সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Action Inspirational

4.0  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Action Inspirational

নিনাদ

নিনাদ

14 mins
443


                              (প্রথম পর্ব)

গ্রামটার নাম শালিকডাঙ্গা। সুউচ্চ শৈলশৃঙ্গের ছায়ায় ঘেরা স্বপ্নের এক দেশ। যেন বহুযুগ ধরে এই বিশাল পর্বতমালা'রা লোকচক্ষুর আড়ালে সযত্নে লালন-পালন করে চলেছে ছোট্ট গ্রামটি কে, আদর ভালবাসা দিয়ে সিঞ্চন করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।

একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকের পর দীর্ঘদিন হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিলাম। শারীরিক ভাবে খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারবাবু হাওয়াবদলের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই হাজির হয়েছি উত্তরবঙ্গের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

ও....কথায়-কথায় নিজের পরিচয়টাই তো দেওয়া হল না। আমার নাম জ্যোতিশেখর মিত্তির। ধাম বালুরঘাট। বয়স বাষট্টি। আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। বাড়ির গুরুজন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা একে-একে সবাই এখন পরপারে। বিয়ে-থা করিনি। পেনশানের টাকা দিয়ে ভালই চলে যায়। এভাবেই জগতের স্রোতে ভেসে-ভেসে দিব্যি তিন কুড়ি বছর পার করে এলাম।

কপালগুণে একখানা ভাল হোটেলও জুটে গেছিল। সন্ধ্যার সময় হোটেলের ম্যানেজার সাহেবের সাথে গল্প করছিলাম। কী একটা মনে হতে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
- "আচ্ছা, এখানে ঘুরে দেখার মতো কোনও জায়গার নাম বলতে পারেন?"
- "হ্যাঁ নিশ্চয়ই," ম্যানেজার বাবু একটু ভেবে বললেন, "সামনের চৌরাস্তা থেকে বাঁ দিকে ঘুরে অল্প এগোলেই মা শ্মশানকালীর জাগ্রত মন্দির আছে। ঘুরে আসুন....দেখবেন ভাল লাগবে।"

হালকা জলযোগ সেরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। এমন বড়সড় অসুখ কাটিয়ে ওঠার পর থেকেই মনটা কিঞ্চিত ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল; এই মুহূর্তে মায়ের শ্রীচরণের সান্নিধ্য আমার নিতান্তই প্রয়োজন। ম্যানেজার সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে মন্দিরে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ে মন্দিরের চূড়া।

রং-তুলি দিয়ে আঁকা ছবির মতো সুন্দর মা শ্মশানকালীর থান। গর্ভগৃহে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত শান্তি। প্রাণ ভরে মায়ের পুজো দিলাম। প্রসাদ নিয়ে এসে বসলাম মন্দিরের বিরাট দালানে। সামনেই অশ্বত্থ গাছের ঘন ঝোপজঙ্গলে ঘেরা পবিত্র শ্মশানভূমি। সেখানে দুটো চিতা পুড়ে নিভু-নিভু হয়ে এসেছে। আকাশে-বাতাসে ব্যাপ্ত এক গভীর নির্লিপ্তি।

কতক্ষণ ওখানে ওইভাবে বসে ছিলাম খেয়াল নেই। হাতঘড়ির দিকে চোখ যেতেই তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। বেশ রাত হয়েছে। মায়ের চরণে আরেকবার প্রণাম জানিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ একটা জিনিস দেখে আচমকা থমকে গেলাম। গর্ভগৃহের ঠিক বাইরে এক ধাতব স্তম্ভ। তার সাথে আংটা দিয়ে ঝোলানো একখানা বিশাল ঘণ্টা। অত বড় ঘণ্টা আমি জীবনে কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। ঘণ্টা'টা বাজাতে যাব, ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে এক ঝটকায় আমার কব্জিটা বজ্রবন্ধনে চেপে ধরল।

- "খবরদার!! এই অভিশপ্ত ঘণ্টায় ভুলেও হাত দিবি না।"

