দাম্পত্য মাধুরী
দাম্পত্য মাধুরী
আজকাল কাঙালি অভয়ার শয়নকক্ষে দাম্পত্য মাধুরী সুবাস ছড়ায়। দেখে লক্ষ্মীর মনটা ক্ষোভে, দুঃখে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। ভাই-ভাজের ঘরে উঁকি দেওয়াটা শোভন নয়, তাই লক্ষ্মী তা দেয় না। কিন্তু ওদের দেখলেই বুকে এক অবুঝ ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউয়ের চূড়ায় একজনই দোলে। সে অমল।
দিনমণি আত্মপ্রকাশের আগেই অমলের দিন শুরু। সকালে সে অনেক কসরত করে, নিয়মিত শরীরচর্চায় অমল ভারী যত্নশীল। রোজ মুগুরভাঁজা থেকে শুরু করে ডন-বৈঠক ও জগিং পর্যন্ত কিছুই বাদ দেয় না। সকালের এই খানিক সময় তার একান্তই একার। বেলা বাড়লে তার ক্ষেত আছে, খামার আছে, মুনিষ রাখালদের কাজের তদারকি আছে।
এর ওপর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও ভারী খুঁতখুঁতে অমল। নিজেই রাতে ছোলা, বাদাম, অ্যামন্ড ভিজিয়ে রাখে এবং সকালে সুদীর্ঘ সময়ের শরীরচর্চার পরে একটু জিরিয়ে আখেরগুড় সহযোগে ছোলা বাদাম খেয়ে পুকুরে সাঁতরে স্নান সেরে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে পূজার্চনা করে।
তারপর অমল তার বাঁশীখানা নিয়ে বসে। ধীরে ধীরে বাঁশীর গায়ে হাত বুলোয়। বিড়বিড়িয়ে ইষ্টনাম জপ করে বাঁশীতে ফুঁ দেয় অমল। চোখ বন্ধ, অমলের বাঁশীতে খেলছে সাতসুর। সেই সুর যেন পাক খেয়ে খেয়ে গাঁয়ের পথে ঘাটে ঘুরছে, খাদে চড়ায় কড়ি কোমলের সূক্ষ্ম নিপুণ ধরা ছাড়ায়। অমলের আঙুলগুলো পেলব মসৃণতায় সৃষ্টি করে চলেছে অপার্থিব সুরের মায়াজাল। বুড়ি পিসি, মঙ্গলা গাই, জগাই বাছুর, ভুলো কুকুর, গঙ্গারাম টিয়া আর রাজা-রাণী রাজহাঁস জোড়াকে নিয়ে অমলের সংসার.... দুকামরা মাঠকোঠা ঘর, নিকোনো উঠোনের কোণে তুলসীমঞ্চ, আলকাতরা লেপা ধানের ছোট গোলা আর বাঁশঝাড়ে ছাওয়া খিড়কি পুকুর ঘিরে। শান্ত স্নিগ্ধ ধীরস্থির মাটো রঙা পাথরকোঁদা যুবক অমল আপনাতে আপনি মগ্ন।
একজোড়া চোখ যে চলতে ফিরতে সর্বক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে নিবদ্ধ, তাতে তার ভ্রূক্ষেপও নেই। অমলের বাঁশীতে যখন ধূন ওঠে "ও পরাণবন্ধু রে...এ...এ...এ", চোখজোড়ার মালকিন তখন তপ্তশ্বাস আর বুকের হাপর নিয়ে ভাবে পরকীয়ায় কি দোষ? চোখজোড়ার মালকিন লক্ষ্মী অমলদের প্রতিবেশী নিঃসন্তান রমণী ঘোষের দ্বিতীয় পক্ষ। সেদিন যখন অমল এসে রমণী খুড়োদের দাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, "খুড়িমা, খুড়োমশাইয়ের ওষুধটা। পথে কোবরেজ মশাইয়ের সাথে দেখা, উনি আসছিলেন এদিকেই, আপনাদের বাড়ীতে। ওনার মুখেই শুনলুম খুড়োমশাইয়ের হাঁপটানটা বড় বেড়েছে। এখন কেমন আছেন উনি?"
খুড়িমা ডাক শুনে লক্ষ্মী পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক পল। তার ভেতরটা যেন নড়ে কেঁপে উঠলো ক্ষণেকের তরে। তার বুদ্ধি তার মনকে ধিক্কার দিয়ে উঠলো সর্বান্তকরণে। খসে পড়া ঘোমটা টেনে মাথায় তুলে লক্ষ্মী অমলের সম্বোধনের মান রাখলে, "খুব ভালো নয় বাবা, বড় কষ্ট পাচ্ছেন। তুমি বরং বাবা একটু ওনার কাছে ঘরে গিয়ে বোসো। আমি তোমাদের জন্য একটু চা করি।"
গনগনে আঁচের ওপর ফুটন্ত চায়ের জল থেকে ওঠা বাষ্প আর লক্ষ্মীর চোখ থেকে বেরোনো বাষ্প মিশে যাচ্ছে। লক্ষ্মী প্রথমে ভাবে পরকীয়া কি সত্যিই খুব দোষের?
পরক্ষণেই লক্ষ্মীর মন ঘুরে যায়। ভাবনায় ছেদ পড়ে। চোখের বাষ্প এবারে চোখের কোলে বৃষ্টি ঝরায়। চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে সেই উষ্ণ বৃষ্টির উষ্ণ জল। উষ্ণতা ধুয়ে দেয় মনের সব মালিন্য, সব দীনতা। লক্ষ্মী নতুন করে ভাবে-- সংসারে সম্পর্কের মান রাখতে পরকীয়া সত্যিই বড্ড দোষের। বড্ডই দোষের। পরকীয়ায় হয়তো মনের মাধুরী মিশে যায়... মন পোড়ানোর জ্বলন কমে... মনে মনে হাজার তারার আলো জ্বলে... অকাল দীপান্বিতা - দোল - দুর্গোৎসবের আনন্দ হিল্লোল বয়ে যায়... কিন্তু পরকীয়ায় যে দাম্পত্য মাধুরী নেই! দাম্পত্য মাধুরীর অভাবে পরকীয়া বড় দীন, বড় হীন, বড় দরিদ্র।
লক্ষ্মী গলায় আঁচল দিয়ে বিড়বিড় করে, "আমার স্বামীকে নীরোগ করো, ঈশ্বর! দাম্পত্য সুখ দাও। দাম্পত্য মাধুরীর সুবাসে জীবন ভরে দাও।"
--------------------------------------