব্যাগের দোকান -- ব্যবসা নিয়েই সবসময় ব্যস্ত।

হাসলো আনসারী -- পৃথিবীতে বোধহয় কারোরই ওকে খুব একটা প্রয়োজন নেই।

যাও বা ছিল -- হাসলো মনে মনে ও, কথাটা মনে করে -- "কি করি বলো। একমাত্র মেয়ে। ওরকম ভাবে সর্বনাশ তো আর করতে পারি না, তাই না? আমরা ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ হয়ে মুসলমান ঘরে মেয়ে কি করে বিয়ে দি বোলো?"

"না না কাকু -- ওটা নিয়ে ভাববেন না। বিয়ের পর আপনার মেয়ে নিজের পদবি রাখবে। আমরা হিন্দু ও মুসলিম মতেই বিয়ে করবো।"

"আমার মত নেই", তোমার বাবা উঠে গেলেন -- "এই নিমাইয়ের মা -- দালানটা পরে গঙ্গার জল দিয়ে ধুয়ে দিও তো...."

তোমার বাবার ক্ষেদোক্তি।

আমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসি -- সেটাই কি সবকিছু নয়? আমি তো আমার সবকিছু ফেলে এগিয়ে এসেছি -- কৈ আমি তো কিছু মনে রাখিনি: আমার ধর্ম, আমার পরম্পরা, আমার নীতিনৈতিকতা, লোকলজ্জা, স্থান-কাল-পাত্রের মারপ্যাঁচ -- কৈ তুমি তাহলে কেন আনছ এসব?

খসখস করে আওয়াজ হলো। একফালি উদাসী হাওয়ায় যেন মনে করিয়ে দিলো সবকিছু। সঙ্কীর্ণতা। এক জীবনের বিফলতার কাহিনী। শেষ না করা কিছু কথা।

আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার এই দেশ। সমাজ। ঘৃণ্য সমাজ ব্যবস্থা। মুছে যাওয়া মানবিকতার হাতের ছাপ।

আমি যেমন ফ্যাকাসে -- আমার ভালোবাসাও এই সমাজের কাছে ফ্যাকাসে।

এই জীবন রেখে কি লাভ আছে?

"ভাই, কটা বাজে এখন?"

চমকে উঠলো আনসারী। হাত গোটানো সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক বসে। মাথার চুলের লাইনটা চওড়া কপালের বাউন্ডারির ওপারে যেন কালসিটে পড়া এক স্মৃতিসৌধ। আর কিছু বছরের মধ্যেই যে টাক পড়বে সন্দেহ নেই। মুখের হালকা হাসি দেখে মনে হয় খুব মিশুকে।

আনসারী ভারী বিরক্ত হলো। কথা বলার ইচ্ছে ওর একদমই নেই।

"কটা বাজে ভাই?"

"পৌনে একটা।" কথা শেষ করলো আনসারী। জিনসের পকেটে একটা কাগজ। খসখস করে অনেক কিছু লিখেছে তাতে ও। কেউ খুলে পড়লে অনেক কিছু জানতে পারবে।

ধিক্কার। ধিক্কার এই সমাজকে।

"কটায় ট্রেন ভাই?", লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলো।

"কেন বলুন তো?", আনসারী বেশ রাগতঃ সুরেই জিজ্ঞাসা করলো পাল্টা।

"না মানে -- বলছিলাম কি -- আমার ট্রেনটা আবার খুব লেট্ করেছে।"

"কোথায় যাবেন?", নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরেই একবার জিজ্ঞেস করে ফেললো আনসারী।

"যাবো অনেক দূরে। জায়গার নাম বললে আপনি চিনবেন না।"

"ও।"

আনসারী আবার মুখ ঘুরিয়ে বসলো।

"কি করা হয়?"

উফফ, লোকটা গায়ে পরে মিশতে চায়।

"আমি student -- গেলো মাসে গ্রাডুয়েশন শেষ করেছি। এখন বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছি। আপনি?"

"আমি পড়াই।"

"স্কুলে?"