দীর্ঘাঙ্গী একজন পুরুষ মানুষের অমনধারা আচমকা হুঙ্কারে নিজের অজান্তেই খানিকটা শিউরে উঠলাম।
- "ক....কিন্তু কেন স্বামীজি? এই মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো নিষিদ্ধ নাকি?"
- "না। শুধু এই অপয়া ঘণ্টায় হাত দেওয়া চলবে না। তুই মনে হয় এই অঞ্চলে নতুন। এখানকার বাসিন্দারা সবাই এই ঘণ্টার ইতিহাস জানে।"
- "ইতিহাস? কীরকম ইতিহাস?"
- "অত কিছু জানতে হবে না তোকে," জটাজূটধারী সাধকের গলায় ধমকের সুর, "শুধু এইটুকু জেনে রাখ....এই ঘণ্টা হল মৃত্যুদূত। আশি বছর আগে কালিকা তান্ত্রিক যে ভুল করেছিলেন, আমি চাই না আজ তার পুনরাবৃত্তি হোক। যে শয়তান কে দমন করতে স্বয়ং আমার পিতামহ কে নিজের প্রাণের আহুতি দিতে হয়েছিল, সেই বলিদান কে ব্যর্থ করার অধিকার কারও নেই।"

রাগে সাধকের ফর্সা মুখটা টকটকে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। তেজস্বী দুই নেত্র হতে ঝরে পড়ছে ক্রোধানল। বেশিক্ষণ তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। ক্ষমাপ্রার্থনা করে তাড়াতাড়ি মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম।

কালক্রমে এই ঘটনার স্মৃতি মন থেকে উহ্য হয়ে এল। প্রতি সন্ধ্যায় মা শ্মশানকালী মন্দিরে যাওয়া একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। রোজ সন্ধ্যেবেলা মন্দিরে যাই, মায়ের পুজো দিই, দালানে কিছুক্ষণ বসি....আবার হোটেলে ফিরে আসি। প্রতিদিন ওই ঘণ্টার দিকে চোখ পড়ে। কিন্তু ত্র্যম্বক শাস্ত্রীর কড়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাহস হয়নি কোনওদিন। দালানে বসে রোজ ওনাকে মায়ের নিত্যসেবা করতে দেখতাম। গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ দিব্য আলোকমণ্ডিত রূপ এই মিতভাষী সন্ন্যাসীর; সে রূপ দেখলে অতি বড় নাস্তিকের মনেও ভক্তির উদ্রেক হতে বাধ্য। আচ্ছা, উনি সেদিন কী বলছিলেন? কালিকা তান্ত্রিক কে? এমন কী ভুল করেছিলেন তিনি যার ফলস্বরূপ ত্র্যম্বক শাস্ত্রীর ঠাকুরদা কে নিজের প্রাণ হারাতে হয়েছিল? অনেক প্রশ্নই মনে উদয় হতো, কিন্তু স্বামীজি কে সেইসব কথা জিজ্ঞেস করতে ভয় পেতাম....পাছে আবার ওনার কোপের শিকার হতে হয়!

দেখতে-দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কাল বালুরঘাট ফেরার টিকিট। আজ শেষবারের মতো মন্দিরে উপস্থিত হলাম। একদল শববাহী হরিধ্বনি দিয়ে একখান মড়া বয়ে আনছে। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে সেদিকেই আনমনে চেয়ে ছিলাম, হঠাৎ কাঁধে এক ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ লাগতেই চমকে উঠলাম।

স্বামীজি নীরবে আমার পাশে এসে বসেছেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
- "কাল চলে যাচ্ছিস?"
- "কী? ইয়ে মানে....হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?"
উনি আমার এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না। মৃদু হাসলেন কেবল।

- "অনেক রাত হয়েছে। এবার ফিরে যা। আমিও মন্দিরের কপাট বন্ধ করি।"
- "আর তো কোনওদিন আসব না এখানে, আরেকটু কিছুক্ষণ বসি নাহয়।"
- "আচ্ছা বেশ, আমি তাহলে উঠছি। তুইও বেশি রাত করিস না। ঠাণ্ডা বাড়ছে।"
স্বামীজি মন্দিরের কপাট রুদ্ধ করে নিজের ঘরের দিকে প্রস্থান করলেন। চতুর্দিকে যেন ঝুপ করে নেমে এল একতাল নিশ্ছিদ্র নিঃসঙ্গতা।

চিতাটা এতক্ষণে দাউদাউ করে জ্বলতে আরম্ভ করেছে। কাল চলে যাব, তাই ওই অভিশপ্ত ঘণ্টা'টা আরেকবার চোখে দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগল। চুপিসাড়ে পা টিপে-টিপে গর্ভগৃহের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওইতো সেই ঘণ্টা! আচ্ছা, শুনলাম এইটা নাকি মৃত্যুদূত? সত্যিই কি এর ক্ষমতা আছে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে ডেকে আনার? একবার বাজিয়ে দেখব? স্বামীজি'র কঠোর নিষেধাজ্ঞা; তবে উনি মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিজের ষাটোর্ধ্ব মনে যেন বাল্যকালের উৎকণ্ঠা অনুভব করলাম। কৌতুহল আর ভয়ের দোলাচলে প্রতিবারের মতো এবারও কৌতুহলই জিতল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘণ্টা'টা সজোরে বাজিয়ে দিলাম।

ঢং....!!!

সেই আসুরিক নিনাদ যেন আমার কর্ণকুহর বিদীর্ণ করে সোজা মস্তিষ্কে হাতুড়ির ঘা বসাল। কানে দু'হাত চাপা দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। একটা ধাতব ঘণ্টা থেকে যে এমন অমানুষিক শব্দকম্পন উৎপন্ন হতে পারে....তা একেবারেই আমার কল্পনাতীত। খুব কাছেই কোথাও কড়কড় শব্দে বজ্রপাত হল। চকিতে সেদিকে তাকাতেই আমার বুকের রক্ত জমাট বেঁধে গেল।

বাজ পড়েছে জ্বলন্ত চিতার ঠিক উপরে। তার ভিতর থেকে আধপোড়া মড়াটা একটু-একটু করে জেগে উঠছে। অগ্নিবেষ্টিত সেই শবদেহ নেমে এসেছে চিতা থেকে। দু'হাত সামনে প্রসারিত করে আমার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। হাঁ-করা বিশাল মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে বিশ্রী এক চাপা পাশবিক গর্জন।

শরীরের উপর আমার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। চোখের সামনে মূর্তিমান মৃত্যু এগিয়ে আসছে, তবুও ভয়ের চোটে আমি এক পাও নড়তে পারছি না। কেউ যেন জাদুমন্ত্রবলে আমাকে বেঁধে রেখেছে। চিৎকার করতে গেলাম, গলা থেকে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত বেরোল না। আমার শরীর এখন আমার বশে নেই। এই মুহূর্তে আমি কোনও এক অদৃশ্য সত্তার হাতের পুতুল।

জ্বলন্ত মড়াটা এখন আমার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। তার শরীর থেকে নির্গত তাপে আমার চোখমুখ ঝলসে যাচ্ছে। তার সাথে বিশ্রী এক চামড়া পোড়া গন্ধ। পিশাচটা আস্তে-আস্তে আমার দিকে হাত বাড়াল। প্রাণের আশা ছেড়ে হতাশায় চোখ বুজলাম। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী........

হঠাৎ এক তীব্র আর্তনাদে আমি কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। চোখ খুলে দেখি....শয়তানটার বুকে আমূল বিঁধে রয়েছে সিঁদুর মাখানো একটা লোহার ত্রিশূল। মৃত্যুদূত এখন নিজেই ভূমিতে লুটিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। দেহের আগুন অল্প-অল্প করে নিভে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আধপোড়া মড়াটা ধীরে-ধীরে শান্ত হয়ে গেল।

- "যাক!" কানে এল এক দৃপ্ত পুরুষ কণ্ঠ, "এখনকার মতো বিপদ কেটেছে।"
- "স্বামীজি, আপনি?"
- "হ্যাঁ আমি। যা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক তাই! শোন, এত রাতে তোকে আর হোটেলে ফিরতে হবে না। আজ রাতটা আমার কুটিরেই নিশিযাপন কর। আয় আমার সঙ্গে।"

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হল। শিয়রে বসে আছেন ত্র্যম্বক শাস্ত্রী। আমি চোখ মেলতেই নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন-
- "কেন আমার নিষেধ অমান্য করেছিলি? কেন জাগিয়েছিলি শয়তান কে?"
- "আমি....আমি ভুল করে ফেলেছি স্বামীজি, আমাকে মার্জনা করুন।"

এই প্রথমবার যেন ওনার কঠিন মুখে বাৎসল্যের ছোঁয়া দেখতে পেলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
- "তোর অতিরিক্ত কৌতুহল দেখে আগেই বুঝেছিলাম, তুই নিশ্চয়ই কোনও অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটাবি। তাই সেদিন ঘরে ফিরেও আমি জানালা দিয়ে তোর উপর নজর রেখেছিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই হল। মা শ্মশানকালী আর শ্রী মহাকালের আশীর্বাদে কোনও বড় ক্ষতি হয়নি, এই রক্ষে। তোর তো সন্ধ্যার ট্রেন, আজ দুপুরে আমার আশ্রমেই আহারাদি সেরে হোটেলে ফিরবি। একটা মাদুলি করে দেব, প্রাণান্ত হয়ে গেলেও সেইটা ত্যাগ করবি না। এখন বিশ্রাম নে।"

