কথাটা....কথাটা ঠিক কি ভাবে শুরু করা যায়?
গলাটা হঠাৎ কেন জানি না ভীষণ ড্রাই লাগলো তৃষার।
এখানে এসেও কি কিছুই পাওয়া যাবে না তাহলে?
"ঠিক আছে, কথাটা অন্যভাবে বলি", ভদ্রলোক হেসে কফি-মাগটা এগিয়ে দিলেন তৃষার দিকে -- "আপনি আপনার স্বামীর সাথে কেন কথা বলতে চাইছেন?"
কফি? মাগটা টেনে নিয়ে খুব জোরে একটা চুমুক দিলো তৃষা -- হ্যাঁ, গলাটা ভেজানোর খুবই দরকার ছিল। ভদ্রলোক টানা দেখে চলেছেন তৃষাকে। কিরকম যেন একটা স্ক্যান করা দৃষ্টি। যেন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে ওর সমস্ত সত্ত্বার।
"একটা পাসওয়ার্ড -- ওর ব্যাংকের একাউন্ট পাসওয়ার্ড আমার চাই।"
ভদ্রলোক কফিতে চুমুক দিলেন -- "তার জন্য আমার কাছে আসার কি দরকার ছিল? ব্যাংকের সাথে কথা বলুন। ডেথ সার্টিফিকেট, এভিডেন্স এসব থাকলে খুব সহজেই ওরা আপনাকে সাহায্য করতে পারে। তার জন্য আলাদা করে আমার কি প্রয়োজন ছিল?"
এর উত্তর শুনলে কেউই যে কোনো সাহায্য করবে না।
"কি হলো?" ভদ্রলোক আবার জিগ্গেস করলেন -- "বললেন না তো? এর জন্য আমার সাহায্যের কি দরকার ছিল?"
"মলয় আর আমি আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ডিভোর্সড হয়ে গেছি। ওর আমি লিগাল ওয়াইফ নই - ব্যাঙ্ক এটা শুনলে নিশ্চই আমায় কোনো সাহায্য করবে না, তাই না?", কথাগুলো একটানা বলে গেলো তৃষা।
ভদ্রলোক কফিটা পুরো শেষ করলেন -- "হুম -- আপনার মনে হয় এখনো কি আপনার স্বামীর সাহায্য আপনি নিতে পারেন? আপনি তাঁর পার্থিব সম্পত্তির দাবিদার?"
দীর্ঘস্বাস ছাড়লো তৃষা -- "আমার স্বামীর সাথে আমি দীর্ঘ দশ বছর সংসার করেছিলাম। আমার প্রতি যদি তাঁর কিছু থেকে থাকে..কোনো ফিলিংস, কোনো দুর্বলতা, তাহলে আমার মনে হয় তাঁর উচিত আমায় সাহায্য করার। এখন...এখন, যখন আমার আর্থিক সাহায্যের সর্বাধিক বেশি প্রয়োজন -- সেটা, সেটা কি উনি দেখতে পাচ্ছেন না?", কাকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলল তৃষা, অভিমানের গলায়।
হাসলেন ভদ্রলোক আবার -- "এর উত্তর আমার কাছে নেই, দিদিভাই", পাশের সোফায় বসা বেড়ালটাকে নামিয়ে রাখলেন মাটিতে --"আমি অন্তত গোটা কুড়ি বছর ধরে আত্মা, প্রেতলোক, subtle body, astral self, near death experience -- এসব নিয়ে চর্চা করছি। আজ ও পর্যন্ত মৃত্যুর পর বিষয়ক ইতিবৃত্ত ঠিক ততটাই জানি, যতটা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে জানতাম।"
"মানে?", আবার সেই অনিশ্চয়তার কুয়াশা যেন ঘিরে ধরলো তৃষাকে।
"মানে আর কিছুই না -- মৃত্যু আর জীবনের মাঝে অনেকগুলো সিঁড়ি আছে। অন্ধকারাছন্ন, পিচ্ছিল সিঁড়ি পথ। বিদেহী সেই আত্মা এতগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে আসবে কি না আসবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে -- সে যদি আদৌ আপনার সাথে কথা বলতে চায় তো।"
"আমি....আমি এখনো ঠিক বুঝলাম না...."
"যদি আপনার প্রতি তার মোহ, মায়া না কেটে থাকে....তবে আপনার ডাকে নিশ্চয়ই উনি সারা দেবেন।"
মলয়ের সাথে সেই শেষ রাত। সেই রাতের কথা আজ ও কানে বাজে ওর। ও যা করেছিল -- তা কি আদৌ কোনোদিন ও ক্ষমা করতে পেরেছিলো মলয়?
"আসুন", ভদ্রলোক উঠলেন, বেড়ালটাও পিছু পিছু চলছিল। বাইরে খুব বাজ পড়ছে। বৃষ্টি হচ্ছে -- "এমন দিনে এরকম অভিসার -- খুবই দুঃসাধ্য বুঝলেন?"
ভদ্রলোক একটা ঘুপচি ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মেঝেতে স্যাঁতস্যাতে ঠান্ডা। জানুয়ারিতে এরকম অকাল বৃষ্টি -- এ যেন বর্ষার অকাল বোধন।
"আমার এই প্রেতপুরের সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রয়াস, ভাইব্রেটিং ক্রিস্টাল ব্যবহার করে -- এতে হাই-ফ্রিকুয়েন্সি, উচ্চ-কম্পাঙ্কের স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন হয়, যা কিনা আকাশে জমা বিদ্যুতের সাথে সংঘাত করে। Electrical interference -- যাকে বলে।"
গলাটা শুকিয়ে গেলো তৃষার -- তাহলে কি আজ হবে না? অপেক্ষা করতে হবে আরও? আর যে -- আর যে ফিরে যাবার উপায় নেই....
হ্যাঁ। তৃষা বের করলো ব্যাগ থেকে। মলয়ের ছবি। আজ থেকে আট বছর আগে তোলা। সান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্ট। সেলফির চল তখন সবে শুরু হয়েছে। এটা একটা সেলফি ফটো। ও ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছিল, ওখানে পৌঁছে। "Te amo" -- এটাই লেখছিলো না নিচে?
সে বছরই গৌতমের সাথে ওর দেখা। নতুন করে আবার প্রেমে পড়া -- নিজেকে জানতে পারা। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো মলয়ের কাজ কারবারে। একা একা থাকতে থাকতে। ওর দিবারাত্রি খালি অফিস, ট্রাভেল, মিটিং আর প্রজেক্টের কাজ। ওর জন্য আর কোনো সময়ই দিচ্ছিলো না মলয়।
গৌতম -- গৌতম অনেক সুন্দর। গৌতম অনেক প্রাণবন্ত। অনেক বেশি relevant ওর মনে হয়েছিল।
আসতে আসতে করে দূরে সরে যাচ্ছিলো মলয় ওর থেকে।
এতো দূরে....যে যেদিন মলয় সব জানতে পারলো, সেদিন নিজেই ওর ওই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলো। এক বারের জন্য ও ফিরে তাকায়নি।
আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তৃষা। মলয় যে কি তা কোনোদিনও বুঝতে পারেনি ও।
ফ্ল্যাটটা ওকেই দিয়ে দিয়েছিলো নিজের থেকে। যেন এতো কিছুর পরেও ভোলেনি নিজের কর্তব্য -- তৃষার মাথা গোঁজার আর কোনো জায়গা ও নেই। গৌতম এমন কিছু করেও না যে তৃষাকে নিয়ে কোথাও মাথা গুঁজবে। ছোট সিরিয়ালের এক উঠতি তারকা -- তার আর কত ক্ষমতা হতে পারে।
মলয় এক কথায় যাদবপুরের এতো বড় ফ্ল্যাটটা দিয়ে দিয়েছিলো ওকে।
অদ্ভুত এক মানসিকতা, তাই না?
"কি ম্যাডাম -- কি ভাবছেন এতো?"
এক ঝটকায় ঘিঞ্জি ঘরে এসে উপস্থিত হলো তৃষা।
ঘরে একটা অদ্ভুত আলো, ফটোটা রেখে আলো ফেলেছে ওটার ওপর। একটা জটিল তারের বেষ্টনী পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আছে এক কালো রঙের জটিল বৈদ্যুতিন য্ন্ত্রকে। সেটার অগ্রভাবে কাশফুলের মতন ফুটে আছে গুনে গুনে পাঁচখানা, ঝাঁ চকচকে স্ফটিক প্রিজম।
"পাঁচ খানা প্রিজম?", কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেসা করলো তৃষা। অবিশ্বাস আর অজানা ভয় একটা ওর গলায় যেন ওর স্বর রোধ করে দিচ্ছে।
ভদ্রলোক আবার হাসলেন -- "পঞ্চ-ভুতকে রিপ্রেসেন্ট করে, বুঝলেন? ধরিত্রী, বাতাস, অগ্নি ও জলের সীমানা পেরিয়েও আরেকটা মাত্রা আছে। Oblivion -- অজ্ঞাত। ব্যোম। ইথার। আমার এই পাঁচটা প্রিজম সেই পঞ্চ ভুতের ভাইব্রেশনকে ক্যাপচার করে এই প্রিজম-গুলোর তারের বেস্টনীর ভেতর দিয়ে এই বাল্বগুলোতে এসে জানান দেয় -- বিদেহীর বিমূর্ত উপস্তিতি।"
এসব কি সত্যিই হয়? এসব কি সত্যিই সম্ভব? সারা পৃথিবী যে উত্তর দিতে পারেনি যুগযুগান্তর ধরে, তা এক সামান্য তারের কুন্ডলি কি আর বলতে পারে?
কিন্তু -- কিন্তু ওর কাছে এ ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই।
"আসুন -- ওকে ডাকি। ফোকাস করুন ফটোটার ওপর -- আপনার সমস্ত চিন্তা ফোকাস করুন ফটোটার ওপর। মনে করুন ওনার কথা। মনে পড়ছে?"
মনে পড়ছে? মনে পড়ছে কি? মায়া -- বড় মায়া যে.....ওর কথায়, ওর প্রসঙ্গে, ওর প্রশ্নে...মলয়....আজ এতো বছর পর যখন গৌতম ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো, তখন ওর মনে পড়লো মলয়ের কথা।
বড় স্বার্থপর ও....ঘেন্না হচ্ছিলো নিজের ওপর।
মলয়...মলয় শুনতে পাচ্ছ কি?
"মলয় -- আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমাদের কথা?", ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, যেন ঘোরের মধ্যে বলছেন -- "দেখুন -- দেখুন কে এসেছে আপনার সাথে কথা বলতে। কথা বলবেন না?"
"মলয়? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমাদের?"
হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় করে আওয়াজ। কালো রঙের যন্ত্রটার সাথে লাগানো বাল্ব-গুলো জ্বলে উঠলো দপ করে।
কেউ....কেউ যেন আছে ঘরে, তাই না?
তৃষার ঘাড়ের কাছে এক ঠান্ডা হওয়ার স্রোত -- হঠাৎ কেন জানি না ভীষণ নগ্ন বলে মনে হলো তৃষার: exposed....
"মলয়?", ভদ্রলোক আবার হাঁক পাড়লেন -- "Are you with us?"
কড়কড় করে একটা আওয়াজ কালো যন্ত্রটার স্পিকার প্যানেলে -- কে যেন কিছু বলছে। খারাপ মাইক্রোফোনে কথা বললে যেমন লাগে, ঠিক সেরকম।
t;">পরিষ্কার কথাটা শুনতে পেলো তৃষা। বাল্বগুলো জ্বলছে দপদপ করে।