Apurba Kr Chakrabarty

Horror Thriller

4.9  

Apurba Kr Chakrabarty

Horror Thriller

কালুইগ্রামের বিভীষিকা

কালুইগ্রামের বিভীষিকা

5 mins
2.4K


  

(কাহিনীটি ১৯৫২ সালের একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে আমার বড় মামার কাছে শোনা ) 


শীতের ভোরে কমলা নাতিকে ঘুম থেকে তুলে দূর্গা দূর্গা বলে রওনা করলেন। কলকাতায় একটি বেসরকারী সংস্থায় চঞ্চল চাকুরী করে। শুশুনী থেকে হেঁটে সুমদ্রগড় ষ্টেশনে সকাল সাতটার ট্রেন ধরলে দশটা - শোয়া দশটায় কর্মস্থল যাওয়া সম্ভব।দেরী হলেই ম্যানেজার সাহেব লাল কালী দেন, বেতন কাটা সঙ্গে গজগজানী।

যাওয়ার পথে মুসলিম প্রধান কালুই গ্রাম যেতে যেতে শীতের দিনেও পুবের আকাশ ফরসা হয়ে যায়। আজ বেশ অন্ধকার, কৃষ্ণ তৃতীয়ার চাঁদ আকাশে তখনও উজ্জ্বল,কালুই গ্রাম পেরিয়েই নির্জন এক মস্ত পুকুর, উঁচু পাড়,পশ্চিম পাড় বরাবর সংকীর্ণ পায়ে চলার পথ, ঠিক পুকুরের জলের পাশ ঘেসে।  প্রতি সোমবার এই পথেই চঞ্চল কত গেছে।আজ কেমন এই পুকুর পাড়ের রাস্তার আসার দুশো গজ দুর থেকেই  গা ছম ছম করছে,গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, কী যেন ভয় মনে চেপে বসছে ।

চঞ্চল সাহসী ছেলে বয়স ২৫-২৬ ব্রাহ্মণ সন্তান হলেও গোঁড়া নয়।পৈতার ধার ধারেনা।আজ পৈতা ধরে ঘন ঘন গায়েত্রী মন্ত্র নীরবে জপ করছে ।এক পচা মাংসের গন্ধ সমানে নাকে আসছে। পুকুরে বড় বড় মাছ গুলো হয়ত লাফ ঝাঁপ দিচ্ছে ,কিন্ত এতটাই জোরে তার মনে হচ্ছিল কোন মানুষ নিশি রাতে স্নানের উদ্দেশ্য পাড় থেকে ঘন ঘন ঝাঁপ মারছে ।আবার কেউ যেন তার পিছু পিছু আসছে এখন চলার শব্দ অনুভুতি হচ্ছে। পিছনে তাকালে কারও দেখা নেই, শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার হাঁটলে ফের শব্দ!

ঘন কুয়াশা সামনের পথ বেশ অস্পষ্ট ,মাঝে মধ্যেই কুকুরের কতর একনাগাড়ে কান্না, দুর থেকে রাতের শেষ প্রহরে শিয়ালের ডাক ভয়াবহ পরিস্থিতির রহস্য যেন বাড়িয়ে তুলছে।

শীতের রাতে চঞ্চলের কপালে ঘাম, হন হন হেঁটে চলছে সে। কিন্ত কী অদ্ভুত কান্ড আবার সেই পুকুর! যেটা সে এই কিছুক্ষণ আগেই অতিক্রম করল !চঞ্চলের ভয়ে পা টলমল করছে,অজানা ভয়ে বুকে কাঁপুনী ধরেছে যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।সেই পচা গন্ধ আগে যেমন টের পেয়েছিল তার পরই কেউ যেন পিছু নিয়েছিল, কিন্ত দেখা যায়নি যেন কোন অদৃশ্য অশরীরী!মাঝে পচা গন্ধটা ছিল না আবার পুকুরের কাছে আসতেই সেই গন্ধ!চঞ্চল আর সামনে এগুতে সাহস পেলো না পিছিয়ে পিছিয়ে অনেকটাই পথ পিছনের দিকে  এল।

গ্রামের শেষে বিচ্ছিন্ন একটি ছোট মাটির কুঁড়ে ঘর। চঞ্চলের আর দম নেই,  এবার বুঝি সে ভয়ে মরেই যাবে ।শেষ চেষ্টা মত ঐ কুঁড়ে ঘরের দরজায় জীবনের অন্তিম শক্তি দিয়ে কড়া নাড়তে লাগল।ছ পাসে ছোট খুপরি জানালা খুলে কেউ যেন দেখল। তার পর হঠাৎই দরজা খুলে তাকে হেচকা টেনে কে যেন ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে নিল,দরজা মুহূর্তেই বন্ধ করে দিল।

এক অজানা আতঙ্কে চঞ্চল দারুণ হাঁপাচ্ছে কল কল করে ঘামছে , সব যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।ঘরের এক কোনে ছোট কুলঙ্গিতে একটি লন্ঠনের আধ নেভা আলো মিটমিট করে জ্বলছে, এক আলো আধাঁর নির্জন ঘরে যে কোন রহস্যময়ী বৃদ্ধা ! চঞ্চলকে একটি ছোট টুলে বসাল, নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে কেমন টিক টিক শব্দ হচ্ছিল যেন কোন টেবিল ঘড়ি বা টাইম ক্লকের শব্দ না আর কিছু !

বৃদ্ধা লন্ঠনের আলো কুলঙ্গি থেকে এনে আলো উস্কে চঞ্চলের খুব কাছে আসে লন্ঠনের আলোয় তার মুখ অনেকক্ষণ নিরক্ষন করে।

উৎকন্ঠা ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল "তুমি কে! এত রাতে এদিকে কেন এসেছিলে!" 

চঞ্চল ভয়ার্ত্ত স্বরে বলল"আমি চঞ্চল চ্যাটার্জি, শুশুনী বাড়ি ,এই পথে আমি সমুদ্রগড়ে হেঁটে প্রতি সোমবার ট্রেন ধরতে যাই।"

বৃদ্ধা বললেন "তাই বলে এত রাতে ?"

- শঙ্কিত চঞ্চল বলে"-না আমি ভোড়ে বের হই এখানে আসতে আসতে প্রায় সকল হয়ে যায়। "

বৃদ্ধা বললেন "ঘড়িটা দেখো !" চঞ্চল এর চোখ কপালে, রাত তখন সাড়ে তিনটে ,

 চঞ্চল বলল " আমার ঠাকুমা  মনে হয় সময়টা আজ ঠাহর করতে পারেননি।" 

বৃদ্ধা কোন কথা বললেন না, জনতা স্টোভে দুধ গরম করে এক গ্লাস চঞ্চলকে দিল,বলল "দুধটা খেয়ে নাও ,সকাল হলে বের হবে, এখন এ ঘরে থাকো আর কোন বিপদ নেই। তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে ভগবান তোমায় বাঁচিয়েছেন, আর আমিও আল্লাহ প্রার্থনা করি, নিষ্ঠা ভরে তাই তোমাকে সাহায্য করেছি, উপর ওয়ালার ইচ্ছা ছাড়া কিছু হয় না।" 

চঞ্চল দুধ পান করে কিছুটা সুস্থ বোধ করছিল, শরীরের ভয় দুর্বলতা কেটেছে তাই কাঁপুনী কাটলেও একটা রহস্যময় ভয় কাজ করছিল। বৃদ্ধা বিষয়েও কৃতজ্ঞতা কৌতুহল রহস্য আবার ভয় হচ্ছিল। তাই আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল,

"আপনি আমার ঠাকুমার মত, আপনি মুসলিম কি হিন্দু আমার কিছু যায় আসে না,আজ আপনি আমাকে আশ্রম দিয়ে বাঁচিয়েছেন , আপনাকে একটা প্রনাম করি। "

বৃদ্ধা বলল "না না তার কোন দরকার নেই তুমি আমাকে ঠাকুমা ডেকেছ এই যথেষ্ট"

কিন্ত চঞ্চল প্রনাম করেই ছাড়ল, এক কৃতজ্ঞতা দুই ছদ্মবেশী অভিনয়কারী কোন ভুত নয় তার প্রমাণ নেওয়া, এমন গল্প সে পড়েছে, ভালো মানুষের অভিনয় করে প্রেত্নী বা মায়াবী রাক্ষসী মানুষের গলা টিপে রক্ত চুষে খায়, পরেরদিন মায়াবী ঘর হয়ে যায় বন জঙ্গল, আর তাতে পরে থাকে ফ্যাকাশে রক্তহীন হতভাগ্য মানুষটির শব। না এখানে সেটা নয়, বৃদ্ধা রক্ত মাংসের মানুষ।তা না হলে ছোঁয়া যেতো না। কিন্ত এত নির্জন গ্রাম থেকে দুরে কেন একাকী!কেন ই বা তার কড়া নাড়ার শব্দে তৎক্ষণাৎ জানালা খুলল, সে বিপদগ্রস্ত ভেবে,এক হেচকা টানে দরজা খুলেই ঘরে টেনে নিল! কেনই বা তার গৃহে টেবিল ঘড়ি! যেটা আমাদের বাড়িতেও নেই ।

বৃদ্ধা তার দিকে মিটি মিটি হাসছিল, চঞ্চলের কেমন ভয় করছিল। তবে বৃদ্ধার এক কথায় সব ভুল ও ভয় দুর হল। বৃদ্ধা বলল, "আজ আমার স্বামীর আকাঙ্খা পূর্ন হল, এই গ্রাম ছেড়ে দুরে বাড়ী করতে আমাকে স্বপ্নে আবেদন করে।উনি ভীষণ ধার্মিক ছিলেন, হিন্দু ধর্মের ওর ঠাকুরদা ছিলেন, এক বিশেষ কারণে তিনি ধর্মান্তারিত হোন, তাই হিন্দুদের উপর ওর খুব আবেগ শ্রদ্ধা ছিল। এই পুকুরের যে উচু উচু পাড় দেখছ ওটা কবরখানা, দিনে কোন সমস্যা নেই, পুকুর পাড়ের বন ঝোপে ঘুরে বেড়াও কোন ভয় নেই, কিন্ত বিশেষ বিশেষ তিথিতে রাত বারোটা থেকে ভোর অবধি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, অতৃপ্ত অশরীরী জলে ঝাঁপ মারার মত শব্দ করে , নর মাংস পচার মত গন্ধ ছড়ায়, মানুষ কে গোলকধাঁধায় ফেলে বিভ্রান্ত করে , সুযোগ পেলেই জলে ফেলে দেয় ,তার তখন মরা ছাড়া উপায় থাকে না,তোমার যেমন হাল হয়েছিল ভয়ে হাঁপাচ্ছিলে ,খুব দুর্বল ক্লান্ত লাগছিল।"

চঞ্চল থামিয়ে বলল "ঠাকুমা এখানে এই পুকুরে কোন মানুষ মরা দেখেছ!"

বৃদ্ধা জানালেন "হ্যা আমি এখানে ছ বছর ঘর করে বাসকরছি, তার মধ্যেই চারজন এই পুকুর রাতে জলে ডুবে মরতে দেখেছি।যাদের চিৎকার শুনেছি, কিন্ত তোমার মত আমার আশ্রম কেউ চায়নি, আমি সাহায্য করতে পারিনি ,তাই খুব দুঃখ হয়।

আমার স্বামীর এখানেই কবর আছে অশরীরী হলেও তিনি আগের মতই সৎ, তাই বিপদগ্রস্ত মানুষের পিছু পিছু গিয়ে তার সীমিত শক্তি দিয়ে  দুষ্ট অশরীরীর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করে। আবার  এই পিছু নেওয়া শব্দের ভয়ে পুকুরের দিকে সে না যায়, বা গ্রামের দিকে ফিরে যায় ,বা খুব সতর্ক হয়ে যায়, সেটাও করে। এলাকার মানুষ সব জানে ,তারা তাই রাতে এই পুকুর এড়িয়ে যায়, দরকারে অনেকটা ঘুরপথে যায়।তোমার মত কোন দুরের মানুষ হয়ত কোন রাতে যায়,আর বিশেষ তিথিতেই এই অশরীরীরা জেগে ওঠে।"

চঞ্চল বলে "ও! তার মানে যিনি আমার পিছু পিছু আসছিলেন..." বৃদ্ধা ব্যাকুল ভাবে বলল "তুমি শুনতে পেয়েছিলে!" 

চঞ্চল বলল "হ্যাঁ ঐ ভয়েই আমি তোমার ঘরে কড়া নাড়ি, পুকুরে মানুষের মত ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ আমি বড় বড় মাছ বা ভোঁদরে লাফ ঝাঁপ ভাবছিলাম। আর পচা গন্ধ নিকটে কোন ভাগাড়ে পচা পশুর ভাবছিলাম। "

বৃদ্ধা বললেন "পুবের আলো ফুটে গেছে ,আর ভয় নেই তুমি ট্রেন ধরতে হলে এবার হাঁটা দাও"

চঞ্চলের মনে হল যেন ঠাকুমাই বলছেন। বৃদ্ধা দরজা খুলে পুকুর পার করিয়ে বিদায় নিলেন। তার চোখে জল,বললেন এত রাতে কখনও আসবে না, যদি ভুলেও চলে আসো পুবের আলো না ফোটে এই ঠাকমার ঘরে বাকী রাত থেকে যাবে।

চঞ্চল দুর থেকে বৃদ্ধার উদ্দেশ্য মাথা হেট করে নমস্কার জানিয়ে বলল "তোমার সাথে আমি আজীবন সম্পর্ক রাখব আর যাবার পথে আর্শীবাদ নিয়ে যাব।"

বৃদ্ধা দুচোখ আনন্দ অশ্রুতে ভরে গেল কথা বের হল না শুধু জোরে জোরে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন নিজের অজানা কোন আপনজনকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror