Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

4.5  

Subhashish Chakraborty

Horror Crime Thriller

খাদক

খাদক

11 mins
1.6K


"একদম পাক্কা খবর আছে স্যার। কোনো মিস্টেক নেই এইবার।"

"বলে যা, শুনছি", এইসব কথা বাইক চালাতে চালাতে শোনা যায় না। ইন্সপেক্টর অর্জুন গুপ্ত বরাবরের অভ্যাস মতন বাইকটা রাস্তার একধারে দাঁড় করিয়ে, সিগারেট ধরালেন, ইয়ারফোনটা কানে গুঁজে। 

"স্যার এই নিয়ে পর পর তিনবার হলো জিনিষটা", কোথা থেকে ফোন করছে কে জানে ব্যাটা। প্রচুর খসখস করে আওয়াজ হচ্ছে -- "আমি এই নিয়ে তিন তিনবার ব্যাপারটা দেখলাম।"

"কি দেখলি ভালো করে বল।"

"মর্গে বেওয়ারিশ লাশ রাখবার একটা করে কোটা থাকে। প্রতি দু-তিন মাস বাদ-বাদ বাকিগুলিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।"

"হুম, তারপর?"

"মর্গের থেকে চালান বানিয়ে নিয়ে ফার্নেসের ঘরে নিয়ে আসা হয়। ফার্নেসে যিনি ইনচার্জ থাকেন, তিনি চালানে সাইন, স্ট্যাম্প মেরে দেন। সেখান থেকে লাশগুলি নিয়ে গিয়ে জ্বালানো হয় বার্নিং চেম্বারে। এমনকি বার্নিং চেম্বারেও একজন চেকার দাঁড়িয়ে থাকে, যার কাজ হলো সেই চালানে মেনসন করা লাশের সংখ্যা আর চেম্বারে নিয়ে আসা লাশের সংখ্যা এক কিনা একবার মিলিয়ে দেখে নেওয়া।"

"হুম, তো? কি হলো তাতে?"

"ন...না, মানে প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে -- দু একটা লাশ কম।"

"মানে?", অর্জুনের কপালে গভীর খাঁজ।

"ম...মানে স্যার লাশঘর থেকে বার্নিং চেম্বারে আনবার মাঝখানেই...কেউ যেন সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে..."

সিগারেটটা মাঝপথে ফেলে দিয়ে বুট দিয়ে পিষলো অর্জুন -- "সিসিটিভি ক্যামেরা? সুপারভাইজার? বাকি ডোমরা?"

"না স্যার....কিছুই ধরা পরে নি। কিছুই কেউ জানে না।"

কপাল দিয়ে সরু ঘামের একটা নদী মুছলো অর্জুন রুমাল দিয়ে। শিরশিরানি একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে আসছে ওর পিঠ দিয়ে।

হাসপাতালটার সম্বন্ধে যা শোনা গেছে -- সব তাহলে সত্যি?


১."দাঁড়া...একটু দাঁড়া। নড়বি না", ফিসফিসিয়ে বললো রাজীব।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, সুতপা ঢোক গিললো। হাতের চেটোটা ভয়ানক ঠান্ডা, সারা শরীরে ভয়ানক কাঁপুনি লাগছে ওর। পাশের পচা ডোবাটা জুড়ে কানফাটানো ঝিঁঝির কীর্তন, মাঝে মাঝে দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা শিয়ালের দলের বিজয়োল্লাস। গত দুদিন ধরে বৃষ্টি হয়ে মাটিটা এখনো ভিজে, প্যাচপ্যাঁচানো কাদায় ডুবে আছে সামনের রাস্তার বেশ কিছু অংশ।

রাজীব গাড়ির ডিকি খুললো -- "শোন, এটাকে এভাবে বের করাটা ঠিক হবে না। আমি আসছি -- এখনই আসছি। তুই এখানে দাঁড়া। না আসা অবধি এখানেই থাক। "

"না....না....আমি একা থাকবো না এখানে", সিঁটিয়ে উঠলো সুতপা ভয়ে -- "এ...এটাকে নিয়ে আমায় এক ফেলে যাবি না একদম।"

"ধ্যাৎ -- ন্যাকামো করিস না তো", রাজীব চেঁচিয়ে উঠলো -- "আমি এখনই আসছি। একবার ভিতরে গিয়ে কথা বলেই চলে আসছি।"

সুতপা রাজীবের হাত ধরে টানলো -- "প্লিস...প্লিস বোঝার চেষ্টা কর -- আমি এই মরাটা নিয়ে এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।"

"কেন? ভয়? ভূতের ভয় লাগছে মামনির?", রাজীব হাত ছাড়িয়ে ভেঙছে উঠলো -- "বাজে কথা রাখ। আমি একবার জিজ্ঞেস করে আসছি ভিতরে গিয়ে।"

সুতপা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, রাজীব হাঁটা দিলো। সুতপা ডিকির ঠান্ডা হাতলটা ধরে বন্ধ করে দিলো। দেহটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। যত না ভয় লাগছে...ঘেন্না লাগছে বেশি।

সরে এসে গাড়ির ভিতরে এসে বসলো সুতপা। ভয়, প্রচুর ভয় লাগছে ওর।

ভুল করিনি তো কিছু?

চোখ বুজে পুরোটা আবার ভাবার চেষ্টা করলো সুতপা।

**************************************************************************************

পুরো জিনিসটার সূচনা কিছু মাস আগে।

সুতপার সাথে বিয়ে হয়েছিল শ্যামলের। শ্যামল নাগপাল। কনস্ট্রাকশনের বিজনেস দিয়ে শুরু করেছিল কিছু বছর, তারপর কিছু পয়সা জমে যাবার পর প্রোমোটিংয়ের বিজনেসে নামে।

বেশ চলছিল কিছু বছর। শ্যামল, ও আর রিচা।

ওদের মেয়ে। কোল আলো করে এলো এক স্বর্গের পরী। সুতপার মা কিছু বছর আগে মারা গেছিলেন, মাকে হারানোর পর রিচাকে পেয়ে হঠাৎ মনে হলো যেন মা ফিরে এসেছেন। ঠিক ওরকম হাসি, ওরকম চোখ, ওরকমই গায়ের রঙ। হ্যাঁ এটা মা-ই। সের্ফ ছ-মাসে নাহলে মা-মা বলে ডাকতে শুরু করে? এ যেন মনে করিয়ে দেওয়া: দেখো তো চিনতে পারো কিনা?

গোলটা বাঁধলো অন্য জায়গায়।

কি জানি কি ছিল বিধাতার মনে।

**************************************************************************************

প্রোমোটারিং-এ ঢোকার পর থেকেই হঠাৎ শ্যামলের হিল্লি-দিল্লি ঘোড়াটা খুব বেড়ে গেছে। আজ কলকাতা, তো কাল মুর্শিদাবাদ, পরশু শিলিগুড়ি, তারপর ফিরে এসেই দু সপ্তাহের জন্য হলদিয়া। কিসের যে এত ঘোরাঘুরি কে জানে বাবা।

একা থাকতে থাকতে বেশ দমবন্ধ হয়ে আসছিলো সুতপার। বেশির ভাগ কাজ আয়াই করে -- শ্যামলই আয়া রাখতে বলেছে। মেয়ে এখন আয়ার কাছেই বেশির ভাগ সময় থাকে।

মালিনী খুবই ভালো মেয়ে, রিচাকে নিজের মেয়ের মতনই যত্ন করে। সুতপা এখন অনেকটাই হাল্কা, অনেকটাই ফ্রি।

সুতপা মাস্টার্সটা কমপ্লিট করলো, চাকরির জন্য অ্যাপলাই করেছিল আগেই। মাস্টার্সটা শেষ করাতেই ঝাঁকে ঝাঁকে অফার আসা শুরু করে।

মনে এক নতুন অ্যাডভেঞ্চারের ঝিলিক দিলো: এতো ভালো ভালো অফার আসছে। এরকম সুযোগ কি আর বারবার আসবে?

আর বেশি না ভেবে পার্ক স্ট্রিটের একটা পালবলিশিং এজেন্সিতে ঢুকলো ও। মাইনেটা ও বেশ ভালো, চাকরির টাইমিং ও বেশ ভালো। কাজের চাপ ও তেমন নেই।

আর কি চাই?

