বোধহয় ভৌতিক
বোধহয় ভৌতিক


আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। অস্বস্তিটা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। বালিশ সরিয়ে উঠে বসলাম। এত জোরে জোরে বাজ পড়ছে আর মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে যেন আকাশটাই ভেঙে পড়লো বুঝি। জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে হু হু করে ভেজা স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা হাওয়া অনবরত ঘরে ঢুকে আসছে। সেই হাওয়ায় মশারিটা ভারী বিশ্রীভাবে দুলছে। আর তার ছায়াটা দেয়ালে কমা বাড়া করছে। এমন শীতল হাওয়ায় ঠাণ্ডায় গা শিরশির করারই কথা। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে আমার কপাল, গলা, বুক, পিঠ ঘেমে উঠেছে। কারেন্ট অফ হয়ে রয়েছে। ঘরের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি একলা।
মাত্র ছয়মাস হলো এই নতুন বাড়িতে ভাড়া এসেছি আমরা। আমার স্বামী ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ওষুধের ব্যাগ নিয়ে নিয়ে ওনাকে ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরে ঘুরে কোম্পানির নতুন পুরনো সব ওষুধের গুণাগুণ বুঝিয়ে বেড়াতে হয়। কখনো কখনো অন্য জেলায় বা অন্য রাজ্যের শহরেও যেতে হয়। তখন আমাকে একাই থাকতে হয়। তাই আমার নিরাপত্তার খাতিরেই আমার স্বামী এই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন, জেলা সদর শহরের ঠিক মাঝ মধ্যিখানে। বাড়িটায় বাড়িওয়ালা বা অন্য ভাড়াটে না থাকায় বেশ একটা নিজের বাড়ি নিজের বাড়ি অনুভূতি আছে। আর এই ব্যাপারটাই আমার স্বামীকে খুব টেনেছিলো। স্বাধীনচেতা ধরনের মানুষ। কারুর কোনো কথা শোনবার মানুষ নন। তাই এতোবড় বাড়িতে আমার একদম একলা থাকতে ভয় হওয়ার মৃদু প্রতিবাদটা একেবারেই ধোপে টেকেনি।
আমাদের মাত্র বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। একেবারে দুম করে বিয়ে, সম্বন্ধ দেখে। তবে এখনো আমাদের সংসারে তৃতীয় কেউ আসেনি। আমার মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ স্বামী এসব ব্যাপারে খুব সতর্ক। দুম করে বিয়ে হয়েছে মানেই দুম করে বাচ্চা হতে হবে তেমন কোনো মানে নেই। কাজেই নিয়মিত ফ্যামিলি প্ল্যানিং চলছে। স্বামীর উৎসাহেই আমি আবার খুব চেষ্টাচরিত্র করে বিএড কলেজ ভর্তি হয়েছি। স্বামীর মতে বিএসসি অনার্স পাশ করে ঘরে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না আজকালকার দিনে। সুতরাং আমাকে ফেসবুকে আর ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আডডা মারা আর টিভিতে সিনেমা দেখায় ইতি টানতে হলো। নতুন করে শুরু হলো পড়াশোনা, আর সেই সঙ্গেই চলছিলো চাকরি-বাকরিরও পরিকল্পনা।
সেদিন আমার প্ল্যান ছিলো যে স্বামী ফিরলে পুজোর বাজারটা খানিক সেরে রাখবো। স্বামীকে সেরকমই বলা ছিলো। বিএডের কিছু প্রোজেক্টের ছবি আঁকার কাজ ছিলো। ছবি আঁকতে আমি তেমন পারিনা, আসলে কখনো শিখিনি তো, স্কুল কলেজে দিদি দাদার সাহায্যে উৎরে যেতো। কিন্তু এখন উপায় নেই। প্রোজেক্টের খাতায় করতেই হবে। আমার বিষয় জীবন বিজ্ঞান। সেই বিষয়েই আঁকাআঁকি। দেখে দেখে মোটামুটি দাঁড় করিয়েছিলাম। একটু সামান্য শেডিং বাকি। ঠিক সেইসময়ে আমার স্বামীর ফোন। ফিরতে দেরি হবে। আজ আর পুজোর কেনাকাটার সময় হবে না। ফোনটা চার্জে বসানো ছিলো বলে আমি উঠে গিয়েছিলাম ফোন ধরতে। খাতাটা খোলাই ছিলো। ফিরে এসে খাতার সামনে বসে চমকে গেলাম। আমি তো শেডিং বাকি রেখেই উঠেছিলাম। হ্যাঁ, আমার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু আমার আঁকা মানুষের সংবহনতন্ত্রের স্কেচের প্রতিটা শিরা ধমনীতে লাল নীল পেন্সিলে রং করা আর হৃদপিন্ডটা টকটকে গাঢ় লাল। সংশয়ে পড়ে গেলাম।আমি কিছুতেই মনে করতে পারলামনা যে, আমি ঠিক কোনখানে আঁকা থামিয়ে ফোন ধরতে গিয়েছিলাম। এই দিনেদুপুরে এসব উল্টোপাল্টা ভাবনা মাথায় আসছে কেন? আবার দেখলাম। নাহ্, চোখের ভুল তো নয়। কোনোরকমে খাতাটা বন্ধ করে উঠে পড়লাম। বাইরে সন্ধ্যা ঘন হয়েছে, খুব মশার উৎপাত। এতোবড় বাড়িতে একলা আমি, গিয়ে চুপ করে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।
আবার খুব জোরে বাজ পড়লো। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। আমি চমকে উঠলাম। বিদ্যুতের আলোয় ঘরটা এক ঝলকের জন্য জেগে উঠে আবার গভীর অন্ধকারে ডুবে গেলো। বৃষ্টির দাপট শুনে মনে হচ্ছে যেন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মনকে শক্ত করতে চাইলাম। ভয়কে প্রশ্রয় দিলেই বাড়তে থাকে। এখন আমি যথেষ্ট বড়, বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটবেলার মতো ভয় পেলে চলবেনা। আমাকে এবার খাট থেকে নেমে আলো জ্বালাতে হবে। মোবাইলটা নিতে গেলাম, ওতে টর্চ আছে। কিন্তু মোবাইল-টর্চটা কিছুতেই জ্বললোনা। অধৈর্য্য কলিংবেল বাজছে। আমার হাত-পা ভারী হয়ে আসছে। উঠে গিয়ে দরজা খোলার সাহস সঞ্চয় করতে পারছিনা। যদি আমার স্বামী না হন?
এবার আমার স্বামীর চিৎকার শুনতে পেলাম, "রঞ্জা, দরজা খোলো, সারাবাড়ি অন্ধকার করে রেখেছো কেন? রঞ্জা, রঞ্জা..."! আমি কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে খাট থেকে নামলাম। সুইচে হাত রাখার আগেই আলো জ্বলে উঠলো। কারেন্ট এসে গেছে।
দৌড়ে গিয়ে আমি দরজা খুলে আমার স্বামীর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, "এতো দেরি করেছো কেন?" আমার স্বামী উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, "কি হয়েছে? এরকম অন্ধকারে বসেছিলে কেন? আর দেরি করেছি কোথায়? আটটায় আসবো বলেছিলাম, বৃষ্টিতে আধঘন্টা মতো দেরি হয়েছে মাত্র।" আমি আর কিছু বললামনা। স্বামীকে আঁকড়ে ধরে ঘরে এলাম। স্বামী বললেন, "এভাবে অন্ধকার করে রাখলে বিপদ হতে পারে তো!" আমি দুপুর থেকে ঘটে যাওয়া সবকিছু বললাম সংক্ষেপে। আমার স্বামী কেমন একটা মুখ করে তাকালেন আমার দিকে। দুজনেই বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট... এরকম আজগুবি অভিজ্ঞতা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বৈকি।
এরপরে কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। মনের ভুল ভেবে একরকম ভুলেই গেলাম সেদিনের কথা। আমার পুজোর ছুটি পড়ে গেছে, আমার স্বামীও কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছেন। কলকাতার বাড়িতে যাবো পুজোয়। গোছগাছ সেরে রেখেছি রাতেই। ভোরবেলা বেরোবো বলে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে। আমার স্বামী আমার দিকে পাশ ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোন, আমিও ওনার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমোই। গত দুবছরে অভ্যেস এমনই হয়েছে। সেদিনও সেরকমই ঘুমিয়েছি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার হাতে একটা খুব শীতল স্পর্শে। ঘরে নীল নাইটল্যাম্পের হালকা আলোয় দেখলাম আমার স্বামী অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। আমি ঘাড় তুলে দেখতে চেষ্টা করলাম, বাড়ির পেছনদিকের বাগানে ঝোপঝাড় আছে, সাপখোপ নয়তো? সর্বনাশ! মনে হতেই উঠে বসে পড়লাম। আমার স্বামীকে পেছনদিক থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে একটা মেয়ে... আমার বয়সীই হবে। আমি বিকট চিৎকার করে উঠলাম।
তারপর থেকে কলকাতায় আমার কাউন্সেলিং চললো অনেকদিন। একা থাকতে থাকতে মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সাব্যস্ত হলো। তবে বাড়িটাও পাল্টানোর কথা চলছে। আমরা ভাড়াবাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়ি বদল হবে। আসার আগের দিনে শুনলাম, আমার ঠোঁটের কোণে নাকি সেদিন রক্ত লেগেছিলো। আমার স্বামী খুব নীচু গলায় আড়ালে ডাক্তারবাবুকে বলছিলেন। আমাদের জিনিসপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে। পরদিন খুব সকালেই এবাড়িটা ছাড়বো আমরা। ভোরবেলা ট্রান্সপোর্টের লোকেরা এসে গেছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষে দরজা খোলা পেয়ে তারা ভেতরে ঢুকে এলো। শোবার ঘরে বিছানায় আমার স্বামীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো, ঘাড়ে শুধু দুটো ফুটো। সবে সকাল হয়েছে, এখনো রোদ চড়েনি। আমি এর সবকিছুই দেখলাম বাড়ির পেছনের লম্বা পেয়ারাগাছটার ডালে বসে। সেই মেয়েটা আমার স্বামীকে জড়িয়ে শুয়ে আছে, তবে তাকে আমি ছাড়া কেউ দেখতেই পাচ্ছেনা। রোদ চড়ে গেলে আবার আমার চোখে কষ্ট হবে। তাই আমি ডানা গুটিয়ে পায়ের নখে পেয়ারাগাছের ডাল আঁকড়ে উল্টো হয়ে ঝুলে পড়লাম।