মেধার দৈন্যতা
মেধার দৈন্যতা
অঢেল টাকা ,উচ্চ শিক্ষা, ভালো বেতন,সচ্ছলতা সব সময়ই সে সুখ শান্তি আর মানসিক পরিতৃপ্তির কারণ তা নয়।উপভোগ বলতে বড় অট্টালিকা, গৃহে এ সি, দামী ব্যান্ডের গাড়ি ,দেশ বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ হয়ত সচ্ছল ছাড়া সম্ভব নয় ! কিন্ত বাহ্যিক উপভোগ সব সময়ই মানসিক প্রশান্তি তৃপ্তির কারণ নয়।সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রান্ত শেষে রাতে আদি অকৃত্রিম সম্ভোগে সনৎ অদিতিরা ছিল চরম সুখী পরিতৃপ্ত।
সনৎ সামান্য দরিদ্র ঘরের সন্তান, বলিষ্ঠ শরীর মেধা থাকলেও পারিবারিক দারিদ্র্যতার কারনে মাধ্যমিক পড়াশোনার গন্ডিও অতিক্রম করেনি। তখন ষোল কি সতের বছর বয়স, গ্রামের ছেলে তার মামা বর্ধমানে এক মারোয়ারী ব্যবসায় ঢুকিয়ে দেয়। ঐ মালিকের মামা দীর্ঘ দিনের বিশ্বাসী অনুগত কর্মচারী, তাই তার সুপারিশে সনৎ কাজ পায়।
তার সচ্ছলতা নেই, কোন মত ভাড়া ঘরে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে থাকে, অভাব ছিল না।কিন্ত সে মস্ত সুখী অন্তত তার মনে হয়।বয়স এখন তার আটাশ, বাইশ তেইশ বছরে সেই কবে তার অদিতির সাথে বিয়ে হয়েছিল। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সরল গ্রাম্য অদিতির তখন আঠারো বছরের।পড়াশোনার দৌড় তার অষ্টম শ্রেণী,তবে চালাক বুদ্ধিমতী, চাপা ফর্সা, আকর্ষণী মুখমন্ডল, মেদহীন নিরোগ সুস্থ সবল দেহ।আজও সে দুই সন্তানের মা হয়ে শারীরিক মেয়েলী গড়নে এখনও যে কোন বিজ্ঞাপনের রঙিন জগতের মডেলকে ভ্যাবাচাকা খাইয়ে দেবে।
তবে সে তো মেঘে ঢাকা চাঁদ বা গভীর ঘন জঙ্গলে এক নাম না জানা বিচিত্র রঙিন সুবাসে সিক্ত সুন্দর বনফুল! অদেখা পরিবেশে অজ্ঞাত। তাই, না কবিতায় কবি তার বর্ননায়, ইনিয়ে বিনিয়ে তার রূপ রস গন্ধ বর্নের কথা পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলবেন, বা কোন মালী তা তুলে দেবতার পূজার উপকরণ করে বা ধনীর গৃহে একদিনের শোভা বর্ধনে জন্য উচ্চ মুল্যে তাদের সওদা বাজারে হাজির করবে না! আর ধন কুবেরের রঙিন ফ্যশন শোয়ে প্রায় নগ্না সল্পবসনায় ছমকে হেঁটে সে তো হাজার পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তুলবে না ! সবটাই জগতটা আজ বানিজ্যিক ও কৃত্রিমতায় ভরা।
নিভৃতে নীরবে গভীর গহনের ফুল। সনৎ যেন এক ভাগ্যবান মধুমক্ষী, প্রতি রাতে তার মধু আহরণে কান্ত শরীরে মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত কোরে অজানা এক স্বর্গীয় সুবাসে তার উপর মদির মাদকতায় ঢলে পড়ত।আর, অদিতি তার পরাগে ধন্য ,দুই অমৃত ফল যেন, এক চার বছরের কন্যা, আর এক দুই বছরের পুত্রের মা হয়ে সে পরম তৃপ্ত। স্বামীর সোহাগে সোহাগিনী।
দরিদ্র স্বামীর কাছ থেকে তার কোন চাহিদা নেই,দুই ফুটফুটে সন্তান নিয়েই সে সারাটা দিন ব্যস্ত। দরিদ্র ঘরের ছাইচাপা আগুন রূপে কেউ হাত লাগাতে এলে তীব্র দহন ছাড়া কিছুই মিলবে না। কিন্ত দুর থেকে শীতল অতৃপ্ত প্রেমহীন কামুক মনে যদি কিছু উত্তাপ কেউ নিতে চাইত সে আরাম পেতো।
রাতে যতই মধুমক্ষী অফুরন্ত লাস্যময়ী জায়ার রূপ যৌবন প্রেমে ডুবে থাক।অবশ শরীরে মাতাল হোক, দিনে তার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। সে এখন মারোয়ারীর মার্বেল দোকানে কাজ করে।মালিক বেশ ধনী মনটাও বড়। বেতন ছাড়াও অন্যান্য অনুসাঙ্গিক আয় ছিল, আর বার্ষিক বোনাস। সনৎ সাইকেল শহরের এপ্রান্ত ও প্রান্ত যেতে হত মালিকের কাজে । মার্বেল দোকানটি শহরের পূর্ব প্রান্তে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খোলা প্রাঙ্গন আর গোডাউনে কত শত কোটির মার্বেল টাইইলস্ তার হিসাব রাখা মালিকেরও মনে হয় ছিল অজানা ।
শহরের বনেদী দোকান । সব দামে সব মানের মার্বেল টালী তুলসীমঞ্চ, ঠাকুরের ছোট মন্দির অবধি অর্ডার মত বানিয়ে হোম ডেলীভারী করত। আর মোটর ভ্যান হোক বা সাইকেল ভ্যানের মাল পরিবহণে সাথে সনৎ তার সঙ্গী। তার সততা আর ব্যবহার মালিকের কাছে অন্য আদর ইজ্জত পেতো। ক্রেতাদের মনোরঞ্জন বিক্রেতার মুলধন। ধনী আগ্রওয়াল বাবুর সময় নেই, তার আরও অনেক ব্যবসা ,কারখানা।দামী ব্যান্ডের এ সি গাড়ীতে সে সখে নয়, কলকাতা দুর্গাপুর মাঝে মধ্যেই ছুটত জরুরী কাজে। উকিল ,চ্যটার, আর বিশ্বাসী পার্টনার ,দালাল নিয়ে তার কারবার।এই তুচ্ছ মার্বেল দোকান নিয়ে তার ভাববার সময়ই নেই।
ব্যবসায়ী তুখোড় চালাক আগ্রওয়ালবাবু,মানুষ দেখে আর তার ব্যবহার আচরণে বুঝে নিতেন সততা আর বিশ্বাস যোগ্যতা। আর তাতে উত্তীর্ণ হলে তবেই পাকা চাকরী। তবে বেতন নিয়ম মাফিক বাজার অনুসারে, সৎ কর্মচারীদের অন্যান্য ভাবে পুষিয়ে দিতেন ।
সনৎ দুপুরে তিন ঘন্টার ছাড় পেতো,স্নান খাওয়া তারপর একটু বিছানায় গড়িয়ে নিতো। নিজের একান্ত সম্পদ যখন তখন ব্যবহারে তার পছন্দের নয় । আর অদিতির ও ,স্বল্প সময়ের টি টোয়েনটি নয়,রাতের দীর্ঘ সময়ের টেষ্ট ম্যাচ, তারও পছন্দ। যাকে বলে মানিক জোড়। মানসিক ও শারীরিক ক্ষুধা চাহিদা পরস্পরের পরিপূরক।
সেদিন ইছলাবাদের এক ধনীর গৃহে মার্বেল ডেলীভারী ভ্যানের সাথে সনৎ সাইকেলে এসেছিল। সব কিছু মালের হিসাব বুঝিয়ে, কিছু বাকী টাকা গৃহ মালিকের কাছে বুঝে নিয়ে সনৎ দোকানে ফিরছিল।হঠাৎই তার নজরে এল পথের ধারে এক ট্যাপকলে আশোক জল ভরছে। সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করে "আশোক তুই এখানে?"
আশোক একটু থতমত খেয়ে বলে "আমি তো অনেক দিন এখানেই থাকি!"
"তুই এখানে বাড়ি করেছিস!"
"পাগল! ভাড়া ঘরে থাকি।"
"তুই বিয়ে থা করেছিস!"
"সবার ভাগ্যে ভাই সব কিছু জোটে না," এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশোক আর কিছু কথা বলে না। সামনের এক বস্তির দিকে সে অগ্রসর হল।
"সনৎ বলে তোর শরীরটা একদম ভেঙ্গে গেছে।"
আশোক একটু দুর থেকে বলে, "শরীর থাকলে ভাই কখনও ভাঙ্গবে কখনও গড়বে। আর না থাকলে কোন জ্বালা নেই।"
আশোকের কথায় কেমন উদাস আর হতাশার ইঙ্গিত, সনতের সাথে টাকা আছে।মালিকের টাকা ,বেশী দেরী করা ঠিক নয় । তবু আশোক কে অনুসরণ করে দেখল সে একটা অতি নিন্ম মানের দরমা ঘেড়া টালীর ঘরে ঢুকল। সনৎ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
তাদের ছোট গ্রামে ছোট বিদ্যালয়ে ক্লাসে ত্রিশ জন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আশোক ফাস্ট হত।সেই ফাইভ থেকে টেন অবধি।মাধ্যমিক পাশ না করতে পারায় দরিদ্র ঘরের সনৎ কে তার মামা সংসারের ভার কমাতে বর্ধমানে তার মারোয়ারীর মালিকের ব্যবসায় ঢুকিয়ে ছিল ।তখন মার্বেল নয়,কাপড়ের দোকানে দুবছর ছিল, বয়স ষোল সতের।
আশোক ফাস্ট ভিভিশনে পাস করে, গ্রামের স্কুল সেরা। বর্ধমান রাজ কলেজে সায়েন্স নিয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়।গ্রামের বিদ্যালয়ে তখন দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল না।কলেজে সেই সময়ে দ্বাদশ শ্রেণী পড়াশোনার অনুমোদন ছিল। বর্ধমানের নামী স্কুলের সাথে সাথে অনেকেই কলেজে দ্বাদশ শ্রেণী পড়ত, এই কলেজে অনার্স পড়ার সুবিধা হয়ত তাতে বাড়বে এমন ধারনা করত। অশোকের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক বাবা তাই ভেবেছিলেন।
অশোকের দ্বাদশ শ্রেণীর ফল খুব ভালো একটা হল না। কলেজের শিক্ষকদের কাছে গ্রাম থেকে এসে প্রাইভেট টিউশন পড়া সম্ভব ছিল না।সে সময়ে স্কুল কলেজের হাতে দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষায়, ইন্টারন্যাল মার্ক্স আর সায়েন্স বিষয়ে প্রাকটিক্যাল নম্বর, আশোক বেশ কম পেলো। অন্য অনেক শহরের বন্ধু লিখিত পরীক্ষায় কম কিন্ত, প্রাকটিক্যাল আর ইন্টারন্যাল নম্বর এতটাই বেশী সে চমকে গেল।কিছু নম্বর জন্য অনার্স পেলো না। এর পরে ব্যাকডোরে অনেকেই কিছুদিনের মধ্যে অনার্স পেলো।গ্রামের অজানা অচেনা আশোক পাস কোর্সে বি এস সি পাস কোরে, যেন সে কোন অপরাধ করেছে।
কোন কাছাকাছি বি এড কলেজের পড়াশোনার সুযোগ পেলো না ।বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ তখন পেপারে বিজ্ঞাপন দিতো ,স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ষোল আনা ক্ষমতা। সন্দেশখালী, পাথরপ্রতিমা বান্দোয়ান থেকে মানবাজার কত দরখাস্ত করল! একটা ইন্টারভিউ কল অবধি পেলো না। পাটির ক্যাডার,বা বাবার অঢেল টাকা স্কুলকে ডনেশনের নামে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেক্রেটারি অনেক ক্ষেত্রেই পকেট ভরাত বা কোন ম্যানেজিং কমিটির বা কোন প্রভাবশালী স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতার মেয়েকে বিয়ে করলে অনেক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরী হত।
হতভাগা অশোকের কোন সুযোগটাই পেলো না।
সরকারী চাকরীর যা বাজার, মাঝে মাঝে কেন্দ্র তখন সরকারের চাকরী নিয়োগে এমবার্গো , রাজ্যে সীমিত চাকরীর প্রতিযোগিতা জন্য তার পড়াশোনার সময় কম ,উন্নত মানের বই কোচিং দুরে থাক সুস্থ পরিবেশ ছিল না।
বাড়িতে তার বাবা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে প্রায় নিঃস্ব বরং দিদি জামাই বাবুর কাছে অনেক সাহায্য পায়। সে বেকার বর্ধমানে প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে যা আয় নিজের খরচ চালিয়ে বাবা মায়ের কোন উপকারে এল না। বাবার মৃত্যুর পর ,দিদি জামাই বাবুর কাছে মা চলে যায়। বাড়িঘর ডগ্নদশা ।জামাইবাবু রেল ড্রাইভার মা থাকলে নাইট ডিউটি কালে দিদির সুবিধা। মায়ের সামান্য পেনশন তারাই ভোগ করত।
সে ইছলাবাদে থাকছে, প্রায় একবছর,নিরিবিলি কম ভাড়া রাতে প্রতিযোগিতার পড়াশোনার করত আর সকাল সন্ধ্যার বস্তির কিছু ছেলে মেয়েদের পড়াত। স্কুলের শিক্ষক নয়, তেমন যোগাযোগ নেই, ডিগ্রি মামুলি, প্রাইভেট টিউশন বাজার ভালোছিল না।ভেবেছিল যদি নিলিবিলি পরিবেশে পড়াশোনা করে একটা সামান্য সরকারী চাকরী পায়। রান্নাবান্না করত না। স্থানীয় এক হোটেলই নিয়মিত খেত।
সনৎ, সরাসরি আশোকের ঘরে ঢুকে যায়।ক্লাসে সেরা ছাত্রের কী দশা! এক সময় অশোকদের সচ্ছলতা ছিল। দু ভাইবোন বাবা শিক্ষক কিছু প্রাইভেট টিউশন করতেন। বেশ ছিল আশোকে বাল্য আর কৈশোর জীবন। সনৎ বরং দারিদ্র্যতায় বাল্য কৈশোর কেটেছে, ক্ষুদ্র চাষী বাবার আট ভাই বোনের অভাবী সংসার। মনে মনে ভাবছিল সত্যি ! কথায় বলে মানুষ আপন ভাগ্যে খায়।
অশোক লজ্জা পাচ্ছে, সনতের কাছ থেকে সে যেন তার বিষয়ে ব্যক্তিগত প্রশ্ন বান থেকে রেহাই চায়। প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল, "তুই কেমন আছিস শুনেছি বিয়ে থা করেছিস। "
"সে তো বহু পুরোন খবর, হাফ যুগ হয়ে গেল, আমার দুই সন্তান। এক মেয়ে এক ছেলে, আর আমার বৌ ওর তুলনা হয় না। আমি সত্যি সুখী।কিন্ত তোর "
আশোক থামিয়ে বলে"আমার কোন সমস্যাই নেই ,এই তো অনেক সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছি,দরখাস্ত করেছি, আবার করব। চাকরী একটা পাবো, তখন তোকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াব। আমার কথা ছাড় তোর কথা বল।"
"আমি তো ভালো আছি,যদিও সরকারী কাজ নয়, তবে আমার মালিক ভীষণ ভালো , সংসারে খাওয়া পরার কোন অসুবিধা নেই। "
"ঠিক কথা,তবে তোর বিরাট দ্বায়িত্ব, দুই সন্তানের তুই বাবা,তাদের ভবিষ্যত, আর তোর উপর তোর স্ত্রী নির্ভর করে। সাবধানে থাকবি। রাস্তা ঘাটের যা হাল।"
"তুই বিয়ে থা চাকরী পেলে করবি!"
"রাখ তো ওসব কথা, গাছে কাঁঠাল তো নয়,ইচর আর গোঁফে তেল! তুই ভাই ভাগ্যবান সংসার করেছিস, আমাকে বিয়ে করতেই হবে এমন তো নয়!"
"আমি কী করছি তুই জানিস! সামান্য মারোয়ারীর এক মার্বেল দোকানের কাজ, তবু তো সাহস করে সংসার করছি।"
"দেখ ভাই তুই কী করছিস কেন করেছিস এসব আমার জানা বা জিজ্ঞেস করা উচিত নয়,তোর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর আমার ব্যপারে তুই এত সব ভাবছিস কেন!মালিকের কাজ কামাই হলে তোরও তো সমস্যা হবে!"
সনৎ শিক্ষিত না হোক বুদ্ধিধরে, আশোক তাকে যে এড়িয়ে যাচ্ছে বেশ বোঝে। ভদ্র তাই ইঙ্গিত আকারে বুঝাচ্ছে। তারও দেরি হয়ে যাচ্ছিল তাই"ভালো থাকিস ভাই " বলে সেদিন সনৎ বিদায় নিল।এরপর সনৎ আর বহুদিন আসে নেই । এদিকে কোন কাজ ও ছিল না।রাত আটটার পর সে বাড়ি ফেরে। উল্লাস নগরীর নিকট বাইপাসের কাছে তাদের মালিকের মার্বেলের দোকান গোডাউন। সনৎ থাকে বীরহাটার কাছে এক ভাড়া বাড়িতে, দুই কুঠারি পাকা ঘর ,নিজস্ব বাথরুম টয়লেট।
আশোক সে বস্তিতে থাকে ,জিটি রোড থেকে বেশ কিছু দুরেই। কিন্ত সনৎ এর যাতায়াত পথে জিটি রোডের মাঝেই পড়ে।হঠাৎ সেদিন সনৎ আশোকের বস্তির ছোট ঘরে গেল। প্রায় তিনমাস পর।আশোক ঘরের ছোট অপরিছন্ন তক্তাপোষে শুয়ে, ঘরে মৃদু আলো।
আশোক বলে ডাকতেই কেমন উদভ্রান্ত হয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসল, তার পর বলে "অ আশোক তুই!" কেমন যেন বিষন্নতা গলায়।
আশোক আগের চেয়েও আরও কেমন দুর্বল ক্লান্ত অবসন্ন। গলার স্বর দুর্বল, মুখচোখে কেমন অসুস্থতার লক্ষন ফুটে উঠছে।
সনৎ কিছু আবেগ ঘন স্বরে বলে "তোকে এ কী দেখছি! তোর কী শরীর খারাপ! "
"হয়ত হবে! তুই এ ঘরে থাকিস না। আমার তো কোন সংক্রমণ রোগও হতে পারে। তোর দুটো বাচ্চা আছে তাদের ক্ষতি হতে পারে।"
আশোক কেমন যেন হাঁপাচ্ছিল, মাঝে মাঝে চোখ বুজছিল, চোখ দুটো ছল ছল করছে।
"তোর কি জ্বর অলোক!"
"আশোক হাত নেড়ে জানায়, না কোন জ্বর নেই ,আমি ঠিক আছি,তুই যা,বাড়ি যা। আর আসিস না।"
"সনতের চোখে জল, বলে,"আমার কথা থাক,তোর কথা ভাব!"
"হতভাগা আমার কে আছে! আমি বাঁচি আর মরি কার কী ক্ষতি! আমার কথা ছাড়, তুই দুর হ, তোর কিছু হলে আমার পাপ লাগবে। তোর জীবনের ভীষণ দাম।গোটা সংসার তো উপরে ভরসা করে। তুই পালা।"
সনৎ নীরবে কাঁদছিল, আদ্র গলায় বলে "ডাক্তার দেখিয়েছিস!"
অশোক কোন উত্তর দেয় না।
"আমি ডাক্তার ডাকব!"
এবার রীতিমত মেজাজ হারিয়ে আশোক বলে,"ভারী তো এক মারোয়ারীর দোকানে কাজ করিস! টাকার গরম দেখাচ্ছিস! নিজের চরকায় তেল দে। আমার তুই কেউ নয়।আমার কথা এত ভাববার তোর দরকার নেই। "
বলতে বলতে আশোক খুব ক্লান্ত হাঁপাচ্ছিল।
সনৎ ভাবছিল, অশোক কে সে কষ্টই দিচ্ছে। এবার ভাড়া বাড়ীর মালিকের ঘরে গেল।মালিক ছিল না,তার আটো আছে ,চালিয়ে আসতে আরও রাত হয়।মালিকের স্ত্রী বের হয়ে বলল," মাস দুই আগে থেকেই উনি অসুস্থ, প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করেছিলেন, কোন আয় উপার্জন নেই, যা কিছু সামান্য সঞ্চয় ছিল,তাই ভাঙ্গিয়ে চলছে। আমাদের ঘর ভাড়া দুমাস বাকী, আমরা চাই না। আর্থিক কষ্টে আছে শরীরও ভালো নেই মনে হয়।"
"ডাক্তার দেখিয়েছ!"
"এটা বলা মুশকিল, উনি তো সকাল সন্ধ্যা দুবেলা বাজারের হোটেল থেকে খেয়ে আসেন। ওষুধ ট্যাবলেট আনে নিশ্চয়ই। "
সনৎ ভাবল এরা উদাসীন, বাড়ির ভাড়া না নিয়ে ওরা বিরাট দায়িত্ব পালন করছে। সনৎ হোটেল থেকে খেয়ে আসে, হাঁটাহাটি করে একটু ভালো খবর। কিন্ত পেটের বড় জ্বালা, তাই কত কষ্টে এ কদিন অশোক নিকট বাজারের হোটেল থেকে সে খেয়ে আসছে।স্বাভাবিক হেঁটে যেটা তার তিন মিনিট লাগত এখন দুর্বল ক্লান্ত কাহিল শরীরে দশ মিনিটের বেশী লাগে। মাথা ঘোরে মাঝে চলার পথে দাঁড়িয়ে থাকে,চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এদিন সন্ধ্যায় সে হোটেল যায়নি, এক কেজি একটা মুড়ির প্যাকেট আর আড়াইশো চিনি,কিনে এনেছিল।তার হাতের টাকাও প্রায় শেষ।শরীরটাও আর তার সাথ দিচ্ছিল না। বাকী কটা দিন,ভাবে মুড়ি চিনি খেয়েই চলাবে। তারপর কী হবে ভাবতে চায় না।
স্বার্থপর আত্ম কেন্দ্রিক মানুষ এসব নজর করে না। সমাজে থেকেও কতজন আর আজ সামাজিক !
সনৎ ভাবছিল,তার সামান্য আর্থিক সংগতি, কী রোগ ! চিকিৎসার কত খরচ কিছুই জানে না! আবার সত্যি যদি সংক্রমণ হয়, তার বা বাড়ির সবার বিপদ হতে পারে। অশোক যা কিছুই মেজাজ হারিয়ে বলুক তার ভালো জন্য। সমাজ সংসারে ঘা খেয়ে খেয়ে ও আজ বীতশ্রদ্ধ ,বিরক্ত, সব কিছুই অসহ্য। তাই বলে কী সে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে!
বাড়িতে গিয়ে সনৎ সব পোষাক ডেটল আর গরম জলে শুদ্ধ করল,নিজে রাতে সাবান দিয়ে মাথা অবধি স্নান করল , চৈত্র মাস গরম ছিল, কষ্টের কিছু নয়।
অদিতি এসবের কারণ জিজ্ঞেস করলে সনৎ সংক্ষেপে বলল। অদিতি তাকে সতর্ক করল,এভাবে তোমার যাওয়া মোটেও ঠিক হয়নি । উনি বিচক্ষন শিক্ষিত মানুষ ঠিক বলেছেন। আর উনার কি হয়েছে উনি নিশ্চয়ই জানেন। হয়ত কোন সংক্রমণ রোগ!
সনতের বাল্য বন্ধু,কত তাকে পড়াশোনায় সাহায্য করত, বই দিয়েও সাহায্য করত, সে পাস করেনি,সেটা তার ব্যর্থতা।কিছুতেই সে অশোককে ভুলতে পারছিল না। সে জানে, তাকে আর্থিক সাহায্য সে করতে পারবে না,তবু একটু ভালোবাসা, কাছে থাকা, সহানুভূতি সে কী দিতে পারে না!
কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অদিতির ভয় আপত্তি সন্তানের জন্য যুক্তি আছে।তবু তার আর মন কোন যুক্তি মানছিল না।
দোকান থেকে ফেরার পথে দুদিন পর আশোকের ঘরে গেল। আশোক এদিন ঠিক উল্টো তার গলার স্বর শুনতে পেয়ে কেমন ব্যাকুল," সনৎ ভাই, তুই এসেছিস! সেদিন যা বলেছি তার জন্য ক্ষমা করে দে।"
হামাগুড়ির মত তক্তাপোষে বসে সে এদিন ওদিক কেমন উদভ্রান্ত চোখে তাকাচ্ছে, সারা মুখচোখ ভয়ে বিবর্ণ।
সনৎ বলে"আশোক তোর কী হল,অমন কী দেখছিস!"
"ওরা আসছে,আমাকে ছাড়বে না,কি বীভৎস আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, তুই এলি ওরা গা ঢাকা দিয়েছে ,তুই না থাকলে আমাকে মেরেই ফেলবে।"
সনতের এবার বেশ ভয় করছিল, কী সব আশোক বলছে! ভুল দেখছে! না ভুল বকছে ! না সত্যি কিছু! ওর কী মরন শিহরে! ঘরটা কেমন থতমতে, যেন কারও উপস্থিতি! মাঝে মাঝেই কিছু যেন আবছা ছায়া চোখে ফুটে উঠছে ,কিন্ত কী তার রহস্য, তার অয়ব সনতের বোধগম্য নয়। আশোক তাকে ঘরের ভিতরে আসতে আকুতি মিনতি করে ডাকছে।
সনতের ঘরে ঢুকতে কেমন গা বাজছে, ভীষন ভয় করছে। দরজার সামনেই সে দাঁড়িয়ে।সনতের মনে হয় এটা কোন সমাধান নয়।ডাক্তার ডেকে আনি,দরকারে হাসপাতালে ভর্তি করব।
এবিষয়ে বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলা দরকার।
সনৎ যখন দরজা সামনে থেকে বাড়ির মালিকের ঘরে যাচ্ছে , আশোক শিশুর মত কান্নায় কোকিয়ে ওঠে,ধরা গলায় অসহায় ব্যাকুল হয়ে বলে,"তুইও পালাচ্ছিস !"
সনতের কথায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী আজ সহমত হলেন। এমন কথাও বললেন, "যদি গাড়ি ভাড়া করে হাসপাতাল নিয়ে যান,ভাড়ার খরচ আমরা দেবো। আপনি ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করুন। "
হন্তদন্ত সনৎ স্থানীয় বাজারে এক ওষুধের দোকান একটু পরিচিত ছিল। রাত তখন নটা। তার পরিচিত দোকানে পাশেই এক ডাক্তার বাবু বসেন, তিনি তখন রোগী দেখছিলেন। তার নির্ধারিত ভিজিট ফি দিতে সনৎ সম্মত হলে,ডাক্তার বাবু আশোককে দেখতে রাজি, কিন্ত তার কাছে আসা অপেক্ষারত সব রোগী দেখা শেষ হলে তবেই যাবেন।তখনও বেশ কিছু রোগী ডাক্তারের চেম্বার ঘরের সামনের বারান্দার বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলেন।
অধৈর্য সনতের এ ছাড়া উপায় নেই। প্রায় তখন রাত দশটা, ডাক্তার বাবুর স্কুটারে পিছনে বসে সনৎ রাস্তা দেখিয়ে ডাক্তার বাবুকে আশোকের দর্মার ঘরে নিয়ে এল। তখন আশোকের ভাড়া বাড়ির মালিক ঘরে ফিরেছিলেন।
ডাক্তার একটু পরীক্ষা করেই জানালেন আশোকের শরীর কোন প্রান নেই।
আশোকের শেষকৃত্যে সনৎ, বাড়ির মালিক ও কিছু প্রতিবেশীদের সাথে বর্ধমান নির্মল ঝিলে দাহ করতে অশোকের শব নিয়ে গেছিল। তার আগে সনৎ বাড়িতে সব জানিয়ে যায়।
শ্মশানে আশোকের শব নামানো। আনুষঙ্গিক দাহের পূর্বের কাজ কর্ম সম্পন্ন হচ্ছিল। সনৎ স্পষ্ট দেখল, আশোকের শব থেকে তার অবয়ব ছায়া মূর্তি সহসা উঠে দাঁড়াল,একটু তার দিকে এগিয়ে এসে আশোক তাকে কিছু যেন বলছে,শোনা যায় না, মুখেরভাব তার প্রসন্ন না ব্যাথিত বোধগম্য নয়। এটা তার দৃষ্টি ভ্রম না সত্যি! সেই ঘটনার বিশ বছর পরও আজ সনৎ বুঝতে পারে নি।
