Apurba Kr Chakrabarty

Classics

5  

Apurba Kr Chakrabarty

Classics

স্বপ্নের গৃহ

স্বপ্নের গৃহ

16 mins
747


অর্ণব ছাত্র হিসাবে বেশ মেধাবী।অঙ্কে এম এস সি ফাস্ট ক্লাস করে বি এড প্রশিক্ষণও নেওয়া ছিল তার। স্কুল সার্ভিস কমিশন মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ যখন রাজ্যে চালু হল। সে প্রথম বছরেই পরীক্ষায় বসেছিল।তখন নয়ের দশকের শেষ সময়।ভাগ্য গুনে মাষ্টারীর চাকরীটাও পেয়ে গেল।অর্নব তখন ছাব্বিশ বছরের যুবক।নবদ্বীপের কাছে তৎকালীন অখণ্ড বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সে একটা গ্রাম্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পদে যোগ দিল। পড়াশোনার বাইরের জগতটা ছিল তার কাছে খুব অস্বস্তির।

এক সহ শিক্ষক হিসাবে একটা হায়ার সেকেন্ডারী বিদ্যালয়ে অর্নবের চাকরি জীবনে সূচনা। সে সময়ের চাকরীর বাজারে সোনার সোহাগা, ঝক্কী কম,ভালো বেতন।আর ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞান বিদ্যা দানে কৃতার্থ করা তার দায়িত্ব! সপ্তাহে মাত্র তার বাইশটা ক্লাস,আর প্রতি ক্লাসের সময় বরাদ্দ মাত্র চল্লিশ মিনিট। গর্বিত অর্নব ,ভাবত সে মানুষ গড়ার কারীগর। বন্ধু বান্ধব যারা অন্য পেশায়, তাদের গর্ব করে সে এ কথা প্রায় শোনাত।

 ক্লাস ফাইভ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যে পড়ানোর তার ক্লাস রুটিন। প্রধান শিক্ষক বষস্ক মানুষ অবসরের বয়স প্রায় চলে এসেছিল। অর্ণবকে স্নেহ করতেন। আর অর্নবের বাড়ি বর্ধমান শহরের নিকট এক গ্রামে।বর্ধমানেই তার পড়াশোনা। স্কুল বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে বিদ্যালয় তাদের কর্মস্থল, যার সরকারী জেলা অফিস বা ডি আই অফিস বর্ধমান। স্কুলের শিক্ষা প্রশাসনিক সংক্রান্ত বা অন্যান্য বিভিন্ন কাজ অর্ণবের মাধ্যমে হেড স্যার, ডি আই অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।

অর্নব তখন ,বাড়ি থেকেই অনেকটা পথ ঠেঙ্গিয়ে বিদ্যালয়ে সে নিত্য যাতায়াত করত।তাই নিকট ডি আই অফিস যাতায়াত করে অর্নব সুযোগ নিতো।আবার ক্লাস রুটিন তৈরীতে হেড স্যারের আনুকল্য পেতো।একাদশ আর দ্বাদশ শ্রেণির সপ্তাহে তার আটটা ক্লাস, নাইনের চারটে, বাকী দশটা ফাইভ আর সেভেনের ক্লাস।

নিচু ক্লাসে গনিত বিষয়ে আলোচনার চেয়ে অর্নব আবোল তাবোল যত গালগল্প করে বাচ্চা ছেলে মেয়েদের মন রঞ্জন করত।আর মাঝে মধ্যেই ক্লাসে চেয়ারে বসে ঘুমে ঢুলত। বেশ তার মজার জীবন! ভালো ছাত্র হলেই যে ভালো দায়িত্বশীল শিক্ষক হবে এমন তো নয়! গ্রামের স্কুল,কো এডুকেশন  ছাত্র ছাত্রী সংখ্যায় কম।আর ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মেধার প্রতিযোগিতা তেমন ছিল না। এত আরাম আর কোন কাজে আছে !

এই অভ্যাস অর্নবকে অলস কুঁড়ে করে তুলেছিল । অর্ণবের বুদ্ধিদীপ্ত মেধায় সে চিন্তা আসত না। এর ফল, তার আয়েশ জীবন। চাকরীর আর বিয়ে তার একই বছরে। বিয়ের পর অর্ণব নবদ্বীপে ভাড়াঘরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকত। বিবাহের প্রায় চব্বিশ পঁচিশ বছর পর, তার স্ত্রী যখন রাগে বিরক্তে ভাড়াঘরে থাকার জন্য ঘেনোর ঘেনোর করতে লাগল।

 অর্নবের মনে হয়, সত্যিই সে এই দীর্ঘ সময়ে ভাড়া ঘরে থেকে ভীষণ ভুল করেছে। ছোট ভাই, ছোট শালা, তার কত পরে চাকরী পেলো,বেতনও কম। আজ তারা নিজস্ব বাড়ির মালিক। যার বাজার মুল্য দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

শুধুমাত্র তাই নয়,ভাই সেদিন বুঝিয়ে বলল, "তুই এই চব্বিশ পঁচিশ বছরে যে পরিমান অর্থ, বাড়ির ভাড়া দিয়েছিস, তার সুদে আসলে মোট যা মুলধন হত, আমার বাড়ি তৈরির খরচ তার চেয়েও অনেক কম । এই সব কথা আবার অর্নবের ভাই আলোক বলছিল, বৌদি মানে অর্নবের স্ত্রী মল্লিকার সামনে! আর মল্লিকা দেওরের সাথে শুধুমাত্র সহমত নয়, দেওরের সে অনেক তারিফ করছিল। সেইসঙ্গে আবার স্বামীর এই আলস্য নির্দুদ্ধিতায় কঠোর সমালোচনা করছিল।

এটা অর্ণবের মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু তার যুক্তি বাড়ি না করে ভাড়া বাড়িতে থাকা অনেক সুবিধা।নিজের ইচ্ছামত ভাড়া বাড়ি বদল করতে পারে। নতুন নতুন বাড়ি নতুন এলাকা,নানা কুযুক্তি হাজার চেষ্টায় সে স্ত্রীর কাছে কলকে পাচ্ছিল না। অর্ণব শেষে বুঝেছিল তার কুযুক্তি তার মেধাকেই ছোট করছে।

ছাত্র হিসাবে সে তো ভায়ের চেয়েও অনেক ভালো ছিল।ভালো রেজাল্ট করেছে,তার ডিগ্রিও ভালো, বৃত্তিগত সামাজিক মান ভালো,বেতনও ভালো । আর আজ কিনা,তার প্রশংসা শুনতে হচ্ছে! তাও আপন বৌয়ের কাছে!

শুধু কী তাই! ভাই যুক্তি দিয়ে অর্নবকে বুঝিয়ে দেয়,তার সম্পদ,এখন দাদার চেয়েও অনেক বেশী! জমির দাম নাকি বেড়েছে সমান্তরাল প্রগতির নিয়মে নয়! গুনিতর প্রগতিতে! তার মানে আমাকে প্রগতির অঙ্ক শেখাচ্ছে! যে কীনা অঙ্কে এম এস সি ফাস্ট ক্লাস, আবার অঙ্কের শিক্ষক, আর ভাই ! অঙ্কের ভয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর পর সে তো বিজ্ঞান ছেড়ে কমার্স নিয়ে পড়াশোনার করে! ঘষে ঘষে অনেক চেষ্টায়, অনেক দিনের ধৈর্যের ফল,একটা তো মামুলি ব্যাঙ্ক ক্লার্কের কাজ ভাই কোনমতে পেয়েছিল।এখন অফিসার হলেও তার কৌলিন্য নেই, কতদিন পর, ক্লার্ক থেকে প্রমোশন পেয়ে অফিসার হয়েছে! ডাইরেক্ট তো নয়!

অর্নবের সমস্যা ভাইকে সে বুদ্ধি মেধা যোগ্যতার নিরিখে তার পাশে রাখতেই চায় না,আবার তুলনা! আর আজ তার চেয়েও আপন বৌ দেওরকেই এগিয়ে রাখছে! অর্নবের অসহ্য। অহংকারে আঘাত লাগে।

ইদানিং ছেলে মেয়ে ভাড়া বাড়ী থাকা নিয়ে বিরক্ত হচ্ছিল।বলত বাবা অবসরের পর তুমি কী আবার সেই অজ গ্রামেই ফিরে যাবে! না আজীবনই ভাড়া বাড়ীতে কাটাবে ! অর্নবের নবদ্বীপে তেমন কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়ী নেই।তবে পরিচিত কিছু মানুষ আছেন। চাকরীর সুত্রে বা প্রতিবেশী বা একই বাড়ীর ভাড়াটিয়া হিসাবে।এখন যে বাড়ীতে থাকে,প্রায় পনের বছরের বেশী ভাড়া আছে।

ভাড়া বাড়ীর মালিক ভদ্রলোক কলকাতায় থাকেন মাঝে মধ্যে নবদ্বীপে আসেন, এটা তো তার পৈতৃক বাড়ী । আগের দিনের বনেদী , একতলায় দুই ঘর ভাড়াটিয়া ।যার মধ্যে, অর্নব ছাড়া একজন ,এ এস আই,পুলিশকর্মী, স্থানীয় থানায় সে কর্মরত, প্রায় পাঁচ বছরের বেশী বসবাস করছে দুটি পরিবার,এই বাড়ীতে।পাশাপাশি ভাড়াঘরে থাকত, তাই তাদের পারিবারিকগত ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব।রান্নার খাবার পরস্পর গিন্নিরা বিনিময় করা থেকে, একসাথে ছোটখাট একদিনের ট্যুর তারা গাড়ি ভাড়া করে দুই ফ্যামিলি মিলে করেছে বেশ কবার।

দালাল লাগিয়ে একমাসের মধ্যেই তাকে একটা নিজস্ব বাড়ির নিতে হবে। তার মত অলস কুঁড়ে মানুষ জায়গা কিনে বাড়ী তৈরী করা তো অসম্ভব। আর পুরোন বাড়ী কিনলেও বেতন থেকে আসল, সুদ যা ব্যাঙ্কের ইন্টলমেন্টে পরিশোধ করবে,তার একটা বড় অংশ, তার মত উচ্চ আয়ের মানুষ ইনকাম ট্যাক্সের উপর ছাড় পাবে। ব্যাঙ্ক চাকুরে ভাই তাকে এসব পরামর্শ দিয়েছিল,সেটা অর্নবের মনে বেশ ভাল লেগেছিল। ভায়ের এ কথাটায় সে প্রশংসা করে।

খাম খেয়ালী অর্নব, মোটা মাইনের টাকার একটা বড় অংশ জিপিএফে রাখত। পি এল আই,এল আই সি, ছিল।তাতেই মোটা অঙ্কের টাকা বছরে বিনিয়োগ করত।আর বছর বছর বৌ মেয়ের গহনা কিনে, অর্নব ভাবত ভালো ইনভেষ্ট করছি।এমন বুদ্ধিমান আর কে আছে! ইনকাম ট্যাক্সও ওর ভালোমত লাগত।

ভাই বোঝায়,আর তোর এত ট্যাক্স লাগবে না,আর ঘর ভাড়া লাগবে না।ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে তুই নিজে বাড়ী কর বা রেডিমেড বাড়ি ক্রয় কর,কোন তফাত নেই। দাদা ভাবে ভায়ের তো বেশ বুদ্ধি! ব্যাঙ্কে থেকে থেকে বোকাটার বুদ্ধি খুলেছে ।সে শিক্ষকতার মত সাদা সরল মহান পথে আছে, তাই এত সে মার প্যাঁচ শেখে নেই। তবে বুদ্ধিতে সে যে ভায়ের চেয়েও শত  যোজন এগিয়ে এ ব্যাপারে সে একশ শতাংশ নিশ্চিত।

কম টাকায় একটু ভালো বাড়ি চাই ফ্ল্যাটে অনীহা। আর স্ত্রীও বলে, এতদিন পর বাড়ি হবে নিজস্ব একবারে ষোলআনা মালিকানা। তোমার ভাই, আমার ভাই, সবাই বাড়ি করেছে জমি কিনে, নিজস্ব বাড়ি।বাড়িতে গাছপালা আছে,আর স্বাধীন, ঐ সব পয়রার খোঁপ ফ্ল্যাট বাড়ি চলবে না। অর্নবের ছেলে মেয়ের একই অভিমত। অর্নবকে বাড়ির দালাল বলল দাম বেশি দেবেন না,অথচ বড় বাড়ি, গাছপালা থাকতে হবে বা বাগান করার মত জায়গা এত কী সম্ভব!

অর্ণব বলে তোমার মত তুমি চেষ্টা করো, আমি আরও দালাল লাগাব, আমার মন যখন চেয়েছে তিন মাসের মধ্যেই বাড়ীর কিনব ।শুধুমাত্র যতটা ব্যাঙ্ক লোন নিতে, কাগজ তৈরির বা আনুষঙ্গিক সময় লাগবে। অনেক বাড়ি সে ঘুরল, বাড়ি আর পছন্দই হয় না,বা দামেতে পোষায় না। অনেক শেষে একটা বাড়ির সন্ধান সে পেলো।তার হিসাবে আর্দশ। গঙ্গার ধারে,উচু জায়গা, নিরিবিলি, বসতি কঘর আছে, তবে বাজার একটু দুর, দুষন নেই।

সবচেয়ে বড় কথা,সচারচর বন্যার জল এখানে ওঠে না।সেই আটাত্তরের আর দু হাজারের বন্যায় নাকি দুদিন জল ছিল,তবু সেবার একতলার মেঝে ভোবেনি।অনেক উচু জমি,বুদ্ধি করে ভেবেচিন্তে তবে এবাড়ীর মালিক যেন বাড়িটা করেছিলেন। তাই অর্নবও তার তারিফ করে। দ্বোতলা বাড়ির নিচে, উপর দুটো করে ঘর। শক্তপোক্ত সদরের লোহার গ্রিলের গেট খুললে, পূর্ব মুখী বাড়ির প্রবেশ পথ, সংলগ্ন বারান্দা। বেশ প্রশস্থ,তার মটোর সাইকেল রাখার অসুবিধা হবে না।আবার একটা সোফা রাখলে, বাইরের মানুষকে বসিয়ে দুটো গল্প করা যাবে। বাড়ির প্রাইভেসী নষ্ট হবে না।

তার পর ডাইনিং কুড়ি ফুট,উত্তর দক্ষিণ বরাবর দৈর্ঘ্য ,আর পুব পশ্চিমে বারো ফুট প্রস্থ তো হবেই।ডাইনিং এর উত্তরদিক আছে দেওয়াল জুড়ে মজবুত গ্রিল,আর গ্রিল বরাবর,কাঁচের জানালা বেশ মজবুত ঠেলা পাল্লা । তারপর উত্তরে প্রাচীর ঘেরা দীর্ঘ মুক্ত প্রাঙ্গন। ডাইনিং এর পশ্চিমে বারান্দা। আর পূর্বদিকে, সিঁড়ি, বাথরুম টয়লেট, আর রান্নার ঘর, পাশাপাশি যথাক্রমে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর রয়েছে। আর ডাইনিং এর দক্ষিণ সংলগ্ন দুটি বেড রুম। দোতলা একতলার অনুরূপ। একটা বাইরে দিকে সিঁড়ি থেকে বের হবার গেট করে উত্তর দিকের খোলা প্রাঙ্গনে যোগ করে  দিলেই, পৃথক একতলা ও দোতলা। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে পড়লে একটা ভাড়াটে বসানোও যাবে।

