বধু মিছে রাগ কোরো না
বধু মিছে রাগ কোরো না


সাল ১৯৬৫, স্থান কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট।
কয়েকজন মেয়ে বসে আছে ঘাটে। তাদের মধ্যে একজন বেশ চোখে পড়ার মতো।
না না তারমানে এই নয় যে মেয়েটা খুব সুন্দর, এমনিই সাধারণ চেহারা, মুখখানা মিষ্টি, গায়ের রঙ হালকা চাপা, তবে মুখটার সাথে গায়ের রঙ টা মানায় ভালো।
তবে মেয়েটা চোখে পড়ার মতো কারণ মেয়েটা অনর্গল কথা বলে চলেছে। কোলে খোলা গীতবিতান, হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ে আছে, চুল গুলো বিনুনি করে পিঠে ফেলা। দেখেই বোঝা যায় কলেজে পড়ে।
গঙ্গার ঘাটের ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর সারা শরীর, ওর হাসির ঝংকারের সাথে মিশে যাচ্ছে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ, ছোট ছোট চুল গুলো এসে চোখে মুখে পড়ছে।
হঠাৎ মেয়েটার কানে ভেসে আসল, কেউ সেতার বাজাচ্ছে । গঙ্গার সমুখে চোখ গেল মেয়েটার। গঙ্গায় একটা নৌকা ভেসে আসছে ওদেরই দিকে, হয়তো ওই ঘাটেই নোঙর করবে।
সেই নৌকাতেই বসে একটি অল্পবয়সী ছেলে সেতারে কি সুন্দর সুর তুলছে।
সুরটা চিনতে পারলো মেয়েটা , ছেলেটা এতই সুন্দর সেতার বাজাচ্ছে যে মেয়েটা সেই সুরে এক্কেবারে মোহিত হয়ে পড়েছে।
সুরটা গুনগুন করতে করতে জোরে গেয়ে উঠলো মেয়েটা,
"মোর ভাবনারে , কী হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।"
ছেলেটা শুনতে পেয়েছে মেয়েটার গলা, ওর ইচ্ছে করছে নিজের বাজনা বন্ধ করে চোখ বুজে ওর গান শোনে।
এত সুন্দর ও কেউ গাইতে পারে!
কিন্তু বাজনাটা ও থামালো না, যদি ওটা থেমে গেলে মেয়েটার গানও থেমে যায় ?
মেয়েটার সুরের মূর্ছনায় মুখরিত হচ্ছে গঙ্গার ঘাট, আর সেই সুর হিল্লোল তুলছে ছেলেটার মনে ।
মেয়েটার গান শেষ হতে হতে ছেলেটার নৌকাও এসে নোঙর করেছে ঘাটে।
গানটা শেষ হতে না হতেই ছেলেটার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বের হয়ে গেল,
"অপূর্ব!"
নৌকাটা ঘাটে এসে নোঙর করা মাত্র মেয়েটার চোখ গেল ছেলেটার দিকে, গায়ের রঙ টা ছেলেটার একটু কালোর দিকে ঘেঁষা, তবে মুখশ্রী টা বেশ মায়া মাখানো, ভাসা ভাসা চোখদুটো যেন অনেককিছু বলতে চায়। কোঁকড়ানো একমাথা চুল। মুখে হালকা দাঁড়ি, দেখতে বেশ বাচ্চা বাচ্চা লাগে।
পরনে সাদা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি।
ছেলেটা আর মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ একেঅপরের দিকে চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। হঠাৎ ওদের ধ্যান ভাঙলো মেয়েটির সাথে থাকা বাকি মেয়েগুলোর আওয়াজে।
ওদের মধ্যে একজন মেয়েটিকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল," কিরে? বাড়ি যাবিনা ?"
মেয়েটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
মেয়েটা পিছন ফিরে যেতে নেবে এমন সময় ছেলেটি বলে উঠলো,"আপনার গানের গলা খুবই সুন্দর।"
মেয়েটা মাথা নিচু করে একটু হেসে বলল,"ধন্যবাদ, আপনিও খুব সুন্দর সেতার বাজান।"
বলেই মেয়েটা হাওয়ার গতিতে চলে গেল।
মেয়েটার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে একটু লজ্জা পেলো ছেলেটা , পরক্ষণেই মনে হল,"যাহ্! মেয়েটির নামটাই তো জানা হল না!"
মেয়েটা বাড়ি ফেরার পর , হাতমুখ ধুয়ে ওর বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।
দরজায় দুইবার কড়া নেড়ে বলল,"আসতে পারি?"
কথাটা শুনে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন, মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ঝকঝক করছে।
মুখটা তুলে হেসে বললেন,"আমার ঘরে আসার জন্য বুঝি তোকে অনুমতি নিতে হয় চন্দ্রিমা?"
চন্দ্রিমা মাথা দুলিয়ে বলল,"না তা নয়, কিন্তু তুমি সারাদিন যা ব্যস্ত থাকো, তাতে তোমার দেখা মেলে কোথায় বল? হয়তো ঢুকলে পরে বলবে প্রোফেসর গগন কান্তি চট্টোপাধ্যায় এখন কাজে নিমজ্জিত রয়েছেন। তাই ভাবলাম অনুমতি নিয়েই ঢুকি।"
গগন বাবু এবার হেসে ফেলেন, এই মেয়েটা কথার ফুলঝুরি, একটা কথা বললে, দশটা কথা বলে দেয়।
মেয়েকে কাছে ডেকে বলেন, "আমার কাছে এসে বোস। কলেজ কেমন হল ?"
"খুব ভালো। জানো বাবাই, আমার সাথে অরুনিমা পড়তো না, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর দুইমাসের মাথায় বিয়ে।"
"সে কি রে? ওর তো এখনও কলেজ শেষই হল না, বিয়ের পরে বুঝি পড়বে?"
"না না, ছেলের বাড়ির লোক তো বলেই দিয়েছে, মেয়েদের ওইসব গানবাজনা নাকি ওনাদের একদম পছন্দ না। ওগুলো নাকি খারাপ জিনিস। আচ্ছা বাবাই তুমিই বলো, সংস্কৃতি কখনও খারাপ হতে পারে?"
"নাহ্ পারে না, গানবাজনা তো কখনই না, ওটা একটা শিল্প, একটা সাধনা, সেই সাধনা বোঝার ক্ষমতা সবার নেই ।"
"আচ্ছা বাবাই, তুমিও কি আর পাঁচজনের মতন , আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে, আমি কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই বাবাই।"
"তোর বাবা সেইরকম মানুষ নয় রে মা। বিয়েটা সবার প্রয়োজন অবশ্যই, কিন্তু সেটা শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও, একটা ছেলের যেমন কখনো নিজের পায়ে না দাঁড়ালে বিয়ে দেওয়া হয় না, তেমনই একটা মেয়েরও নিজের পায়ে না দাঁড়ালে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সবসময় মনে রাখবি মা, যে নিজের দ্বায়ীত্ত্ব নিতে পারে না, সে অন্যের দ্বায়ীত্ত্বও নিতে পারে না।"
"এইজন্যই তো তোমাকে আমি এত ভালোবাসি।" বলে বাবাইকে জড়িয়ে ধরলো চন্দ্রিমা ।
রাতে নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলো চন্দ্রিমা, হঠাৎ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল ওই গঙ্গার ঘাটে ছেলেটার মুখ, "ঈশ্! নামটাই তো জানা হল না ছেলেটার।"
আস্তে করে নিজের ডায়েরীটা বের করে লিখে ফেলল চন্দ্রিমা,
"নামহীন তুমি,
আর কি কখনও দেখা পাবো তোমার?কোনোদিন পেলেও কি তুমি চিনতে পারবে আমায়?
ধুর! জানিনা।"
বিশাল একটা ঘর, ঘরের বড় জানালা দিয়ে শোঁ শোঁ করে হাওয়া ঢুকছে।
কাঠের বড় পালঙ্কের উপর শুয়ে আছে আকাশ বন্দোপাধ্যায়।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে আজ সকালে দেখা মেয়েটার কথা , ওর সেতারের ঝংকারের সাথে তাল মিলিয়ে কি সুন্দর গাইলো গানটা, আবার ওর প্রশংসাও করল, দুঃখের বিষয় নামটাই জানা হল না।
আকাশ বন্দোপাধ্যায়, বড় কারবারি শতদ্রু বন্দোপাধ্যায়ের এক মাত্র সন্তান।
বয়স ২৩ থেকে ২৪ এর মধ্যে হবে, চেহারাটা খুব একটা পুরুষালি না, বরং একটু নরম সরম রকমের, ভালোবাসে সেতার বাজাতে আর গান গাইতে। এই কারবার টারবার তার একেবারেই পছন্দ নয়।
তাই তো বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রবীন্দ্রভারতী তে গানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছে, আগামীকাল থেকেই জয়েন করতে হবে।
এই নরম স্বভাবের জন্য ওকে ছোট থেকে কম কথা শুনতে হয়নি , এককালে তো মেয়েছেলে নামটা ওর আসল নামটাকে ঢেকেই দিয়েছিল। অনেকে আবার হিজড়েও বলতো, আসলে সমাজ এমনই, ছেলেরা যদি ডানপিটে গোছের না হয়, যদি তারা মেয়েদের পায়ের তলায় পিষে না রাখতে পারে তবে সে কিসের পুরুষ?
লোকের টোন টিটকারী তে অতিষ্ঠ হয়ে আকাশের বাবা ওকে বেশ অল্প বয়সে বাইরের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।
একা মুখচোরা আকাশ বোর্ডিং এ গিয়ে আরো বেশি একা হয়ে পড়ে। ওখানকার বাকি ছেলেরা যখন ওকে একই ভাবে খোঁটা দিত, রাতে বালিশ আঁকড়ে চোখের জল বৃথা সংবরনের চেষ্টা করত, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ভাবত,"বাবা কি এমন ভালো করার জন্য এখানে পাঠালো আমাকে?"
যাই হোক ! পুরোনো কথা আর মনে করতে চায়না আকাশ।
কালকের দিনটা ওর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
শাড়িটা কোনোমতে সামলে বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকছিল চন্দ্রিমা, বেশ দেরি হয়ে গেছে আজকে , এমন সময় আকাশ ও তাড়াহুড়ো করে ঢুকছিল ফলে দুজনেই মাথায় ঠোকা খেয়ে যায়।
ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে দুজনেই একেঅপরের দিকে তাকায়।
তাকিয়ে চমকে উঠে একসাথে বলে ওঠে,"আপনি!"
চন্দ্রিমা, আকাশ দুজনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে, দুজনেই একেঅপরকে আরেকবার দেখার জন্য বেশ অস্হির হয়ে উঠেছিল।
আকাশ ওকে দেখে ভেবেই ফেলেছে আজকে ওর নাম জেনেই ছাড়বে, তাই তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করে ফেলে,"কি নাম আপনার?"
চন্দ্রিমা হেসে ওঠে আকাশের অমন তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করা দেখে।
আকাশ একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।
আকাশকে অমন মাথা নিচু করতে দেখে হঠাৎ ছেলেটার উপর একটা মায়া জন্মায় চন্দ্রিমার।
তারপর বলে ,"আমার নাম চন্দ্রিমা, চন্দ্রিমা চট্টোপাধ্যায়।"
আকাশ মনে মনে ভাবে মুখখানা চাঁদের মতই মিষ্টি।
চন্দ্রিমা জিজ্ঞেস করে,"আপনার নাম?"
আকাশ হাসিমুখে বলে,"আকাশ বন্দোপাধ্যায়।"
"আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কি করছেন?" চন্দ্রিমা আবার জিজ্ঞেস করে।
"আসলে আমি এই কলেজেই পড়াবো, আজকেই প্রথম দিন, গানের ক্লাসগুলো কোথায় যদি বলতেন, ভালো হত।" আকাশ অনুরোধ করল।
চন্দ্রিমা একটু থতমত খেয়ে যায়, হাজার হোক স্যার তো, ওনার সাথে এমন করে কথা বলা, একটু কেমন কেমন যেন লাগে ওর।
তারপর একটা হাসি মুখে টেনে এনে বলে,"আপনি গানের প্রোফেসর? ও আমিও তো গানের বিভাগের ই ছাত্রী, এবার ফাইনাল ইয়ার, আসুন আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আকাশকে ক্লাস দেখিয়ে দিয়ে চন্দ্রিমাও নিজের ক্লাসে ঢুকে পড়ে।
আকাশ ওদেরও ক্লাস নিলো, চন্দ্রিমা মুগ্ধ হয়ে আকাশের গান শুনছিল, কি সুন্দর গাইছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুলো।
আবার বিভিন্ন ভাগ, তাদের উৎস এগুলোও কি সুন্দর বুঝিয়ে দিচ্ছিল।
গানের প্রতি যে আকাশের একটা আলাদা ভালোবাসা আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলো চন্দ্রিমা।
আকাশও সারাক্ষণ চন্দ্রিমাকেই লক্ষ করে গাইছিল।
তবে ক্লাস শেষে দুজনের আর দেখা হয়নি।
যে যার মতন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলো।
বাড়িতে ফেরা মাত্রই আকাশের ঠাকুমা বলে ওঠেন,"এতক্ষণ বুঝি ওই মেয়েছেলেদের মতো গান গাইছিলি? বংশের মান মর্যাদা সব ডুবিয়ে এসেছিস তাইনা? "
চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল অজান্তেই বেড়িয়ে আসে আকাশের চোখ দিয়ে।
ওই দেখে ওর ঠাকুমা আবার বলেন,"এই একদম মেয়েমানুষের মতন কাঁদবি না। আচ্ছা লোকে যা বলে তাহলে কি তাই ঠিক? তুই কি সত্যিই হিজড়া? আমাদের বংশে চুনকালি মাখাতেই এসেছিস?"
আর পারে না আকাশ দাঁড়িয়ে থাকতে, ছুটে চলে আসে নিজের ঘরে। এসেই দরজাটা আটকে দেয়।
তারপর দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,"তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে বল তো মা? আজ তুমি থাকলে কেউ আমাকে এমন করে বলতে পারত? বাবাও সব শুনে চুপ থাকে। কেউ ভালোবাসেনা আমায় তুমি ছাড়া, কেউ না।"
সত্যিই তো আজ অব্দি কেউ সেইরকম ভালো করে কথা বলেনি আকাশের সাথে।
না না, ও গান গায় বলে নয়, ওটা তো কথা শোনানোর আরেকটা ছুঁতো মাত্র। আসলে আকাশের স্বভাবটাই একটু নরম সরম, আর শরীরের গড়ন টাও একটু মেয়েলী, তাই বলে ও হিজড়ে নয়।
হঠাৎ আকাশের মনে পরে যায় চন্দ্রিমার কথা, কই ও তো দিব্যি ওর সাথে ভালো করে কথা বলল, সেটা কি শুধুই স্যার বলে?
চন্দ্রিমা গগনবাবুর ঘরে ঢুকতেই উনি বললেন," হ্যাঁ রে মা? তুই পি.এইচ.ডি র জন্য অ্যাপলাই করেছিস?"
চন্দ্রিমা বলল," হ্যাঁ বাবা করেছি তো।"
গগনবাবু আবার বললেন,"শুধু কিন্তু কলেজের চাকরির আশায় বসে থাকিস না, স্কুলের পরীক্ষা গুলো দিস।"
"দেবো তো।" চন্দ্রিমা বলল।
এমন সময় পিছন থেকে চন্দ্রিমার মা সুলতা দেবী বলে উঠলেন,"বাপ বেটিতে কি শুধু পড়াশোনা নিয়ে আলোচনাই করা হবে নাকি খেতেও আসা হবে?"
চন্দ্রিমা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,"আসছি তো।"
সুলতা দেবী মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,"দেখ মা, কলেজে যাচ্ছিস , সাবধানে থাকবি, আজকাল নকশাল আন্দোলন নিয়ে যা হচ্ছে, ওইসবে ভুলেও জড়াবি না কিন্তু।"
চন্দ্রিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
রাতে, অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে চন্দ্রিমা, খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে, সেই আলো আঁধারির পরিবেশে, চোখে ঘুম নামার আগে চন্দ্রিমার চোখের সামনে আকাশের ওই মায়া মাখানো মুখটা আরেকবার মনে পড়লো, তারপর পারি দিলো ঘুমের দেশে।
আকাশের ক্লাস প্রতিদিন করলেও, ওর সাথে কথা খুব একটা হয়নি চন্দ্রিমার।
আসলে চন্দ্রিমারই কোথাও গিয়ে একটা দ্বিধা কাজ করছিল। হাজার হোক শিক্ষক তো, ওনাদের সাথে অকারণ কথা বলাটা খানিকটা দৃষ্টিকটু তো বটেই।
তবে আকাশের মনটা ছটফট করতো, চন্দ্রিমার সাথে কথা বলার জন্য।
মেয়েটার গলার আওয়াজই এতটা স্নিগ্ধ যে ওর সাথে দুদণ্ড কথা বললেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
আর সবচেয়ে বড় কথা চন্দ্রিমা আকাশের সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে, কখনও ওর দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় না বা ওর সম্বন্ধে বাজে কথা বলে না।
চন্দ্রিমা এখন খুব ব্যস্ত, ফাইনালের আর বেশী দিন বাকি নেই।
মাঝে দুদিন চন্দ্রিমা কলেজে যেতে পারেনি, শরীরটা ভালো ছিল না বলে।
আজ কলেজে এসেই প্রথমে স্টাফ রুমে
গেল আকাশের কাছে, কয়েকটি বিষয় বুঝে নেওয়ার জন্য।
আকাশের আজ মনটা একদম ভালো ছিলো না।
বাড়িতে প্রত্যেক দিন অশান্তি চলছে, আর তার কারনটা আকাশ।
ওর বাবাও একটুও বোঝেনা ওকে।
মায়ের অভাবটা আরও বেশি করে বোধ করে আকাশ।
চন্দ্রিমা স্টাফ রুমে ঢুকে দেখে আকাশ মাথাটা নিচু করে বসে আছে।
কাছে যাবে কি যাবে না, ভাবতে ভাবতে চন্দ্রিমা ভিতরে ঢুকেই গেল।
কাছে গিয়ে গলাটা অল্প কেশে একটু পরিষ্কার করে ডেকে উঠল,"স্যার"
হঠাৎ ডাকায় একটু চমকে উঠে আকাশ মুখটা তুলল।
সামনে চন্দ্রিমাকে দেখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।
এই মেয়েটা সামনে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়।
তবে এমন ভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক না, তাই পরক্ষণেই চোখ দুটো সরিয়ে বলল,"কিছু বলবে?"
চন্দ্রিমা মিষ্টি করে হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
আকাশের কাছে গানের বিশ্লেষণ বোঝার সময় চন্দ্রিমা লক্ষ করছিল, কথা বলতে বলতে আকাশের গলাটা বারবার কেঁপে উঠছিল।
"স্যারের কি মনটা খারাপ?" চন্দ্রিমা মনে মনে ভাবলো।
কিন্তু স্যারকে তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না।
স্টাফ রুমের থেকে বেরোনোর আগে চন্দ্রিমা আকাশের কাছে গিয়ে বলল,
"একটা কথা বলব? যা মনকে কষ্ট দেয় তার সম্মুখীন হওয়ার আগে ইউ টার্ন নিয়ে নিন, দেখবেন ভালো থাকবেন, আর মনটাও ভালো থাকবে। আসি কেমন?"
কথাগুলো বলে চলে যায় চন্দ্রিমা ।
আকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রিমার যাওয়ার পথে, ওর নিজের লোকেরাই ওকে বুঝলো না কোনোদিন আর এই দুইদিনের পরিচিত মেয়েটা ওর মনটাকে পড়ে ফেললো অনায়াসেই।
অস্ফুটে বলে উঠলো আকাশ,"তোমার মতন কেউ নেই।"
"দ্যাখো আকাশ, তোমার মর্জি মতন অনেক চলতে দেওয়া হয়েছে তোমাকে, কিন্তু এবার তোমায় আমার কথা শুনতেই হবে ।
ব্যাবসায় তোমাকে যোগ দিতেই হবে।"
বেশ ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বললেন শতদ্রু বাবু।
আকাশ এতক্ষণ মাথা নিচু করে শুনছিল ওর বাবার কথা। প্রত্যেক দিনের এই অশান্তিটা ওর নরম মনে বড্ড আঘাত হানছে।
মনে মনে একবার জিজ্ঞেস করল,"আচ্ছা চন্দ্রিমা, নিজের লোকেদের থেকে ইউ টার্ন নেওয়ার কোনো উপায় জানা আছে কি তোমার? থাকলে বলো না গো।"
"কি হল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কানে কথা ঢুকছে না?" বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেন শতদ্রু বাবু।
এমন আওয়াজে ভিতরটা কেঁপে ওঠে আকাশের।
"কাকে কি বলছিস বাবু? ওর কানে কবে কোন কথাটা ঢুকেছে?" পিছন পিছন আকাশের ঠাকুমাও এসে দাঁড়িয়েছে ।
"এইজন্যই বলেছিলাম, অন্যের পাপের ফল বাড়িতে আনিস না। সব ওই বৌমার জন্য। কে জানে এই ছেলেকে দেখে কোন মায়ায় জড়ালো, সোজা বাড়িতে নিয়ে আসলো, এনে তিনি তো দিব্যি চলে গেলেন, কিন্তু এই ছেলে, থুড়ি মেয়েছেলেকে গছিয়ে গেলেন আমাদের ঘাড়ে।"
ঠাকুমার বলা শেষ কথাগুলো কানে ঢুকলো না আকাশের , ওর কানে তখনও বেজে চলেছে,"অন্যের পাপের ফল বাড়িতে আনিস না।"
"অন্যের পাপের ফল মানে কি ঠাম্মি?"
স্থির গলায় জিজ্ঞেস করল আকাশ।
জিজ্ঞেস করলো ঠিকই কিন্তু উত্তরটা শোনার খুব বেশি আগ্ৰহ নেই, উত্তরটা যে ওর জীবনের কঠিন কোনো সত্যি সেটা ও ভালোই বুঝতে পেরেছে।
শতদ্রু বাবু পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললেন,"এখন ওসব কথা থাক, আকাশ তুমি ঘরে যাও।"
কিন্তু আকাশ ছাড়লো না, বলল,"আমি সত্যিটা জানতে চাই বাবা।"
শতদ্রু বাবু কিছু বলার আগেই ওর ঠাকুমা বলে উঠলেন,"কুড়িয়ে পেয়েছিল তোকে তোর মা আর বাবা, কুড়িয়ে পেয়েছিল। বারবার মানা করেছিলাম, শুনলো না, কে জানে কোন অজাত কুজাতের পাপের ফল এনে ঘরে পুষলো। এখন বোঝ ঠেলা।
এই তো সেইদিনই দেখলাম, ঠাকুরঘরে বসে তিনি মালা গাঁথছেন ।
কোন দিন দেখবো তিনি ঘুঙুর পায় নাচছেন, ওইটাই বা বাকি থাকে কেন?"
পাঞ্জাবির বুকটা কখন ভিজে গিয়েছে চোখের জলে, টের পায়নি আকাশ।
ঠাকুমার কথা শেষ হওয়ার পর আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়ালো না।
বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নাটাকে কোনো রকমে সংবরন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
শতদ্রু বাবু একবার খালি বললেন ,"এভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হল না।"
ঠাকুমা মুখ বেঁকিয়ে বললেন,"ঠিক হলো না, মরে যাই বাপু এদের আদিক্ষেতা দেখলে।"
গঙ্গার ঘাটে একা বসে আছে আকাশ। ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মারছে সারা শরীরে।
কে জানে হয়তো হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে চাইছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলা ছেলেটাকে।
আজ আকাশের নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছে। কেউই কখনও ওর নিজের ছিল না, তবুও ও মনে মনে জানতো যে ওরা ওরই পরিবারের লোক।
আজ সেই ভুল ধারণাটা এক নিমিষে ভেঙে দিলো।
"আচ্ছা সবারই তো বাঁচার জন্য কাউকে লাগে, কিন্তু আমার তো কেউ নেই । তাহলে তো আমার বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না। কি জন্য বাঁচব? কার জন্যই বা বাঁচব?
এমনিতেও আমি মরে গেলে কারোর কিছু যাবে আসবে না। এর চেয়ে এই ভালো।"
কথাগুলো ভেবে , নদীর দিকে পা বাড়ালো আকাশ।
কিন্তু পারলো না, আচমকাই একটা হাত এসে শক্ত করে ওকে টেনে নিলো।
"কি করছিলেন কি আপনি হ্যাঁ? আমি না ধরে নিলে কি হত বলুন তো? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?" আকাশকে নিজের দুই বাহু দিয়ে শক্ত করে ধরে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেল চন্দ্রিমা।
চন্দ্রিমা পি.এইচ.ডির অ্যাপলিকেশন এর ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে এস.এম ম্যামের বাড়িতে গিয়েছিল।
বেড়োতে একটু রাতই হয়ে গিয়েছে।
এখান দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখে একটা ছেলে অমন ভয়ঙ্কর ভাবে পা বাড়িয়ে রেখেছে নদীর বুকে।
কাছে গিয়ে চিনতে পারে ওটা আকাশ স্যার।
আকাশ চন্দ্রিমাকে দেখে প্রথমে একটু থমকে যায়।
তারপর হঠাৎই ওর কোল জড়িয়ে জোরে কেঁদে ওঠে।
আসলে আচমকা একটা ভরসার কোল পেয়ে সেটাকেই আঁকরে ধরেছে ও স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে।
চন্দ্রিমা আকাশের এমন ব্যাবহারে বেশ অবাক হয়েছে।
কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না।
আকাশের মাথায় আলতো করে স্নেহ ভরা হাতটা ছোঁয়ায়।
আকাশ যে ওর শিক্ষক সেটা ও ভুলেই গিয়েছে।
চন্দ্রিমার স্নেহ স্পর্শ পেয়ে আকাশের কান্নার দমক আরও বেড়ে যায়।
চন্দ্রিমা আকাশের মুখটা তুলে বলে ,"এই বোকা ছেলে, কাঁদছো কেন এইভাবে?" বলে চোখের জলটা মুছিয়ে দিলো সযত্নে।
আকাশ যেন চন্দ্রিমাকে ছাড়তেই চাইছে না। ওকে শক্ত করে ধরে আছে।
চন্দ্রিমা আবার বলল,"কি হয়েছে বলো?"
আকাশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,"কেউ নেই আমার, কেউ নেই।"
চন্দ্রিমা একটু হেসে বলল,"ওমা সেকি কথা ? কেউ নেই মানে?"
আকাশ চন্দ্রিমার কোল ঘেঁষে বসে বাচ্চাদের মতন করে বলে,"জানো কি হয়েছে আজকে?"
আকাশকে অমন বাচ্চাদের মতন মুখ করে থাকতে দেখে আবার হেসে ফেললো। তারপর ওর মুখটা ধরে কপালে একটা স্নেহ পরশ এঁকে দিয়ে বলল,"বলো তো কি হয়েছে।"
আকাশের মুখে সবটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল চন্দ্রিমা।
আকাশের জন্য এক অদ্ভুত মায়া কাজ করছে ওর মনে।
এইরকম একটা আবেগপ্রবণ ছেলেকে আঘাত দিতে পারে কি করে কেউ? আজ যদি ও না আসতো, তাহলে তো ছেলেটা ওই ভুল কাজটা করেই ফেলতো।
তখন কি হত?
কে নিত এর দায়?
আকাশের কাঁধে হাত রেখে চন্দ্রিমা বলল,"নিজের জন্য বাঁচতে শেখো আকাশ। কারোর জন্য কখনো জীবনকে থামিও না, তাকে বইতে দাও আপন স্রোতে। বাড়ি ফিরে যাও আকাশ।"
আকাশ অবাক হয়ে বলল,"কি বলছ? আবার ফিরে যাবো ওই বাড়িতে? কি পরিচয়?"
"তোমাকে ওই বাড়িতে তোমার মা নিয়ে গিয়েছিল, তাই ওই বাড়িটা তোমারও, তুমি ওই বাড়িতে ফিরে না গেলে তোমার মাকে অসম্মান করা হবে। তাই বলছি ফিরে যাও।"
আকাশ মন দিয়ে ওর কথাগুলো শুনছিল।
চন্দ্রিমা আবার বলে উঠলো ,"নিজেকে কখনো হারতে দিও না।"
মনে মনে বলল,"তুমি হারতে গেলেও পারবে না, আমি তোমায় হারতে দেবো না।"
আকাশ বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল, এমন সময় চন্দ্রিমা বলে উঠলো,"ভুলভাল কোনো সিদ্ধান্ত নিও না গো, আমার দিব্যি রইল।"
আকাশ জলভরা দৃষ্টিতে তাকালো চন্দ্রিমার দিকে , এই মেয়েটা এত ভালো কেন?
দুজনেই পা বাড়ালো নিজেদের গন্তব্যে।
অজান্তেই একরাশ হিমেল হাওয়া , গঙ্গার বুকে লিখে গেলো এক নতুন প্রেমের সূচনা পর্ব।
বাড়িতে ফিরেছে ইস্তক আকাশ ঘরে দোর দিয়েছে।
নিচে খেতেও যায়নি। খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশটায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে।
এক অদ্ভুত লজ্জা গ্ৰাস করেছে ওকে।
"ছিঃ ছিঃ, চন্দ্রিমাকে ওইভাবে জড়িয়ে ধরাটা একদম ঠিক হয়নি, ভুল বুঝল না তো আমায়?" মনে মনে ভাবলো আকাশ।
আবার পরক্ষণেই মনে হল,"না, ভুল কেন বুঝবে, ও তো আমার সব কথা শুনলো, আমার সাথে কথা বলল, আর আমাকে......"
আর ভাবতে পারেনা আকাশ। চন্দ্রিমাকে জড়িয়ে ধরার পড়ে চন্দ্রিমা ওর কপালে স্নেহ চুম্বন এঁকে দিয়েছিলো। কথাটা মনে পড়তেই ওর গালদুটো সূর্যাস্তের সময়কার আভার ন্যায় লাল হয়ে গেল।
চন্দ্রিমার কথা ভাবতে ভাবতেই, ঘুমে ঢুলে পরলো আকাশ।
মনের অন্তরালে আরেকবার বেজে উঠলো ওই কথাটা ,"অন্যের পাপের ফল"।
আরও একবার ক্ষতবিক্ষত মনটা কেঁদে উঠলো, আর সেইসাথে মানসপটে ভেসে উঠল চন্দ্রিমার মুখটা, যে ওকে ফেলে দেয়নি, বরং কাছে টেনে বাঁচতে বলেছে।
চন্দ্রিমার খালি মনে হচ্ছে আকাশ ঠিকঠাক বাড়ি ফিরেছে তো? আবার নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেললো না তো?
বসে বসে এইগুলোই ভাবছিল, এমন সময় হঠাৎ সুলতা দেবী ঘরে এলেন।
"আজকাল কোন ভাবসাগরে ডুবে থাকিস বলতো? সারাক্ষণ কি আকাশ পাতাল ভাবিস?"
সুলতা দেবীর কথা শুনে চন্দ্রিমা ওনার ফেরে।
তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে বলে,"আচ্ছা মা একটা কথা বলবে?"
"কি কথা?"
"একজন হঠাৎ করে জানতে পারলো, যাদের সে এতদিন নিজের মা বাবা বলে জেনে এসেছে সে আসলে তার আসল মা বাবা নয়, ওনারা তাকে দত্তক নিয়েছে, কথাটা শুনে সে মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়লো। এবার তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ঠিক করা উচিত বলো তো?"
চন্দ্রিমার মা অবাক হয়ে বললেন,"কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস বলতো?"
চন্দ্রিমা বলল,"আহা! বলই না।"
সুলতা দেবী বললেন,"এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন তো আগে কখনো হইনি , তবুও জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সবার আগে তার মনটা বোঝার চেষ্টা কর, পড়ার চেষ্টা কর তার মনটাকে আর তারপর কথা বল, কাউকে মানসিক অবসাদ থেকে বের করার জন্য তার সাথে কথা বলার চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।"
"এই জন্যই তো বলি, সব সমস্যার সমাধান এই তোমার কাছে পাওয়া যাবেই যাবে।" চন্দ্রিমা মিষ্টি করে বলল।
সুলতা দেবী মুখ টিপে হেসে বললেন,"সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এবার বল তো ছেলেটা কে? কার জন্য এত চিন্তা আমার মেয়েটার?"
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ভারি লজ্জা পেলো চন্দ্রিমা,"যাহ্ মা, কি যে বলনা তুমি। সেইরকম কিছুই না।"
সুলতা দেবী হাসতে হাসতে বললেন,"বুঝি বুঝি, সব বুঝি। যাই হোক, অনেক রাত হয়েছে, এখন ঘুমিয়ে পড়।"
বলে চলে গেলেন সুলতা দেবী।
চন্দ্রিমা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, সত্যিই কি সে আকাশের জন্য অন্যরকম কিছু অনুভব করে? যদি নাই করে তাহলে কেন ওর জন্য এত চিন্তা হচ্ছে চন্দ্রিমার?
কেন মনে হচ্ছে ছেলেটাকে এমন ভাবে জড়িয়ে রাখে যাতে কোনো কষ্ট ওকে আর ছুঁতে না পারে?
কোনো কারণ ছাড়াই?
অবশ্য ভালোবাসা তো অকারণেই হয়।
কে জানে ? মনকে বোঝা সত্যিই খুব কঠিন।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় চন্দ্রিমা।
শুধু মনের গহীনে বাজতে থাকে,
"মনের কথা মনই জানে,
তবু বৃথাই খুঁজে মরি,
মনের কথা জানার তরে,
মনরেই দিই ফাঁকি।"
চন্দ্রিমা আজ একটু তাড়াতাড়িই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে, ক্লাস শুরুর আগে যদি আকাশের সাথে কথা বলা যায় তাহলে খুব ভালো হয়। ফাইনালটাও তো একদম সামনে। তাই ক্লাসগুলো মন দিয়ে করতে হচ্ছে।
পড়াশোনাটা তো ঠিক করে করতে হবে।
আকাশ আজ আগেই চলে এসেছে। বাড়িতে যতটা কম থাকা যায় আর কি।
কালকের পর থেকে ঠাকুমা আর ওর সাথে কথাই বলেননি । বাবাও বিশেষ কিছু বলেননি।
একা বসে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি গুনগুন করছিলো আকাশ।
এমন সময় চন্দ্রিমা আচমকাই ঢুকে ওর সামনে বসে পড়ল।
আকাশ একটু থতমত খেয়ে গেল।
চন্দ্রিমা কখনই অনুমতি না নিয়ে ঢোকে না, এমন ঔধত্ব্য দেখানোর মত মেয়ে ও না।
আকাশ কি বলবে বুঝতে না পেরে এমনিই জিজ্ঞেস করল,"কিছু কি বলবে?"
চন্দ্রিমা বলল," হ্যাঁ, বলব তো।"
আকাশ ধীর কন্ঠে বলল,"কি?"
"আপ...... আপনি ভালো আছেন তো?" চন্দ্রিমা ইতস্তত করে বলল।
"শরীর ভালো না থাকলে আর কলেজে আসি কি করে বল?"আকাশ একটু হেসে বলল।
"শরীরের কথা বলিনি, মনে কথা বলছি। মনটা ভালো থাকলে শরীর এমনিই ভালো থাকে।" চন্দ্রিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।
আকাশ অবাক চোখে দেখলো চন্দ্রিমাকে। সত্যিই তো। শরীরের খবর সবাই জানতে চায়, কিন্তু মনের খবর ক'জন রাখে?
এই মেয়েটা সত্যিই আলাদা।
আকাশ একটু ছলছলে চোখে বলল,"আছে ভালোই।"
"আপনি কাঁদছেন?" চন্দ্রিমা আকাশের চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বলল।
আকাশ একটু কষ্টের হাসি হেসে বলল,"না আসলে আগে তো কেউ কখনও এভাবে মনটাকে পড়তে চায়নি। আজ কেউ চেয়েছে, তাই চোখে একটু জল চলে এলো।"
চন্দ্রিমার হাতদুটো নিজে থেকেই আকাশের দিকে এগিয়ে গেল, আলতো ছোঁয়ায় মুছিয়ে দিলো আকাশের গাল বেয়ে নামা অশ্রুবারি গুলোকে।
আকাশ চোখ দুটো বড় বড় করে চেয়ে আছে চন্দ্রিমার দিকে ।
চন্দ্রিমা বলে উঠলো,",কি দেখছেন ওভাবে?"
আকাশ অল্প কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,"চন্দ্রিমা তুমি ক্লাসে যাও। এভাবে আমাদের কেউ দেখলে খারাপ ভাবতে পারে।"
চন্দ্রিমাও দেখলো, সত্যিই তো , লোকে দেখে দুটো বাজে কথা অনায়াসেই বলে দেয়, ভিতরের কাহিনীটা কেউ দেখতে যায় না।
উঠে পড়লো চন্দ্রিমা , বলল,"এখন যাচ্ছি, ক্লাস আছে। তবে কলেজ শেষে অপেক্ষা করবেন। আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।"
হকচকিয়ে গেল আকাশ,"আমাকে নিয়ে যাবেন? কোথায়? আর কেনই বা আমি যাবো আপনার সাথে?"
চন্দ্রিমা একদম আকাশের মুখের সামনে এসে বলল,"আমি আপনার শ্লীলতাহানি করবো না, তাই আমার সাথে নির্ভয়েই যেতে পারেন। চুপচাপ যাবেন।" কথাগুলো বলে মুচকি হেসে চলে গেল চন্দ্রিমা।
আকাশের হতভম্ব ভাব এখনও কাটেনি। মেয়েটা কি বলে গেল? এটা চন্দ্রিমাই তো? ওই শান্তশিষ্ট মেয়েটা এতগুলো কথা বলল? তাজ্জব!
"কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, আমাকে বলবে দয়া করে?" আকাশ বলল চন্দ্রিমা কে। কলেজ শেষে একপ্রকার জোর করেই আকাশকে নিয়ে এসেছে চন্দ্রিমা।
"উফ্ ! এত অধৈর্য্য কেন হচ্ছেন বলুন তো, আরেকটু সবুর করুন, এক্ষনি পৌঁছে যাব।" বিরক্তি ভরে বলল চন্দ্রিমা।
আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর চন্দ্রিমা বলল,"নিন পৌঁছে গিয়েছি।"
আকাশ সামনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় । কি সুন্দর জায়গাটা, বেশ বড় একটা বাগান, তার মাঝে ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি। বাগানটা দেখতে অনেকটা তপোবনের মতন। চারদিকে ফুলের মেলা, বড় বড় গাছগাছালি। কলকাতা মহানগরীর বুকে এমন স্থান বিরল।
চন্দ্রিমা আকাশের মুগ্ধ নয়নের দিকে তাকিয়ে বলল,"এটা আমার বাবার বাগানবাড়ি। মনে হল আপনার মন ভালো করার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা পাবো না।"
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,"তুমি আমার মন ভাল করার জন্য এখানে এনেছো?"
চন্দ্রিমার একটু রাগ হল এমন বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে, বলল,"নাহ্ !এই ভরদুপুরে আপনার সাথে তপোবনের মাঝখানে লুকোচুরি খেলবো বলে এনেছি। খেলবেন?"
কথাগুলো আকাশের কানে গেল না, ও খালি ভাবছে, ওর জন্যেও কেউ ভাবে?
চন্দ্রিমা আকাশের মনের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরে বলল,"আর কারোর কাছে না পারুন, প্রকৃতির কাছে নিজের মনের দরজাটা খুলে দিন, মেলে ধরুন নিজেকে প্রকৃতির কাছে, দেখবেন প্রকৃতি ঠিক আপনাকে কাছ টেনে নেবে, প্রকৃতি কখনও কাউকে ফেলে দেয়না, সবাইকে আপন করে নেয়।"
আকাশ অবাক হয়ে শুনছিলো চন্দ্রিমার কথাগুলো।
একটুক্ষণ চুপ করে বলে উঠলো,"প্রকৃতি নেয় কিনা জানিনা, তবে তুমি যে সবাইকে আপন করে নাও সেটা খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছি আমি।"
আকাশের কথা শুনে চন্দ্রিমা হেসে উঠলো।
আর সেই হাসির ঝর্ণার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল একজোড়া চোখ।
আজ সারা তপোবনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক নিঃশব্দ প্রেমের ঝংকার।
"সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুল গন্ধ,
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ -
তুমি জানো না, ঢেকে রেখেছি তোমারও নাম, রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে,
আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও
প্রাণ সুরের বাঁধনে।"
গানটা গাইতে গাইতে চন্দ্রিমার কথা ভাবছিল আকাশ। কয়েকটা ছোট্টো ঘটনায় চন্দ্রিমা ওর হৃদয়ের বেশিরভাগ টা জুড়ে গেঁথে গেছে।
চন্দ্রিমাকে কি ও তবে ভালোবেসে ফেলল?
ফেলাটাই স্বাভাবিক। চন্দ্রিমা ওকে সেই ভরসা, সেই স্নেহটা দিয়েছে যেটা ও এতবছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছিল।
কিন্তু চন্দ্রিমা কি আকাশকে সেই চোখে দেখে, ও কি ভালোবাসে ওকে ? ওর মতন ছেলেকে কি ভালোবাসা যায়?
"ভালোবাসি" চন্দ্রিমা নিজের মনে বলে উঠলো, "ওই পাগলটাকেই আমি ভালোবাসি, নাহ্ আর কোনোও সন্দেহ নেই আমার মনে, আকাশকে সত্যিই ভালোবাসি আমি। সারাজীবন ভালোবেসে আগলে রাখতে চাই ওকে, আর যাতে ওকে কষ্ট পেতে না হয়।"
আজ সারা সন্ধ্যে চন্দ্রিমা এটাই ভেবে চলেছে , সে আকাশকে ভালোবাসে না বাসেনা?
ভালো না বাসার একটা কারণও খুঁজে পায়নি ভেবে ভেবে। সবগুলোই ভালোবাসার পক্ষে ছিলো।
তাই বিষয় টাকে মেনে নিয়েছে চন্দ্রিমা।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মনের মধ্যে।
একটা মিষ্টি ভালোলাগা কাজ করছে।
"আচ্ছা আকাশও কি আমাকে ভালোবাসে?"
চন্দ্রিমা মনে মনে ভাবে । তারপর নিজেই এর সমাধান করে ফেলে।
"না বাসলেই বা কি? আমি তো বাসি । "
আকাশ সারাটা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে, আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে।
চিন্তা একটাই ও চন্দ্রিমাকে ভালোবাসে নাকি বাসেনা?
"নাহ্ মনে হচ্ছে ভালোই বাসি।" বলে উঠলো আকাশ, আবার পরক্ষণেই বলে উঠলো,"কিন্তু বিষয়টা এগোনোর পর যদি আমি বুঝতে পারি, ওটা ভালোবাসা না মোহ ছিল, তখন তো আর ফিরে আসতে পারবো না।"
"না না আকাশ, ভালোটাই ভাব, ভালোবাসিস তুই ওকে ভালোবাসিস।"
কথাটা বলতে না বলতেই দরজায় কড়া পড়ল । শতদ্রু বাবু ডাকছেন আকাশকে।
আকাশ দরজাটা খুলতেই শতদ্রু বাবু ঘরে ঢুকে বললেন,"দেখো আকাশ, তুমি তোমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি ভাবছো আমি জানিনা। কিন্তু একটা কথা বলতো ? চাকরিটা তো নিজের ইচ্ছায় করছো, বিয়েটা কি আমার পছন্দে করবে নাকি কুলাঙ্গারের মতন নিজের পছন্দে?"
আকাশ ধিরে ধিরে বলল,"আসলে আমি এখনও ওসব নিয়ে কিছু ভাবিনি। আমি এখনও বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই।"
"তাহলে প্রস্তুতি নাও, নিয়ে আমাকে জানাও , তবে তাড়াতাড়ি ।" কথাগুলো বলে শতদ্রু বাবু চলে গেলেন।
আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,"আমার উপর সবাই শুধু সব কিছু চাপিয়েই গেল, আমি কি চাই কেউ জানতে চাইলো না, আমি আক্ষরিক অর্থেই একটা অপদার্থ, নিজের কথাটা কোনোদিন বলতেই পারলাম না মুখফুটে।
তবে এবার আমি আর ভয় পাব না, কালকে চন্দ্রিমাকে আমি ঠিক বলে দেবো যে আমি ওকে ভালোবাসি। আর এভাবে একা একা গুমড়ে মরতে পারছি না আমি। বলে দেবো ঠিক ।"
আকাশ আর চন্দ্রিমা দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হাওড়া ব্রিজে।
আকাশই কলেজ শেষে ওকে নিয়ে এসেছে।
অনেকক্ষণ ধরে আকাশ কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে চন্দ্রিমাকে, সেটা চন্দ্রিমা বুঝতে পারছে, কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারছে না।
শেষে আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললো ও,"আপনি কি কিছু বলবেন?"
আকাশ ঢোক গিলে আস্তে করে বলল," হ্যাঁ"
তারপর আরেকবার ঢোক গিলে চন্দ্রিমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,
"তোমার হৃদয়ের কোণে একটু জায়গা দেবে আমাকে?
তার বদলে আমি তোমায় দেবো এক সমুদ্র ভালোবাসা।"
কথাটা বলেই চোখ বুজে ফেললো আকাশ, চন্দ্রিমার মুখের দিকে তাকানোর সাহস আর নেই ওর।
চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ গোল গোল চোখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর জোরে হো হো করে হেসে উঠলো।
ওর হাসির আওয়াজে আকাশ চমকে চোখ দুটো খুললো।
চন্দ্রিমাকে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে হাসতে দেখে আকাশ থমকে গেল।
মনে মনে ভাবলো,"আমার কথা শুনে কি ও রাগে পাগল হয়ে গেল?"
আকাশের ভাবনাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে, চন্দ্রিমা বলে উঠলো,"আরে আকাশ, পুরো ফাটিয়ে দিলি তো রে, আমি তো জন্মে ভাবিনি তুই এত সাহস করে আমাকে ভালোবাসি বলতে পারবি। পুরো কাঁপাকাঁপি ব্যাপার!"
চন্দ্রিমার কথা শুনে আকাশ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।
মেয়েটা কিনা শেষে ওকে তুইতোকারি করছে!
এদিকে চন্দ্রিমা উত্তেজনার বশে লাফিয়ে উঠে আকাশের গালে নিজের ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলো।
আকাশ এই আকস্মিক ঘটনায় এমন হতভম্ব হয়েছে যে বলার নয়।
লজ্জায় মাথাটা নিচু করে ফেলল আকাশ।
চন্দ্রিমা আকাশের লজ্জা মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলল,"একটা চুমুতে তুমি ভার্জিনিটি লুস্ করবে না অধ্যাপক মশাই ।"
চন্দ্রিমার মন্তব্য শুনে রীতিমতো হেঁচকি উঠে যায় আকাশের।
তারপরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,"তাহলে উত্তরটা হ্যাঁ তো ?"
চন্দ্রিমা এবারে একটু লজ্জা পায়।
আকাশ এবার নিজের লাজ লজ্জা ভুলে চন্দ্রিমাকে জড়িয়ে ধরে।
মাঝে কেটে গেছে একটা মাস।
চন্দ্রিমার ফাইনাল শেষ হয়ে গেছে।
আপাতত পি.এইচ.ডি নিয়ে ও বেশ ব্যাস্ত।
আকাশের সাথে দেখাসাক্ষাৎ ও একদমই বন্ধ।
দুজনেই একেঅপরকে একঝলক দেখার জন্য, গলার আওয়াজ একটু শোনার জন্য আনচান করে।
কিন্তু কোনোটাই হয় না।
তবে আজ চন্দ্রিমাকে বিশ্ববিদ্যালয় আসতে হয়েছে। আজকে রেসাল্ট। ও আর গগনবাবু এসেছেন।
চন্দ্রিমার রেসাল্ট নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।
ভয় ভয় বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকে টাঙানো লিস্টটার দিকে এগোলো। ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় উপচে পড়ছে সেখানে। কোনোভাবে ভিড় ঠেলেঠুলে লিস্টটার কাছে পৌঁছোতে পারল চন্দ্রিমা।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না চন্দ্রিমা।
প্রথম নামটা ওর? সত্যিই?
বাবাকে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রিমা, আজ মেয়ের গর্বে বুক ফুলে উঠছে ওনার।
চন্দ্রিমার এত আনন্দের মধ্যে ভুলেই গেছে আকাশের কথা।
আকাশ অনেকক্ষণ দুর থেকে দেখছিল, খুব ইচ্ছে করছিল ওর কাছে গিয়ে ওকে অভিনন্দন জানাতে, কিন্তু গগনবাবু সামনে আছেন বলে সেটা পারেনি।
কিন্তু যখন দেখলো চন্দ্রিমা একবারও ওর কাছে এলো না তখন মনটা একটু খারাপ হল।
বুকে এক চিলতে অভিমান নিয়ে স্টাফ রুমে চলে গেল ও।
চন্দ্রিমার বেশ খানিকক্ষণ পরে মনে পড়লো আকাশের কথা ।
বাবাকে দরকার আছে বলে স্টাফরুমে চলে এলো ও।
আকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আকাশ বলে উঠলো,"এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো?"
চন্দ্রিমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে ফেললো, তারপর আকাশের গালদুটো টিপে বলল,"মান হয়েছে বুঝি?"
আকাশ মুখটাকে ভার করে বলল,"হয়েছেই তো।"
চন্দ্রিমা বলল,"তাহলে কি করলে মান ভাঙবে?"
আকাশ এবার উজ্জ্বল মুখে বলল,"আজ গঙ্গার ঘাটে আসবে? চারটের দিকে? অনেকদিন দেখা হয়না।"
চন্দ্রিমা হাসি মুখে বলল,"আচ্ছা বেশ, চলে আসব। এখন তাহলে যাই?"
যাওয়ার আগে আকাশের পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে নিলো।
আকাশ অবা
ক হয়ে বলল,"এটা কি হল?"
"বা রে! তুমি না আমার শিক্ষক ? একটা প্রণাম তো করতেই হয়। রেসাল্ট বেড়িয়েছে না?"
বলেই হাসতে হাসতে ছুটে পালায় চন্দ্রিমা।
আকাশ হাসিমুখে চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথের দিকে।
সত্যিই এই মেয়েটা ওর মেঘলা জীবনে এক চিলতে রোদ।
গঙ্গার ধারে বসে আছে আকাশ আর চন্দ্রিমা। শেষ যখন গঙ্গার ঘাটে দেখা হয়েছিল, তখন আকাশ মানসিক ভাবে বিধস্ত ছিল, আর তাছাড়াও ওদের সম্পর্ক তখনও প্রেমে পরিণত হয়নি।
আজ দুজনেই একেঅপরের হৃদয়ের বড় নিকট।
আকাশ আস্তে করে চন্দ্রিমার হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে বলল,"এই চন্দ্রা, বাড়িতে কি বলব এবার আমাদের কথা?"
চন্দ্রিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,"দেখো আকাশ, সবই ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে আমি এখনি করতে পারব না গো। আমি আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, আমার বাবা মা দুজনেরই অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। আর তাছাড়া তুমি তো জানোই আমার পরিবার বাকিদের চেয়ে আলাদা, বাবা মা সবাইকে সমান চোখে দেখতেই ভালোবাসেন বরাবর। ছেলে হলে চাকরি করবে আর মেয়ে হলে বিয়ে, এই জিনিসটায় ওনারা একদম বিশ্বাস করেন না।
বাবা কি বলেন জানো? "যে নিজের খাওয়া পড়ার দ্বায়ীত্ব নিতে পারে না, সে কখনই একটা সংসারের দ্বায়ীত্ব নিতে পারে না। সে ছেলে হোক বা মেয়ে।"
"এরজন্যই তো তুমি সবার চেয়ে আলাদা। কারন তোমার আপব্রিঙ্গিং টাই এত ভালো হয়েছে।
বিয়ের কথা আমি বলিনি চন্দ্রা, আমি শুধু জানিয়ে রাখতে চাইছি, তোমার ক্যারিয়ারে আমি কখনও বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না, কিন্তু বাবা বিয়ে নিয়ে জোরাজুরি শুরু করেছেন। তাই জানিয়ে রাখতে চাইছি ।" কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আকাশ।
চন্দ্রিমা আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলল,"বাড়িতে কি খুব বেশিই ঝামেলা হচ্ছে আজকাল? তোমার চোখমুখ আমার ঠিক লাগছে না।"
"অশান্তি তো আমার নিত্য সঙ্গী চন্দ্রা, ওসব নিয়ে তুমি ভেবোনা। বিয়ের পরে আমি তোমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। এই অশান্তির মধ্যে তোমায় থাকতে হবেনা।" আকাশ বলল।
চন্দ্রিমা বলল,"কোনো পরিস্থিতিতেই পরিবার ভাঙতে নেই আকাশ, এমনটা বোলো না।"
আকাশ একটু হেসে বলে উঠলো,"একটা সুন্দর পরিবার আমার সেই ছেলেবেলার স্বপ্ন চন্দ্রা, কিন্তু সেটা কোনোদিনই পাইনি আমি। এই পরিবার যে আমার নিজের নয় সেটা প্রতি মুহূর্তে ওই বাড়ির লোকগুলো বুঝিয়ে দেয়।"
চন্দ্রিমা আকাশের গালে হাত রেখে বলে,"আর তো কয়েকটা মাসের ব্যাপার গো। আমার পি.এইচ.ডি টা শেষ হয়ে যাক, তারপরে কলেজে চাকরিটা হয়ে গেলেই দুই প্রোফেসর মিলে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসবো কেমন?"
চন্দ্রিমার কথা শুনে হেসে ফেলে আকাশ।
গঙ্গার ঘাটে দুই ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ ছেলে মেয়ে দুটোকে মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছে ভালোবাসার শহর কলকাতা।
কিন্তু কোথাও গিয়ে কি ঝড়ের সূচনা হচ্ছে?
কি হবে সেই ঝড়ে?
ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে এই মিষ্টি সম্পর্কটা নাকি ভালোবাসাই আবার ফিরিয়ে আনবে ওদের সেই ঝড়ের মুখ থেকে?
"বাবা, আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।" আকাশ শতদ্রু বাবুর ঘরে এসে বলল।
" কি কথা?" শতদ্রু বাবু আকাশের দিকে না তাকিয়েই কথাটা বললেন ।
"আমি চন্দ্রিমাকে বিয়ে করতে চাই ।"
আকাশ সাহস করে কথাটা বলেই ফেললো।
শতদ্রু বাবু কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আকাশের দিকে ।
তারপর বললেন,"তাহলে আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, পরিবারের মুখে শেষ চুনকালি টুকুন তুমি লাগিয়েই ছাড়লে। "
"বাবা তুমি একবার অন্তত চন্দ্রিমার সাথে কথা বলে দেখো? মেয়েটা ভালো, ওর পরিবারও ভদ্র। তাছাড়া আর ক'দিন পরেই চন্দ্রিমাও চাকরি পেয়ে যাবে। যথেষ্ট শিক্ষিত মেয়ে ও।" আকাশ বলে ওঠে।
শতদ্রু বাবু বলেন,"কি? চাকরি করবে? মেয়েমানুষ হয়ে সংসার না করে চাকরি করবে? আর কিছু বোঝার বাকি নেই আমার। ওই মেয়ের চরিত্র আমার বোঝা হয়ে গেছে।"
আকাশ বোঝানোর চেষ্টা করে,"কিন্তু বাবা....."
কথাটা শেষ করতে দেননা শতদ্রু বাবু, তার আগেই বলেন,"আমি এই বিষয় আর একটা কথাও বলতে চাইনা তোমার সাথে। যাও এখন তুমি এখান থেকে। যাও!" গর্জে ওঠেন শতদ্রু বাবু।
আকাশ নিজের ঘরে এসে ভাবতে থাকে এরপরে ও কি করবে। চন্দ্রিমার যা আত্মসম্মান বোধ তাতে ও চাকরি ছেড়ে কেবলমাত্র বউয়ের পরিচয় বাঁচতে চাইবে না।
আর তাছাড়া আকাশ চায় ও না সেটা ও করুক । চন্দ্রিমার স্বপ্নগুলো যে এখন ওরও স্বপ্ন।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস।
চন্দ্রিমার পি.এইচ.ডি শেষ হয়ে গেছে।
পেপার্স জমা দেওয়াও হয়ে গেছে। এবার শুধু নেট দিতে বসা বাকি।
সেটার ডেট ও সামনের সপ্তাহেই।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি করে ইন্টারভিউয়ারস দের প্রশ্নের উত্তর দেবে সেটাই অনুশীলন করছিল চন্দ্রিমা।
এমন সময় ওর মা এসে বলেন ,"শুনছিস? আকাশ বলে একটা ছেলে এসেছে তোর সাথে দেখা করতে।"
চন্দ্রিমা একটু অবাক হয়। আকাশ আগে কখনও ওর বাড়িতে আসেনি। আজ হঠাৎ কি হলো?
চন্দ্রিমা সুলতা দেবীকে বললেন,"ওকে ঘরে পাঠিয়ে দেবে গো?"
সুলতা দেবী মুচকি হেসে বলেন,"তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই? এই ছেলেই কি সেই ছেলে?"
"আহ্ মা! কি যে বলনা তুমি?" লজ্জা পায় চন্দ্রিমা।
"বুঝতে পেরেছি সব। এত লজ্জা পেতে হবে না । ছেলেটা কিন্তু বেশ দেখতে। তোদের দুটিকে মানাবে ভালো।" কথাটা বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে চলে যান সুলতা দেবী।
আকাশ ধিরে ধিরে ঘরে ঢোকে । চন্দ্রিমা আকাশকে দেখে ওর হাত ধরে টেনে খাটে বসিয়ে দেয়।
তারপর দরজায় খিল এঁটে বলে,"কি ব্যাপার বলো তো তোমার? তুমি তো হঠাৎ করে না বলে কয়ে সোজা বাড়িতে চলে আসার ছেলে নও। কি হয়েছে বলো তো? সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে।"
আকাশ একটু উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,"আমায় যেতে হবে চন্দ্রা ।"
চন্দ্রিমা অবাক হয়ে বলল,"কোথায়?"
"আসলে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের উপর পোষ্ট ডক করার একটা সুযোগ পেয়েছি আমি চন্দ্রা, সেটার জন্য আগামী তিন বছরের জন্য আমাকে জার্মানি তে যেতে হবে।" আকাশ ধির কন্ঠে বলল।
কথাটা শুনে চন্দ্রিমার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, আকাশের কাঁধ ধরে বলল,"সত্যি!"
আকাশ বলল,"তোমাকে ছেড়ে এতগুলো দিন থাকতে হবে চন্দ্রা। আর তুমি খুশি হচ্ছো?"
"তা হবনা? একসাথে থাকবে বলে এত বড় একটা সুযোগ তুমি হাতছাড়া করবে? তুমি যেমন কখনো আমার ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না, তেমনি আমি কি করে তোমার ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই বলোতো? আর তিনটে বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।" চন্দ্রিমা হাসিমুখে বলল।
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে একটু মলিন হেসে বলল,"তুমি এতটা কেন বোঝো আমাকে?"
চন্দ্রিমা আবারও হেসে বলল,"খালি কোনো সুন্দরী বিদেশিনীর দিকে তাকিও না, তাহলেই হবে।"
আকাশও হেসে ফেললো ওর কথা শুনে।
দুজনেই বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো।
তারপর হঠাৎই চন্দ্রিমা আকাশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
আকাশের শরীরে হালকা শিহরন খেলে গেল।
ওরা আগেও একেঅপরের কাছাকাছি এসেছে, একেঅপরকে জড়িয়ে ধরেছে।
কিন্তু এই কাছে আসাটা আলাদা।
এই স্পর্শে একটা অন্য আবেদন আছে।
আকাশ চন্দ্রিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,"কি করছিস পাগলি?"
চন্দ্রিমা আকাশের মুখটা নিজের দুই হাত দিয়ে ধরে বলল,"এই শোনো না। কদিন পর তো চলেই যাবে গো।
আজকের দিনটা একটু আমায় ভালোবাসবে ? এমন ভাবে, যাতে তোমার অনুপস্থিতিতেও তোমার ছোঁয়া আমার সারা শরীরে অনুভব করতে পারি আমি?"
আকাশ চমকে উঠলো চন্দ্রিমার কথা শুনে।
মেয়েটা বলে কি!
চন্দ্রিমা আকাশের হাতদুটো ধরে বলল,"আজ অন্তত আমায় ফিরিও না গো। বিদেশে গিয়ে তুমি যদি অন্য কারোরও হয়ে যাও, তাও অন্তত তোমার অনুরাগে সিক্ত হয়ে আমি আমার জীবনটা কাটাতে পারব। লক্ষ্মীটি আমার, কথাটা রাখো?"
আকাশ বলে,"কি বলছ কি এসব চন্দ্রা?"
চন্দ্রিমা ছলছলে চোখে তাকায় আকাশের দিকে। নাহ্! এই আকুতি ফেরাবার ক্ষমতা আকাশের নেই।
চারপাশটা ভালো করে একবার দেখে নেয়।
তারপর চন্দ্রিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় ধিরে ধিরে।
দুজনেই মিশে যায় একে অপরের মধ্যে।
কত যুগ এইভাবে কেটে গেছে জানা নেই, দুজনেই দুজনাতে ডুবে ছিল।
সম্বিত ফিরল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।
সুলতা দেবী ডাকছেন।
উঠে পরে দুজনে। জামা কাপড় ঠিক করে নিয়ে দরজা খোলে চন্দ্রিমা।
সুলতা দেবী বললেন,"কি রে ? ছেলেটা সেই কখন এসেছে, আর তুই দরজা বন্ধ করে রেখেছিস, খেতে দেবোনা ওকে?"
আকাশ তারাহুরো করে বলে,"না না মাসিমা, আমি আজ আর কিছু খাবোনা , আমার না একটু কাজ আছে, আমি যাই কেমন?"
বলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল আকাশ।
চন্দ্রিমা আর আকাশের মনে একটা কথা বারবার হাতুড়ি মারছে,"কাজটা একদম ঠিক হয়নি।"
দুজনেই আবেগের বশে যে কাজটা করে ফেলেছে সেটা সত্যিই ভুল।
আকাশ বাড়িতে পৌঁছানো মাত্র ওর বাবা বলে উঠলেন,"কোথায় গিয়েছিলে? ওই চন্দ্রিমার বাড়িতে?"
আকাশ মুখ নিচু করে বলল," হ্যাঁ "
"তুমি যতই চেষ্টা করো আকাশ, আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে আমি তোমায় কিছুতেই করতে দেবোনা।" কথাটা বলে চলে গেলেন শতদ্রু বাবু।
এক অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠল আকাশের।
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেছে আকাশ চলে গেছে।
চন্দ্রিমার মনটা প্রথম প্রথম খারাপ হলেও এখন অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে।
ভাইভা তে ও সিলেক্টেড হয়েছে । এটা ক্লিয়ার করলেই চাকরিটা পেয়ে যাবে।
বাড়িতে আকাশের কথা ও বলে দিয়েছে। মা বাবা কোনো আপত্তি করেননি।
তবে সেই সাথে চন্দ্রিমা সেইদিনের ওই কথাটাও ওনাদের বলে দিয়েছে।
ওই ঘটনার পর থেকে একটা অপরাধ বোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ওকে।
তাই চাপতে না পেরে ও বলে দিয়েছে।
মা তো শুনে খুব রেগে গিয়েছিল, ভয়ও পেয়েছিল একটু।
তবে গগনবাবু রাগ করেননি। মেয়েকে কাছে ডেকে বুঝিয়েছিলেন কি করে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। সুলতা দেবীও এই নিয়ে আর কিছু বলেননি। মেয়েটা যখন বুঝতেই পেরেছে তখন শুধু শুধু রেগে থেকে ওর মানসিক চাপ বাড়ানোর কিই বা প্রয়োজন।
ভাইভাটা দিয়ে বেড়িয়ে আসে চন্দ্রিমা সেন্টারের থেকে।
বাইরে গগনবাবু অপেক্ষা করছিলেন ওর জন্য ।
চন্দ্রিমা বেড়োতেই ওকে জিজ্ঞেস করলেন,"কি রে? কেমন হল?"
চন্দ্রিমা বলল,"উত্তর তো সব দিয়েছি। ওনারা বলেছেন সিলেক্ট হলে একেবারে জব লেটার দিয়ে দেবেন।"
বলে প্রণাম করল গগনবাবুকে।
একসপ্তাহ হয়ে গেছে।
শরীরটা আজকাল ভালো লাগেনা চন্দ্রিমার, মাথাটা ঘোরায় , খেতে ইচ্ছে করে না।
তবে যেটা চন্দ্রিমার চিন্তার কারণ সেটা হল এই মাসে পিরিয়ডের ডেট মিস করেছে ও।
ভীষন চিন্তায় আছে এই নিয়ে।
বসার ঘরে বসে এইগুলোই ভাবছিল চন্দ্রিমা। এমন সময় বেলটা বেজে উঠল।
চন্দ্রিমা দরজাটা খুলতেই পোস্টম্যান এসে একটা চিঠি দেয়। চিঠিটা চন্দ্রিমারই নামে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে একটা হাসি খেলে যায় ওর মুখে। কলেজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। যেটার জন্য এতবছর ধরে পরিশ্রম করছে ও।
অবশেষে বিশ্বভারতীতে গানের প্রোফেসর হিসেবে জয়েন করতে পারবে ও।
ছুটে গিয়ে বাবা মাকে চিঠিটা দেখায় চন্দ্রিমা।
আজ বাড়িটা খুশির আলোতে ঝলমল করছে।
চন্দ্রিমার খুব আকাশের কথা মনে পড়ছে। ও খবরটা জানলে কি খুশিটাই না হোতো।
হঠাৎ মাথাটা টাল খেয়ে যায় চন্দ্রিমার।
অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় ও।
চন্দ্রিমা সন্তানসম্ভবা শুনে নিমেষেই যেন বাড়ির পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেল।
চন্দ্রিমা জ্ঞান হারানোর পর ডাক্তার এসে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ইউরিন টেস্ট করতে বলেন। সেই টেস্টেই ধরা পরে চন্দ্রিমার প্রেগন্যান্সির কথা।
গগনবাবু আর সুলতা দেবীর চিন্তার শেষ নেই। অবিবাহিতা মেয়ে মা হতে চলেছে শুনলে যে সমাজ তাকে পতিতা আক্ষ্যা দেয়।
চন্দ্রিমা খবরটা শুনে আনন্দ করবে নাকি দুঃখ করবে তা বুঝতে পারছে না।
ওর আর আকাশের ভালোবাসার ফসল আসতে চলেছে, এটা শুনে কোন মেয়ে খুশি হয়না? এটা যে সব মেয়েদের কাছেই জীবনের সেরা মুহূর্ত।
কিন্তু আকাশ তো এখন নেই এখানে। ওকে খবরটা জানাবে কিভাবে চন্দ্রিমা?
শতদ্রু বাবুর বাড়িতে গিয়ে কলিং বেল বাজালেন গগনবাবু।
উনি আর চন্দ্রিমা এসেছেন শতদ্রু বাবুর বাড়িতে। গগনবাবু অনেক ভেবেচিন্তে শতদ্রু বাবুকে খবরটা জানানোর কথাই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।
শতদ্রু বাবুর বৈঠকখানায় পৌঁছে নিজেদের পরিচয় জানাতেই ভুরু কুঁচকে তাকালেন শতদ্রু বাবু।
তারপর বললেন,"ও , তুমিই সেই মেয়ে তাহলে।"
চন্দ্রিমা মাথা নিচু করে রইল।
গগনবাবু হাত জোর করে বললেন,"দেখুন শতদ্রু বাবু, ছেলে মেয়ে দুটো মিলে একটা ভুল ঘটিয়ে ফেলেছে, বাবা মা হিসেবে ওদের ক্ষমা তো করে দিয়ে আরেকটা সুযোগ দেওয়াই যায় , কি বলেন?"?
শতদ্রু বাবু গম্ভীর গলায় বললেন,"কি ভুল?"
গগনবাবু ধীরে ধীরে পুরো বিষয়টাই জানালেন শতদ্রু বাবুকে।
শতদ্রু বাবু বিশ্রীভাবে হেসে বললেন,"তো আপনি কি আশা করছেন, অমন মেয়ের সাথে আমি আমার ছেলের বিয়ে দেবো? ওই বাচ্চা যে আমার ছেলেরই সে বিষয় আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে? এমন মেয়েরা সবার সাথেই করতে পারে।"
"মুখ সামলে কথা বলুন শতদ্রু বাবু।" গর্জে ওঠেন গগনবাবু। "আমার মেয়ের বিষয় একটা খারাপ কথাও আমি সহ্য করবো না।"
"আরে যান তো মশাই , এমন মেয়ে ঢের দেখেছি। তাছাড়াও আকাশের বিয়ে আমার অন্যত্র ঠিক করা আছে। ও তো বলেইছে দেশে ফিরেই বিয়ে করবে।"
চন্দ্রিমা চমকে ওঠে, বলে,"আকাশ বলেছে এই কথা? ও অন্যত্র বিয়েতে রাজি?"
"তা নয়তো কি?" অনায়াসে মিথ্যেটা বলে দেন শতদ্রু বাবু।
চন্দ্রিমা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না? যে ছেলেকে ও প্রতিটা মুহূর্ত ভরসা দিয়ে আসল, প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসলো সে কিনা ওকে ঠকালো ? "
" বাড়ি চলো বাবা, কারোর প্রয়োজন নেই আমার, আমার সন্তান কে একাই বড় করতে পারবো। বাড়ি চলো।"
কথাগুলো বলে গগনবাবুকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল চন্দ্রিমা।
শতদ্রু বাবু মনে মনে হেসে বললেন,"যাক চন্দ্রিমা নিজেই সরে গেল আকাশের জীবন থেকে। এবার ওকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে অসুবিধা হবে না। ফিরুক একবার ও দেশে। তালুকদার মশাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে মোটা পণ পাওয়া যাবে।"
কোন দুরে সেই জার্মান প্রদেশের বুকে শুয়ে আকাশ জানতেও পারল না, তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনার আগেই তা অপমানিত হলো। সে তখন রাতের আকাশের চাঁদ দেখতে দেখতে দিন গুনছে, কবে সে চন্দ্রিমার কাছে ফিরতে পারবে, ফিরতে পারবে সেই ভালোবাসার কোলে।
তিন বছর পর , স্থান-শান্তিনিকেতন
"আঁখি, খাওয়ারটা খেয়ে নাও সোনা, জেদ করেনা, তুমি না আমার ভালো মেয়ে?" চন্দ্রিমা একটা বাচ্চা মেয়ের পিছনে ছুটছে আর কথাগুলো বলছে।
মেয়েটা সারা ঘর দৌড়চ্ছে আর বলে যাচ্ছে," কি মজা, কি মজা মামনি ধরতে পারে না, পারে না।"
চন্দ্রিমা এবারে হাঁপিয়ে ওঠে, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে ও।
"নাহ্ আঁখি তার মামনিকে একটুও ভালোবাসে না , মামনির একটা কথাও শোনেনা। মামনি খুব কষ্ট পেয়েছে।" কপট রাগ দেখিয়ে বলল চন্দ্রিমা।
আঁখি এবার গুটিগুটি পায়ে চন্দ্রিমার সামনে এসে দাঁড়ায়, ছোট্টো ছোট্টো দুটো হাত দিয়ে নিজের কান দুটো ধরে বলে,"ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না, ও মামনি, রাগ করেছো?"
এবারে হেসে ফেলে চন্দ্রিমা, মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ওর মুখে খাবারটা ঢুকিয়ে দিতে দিতে বলে ,"মামনি কি কখনও তার আঁখি সোনার উপর রাগ করে থাকতে পারে? কিন্তু আঁখি মামনির কথা না শুনলে মামনির যে ভালো লাগে না।"
"আমি তো শুনি গো তোমার সব কথা, তাহলে কেন তোমার খারাপ লাগে?"
একটু হেসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রিমা।
তিন বছর আগে প্রেগনেন্ট অবস্থায় শান্তিনিকেতনে চলে আসে চন্দ্রিমা। মা বাবা কাউকে সাথে আনেনি। ওনারা আসতে চাইলেও চন্দ্রিমা বলে ও একা সামলে নিতে পারবে।
শুধু ডেলিভারীর আগ দিয়ে সুলতা দেবী চলে আসেন। আঁখি হওয়ার পরও একবছর মতন ছিলেন। নাহলে চন্দ্রিমার পক্ষে চাকরি মেয়ে দুটো সামলানো মুশকিল হয়ে যেত।
কিন্তু সুলতা দেবীরও তো সংসার আছে। তাই ওনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় চন্দ্রিমা। গগনবাবু, সুলতা দেবী দুজনে প্রায় প্রায়ই আসেন মেয়ে , নাতনীকে দেখতে।
তবে এই তিন বছরে একবারও চন্দ্রিমা কলকাতায় ফেরেনি।
আঁখির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অতীতটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে চন্দ্রিমা, তাও ভুলতে পারে কই।
আঁখির চোখদুটো একদম আকাশের মতন, সেই ভাসা ভাসা নিটোল চাহনি।
আজও রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রিমা ভাবে,"এভাবে আমাদের সম্পর্কটাকে অপমান না করলেও পারতে আকাশ, আমি তো নিজেকে সামলে রেখেছি, কিন্তু আঁখি যখন বড় হবে, যখন জানতে চাইবে ওর বাবার পরিচয়, তখন কি বলব আমি?"
বিশ্বভারতীতে ভালো অধ্যাপিকা হিসেবে বেশ নাম আছে চন্দ্রিমার, গানটা শুধু ও ভালো গায় না, গানের প্রত্যেকটা কথার মানে সুন্দর করে বোঝায় ও। এটা ও আকাশের থেকেই শিখেছিলো।
চন্দ্রিমার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কৌতূহলের শেষ নেই, কিন্তু চন্দ্রিমার অমন ব্যক্তিত্ব দেখে ওরা আর প্রশ্ন করার সাহস পায়না।
এ তো গেল চন্দ্রিমার বর্তমান জীবনের কথা।
কিন্তু আকাশ ? সে কেমন আছে?
সে যে আজও অপেক্ষায় আছে, কখন সে তার চন্দ্রিমার কাছে ফিরবে।
"আচ্ছা চন্দ্রিমা কি এখনও আগের মতই আছে ? এখনও আমার কথা মনে পড়ে ওর? এখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কি আমাকে জাপটে ধরবে ওর কোলে?"
জাহাজের সামনে ডেকের উপর দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিল আকাশ।
এমন সময় একজন এসে বলল,"বাবু, জাহাজ এখনই বন্দরে নামবে।"
আজ তিনবছর বাদে কলকাতার বুকে পা রাখলো আকাশ , পা রাখলো তার সেই ভালোবাসার শহরে।
কিন্তু সেই শহরে তার ভালোবাসা যে আজ আর নেই।
বেলটা বেজে উঠতেই সুলতা দেবী রান্নাঘরের থেকে দৌড়ে আসেন। আঁচল দিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছতে মুছতে দরজাটা খোলেন।
খুলে অবাক হয়ে যান।
বাইরে আকাশ দাঁড়িয়ে।
আকাশ হাসিমুখে ঢুকে সুলতা দেবীকে প্রণাম করে, সুলতা দেবী তখনও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
"কে এসেছে?" গগনবাবু উপরের ঘর থেকে নীচে নেমে এলেন।
আকাশকে দেখে ওনার মাথা গরম হয়ে গেল।
"তুমি কেন এসেছো এখানে? কি চাও তুমি?" গগনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন।
আকাশ গগনবাবুর গলা শুনে একটু অবাক হলেও সামলে নিয়ে বলল,"আসলে মেসোমশাই আমি চন্দ্রা মানে চন্দ্রিমার সাথে দেখা করতে এসেছি, ও কি ঘরে আছে?"
"কোন মুখে তুমি ওর সাথে দেখা করতে এসেছো? চন্দ্রিমা এখানে থাকে না।"
"মানে?"
"দেখো আকাশ তোমার সাথে কথা বলার এতটুকু ইচ্ছে আমাদের নেই। তাই যা বলছি শোনো, বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ির থেকে।"
আকাশ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
গগনবাবু এবার ওর কাছে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ,"শুনতে পাচ্ছো না কি বলছি? বেড়িয়ে যাও!" বলে আকাশের মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
আকাশ পাথরের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
কি হল ও কিছুই বুঝতে পারছে না। চন্দ্রিমার বাড়ির লোক ওর সাথে এমন ব্যবহার কেন করল?
হঠাৎ খুব কান্না পায় আকাশের। এতদিন পর ফিরে যে ভালোবাসাটা ও আশা করেছিল সেটা তো পেলই না উল্টে অকারণে এতটা অপমান!
বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বাবার ঘরে আসলো আকাশ।
শতদ্রু বাবু ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কাজের কথা বললেন। আকাশের বসতে ভালো লাগছিল না , তাই মাথা ধরার দোহাই দিয়ে উঠে পড়লো।
"দাঁড়াও আকাশ।" জলদগম্ভীর স্বরে ডাকলেন শতদ্রু বাবু।
"তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। বিকেলে একবার ঘরে এসো।"
আকাশ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
চন্দ্রিমাকে একঝলক দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে ওর। কতকাল দেখা হয়নি দুজনের।
তাছাড়া মনে একটা আশংকাও জন্মেছে। চন্দ্রিমা ওকে ভুলে যায়নি তো? ওর মা বাবা তখন এমন ব্যবহার কেন করলেন ওর সাথে।
চন্দ্রিমার সাথে দেখা তো ওকে করতেই হবে।
কিন্তু কিভাবে দেখা করবে?
চন্দ্রিমা কি আদৌ জানে যে ও ফিরে এসেছে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আপন মনে গুনগুন করে উঠলো আকাশ,
"সখী ভাবনা কাহারে বলে?
সখী যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা,
সখী ভালোবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?"
কখন চোখটা লেগে এসেছিল খেয়াল হয়নি আকাশের, হঠাৎ দরজায় খটখট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে।
দরজাটা খুলে দেখে শতদ্রু বাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
"তোমাকে ঘরে আসতে বলেছিলাম, আসোনি কেন?"
"আসলে চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল।" আকাশ একটু ধীর গলায় বলল।
"ও, আচ্ছা যাই হোক। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।" বলতে বলতে ভিতরে ঢোকেন শতদ্রু বাবু।
"কি কথা?"
"দেখো বিয়ের বয়স তো তোমার হয়েই গেছে, তাই আমি আর দেরি করতে চাইনা, তালুকদার মশাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়েটা তোমার দিয়ে দিতে চাই।"
"বাবা আমি তো তোমাকে চন্দ্রিমার কথা বলেই ছিলাম। তারপরেও এইসব কথা উঠছে কোথার থেকে?"
হেসে ওঠেন শতদ্রু বাবু, বলেন,"হাহ্! চন্দ্রিমাকে বিয়ে করবে। ও কবেই নিজের মুখ পুড়িয়ে পালিয়েছে, আবাগীর বেটি! চরিত্রের তো ঠিকঠিকানা নেই, কোন একটা ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে পালিয়েছে দেখো।"
"বাবা! যাকে চেনোনা তার ব্যপারে এমন নীচ মন্তব্য কোরোনা।" আকাশ প্রতিবাদ করে ।
"দেখো তোমার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। আর তাছাড়া আমি যা বলছি জেনেশুনেই বলছি। আমি ওর সাথে কথা বলে দেখেছিলাম, ও নিজে মুখেই বলেছে, তোমার মতন মেয়েছেলের সাথে ও নাকি সংসার করতে পারবে না। চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো , তোমার চন্দ্রিমা এখানে থাকে কিনা?" বলে ঘরের থেকে বেড়িয়ে যান শতদ্রু বাবু।
আকাশের মনে পড়ে যায় গগনবাবু বলেছিলেন চন্দ্রিমা এখানে থাকে না।
তাহলে কি বাবার কথাই সত্যি? চন্দ্রিমা এখন আর ওকে চায়না?
কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে আকাশ। চন্দ্রিমা ওকে এমন ভাবে ঠকালো !
কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই শুয়ে পড়ে আকাশ।
চোখদুটো কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে গেছে আকাশের। তাহলে কি ভালোবাসা সত্যিই কেবল কষ্ট দেয়? যার সাথে দেখা করবে বলে তিনটে বছর ছটফট করে কাটিয়ে গেল সেই ওকে ছেড়ে চলে গেল?
পুরোনো কথা খুব মনে পড়ছে আজ আকাশের , চন্দ্রিমা সবসময় ওকে আগলে রাখতো, আকাশের মন খারাপ ও একটুও সহ্য করতে পারতো না।
গঙ্গার ঘাটে আকাশের মাথাটা নিজের কোলে শুইয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো চন্দ্রিমা। আকাশ কিছু নিয়ে চিন্তা করলেই ওর গালে হাত রেখে বলত,"চিন্তা কিসের? আমি তো আছিই।"
সেই চন্দ্রিমাই ওর হাতটা ছেড়ে চলে গেল?
"না না, আমি বিশ্বাস করিনা চন্দ্রা আমাকে ছেড়ে যেতে পারে। নিশ্চই কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।
বাবাকে বিশ্বাস করলে হবে না, ওই লোকটা কখনও আমার খুশি সহ্য করতে পারে না।" কথাগুলো বলে উঠে পড়লো আকাশ।
বাড়ির সদর দরজাটা খুলে বেড়িয়ে পড়ল।
চন্দ্রিমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার।
বেল বাজার সাথে সাথেই গগনবাবু দরজাটা খুললেন।
"একি? তুমি আবার?"
"মেসোমশাই আমার খুব দরকারী কিছু কথা আছে।"
"আমার নেই।"
"আপনি দয়া করে একবার আমার কথাটা শুনুন , বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করবনা আপনাদের।"
কিছুক্ষণ ভেবে গগনবাবু বললেন,"এসো , ভেতরে এসো।"
সুলতা দেবীও পিছন পিছন এসে দাঁড়িয়েছেন।
"চন্দ্রিমার সাথে যে আমার একটা সম্পর্ক আছে সেটা কি আপনারা জানেন?" আকাশ জিজ্ঞেস করল।
"আছে না , ছিল। সেই সম্পর্কের তুমি অপমান করেছো, আমার মেয়েকে তুমি অপমান করেছো।" সুলতা দেবী হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত করতে পারেন না।
"আমি অপমান করেছি মানে? আমি তো এতগুলো বছর শুধু চন্দ্রিমাকে পাবো বলে অপেক্ষা করেছি।" আকাশ একটু অবাক হয়ে বলল।
"অপেক্ষা করেছো? তাহলে তোমার বাবার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করার কথা দিয়ে গিয়েছিলে কেন? আমার মেয়েটাকে কত কি সহ্য করতে হয়েছে জানো?" গগনবাবু রেগে বলে ওঠেন।
"আমি বাবাকে কথা দিয়েছি মানেটা কি? আমি তো বাবাকে অনেক আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম চন্দ্রিমার কথা। কি বলছেন এসব আপনারা?" আকাশ এমন কথা শুনে ভীষন অবাক হয়েছে।
"তুমি কথা দাওনি?" বলে গগনবাবু সব ঘটনা সবিস্তারে বলেন আকাশকে।
আকাশ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। একদিকে বাবা হওয়ার আনন্দ আরেক দিকে চন্দ্রিমার ওকে ভুল বুঝে চলে যাওয়া।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আকাশ,"আমি জানতাম না কিচ্ছু, কিচ্ছু জানতাম না আমি। বিশ্বাস করুন, আমি যদি একবার জানতে পারতাম যে আমি বাবা হতে চলেছি, তাহলে তক্ষুনি দেশে ফিরে আসতাম আমি। আমি কাউকে বিয়ের কথা দিইনি। চন্দ্রিমা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিনা আমি, কাউকে না।"
গগনবাবু একটু থমকে যান । এতদিন ধরে একটা ভুল ধারণা মনে পোষন করেছেন ওনারা।
তাও আকাশকে জিজ্ঞেস করল,"তুমি সত্যিই কিছু জানতে না?"
আকাশ চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে।
সুলতা দেবীর এবার একটু মায়া হয় ছেলেটার উপর। আকাশের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বলেন,"কাঁদিস না বাবা, যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আমাদেরই ভুল, চন্দ্রিমা বলেছিল শতদ্রু বাবু কেমন মানুষ, আমাদের একবার যাচাই করে নেওয়া উচিত ছিল উনি কতটা সত্যি বলছেন।
কাঁদিস না, পারলে আমার মেয়েটার মান ভাঙা, ও আজও তোকেই ভালোবাসে রে। আর নিজের মেয়েটাকে দেখবিনা? জানিস পুরো তোর মতন দেখতে হয়েছে।"
আকাশ সুলতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল,"কি নাম রেখেছো গো আমার মেয়েটার?"
সুলতা দেবী হেসে বললেন ,"আঁখি।"
আকাশ গগনবাবুর পায়ের কাছে গিয়ে বসে বলল,"তোমার মেয়েকে আমি ঠিক ফিরিয়ে আনব দেখো।"
আকাশের উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না, আর ওর তো কোনো দোষই নেই, তাই গগনবাবুও পারলেন না।
হেসে বললেন,"ফিরিয়ে আনতে হবে না, ফিরিয়ে আনলে ও চাকরি করবে কি করে?এককাজ কর তুইও ওখানে থেকে যা, কেমন?"
আকাশ ও হেসে ফেলে।
তারপর বাড়ির দিকে পা বাড়ায় আকাশ।
অনেকদিন ভয় ভয় কাটিয়েছে ও, আর না, এবার শতদ্রু বন্দোপাধ্যায়ের মুখোমুখি ও হবেই।
বাড়িতে ঢুকে আকাশ সবার প্রথমে নিজের ঘরে যায়। নিজের যা যা জিনিসপত্র ছিল সব গুছিয়ে নিয়ে বাবার ঘরে যায়।
শতদ্রু বাবু সুটকেস হাতে আকাশকে দেখে বলেন,"আবার কোথায় যাচ্ছ?"
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,"আমাকে এতদিন খাওয়ানো পড়ানোর জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব, কিন্তু এবার আমার ভালোটা আমাকেই বুঝে নিতে দিন, ভালো থাকবেন। আমি চললাম আমার ভালো থাকাটাকে খুঁজে নিতে।"
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে বেড়িয়ে যায় আকাশ।
শতদ্রু বাবু তাকিয়ে থাকেন শুধু, তারপর,"মরুক গে " বলে নিজের কাজে মন দেন।
ছেলের প্রতি টান বা ভালোবাসা কোনোটাই ছিল না ওনার তাই বিষয়টা এত সহজেই মেনে নিলেন উনি।
"ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্যমন্দির মোর,
ঝঞ্ঝা ঘন গরজন্তি সন্ততি,
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া ।
কান্ত পাহুন , বিরহ দারুন,
সঘনে খরশর হান্তিয়া।
কুলিশ- শত- শত- পাত-মোদিত
ময়ুর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী,
ফাটি যাওত ছাতিয়া !
তিমির দিগ ভরি , ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া।।"
শান্তিনিকেতনের পোড়া মন্দিরের সামনে একটা মেয়ে ঝমঝম বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে গাইছে।
বৃষ্টির ফোঁটা মেয়েটার স্নিগ্ধ শরীরটাকে আরও স্নিগ্ধ করে তুলছে।
বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা ওর সারা শরীর ভেদ করে মনের গহীনে গিয়ে প্রবেশ করছে।
ভিজিয়ে দিচ্ছে ভেজা মনটাকে।
বৃষ্টির প্রেমে সিক্ত হয়ে উঠছে তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল।
কিন্তু হৃদয় মন্দির যে তার সত্যিই শূন্য।
সেই যে কোন এক কালে কার যেন ছোঁয়া পেয়েছিল, সেই ছোঁয়াই যে আজও লেগে রয়েছে তার সারা শরীরে সারা মনে।
আর কাউকে তার মনের মন্দিরে বসিয়ে পুজো করা যে তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মেয়েটা যে চন্দ্রিমা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
গানটা শেষ করে মন্দিরের সিঁড়ির উপর বসে পড়ে চন্দ্রিমা।
ওর মন খারাপ হলেই এই পোড়া মন্দিরে চলে আসে চন্দ্রিমা। ভালো লাগে। আজকেও এসেছিল কিন্তু আসা মাত্রই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল আর তার ফলে এই সঙ্গীতের মনমুগ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি।
আজকাল মনটা হঠাৎ হঠাৎই খারাপ হয় চন্দ্রিমার। কিছুই আর ভালো লাগেনা। মেয়েটার জন্যই বেঁচে থাকা ওর।
মন্দিরটার ভিতরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রিমা।
কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই মন্দিরটার ভিতরে।
আচ্ছা সব কিছুই কি কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এইভাবে, পড়ে থাকে শুধু ধ্বংসাবশেষ?
কথাটা ভাবতে থাকে চন্দ্রিমা।
এমন সময় পিছন থেকে এসে কেউ ডেকে ওঠে,
"চন্দ্রিমা!"
"চন্দ্রিমা"
ডাকটা শোনা মাত্র একটা শিহরণ খেলে গেল চন্দ্রিমার শরীরে।
পিছনে ফিরতেই, এ কাকে দেখছে চন্দ্রিমা? যার জন্য প্রত্যেকটা মুহূর্ত বিষাদময় হয়ে গেছে সেই মানুষটা আজ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কেন এসেছে ও? কি চায় কি? মনের ডুবন্ত জাহাজটাকে আরও অতলে ডোবাতে?
আকাশ চন্দ্রিমার হাতদুটো ধরে বলে,"আমি ফিরে এসেছি চন্দ্রা, তোমার কাছে তোমার জন্য।"
"কেন এসেছেন? আপনার হবু স্ত্রী বুঝি পালিয়েছে? তাই আবার আমার প্রয়োজন পড়েছে?" শান্ত কন্ঠে কথাটা বলল চন্দ্রিমা।
"আমি অন্য কারোর কখন হইনি চন্দ্রা, আমি শুধু তোমারই ছিলাম , আছি আর থাকব।" আকাশ আকুতি ভরা গলায় কথাগুলো বলে।
"তাহলে কেন ছেড়ে গিয়েছিলে তুমি? আর তোমার বাবার বলা ওই কথাগুলো? সবটা নিশ্চই মিথ্যে নয়।"
"তুমি তো জানোই চন্দ্রা কেন গিয়েছিলাম আমি বিদেশে, তুমিই তো পাঠিয়েছিলে। আর বাবা যা যা বলেছে তোমায়, সবটাই মিথ্যে চন্দ্রা, আমি এসবের কিছুই জানতাম না, আমি যদি একবার জানতে পারতাম যে আমি বাবা হতে চলেছি তাহলে কখনোই ওই বিদেশে আমি পড়ে থাকতাম না। বিশ্বাস করো ।" গলাটা ধরে আসে আকাশের।
হেসে ফেলে চন্দ্রা,"বিশ্বাস? ওই বিশ্বাস শব্দটার প্রতিই যে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।" চন্দ্রিমা ভাবলেশহীন গলায় বলল।
"কি দিয়ে বোঝাই বলতো তোমায় চন্দ্রা? তোমার মনে হয় তোমার আকাশ তোমায় ঠকাতে পারে?"
"জানি না, আমি সত্যিই কিছু জানি না। আমার মেয়েটা বাড়িতে অপেক্ষা করছে আমার জন্য, আমায় যেতে হবে।"
"শুধুই তোমার মেয়ে চন্দ্রা? ও তো আমারও মেয়ে। আঁখি আমাদের মেয়ে চন্দ্রা।"
"তাই তোমার মেয়ে? তাহলে কোথায় ছিলে তুমি ও হবার বেলায়? এই তিনটে বছর যখন সমাজের সাথে ক্রমাগত লড়াই করে ওকে বড় করেছি তখন কোথায় ছিলে তুমি, কোথায় ছিলো তোমার ভালোবাসা?" চিৎকার করে ওঠে চন্দ্রিমা।
"আমি তো বলছি আমি জানতাম না, একটু বিশ্বাস করে দেখো আমায়,প্লিজ?" বলতে বলতে এতক্ষন আটকে রাখা জলটা বের হয়ে এলো আকাশের চোখ থেকে।
এই একটা জিনিস চন্দ্রিমা একদম সহ্য করতে পারে না, আকাশের চোখের জল। এইটা ওর মনটাকে নরম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আস্তে আস্তে হাতদুটো এগিয়ে যায় আকাশের গালের দিকে, আবার যত্ন করে মুছিয়ে দেয় ওর চোখদুটো। ঠিক যেমনটা তিনবছর আগে করেছিল গঙ্গার ঘাটে।
আকাশ এতবছর পর চন্দ্রিমার স্পর্শ পেয়ে সামলাতে পারেনা নিজেকে। জড়িয়ে ধরে চন্দ্রিমাকে।
এরপর বাচ্চাদের মতন মুখ করে বলে,"আর আমার উপর রেগে নেই তো?"
হেসে ফেলে চন্দ্রিমা, "হ্যাঁ রে? তুই বড় হবিনা তাই না?" বলে টুপ করে একটা হামি খেয়ে দেয় আকাশের গালে।
"আমার মেয়ের সাথে দেখা করাবে না?"
আকাশ জিজ্ঞেস করে।
"করাবো তো ।" চন্দ্রিমা হেসে বলে ।
বাড়ির দিকে পা বাড়ায় দুজনে।
"আঁখি, সোনা এত ছোটাছুটি করে না, পড়ে যাবি তো।" চন্দ্রিমা আঁখিকে ডাক দিলো।
"আহ্ মামনি, আমার এখন কত কাজ আছে বলো তো, ডেকোনা এখন আমায়।" বড়দের মতন কথাটা বলে আবার ফুলের ডালিটা হাতে ছুটে গেল আঁখি।
হেসে ফেলে চন্দ্রিমা, "পাকাবুড়ি একটা।"
আজ চন্দ্রিমা আর আকাশের বিয়ে। তবে আত্মীয় স্বজনদের ডাকেনি। সাধারণ কোর্ট ম্যারেজ করছে। শুধু কলকাতা থেকে চন্দ্রিমার মা বাবা এসেছেন।
আকাশ আর চন্দ্রিমার বক্তব্য, অত আড়ম্বরের কি প্রয়োজন? মন দুটো তো সেই কবেই এক হয়ে গেছে, সেটাকে এবার শুধু সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া। তার জন্য লোকজনের সমাগমের কি দরকার?
আঁখি আজ ভীষন ব্যস্ত, তার মামনি আর বাবাই এর বিয়ে বলে কথা।
আঁখি আর আকাশের সম্পর্কটা এখন একদম সহজ হয়ে গেছে । আঁখি প্রথমে আকাশের কাছে ঘেঁষতে একটু অস্বস্তি বোধ করতো কিন্তু আকাশই সম্পর্কটা সহজ করে নিয়েছে।
একে একে আংটি পড়ানো , মালাবদল আর সিঁদুর দান হয়ে গেল। চন্দ্রিমা আর আকাশের সম্পর্কটা সামাজিক স্বীকৃতি পেলো।
আজ চন্দ্রিমা আর আকাশের ফুলসজ্জা। আঁখি অনেক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সুলতা দেবী বলেছিলেন আঁখিকে নিজের ঘরে নিয়ে যাবেন, কিন্তু চন্দ্রিমাই না করে দেয়।
আকাশ মুচকি হেসে বলে, "নতুন করে আর কি ফুলসজ্জা করব মা? কোনো এক কালের ফুলসজ্জার ফসলই তো আঁখি।"
সুলতা দেবী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন,"চুপ কর! নির্লজ্জ ছেলে একটা।"
এই বলে বেড়িয়ে যান তিনি ঘর থেকে।
সুলতা দেবী আর আকাশের মধ্যে এখন একটা মা ছেলের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। গগনবাবুও বড় ভালোবাসেন এই ছেলেটাকে।
ছেলেটা এত মায়াকাড়া যে ভালো না বেসে থাকা যায়না।
আকাশও এতদিনে একটা সুন্দর পরিবার পেয়েছে।
পরের মাস থেকে আকাশও বিশ্বভারতী জয়েন করবে, ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশনটা কনসিডার করা হয়েছে।
দরজাটা বন্ধ করে দেয় আকাশ।
তারপর আলোটা নিভিয়ে চন্দ্রিমার কাছে যায়।
আস্তে আস্তে চন্দ্রিমার কোলে নিজের মাথাটা রাখে।
কতবছর পরে সেই শান্তির কোলটায় ফিরতে পেরেছে আকাশ, যেখানে কেউ ওকে জাজ করবে না।
চন্দ্রিমা আকাশের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দেয়।
অগোছালো জীবনটা আবার ছন্দে ফিরেছে ওদের। দুটো হৃদয় আজ পুরোপুরি পূর্ণতা পেলো।
অন্ধকার ঘরে, চাঁদের আলো এক অদ্ভুত মায়াজালের সৃষ্টি করছে। দুর থেকে ভেসে আসছে,
"ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো- তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো - তোমার
চরণমঞ্জীরে ।।"
-সমাপ্ত-
কলমে-আশালতা