স্বামীজি উঠতে যাবেন, আমি তাড়াতাড়ি ওনার হাতটা ধরে ফেললাম।
- "কী হল?"
- "আপনি দয়া করে আমার মনে আর কোনও দ্বন্দ্ব ফেলে রাখবেন না। বলুন না....আমাকে বলুন না ওই অভিশপ্ত ঘণ্টার রহস্য।"
স্বামীজি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
- "তুই কি সত্যিই জানতে চাস এই ঘণ্টার অতীত?"
- "হ্যাঁ স্বামীজি। আমাকে বলুন।"

ত্র্যম্বক শাস্ত্রী কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে কী একটা ভাবলেন। তারপর আস্তে-আস্তে নিজের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আমার দুই ভ্রুকুটির মাঝ বরাবর এনে ছোঁয়ালেন। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মাথাটা অল্প ঝিমঝিম করতে লাগল। চোখেও যেন ভুল দেখতে আরম্ভ করেছি। আমার সামনে সমস্ত দৃশ্য কেমন পাল্টে যাচ্ছে। কোথায় স্বামীজি'র ঘর? আমি তো মন্দিরের দালানে শুয়ে আছি। তবে যতদূর মনে পড়ছে, দালানটা পাকা সিমেন্টের ছিল....ভোজবাজির মতো সেটা মাটির হয়ে গেল কী করে? সামনে শ্মশানও আছে আগের মতোই। তবে আশেপাশের জঙ্গলটা যেন আরও বেশি ঘন মনে হচ্ছে। মন্দিরে ভক্তের সমাগম অনেকটাই কম।

কী ব্যাপার? মনে হচ্ছে কোনও অজানা উপায়ে আমি এসে পড়েছি প্রায় আশি-নব্বই বছর আগেকার সময়ে। এদিকে মন্দিরের ভিতর থেকে কেমন যেন এক চাপা হট্টগোলের আভাস পাচ্ছি। গুটিগুটি পায়ে সেদিকে গিয়ে দেখি, রক্তবর্ণ বসনধারী দুই মাতৃসাধকের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। একজন বেশ লম্বা আর গৌরবর্ণ, ত্র্যম্বক শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ওজস্বী মুখের অভূতপূর্ব মিল। আরেকজন কিঞ্চিত শ্যামবর্ণ, কিন্তু তাঁর চোখেমুখে সে এক ভয়ঙ্কর উগ্রতা। ছেনি দিয়ে কাটা পাথরের মূর্তির ন্যায় পেশীবহুল দেহ।

                              (দ্বিতীয় পর্ব)

- "আমি আবার তোমাকে বারণ করছি কালিকাচরণ, এই সাধনার পথে তুমি অগ্রসর হওয়ার ভুল কোরো না," সুদর্শন ব্যক্তিটি বললেন, "তুমি জানো এই মারণবিদ্যা আয়ত্ত করতে গিয়ে তোমার কত বড় ক্ষতি হতে পারে? এমনকি এই কাজে ছোট্ট একটা ভুলচুক হলে তোমার জীবন সংশয় পর্যন্ত ঘটতে পারে!"
- "তুমি এর মধ্যে নাক গলাতে এসো না রত্নাকর," রাগে ফোঁস করে ওঠে সেই দ্বিতীয় সাধক, "তন্ত্রসাধনার যে ব্রতে ব্রতী হয়েছি, সেখান থেকে এক পাও পিছিয়ে আসব না আমি। আর প্রাণ? এই প্রাণের মোহ আমি বহু বছর আগেই ত্যাগ করেছি রত্নাকর। ভুলেও আমার সাধনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে না।"

- "নিজের প্রাণের ভয় তোমার নাই থাকতে পারে, তাই বলে মন্দিরের কথাটা অন্তত একবার ভাবো কালিকাচরণ। যদি গ্রামে এই কথা রটে যায় যে শ্মশানকালী মন্দিরের উপপুরোহিত গোপনে মারণবিদ্যা চর্চায় রত হয়েছে, তাহলে এই মন্দিরের কত দুর্নাম হবে তার খেয়াল আছে?"
- "কীসের মন্দির? কীসের দুর্নাম?" চেঁচিয়ে উঠল কালিকা তান্ত্রিক, "এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আমার হওয়ার কথা, কালিকাচরণ আগমবাগীশের হওয়ার কথা এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত! কিন্তু তুমি শুধুমাত্র গুরুজি'র পদলেহন করে সেই জায়গা কেড়ে নিয়েছ। কী যোগ্যতা আছে তোমার? গুরুজি তো তোমার আনুগত্য দেখে এমনই দিশেহারা হয়ে পড়লেন, যে মৃত্যুর পূর্বে তিনি মন্দিরের সমস্ত কার্যভার তোমার হাতেই সঁপে গেলেন। আর আমি? আমাকে বানিয়ে গেলেন তোমার সহকারী! আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি....গুরুজি অপাত্রে দান করেছেন।"
- "কালিকাচরণ, আমার উপর রাগ দেখিয়ে মন্দিরের এতবড় ক্ষতি কোরো না ভাই। আচ্ছা বেশ, আমি নাহয় স্বেচ্ছায় এই পদ ত্যাগ করে তোমাকে প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করে দেব। আমার অনেক বয়স হয়েছে, বাকি জীবনটা মায়ের চরণসেবা করে কাটিয়ে দিতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট।"
- "কালিকা তান্ত্রিক কারও ভিক্ষা গ্রহণ করে না। আমি যা চাই, তা আমি নিজের ক্ষমতার জোরেই ছিনিয়ে নেব। সরে যাও আমার সামনে থেকে!"

রত্নাকর শাস্ত্রীর গায়ে সজোরে এক ধাক্কা মেরে কালিকা তান্ত্রিক সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আর ঠিক সেই সময় চারিদিকে হঠাৎ আঁধার নামতে শুরু করল। অসম্ভব! এখন তো বড়জোর সকাল দশটা-সাড়ে দশটা হবে....তাহলে? অন্ধকার ক্রমশঃ গাঢ় হতে-হতে এক সময় এমনই অবস্থা হল, আমি আর নিজেরই হাত-পা ঠাহর করতে পারছি না। বেশ কয়েকবার ত্র্যম্বক শাস্ত্রীর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। মিনিট দুয়েক ওই কালিঢালা তমসার মধ্যে প্রস্তর প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর কালো ভাবটা একসময় একটু-একটু করে ফিকে হয়ে এল। এবার যেন এক অদ্ভুত হলুদ আলো চোখে এসে লাগছে। সামনের দৃশ্য কিছুটা স্পষ্ট হতেই দেখি, আমি মন্দিরের লাগোয়া শ্মশানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। দূরে শ্মশানকালী মন্দিরের চূড়াটা অন্ধকারের মধ্যে এক সজাগ প্রহরীর ন্যায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। শ্মশানের এই স্থানটা কিঞ্চিত পরিষ্কার, জঙ্গল বেশ খানিকটা পাতলা। আমার থেকে কয়েক হাত দূরে এক আবছা মানবমূর্তি। কয়েক পা এগিয়ে ভাল করে নজর করতেই ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেল।

কালিকা তান্ত্রিক শবসাধনায় বসেছেন। একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহের উপরে ধ্যানমগ্ন কালিকা তান্ত্রিক। সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে যজ্ঞাগ্নি। সেই আগুনের আলোই চোখে এসে লাগছিল কিছুক্ষণ আগে। তান্ত্রিক একনাগাড়ে বিড়বিড় করে চলেছেন কোনও দুর্বোধ্য বীজমন্ত্র। বেশ কিছুক্ষণ এমন চলার পর মনে হল, সাধক অল্প চোখ খুললেন। একি! উনি কি কারও সঙ্গে কথা বলছেন? ঠিক তাই....কিন্তু কী বলছেন, আর কাকেই বা বলছেন? এখানে তো আমরা দুজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর মনে হল, কালিকা তান্ত্রিকের গলা ছাড়াও আরেকটা কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব রয়েছে; এক নারীকণ্ঠ। অবশ্য তাঁদের সেই বার্তালাপ এতই অস্পষ্ট, আমি তার বিন্দুমাত্র মর্মোদ্ধার করতে পারলাম না। খানিক বাদে চোখের সামনে থেকে সেই দৃশ্য আগের বারের মতোই আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল।

এবার আমি এসে উপস্থিত হয়েছি হোটেল থেকে মন্দিরে যাওয়ার সেই পাহাড়ি রাস্তায়। কালিকা তান্ত্রিক দাঁড়িয়ে আছে আমার থেকে কয়েক হাত তফাতে। কাঁধে বছর পাঁচেকের এক ছেলে। মনে হচ্ছে বাচ্চাটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তান্ত্রিকের এক হাতে মশাল, আরেক হাতে একটা ঝকঝকে খড়্গ। তাঁর পথ আগলে দশ-বারোজন লাঠিয়াল দাঁড়িয়ে। আর সেই মানব শৃঙ্খলার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন পুরুষ। একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক। আরেকজন হলেন স্বয়ং রত্নাকর শাস্ত্রী।

- "আর এক পা এগোবে না কালিকা। বাচ্চাটা কে এই মুহূর্তে আমাদের হাতে তুলে দাও।"
- "পথ ছেড়ে দিন কর্তা, পথ ছাড়ুন বলছি!" আক্রোশে হিসহিস করে উঠল কালিকা তান্ত্রিক, "আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করলে আপনারা দেবীর কোপে পড়বেন, ঝাড়ে-মূলে নির্বংশ হয়ে যাবে আপনার পরিবার!"
- "স্তব্ধ হও! বিমান মুখুজ্জের নাতি কে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি? ভাগ্যিস রত্নাকর শাস্ত্রী আমাকে সময় থাকতে খবর পাঠিয়েছিলেন, নয়তো আজ অনর্থ ঘটে যেত।"
- "এইটা মায়ের আদেশ। আজ মধ্যরাতে পড়বে মহানিশীথ কাল। সেই অভীষ্ট মুহূর্তে এক ব্রাহ্মণ কুমারের বলি দিলে তবেই আমার সাধনা সম্পূর্ণ হবে। কেউ যেন মায়ের এই ইচ্ছের মাঝখানে কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়।"
- "খবরদার! শেষ বারের মতো বলছি, বাচ্চাটা কে আমাদের হাতে তুলে দাও কালিকা। নইলে আমার লেঠেল বাহিনী তোমার একটা হাড়ও আস্ত রাখবে না।"

তবে এরপর কালিকা তান্ত্রিক যে কাণ্ড ঘটাল, তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। একটা চাপা জান্তব হুঙ্কার ছেড়ে নিজের হাতের খড়্গ'টা সবেগে ছুঁড়ে মারল জমিদার বাবুর দিকে। কিন্তু সেই খড়্গ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সোজা গিয়ে লাগল জমিদার বাবুর পাশে দাঁড়ানো রত্নাকর শাস্ত্রীর গায়ে।

- "শাস্ত্রীজি....শাস্ত্রীজি! এ কী হয়ে গেল!" জমিদার বাবু চিৎকার করে উঠলেন, "ভয় নেই শাস্ত্রীজি। আমি যত তাড়তাড়ি সম্ভব আপনাকে বৈদ্যর কাছে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছি। আপনার কিচ্ছু হবে না।"
- "আমার সময় ফুরিয়েছে বড়কর্তা। আমাকে শান্তিতে যেতে দিন। আপনি যেমন ভাবে হোক কালিকা কে আটকান। বাচ্চাটা কে...."

আর কিছু বলতে পারলেন না রত্নাকর শাস্ত্রী। আস্তে-আস্তে তাঁর শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ল। এদিকে জমিদার বাবুর লেঠেল বাহিনী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে কালিকা তান্ত্রিক কে। জোর করে ওঁর কাঁধ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অজ্ঞান বাচ্চাটা। পিঠে দুটো লাঠির ঘা পড়তেই মাটিতে আছড়ে পড়ল কালিকা।

- "এত চেষ্টা করেও আর শেষরক্ষা করা গেল না মা," ডুকরে কেঁদে উঠল কালিকা তান্ত্রিক, "এতদিনের সাধনা আমার ব্যর্থ হয়ে গেল। মা....মা গো!! তোর সাধ পূরণ করতে পারল না রে তোর এই অপদার্থ সন্তান! এই জীবন....এই জীবন আমি আর রাখব না। তবে চিরকালের মতো বিদায় নেওয়ার আগে আমি, স্বয়ং কালিকাচরণ আগমবাগীশ অভিশাপ দিয়ে গেলাম এই মন্দিরের উপর। যে মন্দির নিয়ে তোদের এত অহংকার, তার গর্ভগৃহের বাইরে স্থাপিত ঘণ্টা'তে আমি স্বেচ্ছায় বন্দী রেখে গেলাম নিজের আত্মা কে। যে কেউ এই অভিশপ্ত ঘণ্টা বাজানোর দুঃসাহস দেখাবে, তার জীবনে নেমে আসবে চরম বিভীষিকার কালো মেঘ। কালের কুটিল কবলে এমন ভাবে বাঁধা পড়বে তার জীবন, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মায়ের কাছে মৃত্যুভিক্ষা চাইবে সে....মৃত্যুভিক্ষা চাইবে!"

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কালিকা তান্ত্রিক বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিল মাটিতে পড়ে থাকা রক্তমাখা খাঁড়াটা।

- "জয় তারা!!"

উগ্র তান্ত্রিকের গগনভেদী উদ্ঘোষে আকাশ কেঁপে উঠল। উত্তেজনায় তাঁর সুগঠিত শরীরের প্রতিটা শিরা থেকে-থেকে ফুলে উঠছে। হাতের খড়্গ'টা একবার আকাশের দিকে তুলে সেইটা সবেগে নামিয়ে আনলেন নিজেরই ঘাড়ে। এক কোপে ধড় থেকে তাঁর মুণ্ড মাখনের মতো বিভক্ত হয়ে গেল। চারিদিক ভিজে গেল ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা শোণিতের উষ্ণ ধারায়।

- "না!"

আতঙ্কে দু'হাত দিয়ে চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়লাম। আর দেখতে পারছি না। এত বীভৎস একটা দৃশ্য সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। কেউ আমাকে বাঁচাও!

- "ত্র্যম্বক শাস্ত্রী....রক্ষা করুন আমাকে!"
- "ভয় নেই। আমি এখানেই আছি।"

স্বামীজি'র ডাকে যেন আমার হুঁশ ফিরল। চকিতে চোখ খুলে দেখি....কোথায় কী? আমি তো এখনও সেই আগের মতো তাঁর কুটিরেই শুয়ে আছি। স্বামীজি ঠিক সেই ভাবেই নিজের বুড়ো আঙুল আমার কপালে ঠেকিয়ে রেখেছেন। আমি চোখ খুলছি দেখে উনি আঙুলটা আস্তে-আস্তে আমার কপাল থেকে সরিয়ে নিলেন।

- "আশা করি এখন কিছুটা হলেও তোর কাছে পরিষ্কার হয়েছে এই ঘণ্টার রক্তাক্ত ইতিহাস? তবে সাবধান! যা কিছু দেখলি, তা নিয়ে বাইরে গিয়ে কারও সঙ্গে কোনও প্রকারের আলোচনা করবি না। এই আদেশ অমান্য করলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম।"
- "আপনার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু স্বামীজি, এইটা যখন প্রমাণিত যে জিনিসটা অভিশপ্ত, মুহূর্তের অসাবধানতায় কারও প্রাণান্ত পর্যন্ত ঘটতে পারে এর জন্য....তাহলে আপনারা এই ঘণ্টা সরিয়ে ফেলছেন না কেন? তাহলেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়।"

ত্র্যম্বক শাস্ত্রী উচ্চস্বরে হোহো করে হেসে উঠলেন।
- "হ্যাঁরে, তুই কি আমাদের বোকা ভাবিস? তোর কী মনে হয়, সে চেষ্টা আমরা করিনি? বহুবার করেছি, আর প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। কয়েক বছর আগে তো আমরা শহর থেকে সেই যন্ত্র পর্যন্ত আনিয়েছিলাম। কী একটা বেশ নাম যেন....ও হ্যাঁ, বুলডোজার। অনেকক্ষণ ধরে চলেছিল ঘণ্টার লৌহস্তম্ভটা ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টা। কিন্তু পাহাড়ের মতো উঁচু বুলডোজার যন্ত্রটি লোহা দিয়ে নির্মিত ওই আট ফুটের সাধারণ স্তম্ভ কে এক চুলও নড়াতে পারেনি....ভাঙা তো অনেক দূরের ব্যাপার! যখন বুঝলাম যে এখান থেকে এই ঘণ্টা কে উৎখাত করা আমাদের কর্ম নয়, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ওই জায়গাটা লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে ফেলা হবে। খাঁচাটা থাকলে কোনও অজ্ঞ মানুষ ভুলবশতঃ সেখানে পৌঁছে ওই ঘণ্টায় হাত দিতে পারবে না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মিস্ত্রি ডেকে জায়গাটা স্টীলের মোটা জালি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। কিন্তু...."

- "কিন্তু কী স্বামীজি? থামলেন কেন?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ত্র্যম্বক শাস্ত্রী বললেন-
- "কিন্তু পরের দিন সকালে মন্দিরের কপাট খুলতে গিয়ে দেখি, সেই ঘণ্টা আগের মতোই আছে। তবে তার আশেপাশে লাগানো তারের জালিটা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি প্রচণ্ড ক্রোধে সেই স্টীলের ঘেরাটোপ কে পুরো দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে ফেলেছে। এই ঘটনার পর তড়িঘড়ি সেই খাঁচা সরিয়ে ফেলা হয়। তখন থেকেই আমরা আর এই ঘণ্টা কে নিয়ে কোনওরকম অহেতুক নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকি। এবং ভবিষ্যতেও বিরত থাকব।"

- "তাহলে তো এই অভিশাপ চিরদিন থেকে যাবে।"
- "তা হয়তো থাকবে। এই অভিশাপ কে দিয়েছে সেটা দেখতে হবে তো! স্বয়ং কালিকাচরণ আগমবাগীশের আত্মা বন্দী আছে এই ঘণ্টার ভিতরে। আমাদের কাছে কালিকা তান্ত্রিক একজন অসাধু চরিত্র হলেও; একটা জিনিস স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ নেই। তন্ত্রবিদ্যায় তিনি ছিলেন অসামান্য পারদর্শী। যদি বলি সেই সময়ে গোটা বঙ্গদেশে অমন দক্ষ তান্ত্রিক বড় কমই ছিল, তাহলে সেটা খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। তা ছাড়া এই মন্দির কে সম্পূর্ণ শাপমুক্ত করা সম্ভব না হলেও, কোনও দুর্ঘটনা কে এড়িয়ে চলা অতি সহজ। ঘণ্টায় হাত না দিলেই তো হল। অশুভ শক্তি তো নিজের থেকে জেগে ওঠে না। তোর মতো কোনও অতীব কৌতুহলী আহাম্মক আগ বাড়িয়ে সেই ঘণ্টায় ধ্বনি উৎপন্ন করলেই অশুভ শক্তির নিদ্রাভঙ্গ হয়। কালিকা তান্ত্রিকের অতৃপ্ত আত্মা কে আশ্রয় দিয়েছে এই ঘণ্টা। এর নিনাদ পৌঁছায় নরকের অতল গভীর পর্যন্ত।"

- "শয়তান যদি এতই শক্তিশালী হয়, তাহলে কাল আপনি আমাকে তার হাত থেকে বাঁচালেন কী করে?"
ত্র্যম্বক শাস্ত্রীর চোখেমুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল।
- "ত্রিশূলটা ভাল করে দেখেছিলি? ওতে কী মাখানো ছিল?"
- "কেন? সিঁদুর ছিল তো।"
- "সিঁদুর ছাড়া আরও একটা জিনিস ছিল। চিতার পবিত্র ভস্ম।"
- "ভস্ম?"
- "হ্যাঁ, চিতাভস্ম। শ্মশানটা মন্দিরের লাগোয়া হওয়ার ফলে এই পবিত্র অথচ দুর্লভ জিনিসটা আমাদের কাছে সহজলভ্য। গর্ভগৃহে মা শ্মশানকালীর প্রতিমার পাশেই স্থাপিত রয়েছে শ্রী শ্রী শ্মশানবিহারী ভূতনাথ শিবলিঙ্গ। এই চিতাভস্ম দিয়েই তাঁর নিত্য শৃঙ্গার করা হয়। সেখান থেকেই প্রতিদিন নিজে হাতে একটু করে পবিত্র বিভূতি নিয়ে এই ত্রিশূলে লাগিয়ে রাখি আমি। শ্রী শ্রী শ্মশানবিহারী ভূতনাথ স্বয়ং মূর্তিমান পরম ব্রহ্ম। কালের কাল মহাকাল স্বরূপ। সর্বেশ্বর শিব কালের বক্ষে তাণ্ডব করেন....কাল তাঁর সামনে কিই বা করবে? শিবলিঙ্গ থেকে নেওয়া চিতাভস্ম হল শ্রী শ্রী শ্মশানবিহারী ভূতনাথের প্রসাদ। তাই বিভূতি মাখানো ওই ত্রিশূলের আঘাতে মৃত্যুদূত কে অতি সহজেই প্রতিহত করা গেল।"

- "নিজের বোকামির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী স্বামীজি। প্রতিজ্ঞা করছি, কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে আর কোনওদিন এমন অন্যায়...."
- "থাক তবে," ত্র্যম্বক শাস্ত্রী আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন, "এসব নিয়ে ভেবে মনে আর খেদ পুষে রাখিস না। শুধু একটাই কথা বাবা জ্যোতিশেখর। অনেক তো বয়স হল, এবার পারলে নিজের এই অতিরিক্ত কৌতুহলটা একটু নিয়ন্ত্রণে রাখবি।"

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীজি ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। আমিও চোখ বুজে ভগবানের চরণে একখানা প্রণাম করলাম। বাষট্টি বছর বয়সে এইটা বোধহয় আমার দ্বিতীয় জন্মলাভ হল।

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror