Goutam Nayak

Drama Romance

4.3  

Goutam Nayak

Drama Romance

প্রমিলা

প্রমিলা

12 mins
1.2K


গোধুলি বেলায় আর বাড়িতে বসে থাকা গেলো না, বৈঠক খানা থেকে বেরিয়ে দেখি নীল রতন বাবু বেরিয়েছেন কোথাও যাবে বলে। বললাম:

নিলুবাবু যাবেন নাকি কোথাও?

নিলুবাবু একটু ইতস্তত হয়ে বলল, হ্যাঁ যাবো, তবে আপনি কোথায় বেরোলেন ? তৎক্ষণাৎ আমাকেও জিজ্ঞাসা করল ।

আমি বললাম বেশিদূর না ,এই গোধুলির একটু আনন্দ নিতে। আপনি যাবেন? খুব মজা হবে ।

না । আজ যাওয়া হবে না,আপনি যান । আজ একটি কুটুম্ব বাড়ি যাব।

নিল রতন বাবু আরো গুটি কতক কথা বলে চলে গেলেন ।

আমি গায়ে একটি হালকা সুতির জামা পরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষের দিকে এলাম ।

শেষ প্রান্তে সবুজ ক্ষেতের মনরম দৃশ্য, একটু দূরেই নদী, নদীতে বালির বড় চর, চর থেকে দাঁড়িয়ে দিগন্তের ওই গোধূলী লগ্নের বেশ মজাটা নেওয়া যায় ।

আমি সেই দিকেই চললাম, কিছুটা গিয়েই একটি চর আছে , সেখানেই বসলাম। দূরে দেখলাম ধোঁয়া উড়ছে,,,আমি ঠিক অন্য রকম ভাবছিলাম কিন্তু তখনই দু থেকে তিনবার বলো হরি হরিবল দিতে শুনলাম । নিজেই বিড়বিড় করে বললাম ,মনে হয় নরেনবাবু স্বর্গারোহন করলেন।

লোকটি খুবই ভালো ছিলেন, তবে ছেলেটি নাকি তাকে ছাড়িয়া বিদেশে চলিয়া গেছেন। অফিসের নানা রকম কাজের চাপে তিনি নাকি তার পরম পূজনীয় পিতশ্রীর একবার খবর নিতেও সময় পাননা।

বহুদিন আগে নরেনবাবুর সাথে আমার একবার আলাপ হয়েছিল । লোকটি খুব দুঃখের সহিত বলেছিল ছেলেটাও ছেড়ে চলে গেল আর মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না । অনেক চেষ্টা করলাম সে মানতে চাইছে না । সে নাকি বাকি জীবনটা পড়াশুনার মধ্যে কাটিয়ে দিতে চাই।

নরেন বাবুর পুরানো কথাগুলি ভাবছি এমন সময় হালকা কান্নার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকালাম । দেখি! এক সুন্দরী যুবতী এলোমেলো চুল, আর আলখাল্লা পোশাকে হাটুমুড়ি দিয়ে বসে কাঁদছে। আমার থেকে একটু দূরে বলেই কান্নার আওয়াজটা হালকা আসছিল। কান্না আমার অনুভবটা বিচিত্র করে দেয়। নিজেকে সামলে রাখতে পারিনা। তবুও মেয়ে মানুষ তো অন্য কিছু ভাবতে পারে তাই সাহস থাকলেও এগুতে পারিনা। আমি ইতস্তত করছি কাছে যাবো কিনা, গিয়ে হয়তো সান্তনা দিলে কিছুটা মন ভালো হবে ও পরিচয়টা করা যাবে কেন মহিলাটি কান্নাকাটি করছে ।

ইতস্তত করতে করতে চর থেকে নেমে গেলাম মেয়েটির কাছে । কাছে গিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম । মেয়েটি বোধহয় আমাকে লক্ষ্য করেনি । আমি বললাম-

এই যেঃ আপনি কান্নাকাটি করছেন কেন??

মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল । উঠে যাবার পরিকল্পনা করছিলেন কিন্তু আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম - আপনার ভয় নেই আমি ঐ চরটাতে বসেছিলাম । আপনার কান্না শুনে এখানে এলাম।

আমি আবার বললাম , আপনি কাঁদছেন কেন-

মেয়েটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল-

বাবা মারা গেছে ।

আমি বললাম আপনার বাবা কি নরেনবাবু ?

মেয়েটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,

হ্যাঁ,

মেয়েটি মাথাটি নামিয়ে নিঃশ্চুপ হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ।

আমি মেয়েটির মনের অবস্থা কিছুটা হালকা করার জন্য বলতে শুরু করলাম---

নরেনবাবুর সাথে আমার একবার আলাপ হয়েছিল ।উনি আপনার কথা বলেছিলেন ও আপনার কাজ করে দেবার জন্য খুব কাকুতি মিনতিও করেছিলেন। উনি খুব ভালো ব্যাক্তি ছিলেন।

কথা বলতে বলতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। এখানে আমার একটা ,খুব অবাক লাগছিল , মেয়েটির কোন সেরকম আত্মীয় স্বজন ছিল না বললেই চলে । একজন মধ্যবয়স্কা ছিলেন সঙ্গে । আমি বললাম

চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

নরেনবাবুর মেয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং হাটতে শুরু করলো । কর্তব্য বিশেষ আমি পিছু পিছু হাটতে লাগলাম খানিকটা যাবার পর আমি বললাম- আপনার নামটা আমার জানা হলো না।

মেয়েটি জড়িত গলায় বলল প্রমিলা:

আমি মনে মনে বেশ উতফুল্লিত হচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ ভেবে আমি বললাম, আমি রক্তিম।

লোকে সংক্ষেপে একটা অন্য নামেও ডাকে।  অনন্ত ।

নিঃশ্চুপ ভাবেই আমরা কিছুটা গেলাম এইরকমই । তবে আমি আর কিছু বলার, কথা ভাবতে পারলাম না । কারন মেয়েটি খুবই চিন্তিত ছিল ।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাড়ির কাছে এলাম, প্রমিলা বলল,,

আপনি এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ। তবে সবসময় ও সবদিন না,মাঝেমাঝে।

প্রমিলা বাড়িতে ঢুকার আগেই কান্না শুরু করে দিলো।আমি আর ভিতরে না ঢুকে আমার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । ফিরে আসার পথে নানা কথা ভাবতে লাগলাম। শুধু এটা ভাবতে লাগলাম যে প্রমিলার সাথে হয়তো পরিচয় টা ভালো করে হলো না । সেইরকম কোন কথাই তো হল না। আর যদি আর একটুখানি যদি কথা হত তাহলে বেশ ভাল লাগত।

বাড়িতে ফিরে এসে ডাইরিটা নিয়ে বসলাম। প্রমিলার সাথে সমস্ত আলাপটা যত্ন করে তুলে রাখলাম। কেন জানিনা ওই দিনের আলাপটা আমার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল ।

পরের কদিন আর বালির চরের আনন্দ উপভোগ করতে যাওয়া হয়নি, কেননা আমাকে অফিসের কাজের জন্য কলকাতাতে কদিন কাটাতে হয়েছিল ।

কলকাতা থেকে ফিরে আসতে আমার প্রায় তিন মাস সময় লেগে গিয়েছিল।যখন ফিরেছি তখন বর্ষা পড়ে গেছে l আশা করি নদীতে বেশ বন্যা এসেছে ,চর আর দেখতে পাওয়া যাবেনা l নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়েছে বুঝতে পারিনি l যখন উঠলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে l মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল l কেননা ঐ দিন বিকালে আর বেড়াতে যাওয়া টা হলো না l

কিছুক্ষন এইভাবেই কাটল রাত্রে ডাইরিতে নিয়ে বসলাম l কলকাতার মদন বাবুর রোমহর্ষক গোয়েন্দা কাহিনীর কিছুটা লিখলাম , কিন্তু বেশ ভালো লাগছিল না , কিছু যেন অজানা আশায় মনটা উত্তাল হয়ে উঠলো l বাড়িতে বাহিরে এসে কিছুক্ষণ পায়চারী করতে লাগলাম l আকাশের অবস্থা খারাপের জন্য আমার কদিন আর নদীর দিকে বেড়াতে যাওয়া হয় না । বিভিন্ন রকম কাজের চাপে ও আবহাওয়ার গোলমালের জন্য এইভাবেই বেশ কয়েকদিন কেটে গেল l

একদিন , সকালে শ্রীকান্ত সমগ্রের কয়েকটা পাতা উল্টেছি এমন সময় একটি মেয়ের গলা শুনে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম--

অনন্তবাবু ভেতরে আসবো??

কে? আমি অন্যমনস্ক ভাবেই বললাম।

হালকা গলায় উত্তর এলো- প্রমিলা।

ও! ও! আসুন আসুন---

চেয়ারটা সামনে দিকে বাড়িয়ে দিলাম। আমিতো অনেকটাই চমকে গিয়েছিলাম। মনেমনে নিজেকেই বলছিলাম , প্রমিলা এখন , এখানে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আপনি ভালো আছেন তো??প্রথমেই প্রমিলা জিজ্ঞাসা করলো।

হ্যাঁ। ভালো আছি। আপনি?

খুব একটা ভালো নেই। প্রমিলা ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম ও বললাম , আপনি বসুন আমি আসছি।

আমি রান্না ঘরে গেলাম টিফিনের বন্দোবস্ত করতে। টিফিনের জোগাড় হল না। কফি বানাতে লাগলাম। রান্নাঘর থেকেই ইষৎ লক্ষ্য হলো, প্রমিলা আমার বাড়িটা ও বইপত্রগুলো খুব মন দিয়ে দেখছে।

কিছুক্ষন পরে দু কাপ কফি নিয়ে এলাম। প্রমিলার দিকে এক কাপ বাড়িয়ে দিলাম।

এই নিন ,

প্রমিলা যত্ন করে কফি কাপটা তুলেনিল। আমি কাপটা হাতে নিয়ে বললাম -

বলুন, কি মনে করে হঠাৎ । আপনার সাথে তো সেদিন পরিচয়টা ভালো করে হলই না।

প্রমিলা বলল, দেখুন আপনার কাছে আমার একটি ছোট সমস্যা নিয়ে এসেছি , যদি আপনি সমাধান করে দেন তাহলে খুবই উপকৃত হতাম।

বলুন --

বাবা মারা যাবার পর আমি অনেকটাই হতাশ হয়ে গেছি।আমার পড়াশুনার অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গেছে। মা সবসময় কেমন যেন ঝিমতে থাকেন, দাদা কোনোরকম দেখভাল করেন না আমাদের। মা আমাকে পড়াশুনা ছাড়তে বলছে , আর বাড়ির রোজগারের হাল ধরতে বলছে। এই পরিস্থিতিতে আমি পড়াশুনা বন্ধ করতে চাই না। এই পরিস্থিতিতে আমি যে কি করি তা ঠিক করতে পারছি না।আপনি কিছু একটা যুক্তি দেন , আমার কি করা উচিৎ?

কথাগুলো বলে কেমন যেন গভীর চিন্তায় মুখটা নামিয়ে চুপ করে রইলো প্রমিলা।

আমি কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দিলাম।বললাম--

আচ্ছা আপনি সেদিনের পর আর নদীর দিকে আসেনি?

প্রমিলা মাথাটি তুলে বললো, অনেকবার এসেছি । আপনার পরিচয় নেব বলে । কিন্তু আপনি আর আসেননি। অনেকের কাছে খোঁজও নিয়েছি। পরে জানলাম আপনি বাড়িতে নেই। কোথাও বাইরে গেছেন।

আমি বললাম , আপনি খবর কি করে পেলেন যে আমি এখন বাড়িতে আছি।

না খবর পাইনি। খোঁজ করে এলাম দেখা না হলে ঘুরে যেতাম। প্রমিলা বলল।

আমি তখন প্রমিলার থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। আজ হয়তো অন্য দিনের থেকে আরো অনেক বেশি সুন্দর লাগছে মহিলাটিকে।

জীবন হলো একটি যুদ্ধক্ষেত্র। এখন, সেখানে আপনি একা যোদ্ধা, আর পৃথিবীর বাকি সব লোক আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনাকে লড়াই করতে হবে না হলে আপনি মারা যাবেন। বুঝতে পারছেন প্রমিলাদেবী আমি কি বলতে চাইছি।

প্রমিলা ঘাড় নেড়ে উত্তর দিলো।

আমাদের কথা আর গল্প হতে হতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে এলো। কিছুটা হলেও আজ আমার নিঃসঙ্গতা একটু যে কমবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তাহলে কি আমার পড়াশুনার এখানেই সমাপ্তি করতে হবে? প্রমিলা দুঃখের সহিত বললো।

আমি বললাম , না । তা কেন , বললাম তো আপনাকে লড়াই করতে হবে।

কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ঘড়িটা ঢং ঢং করে দুপুর এক টার বিরতির কথা জানিয়ে দিল l প্রমিলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল ,

আজ উঠি , কথা হতে হতে দুপুর গড়িয়ে এল বুঝতে পারিনি l বাড়িতে মা একা আছে l

কথাগুলি বলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো l আমিও উঠে দাঁড়ালাম ও বললাম

আজ দুপুরটা আমার বাড়িতে খাওদাওয়া করে বাড়ি যাবেন l না হয় আর সামান্য সময় লাগবে l

না না অনন্ত বাবু তা বলবেন না , বাড়িতে মা একা আমি না গেলে আবার খাওয়া দাওয়া করবে না l

আমি জোরকরে আর কিছু বলতে পারলাম না lসময় বের করে আবার আসবেন বলে সম্বোধন করলাম ও সঙ্গে কিছুটা যাবার মনস্থির করলাম l প্র্মিলাও তত্খনাত বলে উঠলো -যদি একবার আমাদের বাড়ি যান তাহলে খুবিই খুশি হব l আমি বললাম

হ্যাঁ,আমি অবস্যই একদিন সময় করে আপনার বাড়িতে যাব l ওখানের লোকের আবার কোনো আপত্তি থাকবে না তো ?

কেন ?প্রমিলা কৌতুহলী হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে l

আমি কথাটার আর কোনো উত্তর দিলাম না l একটু হাসলাম মাত্র l প্রমিলা উত্তরে বলল, আপনার সে ব্যাপারে কোনো চিন্তা নেই l

প্র্মিলাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম l বাড়িতে নিজের টুকিটাকি কাজ করতে করতে সুধু এই কথাটাই ভাবতে লাগলাম যে নিজের গ্রামে এত লোক থাকতে প্রমিলা কেন আমার কাছে পরামর্শ নিতে এল ? তবে কি ও আমার কাছে পড়াশোনার জন্য টাকা সাহায্য চাইতে আসেছিল।বিবেকে লেগেছে হয়ত সরাসরি বলতে তাই মাথা নামিয়ে বসে ছিল, তাছাড়া এত সুন্দর একজন এবং শিক্ষিত ভদ্রমহিলার কোনো পাত্র জুটেনাই বা কেন ? মনে একটা আলোড়ন শুরু হয়ে গেল l যাই হোক সেদিন আর বিকালে নিজের অফিসের কিছু কাজের জন্য বিকালে ঘুরতে যাওয়া হলনা l রাত্রে ডায়রি নিয়ে বসে প্রমীলার সহিত সমস্ত কথোপকথন গুলি তুলে রাখলাম l রাত্রে আর ঘুম আসতে চাইছিল না কেন জানিনা l বারবার মনে একটা প্রশ্ন আসতে লাগলো , তাহলে কি আমি প্রমীলার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গেলাম lবারবার ধরে প্রমীলার রূপ , চোখ আর পোশাক আশাকের বর্ণনা দিতে লাগলাম ডায়রিটাতে l নানারকম ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা l পরের দিন সকালে যখন উঠলাম, তখন সকালটা অন্য দিনের থেকে বেশ আলাদা আলাদা লাগছিল l আকাশ চিরে সূর্য় উঠেছিল ,ঘাসের আগে জলকণা ঠিক যেন মুক্তর প্রতিচ্ছবি মনে হচ্ছিল , সব থেকে মজার জিনিস বাতাসে দারুন একটা গন্ধ ভাসছিল l

ফোনের ঘন্টিটা বেজে উঠলো, অফিসের থেকে ফোন ,ফোনটি তুলে বুঝলাম অফিসে ফিরতে হবে l সকালে প্রাত:রাশ সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম l অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল l অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাকে কলকাতা থেকে দু একদিনের মধ্যে বাইরে পাঠানো হবে এবং বেশকিছুদিন ওখানেই কাটাতে হবেl পরেরদিন জানতে পারলাম , জিরো ভ্যালিতে যেতে হবে। কোম্পানি নাকি ওখানের হাতে তৈরি জিনিসপত্রের উপর কিছু গবেষণা করতে চাই। সেদিন অফিসের প্রধানের সঙ্গে থাকার জায়গার ব্যাপারে আলোচনাটা সেরে নিয়েছিলাম। আমি নিজেই ঠিক করেছিলাম যে দিনকতক ফরেস্ট গেস্ট হিসাবে ওখানের গেস্ট হাউসে থাকব ও তারপর না হয় সুন্দর কোনো এক গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করে নেব।

সেদিন ভোর চারটার ট্রেন ধরে জিরো ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। স্টেশনে নেমে গেস্ট হাউসে পৌঁছাতে প্রায় নটা বেজে গেল। ধীরেন্দ্র বাবু ওই গেষ্ট হাউসের সুপারিটেন্ডেট। উনি স্বাগত জানালেন এবং দেরি না করে খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করে , চারিদিকটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। সেদিন রাতে ধীরেন বাবু আমার জন্য গেস্টহাউসেই ছিলেন।

অনেক গল্প করলাম , পরিবেশ কেমন, এখানের মানুষজন কেমন ও দেখার কি কি জায়গা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি । আমাদের কথা বলতে বলতে প্রায় রাত্রি বারোটা বেজে গেল।

রাত্রের ডিনার সেরে বিছানায় গেলাম। সেদিন আমার মনটা বেশ ভাল লাগছিল না। সকাল থেকেই প্রমিলার কথা বেশ মনে পড়ছিল। বিকালে গেস্ট হাউসের উত্তর পশ্চিম কোনের শিউলি ফুলের বাগানে প্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে অন্তরঙ্গ অবস্থাই দেখে প্রমিলার অনুপস্থিতি ও কথা না বলতে পাওয়ার অভাবটা খুব গভীরভাবে অন্তর থেকে অনুভব করছিলাম। ঘুম আসছিল না , আনেক কথাই ভাবছিলাম।কি মনে হল ব্যাগ থেকে নোটবুকটা বের করে প্রমিলা দেবিকে একটি পত্র লেখার সিধান্ত নিলাম।

প্রিয়,

 প্রমিলা দেবী,

                         আপনি কেমন আছেন? আশাকরি আপনি ও আপনার মা ভালো আছেন । আপনি দেখা করে চলে যাবার পর আপনার কথা আমি অনেক্ষন ভেবেছিলাম। পরের দিনই আমাকে অফিসের কাজের জন্য রওনা দিতে হয়েছিল কলকাতায়। আপনার সাথে দেখা করা বা কথা বলার সময় হয়ে উঠেনি। আপনার পড়াশুনা ও রিসার্চ করার ব্যাপারটা কতদুর এগুলো তা জানার জন্য আমি বেশ কুতূহলী। আফিস থেকে আমাকে এখন জিরো ভ্যালিতে পাঠানো হয়েছে।জিরো ভ্যালি এখনো ঘুরে দেখা হইনি। ধীরেনবাবু জায়গাটির সমন্ধ্যে অনেক কিছু বলেছেন। খুব সুন্দর জাইগা যা দেখলে নাকি মন জুড়িয়ে যাবে।আমার বাড়ীতে ফিরতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। তত দিন হয়ত আপনার সহিত দেখা করিতে পারব না। এরপর বাড়ীতে গিয়ে আপনাদের বাড়ি যাব।