ছেলে মেয়েরা ভবিষ্যতে যদি না থাকে, বুড়ো বুড়ীর একটা সঙ্গী হবে।এক ঘর ভালো ভাড়াটিয়া থাকলে যেমন নিঃসঙ্গতা দুর হবে, আবার ঘর ভাড়ার টাকা!পেনশন জীবনে বড় আর্থিক সুরাহা। বাড়ির পূর্ব দিক প্রবাহবান গঙ্গার বা ভাগীরথীর অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা সুযোগ। আর নির্জন চাঁদনী রাতে ছাদ থেকে তার অনুপম দৃশ্য। গ্রীষ্মের সিদ্ধ শীতল হাওয়া, ভাবতেই অর্নবের হৃদয় জুড়িয়ে যায়।

সবচেয়ে ভালো ছাদটি, অর্ণবের ভীষণ পছন্দ। প্রশস্থ, চল্লিশ বাই ত্রিশ ফুটের ছাদ।তিন ফুট উচু দশ ইঞ্চি ইটের চারিধার প্যারাপিট ঘেরা দেওয়াল। বাড়ির তিনদিক অন্তত কুড়ি ফুটের প্রশস্থ উদ্যান। আম কাঁঠাল নারিকেল সুপারি গাছ, ছাদ থেকেই গাছে হাত ছোঁয়া যাবে।কেবল মাত্র পশ্চিম দিকে বাড়ির সংলগ্ন মোরাম রাস্তা,পনের ফুট প্রশস্থ।

বাড়ির সবই ভালো,একটাই একটু প্রশ্ন,বাড়িটি সব ঠিক থাকলেও মনে হয় অনেক দিনের পুরোন। দালাল বলল, মাষ্টার মশাই, এ বাড়ীই মোট চার কাঠার উপর এরিয়া, এখনকার বাজারে যার দাম, চব্বিশ লাখের কম নয়,আপনি পঁচিশ লাখে দাম পাচ্ছেন। বাড়ির দীর্ঘ প্রাচীর আর গাছের দামই একলাখ, বাড়িটা তো ফ্রি!

অর্ণব ভাবে রবিন, দালাল মন্দ বলেনি। মল্লিকা সঙ্গেই এসেছিল, তার খুব পছন্দ,বলে গঙ্গার ধার, মুক্ত বাতাস,  এতটা জায়গা!

গদগদ খুশীতে মল্লিকা আজ স্বামীর পক্ষ টেনে বলে "তোমার ভায়ের বর্ধমানের বাড়ি এর আর্দ্ধেক জমিতে। মোটে একটা তো আম গাছ , ঘরগুলো ছোট,এ সি ছাড়া গরমের দিনে থাকতে পারে না, এত ঘিঞ্জি। আর আমার ভাই সুদীপ বাড়ি করেছে আসানসোলে, সে তো গরমকালে আগুন, লু বয়, শীতে তেমন ঠান্ডা,আর মাটির নিচে কয়লা তুলে ফোমরা, ভূমিকম্প হলে শহরটার কি হাল হবে কে জানে। ওখানে বাড়ি করে সুদীপ ভীষন ভুল করেছে, পরে পস্তাবে। আর দেরী করো না এ বাড়ী কিনে নাও ,তার পর রংটং করে ,কিছু ডিজাইন করে এমন করো, যেন দেরি হলেও, ওরা বোঝে উস্তাদের মার শেষ রাতে। "

খুশীতে গদ গদ অর্নব বলে, "বলছ গিন্নি ! আমি তাহলে উস্তাদ ওরা আনাড়ি! এই না হলে আমার সহধর্মিনী ! আমার গিন্নি! আহা তোমায় একটা বহুদিন পর চুমু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।"

"সে খাবে,যেদিন একটা গ্যারেজ করে, চার চাকাটা কিনবে।"

"জায়গা তো গ্যারেজের জন্য যথেষ্ট আছে,ছেলেটা নিজে স্বাধীন হোক। গাড়ি তো কিনবই। "


বাড়ি মোটে উপর অর্নব তার স্ত্রী, ও পরে পুত্র কন্যাও বাড়ি দেখে বেশ সন্তুষ্ট। বায়না নামা, ও ব্যাঙ্কলোনের কাগজপত্র তৈরী করে, বাড়ির রেজিস্ট্রেশন সব হল। সরকার নির্ধারিত স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন ফি, ব্যাঙ্কের প্রসেসিং ফি,সব মিলে,ত্রিশ লাখ টাকা।অর্নবের বেশ জেতা জেতা ভাব! তার বিচারে তো তার সব জিনিসই ভালো! কোথায় বর্ধমান , আসানসোল ! নবদ্বীপের সাথে কোন তুলনা চলে ! এ হল গৌরাঙ্গের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি। ইসকন আজ বিশ্বের এক পবিত্র ধর্মচর্চা প্রতিস্থান, যার মুল প্রান কেন্দ্র মায়াপুর, নবদ্বীপেরই তো অংশ ! হোক না গঙ্গার ওপাড় !

বাড়ির নতুন করে কিছু সংস্কার ও রংচং করে একটা শুভ দিনে অর্নব এবার নিজস্ব গৃহে প্রবেশ করল। তখন দিন সাতেক হল।ছেলে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য থাকে।মেয়েকে নিয়ে মল্লিকা বাপের বাড়ি বর্ধমান গেল,একটু দেওরের বাড়িও যাবে। ভালো মত দেওরের বাড়ি পর্যবেক্ষণ করবে।তুলনা করে দেখবে। তারপরে যদি মনে হয়,তাদের বাড়ি সার্বিক ভাবে এগিয়ে। দেওর ছোট জাকে আমন্ত্রণ করবে।বহুদিনের শখ,আর আকাঙ্খার আজ তার বড় প্রাপ্তি।

সেদিন অর্নব বাড়িতে একাই ছিল। বৈশাখের তখন মাঝামাঝি কৃষ্ণ প্রতিপদের চাঁদের আলো ছাদে যেন ঝক ঝক করছে। নতুন রং করা হাল্কা হলুদ প্যারাপিটে আলোর প্রতিফলন,নিজ বাড়ির ছাদে রঙিনের ছটা , তার মন রাঙ্গিয়ে যাচ্ছিল।যদি গিন্নি আজ সাথে থাকত আহা ! ঘরে এসি নেই, তাই ঘর কেমন গুমোট গরম, আর ছাদে কী মধুর শীতল হাওয়া,প্রান জুড়িয়ে যায়।গঙ্গার প্রবাহবান জলের ঢেউ, চাঁদের আলোয় ঝিক মিক করছে। আহ এত সুন্দর পরিবেশ, গঙ্গার ঠিক কিনারা।

রাত দশটার পর,রাতের খাবার খেয়ে কতক্ষণ ধরে ছাদে পায়াচারী করতে করতে পায়ে ক্লান্তি চলে আসছিল। মোবাইলে দেখল রাত এগার টা। নির্জন পরিবেশ, গ্রীষ্মের রাত তবু চার ধারের একটু দুরত্বে বসত বাড়ির আলো নিভিয়ে রাতে শুয়ে পড়েছিল।কেবল রাস্তায় কিছু কুকুরের আনাগোনা করছিল। হঠাৎই সুর তুলে কুকুর গুলো কেমন চিৎকার শুরু করল,যেন তার বাড়ির দিকেই মুখ করে। একটা পচা গন্ধ যেন ছাদে হঠাৎই ভেসে আসছে।

এত রাত স্ত্রী থাকলে হতো না।একা আর দোতলার ঘরে গুমোট ,তাই তার ছাদে এসে শীতল হাওয়া উপভোগ।আর দেরী ঠিক নয়। কুকুরের একটানা হঠাৎ চিৎকার আর একটা দুর্গন্ধ তাকেও বিচলিত করছিল। ছাদের দরজা ভিতর থেকে খিল লাগিয়ে ,তার জন্য নিদিষ্ট দোতলার ডানদিকের ঘরের কপাট খুলতে গিয়ে চমকে গেল।

ভিতর থেকে মনে হচ্ছিল খিল লাগানো! একটু ঠেলে ঠেলি করে কেমন রহস্য আর ভয় করছিল।নিচে নেমে দ্রুত সামনের ঘরে ঢুকেই খিল লাগাল। ঘরের আলো জ্বেলে, বিছানা করছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারটা। মশারী খাটিয়ে ঘরের দরজা আর বাকী সব জানালা বন্ধ করেছিল।তবু বেশ ভয় হচ্ছিল। আলোটা তাই জ্বলছিল,অন্ধকারে ঘুম তার পছন্দের কিন্ত আজ অন্ধকার কেমন আতংক লাগছে!

নতুন আনকো অজানা বাড়ি ! উপরের ঘরে কী কোন মানুষ ঢুকেছে! ছাদের সংলগ্ন আম কাঁঠাল গাছ বেয়ে ছাদে মানুষ ওঠা অসম্ভব নয়! সে যেই উঠুক, রাত দশটার আগেই সে উঠেছে, ঘরে নিশ্চয়ই ঘুপচি মেরে বসেছিল। রাত দশটার পর সে তো সমানেই ছাদে পায়াচারী করছিল, ঐ সময়ে তার চোখের আড়ালে ছাদ থেকে এই ঘরে ঢোকা অসম্ভব। আর ঘরেই বা ঢুকবে কেন?সে তো আজ একা বাড়িতে,তাকে তাই চোর ডাকাত হলে সহজেই আচমকা আক্রমণ করতে পারত! তবে ঐ ঘরে কে! মানুষ না আর কিছু! নতুন বাড়িতে এসেছিল, কত দিনের পুরোন বাড়ির। কতদিন বাড়িটা ফাঁকা ছিল কে জানে ! এত সব চিন্তাই তার মাথায় আগে আসে নি।

হঠাৎই তার দরজায় তীব্র ধাক্কাধাক্কির শুধু হল।অর্নবের মনে হচ্ছিল, দরজাটা ভেঙ্গেই যাবে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।একটু পর ধাক্কাধাক্কিটা থেমেছে। চোর বা ডাকাত হলে তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে সুবিধা করে দিত না। এ কোন অপদেবতা! ভুত! অর্নব এবার তার মোবাইলে থেকে ফোন করল, অনেককেই, তবে কোন আশা দেখছে না।রাতে কেউ বা ফোন ধরছে না। কেউ বা ধরলেও এসব কান্ড শুনে ভয়ে থমকে ফোন কেটে দিচ্ছে।

একমাত্র, প্রথমে ফোন না ধরলেও,পুলিশের এ এস আই,দিনুবাবু তার দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া, এত রাতে অর্নবের মিস কল দেখে ফোন করল।অর্নব ভয়ে কেঁদে কেটে একাকার, সব শুনে দীনুবাবু বলে "চিন্তার কিছু নেই, আপনার বাড়ির লোকেশনটা বলুন, আমি থানাতেই,আপনি যখন ফোন করেছিলেন আমি একটু বাথরুমে ছিলাম। মোবাইলটা অফিসের টেবিলে ছিল। "

 

অর্নব বাড়ির লোকেশন বললে, দীনুবাবু বুঝে গেল। পুলিশের লোক, পাঁচ বছর এই থানায় আছে, শহরের অলি গলি তার চেনা।এবার বদলী হবে। থানার গাড়ি নিয়ে দীনু আরও তিনজন কনস্টেবল, ড্রাইভার নিয়ে পাঁচ জন। 

বাড়ির গেটে এসে কড়া নাড়া দিল।অর্নব ভয়ে অদ্ধ মৃত। ধাক্কাধাক্কির শব্দটা মাঝে মাঝেই এমন জোরে হচ্ছিল, ভাবছিল দরজার কপাট ভেঙ্গেই যাবে।পুলিশ গেটে একটু সাহস পেলোও কপাট খুলে বের হবার সাহস তার হচ্ছিল না। তাই অর্নব ফোনে দীনুবাবুকে অনুরোধ করল।"গ্রিলের দরজা ভেঙ্গে আমাকে বাঁচান। আমি ঘর থেকে বের হলেই ও আমাকে মেরে ফেলবে!"

দীনুবাবু বলে, "আমরা এভাবে করোর বাড়ির ভাঙ্গতে পারি না। কোন আগুন লাগা বা ঘর ভেঙ্গে পড়া সে সব ক্ষেত্রে অন্য বিবেচনা করতে হয়।"

অর্নব বলে " মোবাইলে আমি ম্যাসেজ করছি, আর হোয়াটস্আফ করছি।আমি বাড়ির মালিক, বাড়ির দরজার গ্রিল ভাঙ্গার আবেদন আমি করছি। ডকুমেন্ট রেখে গ্রিলের তালা ভেঙ্গে আমাকে বাঁচান।"

দীনু বলে,"সত্যিই কি কোন অপদেবতা ! না ডাকাত নিশ্চিত হলেন কী ভাবে! "

অর্ণব, মোবাইলে চিৎকার করে বলে " আবার সে ধাক্কাধাক্কির করছে! " এত কাছে তাই ধাক্কাধাক্কির শব্দ পুলিশও পাচ্ছিল।পুলিশও বিস্মিত তবে কিছু রহস্য বটে! পুলিশ এসেছে জানলে চোর ডাকাত এমন কান্ড করবে না। তাই দীনু এবার গ্রিলের গেটের চাবি ভেঙ্গেই দিল। ঘরের আর সব খোলা ছিল। সে সময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে অর্নব ডাইনিং এর কপাট লাগানো সময় পায়নি, ছুটে একতলার কাছের ঘরে ঢুকেছিল, কোন মত রক্ষা পেতে।

তখন তার ভুতের চেয়েও ডাকাতের সন্দেহ বেশী ছিল।এই ধাক্কাধাক্কির শব্দ আর একটা গন্ধ তাকে নিশ্চিত করে এসব ডাকাতের কর্ম নয়। দীনুবাবু একবারে অর্নবের ঘরের দরজায় এসে এবার মৃদু কড়া নাড়া ও অর্নব বাবু নাম ধরে পরিচিত গলার  ডাক শুনে অর্নব ঘর থেকে বের হল।সারা শরীর বিধ্বস্ত ভয়ার্ত্ত,আতংকিত মুখচোখ, বলে "আপনি সত্যিই আজ আমায় বাঁচালেন দীনুবাবু, এ ঋণ জীবনে ভুলব না। "

পুলিশের সন্দেহ বশত, বাড়ির প্রতিটি ঘর বাথরুম টয়লেট সিড়ির তলার ছোট ঘর, কিছুই খুঁজতে বাকী রাখে না। আর ছাদের দরজা ভিতর থেকেই খিল। যদি চোর ডাকাত হয়, ছাদ দিয়ে যদি পুলিশ আসার পর পালাত ,তবে তো সিড়ির ছাদের দরজা খোলা থাকত ! অর্নব আর এ বাড়িতে এক মুহুর্ত থাকতে চায় না ,বলে "দীনুবাবু আজ আমি বাকি রাত থানায় বসে কাটাব।"

দরজার সব লক করে সদরের গ্রিলের অর্নব যখন তালা দিচ্ছিল ,পাড়ার কিছু উৎসুক মানুষ পুলিশ আসা চেঁচামেচিতে,উঠে আসে। অর্নব যাদের সাথে এই সাতদিনে আলাপ করতে পারে নি।কেউ একটু এগিয়ে এসে পুলিশের সামনেই বলল,মশাই বাড়িটা কেনার আগে প্রতিবেশীদের সাথে একটু আলাপ  করবেন তো ! দালালদের কথা কেউ বিশ্বাস করে বাড়ি কেনে! এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলে, এবাড়ীতে মশাই ভুত আছে। আমি নিজের দেখেছি।

পুলিশ জিজ্ঞেস করে আপনার বাড়ি কোনটা ? সামনে একটা দোতলা বাড়ি দেখাল। পাড়ার অন্য মানুষ সহসা নিজের নিজের মত এরপর বাড়ি চলে গেল, সবার মুখেই আতংকের ছায়া

অর্নব সে রাত থানায় কাটায়,তবে তার দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ পরিচিত এ এস আই দীনুবাবুর সৌজন্যতা বশত থানার এক ঘরের মেঝে মশারি খাটিয়ে তার শোবার ব্যবস্থা করে।যদিও অতংকিত অর্নবের ঘুম হয়নি।পরদিন অর্নব ,দীনুবাবুর সাথে এ বাড়ীর ইতিবৃত্ত নিকট প্রতিবেশীদের কাছে জানতে আসে। প্রথমেই তারা যায় যে ভদ্রলোক এ বাড়ীতে ,যিনি ভুত দেখেছেন বলেছিলেন, তারই বাড়ির দরজায় প্রথম কড়া নাড়ে। 

পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে তাই একটু বিচলিত, এক বয়স্ক ভদ্রলোক বের হয়। কিন্ত সে তো গতরাতের ভদ্রলোক নয়। তাই দীনুবাবু জিজ্ঞেস করে। এ বাড়ীর এক ভদ্রলোক গতরাতে আমাদের সাথে কথা বলেছিলেন, তিনি কী বাড়িতে আছেন?"

"কি বলেন মশাই আমার বাড়িতে আর কেউ বয়স্ক মানুষ নেই, যাকে দেখেছিলেন কেমন দেখতে বলুন তো! "

অর্ণব বলে "আমি নিখঁত দেখেছি, মাথায় মস্ত টাক একরাশ পাকা গোঁফ, লম্বা, ফর্সা-- "

"আর বলতে হবে না মশাই, ও আপনি যে বাড়িটা সবে কিনেছেন।ঐ বাড়ির মালিক ছিলেন। পনের বছরের আগে আমার তখন বয়স পঞ্চাশ হবে ।ঐ ভদ্রলোক দোতলার ডান দিকের ঘরে,গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। মেয়ে জামাই এ বাড়ীটা লিখে দেবার জন্য জোর জবরদস্তি করে, গায়ে হাতও নাকি তুলেছিল। আর ভদ্রলোক কিছুতেই এ বাড়ী তাদের লিখে দেবে না।

তার ছেলে সেনাবাহিনীর কাজ করত,এখন ওখান বদলীর কাজ। বন্ড শেষ হতে আরও চার বছর বাকী, হঠাৎই তার মা মারা যায়। নিরীহ স্বভাবের  ভালোমানুষ ছিলেন ভদ্রলোক।জামাই মেয়ে বলে, তাদের নামে বাড়িটা লিখে দিতে হবে । এমনিতেই বুড়ো বয়সে স্ত্রী বিয়োগে দিশেহারা।ছেলে সাতদিন থেকেই, জরুরী কাজে আবার ডিউটি চলে যায়। আর জামাই মেয়ের জুলুম । তবে এমন কান্ড বুড়ো সহসা করবেন, মেয়ে জামাই হয়ত বোঝে নেই।

তার পর মেয়ে জামাই, ভদ্রলোকের ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে বাড়িটা কিনে নেয়। ছেলে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে শুনেছি এখন বাসকরছে। আর মেয়ে জামাই বাড়ি কিনল বটে,তারা বাস করতে পারেনি। কিছুতেই সত্য বলত না ভয়,প্রতিবেশীদের সত্যিটা বললে বাড়ির দাম পাবে না। তবু কেন জানি না। এ বাড়ী বিক্রি হয় নি আজ পনের বছর। "

অর্নব বলে " আমাকে তো ঐ জামাই ভদ্রলোক আর মেয়ে বাড়িটা বিক্রি করেছে!"

"কত দামে কিনলেন!"

"পঁচিশ লাখে ।"

"তাহলে ঠিক আছে।আরে মশাই এই বাড়ির সঠিক মুল্য বর্তমান বাজারে পঞ্চাশ লাখে পাবেন না।"

"দীনুবাবুর বলে আপনি ভীষণ ভুল করেছেন অর্নব বাবু আপনি শিক্ষক, উচ্চ শিক্ষিত মানুষ এ বাড়ী মাত্র পঁচিশ লাখে কী ভেবে কিনলেন!"

"পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বললেন, মেয়ে জামাই মাঝে মাঝেই গাড়িতে আসত,সারাদিন থেকে রাতে ফিরে যেত,বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ জন্য একজন ছিল, সে দিনে থাকলেও রাতে থাকত না।"

"অর্ণব বলে সাতদিন আমরা থাকলাম কোন সমস্যাই হয়নি।" 

পাশের প্রতিবেশী বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন " এক তান্ত্রিক কে দিয়ে মৃত ভদ্রলোকের মেয়ে জামাই এ বাড়ীতে যাক যজ্ঞ করে। ঐ তান্ত্রিক আমার বেশ পরিচিত, পাশাপাশি বাড়ীর রহস্য তার কাছে জানতে চাই। তিনি বলেন, কৃষ্ণ প্রতিপদের দিন উনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন । আমারও মনে আছে, ঠিক কোজাগরী পূর্নিমার পরদিন রাতে এই মর্মান্তিক ঘটনা। আর তান্ত্রিকের মতে ঐ তিথিতে ওর আত্মা সক্রিয় হয়, কাল মনে হয় কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথি ছিল। "

অর্ণব " ঠিকই, গত পরশু পূর্ণিমার দিন গিন্নি বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মায়ের পুজো দেয়, এই বাড়ির মঙ্গল কামনায় "

দীনুবাবু হেসে বলে "তাই আপনি এযাত্রায় প্রানে বেঁচে গেলেন দাদা! বৌদিকে একটা থ্যাঙ্কস দিন। "

পাশের বাড়ির বষস্ক ভদ্রলোক বললেন "আপনি চাইলে ঐ তান্ত্রিকের সাথে কথা বলতে পারেন, এই শহরেই থাকেন।প্রতিবেশী হিসাবে ঐ তান্ত্রিক বাবার সাথে আলাপ করিয়ে দেবো।এই টুকু উপকার করতে পারি। তবে আগে যদি আলাপ হত,তাহলে  এ বাড়ী কিনতে নিষেধ করতাম। এমন তো কত মানুষকে বলছি। তবে আমার নাম নিতে মানা করতাম।না হলে এরা আমাকে শত্রু ভাবত। এত কম দামে এত বড়, সুন্দর পরিবেশে বাড়ি পাচ্ছেন ,একটু তো ভাববেন মশাই!"

অর্ণবের বৌ মেয়ে আরও দুদিন পড়ে আসার কথা এসব বলে বিভ্রান্ত করেনি,তবে সে একা রাতে কেন দিনের বেলায় এবাড়ীতে থাকতে সাহস পাচ্ছিল না। তাই  অর্নব দুদিন হোটেলই থাকল।

তান্ত্রিকের কাছে প্রতিবেশী বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে গিয়ে অর্নব, এ বাড়ীর বিষয়ে আলোচনা করলে তান্ত্রিক বলে।"ওর অতৃপ্ত আত্মা ঐ বাড়ি থেকে যাবে না ,যদি চেষ্টা করেন অকাল মৃত্যু নিশ্চিত। আর কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথি ছাড়া ওর উপস্থিত প্রকাশ পায় না।সেদিনটাও ছিল কৃষ্ণ প্রতিপদ। দোতলার ডান দিকের ঘরে তীব্র মানসিক অতৃপ্তি,সাংসারিক হতাশা ঘৃনায় গলায় দড়ি নিয়ে ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেন।

সেদিন বাইরে থেকে, তার বন্ধ ঘরে অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে,মেয়ে জামাই ও আরও অনেক মানুষ। সেই ক্ষোভ আক্রোশের প্রকাশ ঐ তিথিতে ঐ ঘর সে রাত দশটার পর কপাট বন্ধ করে রাখে। আর বাড়ির অন্য কোন ঘর,  ভিতর থেকে বন্ধ বুঝলেই ধাক্কাধাক্কির করে বার বার সারারাত ধরে। দরজা খুললে কী হবে! তার অশরীরীর আত্মার কোন বীভৎস রূপের দেখা মিলবে কিনা! বা কোন ক্ষতি করবে কিনা জানা নেই । তবে ওই বাড়িতে সারাক্ষণ তার সুপ্ত উপস্থিতির অশুভ প্রভাবে সংসারের অমঙ্গল, নানা ব্যাধি আর আর্থিক সমস্যার কারণ হবে।

তাই ওর মেয়ে জামাইও এবাড়ীতে থাকেনি।বাড়িটার খদ্দের ছিল না। আমাকে বলেছিল অনেক কম দামে হলেও এ বিক্রি করে পাপ মুক্ত হবে। নানান সমস্যায় তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। "

এরপর অর্নবের উদ্দেশ্যে তান্ত্রিক বলেন "পারলে কোন প্রমোটারকে একটু কম দামে হলেও বাড়িটা বেচে দিন। এ বাড়ি আপনার জীবনে অশুভ ডেকে আনবে।বাড়িটা ভেঙ্গে কোন প্রমোটার, নতুন বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করলে যদি ওর নিজের বহুকষ্টে তৈরী শখের বাড়ির মোহ দুর হয় তো হবে!তারপর যদি তার অতৃপ্ত ক্ষিপ্ত আত্মা ঐ বাড়ি ছাড়ে।"

দীনুবাবু সেদিন এসব কথা শুনে অর্নবকে বলে "অর্নব দা, বাড়িটা সত্যি সত্যিই কোন প্রমোটারকে বেচে দিন । তান্ত্রিক বাবা ঠিক বলেছেন। একটু তাতে আর্থিক ক্ষতি হয় হোক।তারপর আপনার দীর্ঘ দিনের পুরোন ভাড়া বাড়ীটা এখনও ফাঁকা পড়ে, ওখানেই ভাড়া নিয়ে বৌদিকে নিয়ে সবাই চলে আসুন। সবার ভাগ্যে শুনেছি নিজের বাড়ি সহ্য হয় না।আর আপনি তো হলেন বোনাফাইড ভাড়াটিয়া। ভাড়া ঘরেই ভালো থাকবেন। কবির ভাষায় সেই যে বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃ কোলে না ক্রোড়ে কী যেন বলে!" তার পর দীনুবাবু খুব হাসতে লাগল। 




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics