Maheshwar Maji

Drama Classics Inspirational

4  

Maheshwar Maji

Drama Classics Inspirational

স্বাধীন

স্বাধীন

5 mins
478



শাবিনা আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত৷সাত তাড়াতাড়ি চানটা সেরে নিয়ে কিচেনে ঢুকে পড়েছে৷ রাজিয়ার আজ ছুটি৷ শাবিনাই আসতে মানা করেছে৷ঈদ বলে কথা৷উৎসব তো শুধু তাদের একা না৷ধনী,গরীব সকলের৷সবার ইচ্ছে হয়,অন্তত উৎসবের দিনগুলোতে প্রিয়জনদের সাথে একটু খাওয়া,দাওয়া এবং আনন্দ করতে৷মেয়েটা আসলে বড্ড অসহায়৷দু দুটো সন্তান আছে ঘরে৷তিন বছর আগে তালাকের পর রাজিয়া আর বিয়ে করেনি৷ইচ্ছেও নেই৷তার শুধু একটাই স্বপ্ন৷ ছেলে,মেয়ে দুটোকে ভালভাবে মানুষ করা৷বড়টি মেয়ে৷বয়স আট বছর৷সরকারি ইস্কুলে পড়ে৷আর ছোটটি ছেলে৷মাদ্রাসায় ভর্তি করেছে৷শাবিনা জানতো,আজ একা হাতে তাকে সবকিছু সামাল দিতে হবে৷ কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছে৷কারণ কিছু কিছু, কষ্টে বড় আনন্দ পাওয়া যায়৷তাই শাবিনা কোনরকম বিরক্ত না হয়ে একমনে সব কাজ করে চলেছে৷ইউসুফ একজন সফ্টওয়ের ইঞ্জিনিয়ার৷ধর্মে তেমন বিশ্বাস না রাখলেও কখনো ধর্মীয়বিশ্বাসীদের মনে আঘাত হানেনা৷আধুনীক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী৷শাবিনাকে সে প্রেম করে বিয়ে করেছে৷প্রথমটাই ইউসুফের মা,বাবা ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি৷তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান৷বড় আদর,যত্নে মানুষ করেছিলেন৷তার কাছ থেকে এরকম বিরূপ আচরণ কখনোই আশা করেননি৷ইচ্ছে ছিল ইউসুফের বড় খানদানী বংশে বিয়ে দেবেন৷বাংলাদেশ থেকে মেজ মেয়ে সেরকম একটা সম্বন্ধের খোঁজও দিয়েছিল৷শেষমেশ ছেলের জিদের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হন৷সত্যি বলতে কি শাবিনার ব্যাপারে সবকিছু শোনার পর থেকে ইউসুফের মা,বাবা শাবিনাকে বাড়ির বউমারূপে ঠিক মেনে নিতে পারেননি৷বস্তিতে সৎ মায়ের সাথে মানুষ হয়েছে৷সে মেয়ে আর কেমন হবে?লেখাপড়া করলেই কি বংশের দাগ মেটানো যায়?একটা ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পড়ানোর কাজ করত শাবিনা৷ইউসুফের সাথে পরিচয় অবশ্য তার অনেক আগে থেকে৷সেই কলেজের সময়৷শাবিনা তখন যাদবপুরে৷ ইংরেজিতে অনার্স করছে৷হঠাৎ একটা সেমিনারে ইউসুফের সাথে তার প্রথম পরিচয়৷ক্রমে,ক্রমে সেই পরিচয় বাড়ে৷এক সময়, হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া৷মাঝে দুবছরের জন্য ইউসুফকে চেন্নই যেতে হয়েছিল প্রথম চাকরি জয়েন করতে৷এখন অবশ্য কোলকাতায় শিফ্ট হয়েছে৷ ইউসুফের মা,বাবার ধারণা যে ভুল ছিল,সেটা বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই বুঝতে পারেন৷শাবিনাকে প্রতিনিয়ত দেখে৷ তার কমনীয় আচার,আচরণ এবং কর্তব্যপরায়ণে তারা মুগ্ধ৷ একজন উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মীয় সংস্কারে কোন খামতী নেই৷ তাতেই তারা সবথেকে বেশি অভিভূত৷তাই শাবিনাকে এখন তারা আপন মেয়ের মতোই স্নেহ করেন,ভালোবাসা দেন৷শাবিনাও শ্বশুর,শাশুড়ির প্রতি কর্তব্যে কোনরকম খামতি রাখে না৷

ইউসুফের দিদি,জামাইবাবুরা আসছেন বাড়ি তে৷তারা পৌঁছালে একসাথে কোরবানিটা সারবেন৷তারপর নমাজে বসবেন সকলে৷ তাই তাদের আসার আগেই জলখাবারটা সেরে ফেলতে চায় শাবিনা৷ সেইজন্য এখন তার পিছু ঘোরার পর্যন্ত সময় নেই৷ইউসুফও আজ কিচেনে ঢুকে পড়েছে,শাবিনাকে এটা সেটা সাহায্য করতে৷ কিন্তু আনাড়ীর ধান ভানার মতো অবস্থা৷ সাহায্যের নামে বাগড়া লাগাতেই বেশি ব্যস্ত৷শাবিনা তাই এক সময় ইউসুফের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বলে উঠল,এবার আপনি একটু ব্যালকনিতে গিয়ে বিশ্রাম করুন জাহাপনা৷ অনেক করেছেন৷ আটার পাত্রটিকে প্রজাদের শুকনো জমি ভেবে যে পরিমান সেচের পানি ছেড়ে দিয়েছেন,তাতে করে আর পুরি নয় পিঠে করতে হবে দেখছি!ইউসুফ অপরাধীর সুরে বলে উঠল,সরি বেবি৷ সেই দেখে এত ব্যস্ততার মাঝেও শাবিনা হো হো করে হেসে উঠল৷


বিকেল পাঁচটার দিকে সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে টিভির পর্দায় একমনে মৌলানা সাহেবের  ধর্মীয় ভাষণ শুনছিলেন৷ ইউসুফ পাশের কামরায় দুজন ভাগ্নির সাথে পাবজি খেলছিল৷ তখনি সদর দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল৷কেউ আওয়াজ করার আগেইইউসুফ উঠে গেল৷খুলেই দেখল,দরজার সামনে একটা জটলা৷মানুষগুলোর চোখ,মুখ দেখে ইউসুফ একটু ভয় পেল৷পরক্ষণেই সেটা ঝেড়ে ফেলে মুখে খানিক হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,ঈদ মুবারক৷ কিছু কি বলছিলেন?জটলার একজন কড়া গলায় বলে উঠলেন,আপনারা কিন্তু ব্যবহার ভালো করছেন না৷ উৎসবের নাম করে জাত নষ্ট করছেন৷


এর ফল কিন্তু মারাত্মক হবে বলে দিলাম৷লোকটার তর্জন,গর্জন শুনে ড্রয়িং রুম থেকে বাকিরাও এসে গেলেন৷এমনকি পাশাপাশি ফ্ল্যাটের লোকজনও দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷ইউসুফের বাবা ইউসুফকে ভেতরে টেনে নিজে সামনে এসে দাঁড়ালেন,কি হয়েছে আগে বলবেন তো?শুধু শুধু দলবল নিয়ে এমনভাবে চড়াও হয়ে যাচ্ছেন?তারপরই লোকটা পিছন থেকে একজন অর্ধ উন্মাদ যুবককে টেনে এনে দেখালেন,আপনারা জানতেন না যে এ একজন হিন্দু?সব জানতেন৷তা সত্ত্বেও ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে গোমাংস খাইয়ে জাত নষ্ট করেছেন!আপনারা কি মনে করেন বলুন তো?এটা কি বাংলাদেশ নাকি পাকিস্থান?যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন!আর আমরা হিন্দুরা সেসকল চোখ বুজে সহ্য করে যাব? অনেক হয়েছে৷আর না৷ আপনাদেরকে শেষ বারের মতো সাবধান করে দিতে এলাম৷ এরকম আচরণ যদি দ্বিতীয়বার চোখে পড়ে,আর কিন্তু কোন কথা হবে না৷ পুরো বাড়িসুদ্ধ বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেব৷ ইউসুফের বাবা তো রাগে কাঁপতে লাগলেন৷ তিনি হাইপার টেনশনের রুগী৷ কিছু একটা ঘটার আগেই ইউসুফের জামাইবাবু শ্বশুরমশাইকে সাবধানে পিছনে টেনে শান্তভাবে বলে উঠলেন,একমিনিট,আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন,আমি দেখছি৷তারপর জটলার মুলব্যক্তির উদ্দেশ্যে সংযতভাবে বলে উঠলেন,ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে দয়া করে একটু বলবেন?মুলব্যক্তিটি জামার হাতা গুটিয়ে বলে উঠলেন,মানলাম যুবকটি পেটের দায়ে সাহায্য চাইছিল৷ আমাদের পাড়ার ছেলে৷মা,বাবা একসাথে মারা যাওয়ার পর একটু পাগলাটে হয়ে গেছে৷ পেট পালতে এর,ওর কাছে হাত পাতে৷তাবলে ওর পাতে গোমাংস তুলে দেবেন?---সেকি!কে দিয়েছে?উত্তরে পিছন থেকে নরম সুরে শাবিনা বলে উঠল,আমি৷দুপুরে কিচেনের জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে নিচে ছেলেটাকে দেখলাম৷রাস্তায় দুটো খাবারের জন্য সকলের কাছে হাত পাতছে৷অথচ সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছে৷দেখে মনটা কেঁদে উঠল৷ভাবলাম,আমাদের আজ উৎসব৷ কতরকম খাবার!অথচ একজন ছেলে খিদে পেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তাই বিরিয়ানির হাঁড়ি থেকে কিছুটা বিরিয়ানি আর সিমুই প্যাকেটে করে তুলে দিয়েছিলাম তার হাতে৷লোকটি তারপরেই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,ভুল বললেন৷ বলুন ইচ্ছে করে তুলে দিয়েছিলেন৷আর এটাই তো আপনাদের জেহাদ৷এরপর আরো কিছুক্ষণ দুপক্ষের মধ্যে বাকবিতন্ডা হল৷শেষে প্রতিবেশিদের বোঝাবোঝিতে সবকিছু তখনকার মতো মিটিয়ে ফেলা হল৷ইউসুফের মা,বাবা এই উটকো কান্ডের জন্য একপ্রস্থ শাবিনাকে বকাঝকা করলেন৷তাতে শাবিনার দুচোখে অশ্রুধারা বইতে লাগল৷ইউসুফ তাকে নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে পরম সোহাগে হাত বুলিয়ে শান্ত করল৷


আজ পনেরোই আগস্ট৷দেশের সর্বত্র স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে৷সকাল থেকে ইস্কুলের ছেলে,মেয়েগুলো সাজপোশাক পরে একহাতে ফুলের মালা আর অন্য হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে৷তারপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে মোড় আর ক্লাবগুলে থেকে দেশাত্মবোধক গানের সুর আর বন্দে মাতরম ধ্বনিতে আকাশ,বাতাস ভরে উঠল৷তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই পরিবেশ সেই চেনা রূপে ফিরে গেল৷  শাবিনা একমনে শ্বশুর,শাশুড়ির সাথে বসে ড্রয়িং রুমে এলসিডি স্ক্রিনে "ক্রান্তিবীর" সিনেমাটা দেখছিল৷ফিল্মের শেষভাগ চলছে৷ নানা পাটেকর ফাঁসিকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ডাইলগ বলছেন৷এমন সময় দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাবিনা গিয়ে দরজা খুলল৷দরজার ওপ্রান্তে তিন,চারজন লম্বা টুপি পরিহিত সজ্জন মানুষ৷শাবিনা ওড়নায় মাথা ঢেকে একপাশে সরে দাঁড়াল৷তাদের একজন বলে উঠলেন,নাদির ভাইসাব বাড়িতে আছেন? শাবিনা শান্ত সুরে বলে উঠল,হ্যা আছেন৷ গিয়ে দেখা করতে পারেন৷ তাদের সকলকে শ্বশুরমশাই এর সামনে বসিয়ে চা চাপাতে চলে গেল শাবিনা৷চা নিয়ে হাজির হতেই শ্বশুরমশাই শাবিনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,একি শুনছি সাব্বু!তুমি নাকি সকালে মসজিদের গেটে তিরঙ্গা টাঙিয়ে এসেছ?শাবিনা ওড়নার ফাঁকে মুখ বের করে উত্তর দিল,বাজার থেকে আসার পথে রাস্তার ধারে জাতীয় পতাকাটা পড়ে থাকতে দেখে মনে মনে খুব আঘাত পেয়েছিলাম৷তাই সেটা তুলে নিই৷আশেপাশে কোথায় টাঙাবো ভেবে শেষে মসজিদের গেটটাই চোখে পড়ল৷আজ তো স্বাধীনতা দিবস৷তাই ভাবলাম মসজিদের গেটে টাঙিয়ে রাখলে,মর্য্যাদাও বাড়বে৷সে কথা শুনেই সজ্জনদের একজন প্রায় ধমকে উঠলেন,স্বাধীনতা!কাদের স্বাধীনতা,কিসের স্বাধীনতা?দেখো বেটি তুমি নাদান আছো৷এসবের কিছু বোঝো না৷তাই ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর কখনো করতে যেও না৷নাহলে বড়সড় বিপদে পড়ে যাবে?তোমাকে পতাকাটা ওখানে রাখতে অনেকেই দেখেছিল৷কিন্তু তুমি নাদির ভাইসাবের বহু বলে কিছু করেনি৷তাই তারা আমাদেরকে জানিয়েছিল৷সেই পতাকা হটাতে গিয়ে অনেক কান্ড ঘটে গেছে৷ইউসুফ বেডরুমে ল্যাপটপে কাজ করছিল৷সজ্জনদের গলা পেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল৷সজ্জনদের একজন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,ওকে বোঝাও ইউসুফ৷শাবিনা আর থাকতে পারল না৷ট্রেখানা টেবিলের উপর নামিয়ে কাঁদতে,কাঁদতে ছুটল বেডরুমের দিকে৷একটু বাদে ইউসুফও গেল তার পিছু পিছু৷শাবিনা তখনো বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে৷ইউসুফ তার মাথায় হাত বোলাতেই শাবিনা হো হো করে খরস্রোতা নদীর মতো তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷কেঁদে কেঁদে বলে উঠল,বিশাল এই পৃথিবীর কি এমন কোন জায়গা নেই,যেখানটা স্বাধীন?আমি আমার মতো করে বাঁচতে পারবো ইউসুফ৷ ইউসুফ দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,আছে তো৷যেখানে তুমি এখন মাথা রেখে আছো,সেটা তোমার জমি৷এখানে তুমি একদম স্বাধীন৷তুমি তোমার মতো করে বাঁচতে পারো শাবিনা৷কথাটা শুনে শাবিনা আরো শক্ত করে ইউসুফকে আঁকড়ে ধরল৷       -



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama