দাম্পত্য মাধুরী
দাম্পত্য মাধুরী




এই কাহিনী হলো গিয়ে বিগত বিংশ শতকের প্রথম দশকের কলকাতার এক গড়পড়তা উচ্চবিত্ত একান্নবর্তী যৌথ বাঙালি পরিবারের। বিবাহযোগ্য এক শিক্ষিত সুপুরুষ সদ্যযুবকের বিবাহের জন্য পাত্রী খোঁজা শুরু হলো। পাত্রের তেমন কোনো দাবী-দাওয়া নেই... কেবলমাত্র দুটি অতি সামান্যই দাবী তার। পাত্রীর যেন বাংলা অক্ষরজ্ঞান থাকে এবং পাত্রীর বাপের বাড়ির লোকের যেন জামাইয়ের বিলেতে গিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছায় কোনো আপত্তি না থাকে।
গালে পান ঠুসে নিয়ে, "তা বেশতো, এতো অতি উত্তম কতা! তেমন মেয়েও আচে বৈকি... এট্টু খোঁজখপর কোরেনি," বলে ঘটক ঠাকরুন তখনকার মতো বিদায় নিলেন। তারপর প্রায় মাসখানেক বাদে পাথুরেঘাটার মিত্তিরবাড়ি থেকে উপযুক্ত মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে তিনি এলেন এই দর্জিপাড়ার দত্তবাড়িতে। পাত্র কাঙালীচরণ তখন তার কালেজের ইয়ারদোস্তদের সাথে বসে আত্মা আছে কি নেই সেই গুরুতর চর্চায় ভারি ব্যস্ত। পেয়ালার পর পেয়ালা চা তৈরি হচ্ছে এবং নোনতা ভাজা ও মিষ্টি সহযোগে তা পৌঁছে যাচ্ছে দোতলায় কাঙালির লাইব্রেরী লাগোয়া ছোট বসবার ঘরখানাতে। ঘরের সামনেই দোতলার টানা বারান্দা ধরে সর্বক্ষণই বাড়ির দাস-দাসী আর সেরেস্তার কর্মচারী এবং বাড়ির ছোট ছেলেপুলেদের যাতায়াত। তাদের মধ্যেই কোনো দুজন দাসীর কথোপকথন হঠাৎই কানে এলো কাঙালির, "ছোটোবাবুর বে'র জন্যে মেয়ের খপর নিয়ে ঘটক ঠাকরুন এয়েচেন নীচে। খেঁদি, যাতো বাছা, বড়ো গিন্নিমাকে খপর করগে যা।" কথা কয়টি কানে আসতেই কাঙালির কান গরম হয়ে উঠলো। আত্মা সম্পর্কে ঠিক কী আলোচনা চলছিলো তখন যেন, তা আর কিছুতেই কাঙালিচরণের মনে পড়লো না। বন্ধুবর্গের উৎসাহেও যেন কেমন ভাটা পড়লো। চা ও জলযোগও ততক্ষণে শেষ হয়েছিলো। বন্ধুরা বিদায় চাইলে, সেদিন আর কাঙালি তাদের আটকালো না। কারণ তার দাবী অনুযায়ী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্না কেমন পাত্রীর খোঁজ ঘটক ঠাকরুন এনেছেন, তা জানবার জন্য সদ্য একুশ উত্তীর্ণ হিন্দু কালেজের প্রগতিশীল ছাত্র কাঙালিচরণ দত্তের ঔৎসুক্যের পরিসীমা নেই তখন।
কয়েকদিনের উৎকন্ঠার পরে কাঙালি শুনলো... ছোট খুড়োমশাই আর বড়ো পিসেমশাই দুজনে ঘটক ঠাকরুন ও সেরেস্তার নায়েবমশাইকে সঙ্গে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেছেন। পাত্রী তেরোবছর বর্ষীয়া... যথেষ্ট সুশ্রী, শান্ত ও সুলক্ষণা। নাম অভয়াবালা। পাত্রপক্ষের পাত্রী বেশ পছন্দ। পাকা কথা দেওয়ার আগে ঐ শুধু একটু বাজিয়ে নেওয়া আরকি... নিয়মরক্ষার তাগিদে। সব ভালো করে জেনেশুনে না নিলে বাড়ির মহিলারা আবার বাঁকাকথা শোনাতে ছাড়বেন না... তাঁদের যে পাত্রী পছন্দ করতে আসার রীতি-রেওয়াজ নেই। কাজেই বাড়ির পুরুষদের তাঁরা পইপই করে করে বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন কীকী বিষয়ে জেনে নেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
কাঙালির ছোট খুড়োমশাই পাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন --"মা লক্ষ্মী, তা তুমি রান্নাবান্না কিচু জানোতো? নাকি না?"
বড়ো করে ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিলো অভয়াবালা, "হ্যাঁ"।
-- "তা কীকী রাঁধতে জানো এট্টু বলোতো মা?"
-- "নুচি, কুমড়োর ছক্কা, ছোলা-বুটের ডাল, হালুয়া, পায়েস, মোহনভোগ, ক্ষীর..."
-- "তা বেশ, তা বেশ! বৈকালের জলখাবার ঐ ওতেই বেশ হবে। তা মা শুনিচি তুমি নাকি লেকাপড়াও করতে পারো!"
অভয়াবালা লজ্জায় মাথা নীচু করে বুকে চিবুক ছোঁওয়ায়। ঘটক ঠাকরুন আর অভয়ার বড়ো জ্যাঠামশাই সমস্বরে উত্তর দেন, "রোজ রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনায় বাড়ির সব্বাইকে।"
কাঙালির বড়ো পিসেমশাই জিজ্ঞেস করেন এবার, "তা মা লক্ষ্মী, লেকাপড়া কী গুরুমশায়ের কাচে শিকোচো?" প্রশ্ন শুনে অভয়াবালা মাথা নীচু করেই দু'দিকে প্রবলবেগে ঘাড় নাড়ে। অভয়ার হয়ে বড়ো ঠাকুরদামশাই উত্তর দিয়ে দেন, "আরে রামোঃ, না না! কোনো গুরুমশায়ের কাচে আমাদের ঘরের মেয়ে নেকাপড়া শিকবে? এটা এক্কানা কতার মতো কতা হলো কি ঘোষমশায়? অভয়া মায়ের আমাদের বড্ড মাতা! দাদাদের নেকাপড়া শুনে শুনেই সে শিকে নেয়।"
কাঙালির বড়ো পিসেমশাই পাইকপাড়ার ডাকসাইটে ঘোষবাড়ির বড়ো তরফের বড়ো ছেলে... দর্জিপাড়ার দত্তবাড়ির বড়ো তরফের বড়োজামাই। তাঁর মান-মর্যাদা বিচার-বিবেচনাই আলাদা ধাঁচের। সায় দিলেন পাত্রী অভয়াবালার বড়ো ঠাকুরদামশাইয়ের কথায়, "বটেইতো, বটেইতো! আমাদের কাঙালিরতো ঐটুকখানিই দাবী... বৌ একটু লেকাপড়া জানবে। সেওতো বড্ডো একজন পুঁথিপোড়ো ছেলে কিনা! হিন্দু কালেজে তার আদর-কদরই আলাদা... বুজলেন কিনা? বিলেতে যাবার কতাওতো চলচে তার।" ঠারেঠোরে বড়ো পিসেমশাই কাঙালিচরণের সামাজিক অবস্থানটি পাত্রীপক্ষকে বেশটি করে বুঝিয়ে দিলেন। স্নেহপ্রবণ চোখে অভয়াবালাকে বলেন, "এসোগে মা লক্ষ্মী, এবারে ভেতরে এসোগে।"
প্রায় ছুটেই ভারি বেনারসির পুঁটুলি পাকানো অভয়াবালা ভেতরে চলে গেলো দাসী পরিবৃত হয়ে। হয়ে গেলো পাত্রী পছন্দ। এবারে রইলো বাকি কেবল দেনাপাওনার কথা। সেসব কথা বলবার কইবার জন্য অবশ্য সঙ্গে সেরেস্তার নায়েবমশাই আছেন। তাঁকে সবরকম নির্দেশ দেওয়াই আছে। অবরেসবরে কিছু বলবার কইবার থাকলে বাড়ির কর্তারা তা জানাবেন। সুতরাং কথা মাখনের মতো মসৃণ গতিতে এগিয়ে গেলো। দর্জিপাড়ার দত্তবাড়িতে বৌ হয়ে যাবে পাথুরেঘাটার মিত্তিরবাড়ির মেয়ে... দেনাপাওনায় কখনো আটকায়? কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেলো। বিবাহের দিনক্ষণ সবই ধার্য হলো কথা পাকা হতেই।
তারপর মাঘের এক শুভদিনে শুভলগ্নে তেরোবছরের অভয়াবালার সঙ্গে একুশবছরের কাঙালিচরণের শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়ে গেলো। যথাবিহিত শুরু হলো তাদের দাম্পত্যজীবন। বাড়িভর্তি সমবয়সী ননদ দেওর ভাসুরপো ভাসুরঝি ভাগ্নে ভাগ্নীর সঙ্গে দিনরাত হেসে খেলে গল্প করে অল্পদিনেই অভয়া ভারি মিশ খেয়ে গেলো শ্বশুরবাড়িতে। অষ্টমঙ্গলা, ধুলোপায়ের দিন, সুবচনী সত্যনারায়ন... সব একে-একে মিটতে এবং বিবাহ উৎসবের রেশ কাটতেই আত্মীয়-স্বজন অতিথিরাও বিদায় নিলেন। এইবার ঠিকঠিক সংসারযাত্রা শুরু হলো অভয়া ও কাঙালির। দিদিশাশুড়ি, জ্যেঠশাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি, শাশুড়িমা, পিসশাশুড়ি, মাসশাশুড়ি, তিন তরফের তিন বাল্যবিধবা ননদ... সবাইয়ের সমবেত তত্ত্বাবধানে শুরু হলো অভয়াবালার সংসারের তালিম। তবে বকাঝকার বিশেষ চল নেই এবাড়িতে। এতে ভারি স্বস্তি পেলো অভয়াবালা।
রোজ বিকেলবেলা বালিকাবধূকে চুলে তেল দিয়ে রকম রকমের বাহারি খোঁপা বেঁধে দেন বাল্যবিধবা পিসশাশুড়ি। সোনার ঝুমকো দেওয়া রূপোর কাঁটা আর সোনার ফুলকাটা বাহারি চিরুনি গুঁজে দেন খোঁপায়। তারপর তারিফের চোখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নববধূকে দেখে তার চিবুক ছুঁয়ে আশীষ দেন। কিন্তু কী জ্বালাতন! রাত্রিবেলায় শুলেই মাথায় কাঁটা আর চিরুনির দাঁড়া ফুঁটে যায়। অসুবিধার কথা কাঙালিকে মুখ ফুটে বলে ফেলে অভয়া। কাঙালি ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করায় নববধূকে। রাতে ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে বৌকে কোলের কাছে বসিয়ে কাঙালি বৌয়ের খোঁপা খুলে দেয় নিজের হাতে। তারপর কাঙালির বুকে হেলান দিয়ে বসে নিজের পছন্দমতো বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে মুচকি হেসে অভয়া বলে, "আপনার নামখানা অমনধারা কেন?" হতভম্ব কাঙালি... কখনোতো নিজের নাম নিয়ে সে ভাবেইনি, বোকাবোকা অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলে, "কেমনধারা?" খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ে অভয়া বলে, "কেমন যেন দুঃখী-দুঃখী পারা?...হি হি হি..."! তরুণ কাঙালি শক্ত আলিঙ্গনে বাঁধে সদ্যকিশোরী অভয়াকে, "চুপ, চুপ, সবাই শুনতে পাবে যে! তোমায় মন্দ বলবে যে!" "ইস্, বললেই হলো? আপনি আচেন কী কত্তে?" অভয়া আদুরে গলায় বলেই বরের গলার ভাঁজে মুখ লুকোয়। অভয়ার চোখ বোজা, নাকের পাটা তিরতির করে কাঁপছে। কাঙালির বুকের বাঁ-দিকের যন্ত্রখানি বড্ডো জোরেজোরে হাতুড়ি পিটছে যেন... ঢিপঢিপ... ঢিপঢিপ... ঢিপঢিপ! কাঙালির উত্তপ্ত শ্বাস অভয়ার সর্বাঙ্গে কেমন যেন এক শিহরণ জাগায়। সেই উত্তেজনা আর শিহরণ হাসির ঝর্ণাধারা হয়ে দু'জনকে ভিজিয়ে স্নান করায়।
কাঙালি একহাতে বৌকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেকহাতে তুলে নেয় বই। হাত বাড়িয়ে উস্কে দেয় বিলিতি ল্যাম্পের আলো। সাদা ধবধবে বিছানায় সেই আলো কতরকমের কারিকুরি করে। কেমন ছায়া-ছায়া মায়া-মায়া। অভয়া শাড়ির আঁচল গুছিয়ে কাঙালির বুকের কাছটিতে আরো ঘেঁষে বসে। কাঙালির আঙুল খেলা করে অভয়ার বাহুতে, কোমরে, গলায়। কতরকমের মোটামোটা লাল নীল সবুজ বাঁধাইকরা সব ইংরেজি বই। তার থেকে কাঙালি বৌকে পড়েপড়ে শোনায় শেলী - বায়রন - কিটসের কবিতা... মানে বলে-বলে বুঝিয়ে দেয়। শোনায় হেলেন অফ ট্রয়ের গল্প, ওথেলো ডেসডিমোনার গল্প, অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার গল্প, রোমিও জুলিয়েটের গল্প। মাঝেমাঝে পড়ে পুরাণের কাহিনী। সংস্কৃত থেকে বাংলায় তর্জমা করে কাহিনীর ভাবার্থ বুঝিয়ে দেয়। অভয়া শিহরিত হয়। আরো জোরে দুহাতে জড়িয়ে চেপে ধরে থাকে কাঙালিকে। এভাবেই দিন গড়ায়, মাস গড়ায়, বছর গড়ায়... অভয়া একেকদিন সুর করে কাঙালিকে বাংলায় অনুবাদিত রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনায়। পড়তে পড়তে কোনোকোনো জায়গায় ঠেকলে কাঙালিই তার মানে বুঝিয়ে দেয় সরল করে। মাঝেমাঝে অভয়া কাঙালির হাত ধরে টেনে মেঝেতে বসায়। তারপর বিয়ের তত্ত্বে ও যৌতুকে পাওয়া দমদেওয়া খেলনা পুতুলগুলি নিয়ে খেলে দুজনে একসঙ্গে বসে। কিড়কিড় কড়কড় আওয়াজে পুতুলেরা চলে মেঝে জুড়ে। একমনে বৌ পুতুলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। আর বৌয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে একুশ উত্তীর্ণ সদ্যযুবক কাঙালিচরণ তার তেরোবছরের বৌয়ের অবয়বের প্রত্যেক বিভঙ্গে খুঁজে পায় হেলেন, ডেসডিমোনা, ক্লিওপেট্রা, জুলিয়েট অথবা শকুন্তলা, দময়ন্তী, বেহুলা, সাবিত্রীকে। ধীরেধীরে দুটি কুসুমকোমল প্রাণে উন্মিলিত হতে থাকে চিরন্তন প্রেমের অঙ্কুর... দুটি নবীন প্রাণে প্রেম জাগ্রত হয় সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পকোরকের মতো। দিনেকালে সেই কোরক পূর্ণতালাভ করে সাবালক হবে, সবকটি পাপড়ি মেলে ধরবে আর প্রেমসুধারসে পরিপূর্ণ হয়ে অবিমিশ্র দাম্পত্য মাধুরী ছড়াবে আজীবন নিরবিচ্ছিন্ন।
কালেজের একজামিন নিয়ে কিছুদিন কাঙালিচরণ ভারি ব্যস্ত হলো। সারাদিন হয় কালেজে, নয় বইয়ে মুখ গুঁজে। রাত গভীর অবধি পড়ার ঘরে। অভয়াবালার বড়ো একলা লাগে। মনখারাপে তার আর কিচ্ছুটি ভালো লাগেনা। তার শাশুড়িরা সিদ্ধান্ত নিলেন কাঙালির একজামিনের এই দিনকতক অভয়াবালা বাপেরবাড়ি থেকে ঘুরে আসুক। মনটা ফিরবে তাতে... সারাদিন মুখ কালো করে বেড়ায়! পালকি করে রওনা হবার সময়ে দোতলার টানাবারান্দায় অভয়া ঘোমটার আড়াল থেকে বারান্দার এমাথা ওমাথা উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়। কোত্থাও কাঙালিচরণ নেই। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে অভয়ার। মনেমনে ভাবে, "যান, থাকুনগে আরো বেশি করে নুকিয়ে... আমিও আর বাপের বাড়ি থেকে ফিরচিনে। তকোন বুজবেন মজাটা!" হুহুম-না হুহুম-না শব্দে বেহারারা পালকি নিয়ে চলেছে দর্জিপাড়া থেকে পাথুরেঘাটার পথে। সামনে পথ দেখিয়ে পাকানো গোঁফওয়ালা লেঠেল বরকন্দাজ... ছয় বেহারার পালকি। দত্তবাড়ির নববধূর পালকি। পালকির পাশেপাশে হেঁটে চলেছে মানদা দাসী আর ক্ষীরি বামনি... সঙ্গে আরো একদল দাস-দাসী। তাদের মাথায় পরাতে, ঝুড়িতে মেলাই উপঢৌকনের উপকরণ। দত্তবাড়ির নববধূ বাপেরবাড়ি যাচ্ছে... সে কি খালিহাতে যেতে পারে? শ্বশুরবাড়ির নাক কাটা যাবে না তবে? তবে অভয়ার সেদিকে মোটেই মন নেই। বারবার শাড়ির আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছছে সে। তার মন প্রাণ জুড়ে তখন কেবলমাত্র কাঙালি আর কাঙালি। আসবার কালে একবার চোখের দেখাটুকুও হলো না।
যদিও রাস্তাঘাট মোটেই তেমন চেনে না অভয়াবালা, তবুও কতদূর এলো দেখতে পালকির কপাট একটুখানি ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকালো অভয়া। পালকির ডান ধারে পাশেপাশে হাঁটছে মানদা দাসী আর ক্ষীরি বামনি... এরা দুজন অভয়ার শাশুড়ির খাস লোক। দরকারে অদরকারে অভয়ার সব খেয়াল এরাই রাখে। এবারে পালকির বাঁ-ধারে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে নন্দদাদার পাশে এক জোয়ান ছোকরা। মালকোঁচা মেরে পরা কালো পাড়ওলা কাপড়... গায়ে দোলাই, হাতে তেল চুকচুকে বাঁশের লাঠি, মাথায় তার গামছার ফেট্টি, মুখে কালচে ছোপ, নাকের তলায় মস্ত মোচড়ানো একজোড়া গোঁফ। পাশ থেকে একঝলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয় অভয়া... কারণ সেই জোয়ান লেঠেলও অভয়ার দিকে তাকিয়ে আছে! ও মাগো! মাথায় ঘোমটা লম্বা করে টানে অভয়া। পালকির দরজা মুড়ে বন্ধ করে দেয়। কে কোথায় দেখবে... তারপর তাই নিয়ে পাঁচটা ছোট-বড় কথা হবে, বাপের বাড়ির সহবৎশিক্ষার বদনাম হবে! অভয়ার বুকটা ধ্বক করে ওঠে, "ও মাগো, আমি এসব কী ভাবচি? লেঠেলকে ওনার মতো দেখতে কেন হবে? ছিঃ ছিঃ, একী পাপের ভাবনা? সীতা, সাবিত্রী, অহল্যা, তারা, মন্দোদরী... সীতা, সাবিত্রী, অহল্যা, তারা, মন্দোদরী... জপ করতে থাকে অভয়া, দু'চোখ প্রাণপণে বুজে... হয়তো পরপুরুষের মধ্যে স্বামীর ছায়া দেখতে পাওয়ার মহাপাপের স্খালন করতে। অভয়ার গাল বেয়ে জলের ধারা... মেয়েরা বাপেরবাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যেতে কেঁদে ভাসায়। আর অভয়ার হলো উল্টো বিপত্তি। শ্বশুরবাড়ি থেকে দিনকয়েকের জন্য বাপেরবাড়িতে যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে... বরের কালেজের একজামিনের কারণে। আর সে কিনা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে... স্বামীর বিরহে! চোখের জল মোছবার সময় চোখ খুলতেই অভয়া দেখে একটুকরো ভাঁজকরা কাগজ পালকির বাঁ-ধারের দরজার ফাঁক দিয়ে গলানো।
চোখের জলে গাল ভাসছে... ভাসুক... বুদ্ধিমতী অভয়া ঠিকই দেখেছে! হাসিমুখে তাড়াতাড়ি ভাঁজ করা কাগজের টুকরোখানা দু'হাতে তুলে নেয় অভয়া। তার দু'হাত থরথর কাঁপছে, তার বুকের ভেতর দমাদ্দম ঢাক-ঢোল বাজছে। কাগজখানার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে অভয়া। পালকির দুলুনিতে অভয়াও দুলতে দুলতেই পড়ে গোটাগোটা অক্ষরে কাঙালির হাতের লেখায় ক'ছত্রের চিরকুট, "লেঠেল সর্দারকে গোটা একটি টাকা বকশিস দিয়ে তারই কাছ থেকে ধারকরা পোশাক পরে আর রামযাত্রার রং মেখে গোঁফ জুড়ে ছদ্মবেশে তোমার পাশেপাশে যাচ্ছি তো! পালকির দরজাটা একটুকু ফাঁক করে রাখো। যাতে দেখতে পাই।" ঘোমটা সরিয়ে অভয়া চিরকুটের কাগজখানি খোঁপার ভেতরে গুঁজে রাখলো, "ভাগ্যে আজও আসবার কালে পিসিমা বাহারে খোঁপাখানা বেঁদে দিয়েচিলেন!" আবার ঘোমটা টেনে অভয়া পালকির বাঁ-ধারের দরজাটা একটুকু ফাঁক করে রাখলো। গোপন চোখাচোখিতেই পথ কোথা দিয়ে যেন ফুরিয়ে গেলো। পাথুরেঘাটার মিত্তিরবাড়ির সদর দেউড়িতে এসে পালকি থামলো। মানদা দাসী আর ক্ষীরি বামনি নতুন বৌকে দু'পাশ থেকে আঁকড়ে ধরে পালকি থেকে নামালো। বাড়ির ছোট-বড় সবাই প্রায় সদরে এসে পৌঁছেছে। বিয়ের পরে অভয়াবালা এই প্রথমবার এতোদিনকার জন্যে আসছে, তার স্বামী কাঙালিচরণের একজামিন বলে। যাতে তার পড়ার ক্ষতি না হয়, তাই আপাতত এই ব্যবস্থা।
অভয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে আগত দাস-দাসীদের খুব ভালো করে খাতির আপ্যায়ণ করা হতে লাগলো। অভয়ার বড়ো ঠাকুরমা নির্দেশ দিলেন, "ও অভয়া মা, তুমি নিজে হাতে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের আদরযত্ন করে খাওয়াও। বাপেরবাড়ির মাতা না হেঁট হয়, দেকো মা!" খুশিমনে ঘাড় নেড়ে অভয়া মা খুড়িমা জ্যেঠাইমাদের সাথে হাত লাগায়। এককোণে বসেছে জোয়ান নতুন লেঠেলটা। মোটে খেতে পারে না বেশি। অভয়া ঘোমটা টেনে তার সামনে গিয়ে তার পাতে, "আর দুকানা দিই", বলে চারটি ক্ষীরকদম ঢেলে দিলো ঠোঁট টিপে হেসে। কাঙালি এই মিষ্টিটি ভারি ভালোবাসে কিনা! কায়দা করে আঁচলের আড়াল করে একখণ্ড ভাঁজকরা কাগজ ফেলে দেয় নতুন লেঠেলের পাতের পাশে। সকলের চোখ বাঁচিয়ে সে কাগজ ঢুকে পড়ে নতুন লেঠেলের মাথায় বাঁধা গামছার ফেট্টির ভাঁজে। মন উসখুস করে ওঠে কী লেখা আছে দেখবার জন্য। বকশিস বিদায় নিয়ে অভয়ার শ্বশুরবাড়ির কুটুম্বসমান দাস-দাসীরা ফিরতিপথ ধরলো। পাথুরেঘাটা থেকে ফেরার সময়ে নতুন লেঠেলের ছদ্মবেশধারী কাঙালিচরণ মাঝপথে কোথায় যে দলছুট হলো, তার হিসেব লেঠেল সর্দার ছাড়া আর কারুর কাছেই রইলো না। ছোটবাবুর একাজে সাহায্য করে ইস্তক বড়ো ভয়ে ভয়ে ছিলো সর্দার, সে বেচারিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
রাতে পড়ার মাঝে বারবার হাতের চিরকুটে চোখ গেলো কাঙালির, অভয়া লিখেছে, "পড়ায় মন দেবেন। একজামিন ভালো হয় যেন। তারপর আমায় নিয়ে যাবেন।" কাঙালির একজামিন শেষ হবার দিনেই বৈকালে তার ভয়ানক বাহ্যে-বমি। ছেলে একবারে নেতিয়ে পড়েছে। তড়িঘড়ি পালকি গেলো পাথুরেঘাটার মিত্তিরবাড়িতে। বিন্দুমাত্রও কালবিলম্ব না করে অভয়া রওনা হলো... স্বামীর যে বড়ো অসুখ! বেশ গভীর রাতেই এসে পৌঁছোলো অভয়া। কাঙালি শোবারঘরের পালঙ্কে চোখ বুজে শুয়ে। অভয়া স্বামীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে শুধোয়, "একোন কেমন আচেন?" অভয়ার ঘোমটার একধার দিয়ে কাঙালির মাথাটা চাপা পড়ে গেছে। মাথাটা একটু উঁচিয়ে অভয়াবালার ঠোঁট দু'খানা নিজের উষ্ণ ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে কাঙালিচরণ। অভয়া বুঝলো এবার কাঙালির আসল রোগ! বার্লি খেয়ে শুয়েছিলো এতোক্ষণ। ঘুমের ভাণ করলো কাঙালি... বাড়ির সবাই নিশ্চিন্ত। এবারে অভয়াই সামলাবে। সবাই বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করে অভয়া, "অতকানি নুনগোলা জল খেয়ে যতি মন্দ কিচু হতো? তকোন?" কাঙালি অভয়ার মুখখানি দু'হাতে ধরে বলে, "নইলে তোমায় কীকরে আনাতুম বলো? কতদিন দেখিনি যে! কখন বড়মা আদেশ দেবেন, তারজন্যে অপেক্ষা করতুম তবে?" অভয়া খিলখিলিয়ে বলে, "রোমিওটা আমার কাঙালিই বটে!" কাঙালিও মুচকি হাসে, "আর আমার জুলিয়েটটাওযে সাক্ষাৎ অভয়া, তার বেলায়?" কাঙালি অভয়ার শয়নকক্ষে দাম্পত্য মাধুরী সুবাস ছড়ায়!
-