চিরভক্ত
চিরভক্ত
১.পাহাড়টা দূর থেকে কিন্তু এতো বড় বলে মনে হয় না। অনেকগুলো টিলার মাঝে একটা গোঁজ হওয়া নীল রঙের পাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কেমন যেন বেমানান। অনেকগুলো গাঢ় বাদামি আর সবজে টিলার মাঝে, নীল টিলাটি কে যেন উড়িয়ে এনে রেখে দিয়ে চলে গেছে। কাছে আসলে বুঝতে পারা যায়, যতটা ছোট বলে মনে হয়, আদৌ কিন্তু অতটা ছোট নয়, মাটির থেকে প্রায় বাইশ থেকে চব্বিশশো ফিট তো হবেই।
অন্তত রবার্ট হিগিন্সের ত্রিকোণমিতির জ্ঞান তো তাইই বলে।
শ্যাওলা পড়া চাতালের কাছে এগিয়ে এসে, উবু হয়ে, দুহাতে করে নলটার কাছে হাত রেখে জল খেলো রবার্ট। ঝোপ আর আগাছার মাঝে বেরিয়ে আছে একটা পুরোনো পাথরের নল -- খুব জোরে জল বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। পাহাড়ের এতো উঁচুতে, এরকম প্রত্যন্ত কোণে এতো মিষ্টি, ঠান্ডা জল -- ভাবাই যায় না। রবার্ট প্রাণ ভরে জল খেয়ে, মুখ মুছে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে একজন বুড়ো মতন লোক কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে। সাদা রঙের ফতুয়া আর ধুতি। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, তাই লোকটার জামা কাপড় ভেজা, মাথার চুল দিয়েও টপটপ করে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে, গলা আর ঘাড় দিয়ে।
রুকস্যাকে ঝোলানো টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো রবার্ট। চারদিকে আগাছার জঙ্গল, দিনের বেলায়ও বেশ অন্ধকারের রেশ থাকে। সাথে ঝিঁঝি পোকার ক্যাকোফনি, আর আশপাশের গাছগাছালির মাথার থেকে নানান পাখি-পক্ষীর চিৎকার।
ঝর্ণার পাশের একটু ঢালু হয়েছে পাহাড়ের মাটি। কিছু পা এগিয়ে গেলেই একটি মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরটির চারদিক খোলা, ভিতরে একটা উঁচু মতন বেদি, তার ওপর দাঁড়িয়ে চার হাত ওয়ালা এক অস্পষ্ট মুখাবয়বের ভাঙা বিগ্রহ, কিছু কুচো ফুল, ভাঙা নারকেল, আর ছোট গ্লাসে করে ভরা জল।
"এতো উঁচুতে ঝর্ণার এরকম সুমিষ্ট জল....কোথার থেকে আসছে বলুন তো এই জল?", রবার্ট ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো লোকটাকে।
লোকটার চোখে মুখে কেমন যেন কৌতুকময় হাসি - "অনেকে বলে, ওপরে...পাহাড়ের অনেক ওপরে কোথাও একটা সরোবর আছে। ওখান থেকেই জলটা আসছে। বৃষ্টি হলে জলের ফোর্স বাড়ে।"
লোকটার হিন্দিতে কেমন যেন একটা প্রাদেশিক টান। পাহাড়ের মানুষের একটা আলাদা অ্যাকসেন্ট আছে -- সাধারণ হিন্দির থেকে বেশ আলাদা।
"আপনি দেখেছেন কখনো সেই সরোবর?"
"নাহ, আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি", লোকটা এগিয়ে গিয়ে ওই পাথরের নলে হাত-পা ধুলো -- "অনেক আগে এখানে সোনাই বাবা বলে একজন সাধক থাকতো, তাও সে বহু বছর হলো। আমার দাদু ওনার মুখে শুনেছিলেন ওই সরোবরটির কথা। এরপর সেই সোনাই বাবা চলে যাবার পর, আর কেউই ওপরে ওঠার সাহস করেনি। বাবার কুটির, মন্দির, জলাধার নাকি আজ ও ওভাবেই পড়ে আছে।"
"কেন? কি এমন আছে ওখানে?", রবার্ট জুতোতে পা গলালো -- "এতোদূর অবধি আসতে পারছেন, আর একটু ওপরে গেলেই তো...."
লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে, কোনো উত্তর না দিয়ে, ভাঙা মন্দিটার ভিতরে ঢুকে পড়লো। যেন প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, পুরোটা শেষ করতে দেওয়াও এক ধরণের ধৃষ্টতা।
রবার্ট ক্যামেরা বের করে কয়েকপা এগিয়ে এসে শুট করার চেষ্টা করলো। উফফ....এখানে এতো অন্ধকার না....
কিসের....কোন দেবতার মূর্তি এটা? মাটির থেকে প্রায় আড়াই ফিট লম্বা একটি আবছা অবয়ব। সারা গায়ে পাথরের ওপর নীল নীল রঙের ছোপ। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে রঙটা হালকা হয়ে গেলেও, স্পষ্ট বোঝা যায় কোনো এক সময়ে মূর্তিটির পুরো গা-টাই নীল রঙা ছিল। রঙটা চটে গিয়ে, কালো পাথরের ওপর নীল শ্বেতির মতন বাকি রঙটা পড়ে রয়েছে। মূর্তির চারটে হাতই ভাঙা, কনুইয়ের পর থেকে আর নেই, পেটের নিচ থেকেও দেহের জ্যামিতি স্পষ্ট নয়। ফলতঃ, এটা কিসের মূর্তি সেটা অনুমান করা সত্যিই খুব দুস্কর।
কপালের ঘাম মুছলো রবার্ট।
যা দেখছি, যা বুঝছি আর যা শুনে এসেছি -- কেন জানি না মনে হচ্ছে...সব সত্যি। বিশেষ করে নীল রঙের পাহাড়, তার ওপর ওই সরোবর আর এই ভাঙা মূর্তিটা....পুরোটাই কি কাকতালিয়?
মন্দির থেকে কয়েক পা পিছিয়ে আসতেই, মোটা ঝোপে লুকোনো সিঁড়ির ধাপ চোখে পড়লো। থমকে থমকে পাহাড়টার ওপরে উঠে গেছে। দূরবীন বের করে চোখে লাগাতেই, এখান থেকে প্রায় তিন থেকে চারশো ফিটের ওপর আরো একটা ভাঙা মন্দির নজরে এলো। মেটে রঙের ইঁটের খিলান আর একটা ঝুল বারান্দা, ওপরে একটা অস্পষ্ট পতাকা উড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও পতাকার ওপর আঁকা চিহ্নটি কিসের, সেটা কিছুতেই বুঝতেই পারলো না ও।
পিছন ফিরে একবার দেখে নিলো রবার্ট। ওই অদ্ভুত বুড়োটা তখন ও পুজো করছে, বসে বসে। কিছুক্ষণ আরও দাঁড়িয়ে মন্ত্রটা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো রবার্ট। রবার্টের এতো বছর ধরে ভারতে থেকে যে বিশ্বাসটা জন্মেছে সেটা হলো: এই ইন্ডিয়ানদের পুজো, মন্ত্র, আচার, আদব-কায়দা আলাদা আলাদা হলে কি হবে -- ভীষণভাবেই কিন্তু প্রেডিক্টেবল। যে কোনো মন্ত্রর প্রথমটা শুনলেই বোঝা যাবে, কার বা কিসের স্তুতি হচ্ছে।
কিন্তু না, লোকটার কোনো কথাই শোনা যাচ্ছে না -- এতটাই আস্তে আস্তে কথা বলছে।
যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তার প্রিয়তম দেবতার সাথে। যেন কোনো নিকটতম আত্মীয়ের সাথে কথা বলছে লোকটা। পুজোয় কোনো ভক্তির চিহ্নই নেই।
সময় নষ্ট না করে, শেষমেশ বিরক্ত হয়েই আবার চলতে শুরু করলো রবার্ট।
যেমন অদ্ভুত দেশ, তেমনই অদ্ভুত সব লোকজন। যে দেবতাকে পুজো করছি, তাঁকে সম্বোধন করার মন্ত্রই যদি না থাকে, তাহলে এটা কেমন ধরণের পুজো হয়, শুনি?
দূর দূর, যত্তসব...
বাইনোকুলারটা আবার চোখে লাগালো রবার্ট। হুম, অনেকটাই ওপরে চলে এসেছি। টিলার পাদদেশের ঝোপঝাড়, দূরদূরের ঘর বাড়ি, ছোট ছোট গাড়ি, বাড়ি দেখে আন্দাজ হচ্ছে, প্রায় ১০০০ ফিটের ওপর চলেই এসেছি, তাই না? মুখ উঠিয়ে আরেকবার দূরের মন্দিরটাকে দেখতেই রবার্ট টের পেলো ওটা কিন্তু বেশ কাছেই চলে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ভেজা ভেজা মাটির ওপর চারদিকে নানান বুনোফুল ঝুলে আছে, অনেক পাখির কিচিমিচি। সূর্যটাও কোন এক ফাঁকে ঢেকে গেছে মেঘের মাঝে -- মেঘের আড়ালে বেশ বেলাও হয়েছে, ভুলেই গেছিলো রবার্ট, ঘড়ি দেখে মনে পড়লো।
হিমালয়ের এই চত্ত্বরে সূর্য ডুবে বেশ দেরি করে। এখন চারটে বাজলেও, অন্ধকার নামতে অনেক দেরি আছে। তারপর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় অন্ধকার সব জায়গায় একসাথে নামে না, উঁচু পাহাড়ের মাথায় আলো থেকে যায়, পাহাড়ের নিচের গ্রামে কিন্তু অন্ধকার নেমে আসে খুব তাড়াতাড়ি।
যেন রোদে আর দিনে লোডশেডিঙের চাদর ধরে টানাটানি করছে।
হঠাৎ একটা আওয়াজে বেশ চমকে উঠলো রবার্ট।
ও...ওই পাশের ঝোপটা নড়ে উঠলো না? ওই যে, ওই যে আবার নড়ছে। কেউ যেন আছে। কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। রবার্ট কিছু পা এগিয়ে যেতেই, একটা মুখ দেখতে পেলো।
একটা লোক। একটা মাঝবয়েসী লোক, গালে এক মুখ দাড়ি। একটা হাফ প্যান্ট, আর গেঞ্জি পরা। রবার্টকে দেখে যেন ভুত দেখার মতন তাকিয়ে আছে।
রবার্ট কাছে যেতেই, গোঙানির মতন আওয়াজ করে উঠলো।
হাত তুলে রবার্ট নরম গলায় বললো -- "না, না ভয় পেয়ো না....আমি এখানে ঘুরতে এসেছি...."
লোকটা তখন ও গোঙ্গানির আওয়াজ করছে। রবার্ট ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা ভাঙা ক্যাডবেরীর মোড়ক এগিয়ে দিলো -- "ফ্রেন্ডস? বন্ধু হতে পারি আমরা?"
লোকটা রবার্টের দিকে আরেকবার দেখে ক্যাডবেরীর মোড়কটায় কাঁপা কাঁপা হাতে হাত দিলো।
রবার্ট আরো নরম গলায় প্রশ্ন করলো -- "তুমি এখানে থাকো?"
লোকটা গোঙিয়েই চলেছে।
"আমি ওই ওপরের মন্দিরটায় যাবো। তুমি কি রাস্তা চেনো?"
না, উত্তর নেই, গোঙিয়েই চলেছে। অদ্ভুত তো? আমি কি একে মেরেছি-ধরেছি নাকি? এরকম করছে কেন? লোকটা কি পাগল?
"তুমি যাবে? আমার সাথে যাবে?", খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো রবার্ট, ওর খুব কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে -- "তোমায় আরও একটা ক্যাডবেরি দেবো।"
লোকটা গোঙাতে গোঙাতে মুখটা হাঁ করলো। চমকে ছিটকে পড়লো রবার্ট। লোকটার জিবটা ঠিক শুরুর থেকেই কাটা। জিৰ বলে লোকটার কিছুই পড়ে নেই।
লোকটা হঠাৎ হাসলো, একটা হাত তুলে পাশে রাখা ব্যাগের থেকে একটা লম্বা টিনের বাক্স বের করলো।
রবার্ট টের পেলো, কেন জানি না ও খুব ঘামছে।
লোকটা হাসছে, গোঙাতে গোঙাতে -- বাক্সটা খুলে ওর দিকে এগিয়ে দিলো।
একটা কালচে লেয়ারের মাঝে, নুন ছড়ানো গোলাপি রঙের আধা পচা মানুষের জীব -- human tongue।
ক....কি এটা? কার জিব এটা?
লোকটা যেন নিজের কাটা জিবটা নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে, ট্রফির মতন।
ঘেন্না আর অজানা একটা ভয়ে রবার্ট টের পেলো ওর পেটটা বেশ গুলিয়েই উঠছে। সময় নষ্ট না করে, প্রায় দৌড় মারলো ওখান থেকে রবার্ট।
লোকটা তখন ও গোঙাচ্ছে, হাসতে হাসতে।
******************************************
আরও কিছুদূর এগোতেই রবার্ট ব্যাপারটা টের পেলো।
খুব জোরে হাওয়া দিচ্ছে, পাখিদের চেঁচামিচি হঠাৎই যেন খুব বেড়ে গেছে। কোথায় যেন একসাথে অনেকগুলো ঘন্টা বেজে চলেছে। উঁচু উঁচু ঝোপ আর গাছের বুহ্যের ওপারে ভালো কিছু চোখে পড়ে না, চুপচাপ কিছু পা এগোতেই পাথুরে মাটিতে সোঁদা গন্ধ টের পেলো রবার্ট। বাইনোকুলারটা চোখ থেকে নামাতেই টের পেলো জিনিষটা ও।
হ্যাঁ...ওই তো...ওখানেই তো ওই সরোবরটা।
মেঘ সরিয়ে সূর্যটা বেরিয়ে এসে গনগনে লাল রঙ নিয়ে জলের ওপর বিলি কাটছে। একটা নাম না জানা পাখি মাঝ সরোবরে একটা ভেসে থাকা গাছের গুঁড়িতে বসে বসে ঘুরছে। সবজে-নীল রঙের জলটা এতটাই পরিষ্কার আর মোহময়, যেন ইচ্ছে করে পেট পুরে গলা ভেজাই।
হ্যাঁ, ঠিক পাশেই একটা মন্দির।
সেই ভাঙা মন্দিরটা, যার বিস্তীর্ন একটা ঝুল বারান্দা, পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিলো। রবার্ট কয়েক পা এগোতেই ব্যাপারটা খেয়াল করলো।
মন্দিরটার ওপরে ঝোলানো সেই ফ্ল্যাগটা আর নেই।
চোখে বাইনোকুলার লাগলো ও। ভুল দেখছি না তো? না, ভুল দেখছি না। পতাকাটা কে যেন খুলে নিয়েছে মন্দিরের চূড়ার থেকে।
সারা শরীরে কি যেন খেলে গেলো ওর।
মন্দিরটায় কি কেউ থাকে? এখানে কি কেউ থাকে? লোকটা কি যেন বলছিলো -- কি একটা বাবা না কি যেন এখানে থাকতো, তারপর সে চলে যাওয়ার পর থেকে জায়গাটা খালিই পড়ে আছে। সত্যিই কি তাই? অনেক সময় নিচের লোক ওপরে আসে না বলে, হয়তো খোঁজই রাখে না।
দু পা এগোতেই পাথুরে মাটির ওপর একটা দরজা। একটা হ্যাচডোর।
ঠিক দেখছি তো? ঠিক দেখছি তো?
রবার্ট ঝুঁকে পড়ে, মর্চে পড়া একটা হুড়কো দেখতে পেলো দরজাটার ওপর। তালা লাগানো নেই? টান মারবো? ইতস্তত করতে করতে একটু টানতেই দরজাটা খুলে গেলো, নিচে একটা সিঁড়ি। একটা ভল্ট।
ইয়েস।
আর কোনো সন্দেহই নেই, যা শুনেছি।
সিঁড়িটা বেশ কিছুটা নেমে যেতেই আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রবার্ট কোমর থেকে টর্চ পের্ করে, আরেকহাতে রিভলভারটা নিলো। কাঠের সিঁড়ি। পা দিতেই মশমশিয়ে উঠলো। কাঠের ওপর ধুলো আর শ্যাওলার পরত। অনিশ্চিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে নিচে নামতেই চোখ ঝলসে গেলো রবার্টের।
হ্যাঁ, হ্যাঁ -- স্বর্নভাণ্ডার। সোনার মুকুট, কানের ভারী ভারী পাশা, হাতের ভারী বাউটি, ভারী ভারী আর্মলেট, গলার চেন, কোমরবন্ধ, সোনার জুতো-জোড়া, সোনার বাটে রাখা তরোয়াল, মণিমুক্তো চড়ানো নানান সাইজ আর শেপের আংটি, থালার ওপর শোয়ানো সোনার বিগ্রহ, সোনার তাবিজ, অগুনতি সোনার কয়েন, সোনার থালায় সাজানো ভারী ভারী চেন, পায়ের নুপুর -- রবার্টের কপাল ঘামছে। সোনা? এতো সোনা? এ তো মনে হচ্ছে সারা ভারতের যত রাজা ছিল সবার ভান্ডার লুট করে এখানে রাখা হয়েছে।
রবার্ট ঢোক গিলে কোনোরকমে বাইরে বেরিয়ে এলো। ওরে বাপ রে -- না, না আর সময় নষ্ট না করে একবার ফোন করি, তাহলে? বড় সাহেবকে তো জানানো উচিত, তাই না?
চট করে ফোন বের করে ফোন লাগাতেই রবার্ট টের পেলো সিগন্যাল নেই। না, না একটু আগেও তো একটা SMS এলো না? রবার্ট ফোন চেক করলো। হ্যাঁ, এসেছিলো ঠিকই। কিন্তু এখন একদমই টাওয়ার নেই। ধ্যাৎ, ধ্যাৎ....damn it -- এখনই সাহেবকে ফোন করাটা খুব জুরুরি। রবার্টের মনে পড়লো, নিচে -- ওই নীলচে ভাঙা বিগ্রহের কাছে একবার ও ইন্সটাগ্রামে ফটো আপলোড করেছিল। মোটামুটি ওখানে সিগন্যাল ভালোই ছিল। নিচে নামবে কি ও?
না, না -- সময় নেই। এই স্বর্ণভাণ্ডার ফেলে যাওয়াটা মোটেই ঠিক হবে না। রবার্ট তাকিয়ে দেখলো হঠাৎ সূর্য ডুবে গেছে। ফোনটা হাতে ধরে হোয়াটস্যাপে কোঅর্ডিনেটস পাঠালো রবার্ট বড় সাহেবকে, সাথে পুরো অভিজ্ঞতাটা একটা ভিডিও মেসেজ করে রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলো। যখন হোক এটা পৌঁছলেই হলো। এসব দেশে টাওয়ারের-টেলিকমুনিকেশনের প্রচুর প্রবলেম। হয়ত একটু পরে টাওয়ার চলেও আসবে।
সময় নষ্ট না করে, নিচে গিয়ে থালার ওপর সাজানো বড় বড় তিনটি ভারী মূর্তি ওঠালো রবার্ট। ব্যাগে পুড়লো ওগুলোকে। বড় সাহেবকে সব কিছুর হিসেব দিতে কে বলেছে? আমার টাকা চাই -- বড় সাহেবের ওই দু পয়সার প্রফিট দিয়ে আমার পেট ভরবে না। নিজের মনে হিসেবে করে, মুঠো মুঠো সোনার কয়েন ব্যাগে পুড়লো রবার্ট, বেশ কিছু চেন আর আর্মলেট ও নিলো। না, না -- ব্যাগটা বেশ ভারিই হয়ে গেছে। আগে এটাকে লুকাই। বাইরে বেরিয়ে এসে, খাঁদের ধারে দাঁড়িয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেললো ব্যাগটাকে। বেশ কিছুদূর গড়িয়ে গড়িয়ে একটা ঝোপে গিয়ে আটকে গেলো ব্যাগটা। পরে সময় সুযোগ বুঝে ওটাকে সরিয়ে নেওয়া যাবে। ফোন বের করে দেখলো -- হ্যাঁ, ও ঠিকই ধরেছিলো। মেসেজটা বড় সাহেবের কাছে পৌঁছে গেছে, নীল টিক দেখাচ্ছে। তার মানে লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে রওয়ানা দিয়েছে -- বলেছিলো শহরের কাছে পিঠেই থাকবো।
রবার্ট সব হিসেব করে উঠে দাঁড়াতেই জিনিষটা টের পেলো।
হ্যাচডোরটা বন্ধ হয়ে গেছে কখন জানি। সেই ভাঙা মর্চে পড়া হুড়কোটা আবার যে-কে-সেই লেগে গেছে দরজার ওপরে। আর শুধু তাই না, মন্দিরের মাথার ওপর একটা গোল আলো। সোনালী রঙের আলো।
যেন সূর্যটা ডোবার পর, কি মনে করে আবার উঠে এসেছে।
কি...কিসের আলো ওটা?
রবার্ট কিছু বোঝার আগেই, ব্যাপারটা ঘটলো। সাই-সাই করে আওয়াজে কি যেন শব্দে গোলাকারের চাকতির মতন কি একটা জিনিস সোজা ওর বুকে গিঁথে গেলো।
প্রচন্ড ব্যাথায় পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই, টের পেলো আরও ওরকম ধরনের জিনিস সোজা উড়ে উড়ে ওর দিকে আসছে আর ছোবল মারছে ওর সারা দেহে। রিভলবারটি বের করে গুলি চালালো। কাকে মারছে? কটাকে থামাবে গুলি চালিয়ে। ওর দিকে শত শত গোলাকার ওরকম চাকতি উড়ে এসে সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত করে দিলো, ব্যাথার চোটে খাঁদের দিকে যেতে যেতে, পা ফসকে সোজা নিজে পড়লো।
কিছু বোঝার আগেই মাথার পিছনে চোট -- খুলির ছাত ফেটে থকথকে ঘি বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।
বেশিক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি।
বেশ কিছুক্ষণ চাকতিগুলি ওর গায়ে লেগে থাকার পর, গায়েব হয়ে গেলো। মন্দিরের মাথার ওপর গোলাকার আলোকচক্রিকা ও অদৃশ্য। আবার পাখিরা ডাকা শুরু করেছে, ঘরে ফিরতে ফিরতে। মোহময় সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা নিয়ে আবার একবার প্রকৃতি শান্ত ভয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণ রবার্টের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকার পর, একটা খসখসানি শব্দ হলো।
কে যেন ভারী ভারী পায়ে এদিকেই আসছে।
হ্যাঁ, সেই জিব কাটা লোকটা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে খাঁদের এপারে এসে, উঁকি মেরে দেখে একবার চুক চুক শব্দ করলো।
জিব দিয়ে।
তারপর হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে, রবার্টের ফেলে দেওয়া ব্যাগটা উদ্ধার করলো ও। ওটাকে নিয়ে ওপরে এসে, হাঁফাতে হাঁফাতে হ্যাচডোর খুলে ভেতরে ঢুকলো ও। যা, যা যেখান থেকে সরানো হয়েছিল, সবকিছু আবার যথাস্থানে রেখে উঠে এসে দরজাটা হুড়কো দিয়ে বন্ধ করলো ও।
তারপর মন্দিরের উদ্দেশে জোর হাত করে প্রণাম করলো -- "ব্রহ্মাত্বে সৃজাতায়ে বিশ্বম স্থিতৌ পালায়াতে নামাহ, রুদ্ররূপাম কল্পান্তে নামস্তুভূয়াম ত্রিমূর্তায়ে..."
ওর কাটা জিবের জায়গায় একটা নতুন জীব এসে লেগে গেছে, কখন জানি।
২.ছোট্ট স্টেজ, লোকে লোকারণ্য। অডিটোরিয়ামটায় যত না লোক ধরে, তার থেকে অনেক বেশিই লোক এসে ঢুকেছে। হাজার মুখে হাঁ করা বাকরুদ্ধতা। স্টেজের ওপর দাঁড়ানো ভদ্রলোক যা বলছেন, তা শোনার জন্য। আধা ইতিহাস, বাকিটা তত্ব আর পাওয়া মিসিং লিংকের হাতে বোনা এ যেন এক রূপকথার এক উলের সোয়েটার। শুনে বিশ্বাস ও হয়না।
অথচ বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় ও নেই।
প্রফেসার স্যাম লরেন্স। হাভার্ডের আর্কিওলজিস্ট, হিস্ট্রিয়ান, সিম্বোলজিস্ট। এবং বিশ্বখ্যাত থিওলজিস্ট। বোধকরি শেষোক্ত ডিগ্রিটির জন্যই তাঁর ভারতে আসা। ভারতের প্রাচীন দেব দেবী নিয়ে তাঁর প্রচুর লেখালেখি। ভদ্রলোক মার্কিনি হয়েও সনাতনী স্রোতের দেব, দেবী, আচার, বিচার সম্বন্ধে এতো কি করে জানলেন -- তা সত্যিই ভেবে তাজ্জব হতে হয়। শেষমেশ ভারতের গর্ভনমেন্টের নিমন্ত্রণটি আর ফেলতে পারলেন না। দেবতাদের নিয়ে রিসার্চ করেছেন এতো বছর পর আজ সত্যিই তাঁর দেবভূমি আসার স্বপ্ন সত্যি হলো।
শেষে একবার এসেছিলেন ঠিকই....কিন্তু যে কাজের জন্য এসেছিলেন, সেটা পুরো করতে পারেন নি।
উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূর, শোনপ্রয়াগের কাছে, বাসুকি নদীর ধারে, এক ক্যাম্পিং সাইটে, উইকেন্ড জুড়ে বিশাল এক সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। প্রফেসার স্যাম আজ শুধু বলবেনই না, উত্তর ও দেবেন, তাঁর পাঠক, অ্যাডমায়ারারদের।
"মানব ইতিহাসে, হঠাৎ সোনা যে কি করে এতো দামি এক অর্নামেন্টের উপাদান হয়ে উঠলো -- এ প্রশ্নটা আজ ও খুব গোলমেলে, জানেন?" স্যাম লরেন্স তাঁর সেমিনারের একদম শেষ পংক্তিতে এসে দাঁড়িয়েছেন, অনেকক্ষণ কথা বলে খুব ক্লান্ত -- "ভালো লাগার মতন আরও অনেক কিছু ফ্যান্সি উপাদান মৌল ছিল: রুপো, লোহা, পারদ...কত কি। হঠাৎ সব ছেড়ে সোনা কেন?"
দর্শকজন সবাই চুপচাপ। প্রফেসারের মুখে এক কৌতুকময় হাসি।
"একটা ছোট্ট গল্প বলি। সুমেরিয়ানদের কথানুযায়ী নাকি আকাশ দেবতা অনুন্নাকিরা এখানে এসে বসবাস করা শুরু করে। ওদের গ্রহ নিবিরুতে নাকি প্রবল পরিমাণে আবহমন্ডলী নষ্ট হয়ে গেছে, তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে, বাধ্য হয়ে নাকি ওরা পৃথিবীতে এসেছিলো -- গোল্ডমাইনিং করার জন্য। সোনা নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেন? সোনা দিয়ে কি হবে? উত্তরটা খুব সোজা করে বলতে গেলে, সোনার স্বাভাবিক এক ক্ষমতা আছে, অ্যান্টি-রেডিয়েশনের। সম্ভবতঃ, সেই কারণেই এরা পৃথিবীতে এসেছিলো। সাথে ছিল ওখান থেকেই আনা ভৃত্যবর্গ -- এগিগি, যারা অনুন্নাকিদের মাইনিংয়ের কাজে সাহায্য করছিলো। অনুন্নাকি দেবতা এনকির নামেই আজকের ইরাকের নামটি এসেছে -- সম্ভবতঃ, ওখানেই ছিল ওদের রাজধানী। বেশ কিছু সময় এরা এখানে থাকার পর, একটা বড় গন্ডগোল হয়। 'নেপিহিলিম' বলে এক ভারী রহস্যময় প্রাণীর পাপে নাকি ধরিত্রী ভরে যায়। অনুন্নাকিরা বাধ্য হয়ে পৃথিবী ডোবানোর কথা ভাবেন। পৃথিবী ছাড়ার আগে, বলে যান রাজা 'জায়াসুদরা'কে -- প্রতি প্রাণীর বীজকে জোড়ায় জোড়ায় উঠিয়ে তাঁর নৌকায় রাখতে। জলমগ্ন পৃথিবীতে থেকে আবার যখন ডাঙ্গা দেখা যাবে, তখন আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করা যাবে।"
"গ্রেট ফ্লাড"। "ডিলিউজ"। "বিবস্বান মনু"। "নোহা।" "মহা প্লাবন।" "মৎস অবতার।"
সারা ঘর থেকে অনেকেই বলে উঠলো।
"কাহিনীটা নানান জায়গায় নানান নাম থাকলেও, বস্তুতঃ একই", স্যাম হাসলেন -- "যেন মনে হয়, ঘটনাটি সত্যিই হয়েছিল। যে যার মতন করে সাজিয়ে নিয়ে বলেছে। এমনকি ইজিপ্টের ফ্যারাওদের ব্লাডলাইনে পর্যন্ত এই মহা প্লাবনের কথা পরিষ্কার উল্লেখ করা আছে। মেডিটেরিনিয়ান আর ব্ল্যাক সির মাটিতেও পাওয়া যায় কোনো এক সময় ঘটা মারাত্মক কোনো প্লাবনের ইঙ্গিত। যাক গে, অনুন্নাকিরা চলে যাওয়ার পর, পৃথিবীর মানুষরা আশা করেছিল ওদের প্রিয় দেবতারা ফিরে আসবে। তাইই নানান মন্দিরে মন্দিরে সোনা রাখা শুরু হয়, ইজিপ্টে ফারাওরা নিজেদের ভগবান মনে করতেন -- তাই তাঁদের মাস্তাবা বা 'burial chamber'- এ পাওয়া যায় বিশাল স্বর্ণ ভান্ডার। আজটেক সভ্যতা লুন্ঠন করে করে, স্প্যানিশ দস্যুরা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল -- তাও মেক্সিকো, পেরু বা হন্ডুরাসের সেই প্রাচীন দেবভূমির স্বর্ণভাণ্ডার যেন কিছুতেই নিঃশেষিত হচ্ছে না। অথচ দেখা গেছে, এতো সোনা এদের মাটির থেকে পাওয়া গেলেও, নিজেরা কিন্তু সেই সোনা পরতো না, ব্যবহার করতো না -- পুরোটাই দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। জিজ্ঞেস করায়, আজটেকের লোকেরা বললো, স্বর্ণ খননের সেই বিদ্যা টোলটেকরা শিখিয়েছিল ওদের। টোলটেকদের জিজ্ঞেস করায় বললো ওদের নাকি দেবতারাই শিখিয়েছিলেন -- এবং তাই যা কিছু সোনার, তা সবই দেবতাদের, মানুষের না।"
সবাই হাঁ করে চেয়ে আছে প্রফেসারের দিকে। সুপুরুষ স্যাম, তাঁর চশমা ঠিক করতে করতে বললেন -- "সেই ট্র্যাডিশনটা আজ ও রয়ে গেছে, ভেবে দেখেছেন? আজ ও কিন্তু সোনা হলো এক দৈবিক উপাদান। ধনতেরাসের সময় সোনা কেনার প্রচলন, বিয়ে বা বাচ্ছার মুখে ভাতে বা 'মুখ দেখতে' হলে সোনা দিয়ে মুখ দেখার রীতি, এমনকি ভূমি পূজা করার সময় সোনা ছোঁয়াতে হয় মাটিকে, শ্রাদ্ধের সময় বৈতরণীর পাড়ে গতি করানোর জন্য মৃতের উদ্দেশেও সোনা উৎসর্গ করাও এক রীতি -- যা কিছু শুভ, সবসময় সোনাই জড়িত থাকে। কেন? কারণটা বুঝতে পেরেছেন? সোনা ব্যবহার করার চল মানুষের কোনোদিনই ছিল না -- ব্যাপারটা ইনহেরিটেড, কাউকে দেখে শিখেছি।"
আরো কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তর চলার পর, ডায়াস থেকে নামতেই শেখর এগিয়ে এলো। শেখর এখানকারেরই ছেলে, স্যামের সাথে ফেসবুকে আলাপ।
কিন্তু বেশ বিস্বস্ত। স্যাম তার প্রচুর প্রমাণ পেয়েছেন।
কিছু বলার আগেই, শেখর বলে উঠলো -- "রবার্ট একটা মেসেজ করেছে, কিছুক্ষণ আগে।"
চশমাটা খুললেন প্রফেসার স্যাম -- "কি মেসেজ?"
"একটা লোকেশন পাঠিয়েছে, হোয়াটস্যাপে। আর সাথে একটা ভিডিও", শেখর প্রফেসারকে ফোনটা এগিয়ে দিতেই, প্রফেসার হাত তুলে ওকে থামালেন -- "না, না, এখানে না -- চলো ওয়াশরুমে গিয়ে দেখা যাক ভিডিওটা...."
প্রফেসারের সাথে আরো জনা কয়েক শ্রোতা বন্ধু হাত মেলানোর পরই, ঘরটা একটু হালকা হতেই, শেখরকে নিয়ে স্যাম ঢুকলেন ওয়াশরুমে। না, এখানে কেউ নেই -- ওয়াশরুম পুরোই খালি। শান্তিতে ভিডিওটা চালানো যাবে।
শেখর ঝুঁকে পড়ে ভিডিওটা চালাতেই, চমকে উঠলো প্রফেসার আর শেখর দুজনেই।
এ...এ কি দেখছে ওরা?
এ...এই তো সোনপ্রয়াগের বিষ্ণুর সেই হারানো মন্দির, এই তো সেই নীল পাহাড়, এই তো সেই স্বর্ণ ভান্ডার। এত্ত বছর ধরে এটা খুঁজছি -- এটা এতো কাছেই ছিল, আর সেটা কিছুই বুঝতে পারিনি?
সারা শরীরে অ্যাড্রেনালিনের এক স্রোত খেলে গেলো স্যামের -- "আমি জানতাম, এবারে খুঁজে পাবোই। আমার ভারতে আসা বিফলে যাবে না।" স্যামের মনে একরাশ খুশির বুদ্বুদ ফুটে উঠলো।
উফফ, কত দেনা হয়ে আছে। কি সমস্যাই না চলছে ওর....ক্রেডিট কার্ড, পার্সোনাল লোন, ল্যাম্বোরগিনিটা বেকার কিনে ফেঁসেছে -- গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না। তারপর আছে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা: মিশেল। বারো মাস ওর নানান বায়না। গয়না আর গাড়ির প্রতি বাচ্ছাদের মতন ওর ইন্টারেস্ট। রোজই পারলে একটা নতুন গাড়ি কিনে দিতে হবে। কি যে হবে, কোথার থেকে যে এতো টাকা আসবে, ভেবে ভেবে তো রাতে ঘুমই আসে না, স্যামের।
ওই বই লিখে আর কলেজে পড়িয়ে কত টাকাই বা হাতে আসে?
যদি বিষ্ণু মন্দিরের এই ভাণ্ডারটি সত্যিই পাওয়া যায় -- একসাথে কত কিছুর সমাধান হয়ে যাবে, ভাবা যায়? প্রথমেই ওই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোককে ওই সোনার মূর্তিগুলো বেঁচবো -- লোকটা তো উখিয়েই আছে কেনার জন্য। তারপর সোনার চেইনগুলো দিল্লিতে নিয়ে এসে ঠিকঠাক খদ্দের পাওয়াটা কি খুব কঠিন হবে? এছাড়াও শেখরও আছে -- বেচাকেনায় সাহায্য করবে। সবমিলিয়ে মেগা প্রফিট।
স্যাম টের পেলো, এক সুউজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
শেখর বললো -- "একবার রবার্টকে ফোন করবো?"
উফফ, এটা তো ভুলেই গেছিলো স্যাম। রবার্টকে ফোন করতে হবে। এ...এমনটাই তো কথা হয়েছিলো, না? রবার্ট জায়গাটা খুঁজে পেয়ে ওদের জানালেই, স্যাম বা শেখর ওকে রিংব্যাক করবে।
প্রচন্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ফোন লাগালো স্যাম। দু-তিনবার পুক পুক করে আওয়াজ করার পরই, ফোনটা বাজতে শুরু করলো।
ঠিক পরের মুহূর্তেই ওরা দুজনেই টের পেলো, ফোনটা কাছেপিঠেই কোথাও থেকে বাজছে।
খুব কাছে।
চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাতেই, দুজনেই টের পেলো, ফোনটা ভেতরের টয়লেট রুমের থেকে বাজছে।
দরজাটা বন্ধ করা আছে।
দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো, দরজার কাছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ল্যাট্রিনটার দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেলো ওটা।
হ্যাঁ....ফোনটা পড়ে আছে, বন্ধ করা কমোডের সিটের ওপর।
আর তার পাশে....একটা টিনের বাক্সে রাখা আছে একটা ছয় ইঞ্চি লম্বা কাটা জিব।
Human Tongue....
৩.সমস্যাটা হলো, ইংরেজিতে 'দেবতা' আর 'ঈশ্বর' শব্দটির কোনো তফাৎ নেই, দুটোরই অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'God'।
আসলে, দুটোর মানে কিন্তু আলাদা, দেবতা বললে ঈশ্বর মোটেই বোঝায় না। ঈশ্বর ও দেবতা -- সম্পূর্ণ দুটি আলাদা কনসেপ্ট, ধারণা। সাধারণ কথায়, দুটোর মানে এক হলেও, আসলে একদমই এক নয়।
সনাতন ধর্মের সাথে তদানীংতন বাকি সব সভ্যতার একটা আশ্চর্য তফাৎ ছিল।
বাকি সব সভ্যতাগুলিতে বারবার এই দেবতাদের নিয়েই চর্চা করা হয়েছে।
প্রাচীন মিশরে সব মিলিয়ে ১৪০০ দেব-দেবীর পুজো হতো। সুমেরীয় সভ্যতায় সংখ্যাটি আরও বেশি: ৩৬০০। গ্রিকরা অবিশ্যি ১২ জন দেব-দেবীরই পুজো করতো। মায়ান সভ্যতায় সংখ্যাটি কম বেশি: ২৫০।
আদিম বেদে তেত্রিশ কোটি দেবতার উল্লেখ আছে। এ ক্ষেত্রে 'কোটি' কথাটির অর্থ হলো 'ধরণ', অর্থাৎ তেত্রিশ ধরণের দেবতার উল্লেখ আছে। যদিও নানান পুরাণ ঘাঁটলে দেখা যাবে সংখ্যাটি কয়েকশোরও বেশি।
এইখানেই সমস্যাটা।
সনাতন ধর্মে শুধু দেবতাদেরই স্তুতি গাওয়া নেই, আরেকটি ভারী রহস্যময় অস্তিত্বের কথা বারবার বলা হয়েছে।
ব্রহ্ম। ঈশ্বর। ভগবান। যাঁর ব্যাখ্যা-বর্ণনা কোনোভাবেই কেউই কোথাও দিতে পারেন নি। যুগপুরুষ রামকৃষ্ণদেব তাই ব্রহ্মর সম্বন্ধে বলেছেন: সবই 'এঁটো' (জিব দিয়ে, মুখ দিয়ে যার বর্ণনা দেওয়া যায়), এক ব্রহ্মই শুধু এঁটো নন।
আশ্চর্যের কথা হলো এই, অন্য কোনো তদানিংতন সভ্যতায় এই ব্রহ্মের কথা বলাই নেই। ব্যাপারটা নিয়ে অতো অবধি কেউ ভাবেইনি। বাকিরা দেবতা অবধিই খুশি ছিল।
কিন্তু বৈদিক ঋষিরা কেন জানি না বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু দেবতা দিয়েই হবে না। প্রকৃতির নাড়ি-নক্ষত্র বুঝতে গেলে, আরও গভীরে যেতে হবে....
অনেক গভীরে...
পরবর্তীকালে, অ্যাব্রাহামিক ধর্মে বর্ণিত যে নিরাকার, নির্গুণ ঈশ্বরের প্রসঙ্গ বারবার আসে, তিনি আর কেউ নন....এই পরাৎপর ব্রহ্মই।
******************************************
আচ্ছা, রাবণকে মারতে নাকি সুদর্শন চক্রও চালানো হয়েছিল? ব্রহ্মার বরে সেটি নাকি কিছু করতে পারেনি?
এরকম কেন? সুদর্শণ চক্র তো শ্রী বিষ্ণুর অস্ত্র। সেটি রাবণকে মারতে পারলো না -- অথচ, শ্রী রামচন্দ্র, যিনি বিষ্ণুর অবতার, তাঁর হাতে রাবণ বধ হলো? এমন স্ববিরোধী কথার মানে?
এর দুটি কারণ আছে।
এক হলো -- ব্রহ্মা বলেছিলেন রাবণের মৃত্যু কোনো দেব-যক্ষ-দক্ষ-তক্ষ-রাক্ষস-পিশাচ-গন্ধর্ব কারোর হাতে হবে না। রাবণ যদি মরে, তাহলে মানবের হাতেই মরবে। তাই দেব-প্রেরিত সুদর্শণ চক্রে তাঁর মৃত্যু হয়নি -- পরে শ্রীরামের হাতে হলো।
আরেকটি কারণ ও হতে পারে।
সেটি ভারী অদ্ভুত এক ব্যাখ্যা।
বিষ্ণু তো স্বয়ম ব্রহ্ম। তিনি তো দেবদেব...অর্থাৎ দেবতাদেরও দেবতা। তাঁর এক ইচ্ছেতে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়, আবার এক ইচ্ছেতে নষ্ট হয়। তাঁর সুদর্শণ চক্রে আদি আদিরাক্ষস মধু আর কৈটভকে নাশ হয়ে গেলো আর রাবণের মতন এক কীটাণুকীট মরলো না?
এর কারণ আর কিছুই না....সুদর্শণ চক্র বিষ্ণুর হলেও, সেটা নাকি তিনি চালান নি, চালিয়েছিল দেবতারা। তাই জিনিসটি কাজ করেনি।
যে আর্কিটেক্ট সফটওয়্যারটি লিখেছেন, তিনি যদি প্রোগ্রামটি এক্সেকিউট না করেন, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ এসে চালালে, সেটি চলবে থোড়াই?
******************************************
পাহাড়টার নিচে দাঁড়িয়ে স্যাম কপালের ঘাম মুছলো।
কমোডের নামানো সিটটার ওপর রবার্টের ফোন আর পাশে ওই টিনের বাক্সে ভরা ওই জিব। ঘেন্নায় এখনো গা টা গুলোচ্ছে স্যামের। মানে কি এসবের? একটু আগে পাহাড়ের ওপর থেকে লোকেশন পাঠিয়েছে, ভিডিও পাঠিয়েছে। তারপর ফোনটা কমোডের সিটের ওপর বসিয়ে রেখে কোথায় চলে গেলো?
আর পাশে...ওই নোংরা জিবটা....স্যাম বিরক্ত হয়ে পাহাড়চূড়ার দিকে দেখলো। পাহাড়টির পাদদেশে অন্ধকার নেমে এলেও, এখনো ওপরের চূড়ার দিকে রোদ ঝলমল করছে।
রবার্ট। রবার্টকে স্যাম প্রায় তিন বছর ধরেই চেনে। এর আগে নানান কাজে সাহায্যে করেছে। একটু জালি ঠিকই, কিন্তু ওকে দিয়ে অনেক কাজই হয়। স্যাম আসলে অনেকদিন ধরেই জানতো এই মন্দিরটির কথা, পাহাড়চূড়ার ওই মন্দিরটির কথা। শুধু কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছিলো না, ওটির ঠিকানাখানা। রবার্টকে দিয়ে সে কাজটাও হয়ে গেলো।
তা...তাহলে ব্যাটা গেলো কোথায়?
সোনাদানা সব লুটে, পালিয়ে গেলো নাকি?
আবার একবার ভয়ানক রাগ হলো রবার্টের ওপর। জানতাম। ও একটা চোর -- অনেকদিন ধরেই আঁচ করছিলাম। আজ একদম হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম।
"সাহেব, একবার ওপরে গিয়ে দেখবেন নাকি?", শেখর জিজ্ঞেস করলো।
ওপরে? ওপরে গিয়ে তো দেখবো কিছুই পড়ে নেই....ব্যাটা সব মেরে দিয়ে কেটে পড়েছে। কি লাভ হবে ওপরে গিয়ে? স্যাম মুখে কিছু না বললেও, খুব উদাস ভাবে উত্তর দিলো -- "ঠিক আছে। তুমি একবার দেখে এসো। আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি দেখে এলে, না হয় যাবো ওপরে।"
"স্যাম, বোধহয় আপনি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন", বেশ বিরক্ত হয়েই শেখর বললো -- "ওপরে সোনার ভান্ডার থাক বা না থাক, ওপরে বিষ্ণুর এই মন্দিরটির আবিষ্কার মানেই তো অনেক বড় ব্যাপার। আজ আপনার হাত ধরে এই হারিয়ে যাওয়া মন্দিরটি আবার খুঁজে পাওয়া যাবে। এটিই বা কি কম কথা?"
"Cut the crap", হাত তুলে থামালো ওকে স্যাম -- "আমার এইসব মন্দির-দেবালয়, তোমাদের বেদ-উপনিষদের ভড়ংবাজির প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। আমি ভারতে এসেছিলাম শুধু ওই ধনদৌলত হাতাতে। এছাড়া তোমাদের দেশের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই আমার।"
প্রচন্ড রাগে শেখরের মনে হলো ও ফেটে পড়বে। লোকটা যে এমন দ্বিচারী জানোয়ার জানাই ছিল না। পুরোটাই অভিনয় তাহলে? ভারতকে নিয়ে এতো বড় বড় কথা, ভারতের ইতিহাসকে নিয়ে এতো লেকচার দেওয়া -- পুরোটাই eyewash তাহলে?
"আমি এখানেই রইলাম", স্যাম সিগার ধরালো -- "তুমি দেখে এসে আমায় জানালে, তবে আমি ওপরে যাবো।"
কিছুক্ষণ প্রচন্ড রাগে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে পাহাড়ের জঙ্গলটার দিকে পা বাড়ালো শেখর।
মনের মেঘের তোলপাড় করে একটা ঝড় বইছে ওর।
হ্যাঁ, ওই স্বর্নভাণ্ডার যদি আমি ওপরে গিয়ে সত্যিই হাতে পাই, তোমার হাতে আমি আর ওটাকে পড়তে দেবো? সবটা নিয়ে আমিই পালাবো। তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগার টেনো, কেমন?
******************************************
মাটির থেকে প্রায় পাঁচশো ফিট ওপরে ওঠার পরই সেই মন্দিরটা পড়লো, একটা পাথরের নল থেকে ঠান্ডা জল বেরোচ্ছে। একজন বুড়ো পূজারী ঝুঁকে পড়ে জল খাচ্ছেন।
মন্দিরের ভিতরে একটা ভাঙা নীল রঙা, চতুর্ভুজ মূর্তি। পায়ের কাছে কিছু ফুল ছড়ানো।
শেখর এসে দাঁড়াতেই, হেসে তাকালেন। যেন ও আসতো, সেটা জানতেন।
"এখান দিয়ে একজন একটু আগে ওপরে গেছে? আপনি দেখেছেন?", শেখর জিজ্ঞেস করলো, মূর্তিটা দেখতে দেখতে। কিসের মূর্তি এটা?
"সেই ফরেনার ভদ্রলোক কি?", লোকটা উত্তর দিলো। গলাটা কেমন যেন ফ্যাঁসফ্যাঁসে।
"হ্যাঁ। ককেসিয়ান।"
লোকটা আবার হাসলো, মাথা নাড়তে নাড়তে।
"কি হলো? দেখেছেন কি ওকে?", শেখর আবার জিজ্ঞেস করলো।
লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে, হাসতে হাসতে, পাহাড়টার খাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক লাফ মারলো ওপর থেকে।
শেখর শিউরে উঠে দৌড়ে কাছে এগিয়ে গেলো।
অনেক নিচে খিলখিলিয়ে মন্দাকিনী দৌড়ে চলেছে। দূর পাহাড়ের চৌহদ্দি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীলকন্ঠ। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।
শেখর টের পেলো ও কাঁপছে। অনেক নিচে, ঘাড় গুঁজে মাথা থেঁতলে, পাথরের ওপর পড়ে আছে লোকটা।
******************************************
সময় নষ্ট না করে ওপরে উঠতে থাকলো শেখর।
শালা, বুড়োটা পাগল নাকি? হয়তো আত্মহত্যার প্ল্যানেই ছিল -- আর ঠিক সেই সময়েই শেখর ওখানে এসে পড়েছে। ভয়ানক কাকতালীয় একটা সংস্রব ছাড়া কিছুই না। ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো শেখর।
লোকটাকে এখন যদি নিচে নেমে বাঁচাতে যায়, ফালতু ফাঁসতে হবে। পুলিশি চক্কর, হাসপাতাল, আরও কত কি....
দূর দূর, তার চেয়ে বরং নিজের কাজটা আগে করি।
খুব জোরে দৌড়ে আরও শ' তিনেক ফিট ওপরে ওঠার পরই, একটা জিনিস টের পেলো ও।
পাহাড়টার ঠিক ওপরে এসে ওর ঘড়ির ডায়ালে লাগানো কম্পাসের কাঁটাটা বীভৎস জোরে ঘুরে চলেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো ও। কি হয়েছে ঘড়িটায়? কম্পাসটা খারাপ হয়ে গেছে কি? নাকি ঘড়িটাই খারাপ হয়ে গেছে?
কিছু বোঝার আগেই, আরেকটা জিনিস ঘটলো।
ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটাটা টিকটিক করে পিছন দিকে যাচ্ছে, এক পা-এক পা করে।
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না শেখর। এ...একই ঘড়িটাই কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? ভালো করে আবার দেখলো ও। হ্যাঁ -- ঘড়িটা উল্টো দিকে চলছে। সময় পেছোচ্ছে একটু একটু করে, ওর ঘড়িতে।
না, না....কি দেখছি আমি? মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে কি? একটা খসখস করে আওয়াজ হচ্ছে কোথাও থেকে। পিছন দিকে শেখর তাকাতেই দেখতে পেলো একটা অদ্ভুত জিনিস। টলতে টলতে একটু একটু করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, সেই বুড়ো পুরোহিতটা, মুখে সেই হাসিটা। মাথাটা ফেটেছে, টসটস করে রক্ত পড়ছে, ভিজে গেছে সাদা ফতুয়াটা, গলায় একটা গোঙানির আওয়াজ।
আর হ্যাঁ, হাতে ধরা একটা টিনের বাক্সে সেই কাটা জিবটা।
কিছু বোঝার আগেই আরেকটা জিনিস হলো, খুব তাড়াতাড়ি।
আকাশে মেঘ জমে হঠাৎ ঘিরে ধরলো উঁচু পাহাড়টাকে, মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেলো ডুবন্ত সূর্যটা। মেঘটা যেন এই পাহাড়টাকে ঘিরেই জমেছে।
আকাশের দিকে বেওকুফের মতন তাকাতেই সোঁ-সোঁ করে একটা আওয়াজ। সোনালী রঙের একটা চাকতি এসে সোজা ওর বুকে।
ভয়ঙ্কর ব্যাথায় পাহাড়ের পাথুরে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে আকাশের দিকে তাকাতেই টের পেলো ওরকম হাজার হাজার চাকতি তীর বেগে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, গিঁথছে সারা শরীরে। চরম ব্যাথাতে চিৎকার করতে করতে শেখর দেখলো, বুড়োটার আরেক হাতে একটা খড়্গ। হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে আরেক হাতে জিবটা নিয়ে।
শেখর নড়তে না পেরে, শেষবারের মতন চেঁচিয়ে উঠলো -- "নাআআআআআআআআআ......"
বুড়ো পুরোহিত সস্নেহে এগিয়ে এসে মৃতপ্রায় শেখরের গলায় এক চালালো এক কোপ --
"অভেদ নয়নে দ্যাখ রে মন....যে কালি, সেইই হরি...."
******************************************
ধপ করে একটা আওয়াজে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকালো স্যাম। পাহাড়টার ওপর থেকে, পাশের ঝোপটায় কিছু একটা পড়লো না?
সিগার-টা ফেলে এগিয়ে আসতেই দেখতে পেলো জিনিষটা।
শেখরের কাটা মাথা। গলার কন্ঠীর ওপর দিয়ে সযত্নে কাটা। মুখটা অসহ্য যন্ত্রণায় ফাঁক করা, বন্ধ করার সুযোগও পায়নি বেচারি, টপটপ করে তখনও রক্ত বেরিয়ে চলেছে। যেন শেষ মুহূর্তেও বেঁচে থাকার এক প্রয়াস চালাচ্ছে প্রাণটা।
তবে হ্যাঁ, আরেকটা কথা।
মাথার ওপরে একটা ভারী রাজ মুকুট পড়ানো। চকচক করছে -- pure gold……..
কে যেন মাথাটা কেটে, একটা রাজ মুকুট পরিয়ে, ওপর থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে। ভাবটা এমন, এমনি এমনি কাটা মাথাটা ফেলতে খারাপ লাগে -- তাই একটু সাজিয়েগুজিয়ে দিয়ে ফেলা আর কি.....
৪.
বিশ্ব চরার মাঝে করেছো যে সৃষ্টি
দিয়েছো নয়ন মোরে,
দাওনি তো দৃষ্টি....
Theism.
ঈশ্বর আছে মনে করলে, তার পক্ষে যত না প্রমাণ পাওয়া যায়, তার প্রত্যুত্তরে ঈশ্বর বলে কিছুই নেই, তার প্রমাণ অনেক বেশি মেলে।
যেমন ধরুন, ১৩.৭ বিলিয়ন বছর পুরোনো, অন্তত ১ সেপ্টিলিয়ান (১ এর পিঠে ২৪টি শুন্য বসালে, যে সংখ্যাটি দাঁড়ায়) তারার বসতি, ও সাথে নানান মহাকূটিল কোয়াসার, পাল্সার, ইন্টারগ্যালাটিক নেবিউলা, ধুমকেতু, গ্রহ, উপগ্রহ, ব্ল্যাকহোল, ডার্কম্যাটার, ডার্ক-এনার্জি নিয়ে এক ব্রহ্মান্ড। কে বানালেন? ঈশ্বর? কেন বানালেন? যাতে মানুষে তাঁকে জানতে পারে, বুঝতে পারে, স্তব-স্তুতি করে?
অথচ বিশ্বাস করুন, পৃথিবীর মতন ক্ষুদ্রাদপিক্ষুদ্র এক গ্রহের থাকাতে আর না থাকাতে ব্রহ্মান্ডের কিচ্ছু যায় আসে না।
তাহলে পুরো মানচিত্রে 'ঈশ্বর' এলেন কোথার থেকে?
******************************************
ও হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছিলাম।
ঈশ্বর যদি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করে থাকেন, আহলে ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করলো? ঈশ্বর যদি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করে, তার মধ্যে বসবাস করা শুরু করেন, তাহলে তার আগে কোথায় থাকতেন? ছয় দিন ধরে ঈশ্বর ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করে, সাতদিনের বিশ্রাম নেন -- তখন তো সূর্য বলেই কিছু ছিল না -- দিন আর রাতের হিসেবটা এলো কোথার থেকে তাহলে?
আজ পৃথিবী জুড়ে এতো অশান্তি, এতো কষ্ট, এতো ব্যাথা, এতো অধঃপতন -- কোই? কোথায় ঈশ্বর? ঈশ্বর তো একবারও এসে মানুষকে থামান না, শোধরান না, ভালোবাসান না।
কোথায় তাহলে সে ঈশ্বর?
তাহলে কি মানব সৃষ্টি, ঈশ্বরের ভুল ছিল -- নাকি ঈশ্বর সৃষ্টিই মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল?
******************************************
কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেও জয়কৃষ্ণ আচার্যের ঈশ্বর, ধর্ম, বিশ্বাস, আচার, অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল চরম অবিশ্বাস। বারবার কেন জানি না, মনে হয়, ঈশ্বর বিশ্বাস ব্যাপারটাই কেমন যেন অসম্পূর্ণ, কে যেন কিছু বলতে বলতে মাঝপথে থেমে গেছে। যেন মনে হয় কোনো কিছু প্রতিবাদ না করে চুপ করে সব মেনে নাও -- তাহলে ঈশ্বর আছেন। যেই তুমি যুক্তি আর তর্ক আনবে, তখনই মনে হয়: কোই? কোথায় ঈশ্বর?
ঠিক যেন এক ছন্দহীন 'প্ল্যাসিবো এফেক্ট' : যতক্ষণ বিশ্বাস করছি, ততক্ষণ আছে, বিশ্বাস না করলে নেই। যুগযুগান্ত ধরে মানুষ যেন ধর্মের যাঁতাকলের এক খুঁড়োর কলের পিছনে ছুটে চলেছে, এক অধরা মরীচিকার আশায়।
জয় সারা জীবন এটাই মনে করে এসেছে। কোনো কিছু ভুল বিশ্বাস করার থেকে, কিছু না বিশ্বাস করাটা মনে হয় যেন অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। ছোটবেলায় মা মারা গেলো -- মাকে খুব ভালোবাসতো জয়। মা চলে যাবার পর, ধারণাটা পাকা হলো। বেশ কয়েক বছর খুব কষ্টে কেটেছে, কোনো রকমে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, তারপর ভালো রেসাল্ট নিয়ে ফিজিক্স অনার্স পাস করে কিছুদিন মাস্টার্স পড়বে বলে তোড়জোড় ও করেছিল। এরপর একদিন টুক করে বাবা ও চলে গেলেন। জয়ের তিনকূলে কেউ ছিল না। কেউ কোনো খবর ও নেয় নি বাবার মৃত্যুর পর।
এরপর হঠাৎ একদিন মনে হলো, সব ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে যাই। যার তিনকূলে কেউ নেই, সে তো মুক্ত। খুব ভয়ানক আর খুব কঠোরভাবে মুক্ত।
যে মুক্তি সংসারে থেকে কখনোই পাওয়া যায় না, কে যেন না চাইতেই ওকে দিয়ে দিয়েছে।
******************************************
এরপর সারা ভারত ঘোরা শুরু হলো জয়ের। প্রথমে পূর্ব থেকে রেল পথে দক্ষিণ, তারপর সেখান থেকে আবার পশ্চিম।
আর সব শেষে উত্তর।
ভারত। ভারতবর্ষ। ভরত রাজার ভারতবর্ষ। যে স্থানে এসে ভা (অর্থাৎ ভানু বা সূর্য) আনন্দিত হন (রতি করেন), তাকে ভারত বলে। ভারত জুড়ে আছে কষ্ট, অভাব, দৈন্য, দুঃখ -- খালি নেই আর নেই। কিন্তু কেন জানি না মনে হয়, সব অভাবের মাঝে প্রাচুর্য যেন প্রয়োজনহীন। অভাব থেকে বৈরাগ্য আসে, বৈরাগ্য থেকে কৈবল্য আসে।
কৈবল্যের থেকে মুক্তি।
শোন প্রয়াগ। দূরে দাঁড়ানো শৈল্যরাজ হিমালয় যেন সব ছেড়ে, ফেলে দিয়ে ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন, তার কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। এখানেই দেখা হয় একটা লোকের সাথে। একটা নীল রঙের পাহাড়ের ওপর, এক দুর্গম জঙ্গলে একটা ছোট পুষ্করিণীর পাশে থাকে।
লোকটার নাম 'সোনাই বাবা'।
লোকটা জয়কে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। এবং জয়ের আসল পরিচয় ও জানান।
এবং.....পর্যায়ক্রমে আলাপ ও করান আরেকজনের সাথে।
বিজয়।
******************************************
ঈশ্বর যদি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলো?
সোনাই বাবা উত্তর দিলেন -- "দে-কার্তের (Descartes) কথাটা মনে আছে? I think, so I exist…। আমি চিন্তা করি, তাইই আমি আছি - আর যদি চিন্তা বন্ধ করে দি, তাহলে আমি নেই। এটাকেই ঘুরিয়ে বলা: সবিকল্প আর নির্বিকল্প সমাধি। জানিস বাবা...ব্রহ্মান্ড কোনোদিন ও সৃষ্ট হয়নি। ব্রহ্মান্ড ঈশ্বরের অনেক অনেক manifestation বা প্রকাশিত রূপের মধ্যে একটি। এইরকম আরও অনেক জগৎ আছে, প্রতিটি জগতে ঈশ্বর নানানভাবে প্রকাশ করে চলেছেন নিজেকে। কখনো জাল ফেলছেন, কখনো জাল গোটাচ্ছেন। এরকম করতে করতে, অসীমে গিয়ে মিশেছে: এই পুরো কায়নাত। সেই জন্যই তো দেখ না: বারবার সবকিছুকে দেখানো হচ্ছে ব্রহ্মের মানসপুত্র, মানসকন্যা হিসাবে। সৃষ্টির জন্য কোনো যোনীর দরকার হয়নি: সৃষ্টি স্বয়ম্ভূ, অযোনিসম্ভূত। কারণ সৃষ্টিই হলো স্রষ্টা -- স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই রে বাবা। "
খলখল জলের এক ঝর্ণার মাঝে পদ্মাসনে বসে মিটিমিটি হাসছেন সোনাই বাবা।
"আমি কি দোষ করলাম, বলতে পারেন?", জয় জিজ্ঞেস করলো, মুখে চোখে একগাদা বিতৃষ্ণা নিয়ে -- "আমার মা আর বাবা এতো কম বয়সে আমায় ছেড়ে চলে গেলো। আপনার মনে হয় না, যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকেই থাকেন, তাঁর কি আমার প্রতি এইটুকু দয়া আর মায়াও ছিল না? আমার প্রতি তাঁর এতো নির্দয়তা, অবিচার কেন?"
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন সোনাই বাবা।
আর তারপর -- "যদি বলি তোকে এই মায়ার সংসার থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার জন্যই এই সব করা? তোর জন্য এসব কিছু না, ¸তোর জন্য আরও বড় কিছু যোজনা ছিল, ঈশ্বরের? মা-বাবা-পরিবার-সংসারে থাকলে, কখনোই ঈশ্বরের সেই যোজনা সফল হতো না -- এই জন্যই তোর মা আর বাবা এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তোকে ছেড়ে। তাই তোর এতো দৈন্য, তাই তোর জীবনে এতো কষ্ট -- যাতে তুই বিতৃষ্ণায় সবকিছু ছেড়ে পালাস।"
" আ....আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না..... "
উঠে দাঁড়ালেন সোনাই বাবা -- "সময় এসেছে তোকে তোর আসল পরিচয় দেওয়ার। তোর সাথে আরও কারোর পরিচয় করাই আয়...."
******************************************
"ঘুমিয়ে পড়....ঘুমিয়ে পড়....আমার কথা শোন....যা বলছি শোন....এই মুহূর্তে জগতে আমি ছাড়া, আর আমার এই গলার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নেই", পাথরের মাটিতে শুয়ে পড়তেই দেহটা খুব ভারী মনে হতে লাগলো জয়ের। কোথাও যেন ভাসছি আমি। খুব হালকা, খুব ভালো লাগছে, খুব মুক্ত লাগছে। খুব শান্তি। খুব শান্তি।
"কিছু দেখতে পাচ্ছিস? কাউকে দেখতে পাচ্ছিস?"
না। খুব আলো। খুব আলো। আলোর আবরণে চোখ ঝলসে যাচ্ছে।
"কিছু দেখতে পাচ্ছিস? কাউকে দেখতে পাচ্ছিস?", আবার জিজ্ঞেস করলো সোনাই বাবা।
না....না, পাচ্ছি না।
তবে....একটা দরজা। হ্যাঁ। একটা দরজা, বন্ধ দরজা। অনেকগুলো সিঁড়ির ওপর একটা বন্ধ দরজা।
কেউ আছে। দরজার ওপারে কেউ আছে।
"ঠেল...খোল দরজাটা আস্তে আস্তে...."
খুলবো? খুলবো দরজাটা? কাঁপা কাঁপা হাতে ভারী দরজার কড়ায় হাত রেখে ঠেলতেই সারা শরীরে হাজার হাজার ভোল্টের ইলেক্ট্রিসিটি খেলে গেলো।
জয় টের পেলো কাঁপছে ও, ঠকঠক করে কাঁপছে। এক অসীম উদধির তীরে দাঁড়িয়ে আছি, এক গলা তৃষ্ণা নিয়ে। কি করেছি এতদিন আমি? কিসের দুঃখ আমার? আমি তো অমৃতের এক অংশ, অর্থাৎ আমিও তো অমৃত। তাহলে কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য আমার? আমি তো মুক্ত। পূর্ণের থেকে এক ফোঁটা সরিয়ে নিলে, কি পূর্নতায় কিছু বা তফাৎ আসে?
পিছন ফিরে তাকাতেই দেখা গেলো আরেকজনকে।
বিজয়।
হাঁ করে হাসছে। গোড়ার থেকে জিবটা কাটা।
এক মুহূর্তে সবটা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেলো।
জয় আর বিজয়।
পূর্ণতার অসীমের সিঁড়ির কাছে যুগযুগান্ত ধরে পাহাড়ারত দুই দাসানুদাস। হিরণক্ষ-হিরণ্যকশিপু। রাবণ-কুম্ভকর্ণ। শিশুপাল-বক্রদন্ত। দুজনেই চোখ বুজলো, পরম এক প্রেমের আবেশে। প্রভু আমার। সখা আমার। দয়াল আমার। গুরু আমার। মা আমার। বাবা আমার। ভাই আমার। তুমিই আমি। এ ছাড়া আমি বলে কিছু নেই।
বারবার তোমার থেকে বিচ্ছেদ হয়, তোমায় নতুন করে পাবো বলে।
যেন বাচ্ছার সাথে এক মা লুকোচুরি খেলছে, বারবার চোখের আড়ালে গিয়ে মজা দেখছে -- ধরা দিচ্ছে আবার হারাচ্ছে, নতুন করে পাবে বলে।
বিজয় হেসে বললো -- "আমি রোজ সকালে জিব কেটে ফেলি, বিকেল বেলা আবার ফেরত পাবো বলে। ধরে নাও, এটাই আমার তাঁর প্রতি এক ধরণের নৈবেদ্য উৎসর্গ করা। বারবার ব্যাথা পেয়ে দেখানো -- তোমায় কত ভালোবাসি।"
******************************************
চোখ চাইতেই দেখা গেলো সোনাই বাবা হাসছেন -- "এবার বুঝলি জ্যামিতিটা? কেন তুই আলাদা? কেন তোকে সরিয়ে নিয়ে আসা হলো এভাবে?"
কোনো উত্তর দিতে পারলো না জয়। সব কিছু হ্যাঁ আর না-য়ে হয় না।
"শোন। আমার কথা মন দিয়ে শোন", গলা নামালেন সোনাই বাবা -- "এই পাহাড়ে লুকানো আছে এক বহু পুরোনো বিষ্ণু মন্দির, সোনা-জহরত আর প্রাচুর্যে ভরা এক গভীর-গোপন ধন ভান্ডার নিয়ে। এখানে খুব শীঘ্রই অযোগ্য এবং অকৃতি-অধম দস্যুদের আনাগোনা শুরু হবে, ভাণ্ডারটি লুট করার জন্য। তোদের কাজ হচ্ছে, সেই ধন ভান্ডারকে পাহাড়া দেওয়া। সেই পবিত্র ভাণ্ডারে যেন কিছুতেই না পড়ে, সেই রাক্ষসের অপবিত্র হাত। কথা দে....রক্ষা করবি, কথা দে...."
কাঁপা কাঁপা হাতে সোনাই বাবার পায়ে হাত রাখলো জয় -- "কথা দিলাম..."
চোখ বুজে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সমাধিতে ডুবে গেলো সোনাই বাবা -- "না-রা-য়-ণ।"
৫.শুরুতে কিছুই ছিল না।
তারপর শূন্যতা সৃষ্টি হলো, অন্ধকার সৃষ্টি হলো। তারপর জল। সীমাহীন সমুদ্র, তারওপর সমুদ্রের ওপর এক বিশাল সর্পরাজের ওপর বিষ্ণুরূপী ব্রহ্ম আগত হলেন। তাঁর নাভীর থেকে উত্থিত হলো এক পদ্ম, যার ভিতর বসে আছেন, পদ্মযোনি ব্রহ্মা।
সৃষ্টির শুরু এখান থেকেই। ব্রহ্মার মানসরুপী অনাহুতের থেকে তৈরী হলেন সপ্তর্ষি, প্রজাপতি দক্ষ, নারদ মুনি, বালখিল্য-গণ, এবং যাঁদের থেকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হলেন দেব, দৈত্য, রুদ্র, মরুৎ, লতা, গুল্ম, সরীসৃপ, কীট, পতঙ্গ, নক্ষত্র, আলো, দ্যুতি, তাপ, ত্বেজ -- সুজলাং, সুফলাং এই ত্রিগুণা প্রকৃতি। ব্রহ্মান্ড প্রকৃতিস্থ হলো।
মাঝে অবিশ্যি একটু মুশকিল হয়ে গেছিলো। মধু আর কৈটভ বলে দুই রাক্ষসের অত্যাচারে, আরেকটু হলেই সৃষ্টিকাজ থেমে যাচ্ছিলো আর কি।
বিষ্ণুর ইচ্ছেতেই বধ হলো ওই দুই দানব, বিষ্ণুর ইচ্ছেতেই আবার সৃষ্টিকার্য পুনরারম্ভ করা গেলো।
এইসব গল্প অমরচিত্র কথার পাতায় পড়তে খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে হিন্দি মেগা-সিরিয়ালের পর্দায়ও দেখা যায়। ছোটবেলায় দাদু-ঠাকুমার মুখে শুনতেও বেশ লাগতো।
কিন্তু, দুৰ্ভাগ্যবশতঃ, বাস্তবের সাথে যে কোনো মিলই নেই এই গল্পের।
যদি কোথাও কিছুই না থাকে, তাহলে সমুদ্র এলো কোথার থেকে? জল এলো কোথার থেকে? কিছুই যদি না থাকে, তাহলে নাভির থেকে পদ্মটাই বা এলো কি করে? ওই সাপটাই বা কোথার থেকে এলো?
গল্পটা যদি চোখ বুজে বিশ্বাস করে নেওয়া যায়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু এখানে যুক্তি আনতে গেলেই, মহাবিপদ। মনে হয় বাচ্ছাদের গল্প শুনছি।
আসলে তা না।
সনাতন ধর্মের সমস্যা হলো, বেশির ভাগ কথা বা কাহিনীই হলো রূপক, symbolic। পুরোটাই যদি আক্ষরিকভাবে মেনে নি, তাহলে কিন্তু কোনো কিছুরই মানে দাঁড়াবে না।
মানে বুঝতে গেলে, রূপকের কুসুমের ভিতর থেকে বাইরে আসতে হবে।
শুরুতে সব কিছু সমুদ্র ছিল। এক্ষেত্রে সমুদ্র মানে 'ocean of energy'-কে বোঝাচ্ছে। শক্তি সাগর। এই এনার্জিতে সামান্য quantum fluctuations হওয়ার কারণে, হাজার হাজার নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ সৃষ্টি হলো। আজকের WMAP স্যাটেলাইটের তোলা যে চিত্রটি পাওয়া গেছে, সেখানে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে: অসীম শক্তিভান্ডে একটু একটু করে শক্তিপট ওঠানামা করছে। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, চারপাশে যা দেখতে পাচ্ছি: সে সব কিছুর।
আর হ্যাঁ: বিষ্ণুর নাভি এখানে একটা ব্ল্যাকহোলকে বোঝাচ্ছে, আর ব্রহ্মা এখানে এক 'baby universe' -- স্টিফেন হকিংয়ের বিখ্যাত উধৃতি: সব ব্ল্যাকহোলের সাথেই যদি একটি করে baby universe থাকে, তাহলে আমরা যে ব্রহ্মাণ্ডে আছি, সেটাও কি কোনো ব্ল্যাকহোলের ভিতর অবস্থিত?
বিষ্ণুর নাভির সেই পদ্মটি 'Einstein-Rosen bridge' -- ভয়ানক মাধ্যকর্ষের এক অভিসারী converging field lines, বলরেখা।
মধু আর কৈটভ হলো অ্যান্টি-পার্টিকেল। শুরুতে অ্যান্টি-পার্টিকেলের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছিলো, পার্টিকেলের তুলনায়। তখন এক অজ্ঞাত কারণে কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। ব্রহ্মাণ্ডে পার্টিকেল বা কনার সংখ্যাই বেশি, অ্যান্টি-পার্টিকেলের নয়।
কেন? নাঃ, তা আজও জানা যায়নি।
পুরো জিনিষটা আদৌ অমর চিত্র কথা বা ঠাকুমার ঝুলির গল্প নয় -- সাক্ষাৎ কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর রিলেটিভিটির এক মরুঝড়। হয়তো সাধারণ মানুষে বুঝবে না, তাই এইসব রূপক দিয়েই বোঝানো হয়েছিল।
******************************************
নিজের মনে গজড়াতে গজড়াতে পাহাড়টার বেশ কিছুটা ওঠার পর, প্রথম যে জিনিষটা স্যাম টের পেলো, সেটা হলো কখন জানি ঝুপ করে সন্ধে হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডাও পড়ছে আস্তে আস্তে করে, কোথার থেকে যেন একটা শুকনো হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে চারপাশের গাছগাছালিগুলোকে। একটা মন্দির পড়লো আরো কিছুটা যাওয়ার পর, ভিতরে কেউ যেন বসে আছে। ছলছল করে আওয়াজ হচ্ছে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটে দেখা গেলো, একটা পাথরের নল ভেঙে ঝরঝর করে জল বেরোচ্ছে।
একটা বুড়ো মতন লোক এগিয়ে এলো স্যামকে দেখে, মন্দিরটার থেকে।
"এখানে -- দুজন বন্ধু আমার -- এই রাস্তা দিয়ে ওপরে গেছে, দেখেছেন?", স্যাম জিজ্ঞেস করলো।
লোকটা কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন হাসলো। বিরক্ত হয়ে আবার স্যাম জিজ্ঞেস করলো -- "দেখেছেন এখান দিয়ে কাউকে যেতে? দুজন বন্ধু আমার?"
লোকটা কিছু না বলে, উঁচু পাহাড়ের চূড়াটা দেখালো। এক লাফে কয়েক পা পিছিয়ে এলো স্যাম।
রাতের আকাশে দুটো চাঁদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ কোনো আলো নেই তাদের, যেন দুটো বৃহদাকার মৃত মাটির ঢেলা -- কেউ শুন্য আকাশে ঝুলিয়ে রেখেছে।
"ও....ওটা কি?", স্যামের গলা জড়িয়ে যাচ্ছিলো -- "চাঁদ?"
লোকটা কিছু না বলে, হাসতে হাসতে মন্দিরের ভেতরে দেখালো। স্যাম ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, দুটো দেহ মাটিতে পড়ে আছে, মন্দিরের গর্ভগৃহে।
খুব চেনা চেনা লাগছে।
শেখর আর রবার্ট। শুধু শেখরের ধরে রবার্টের মাথাটা বসানো, আর রবার্টের ধরে শেখরের। কে যেন মজা করে মাথা দুটো পাল্টাপাল্টি করে দিয়েছে।
"না...না....", নিজের গালে থাপ্পড় লাগালো স্যাম -- "আমার কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? দুপুরে লাঞ্চে কি হুইস্কিটা একটু বেশিই পেটে পড়েছিল নাকি?"
না...না....ওপরে পাহাড়ের চূড়ায়...পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো স্যাম অল্প আলোয় চাঁদ দুটোর ঠিক মাঝখান করে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরোনো মন্দিরটি। হ্যাঁ...হ্যাঁ -- এটাই। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মন্দিরটা। একটা...একটা ফ্ল্যাগ ও আঁকা আছে ওটায়, তাই না? ওখানেই আছে সেই রত্নভাণ্ডার। প্রচন্ড উত্তেজনায় স্যাম টের পেলো কুলকুলিয়ে ঘামছে।
আ...আমায় পৌঁছতেই হবে ওখানে...যে হোক করে হোক। আর তারপর...সবটা আমার। সবটা....
লোকটা এগিয়ে এসে স্যামের গায়ে হাত দিতেই, স্যাম ওকে এক ঠেলা মারলো। বুড়োটা মাটিতে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলো।
যেন কিছু বলছে। কোনো মন্ত্র পড়ছে। স্যাম কিছুক্ষণ শোনার চেষ্টা করলো লোকটা কি বলছে।
না...না -- ঠিক মন্ত্র নয় -- যেন নালিশ করছে কাউকে। ঠিক যেমন বাচ্ছারা মাকে নালিশ করে।
স্যাম আর সময় নষ্ট না করে, দৌড় মারলো পাহাড়চূড়ার দিকে।
যত্তসব....!!!
******************************************
হ্যাঁ, আরো কিছুদূর যাওয়ার পর একটা সরোবর পড়লো। ছোট একটা কুটির আছে পাশে, আর একটু দূরে মন্দিরটা।
কিন্তু নিচ থেকে যে ফ্ল্যাগটা দেখেছিলো -- কোই? সেটা কোই গেলো?
দূর ছাই নিকুচি করেছে ফ্ল্যাগের। আগে ওই হ্যাচডোরটা খুঁজে বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে। পাগলদের দেশ, পাগলদের দেবতা, পাগলদের ভগবান। ব্রিটিশরা যে কেন এদের স্বাধীনতা দিলো? শিষ্টতা শিখতে আরও হাজার খানেক বছর তো লাগবেই।
তাড়াহুড়োতে আরও কিছু সময় নষ্ট হওয়ার পর, চোখ পড়লো পাথুরে মাটিটার ওপর অনতিদূরে। হ্যাঁ -- ওই তো, হ্যাচডোরটা।
ঝামরে পড়ে উবু হয়ে ছিটকিনিটা ধরে টানতেই, টের পেলো দূরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
হ্যাঁ -- ওই যে ওখানে।
রিভলভারটা বের করে মোবাইলের আলোটা ফ্ল্যাশ করতেই স্পষ্ট দেখতে পেলো স্যাম। ওই যে....ওখানে।
দুজন। দুজন খেলা করছে। পায়ে করে কিছু একটা নিয়ে বল খেলছে।
স্যাম আরো একটু ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলো সেই বুড়ো লোকটা আর সাথে একটা ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা লোক, হাফ প্যান্ট পড়া।
দুজনে মিলে বল খেলছে।
অবিশ্যি বল না...শেখরের কাটা মাথাটা।
গা গুলিয়ে উঠতেই দুজনকে লক্ষ করে গুলি চালালো স্যাম। দু দু-বার। ফাঁকা পাহাড়ের চূড়াটা যেন কেঁপে উঠলো ব্যাথায়।
দূরে গাছের মাথায় বসা কাক পক্ষীরা ত্রাহি-স্বরে ডেকে উঠলো।
লোক দুটো মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। গুলি দুটো মোক্ষম জায়গায় লেগেছে: একজনের বুকে, আরেকজনের পেটে।
"Bloody barbarians", ক্রূর একটা হাসি হেসে, হ্যাচডোরটা খুললো স্যাম -- "হাজার হাজার বছরের পুরোনো বাচ্ছাদের গল্প। তোরা আর কোনোদিন ও মানুষ হলি না। বিষ্ণু, শিব, কালী, দূর্গা -- এসবই কর। West is west....."
******************************************
হ্যাঁ, স্যাম যা পেরেছে লুটেছে। ভারী ভারী সোনার বিগ্রহ, গোটা গোটা ভারী চেন, কোমরবন্ধ, টিকলি, মুকুট, নুপুর, বড় বড় নানান রঙের রত্ন, নানান আকারের আংটি -- উফফ, না, না -- এ তো আলাদিন ও এর কাছে নস্যি। ভারী ডাফেলব্যাগটা নিয়ে খুব কষ্টে ওপরে উঠে এসে হাঁফাতে লাগলো স্যাম। খুব ঘামছে ও। এখান থেকে টেনে টেনে ব্যাগটা নিয়ে পাহাড়ের নিচে নামিয়ে এসে -- ওই যে দূরে ওর গাড়িটা পার্ক করা আছে। আজই রাতে দিল্লির জন্য রওয়ানা হবো। কাল পৌঁছে ওই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোককে ওই মূর্তিগুলো আগেই গছাতে হবে, তারপর বাকি জিনিসগুলোর যা করার করবো খন।
খসখস করে আওয়াজ -- তাকিয়ে দেখে ওই লোকদুটো আবার খেলছে।
এবার খেলার বল অবিশ্যি অন্য কিছু।
রবার্টের কাটা মাথাটা।
না, না সময় নষ্ট করবো না। যা খুশি করুক পাগলদুটো। ব্যাগটা নিয়ে হুড়হুড় করে টানতে টানতে কিছু দূর নামাতেই স্যাম দেখতে পেলো, রাস্তার মাঝখানে বুড়োটা মরে পড়ে আছে, মুখ দিয়ে এক পোঁচ রক্ত বমি করে।
Holy Shit....
নিজের নার্ভটাকে যতদূর সম্ভব ঠান্ডা রেখে কয়েক পা নামতেই একটা আলোর ঝিলিক -- আরে, একি....!!!
সেই হ্যাচডোরটা।
ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগলো স্যাম। আ...আমি কি তাহলে আবার ফিরে এলাম ওপরে? মাথাটা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি? নাকি পুরো জিনিসটাই এই ইন্ডিয়ানগুলোর হিংটিংছট? নিজেরা যেমন ভুত-রাক্ষস-ডেভিলের পুজো করে, তেমনি যা ঘটছে তা কি সব ওই জাদুটোনারই ফল? স্যাম কোনোদিন ও কুসংস্কারকে মনে স্থান দেয়নি ঠিকই, কিন্তু কেন জানি না আজ এগুলো সব সত্যিই বলেই মনে হচ্ছে।
ডেভিল। প্যাগান। স্যাটানিক ওয়ারশিপ। এ...এই ইন্ডিয়ানরা চিরকাল এসব কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকেই ধর্ম ও বিশ্বাস বলে মেনে এসেছে। তা নইলে, যে দেবী কাটা মাথার মালা পরে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁকে কেউ পুজো করে?
ব্যাগটাকে টেনে আরও কয়েক ধাপ নামাতেই একটা আওয়াজ হলো।
একটা সিঁড়ি। অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। একটা বন্ধ দরজা। দরজার দু পাশে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। ওই বুড়োটা আর ওই হাফ প্যান্ট পরা, আধ পাগলা জিব কাটা ওর সাগরেদটা।
বুড়োটা হাসছে, আবার কেঁদে কেঁদে কি যেন এক ভাষায় নালিশ করে চলেছে কাউকে।
এরপর কিছু বোঝার আগে বন্ধ দরজাটা খুলে গেলো।
কে....কে যেন বাইরে এসে দাঁড়ালো না?
ভারী ব্যাগটা আর টানতে পারছে না। খুব অবশ লাগছে ওর হাতদুটো।
ক...কে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে?
দরজার বাইরে কে ওটা? মিশকালো এক অবয়ব। চা...চারহাতওয়ালা একটি মূর্তি। পুরুষ না নারী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রিভলভারটা উঁচু করে গুলি চালালো আরও একবার।
আবার। আবার। আবার।
সেই চতুর্ভুজ মূর্তিটি অদৃশ্য হয়েছে। সিঁড়ির ওপর দরজাটাও বন্ধ, দু পাশে দাঁড়ানো দুটো পাগল ও আর নেই। Bloody imbecile Indians -- তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসতে হাসতে হঠাৎ থেমে গেলো স্যাম।
ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারী মূর্তি।
ভয়ানক ত্বেজে চোখ ঝলসে যাচ্ছে স্যামের -- "কে...কে তুমি?"
নারী মূর্তির গলায় ঝুলছে কাটা মুন্ডের মালা, রক্তাক্ত জিব আর হাতে চকচকে এক খড়্গ।
"ক...কে তুমি?"
"এই মাথাগুলো দেখছিস, এগুলো সবই তোর। তুই বারবার পৃথিবীতে এসেছিস, মানুষ বারবার পৃথিবীতে আসে, সবার অর্থ চাই, কামিনী চাই, কাঞ্চন চাই, প্রাচুর্য চাই। অথচ দেখ, কেউই আমায় চায় না। আর চায় না বলেই তাকে বারবার আসতে হয়। তাই যখন এ জন্মে তুই আমার দর্শন পেয়েই গেলি -- তুই তাই মুক্ত....তুই মুক্ত...."
এক প্রচন্ড আলোর ঝিলিকে সেই নারীমূর্তির অন্তর্হিত হলো, তার জায়গায় এক পুরুষ মূর্তি এলো। এটিও চতুর্ভুজ। কিন্তু হাতে খড়্গ নেই -- ভয়ানক ত্বেজভাণ্ডে জ্বলন্ত এক চক্র ধরে আছে সেই মূর্তিটি। মূর্তিটি কমনীয়, সৌম্য নয়। ভয়ানক উগ্র ও বীভৎস। মৃত্যুরও কোনো রূপ থাকতে পারে, তা সত্যিই স্যামের জানা ছিল না।
"ভালো করে দেখ আমায়। তুই এই ভয়ানক রূপই দেখতে চেয়েছিলি। যে আমায় যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবেই আমি দেখা দি -- ভক্তের আঁকা ছবিতেই আমি অঙ্কিত হই। এ ছাড়া আমার তো আর কোনো রূপ নেই।"
না....না....এ হতে পারে না....
লাফাতে লাফাতে পাহাড়ের খাঁদের এক কোণে গিয়ে আবার গুলি চালালো স্যাম। শেষ গুলি। চেম্বার খালি।
পুরুষ মূর্তিটি অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো, এক ঝলকে তার হাতে ধরা চক্রটি স্যামের দিকে চালিয়ে -- "একোহাম, দ্বিতীয় নাস্তি...."
এক ঝলকে মাথাটা কেটে, ড্রপ খেতে খেতে সোজা গিয়ে পড়লো সফেন মন্দাকিনীতে, ধড়টি তখনো ব্যাপারটি বোঝেনি...ব্যাগটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
পাগল বুড়োটা অর্ধেক হাসি, অর্ধেক কান্না নিয়ে আধো আধো গলায় বলে উঠলো, হাত তালী দিয়ে --
"তুমি পুরুষ কি নারী, বুঝিতে নারি...
স্বয়ম না বোঝালে তা কি বুঝিতে পারি?"
[সমাপ্ত]