আপনার রিসার্চের জন্য যাবতীয় খরচ খরচার ভার আমি নেব বলে ভেবেছি। আশাকরি আপনি এতে বেশ খুশি হবেন। নদীর খবরটা জানাবেন ,জল কমে নদীর চর বেরিয়েছে কিনা তাও জানাবেন --

      

    জিরো ভ্যালি              

  ১২/০৯/২০০৫                                    ইতি           

                                                      রক্তিম সিংহরায়

পত্রটি লিখে লাল খামে ভরলাম ও প্রমিলাদেবীর ঠিকানাটাতে পোস্টের সব ব্যবস্থা করে রাখলাম।

সকালে ধীরেন বাবুর যে কর্মচারিটি আছে তার হাতে একশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম তুমি এটি পোস্ট করে দিও। লোকটি টাকা পেয়ে খুব খুশি হলো ও হাসতে হাসতে চলে গেল।

বিরেনবাবুকে একটি লিস্ট দিয়ে বললাম, বীরেন বাবু এইসমস্ত জায়গাগুলিতে আমার কাজ আছে।আপনি একটি ভালো জায়গা দেখে আমার থাকার ও কাজ করার সুব্যবস্থা করে দিন । বিরেনবাবু সমস্ত জায়গাগুলি ভালভাবে দেখে ’বোলেং’ এ থাকার কথা বললেন। জাইগাটি নাকি খুব সুন্দর এবং ওখান থেকে আমার কাজের খুব সুবিধা হবে। সেদিন আমি গেস্ট হাউস থেকে বিরেন বাবুর বাড়ীতে উঠেছিলাম। বিরেনবাবুর স্ত্রী খুব আত্মীয়তা পরায়ণ মহিলা ছিলেন)। চন্দনা দেবরায় (বিরেন বাবুর স্ত্রী) যেন মাটির মানুষ। উনি নাকি বাংলাদেশের মেয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের যখন বের করে দেওয়া হচ্ছিল তখন চন্দনা ও তার পরিবার চলে আসে জিরো ভ্যালিতে ।

পরেরদিন সকালে আমি বলেঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । জিরো ভ্যলি থেকে বোলেং প্রাই ৪২০ কিলোমিটারের মত দূরে । আসামের রাস্তা ধরে যেতে হয়।বাসে যেতে যেতে নূতন জায়গায় যাওয়ার আনান্দটা বেশ অনুভব করতে লাগলাম। বলেঙ্গে পৌঁছাতে আমার প্রায় বিকাল হয়ে গেল। আমি থাকার জায়গা একটা জোগাড় করে নিলাম। ওখানের লোকগুলি খুব ভালো।সেজন্য বোধহয় আমার থাকার জায়গা খুঁজতে কোনো অসুবিধা হলো না। জারবম টুকি নামের এক ভদ্রলোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। লোকটি বেশ মিশুকে। সেদিন তার বাড়িতেই ছিলাম।লোকটির পারিবারিক সমস্যাগুলি পরিস্থিতির সহিত পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তাই ভাবলাম যদি কিছুটা সাহায্য করা যায়।আমি সেদিন ডিনারের সময় টুকি বাবুকে বললাম,

টুকিবাবু আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে একটা কথা বলি-

টুকিবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন বলুন বাবু বলুন

আমি বললাম, আমার এখানে কাজের জন্য প্রায় দুমাসের মতো থাকতে হবে, যদি আপনারা আমাকে আপনাদের এই ছোট্ট ঘরে একটু আশ্রয় দেন তাহলে খুবই উপকার হয়।

টুকিবাবু একটু ইতস্তত করে ,স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কি বলব না বলব ভেবে বলল , আমরা কি রকম গরীব বুজতেই তো পারছেন । আপনাকে যদি থাকতে দিই তাহলে আমাদের খাওয়া দাওয়া দেবার সমস্যা হবে । তাই যে আপনাকে কি বলব ঠিক করতে পারছি না। আমি পুনরায় বললাম,

আপনাদের কোন চিন্তা নেই আমি তার জন্য আপনাদের টাকা দেবো ও আপনাকেও কাজ দেবো ।

টুকি বাবুর মুখে একটু খুসির আভাস দেখলাম।বেশ ভাল লাগলো। টুকি বাবুর ঘরোয়া অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পাহাড় কেটে চাষবাস আর হ্যান্ডিক্রাফট বানিয়ে যা জোগাড় হয় তাতে তার সংসারটা স্বাচ্ছন্দে না হলেও কোনোরকমে কেটে যায়। সেদিন আর কাজে যাওয়া হলো না। গ্রামটি ঘুরে দেখলাম।বেশ সুন্দর গ্রাম। সামনেই ব্রহ্মপুত্র নদী। পরিবেশ আর মনের মিলনের এক চরম পরিস্থিতির উদ্ভাবন হয়েছে , মনে হবে আর বাড়ি ফিরে আসবো না। নদীর তীর , জলে নেমে আনন্দ, স্নান করা বেশ মজা করলাম সেদিন।সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলাম। টিফিন সেরে ডাইরিটা নিয়ে বসলাম।নদীতে যাবার সময় প্রমিলার কথা খুব মনে পড়ছিল। এই সুন্দর পরিবেশে যদি এখানে থাকতো তাহলে প্রমিলার সমস্যার সমাধান না হলেও মনটা বেশ সুন্দর এক আবহাওয়া গড়ে নিত।

চিঠির উত্তর এখনো আসেনি। অসীম আগ্রহে অপেক্ষা করছি চিঠির উত্তরের জন্য। ওই দিন কলম আর ডাইরিটা বেশ, প্রমিলার রূপ আর সামান্য কিছু গুন ও মিষ্টি কথাবার্তার প্রশংসার পঞ্চমুখ হয়ে উঠে ছিল।ডাইরির পাতাটা সবচেয়ে সেরা হয়ে উঠেছিল বর্ননায়। ডাইরিটা লেখা হয়ে যাবার পর , আমার বর্তমান ঠিকানাটা আফিসে একটি ফ্যাক্স করে দিলাম।

চার দিন কাজ প্রায় নানারকম ভাবে কেটে গেল কাজের মধেই। অরুণাচল প্রদেশ যে দ্বিতীয় স্বর্গ তা এখানে না আসলে কেও বুঝতেই পারবে না। আর এখানে মানুষজন , যাদের তুলনায় নেই । কঠোর পরিশ্রমী ও অপূর্ব মেলবন্ধনের মধ্যেই স্বর্গের আনন্দ উপভোগ করে। সেদিন ১৭ রই সেপ্টেম্বর দুপুরের লাঞ্চ করছি , অফিস থেকে ফোন এলো, বিভূতি বাবু ফোনে কথা বললেন , আমার একটি পত্র এসেছে। পত্রটির উপর লেখা আছে,

পত্রটি আমি ব্যাকুল চিত্তে লিখিয়াছি।সঠিক ব্যাক্তি যেন এটি খুলিয়া দেখে। অন্যথায় আমি খুবই কষ্ট পাবো।পত্রটির উত্তর একমাসের মধ্যে দিলেও চলবে।

।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।

*** গল্পটি কয়েকটি পর্বের, প্রিয় পাঠকগণ যদি আপনাদের ভালো লাগে আমাকে জানাবেন । বাকি পর্বগুলি আমি তুলিয়া ধরিব। নচেৎ আমি আর লিখিব না। আপনি মতামত দিলে আমার অনুভব আরো ভালো হবে ও আমার ডিটেকটিভ গল্পটিও প্রকাশ করিতে সুবিধা হইবে। ***


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama