বন্ধন
বন্ধন
তমালের ঠাকুর্দা দুদিন হল মারা গেছেন।বয়স হয়েছিল পঁচাশি বছর।হয়তো আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন যদি হাঁপানীটা ওভাবে হুট করে বেড়ে না যেত।তমাল এখন সেভেনে পড়ে।ফাইভ থেকেই সে তার ঠাকুর্দার সাথে ঘুমোত।তবে একটা বিছানায় না। তার ঠাকুর্দা শুতেন পাটের দড়ি দিয়ে বোনা একটা চারপায়াতে আর সে তক্তপোশে।একদম পাশাপাশি।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তমাল একটু সাহসী গোছের।তার ঠাকুর্দা রাতে শোওয়ার সময় কখনো,সখনো ভূত,প্রেতের গল্প শোনাতেন।তমাল গল্পগুলো উপভোগ করলেও ভয় কোনদিন তেমন পায়নি।তার ঠাকুর্দা প্রথম,প্রথম বলতেন,'কীরে ছোকরা ভয় পাচ্ছিস নাকি?'
তমাল সোজাসাপ্টা উত্তর দিত,'না।'
তার গলার স্বর শুনে ঠাকুর্দাই বরং মাঝে মাঝে চমকে উঠতেন।নাতির বুকের পাটা বটে!যে বয়সে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে ভূতের গল্প শুনে মা-বাবাকে জড়িয়ে কাঁথা মুড়ি নেয়।সেই বয়েসে তমাল একা শুয়েও অকম্পিত গলায় ঠাকুর্দার প্রত্যেক কথার জবাব দিত।
শেষ দিকে প্রায় মাস তিনেক তমালের ঠাকুর্দা রাতে আর নাতির সাথে গল্প করতেন না। মুখ দিয়ে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়,সড়সড়,সাঁইসাঁই অদ্ভূত সব আওয়াজ বের হত।কখনো,সখনো সেই আওয়াজে তমালের ঘুমটাই ভেঙে যেত।মাঝরাতে হঠাৎ চমকে উঠত।ঠাকুর্দার রোগের কথা মনে পড়তেই আবার শুয়ে পড়ত।শেষ মাসটা তমালের পাশে তার বাবা এসে শুয়ে ছিলেন।ছেলেকে সাহস জোগাতে না।তার বাবার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য।শরীরের যা অবস্থা কখন কী হয় বলা যায় না!
অথচ তমালই প্রথম তার ঠাকুর্দার মুত্যুঘন্টা টের পায়।সেদিনও তার ঘুমটা মাঝরাতে ভেঙে গেছিল।কিন্তু তার ঠাকুর্দার গলায় কোনরকম আওয়াজ শুনতে পায়নি।মিনিট পাঁচেক দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করার পর,তার বাবাকে জাগিয়ে ছিল।ততক্ষণে সব শেষ।লোকজনকে ওঠান হল। আত্মীয়দের খবর দিয়ে,তাদের আসতে ভোর কাবার।দাহকাজ শেষ হতে সাতটা বেজেছিল।
তার ঠাকুর্দার মুখেও তমাল অনেকবার কথাটা শুনেছে।মৃত্যুর পর তিনদিন পর্যন্ত সেই মানুষটার আত্মা বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।তাই সন্ধ্যের পর মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদের বাইরে ঘোরা নিষেধ! অথবা একা-একা রাতে উঠে পায়খানা-পেচ্ছাব করতে যাওয়াও চলে না। কাউকে সাথে নিয়ে কোন লোহার বস্তু হাতে ঠেকিয়ে যেতে হয়।না হলে আত্মা তাকেও সাথে করে টেনে নিয়ে যায়।
প্রথম রাতটা তমালের ভালই কেটে ছিল।ভয়-ডর তো তার এমনই খুব কম।তার উপর রুখু মাথায় ডুব পেড়ে,শুকনো মুড়ি চিবিয়ে দেহ,মন দুই ক্লান্ত ছিল।তাই এক ঘুমেই সকাল।
কিন্তু আজ হঠাৎ তার ঘুমটা পট করে ভেঙে গেল।পাশে তার বাবা শুয়ে আছেন।চৈত্র মাসের মাঝামাঝি হলেও ভোরের দিকে কাঁথা মুড়ি নিতে হয়।বারান্দাতে এখন সবাই জুড়ি-সুড়িভাবে একসাথে শুয়ে আছে।একটা একদম কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে।তাতে সবকিছু টের পাওয়া গেলেও,মুখ চেনা যায় না। তমাল প্রথমেই ভাবল, সে হঠাৎ জাগল কেন?আর তখনি মনে পড়ল একটা আওয়াজের কথা।ঠিক যেন তার ঠাকুর্দার গলা।মৃত্যুর আগে যে শব্দটা শুনে তার ঘুম ভেঙেছিল।তেমনিই একটা আওয়াজ সে পেল।তমাল নিজেকে বোঝাল।নিশ্চয়ই মনের ভুল হবে।তাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
তার কিছুক্ষণ বাদে ঠিক একই রকমভাবে সে আবার জেগে উঠল।আর তখনি তার কৈশোর মনে জিজ্ঞাসুর খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল।সত্যি-সত্যিই কী তার ঠাকুর্দার মৃত আত্মা তাকে ডাকছে?চোখ মেলে অল্প চেয়ে রইল।না! আর কোন ডাক সে শুনতে পেল না।তবু একবার তাকে উঠতেই হবে।প্রচন্ড পেচ্ছাবের বেগ পেয়েছে।তার বাবা পাশে নাক ডাকছেন।একবার ভাবল,জাগায়।কারণ দরজাটা বড্ড কড়া।কিছুতেই সে খুলতে পারে না।একবার তাকিয়ে দেখে নিল দরজার দিকে।মনে হল ওটা খোলা রয়েছে।যাক ভালই হল।দরজা খুলে আঙনে বেরিয়ে বাঁ দিকেই বাথরুমটা।নিশ্চয়ই কেউ উঠেছে।তাই আর তমাল বাবাকে বিরক্ত করল না। কাঁথাটা একহাতে সরিয়ে ওঠে পড়ল।পা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে চলে এল দরজার সামনে।যা ভেবেছিল তাই।দরজা খোলা।আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে আছে।তারমাঝে একফালি চাঁদটা ঝকঝক করছে।ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা সুরটা হঠাৎ থেমে গেল।চোখ ঘোরাতেই তমাল আঙনের একপাশে মানুষের একটা ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেল।নিশ্চয়ই তার দীপুমামা হবে।সন্ধ্যের সময় এসেছেন।আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
বাথরুমের কাছে আসতেই মাথাটা তার গরম হয়ে গেল। দরজায় তালা ঝোলান।নিশ্চয়ই তার মায়ের কাজ হবে।এখন তবে রাতের বেলায় পেচ্ছাব-পায়খানাও চেপে রাখতে হবে নাকি?এবার উপায়?এতক্ষণে তমাল বুঝতে পারল,তার মামুটি আঙনের একপাশে কুয়োতলার সামনে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?কোথাও তো হাল্কা হতে হবে নাকি?তমাল মুখের হাসি চেপে দরজার উপরেই সেরে নিল।আবছা আলোয় কালো ধারাটা আঙনের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নিঃশব্দে বয়ে গেল। সকাল পর্যন্ত শুকিয়ে যাবে।কাজ সেরে যেই পিছন ফিরে তাকাল। তমাল আর মামুকে দেখতে পেল না।তবে কী তাকে দেখে একটু আড়ালে চলে গেলেন? হবে হয়তো।সেই ভেবে তমাল ভেতরে ঢুকে পড়ল।থাক, দরজাটা লাগিয়ে লাভ নেই।মামু ফিরবেন একটু পরেই।আবার সকলের মাথা বাঁচিয়ে সাবধানী পায়ে বিছানায় গিয়ে পৌছাল।তারপর শান্ত মনে শুয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল উঠোনভর্তি লোকের চেঁচামেচি শুনে।সকাল হয়ে গেছে।চারিদিক ফর্সা।কাঁথা সরিয়ে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল।তারপর যা দেখল,তাতে চক্ষু চড়ক গাছ!
তার সেই পেচ্ছাবের রেখাটা নিয়েই সবাই আলোচনা করছে! তমাল তার মায়ের চাঁপা গলার ফিসফিসানি বেশ স্পষ্ট মত শুনতে পেল,
"রাতের বেলায় কেউ যখন দরজা খুলে বেরোইনি তখন নিশ্চয়ই এটা উনার কাজ হবে।যতই অসুস্থ থাক না কেন কখনো উনি বাথরুম ছাড়া বিছানায় এসকল জিনিস করেননি।দরজা বন্ধ ছিল বলেই চিহ্ন পেলাম।বাড়ির মায়া এখনো শ্বশুরমশাই কাটিয়ে উঠতে পারেননি।"
তমালের মনে হল,চেঁচিয়ে সবাইকে সত্যি কথাটা বলতে।কিন্তু পারল না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল।দীপুমামা গাড়ি নিয়ে আসার একটু পরেই ফিরে গেছেন! অথচ কথাটা রাতের সময় খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছায়ামূর্তিটা দেখার পর একবারও খেয়াল পড়েনি।তার মনেও এতক্ষণে সংশয় দানা বাঁধতে শুরু করল।তবে কী গতরাতে সত্যি সত্যিই তার ঠাকুর্দা আত্মা হয়ে ফিরে এসেছিলেন?...তাই যদি হবে,তাহলে তাকে তো সাথে করে নিয়ে যেতেন!সে তো কোন লোহা ছুঁয়ে থাকেনি।
সত্যি কথাটা সকলের সামনে বললে, এখুনি সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।ঝাড়ফুঁক,তাবিজ,মাদুলি এটা সেটা করে একেবারে নাজেহাল করে ছাড়বে।তাতে সবার উদ্বিগ্নও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।তমাল তাই চুপ করে গেল।তারথেকে বরং সকলের ধারণাটাই বেঁচে থাকুক।এতে ঠাকুর্দার অল্প সম্মানহানি ঘটলেও শান্তি।
একসময় তমালের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রুধারা গড়াতে শুরু করল। ঠাকুর্দার স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে।বুকটা তাই ফুলে-ফুলে উঠল।চোখে জল না গড়ালে এ ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।
পেছন থেকে তার বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
"কাঁদিসনে তমাল..চুপ কর বাবা।এভাবে কাঁদলেই কী তোর দাদুমণি ফিরে আসবে?বরং তোর এই অবস্থা দেখে কষ্টই বেশি পাবে।আমি জানি রে তোকে বাবা প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসত।তাই তো সহজে মায়া কাটতে পারছে না!
-----সমাপ্ত----