সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Thriller Action

4.5  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Thriller Action

বন্দিনী

বন্দিনী

13 mins
138


                              (প্রথম পর্ব)

কিউরিও শপে জিনিসটা দেখেই মনে ধরে গেছিল আমার। পুরনো আমলের একটা আয়না। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট মতো। পালিশ করা গাঢ় কালচে-বাদামি মাহোগনি কাঠের ভারী ফ্রেমে বেষ্টিত। তার ভিতর থেকে ঝকঝকে কাঁচটা থেকে-থেকে ঝলমল করে উঠছে।
- "খুব ভাল জিনিস স্যার," কিউরিও শপের মালিক এক গাল হেসে বললেন, "খাঁটি নবাবী আমলের আইটেম। প্রথমে এই আয়নাটা লক্ষ্ণৌ'র নবাবদের সম্পত্তি ছিল। নবাবী রাজ উঠে যাওয়ার পর বহুদিন ধরে এর মালিকানা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তারপর অনেক হাত ঘুরে....আজ স্বাধীনতার এত বছর পর শেষমেশ এর জায়গা হয়েছে আমার এই দোকানে।"

কাঁড়িখানেক টাকা খরচ করে জিনিসটা কিনেই ফেললাম। কিউরিও শপ থেকেই লোক এসেছিল, তাদের কে বলে ভারী আয়নাটা আমার শয়নকক্ষে সেট করিয়ে দিলাম। বাহ্....চমৎকার! এইবার আমার এই ঘরের আন্তরিক সজ্জাটা যেন পূর্ণতা পেল। এমনিতেই আমি অ্যান্টিকের পোকা; আদ্যিকালের সব জিনিসপত্র দিয়ে ঘরটা পুরো ঠাসাঠাসি। তাও এতদিন ধরে কোথাও যেন মনে হতো, কিছু একটার অভাব রয়ে গেছে আমার সংগ্রহের তালিকায়। আজ সেই অভাবটা ঘুচে গেল। এতগুলো টাকা এক ধাক্কায় ভস্মীভূত করার দুঃখটাও মুহূর্তের মধ্যেই উবে গেল....তার জায়গায় জন্ম নিল এক অনাবিল তৃপ্তি।

দুই দিন সবকিছু একদম ঠিকঠাক চলল। তৃতীয় দিন রাতে আমাদের বাড়ির কাজের লোক বিনয় দা আমার শয়নকক্ষে এসে হাজির।
- "কী হল বিনয় দা?"
- "দাদাবাবু, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারব না।"
- "সেকি! কিন্তু কেন?"
- "রাতের বেলা মনে হয় কেউ যেন আমার ঘরের উপরে ছুটে বেড়াচ্ছে। সারারাত ধরে ধুপধাপ শব্দ পাই। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় কেউ যেন ভারী কিছু একটা জিনিস ঘরের মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।"

বলে কী বিনয় দা! তার ঘরের ঠিক উপরেই তো আমার এই শোওয়ার ঘর। অর্থাৎ সে যদি উপর থেকে কোনও শব্দ পায়, তার উৎস নির্ঘাত আমার এই শোওয়ার ঘর থেকেই। কিন্তু আমি তো রাতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করি না। তা ছাড়া মাঝরাতে কোনও ভারী জিনিস নিয়েও বা টানাটানি করতে যাব কেন? সারাদিন অফিসে খেটেখুটে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরি। এসে দুটো নাকে-মুখে গুঁজেই শুয়ে পড়ি। এক ঘুমে কখন যে রাত কাবার হয়ে যায় বুঝতেই পারিনা। তাহলে বিনয় দা এইসব কী বলছে?

সেই বারের মতো তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। বুড়ো মানুষ; বার্ধক্যে এমনধারা মনের ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তারপর তিন-চার দিন একদম নির্বিঘ্নে কেটে গেল। সেদিন শনিবার। পরের দিন ছুটি, তাই সকালে তাড়াতাড়ি উঠে অফিস যাওয়ার বালাই নেই। সেই জন্য বেশ রাত পর্যন্ত জেগে ফোন ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ এক মৃদু অথচ স্পষ্ট 'ঠক ঠক' শব্দে আমার ধ্যানভঙ্গ হল। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম। কোথায় কী? সবকিছু তো স্বাভাবিক আছে। নিজের উপর খানিকটা হাসিই পেল। আবার মোবাইলে মনোনিবেশ করলাম।

প্রায় মিনিট পনেরো পর আবার সেই একই 'ঠক ঠক' আওয়াজ। এইবার একটু জোরে। মন দিয়ে কান খাড়া করে শুনলাম, ঠিক যেন কেউ শক্ত কাঁচের উপর আঙুল দিয়ে টোকা মারছে। আমার খাটের মাথার দিকে একটা বড় জানালা আছে বটে। তবে সেটার কাঁচে কেউ আঘাত করবে, এইটা অসম্ভব। কারণ আমার এই ঘরটা তিনতলায়। তাও একবার উঠে জানালাটা ভাল করে যাচাই করে নিলাম। সবই ঠিক আছে। জানালার বাইরে দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই মধ্যরাতেও তিলোত্তমা কলকাতার বুকে গাড়ির প্লাবন বয়ে যাচ্ছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খাটে এসে বসলাম। মেজাজটা বেজায় খিঁচড়ে গেল। ধুর! আর ফোন ঘাঁটতে ভাল লাগছে না। আলোটা নিভিয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। একটা উগ্র গন্ধ নাকে আসতেই খাটে সোজা হয়ে উঠে বসলাম। গন্ধটা কেমন অন্য ধরণের। ঠিক যেন....ঠিক যেন কোনও মাদ্রাজি ধূপের কড়া গন্ধ গোটা ঘরময় ভুরভুর করছে। ফোনে সময় দেখলাম, রাত তিনটে। মা-বাবা তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার! এত রাতে আবার কে ধূপ জ্বালাল তাহলে?

বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস জল খেতে যাব, এমন সময় আবার সেই 'ঠক ঠক' শব্দ। এইবার আওয়াজটা এতটাই জোরে আর আকস্মিক ভাবে হল, পুরো ঘরটা যেন সেই শব্দে গমগম করে উঠল। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এসি'র মধ্যেও আমার কপালে রীতিমতো স্বেদবিন্দু জমতে শুরু করেছে। না, এভাবে চলতে পারে না। শব্দ থাকলে তার উৎস তো থাকবেই।

কান খাড়া করে মনোযোগ দিয়ে শুনছি। এখনও সেই অস্বস্তিকর ঠক-ঠক শব্দটা অনবরত হয়ে চলেছে। হঠাৎ আমার চোখটা চলে গেল সেই আয়নাটার দিকে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক তাই তো! আওয়াজটা ওইদিক থেকেই আসছে না? একটু ভয়ে-ভয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকার ঘরের এক কোণে আমার শখের আয়নাটা....দু'শো বছরের নবাবিয়ানার কালো ইতিহাস নিজের মধ্যে লুকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ সম্মোহিতের মতো নিজের প্রতিবিম্বর দিকে চেয়ে রইলাম। এই আয়না বিগত এতকাল যাবৎ কতরকম অন্যায়-অত্যাচার, ষড়যন্ত্র-প্রতিহিংসার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আজ এই আয়না এখন আমার মালিকানায়; ইন্দ্রজিৎ সরকারের দখলে এই অমূল্য রাজসিক জিনিসটা! এতদিন ধরে অ্যান্টিক শপের চক্কর কেটে অথবা বিভিন্ন নীলামে অংশগ্রহণ করে বহু পুরনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছি। কিন্তু জীবনে যেন প্রথমবার এই আয়নাটা পেয়ে নিজেকে এতটা গর্বিত মনে হচ্ছে।

আবার কানের খুব কাছে সেই ঠক-ঠক শব্দ হতেই আমার চিন্তার জাল ছিন্ন হল। হঠাৎ কী মনে হল জানিনা, নিজের কানটা আমি আয়নার কাঁচে পেতে দিলাম। এইবার স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কাঁচের ঠিক ওপার থেকেই সেই শব্দটা ভেসে আসছে....ঠক ঠক ঠক ঠক! একটা শিরশিরে স্রোত যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এক ঝটকায় আয়নার কাছ থেকে সরে এলাম। মুহূর্তের মধ্যেই যেন রাতের চাপ-চাপ আঁধার এক অজানা ভয়ের রূপ নিয়ে আমার মস্তিষ্কটা আচ্ছন্ন করে তুলল। তাড়াতাড়ি বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দিলাম। ঘুম আর হল না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করেই কেটে গেল।

তিন-চার দিন পরের কথা। প্রতিদিন একটু-একটু করে এই অলৌকিক উপদ্রব যেন বেড়েই চলেছে। আগে ওইসব আওয়াজগুলো শুধু রাতে শুনতাম। এখন মাঝেমধ্যে দিনের বেলাতেও শুনি। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার, এই শব্দগুলো শুধু আমি একাই শুনতে পাই। বাবা, মা, বিনয় দা....সবাইকে মাঝরাতে ঘরে ডেকে আওয়াজটা শোনানোর চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু তাজ্জব বিষয়, তাঁরা কিছুই সন্দেহজনক শোনেনি বা অনুভব করেনি। আমি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছি? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি একটু-একটু করে? আগে বেশ গর্বই করতাম আয়নাটাকে নিয়ে। তবে এখন ধীরে-ধীরে সেই গর্বের জায়গায় জন্ম নিচ্ছে একরাশ অনুশোচনা। কেন যে মরতে এই অপয়া জিনিসটা বাড়িতে এনে তুললাম! গত আঠাশ বছর ধরে এই বাড়িতে দিব্যি সুখেই ছিলাম। কই, কোনওদিন তো এরকম অপার্থিব ঘটনার মুখোমুখি হইনি? এই আয়নাটা আমার জীবনে আসার পর থেকেই সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এই অসহ্য ঠকঠকানি যেন আমার মস্তিষ্কের ভিতরে হাজারটা হাতুড়ির ঘা হেনে চলেছে।

আজও সারারাত ধরে ঠায় জেগে বসে আছি। আহার যেতে বসেছে; ঘুম তো আগেই গেছে। তখন থেকে মাদ্রাজি ধূপের ওই জোরালো গন্ধ আর কাঁচে টোকা মারার শব্দটা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। নাহ্....এভাবে দীর্ঘদিন সহ্য করা যায়না! আজ এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়ব। আলোটা জ্বালিয়ে দৃঢ় পায়ে উপস্থিত হলাম আয়নার সামনে। আমার এই করুণ অবস্থা দেখে যেন এই নির্জীব জড় দর্পণটাও ব্যঙ্গের অট্টহাসি হাসছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পাশের টেবিলে রাখা পেপারওয়েট'টা সজোরে ছুঁড়ে মারলাম আয়নার কাঁচে। ঝনঝন করে কাঁচের অসংখ্য টুকরো ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকটা অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটে গেল। কাঁচ ভেঙে আয়নার বুকে সৃষ্টি হওয়া বিশাল গহ্বর থেকে হঠাৎ একপুঞ্জ অন্ধকার বেরিয়ে এসে আমার ছায়ার সাথে মিশে গেল। গোটা শরীরটা অমানুষিক ভাবে থরথর করে কেঁপে উঠল আমার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। দু'চোখে আঁধার দেখছি। তারপর আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। সকাল হয়ে গেছে। আমাকে ঘিরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাবা, মা আর বিনয় দা।
- "কী হয়েছে....কী হয়েছে আমার?"
- "সে তো তুমি বলবে দাদাবাবু," বিনয় দা বলে উঠল, "আজ সকালে তোমার ঘরে চা দিতে এসে দেখি যে তুমি মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছো। আর চারিদিকে শুধু কাঁচের টুকরো ছিটিয়ে আছে। কী হয়েছিল দাদাবাবু?"
কিছু ভুজুংভাজুং অজুহাত দিয়ে কাল রাতের সমস্ত ঘটনা বেমালুম চেপে গেলাম। জানি সত্যি বললেও কোনও লাভ হবে না, কারণ কেউ এইসব ভৌতিক কাণ্ডকারখানা বিশ্বাসই করবে না। অকারণে উপহাসের পাত্র হয়ে লাভ নেই।

এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। এই ক'দিনেই আমার শরীরটা ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, উস্কো-খুস্কো চুল, চোয়াল দুটোও বসে গেছে। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, যখন সব অশান্তির মূল ওই আয়নাটা'কেই ভেঙে ফেলেছি....তখন আর সমস্যা রইল কোথায়? হ্যাঁ তা ঠিক, সেই রাতের পর আর ওই ভুতুড়ে শব্দগুলো একবারের জন্যও শুনতে পাইনি। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ভাঙা কাঁচটা বদলে আবার নতুন কাঁচ বসিয়েছি। এখন ওই আয়নাটা দিব্যি একটা সাধারণ আয়নার মতোই কাজ দিচ্ছে। কোথাও একফোঁটা ছন্দপতন নেই।

কিন্তু সেই রাতের ওই ঘটনার পর থেকে নিজেকে কেমন যেন দুর্বল বোধ করি। শরীরে শক্তি পাই না, একটু-আধটু পরিশ্রম করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মাথাটাও সবসময় চাপ ধরে থাকে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই আঁতকে উঠি। আর শুধুই কি শারীরিক? মানসিক দিক থেকেও যথেষ্ট কমজোর হয়ে পড়েছি। সব জিনিসের প্রতিই মনে একরকম অরুচি জন্মে গেছে। খেতে ভাল লাগে না, ঘুমাতে ইচ্ছে করে না....অফিসে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারি না। সারাদিন উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। কথা বলতে ভাল লাগে না, আবার কারও অবান্তর কথা শুনতেও মন চায় না। সহজেই রেগে যাই। সংসারের প্রতি জন্মেছে অপরিসীম ঔদাসীন্য। একটু-একটু করে মনের সব অনুভূতিগুলো যেন অসাড় হয়ে আসছে। না আছে জীবনের মোহ....না আছে মৃত্যুর ভয়।

                              (দ্বিতীয় পর্ব)

একদিন সকালে অফিসে বেরোনোর সময় মা আমাকে পাকড়াও করল।
- "ইন্দ্র, কী হয়েছে বাবা? দিন-দিন এমন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন? ভাল করে খাওয়া-দাওয়া করিস না, কারও সাথে ঠিকমতো কথাও বলিস না। কী হয়েছে রে? আমাকে অন্তত খুলে বল।"
- "ও কিছু না, সব ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না মা।"
- "কিছু হয়নি বললেই হল? মায়ের চোখ কে ফাঁকি দিতে পারবি? তোর কি শরীর খারাপ? তাহলে তোর বাবা কে বলে একজন ভাল ডাক্তার...."
- "উফ্! বলছি তো কিছু হয়নি আমার। কতবার এক কথা বলব? আমাকে প্লিজ যেতে দাও মা; অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
আমার এই রূঢ় প্রতিক্রিয়ায় মা চুপ করে গেল। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

বেশ কিছুদিন পরের কথা, অফিসে বসে একটা জরুরি ফাইল দেখছি। হঠাৎ আমার পাশের টেবিলের সুমন্ত বলে উঠল-
- "হ্যাঁরে ইন্দ্র, তুই কি কোনও সমস্যায় পড়েছিস?"
- "কই না তো। কেন?"
- "বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, তোকে কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগে। তোর মতো কাজপাগল একটা ছেলে সেদিন কাজের প্রতি অমনোযোগিতার জন্য বসের কাছে ঝাড় খেল? অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কতদিন হয়ে গেল মন খুলে হাসছিস না, ভাল করে কথা বলছিস না। সারাক্ষণ দেখি নিজের মনে কী সব বিড়বিড় করিস। তোর চোখদুটোও মাঝেমধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের লালচে হয়ে ওঠে। এতদিন তোর সাথে আছি, কোনওদিন তোকে এত রোগা তো দেখিনি। কী হয়েছে ভাই বল না?"
- "সত্যিটা বললে তুই বিশ্বাস করবি তো?"
- "অবশ্যই করব।"

সুমন্ত কে সেই রাতের সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলাম। সবকিছু শুনে ও কিছুক্ষণ চুপ করে কী একটা ভাবল।
- "ভাই, যা শুনলাম তাতে বেশ বুঝতে পারছি....এ রোগ সারানো কোনও ডাক্তার-বদ্যির কম্ম নয়। এক কাজ কর। আজ অফিস ছুটির পর তোকে একজনের কাছে নিয়ে যাব। আশা রাখছি, উনি অবশ্যই তোর সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।"

অফিস থেকে ছুটি পেয়েই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের ট্যাক্সিটা এসে থামল ভবানীপুরের এক পুরনো বাড়ির সামনে।
- "এইটা কোথায় নিয়ে এলি সুমন্ত?"
- "এইটা হল শ্রী শ্রী সম্বুদ্ধানন্দ মহারাজের আশ্রম। আমরা সপরিবারে ওনার কাছেই দীক্ষিত। আয়, ভিতরে চল।"

বিরাট কালীমন্দিরের গর্ভগৃহে স্বামীজি তখন মায়ের সন্ধ্যা আরতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমরা ঠাকুর প্রণাম করে মন্দিরের এক কোণায় চুপ করে বসে পড়লাম। খানিকক্ষণ বাদেই স্বামীজি বাইরে এলেন। সুমন্ত ওনাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল-
- "গুরুদেব, এ আমার বন্ধু ইন্দ্রজিৎ...."
স্বামীজি ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কী অন্তর্ভেদী সেই দৃষ্টি....স্বচক্ষে না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। অনেকক্ষণ ওইভাবে নীরবে তাকিয়ে থাকার পর উনি বলে উঠলেন-
- "এতদিন ধরে দর্পণে বন্দী সেই পিশাচিনী এখন মুক্ত। অত্যন্ত শক্তিশালী এই অশুভ আত্মা। খুব সাবধান!"

আমার চোখের দিকে আরও কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তিনি বললেন-
- "এতকাল ধরে মন্ত্রবলে ওই পিশাচিনী কে দর্পণের ভিতরে আটকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তুই বোকার মতো তাকে ছাড়া দিয়ে দিলি। এখন সে তোর আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। একটু একটু করে কুরে-কুরে খাচ্ছে তোকে ওই বুভুক্ষু শয়তান ডাইনিটা। কিছুদিনের মধ্যেই তোর আত্মাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলবে। তখন শুধু এই শরীর-রূপী খোলসটাই তোর নিজের থাকবে। কিন্তু তার ভিতরে বাস করবে এক অতৃপ্ত আত্মা। যত দিন যাবে, ততই একটু-একটু করে তোর ভিতরে ফুটে উঠবে ওই শয়তানের প্রতিবিম্ব। হাহাহা! বন্দিনী কে এত সহজে মুক্ত করে দিলি? কী চরম আহাম্মক রে তুই! মূঢ়মতি!"

- "এইসব কী বলছেন গুরুদেব?" সুমন্ত'র চোখে-মুখে আতঙ্কের কালো ছাপ, "এ যে মহাসঙ্কট। এর তাহলে কী প্রতিকার গুরুদেব? কীভাবে আমার বন্ধু কে বাঁচানো যায় এই ঘোর অমঙ্গলের হাত থেকে?"
- "ভয় নেই। আমি আছি তো। আমি থাকতে কিছুতেই এই অশুভ আত্মা কে তোর বন্ধুর কোনওরকম ক্ষতি করতে দেব না। নির্ভয়ে বাড়ি নিয়ে যা। কাল সন্ধ্যায় তোরা দুজনে তৈরি থাকবি। আমি কাল তোদের বাড়ি যাব।"

সুমন্ত পুনশ্চ স্বামীজি কে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। স্বামীজি হঠাৎ মায়ের আরতির একটা ফুল নিয়ে আমার মাথায় ছুঁয়ে দিলেন। মনে হল কপালটা যেন জ্বলে গেল....ছিটকে দূরে সরে গেলাম। খেয়াল করে দেখলাম, আমার এরূপ আচরণ দেখে স্বামীজি'র ঠোঁটের কোণে একটুকরো প্রহেলিকাময় হাসি খেলে গেল।

- "চল ভাই সুমন্ত। এবার বাড়ি ফেরা যাক।"
- "বলিস কী ইন্দ্র? মায়ের প্রসাদ নিবি না?"
- "না রে। এখানে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চল এখান থেকে।"
- "মানে? মায়ের মন্দিরে থাকতে তোর অসুবিধা হচ্ছে? বলি পাগল-টাগল হলি নাকি? আরে....একি! তোর চোখদুটো এমন টকটকে লাল দেখাচ্ছে কেন?"
- "জানি না!" খানিকটা চিৎকার করেই বললাম, "তোর থাকতে হলে তুই থাক। আমি চললাম।"
সুমন্ত হয়তো অকস্মাৎ আমার কাছ থেকে এমন হিংস্র ব্যবহার আশা করেনি। আর বাক্যব্যয় না করে ও চুপচাপ আমার পিছু-পিছু আশ্রম থেকে বেরিয়ে এল।

পরদিন সন্ধ্যায় আমরা প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। সুমন্ত আগেই এসে পড়েছে আমাদের বাড়িতে। এখন আমরা দুজনে মিলে স্বামীজি'র আগমনের প্রতীক্ষা করছি। সুমন্ত ওনাকে ঠিকানাটা বলেই রেখেছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি এসে পড়লেন। আজ প্রচণ্ড গম্ভীর লাগছে স্বামীজি কে। হাতে একখানা বড় ঝুলি। কপালে সিঁদুর দিয়ে একটা বড় লাল তিলক কাটা। রক্তবর্ণ বসনধারী তন্ত্রসাধকের এই উগ্ররূপ দেখে নিজের অজান্তেই ভিতর-ভিতর খানিকটা শিউরে উঠলাম।

প্রথমে এসেই উনি বাবা-মা কে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দোর এঁটে দিলেন। এখন ঘরে আমার সঙ্গে শুধু সুমন্ত। স্বামীজি ঘরের ঠিক মাঝখানে তেল আর সিঁদুর দিয়ে একটা বড় চক্র আঁকলেন। তার ঠিক মাঝখানে আমাকে বসিয়ে দিয়ে তিনি নির্দেশ দিলেন-
- "যতক্ষণ না কাজটা সমাপন করা হচ্ছে, ততক্ষণ এই গন্ডির বাইরে বেরোবি না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আসন ছেড়ে উঠবি না তুই। মনে রাখবি....মুহূর্তের অসাবধানতায় কিন্তু তোর প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। সুমন্ত, তোকে দায়িত্ব দিলাম। তোর বন্ধু আসন ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করলে তুই কিন্তু সেটা যে কোনও মূল্যে আটকাবি।"

সুমন্ত ঘাড় নেড়ে গুরুর আদেশে সম্মতি জানাল। স্বামীজি এবার ঝুলির ভিতর থেকে একটা-একটা করে বিভিন্ন উপকরণ বার করতে শুরু করেছেন। বেশ কয়েকটা বড়-বড় মাটির প্রদীপ, এক বাটি তেল, এক বাটি সর্ষে, লোহার এক সাঁড়াশি জাতীয় যন্ত্র, সিঁদুর মাখানো একটা লোহার ত্রিশূল। আরও বেশকিছু জিনিসপত্র উনি বার করে সামনে রাখলেন, কিন্তু সবগুলো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।

বাইরে গুটিপায়ে নামছে সন্ধ্যার আঁধার। সারা বাড়িতে যেন এক অদ্ভুত অথচ ভয়াবহ শান্তি বিরাজ করছে। আমাদের ঘরটা পুরোই অন্ধকার। শুধু সিঁদুর দিয়ে আঁকা চক্রটা ঘিরে চারটে প্রদীপ জ্বলছে। স্বামীজি এবার নীচু গলায় মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করেছেন। মন্ত্র বিড়বিড় করতে-করতে আমার গায়ে কিছুটা গঙ্গাজল ছেটাতেই আমার সারা শরীর জ্বলে উঠল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম আমি। স্বামীজি স্মিত হাসলেন।
- "এইতো সবে শুরু পিশাচিনী! এখনই এত কষ্ট?"

আকাশে কালো মেঘ জমেছে। মাঝেমধ্যে বজ্রপাতের শব্দও কানে আসছে। আমাদের বাগানের দোদুল্যমান গাছগুলো ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে চলেছে একনাগাড়ে। অনেকক্ষণ ধরে নিবিষ্টমনে মন্ত্র পড়ার পর স্বামীজি হঠাৎ বাটি থেকে একমুঠো সর্ষে নিয়ে সজোরে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারলেন। মনে হল কেউ যেন আমার শরীরে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারল।
- "আমাকে যেতে দে!" একটা চাপা জান্তব চিৎকার করে উঠলাম আমি, "ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। ছেড়ে দে বলছি, যেতে দে আমাকে!"

আকাশে মেঘের গর্জন বেড়েই চলেছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে স্বামীজি'র মন্ত্রপাঠের ধ্বনি। সারা ঘরটা ওনার জলদগম্ভীর স্বরে গমগম করছে। আমি আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছি না। দম যেন ক্রমশঃ বন্ধ হয়ে আসছে।
- "মুঝে ছোড় দে!" আমার গলা চিরে বেরিয়ে এল এক তীব্র আর্তনাদ, "ম্যায় কেহতি হুঁ ছোড় দে মুঝে! ম্যায়নে তেরা কেয়া বিগাড়া হ্যায়? তুঝে আখরি বার সমঝা রহি হুঁ, তুঝে ইয়ে সব বহুত মেহেঙ্গা পড়েগা। ইয়ে লড়কা তো মরেগা হি....ইসকে সাথ তু ভি মরেগা!"
- "একি! ইন্দ্র হিন্দিতে কথা বলছে কেন গুরুদেব? আর ওর গলাটা এমন মেয়েলি শোনাচ্ছে কেন? এইটা তো ওর গলা নয়!"

সুমন্ত'র প্রশ্নে স্বামীজি কোনও কর্ণপাতই করলেন না। এইবার উনি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ওই লোহার সাঁড়াশিটা দিয়ে আমার কপালে সজোরে আঘাত করলেন।
- "আহ্!!"
প্রচণ্ড নরক-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমি এক ঝটকায় আসন ছেড়ে উঠে পালাতে গেলাম। কিন্তু স্বামীজি বিদ্যুৎগতি'তে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে পুনরায় আসনে বসিয়ে দিলেন। ওদিক থেকে আমাকে চেপে ধরল সুমন্ত।

"জেগে ওঠ শয়তান!" স্বামীজি'র হুঙ্কারে অন্ধকার ঘরটা কেঁপে উঠল, "নরকের অতল গর্ভ থেকে বেরিয়ে আয়; নেমে আয় এই মর্ত্যে। দাঁড়া আমার চোখের সামনে প্রেতিনী। কোথায় লুকাবি? আজ তোর নিস্তার নেই। নিজমূর্তি ধারণ করে নিজেকে প্রকাশ কর আমার সম্মুখে। জেগে ওঠ....জেগে ওঠ!"

আর সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ আমার বুক চিরে হৃৎপিণ্ডটা খুবলে বার করে নিচ্ছে। সারা শরীরে আমার আগুন জ্বলছে। প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, আমার ছায়া থেকে একটু-একটু করে জন্ম নিচ্ছে আরেকটা ছায়াশরীর। ধীরে-ধীরে সেই একতাল অন্ধকার যেন একটা নারীর রূপে পরিণত হল। স্বামীজি একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের মন্ত্রপূত ত্রিশূলটা আমূল বিদ্ধ করে দিলেন ওই নারীমূর্তির বুকে।

আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার। খুব কাছেই কোথাও কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল। পরমুহূর্তেই বাইরে আমাদের বাগানের বিশাল আম গাছটার একটা মোটা ডাল মড়মড় করে ভেঙে আছড়ে পড়ল মাটিতে। আমিও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।

পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে আমার বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। পরের দিন সকালে জ্ঞান ফেরার পর বাইরে গিয়ে দেখেছিলাম, গোটা বাগানটা একদম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সারারাত ধরে সেখানে প্রলয়নাচন চলেছে। কেউ যেন ভীষণ আক্রোশে পাগল হয়ে বাগানের গাছগুলো গুঁড়ি সমেত উপড়ে ফেলেছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটি বড় জানালা আছে। তার একটা লোহার গরাদ বেঁকে গেছিল....ঠিক যেন কোনও দানবীয় সত্তা আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে জানালাটা ভেঙে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। অথচ আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানার বাইরে কোত্থাও ঝড়ের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখতে পেলাম না। সবকিছু একদম শান্ত।

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। নিজের পরিশ্রমের জোরে কর্মক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছি। তবে সুমন্ত কে আজও ভুলে যাইনি। ওর কারণেই আজ আমি এই গল্পটা বলার জন্য জীবিত আছি। আর ভুলিনি শ্রী শ্রী সম্বুদ্ধানন্দ মহারাজ কে। স্বামীজি'র অক্লান্ত প্রয়াস আর ভগবানের অশেষ কৃপায় আমি এক অতৃপ্ত প্রেতিনীর করাল গ্রাস থেকে প্রাণরক্ষা পেয়েছি। স্বামীজি একটা মাদুলি করে দিয়েছেন, ওইটা আমি আজীবন ধারণ করব। ভগবান যেন এভাবেই গোটা বিশ্ব কে সবরকম অশুভ শক্তি থেকে সর্বদা রক্ষা করেন।

|| ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ||

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror