দায়ী
দায়ী
নমিতা হাতের উলকাঠি দুটো একটু থামাল।তারপর
সদর দরজার দিকে চোখদুটো বার কতক বাই,বাই করে ঘুরিয়ে সামনের মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, সিরিয়ালের কথা বাদই দিলাম বুলু।এই তো দিন কয়েক আগের ঘটনা।ফুচির বাবা বলছিল,বিয়ে বাড়িতে একজন ছেলে একটি মেয়েকে সরবতের সাথে কী সব খাইয়ে দিয়েছিল।মেয়েটা ঢলে পড়তেই,তাকে একটা পুরনো বাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে যাচ্ছে তাই কান্ড ঘটায়।
এরপর বুলু কথার মধ্যে আক্ষেপ মিশিয়ে বলে উঠল,যুগটা দিন,দিন ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে গো বৌদি।বাবা তুল্য শ্বশুরগুলো পর্যন্ত বউমার গায়ের গন্ধ নিতে চাইছেন।ওই "সতী-অসতী"তে কাল কী দেখাল?সব তো দেখেলে।আজকাল সেই সকল ঘটনাই ঘটছে গো মিনাক্ষীদি।
শর্বানী সুঁচের আগায় সুতো পরাতে গিয়ে বলে উঠল,আমি তো বাপু মেয়েকে কড়া শাষনে রেখেছি।কলেজে পড়তে চাইছো,পড়ো।কোন ছ্যাচড়া ছেলের পাল্লায় পড়েছ কী,সেদিন থেকেই কলেজ,ফলেজ সব বন্ধ।
নমিতা কথার স্পীড বাড়িয়ে বলে উঠল,আর ধন্যি করি আজকালকার মেয়েগুলোকেও।পোষাকের কী কোন ছিরি আছে নাকি?..বাইরে বেরুলে পোশাকের বাহার দেখে মনে হয়।শরীর দেখাতে যাচ্ছে।বুক,পেট সব ঠেলে বেরোচ্ছে।ছেলেরা তো তাকাবেই।দেখার জন্য তো আর টিকিট লাগে না।
মালা এতক্ষণ ধরে একটু আড়ালে গিয়ে কারু সঙ্গে ফোনে ফিসফিস করে কথা বলছিল।এখন আসরে এসেই ডায়লগ শুরু করে দিল,এই তোমরা বিভার কেসটা শুনেছ?
মিনতি বলে উঠল,বিভা মানে তো ওই পাড়ার সেই স্বামী ছাড়া মেয়েটা?
মালা বলল,হ্যাঁ গো হ্যাঁ সেই বিভারাণী।
শর্বানী সেলাই থামিয়ে বলে উঠল,আবার ধরা পড়ল নাকি?
মালা ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল, এবার তো একজন আধবুড়ো ঢ্যামনার সাথে।দিনের বেলায় কুয়োতলার পাশে!!
ছিঃ..ছিঃ..গো!..নির্লজ্জের একটা সীমা থাকে।সেইটুকুও মাগী রাখলো না।স্বামীর অক্ষমতার ঢোল পিটিয়ে এসে বাপের ঘরে ডেরা বেঁধেছে।তারপর পাড়ায় একটার পর একটা সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে।লোকটা ধরা পড়ার পর শুনছি ওর বড় ছেলেটা লজ্জায় বাড়ি থেকে পালিয়েছে।
আসরটা হঠাৎ করে থেমে গেল।কারণ সদর দরজা ঠেলে মুনাই ঘরে ঢুকল।এ বছর এইটে উঠেছে।পড়াশুনোই মন্দ না। মুখে লাবন্য আছে।উচ্ছ্বল,প্রাণবন্তা মেয়ে।তবে এখন ওর চোখ,মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেছে ।একটা চাপা জড়তাও লক্ষ্য করা গেল।মানুষ ভয় পেলে যেমন হয়।মুনাই-এর অবস্থা অনেকটা সেইরকম।
তার মা নমিতা সর্বপ্রথম দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে বিষ্য়মভরা কন্ঠে বলে উঠল,.. কীরে ফুচি!..আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে!.. স্কুল ছুটি হয়ে গেল নাকি?
মুনাই ফিসফিস করে কিছু বলল।সেটা কেউ বুঝে উঠতে পারল না।তাই সবাই একসঙ্গে তাকে অপরাধীর মতো ঘিরে ফেলল।
একটার পর একটা প্রশ্ন তার বুজে আসা চোখ,মুখের দিকে তিরের মত ধেয়ে এল।
কী হল তোর?
এমন হাপাচ্ছিস কেন?
এ্য মা এত রক্ত কেন তোর পায়ে!!
..ইস কে করল তোর এতবড় ক্ষতি?
জানোয়ারটার নাম বল একবার ।
মুনাই অজ্ঞান হওয়ার পূর্বে ভয়ার্ত চোখে ফিসফিসভাবে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলেও প্রশ্নের ভীড়ে সেই কথা কেও ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করল না।
শুধুমাত্র তার মুখের ওই "লাল্টুদা" শব্দটাই স্পষ্ট শুনতে পেল।
উত্তরে তখন মজলিসের একজন মহিলা বলে উঠল,ছিঃ...ছিঃ গো শেষে কিনা লাল্টুও জানোয়ার হয়ে উঠল!!.. আজ ওর ভাল মানুষির বিদ্যে ঘোচাচ্ছি।
মুনাই চোখ মেলে চাইতেই বিচানার চারপাশে একগাদা মানুষের ভীড় লক্ষ্য কর
ল।
তার মা,বাবা দুজনের চোখ জল।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুলিশকে দেখতে পেয়ে মুনাই-এর ভয় আরো বেড়ে গেল।ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
তলপেটের ব্যথাটা আবার জানান দিল। তাই যন্ত্রনায় কুকড়ে উঠল।
সেই দেখে উপস্থিত কয়েকজন রাগে গজগজ করে উঠলেন,জানোয়ারটাকে আজ আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন স্যার।ওকে উপযুক্ত শাস্তি আমরাই দেব।
একজন পুলিশ অফিসার আদেশের সুরে বলে উঠলেন,আগে আপনারা সকলে বাইরে বের হোন।ভিক্টিমের মা,বাবাই কেবলমাত্র থাকবেন।আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে মেয়েটিকে।
সেইমত সকলে বাইরে বেরিয়ে গেল।পুলিশ অফিসার দরজা বন্ধ করলেন।তারপর সুস্থভাবে মুনাই-এর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন, তোমার নাম কী?
মুনাই-এর খুব ভয় হচ্ছে।তাই কাঁপা গলায় জবাব দিল,মুনাই।
অফিসার বললেন,ভয় পেয়ো না মা।তুমি আমার মেয়ের মত।তোমার সঙ্গে কী হয়েছিল একটু খুলে বলো।এখানে আমরা সবাই আছি ।তোমার কোন ভয় নেই।লুকিয়ো না কিচ্ছুটি।দোষীকে আমরা কঠোর শাস্তি দেব।
মুনাই কিছুতেই তার জীবনের এমন যন্ত্রনাময়,লজ্জাকর,ভয়াভয় অভিজ্ঞতা বলতে রাজি নয়।তারপর আবার তিন,চারটে মুখ!
শেষে মা,বাবার করুণ আর্তি মেনে মুখ খুলল,
...স্যার আমায় একটা অঙ্ক কষতে বোর্ডের সামনে ডেকেছিলেন।অঙ্কটা জটিল ছিল।একটু জোর করে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আমার গাটা কেমন গুলিয়ে উঠল।তার একটু পরেই পেটের নিচে চিনচিনে ব্যথা শুরু হল।
কোন রকমে অঙ্কটা শেষ করেই স্যারকে বলে বাথরুমে গেলাম।ভাবলাম পায়খানা হবে।একটু পরেই ব্যথা আরো বাড়ল।তখনি অনুভব করলাম আমার নিচের দিকে কিছু তরল বের হচ্ছে।দেখলাম রক্ত!
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।কাঁপছিলাম।বমিও হল।লজ্জাও লাগছিল।চারিদিকে রক্তের দাগ!
কী করব..কাকে বলব।ঠিক করতে পারলাম না। যতটা সম্ভব দাগগুলো মুছে বাইরে বেরিয়ে এলাম।এসেই হেডস্যারকে শরীর খারাপ লাগছে বলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।রক্তে আমার দু পা ভিজে যাচ্ছিল।হাতের রুমালটাই করে মুছে হাঁটছিলাম।তখনি লাল্টুদার সাথে দেখা। সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল।আমার শরীর খারাপ শুনে পিছনে বসিয়ে বাড়ি অব্দি ছেড়ে দিয়ে গেল।
ভয়ে,যন্ত্রনায় আমার সারা শরীর কাঁছিল।মাথাটাও অল্প,অল্প ঘুরছিল।তাই বাড়ির দরজা অব্দি এসেই আমি আর নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারিনি। দুর্বলতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
..এতদুর এক নাগাড়ে বলার পর মুনাই একটু দম নিল।তারপর বিস্ময়ভরা কন্ঠে আবার বলে উঠল,কিন্তু আমাদের বাড়িতে এত লোকজনের ভীড় কীসের?..পুলিশকাকুরাই বা কেন এসেছেন?..আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মুনাই এর প্রশ্ন শুনে
উপস্থিত সবাই একে অন্যের দিকে অবাকভাবে চাইলেন।
অফিসার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর একটা মুহূর্তও দেরী করলেন না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।তারপর সবার উদ্দেশ্যে জোর গলায় বলে উঠলেন,যে যার বাড়িতে চলে যান।এখানে আর কাউকে যদি দেখি সোজা জিপে ঢোকাব।
তারপর নিচু স্বরে লাল্টুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,লাল্টু..তুমি আমার সঙ্গে একবার ভেতরে এসো।
লাল্টু তার কপালের ক্ষতটায় একটা হাত চেপে ভেতরে ঢুকল।
মুনাই তো লাল্টুর এমন অবস্থা দেখে বিছানা থেকে তড়াক করে ওঠে পড়ল।
--একি!..তোমার এ অবস্থা কেমন করে হল?
মুনাই-এর কথার জবাব কে প্রথম দেবেন? সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।তাই সকলেই কিছুক্ষণ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
------+++--------