৯-৫টা বাঁধাধরা ছক। অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরে রিচার সাথে খুনসুটি। বাকিটা সময় মালিনীই ওকে দেখে।

**************************************************************************************

কি জানি কেন যে সন্দেহটা মনে এলো ওর। মোবাইল আনলকের প্যাটার্নটা দেখে রেখেছিলো ও আগেই।

শ্যামল স্নান করতে গেছিলো সেদিন, আর ওর মোবাইল আনলক করে হোয়াটস্যাপ আর গ্যালারি খুলে হৃদ্স্পন্দনটা হঠাৎ থেমে গেলো ওর।

এই জন্যই কি এতো ঘনঘন বাইরে যাওয়া ওর? এই জন্যই কি সুতপার জন্য ওর কোনো সময় হয় না ওর? এই জন্যই কি সুতপার প্রতি ওর এতো নিষ্ক্রিয়তা?

ব্যাথাটা যেন নেওয়া যায় না।

আজ আমি সব ছেড়ে তোমার জন্য চলে এলাম -- এই কি পরিণামে ছিল আমার?

সুতপার চোখ লাল, শ্যামল বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলেই চলেছে -- "আর বোলো না, প্রচুর চাপ বেড়ে গেছে। অনেক নতুন কন্ট্রাক্ট আসছে। পরশুদিন আবার বহরমপুর যেতে হবে, সপ্তাহ খানেকের জন্য।"

দাঁতে দাঁত চাপলো ও।

আমিই বা কেন বাদ যাবো?

তুমি ওখানে রাধা-কৃষ্ণ-লীলা চালাবে, আর আমি এখানে মীরাবাঈ হয়ে ঘুরে বেড়াবো? ভয়ানক এক রাগ যেন আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলো ওকে।

ঠিক এই সময়ই রাজীব ওর জীবনে আসে।

রাজীব ত্রিপাঠি। ওর অফিসের লাইন ম্যানেজার। এমনিতেই রাজীব ওর চেনাই ছিল। ওর কলেজের দু-বছরের সিনিয়ার। হঠাৎ যেন রাজীবকে খুব কাছের বলে মনে হলো। ওর বৃত্ত শ্যামল আর রিচাকে নিয়ে নয়। বৃত্তটি ভেঙে লম্বা একটা সরলরেখা দেখতে পাচ্ছে ও --রাজীব আর রিচাকে নিয়ে।


২.ওই যে বললাম -- কি জানি কি ছিল বিধাতার মনে।

সেদিন রাজীবের সাথে গাড়ীতে করে লাঞ্চের জন্য বেরিয়েছিল সুতপা। আজ শুক্রবার, এমনিতেই কাজ কম। ঘন্টা দুয়েক আগে মালিনীকে কল করেছিল ও, রিচা এতক্ষনে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই।

বেশ ভালো লাগছিলো ওর। শীত আসছে, গরম জামা বের হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। রাজীবের কাঁধে মাথা রাখলো ও। রাজীব কিশোরের কি যেন একটা গান গাইছিলো, ড্রাইভিং করতে করতে। বেশ ভালোই গায় ও।

"আজ সন্ধ্যাবেলা কি করবি? সাম-প্লেস-এলস চলবে?", স্টিয়ারিংয়ে ড্রাম বাজাতে বাজাতে রাজীব জিজ্ঞেস করলো।

"আজ থাক রে, মাথাটা ধরেছে", আদুরে গলায় সুতপা উত্তর দিলো -- "দেখি, কাল করা যায় কি না?"

"কাল তো -- ", প্রচন্ড জোড়ে ব্রেক কষলো রাজীব, ছিটকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো সুতপা।

সামনে এসে পড়া এক ভিখারি মা আর তার হাতে ধরা প্রায় নগ্ন শিশু কন্যা। রাজীব গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বেশ চেঁচিয়েই উঠলো -- "দেখতে পাও না?"

সুতপা কিছু বলতে পারলো না। এতো অবাক বোধহয় আর আগে কখনো হয়নি।

ভিখারি মা-টিকে ও চেনে। কোলে ধরা বাচ্ছাটি ও চেনা।

মালিনী আর রিচা।

**************************************************************************************

অবাক হওয়ার প্রাথমিক ধাপটা পেরোনোর পর, প্রচন্ড রাগ হয় ওর। অফিসে জানিয়ে বাড়ি ছুটলো সুতপা।

মালিনী। রিচা।

মালিনী তাহলে...ছি, ছি -- এতো ভাবাই যায় না। গাড়ির স্টিয়ারিংটা রাগের মাথায় উপরেই ফেলে সুতপা রাগের চোটে।

ব্যাপারটা তাহলে সত্যি?

