হালকা একটা ঝটকা লাগতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। কোনও স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বড্ড গরম! এর মধ্যে আবার নিদ্রাদেবীর সদয় হওয়ার সম্ভাবনা কম, অগত্যা চোখ কচলে উঠে বসলাম। এইটা কোন জায়গা? বেশ ব্যস্ত কোনও স্টেশন বলেই মনে হচ্ছে। এত রাতেও ভীড় মোটামুটি ভালই। টাইম দেখলাম মোবাইলে, রাত একটা বেজে পাঁচ। গলাটা শুকিয়ে এসেছে, একটু জল পেলে বেশ ভাল হতো। কিন্তু ব্যাগ থেকে বোতলটা বার করে দেখি, তাতে আর একবিন্দু জলও অবশিষ্ট নেই। জানালার ঠিক সামনেই পানীয় জলের একটা কল চোখে পড়ল। বোতলটা নিয়ে চটপট নেমে পড়লাম প্ল্যাটফর্মে।
মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি পড়েছে, গোটা প্ল্যাটফর্ম এখনও জবজবে ভিজে। আরেকটু হলেই পা হড়কে যাচ্ছিল। সাবধানে টাল সামলে ট্রেন থেকে নামলাম। আকাশ এখনও গাঢ় কালো মেঘে ঢাকা। যে কোনও মুহূর্তে আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে পারে। যাই, তাড়াতাড়ি বোতলটা ভরে নিই।
ধ্যাৎ! কল থেকে সুতোর মতো জল পড়ছে। সামান্য দুই লিটারের একখানা বোতল ভরতেই যেন পেরিয়ে যাচ্ছে একযুগ সময়। কিন্তু বোতলটা ভরে পিছনে ঘুরতেই মাথায় বজ্রপাত হল। ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে একটু-একটু করে এগোতে শুরু করেছে। এক হাতে কোনওমতে বোতলটা সামলে দৌড় দিলাম ট্রেনের দিকে। তবে বাধ সাধল বৃষ্টিস্নাত প্ল্যাটফর্ম। তাড়াতাড়ি ছুটতে গিয়ে পা'টা গেল পিছলে। অতগুলো লোকের সামনে দু-তিনটে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম। মাথা তুলে দেখি, ট্রেনের শেষ বগির লাল আলোটা আমাকে ভেংচি কেটে ক্রমশঃ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এ তো ভারি আতান্তরে পড়া গেল! ট্রেনে আমার সমস্ত লাগেজ পড়ে আছে। কী করি এখন? একবার স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলে দেখব? উফ্....যত্তসব উটকো আপদগুলো দেখছি আমারই কপালে এসে জোটে!
তবে আসল ধাক্কাটা মনে হয় এখনও খাওয়া বাকি ছিল। হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এইটা আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কিছুক্ষণ আগেই তো যথেষ্ট লোকজন ছিল, কোথায় গেল তারা সবাই? প্ল্যাটফর্মের এপার থেকে ওপার সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। আমি একাই এখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। এতগুলো লোক সব কর্পূরের মতো উবে গেল নাকি? এ ছাড়াও আমার একটা জিনিস স্পষ্ট মনে আছে, স্টেশনে প্রায় পাঁচ-ছ'টা প্ল্যাটফর্ম ছিল। এখন শুধুমাত্র দুটো....একটা আপ লাইন, আরেকটা ডাউন। স্টেশন চত্বরের ঝলমলে টিউবলাইটগুলো উধাও। এখন তার জায়গায় টিমটিম করে জ্বলছে ল্যাম্প-পোস্টে টাঙানো কেরোসিনের বাতি। তাতে কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না, উল্টে সৃষ্টি হচ্ছে এক অদ্ভুতুড়ে হলুদ আলো-আঁধারি। এক নিমেষে আকাশের মেঘও সরে গেছে। এই আকাশ একদম পরিষ্কার, সেখানে আবার সুন্দর একফালি নীল চাঁদও উঠেছে। অমন উজ্জ্বল চাঁদ আমি জীবনে দেখিনি। ঠিক যেন কোনও অদৃশ্য পুরুষ এক বৃহৎ রূপালী ঘড়ার থেকে পৃথিবীর বুকে জ্যোৎস্নার নির্মল ধারা ঢেলে চলেছে। সেই গলিত জোছনা আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে আমার গায়ে....শীতল চাঁদিনী ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার সর্বাঙ্গ।
ধপ্ করে একটা পাথরের বেঞ্চি'তে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। কী হল ব্যাপারটা? মাটিতে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেলাম বুঝি? এমনধারা মতিভ্রম তো হওয়ার কথা নয়! সদ্য ভরা বোতলটা থেকে জল নিয়ে চোখেমুখে ছেটালাম। নাহ্! সব ঠিকই দেখছি। আমার চোখের সামনেই অন্ধকারাচ্ছন দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মটা একাকী পড়ে আছে। মোবাইল বের করে আরেকবার সময়টা দেখলাম....একটা বেজে পাঁচ। স্ট্রেঞ্জ! এতক্ষণ ধরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ সময়টা এক মিনিটও এগোয়নি! ফোনটাও বিগড়াল নাকি? নেটওয়ার্ক তো একদম শূন্য। কোন কুক্ষণে যে বোনের বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য বেরিয়েছিলাম!
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট'টা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েকটা লম্বা টান দিতেই মাথাটা কিঞ্চিত হালকা বোধ হল। বেঞ্চে মাথা হেলিয়ে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেইটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম, ঠিক তখনই ট্রেনের হর্নে চমক ভাঙল। কেমন অদ্ভুত সেই হর্নের ধ্বনি, ঠিক যেন শিস্ দেওয়ার মতো এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ। দূরে ইঞ্জিনের আলো দেখতে পাচ্ছি। কাছে এল ট্রেনটা....একটা মালগাড়ি। কিন্তু ইঞ্জিনটা কীরকম? ডিজেল বা ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন নয়, এইটা তো সেই আদ্যিকালের স্টীম লোকোমোটিভ! এই রুটে যে আজও স্টীম ইঞ্জিন চলে তা তো জানতাম না। একরাশ কুচকুচে কালো ধোঁয়া এবং কয়লার মিহি গুঁড়ো ছড়িয়ে আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল ইঞ্জিনটা।
মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে, কয়লা বোঝাই করা মালগাড়িটা আবার ঘটাং-ঘটাং শব্দ তুলে স্টেশন থেকে বিদায় নিল। না, এভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। একবার স্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বলতেই হবে। মনে হচ্ছে সবই অচেনা; যেন কালচক্রের কোনও গুপ্ত চোরাপথ ধরে আমি এসে পড়েছি সত্তর-আশি বছর আগেকার সময়ে। বেঞ্চি ছেড়ে উঠতে যাব, তখনই প্ল্যাটফর্মের অপর প্রান্ত থেকে একটা ক্ষীণ সবুজ আলো চোখে পড়ল। রেলের পোশাক পরা দুজন লোক হাতে সিগন্যাল-বাতি দুলিয়ে আমার দিকেই হেঁটে আসছে। একজন বেশ লম্বা, ফর্সা। আরেকজন কিছুটা বেঁটে, রোগা।
আমার কাছে এসে লম্বা লোকটি দরাজ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন-
- "এত রাতে আপনি এখানে একা-একা কী করছেন? কোথায় যাবেন?"
- "আমি ট্রেন মিস্ করেছি। স্টেশন মাস্টারের ঘরটা একটু দেখিয়ে দেবেন?"
- "আমিই এখানকার স্টেশন মাস্টার, সমরেশ দত্ত।" ভদ্রলোক নমস্কার করলেন, "আর এ হল এখানকার পয়েন্টসম্যান মনোহর। আজ রাতের শেষ মালগাড়িটা পাস করিয়ে আমরা কোয়ার্টারে ফিরছি।"
আমিও দুজন কে প্রতিনমস্কার করে জিজ্ঞাসা করলাম-
- "আচ্ছা এখানে কি বৈদ্যুতিক আলো নেই? স্টেশনের ল্যাম্প-পোস্টে কেরোসিনের বাতি, আপনাদের হাতেও লণ্ঠন...."
দুজনে হতভম্বের মতো একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
- "কী বললেন আজ্ঞে, বৈদ্যুতিক আলো? বলেন কী বাবু!" খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে পয়েন্টসম্যান মনোহর নীচু গলায় বলল, "বৃষ্টি পড়লে আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় বলে জানতাম। কিন্তু মেঘের বিদ্যুৎ দিয়ে লণ্ঠন জ্বালানো যায়....এমন পাগলের প্রলাপ তো কস্মিনকালেও শুনিনি!"
- "আমি বুঝেছি আপনি কী বলতে চাইছেন," মাঝখানে ফোড়ন কাটলেন সমরেশ বাবু, "আপাতত ওইসব বিলাসিতা বড়-বড় শহর পর্যন্তই এসেছে। কিন্তু এই এঁদো গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিক আলো আশা করাটা চরম মূর্খামিই বটে। হাহাহা!"
নিজেকে একাধারে পাগল আর মূর্খ বললে কার আর মাথার ঠিক থাকে? আমারও গা-পিত্তি জ্বলে উঠল। তবে এইমুহূর্তে আমি পড়েছি মহাফাঁপরে। এমন দুর্যোগে এই দুজনই আমার কাছে আশার একমাত্র কিরণ। এদের চটালে চলবে না। তার চেয়ে বরং আলোর প্রসঙ্গ বাদ দেওয়াই শ্রেয়।
- "সমরেশ বাবু, জায়গা'টার কী নাম?"
স্টেশন মাস্টার দূরে আঙুল দেখালেন। প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে লোহার এক ক্ষয়িষ্ণু হলুদ বোর্ড। তাতে ঘষা-ঘষা কালো হরফে স্টেশনের নাম লেখা। কেরোসিন বাতি আর জ্যোৎস্নার মিশ্রিত আলোয় অতি কষ্টে পাঠ করলাম নামটা:- বকুলডাঙা হল্ট।
- "তা মশাইয়ের কোথায় যাওয়া হচ্ছিল শুনি?" সমরেশ বাবু আবার প্রশ্ন ছুঁড়লেন, "আরও কী একটা বলছিলেন....ট্রেন মিস্ করেছেন না কী যেন?"
- "হ্যাঁ। আমি যাচ্ছিলাম হাওড়া, আমার বোনের বিয়ে অ্যাটেন্ড করার জন্য। বোতলে জল ভরতে নেমেছিলাম এখানে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গাড়িটা ছেড়ে দেয়। আমার অনেক লাগেজ ওই ট্রেনেই রয়ে গেছে। দেখুন না, যদি সেগুলো কোনওভাবে উদ্ধার করা যায়।"
প্রৌঢ় স্টেশন মাস্টার খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে কী একটা ভাবলেন।
- "দেখুন, এত রাতে তো আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। কাল সকালে এসে আমি নাহয় টরেটক্কার মাধ্যমে হাওড়ার স্টেশন মাস্টার কে একখানা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেব'খন। দেখি, আপনার সব মালপত্রগুলো রিকভার করা যায় কি না।"
- "টেলিগ্রাম কেন? আপনাদের কাছে মোবাইল নেই বুঝি? একবার ওনাকে মোবাইলে সবকিছু জানিয়ে দিলেই তো হয়।"
- "মোবাইল? সেইটা আবার কী?"
- "মোবাইল মানে মোবাইল....আরে মোবাইল ফোন!"
দুজনে আবার বেশ কিঙ্কর্তব্যবিমূঢ় চোখে আমার দিকে তাকাল।
- "মশাই কি নেশা-টেশা করেন? না মানে...."
- "ধুত্তোর! আমাকে দেখে আপনাদের নেশাখোর মনে হয় নাকি? একটা সমস্যায় পড়েছি। কোথায় আপনি সেটার নিরসন করবেন, তা না...."
- "বুঝেছি বুঝেছি। চিন্তা নেই। আজ রাতটা আপনি আমার ঘরেই কাটিয়ে দিন। ওখানে গ্যাংম্যান হরিয়া আছে, ভারি মজার মানুষ! ভোরের আলো ফুটতে আর বড়জোর তিন-চার ঘণ্টা বাকি। এইটুকু সময় দিব্যি হরিয়ার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিন। তারপর সকালে আমি এসে কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।"
প্ল্যাটফর্মে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার পর চোখের সামনে সমস্ত দৃশ্য এক লহমায় পাল্টে গেছে; এই কথাটা আর স্টেশন মাস্টারের কাছে ভাঙলাম না। বৈদ্যুতিক আলো আর মোবাইল ফোনের কথা শুনে এরা আমার মানসিক ভারসাম্য সম্পর্কে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে পড়েছে। এরপর এইসব গালগল্প শুনলে এরা দুজন মিলে নির্ঘাত আমাকে কোনও রাঁচি-গামী ট্রেনে তুলে দেবে!
- "আরে কী হল মশাই! কী এত আকাশকুসুম ভাবছেন? আসুন আমার সঙ্গে, রাতটা আমার ঘরেই কাটাবেন।"
**************
টালি দেওয়া ছিমছাম ছোট ঘর। কোণায় একজন লোক আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে বসে আছে। কুলুঙ্গির উপর মিটমিট করে জ্বলতে থাকা কুপির আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
- "হরিয়া!" সমরেশ বাবু ওকে উদ্দেশ্য করে হাঁক পাড়লেন, "বাবু সাহেব আজ রাত ইয়াহিঁ রুকেঙ্গে। ইনকা ধ্যান রাখনা।"
চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটা ইতিবাচক মাথা নাড়ল। সমরেশ বাবু আর মনোহর বিদায় নিলেন। আমিও ঘরের একপাশে রাখা কাঠের প্যাঁটরার উপর বেশ গুছিয়ে বসলাম।
- "বাবু কি কোনও ঝামেলায় পড়েছেন?"
হরিয়ার গলা শুনে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এমন কর্কশ স্বর জীবনে কখনও শুনিনি। যেন আস্ত একখানা স্টীম ইঞ্জিন গলায় পুরে রেখেছে।
- "বললেন না তো বাবু, কোনও ঝামেলা হয়েছে কি?"
খানিক ইতস্তত করে ওকে সমস্ত ঘটনা প্রথম থেকে খুলে বললাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হরিয়া বলল-
- "আপনি চিন্তা করবেন না। টেশন্ বাবু বহুত কাম কা আদমী আছে। কিছু একটা উপায় জরুর বের করবেন।"
কথায়-কথায় জানলাম, হরিয়ার ভিটে বিহারের পূর্ণিয়া জেলায়। পেটের দায়ে কুড়ি বছর পূর্বে এসেছিল এই বঙ্গদেশে। স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়ে আজও পূর্ণিয়া'তেই থাকে। বছরে একবার করে হরিয়া নিজের গ্রামে যায়। এছাড়া ওর সারাটা বছর কাটে এই ছোট্ট হল্টেই। ছোট স্টেশনে স্টাফ খুবই কম, গ্যাংম্যানের কাজও যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণ। তাই বেশি কামাই করা চলে না।
সমরেশ বাবু ঠিকই বলেছিলেন। কণ্ঠস্বর ভয়াবহ হলেও লোকটা কিন্তু সত্যিই ভারি মজার। এতদিনে হিন্দি মেশানো ভাঙাচোরা বাংলা বলতেও শিখে গেছে হরিয়া। আপাতদৃষ্টিতে হরিয়া কে দেখে মোটামুটি বিশ্বাসী বলেই মনে হল। আসল কথাগুলো কি একে একবার বলে দেখব? তারপর যা থাকে কপালে!
- "আচ্ছা হরিয়া, একখানা কথা তোমাকে বলতে চাই। কথা দাও স্টেশন বাবু বা মনোহর কে সেই কথা বলবে না?"
- "কৌন-সা বাত বাবু?"
সবকিছু খুলে বললাম। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর থেকে যা-যা ঘটেছে....সব। হরিয়া নীরবে পুরোটা শুনল। অন্ধকারে মুখটা পরিষ্কার ঠাহর না হলেও, কুপিবাতির ম্লান আলোয় বুঝলাম লোকটা ঠোঁট বেঁকিয়ে অল্প হাসল।
- "ইয়ে বকুলডাঙা হল্ট হ্যায় বাবু। ইহাঁ এমন আরও বহুত জিনিস দেখতে পাবেন। দেখছেন না, রাতে এই হরিয়া মাহাতো ছাড়া টেশনে এক ভি আদমী নেই? এক ভিখারি তক্ নেহি! সাধেই কি টেশন্ বাবু আর মনোহর রাতের আখরি মালগাড়ি পার করিয়ে এখান থেকে চম্পট দেয়? এই সময় ইহাঁ কুত্তা-বিল্লিও ঘোরে না, ইন্সান তো দূর কী বাত!"
- "কেন?" আমি ঢোঁক গিললাম, "কোনও ভয়-টয় আছে নাকি?"
- "ভয়? হাঁ, ভয়ই বলতে পারেন। পহিলে এইটা একটা আম টেশনের মতোই ছিল। কিন্তু একটা দুর্ঘটনার পর থেকে এই টেশনে সব কুছ বদলে যায় বাবু....সব কুছ।"
- "কীরকম দুর্ঘটনা?"
- "পাঁচ সাল পহিলে কা ঘটনা। ইহাঁ সে থোড়া দূর পে রেলের ক্রসিং আছে। উহাঁ রেললাইনে কিছু একটা গড়বড়ি হয়েছিল। তখনকার টেশন্ বাবু একজন গ্যাংম্যান অউর একজন পয়েন্টসম্যান কে নিয়ে সেইটা ঠিক করাতে গেছিল। সব কাজ ঠিকঠাক করে উ তিনো লোগ লাইনের ধার দিয়ে প্যায়দাল টেশনে ফিরছিল। কিন্তু এক জায়গায় এসে উ তিনো আচানক রেলে কাটা পড়ে যায়। ওদের কাটা পড়াটাও বহুত আজিব ছিল বাবু। যারা সামনে-সে দুর্ঘটনাটা দেখেছিল, তারাই বলেছে যে উ তিনো লাইনের অনেক দূর দিয়েই হাঁটছিল। লেকিন কোনও শয়তানী শক্তি যেন তিনো কে ধাক্কা মেরে লাইনের উপর ফেলে দিয়েছিল। উল্টোদিক দিয়ে আসছিল ডাউন মেইল। ব্যাস! এক হি ঝটকে মে তিনো কা খেল খতম। উস্ ঘটনা কে বাদ সে ইহাঁ রাত কে সময় বহুত কুছ দেখতে পাওয়া যায়।"
এতক্ষণে আমি রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছি। কী বলছে হরিয়া? আগেই ঝামেলার অন্ত ছিল না, এখন আবার ভূতের দৌরাত্ম্য?
- "আপনিও ওদের দেখেছেন বাবু, শুধু চিনতে পারেন নাই। উ লোগ কিসিকা নুকসান করে না বাবু। শুধু নিজেদের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয়।"
- "দেখা পেয়েছি কিন্তু চিনতে পারিনি....মানে? বলো কী হে হরিয়া! কাদের কথা বলছ তুমি? ওরা কারা?"
- "ওরা কারা?" নিঃশব্দে হাসল গ্যাংম্যান হরিয়া, "ওরা হল সমরেশ বাবু, মনোহর আর হরিয়া মাহাতো।"
একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে হরিয়ার গা থেকে চাদরটা খুলে পড়ল। কুপিবাতির নির্বাণোন্মুখ শিখার স্বল্প আলোয় পরিষ্কার দেখলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর প্রেতমূর্তি। ডান হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে কাটা পড়েছে। সেখান থেকে এখনও চুঁইয়ে পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা তাজা রক্ত। মাথাটা একদিকে বিশ্রীভাবে থেঁতলে গেছে। ভাঙাচোরা দাঁতগুলোর ফাঁক দিয়ে ঝুলে পড়েছে জিভটা। এছাড়াও শরীরে অজস্র জায়গায় কাটাছেঁড়া। হরিয়া হাসছে....খলখল করে হাসছে! ঠিক তখনই কুপিবাতির শিখাটাও দুইবার দপদপ করে নিভে গেল। পুরো ঘরটা তলিয়ে গেল অন্ধকারের অকূল সমুদ্রে।
এতক্ষণে যেন আমার সম্বিত ফিরল। গা ঝাড়া দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে অন্ধের মতো ছুট লাগালাম। পিছন থেকে তখনও ভেসে আসছে হরিয়ার কণ্ঠস্বর, এখন যেন ওর গলাটা আরও কয়েকগুণ বেশি কর্কশ শোনাচ্ছে:-
"ভাগনে সে কুছ নেহি হোগা। টেশন্ বাবু জিন্দা নেহি বাচ্ পায়া, না মনোহর অউর নাহি ম্যায়। ইহাঁ সে কোই জিন্দা বাচ্ কে ওয়াপিস্ নেহি জাতা বাবু....তু ভি নেহি জায়েগা!"
কতক্ষণ ধরে ওই অচেনা মফঃস্বলের পথেঘাটে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে বেড়িয়েছি, তার খেয়াল নেই। ছুটতে-ছুটতে এক জায়গায় এসে ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লাম। পা'দুটো আর সঙ্গ দিচ্ছে না। মনে হয় এর চেয়ে বেশি ছুটলে মুখে রক্ত উঠে মরব। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কথা বলার শক্তিটুকুও আর নেই। অনতিদূরেই চোখে পড়ল একটা আলো। কোনওমতে ক্লান্ত শরীরটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চললাম সেইদিকে।
আরে! এইটা তো একটা লেভেল ক্রসিং। এখানেও কোনও জনমনিষ্যি নেই। এই ক্রসিংয়ের কথাই কি বলছিল হরিয়া? দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, হঠাৎ ঘাড়ে কারও তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিঠে এসে পড়ল হাতুড়ির মতো এক প্রবল ধাক্কা। টাল সামলাতে পারলাম না....হুড়মুড়িয়ে সোজা গিয়ে পড়লাম রেললাইনের উপরে। উঠে বসতেও পারছি না, অদৃশ্য কেউ যেন বুকের উপর চেপে বসে জোর করে শুইয়ে রেখেছে আমাকে। শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করেও সেই বায়বীয় সত্তা কে বুকের উপর থেকে ঠেলে ফেলা যাচ্ছে না। ঠিক তখনই দূর থেকে কানে এল ট্রেনের হর্ন। মুখে আছড়ে পড়ল ইঞ্জিনের চোখ ধাঁধানো আলো। দুর্নিবার গতিতে আমার দিকেই ধেয়ে আসছে একটা মেইল ট্রেন........
**************
চোখেমুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা লাগতেই হুঁশ ফিরল। ভোরের আলো ফুটেছে। আমি বকুলডাঙা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই পড়ে আছি। পরম যত্নে আমার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছেন একজন পুরুষ। ভাল করে তাঁর মুখের দিকে তাকাতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। একি! বাবা, তুমি?
- "কী রে খোকা? ভেবেছিলি শ্মশানে দাহ করে এসেছিস বলে তোর এই বাপটা চিরকালের জন্য উবে গেছে?"
- "তবে যে আমি....ক্রসিং....রেললাইন....ট্রেন!!"
- "তুই ভয়ের চোটে জ্ঞান হারিয়েছিলি, ভীতুর ডিম কোথাকার! এখনও বুঝতে পারলি না? আরে এখন তো তুই আমাদের জগতে চলে এসেছিস রে! এখানে কেউ ট্রেনে কাটা পড়ে না। আগুন আমাদের পোড়াতে পারে না। তলোয়ার আমাদের কাটতে পারে না। আমরা অবিনশ্বর!"
এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, বাবার পাশে আরও তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। স্টেশন মাস্টার সমরেশ দত্ত, পয়েন্টসম্যান মনোহর আর গ্যাংম্যান হরিয়া। সমরেশ বাবু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন-
- "আপনি জানেন, প্ল্যাটফর্মে পিছলে পড়ার পরেই সমস্ত দৃশ্য কেমনভাবে ভোজবাজির মতো বদলে গেছিল? কী ভাবে এক নিমেষে অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে গেছিলেন আপনি? আমি দিচ্ছি উত্তরটা, এদিকে আসুন।"
সমরেশ বাবু আমার হাতটা ধরে নিয়ে এলেন প্ল্যাটফর্মের ধারে। লাইনের উপরে এক জায়গায় আঙুল দেখালেন তিনি।
- "ওই দেখুন। কিছু বুঝতে পারছেন?"
দুটো লাইনের মাঝখানে পড়ে রয়েছে একটা দলা পাকানো, রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড। ট্রেনের চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে এমনই অবস্থা হয়েছে....লাশটা এখন শনাক্ত করাই মুশকিল। তবে লাশের রক্তমাখা ডান হাতের মধ্যমায় জ্বলজ্বল করা হীরের আংটিটা দেখে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, এ মৃতদেহ আসলে কার।
এবার একটু-একটু করে সবটা স্বপ্নের ঘোরের মতো মনে পড়ছে। প্ল্যাটফর্মে নেমে কল থেকে বোতল ভরছিলাম। ততক্ষণে ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছিল। দৌড়ে বগি'তে উঠতে গেছিলাম। কিন্তু ভেজা প্ল্যাটফর্মে পা হড়কে সোজা গিয়ে পড়েছিলাম ট্রেনের তলায়। মুহূর্তের মধ্যে লোহার চাকাগুলো খণ্ড-খণ্ড করে দিয়েছিল আমার শরীরটা।
- "ওয়েলকাম টু আওয়ার ইউনিভার্স, মাই সন্!" বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, "মৃত্যুর পরের এই সমান্তরাল জগতে তোকে আমরা স্বাগত জানাই।"
**** সমাপ্ত ****