"হ্যাঁ।"

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। আনসারী ভাবছিলো ও উঠে যাবে কি না। এভাবে কেউ পাশে বসে থাকলে লাইনে ঝাঁপ দেওয়াটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

"সূর্য।"

"সরি?", আনসারী বেশ বিরক্ত। লোকটার কথা বলার রসদ যেন আর ফুরচ্ছেই না।

"আমার নাম সূর্য।"

"আনসারী", অগত্যা নামটা বলতেই হয় নিজের -- "নৈম আনসারী।"

লোকটা হাসলো -- "নৈম...বেশ মনে পরে গেলো কারোর কথা জানেন ভাই? আমার পাশের গাঁয়ে বাড়ি ছিল। সেবার গ্রামে ওলাওঠায় ওর বাড়ির সবাই মারা গেলো। সাজানো পরিবার: মা, বাপ্, ভাই, বোন -- সবাই। ছেলেটা একটু ও দমলো না, জানো? ওই অবস্থাতেই সেবায়েতের কাজে নেমে গেছে।"

আনসারী ঘুরে বসলো লোকটার দিকে।

"দেশ জুড়ে তখন আগুন জ্বলছে। শেয়ালের মতন ওরা খুঁজে বেড়ায় আমাদের। নিজের দেশে প্রবাসী হয়ে মুখ ঢেকে বেড়াচ্ছি। মৃত্যু প্রতি পদে পদে। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে থাবা চালাতে পাড়ে ভয়ানক শাপদ। একটা ব্রিফকেস পাঠানোর দরকার ছিল কলকাতায়। আমার ছেলেগুলো কেউই ছিল না তখন -- এটা করার জন্য। আমরা তখান বরিশালে -- আরও মধ্যেই প্ল্যান করা হয়েছে চট্টগ্রাম আসার। নৈম তখন নিজের থেকে বললো ও ব্রিফকেসেটা নিয়ে যাবে।"

ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে? কারা খুঁজছে? কেন? ব্রিফকেসে কি আছে?

"বর্ধমানের কাছে ট্রেন থামায় একদল এঁড়ে কুকুর উঠলো, জানো? নৈম -- একটা ভুল করে ফেলেছিলো। ওরা প্রত্যেক যাত্রীর তল্লাশি করতে করতে নৈমের কাছে পৌঁছাতেই নৈম পালাতে গেলো ট্রেন থেকে -- ওরা গুলি চালালো। নির্নিমেষ গুলি। পিঠ-পিছে। ধূর্ত-কাপুরুষ শেয়ালের থাবা। নৈম থামেনি -- লাফ মারলো চলতি ট্রেন থেকে। উল্টো দিক থেকে আসছিলো আরেক ট্রেন। নৈমের গুলিবিদ্ধ দেহ আর ব্রিফকেস নিয়ে পিষে বেরিয়ে গেলো। ওদের চোখে অবিশ্বাস, হতাশা আর হেরে যাওয়ার গ্লানি। পড়ে থাকলো শুধু নৈম -- ওর মৃত্যু ওর গলায় বিজয়ীর মালা হয়ে ঝুলছে ।"

কি বলছে লোকটা? এরা করা? কোনো টেররিস্ট গ্রূপ?

"নৈমের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও চিনতে পারা যাচ্ছিলো না। ওই দিন অনেকে এসেছিলো। আমার ছেলেরা ও ছিল। নৈমের ওই দেহ দেখে জেদটা আরও চেপে বসলো, জানো ভাই? ছেলেটা মরে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো -- মরি তো মেরে মরব।"

কিসের আগুন? কি বলে চলেছে লোকটা? কাকে মারার কথা বলছে লোকটা? কিরকম যেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আনসারীর।

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো -- গভীর দীর্ঘশ্বাস। কোথায় যেন খুব ব্যাথা -- "খুব চেষ্টা করলাম জানো ভাই? কাঁটায় কাঁটায় দশটা। দমপাড়ার পুলিশ স্কান্ধাবার। গনেশ কিছু ছেলে নিয়ে হামলা চালালো, আর ওদিকে লোকনাথ ওল্ড-সার্কিট হাউসে আক্রমণ করলো। বুদ্ধি করে করেছিল কি -- কেটে দিয়েছিলো ট্রেন লাইন, টেনিফোনের লাইন -- বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলো পুরো অঞ্চলটি। ওরা অনেক পরে এসেছিলো, ওদের সেদিন গুড ফ্রাইডে ছিল যে -- তাই বেশিরভাগ লোকেই ছিল না। আর এলো যখন তখন ভয়ানক খণ্ডযুদ্ধ বাঁধলো। চারিদিক থেকে গিরে ধরেছে ধূর্ত হায়নার দল -- ধোঁয়ায় এবং রক্তের লালে বিসন্ন মাতৃকা। ওরই মধ্যে পালাতে পেরেছিলো কোনোমতে সবাই - অনন্ত সিং, জীবন ঘোষাল, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত --পালিয়ে উঠে এসেছিলো চন্দননগরে।"

আরে -- এই নাম গুলো যেন -- কেন যেন খুব চেনা চেনা লাগছে, তাই না?

"কিছুদিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেলো। ওদের বড় কুকুর চার্লস টেগার্ট আর তার পোষা নেকড়ে গুলোকে নিয়ে ঘিরে ফেলেছিলো আমাদের হাইডআউট। অনেক লড়াই করেছিলাম আমরা সব্বাই। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে unjustified লড়াই: আমরা মোটে কয়েকজন আর ওরা শয়ে শয়ে। গুলি শেষ হতে লাগলো, হাতিয়ার শেষ হতে লাগলো। টেগার্টের গুলিতে প্রাণ হারালো জীবন ঘোষাল। আরও বেশ কিছু তাজা প্রাণ। আর কিছুদিনের মধ্যে বাকিরা -- মনরঞ্জন সেন, রজত সেন, দেবা গুপ্ত, স্বদেশ রায় -- এরা সবাই সামনাসামনি লড়াইতে বীরগতি প্রাপ্ত হলো। ফনী আর দেবীপ্রসাদের ভাইয়ের যাবজ্জীবন হলো।"

ঘামছে আনসারী। কে এই লোকটা?

"১৬ই ফেব্রূয়ারি -- ধরা পড়লাম আমিও। হায়রে অদৃষ্ট -- নেত্রা সেন। যে নেত্রাকে এতো বিশ্বাস করতাম -- সেই নেত্রাই গিয়ে ওদের বলে দিয়েছিলো আমার কথা। যুগে যুগে আসা সেই মীর জাফরের বিষদাঁত -- সেই যুগের দশ হাজার টাকার ইনামের লোভ বোধহয় বেচারি সহ্য করতে পারেনি। আর বিধাতার দেখো -- সে টাকাটার মুখ ও বেচারি দেখতে পেলো না। গুলি করে তার আগেই আমার বাকি কমরেডরা তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো।"

"কে....কে আপনি?", গলাটা যেন বসে আসছে আনসারীর।

"কষ্ট --খুব কষ্ট। শেষটা খুবই কষ্টের। ওরা নির্ধিধায় আমার ফাঁসির হুকুম দিলো। সে সময় মৃত্যুদন্ড দেওয়াটা যেন মুড়িমুড়কি খাবার মতন। মৃতুমঞ্চে ওঠার আগে ওরা খুব মেরেছিলো আমায়। আমার হাতের আঙুলের নখগুলো উপড়ে নিয়েছিল, হাত আর পা ভেঙে দিয়েছিলো মেরে -- বিষময় ব্যথা নিয়ে আমি মৃত্যুবরণ করলাম", লোকটা হাসলো -- "বণিকের মানদন্ড দেখা দিলো রাজদন্ড রূপে..."

হাসি, তাচ্ছিল্যের হাসি।

"মাস্টারদা", আনসারী টের পেলো ওর সারা শরীরে দৌড়ে চলেছে কোটি কোটি ভোল্টের বজ্রবিদ্যুৎ -- "মাস্টারদা সূর্য সেন...."

"দুঃখের কথা কি জানো?", লোকটা উত্তর না দিয়ে বলেই চলেছে -- "ব্রিটিশরা আমাদের দেশ রাজত্ব করতো সেই কথাটার থেকে বড় কথা কি জানো? ওরা আমাদের যা ক্ষতি করেছে - তা হয়তো কোনোদিনই পরিশোধ করা যাবে না। দুশো বছরের রাজত্বে ওরা সব মিলিয়ে লুটেছে ৪৫ ট্রিলিয়ন কোটি মার্কিনি ডলার। নানাভাবে। অভদ্র-নপুংসক ছিঁচকে চোর -- ঘৃণার কীট -- আজ ও জানো, কত কোটি টাকা আমার ভারত ওদের থেকে পায়, ওরা দেয়নি? আজ ও ভারতের গলায় দারিদ্রের না শুকানো ক্ষতস্থানের জন্য ওরা অনেকটাই দায়ী। হয়তো কোনোদিন ও শুকোবেই না এই ক্যান্সারের ঘা। "

আনসারী সিঁটিয়ে বসলো সিটের এক কোণায়।

"আমি এক নই ভাই -- আমি অনেক। প্রত্যেকবার মরেছি আবার জন্মেছি মরবো বলে - দেশের জন্য, সবার জন্য। আমিই সেই সমুদ্র-মন্থনে ওঠা কালকূট পান করা তরুণ ঈশান। সন্ডার্স সাহেব ও এসেম্বলির ফ্লোরে বোমা ফেলা সেই ক্রন্তিকারী ম্যাভেরিক ভাগত সিং নয় -- ওটা আমিই ছিলাম। যতীন-দাসের লাহোর জেলে না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া -- না, না ওটা যতীন নয়: ওটা আমিই ছিলাম। আই.এন.এ.'র রক্তাক্ত যুদ্ধের সেই যুবনেতা আর কেউ নয় -- আমিই। কুকুরগুলো ঘিরে ধরে একা যে পুরুষ সিংহকে আক্রমন করে মেরেছিল - সেই চন্দ্রশেখর আজাদ ও আমি। রামপ্রসাদ বিসমিল ও আমি। আশফাকুল্লা খান ও আমি। বুড়িবালামের তীরে গুলিবিদ্ধ সেই বীরসিংহ বাঘাযতীন ও আমি। আমিই বিনয়, আমি বাদল, আমিই দীনেশ। আমিই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার , আমিই বিরমণী বীর সাভারকার। আমি মরি না -- আমি হারি না। হার কি ভাবে মানতে হয় জানি না।"

থরথর করে কাঁপছিলো আনসারী।

"লজ্জা করে না?", লোকটার গলায় ক্রোধ ওর ঘৃণা -- "লজ্জা করে না তোমার? আত্মহত্যা করছো? কেন করছো তুমি? Indians and dogs not allowed -- কে দেবে একথার সপাটে উত্তর?"

"আমি....আমি ওকে ভালোবাসি...ওকে আমি খুব --"

"চুপ করো -- ফেরত দাও আমায় আমার প্রতিটি রক্তকণা। ফেরত দাও আমায় আমার প্রতিটি মুহূর্ত। আমি ও তোমার থেকে অনেক ভালো থাকতে পারতাম। ভালোবাসা-প্রেম-প্রীতি করে, ওদের পায়ের তলা চেটে, ওদের দেওয়া চাকরি করে -- আমি অনেক ভালো থাকতাম আজ। আমি সব কিছু ত্যাগ করেছি -- বারম্বার: সেটা কি এই দিন দেখার জন্য - প্রেমে প্রত্যাঘাত পেয়ে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেবে আমার এই দেশের তাজা খুন?"

"মাস্টারদা..."

"ওঠো তরুণ, ওঠো নবযুবক, ওঠো বীর -- যদি তুমি, তোমরাই বসে যাও হাল ছেড়ে -- তাহলে তো বৃথা যাবে আমার দেয়া বলিদান, আমার সবকিছু।"

আনসারীর সারা শরীর কাঁপছে -- ওর চোখ চাপিয়ে জল।

"আজ ও ওরা -- আমাদের খুব নিচু নজরে দেখে। ওদের বনেদিআনার অহংকার আজ ও যায়নি। আজও সুযোগ, সময় পেলেই বক্রোক্তি, কটূক্তি করে আমাদের দেশকে নিয়ে। কেন জানো? আমাদের দেশের ঐকতার অভাব, আমাদের দেশে আজ ও stupid ধর্ম-জাতি ও সংস্কার নিয়ে লড়াই চলে। আজ আমাদের দেশে disequilibrium ব্যাপারটা এতো বেশি - যে বড়লোক খালি বড়লোক হয়েই চলেছে, আর গরীব ক্ৰমশঃ গরীবতর। টাকাটা -- গোটা ইকোনমিটা এক সম্প্রদায়ের কাছেই আটকে আছে, চলছে নির্বিচারে বিষাক্ত করাপশন, হিংস্রতা, দুর্নীতি। স্বাধীনতা পেলেই হলো না -- সেটাকে জাস্টিফাই করতে হয়, বলি নি আমরা সে কথা?"

আনসারীর চোখ জল ভরে গেছে।

"শিক্ষা চাই, শিক্ষা। শিক্ষাই ভালো- খারাপ,ন্যায়-অন্যায়কে চেনাবে। বিদ্যাকে শানাও, শিক্ষাকে আয়ুধ করো -- তোমরাই ভারতকে পাল্টাতে পারো।"

হাত ওঠলো আনসারী -- করজোড়ে।

"CEPTAM পরীক্ষার রেসাল্ট আর কয়েকদিনের মধ্যেই তো বেরোবে...কেমন দিয়েছিলে পরীক্ষা?"

"মাস্টারদা...", ভাষা হারিয়ে ফেলছিলো আনসারী -- "আপনি জানেন আমি এই পরীক্ষাটা দিয়েছি?"

"আমি সবসময় সমস্ত কর্মবীর, তরুণ-তুর্কির পাশে থাকি -- সিরিয়ার ক্ষতস্থানে স্নেহপ্রলেপ দিচ্ছি, সোমালিয়ার না খেতে পাওয়া ক্ষুধার্ত বাচ্ছাগুলোর পাশে আমি, বলিভিয়ার ভয়ানক কালো দিনে ও আমি, ভয়ানক বিষরোগে বাপ্-মা মরা বাচ্ছাটার ও মাথায় আমিই জল- পট্টি দিচ্ছি । কি করবো বলো -- কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারিনা যে", মাস্টারদা উঠে -- দাঁড়ালেন সারা গায়ে প্রচুর আলো --"আমি ও ভালোবেসেছি। মানুষকে। সমষ্টিকে। জন-সমুদ্রকে। ব্যক্তিগত প্রেম বন্ধন নিয়ে আসে -- ব্যথা আনে। আমার রাস্তায় চললে দেখতে পেতে -- মুক্তির স্বাদ কত সুন্দর।"

গোঁ-গোঁ করতে করতে কখন যে মাথা ঘুরে পরে গেছিলো আনসারী তা বোধহয় নিজেও বুঝতে পারে নি।

                                                     ******************************

"ও দাদা -- ও দাদা, শুনছেন?",

ধড়মড় করে উঠে বসলো আনসারী। অনেকগুলো মুখ ওর উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো ও আনারা স্টেশনেই পরে আছে। ভোরের আলোর পসরা নিয়ে সূর্য উঠছে। নতুন এক সূর্য -- কাছে একটা পাখি ডাকছে।

না, না। আমি ঠিক আছি। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখছিলাম, তাই না? খুব হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সর্বত্র -- সবেতে -- ব্যক্তি-বিশেষ নই।

খুব মন খারাপ করে উঠলো আম্মির জন্য। মা…..বুড়ি মা-টার জন্য। কি করছে এখন কে জানে?


                                                     ***************************

একটা চিঠি এসেছে।

চিঠিটা নিয়ে নিজের পড়ার ঘরে উঠে এলো আনসারী। কাল ১৫ই আগস্ট -- চারিদিকে ত্রিবর্ণা ফ্ল্যাগে ফ্ল্যাগে আর বোধহয় এক চিলতে জায়গা নেই। ও গিয়ে জানলাটা খুললো -- পড়ন্ত সূর্যের আলো।

একটা চিঠি।

DRDO.....CEPTAM -- হ্যাঁ পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম বটে। গত জানুয়ারি মাসে মেইনটাও হয়ে গেছিলো। চিঠিটা অধীর আগ্রহে এক টানে পড়ে শেষ করলো ও।

হ্যাঁ পাশ করেছে। দিল্লি যেতে হবে। ট্রেইনিং। তারপর ওখান থেকে নারীমনাম।

বহু পুরোনো একটা স্বপ্ন যেন ঝিলিক দিয়ে চলে গেলো ওর চোখের ওপর।

এ...এ কি সম্ভব? এ পরীক্ষায় পাশ করা তো খুব কঠিন - ও চেয়ারে বসে পড়লো।

ও যা পড়ছে তা কি সত্যি? আজ...গা শিউরে উঠলো ওর...আজ সত্যিই যদি আত্মহত্যা করতো ও -- তাহলে...তাহলে এই চিঠিটা কোনোদিন ও পেতো না ও। নিজের ওপর কিছুক্ষণ রাগ হলো ওর। ইশ -- কি ভুলই করতে চলেছিল ও।

খোলা জানলার নিচে ব্যস্ত কলকাতার ফুটপাতে দূরে দাঁড়ানো লোকটাকে ও বোধহয় দেখতেই পায়নি।

পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা -- সেই অগ্নিপুরুষ।

মৃদু হেসে জনসমুদ্রে মিলিয়ে গেলেন -- এক পলকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action