চাইল্ড ট্রাফিকিং, বেগার মাফিয়া -- এসব কথা তো চাপা স্বরে কতবারই শোনা গেছে গল্পে, নিউজে, সিনেমায়। চোখের সামনে এরকম দেখা -- এ জিনিস তো কল্পনাতীত। বিশেষ করে মালিনীর মতন ওরকম বিশ্বাসযোগ্যা একজন মানুষকে দেখে কখনোই মনে হতে পারে না।

রোজ সকালে বাড়ি এসে 'ভালো-আন্টি'র একটা সুন্দর অভিনয় করে কিছুক্ষন। বাচ্ছাকে ভোলানো, কোলে-পিঠে নিয়ে ঘোরা, গল্প বলা -- এ তো মায়ের থেকেও বড়ো কেউ বলে মনে হয়। আর তারপর সুতপা বেরিয়ে গেলে কিছুক্ষন পরেই রিচাকে নিয়ে বেরোয় ও। বেশ-ভূষা পাল্টে রাণী থেকে ভিখারিনী। তারপর রাস্তায় রাস্তায় গাড়িতে গাড়িতে বন্ধ করা জানলায় মুখ দেখিয়ে ভিক্ষে চাওয়া।

সহজ হিসাব।

সুতপা মাথার চুলে হাত চালালো -- ভুল, বিশাল ভুল করে ফেলেছে ও।

বাড়ি পৌঁছে আজ পিষে মেরে ফেলবো ডাইনীটাকে।

মনে মনে এমনটাই সঙ্কল্প করলো ও।

**************************************************************************************

বাড়ি পৌঁছে দেখে যথারীতি -- ফ্ল্যাট খালি। মালিনী নেই। রিচা নেই। ফ্ল্যাটটায় বাইরের থেকে তালা দেওয়া।

ডুপ্লিকেট চাবি দেওয়া থাকে মালিনীকে। সেটাও একটা ভুল করেছে ও, সুতপা বুঝতে পারলো।

সুতপার কাছে আরেক জোড়া চাবি ছিল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসলো ও। আগুন জ্বলছে ওর সর্বাঙ্গে।

শ্যামল? শ্যামলকে ফোন করবে? সুতপা নম্বর ডায়াল করলো -- তবে শ্যামল ধরলো না। আরও রাগ হলো। এক ছোট কাঁদলো ও।

পুলিশ? পুলিশে কল করবে ও ? কিন্তু প্রমাণ? প্রমাণ আছে কি? এসব বেগার মাফিয়া কিংপিংদের অনেক দূর অবধি হাত থাকে।

কি করা যায় তাহলে?

মালিনীকে ছাড়িয়ে দেবে? অন্য কেউ এলে যে সেই কাজ করবে না তার কোন আশ্বাসন রয়েছে?

ঠিক সেই সময়ে রাজীব ফোন করলো -- "কি হলো, জান? তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলি? সব ঠিক আছে তো?"

ভারী গলায় উত্তর দিলো সুতপা -- "একবার আসতে পারবি আমার ফ্ল্যাটে?"

"আসছি...এখনই আসছি।"

দরজা খুলে ফ্ল্যাটে মালিনী ঢুকলো , রিচাকে নিয়ে।

রক্তচক্ষু নিয়ে সুতপা তাকালো মালিনীর দিকে -- "কোথায় গেছিলে তুমি?"

"এ...এই তো দিদিভাই -- খুব কান্নাকাটি করছিলো। একটু পাশের পার্কে ঘোরাতে নিয়ে গেছিলাম", মালিনীর গলায় ঈষৎ জড়তা। রিচাকে নামিয়ে সোফায় বসালো ও।

"মিথ্যা কথা বোলো না", দাঁতে দাঁত চিপে, অগ্নিভ দৃষ্টিতে ফের জিজ্ঞেস করলো সুতপা -- "পার্ক স্ট্রিটের কাছে আমার মেয়েকে নিয়ে তুমি কি করছিলে? বলো?"

"আ...আমি পার্ক -- পার্কে গেছিলাম দিদি, পার্ক ইস্ট্রিটে যাই নি", আমতা আমতা করে একই কথা বললো মালিনী।

সামনে পাওয়া পিতলের ফ্লাওয়ার ভাসটা ওঠালো সুতপা -- "মনে হয় তুই এমনিতে উত্তর দিবি না। আঙ্গুল বাঁকাতে হবে।"


৩.রাজীব যখন সুতপার ফ্ল্যাটে এলো, তখন যা হবার হয়ে গেছে।

রাজীব দাঁড়িয়ে রইলো হাঁ করে কিছুক্ষন, একরাশ অবিশ্বাস আর ভয় নিয়ে -- "এ...এ তুই কি করেছিস?"

সুতপার চোখ তখন ও মালিনীর ওপর। মালিনী চিৎ হয়ে টিভির স্ট্যান্ডের নিচে পড়ে আছে, থিকথিকে এক পুকুর রক্তের মাঝে। মাথার ঠিক মাঝখানে আড়াআড়ি ভাবে প্রায় তিন ইঞ্চির লম্বা একটা কাটা দাগ। টপটপ করে বেরিয়েই চলেছে রক্ত তখনও।

পাশেই পড়ে আছে ভারী ফ্লাওয়ার ভাসটি। সোফায় বসে রিচা তখনও কাঁদছে।

রাজীব ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো -- "কেন করলি এটা?"

সুতপা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা বললো ওকে। শ্যামলের কথা, রিচার কথা, মালিনীর সাথে খুঁজে পাওয়া 'ভিখারি' মেয়ের কথা।

"তুই বল, আমি কি কিছু ভুল করেছি?", কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলো সুতপা রাজীবকে -- "এক মা হয়ে কি এটুকুও করতে নেই আমায়?"

রাজীব কিছু বলতে পারলো না। ওর পেট জুড়ে কেঁপে চলেছে এক পাগল হস্তিনীর বাধনহীন নাচন।

"কি করবো রাজীব এবার?", হঠাৎ খেয়াল হলো সুতপার -- "এই দেহটা নিয়ে কি করবো?"

খুব ভয় লাগলো ওর। পুলিশ। শ্যামল। লোকলজ্জা। সমাজ এটা দেখবে না কেন ও ওরকম করেছে -- সমাজের চোখে ও এক খুনি বৈ কিছু না।

"একটা উপায় আছে", রাজীব বলে উঠলো -- "আমি কাউকে চিনি, যে কিনা এই লাশের ঠিকানা লাগাতে পারে।"

"ক...কে?", সুতপার সামনে যেন আশার আলো।

রাজীব উঠে দাঁড়ালো -- "আমি বেরোচ্ছি। এখনই আসছি।"

"না....না....আমায় ছেড়ে যাস না", সুতপা ওকে জড়িয়ে ধরলো -- "আমার খুব ভয় করছে রে।"

"শোন, শান্ত হ", রাজীব ওকে ঠেলে সরালো -- "এই দেহটা ফ্ল্যাটটা থেকে বের করতে হবে। লোকে দেখে ফেলবে। আমি সুটকেস নিয়ে আসছি। বড় সুটকেসে আশা করি ধরে যাবে লাশটা।"

**************************************************************************************

রাজীব এলো বেশ বড় সাইজের একটা অ্যামেরিকান টুইস্টার নিয়ে।

কোনো রকম ভাবে ভেঙেচুরে, তাল-তুবড়ে দেহটা সুটকেসে ঢোকালেও, কিছুতেই সুটকেসের ছাদ আর বন্ধ করা যাচ্ছে না। মাথাটা আটকে যাচ্ছে যে।

অবশেষে বাধ্য হয়েই রাজীব বললো -- "বঁটি আন। মাথাটা কাটতে হবে -- তবে যদি সুটকেসটা বন্ধ করা যায়। আরেকটা সুটকেসে মাথাটা ভরতে হবে মনে হচ্ছে।"


৪."এই ওঠ ওঠ", সুতপা চমকে উঠলো রাজীবের চিৎকারে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ধরে দূরে জ্বলছে আগুন। সন্ধ্যাবেলা বেরিয়ে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছতে লাগলো পাক্কা তিন ঘন্টা। পুরুলিয়া আর রঘুনাথপুরের ঠিক মাঝামাঝি কংসাবতীর ধার ঘেঁষা এক ভয়ানক শ্মশান ভূমি। বৈদ্যুতিন আধুনিকীকরণ এখনও এখানে স্পর্শ পায়নি -- তাই শবদাহ এখনো কাঠের শয্যায়ই করা হয়, ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবহার এখনো করা হয় না।

দূরে দূরে ইতস্তত কাঠের চুল্লি জ্বলছে, মরার হাড় নিয়ে কুকুরে-শেয়ালে চলছে ভয়ানক লড়াই।

এ কোথায় নিয়ে এলো রাজীব ওকে?

গাড়ির থেকে বেরোলো ও। রাজীবের পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

ভয়ানক চেহারার এক সাধু। নোংরা চুলের জটা কাঁধ অবধি নেমে এসেছে, চওড়া কপাল জুড়ে ছাই লেপা। খালি গা, আর সুদৃঢ় পেশির ঘনঘটা দেখলেই বোঝা যায় লোকটার গায়ে জান্তব শক্তি। ছোট ধুতি আর পায়ের কাফ মাসল জুড়ে নানান ধমনীর ইতিউতি খেলা।

এক টানে সুটকেস দুটো বের করলো লোকটা। রাজীব সুতপাকে ধরে সরে দাঁড়ালো।

উবু হয়ে সুটকেস খুললো লোকটা আস্তে আস্তে করে।

"স...সব ঠিক আছে তো সাধুবাবা?", রাজীব জিজ্ঞেস করলো।

উঠে দাঁড়ালো লোকটা, চোখ দুটো ইঁট-ভাঁটার মতন লাল -- "খুন করেছিস একে, তাই তো?"

"খু...হ্যাঁ, মানে খুনই তো", রাজীব তোতলাতে তোতলাতে, হাসতে হাসতে বললো -- "এই মহিলাটি আমার এই বন্ধুর মেয়েকে চুরি করে পালাচ্ছিল। তাই মারতে হলো।"

"মিথ্যা বলছিস তুই", লোকটি ঠান্ডা গলায় বললো -- "অর্ধ-সত্য।"

রাজীব হাত জোড় করলো -- "এ...এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বাবা, আমাদের কাছে।"

লোকটা হাসলো -- "যাক গে, আমার কি। যা কিছু অনিত্য, যা কিছুর শুরু আছে, শেষ আছে -- আমি খাই। এই পৃথিবী হলো মা, ওই আকাশ আমার বাবা। এদের দুজনের মাঝে যা পাওয়া যায়, তাইই খাই।"

সুটকেস দুটো উঠিয়ে হাঁটা শুরু করলো লোকটা -- "হার-হার-মহাদেও...."

"কাটা-অঘোরী", আস্তে আস্তে কথাটা বললো রাজীব, লোকটা অনেকদূর চলে যাবার পর -- "লোকে কাটাবাবা বলেই ডাকে। স্থানীয় শ্মশ্মান চত্ত্বরে ঘুরে বেড়ানো এক লিভিং লিজেন্ড। মরা, পড়ে থাকা মৃতদেহের হাড়গোড়, আধ পোড়া মাংস কুড়িয়ে কুড়িয়ে খান। লোকটাকে মাঝে মাঝে দেখা যায়, মাঝে মাঝে পাওয়া যায় না। যখন দেখা দেয়, তখন নাকি বিপদের হাত থেকে উদ্বার করতেই দেখা দেন। তোর সত্যিই বড়ো কোনো বিপদ হয়েছিল রে -- তাই দেখা দিলেন।"

সুতপা লোকটার উদ্দেশ্যে প্রণাম করলো। বাড়ি ফিরতে হবে। খুব হাল্কা লাগছে।

**************************************************************************************

আলাদা আলাদা সুটকেসদুটো খালি করে, পেট ভরে আধপচা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই কাটা অঘোরী টের পেলো, কপালে ঠেকেছে শীতল বন্দুকের নল।

"একদম নড়ার চেষ্টা করবেন না", ইন্সপেক্টর অর্জুন গুপ্ত ঠান্ডা গলায় বললেন -- "আপনার নামে অনেক কিছুর হিসাব ঝুলছে। হাসপাতাল থেকে মরা চুরি করা, মর্গের বার্নিং চেম্বার থেকে মরা চুরি করা, খুন করা দেহ পাচার করা -- পালানোর চেষ্টা করার আগে আমার ট্রিগারে আঙুলটি তার খেলা দেখাবে।"

হেসে একবার ঘুরে দেখলো কাটা অঘোরী -- "এর জন্য আমায় অ্যারেস্ট করবে তুমি?", লোকটার দাড়িতে লেগে আছে শুকনো রক্ত, দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে আছে মাংসের ছিবড়ে।

পায়ের কাছে পড়ে আছে এক ঢিপি নাড়িভুঁড়ির ছিন্ন স্তুপ।

কি জানি কি মনে করে সেগুলো আর খায়নি লোকটা... 

অর্জুন পকেটে হাত দিয়ে হ্যান্ডকাফ বের করে লোকটার হাতে পরাতেই টের পেলো ব্যাপারটা -- লোকটা ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

একটু একটু করে।

না, না -- এতো হতেই পারে না -- "চালাকি মারার চেষ্টা করবে না আমার সাথে -- আমি কিন্তু গুলি চালাতে বাধ্য হবো...."

"আমায় অ্যারেস্ট করবে তুমি?", লোকটা একটু একটু করে হাওয়ায় মিশছে, পিছিয়ে যেতে যেতে -- "আমায় অ্যারেস্ট করবে তুমি?"

বেশ থতমত খেয়েই গুলি চালালো অর্জুন। শ্মশানের পৈশাচিক নৈশব্দতা ভেদ করে গুলিটি বেরিয়ে গেলো। অর্জুন গুলি চালালো আবার। আবার। আবার।

কান ফাটানো একটা অট্টহাসি। শ্মশান ভূমির দূর দিক চক্রবাল ভেদ করে কেঁপে উঠলো ভূমন্ডল -- "আমি তো সামান্য নিমিত্ত মাত্র। পড়ে থাকা মরা খাই। আসলে যে মেরেছে তাকে ধরতে পারলে ধর। আমায় ধরে কি করবি?"

**************************************************************************************

কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে এসে বসলো অর্জুন। বেওকুফের মতন লাগছে নিজেকে। ধরবো? সত্যিই তো কাকে ধরবো?

রিভলবারটি হোলস্টারে ভরতে ভরতে ভাবতে লাগলো ও। নলটা এখনো গরম হয়ে আছে।

পিছনের বুড়ো বটগাছের পিছনে লুকিয়ে থেকে সবটা শুনেছে ও – কাটা অঘোরীর সাথে ওদের কথোপকথন, গাড়ির ডিকি খুলে সুটকেস বের করা, অঘোরীর সাথে ওদের কথা কাটাকাটি। তারপর ওরা চলে গেলো, সব হিসেব মিটিয়ে।

রেখে গেলো বেশ কিছু প্রশ্ন।

কে অপরাধী?

কলকাতা থেকে ড্রাইভ করে আসা ডিকিতে ভরা সুটকেসে মৃতদেহ নিয়ে আনা নারী আর পুরুষটি -- ওরা খুন করেছে, ওরাই কি দোষী? নাকি যাকে মেরেছে সে নিজেই দায়ী -- পাপের উচিত শাস্তি সে পেয়েছে? নাকি দায়ী আমাদের সমাজের গোপন ঘাতকরা যারা বেগার ট্রাফিকিং, চাইল্ড ট্রাফিকিংয়ের মতন নক্কারজনক পাপ করে চলেছে?

সব গুলিয়ে গেলো অর্জুনের -- না, না....আর যাই হোক কাটা-অঘোরীকে কোনো কিছুর জন্যই দায়ী বলা যায় না।

মৃত পশুর মাংস ভক্ষণকারী চিল-শকুনকে কি আর কিছুর জন্য দায়ী, দোষী বলা যায়?

প্রাচীন শ্মশান ভূমি জুড়ে উশৃঙ্খল মাংসাশী শেয়ালের দল চিৎকার করে উঠলো...

[সমাপ্ত]


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror