Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3.4  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

ভালোবাসার বয়স

ভালোবাসার বয়স

5 mins
1.9K


দোতলায় পুব-দক্ষিণ কোণে এক মাঝারি মাপের ঝুলবারান্দা। সেখানে এক মস্ত মাপের দোলনা টাঙানো, লোহার ফ্রেমে। সেই যে সেই গেল বারের ছুটিতে এসে মৈনাক এই দোলনাখানা টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। চুপিচুপি কখন যেন দোকানে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে, মিস্ত্রী ডেকে জায়গামতো টাঙানোর আগে পর্যন্ত কেউ কিচ্ছুটি বোঝে নি, না অনুপমা, না নির্মলেন্দু। ছেলে মৈনাক বাবা মাকে চমক দিয়েছিল, বাবা মায়ের পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে উপহার হিসেবে। নূপুর, মানে মৈনাকের বৌ, মোটেই এই দোলনা পর্বটিকে সোজা মনে মেনে নেয় নি। উল্টে নিজের বাবা মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতেই হয়তো, গুচ্ছের বাঁকা কথাও শুনিয়েছিল মৈনাককে। ঠারেঠোরে মৈনাকের বাবা মাকে, অর্থাৎ শ্বশুর শাশুড়িকে। সেও আজ অনেককালেরই কথা।


মৈনাককে নূপুর ধুদ্ধুড়ি নেড়ে কথা শুনিয়েছিল, "উঁহ্, আদিখ্যেতা কত? তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে, মরবার বয়স পেরোতে চলেছে... এখন নাকি বাবা মা দোলনায় বসে দোল খাবে। আশেপাশের লোকের কথা তো আর শুনতে হয় না তোমাকে! সবই তো আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে চলে। ন'মাসে ছ'মাসে ছুটি নিয়ে আসো। বন্ধু বান্ধব আড্ডা হৈহৈ করে চলে যাও, কোন খেয়ালটা রাখো শুনি? বলেছিলাম একটা স্কুটি কিনে দাও। দোকান বাজার সবই তো করতে হয় ঐ রিক্সা নিয়ে একগাদা খরচা করে, নয়তো হেঁটে। তানা কোত্থেকে এক দোলনা খাটানো হয়ে গেল।" মৈনাক ভারী অস্বস্তিতে। শাশুড়ি জামাইয়ের পাতে আরো অনেকখানি মাংস ঢেলে দিয়ে বলেই ফেলল, "হ্যাঁ বাবা মৈনাক, নূপা তো ভুল কিছু বলে নি। তোমার অবর্তমানে সবই তো ওকেই করতে হয়। ওর কথাটা তো ফ্যালনা নয়!" টেবিলের উল্টো পিঠে বসা শ্বশুর বেশ করে মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে গরাস পাকিয়ে মুখে পুরে হড়বড় করে বলে উঠল, "এটা হক কথা বটে, এতোখানি খরচার আগে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা আলোচনা করা উচিৎ ছিল। তাছাড়া কোথায় কীসে খরচা করছো, সেটাও তো ভাবা খুবই দরকার। তোমার বাবা মায়ের কী এখন দোলনায় চেপে দোল খেয়ে ভালোবাসা করবার বয়স আছে? আমরা তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি।" মৈনাক চুপ। অপ্রস্তুতের একশেষ। শ্বশুরবাড়িতে এসে এই আলোচনার সামনে পড়তে হবে জানলে মৈনাক আসতই না। মৈনাক নির্বিবাদী চুপচাপ প্রকৃতির। খাওয়া থামিয়ে শান্ত গলায় বলল, "বলেছি তো, পরের ছুটিতে আসার সময় আমাদের আর্মি চিপ ক্যান্টিন স্টোর থেকেই আনার চেষ্টা করবো একটা স্কুটি, না হয়তো এখানে এসেই কেনা...."! নূপুর গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, "আবার হয়তো নতুন কোনো বাহানা বেরোবে, বাবা মায়ের দরকার পড়ে আবার কিসের না কিসের?" মৈনাক আর কথা বাড়ায় না। খাওয়াদাওয়া শেষে দুজনে নিশ্চুপ দুই পুতুলের মত নিজেদের বাড়িতে ফিরে এল।



রিক্সা থেকে নেমে গেট খুলে ঢোকার সময় ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে চোখ তুলে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে নূপুরের। "মরণদশা! বুড়ো বয়সে ভীমরতি! ছেলে দোলনা টাঙিয়ে দিয়েছে, আর বাবা মাও সারাদিন একসাথে বসে দোল খেয়ে খেয়ে ভালোবাসা হচ্ছে!" বলতে বলতে ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। নূপুর আর মৈনাকের বিয়ে হয়েছে পাক্কা দু'বছর সাতমাস। এখনো ছেলেপুলে হয় নি। মৈনাক বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। জেদ করে ইণ্ডিয়ান আর্মিতে চাকরি নিয়েছে। এখন ওর যেখানে পোস্টিং, সেখানে ফ্যামিলি নিয়ে থাকবার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া উত্তরপাড়ায় নিজেদের এতোবড়ো দোতলা বাড়ি, আর তাছাড়া নূপুরের বাপেরবাড়িও একেবারে কাছেই উত্তরপাড়াতেই। সুতরাং নূপুরের উত্তরপাড়াতে থাকাই ভালো। এইসব জেনেশুনেই তো দু'বাড়ি থেকে দেখাশোনা করেই বিয়ে মৈনাক নূপুরের। ভালো চাকরি পরিবার ঘরবাড়ি দেখেই বিয়ে হয়েছে। তবে শ্বশুর শাশুড়ি যে এমন আদেখলে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো দিনরাত একে অপরকে চক্ষে হারায়, তা আর আগে কে জানতে পেরেছে!



মৈনাকও তেমনি। বলে কিনা, "ভালোবাসার আবার বয়স কি? বয়স যত বাড়ে টানও তত বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভালোবাসাও।" শুনলেই গা-পিত্তি জ্বলে যায় নূপুরের, বিড়বিড় করে, "যেমনি বাপ-মা, তেমনি তাদের ছা।" মৈনাকের ছুটি শেষ হলো জুলাইয়ের শেষে। ফিরে গেল মৈনাক, ওর হেডকোয়ার্টারে, জম্মুতে। আবার বাড়িটা ফাঁকা। বাবা-মা বারান্দায় বসে বটে মাঝেমধ্যে গিয়ে, তবে দোলনায় না। মনটা পড়ে থাকে হয় ফোনের রিঙের দিকে, নয়তো টিভিতে, খবরের দিকে। যুদ্ধ লেগেছে। কার্গিল যুদ্ধ। এখানে বসে সব খবর নির্ভুলভাবে বিস্তারিত পায় না। মৈনাক জানিয়েছিল, ফিল্ড ডিউটিতে যাবার আগে। তারপর থেকে প্রায় সপ্তাহ গড়াতে চলল, যোগাযোগ নেই। রোজ কত তাজা সৈনিকের প্রাণ যাওয়ার বা আহত হবার খবর আসছে খবরে। মৈনাক কেমন আছে? বাবা-মা ভয়ে আতঙ্কে তটস্থ। নূপুরও কেমন অদ্ভুত রকমের চুপচাপ হয়ে গেছে। 



তারপর সেই অমোঘ দিনটা এল। একটা ফোন। শুনেই মৈনাকের মা জ্ঞান হারিয়েছে, বাবা হতবাক। লোকজন, খবরাখবর, ততক্ষণে টিভিতে ঘোষণা হয়েছে ইণ্ডিয়ান আর্মির মৃত ও আহত সৈনিকদের অফিসারদের নামের তালিকা। তাতে লেফটেন্যান্ট মৈনাক মুখার্জির নামটাও রয়েছে। শুনেই দলে দলে লোকজন আসছে, নূপুর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নূপুরের বাবা-মা সব দেখভাল করছে। কফিনবন্দী হয়ে, জাতীয় পতাকা মুড়ে প্লেনে চেপে এল আর্মি অফিসার মৈনাকের দেহ। সত্যি সত্যিই মৈনাক অবর্তমান হয়ে গেল।



কাজকর্ম মিটেছে। নূপুরকে বাবা মা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। নূপুর যায় নি। মৈনাকের বাবা মায়ের কাছে থেকে গেছে। আশ্চর্য রকমের শান্ত, ধীরস্থির হয়ে গেছে,একসময় মুখে কথার খই ফোটা নূপুর। আছে তিনটে প্রাণীতে জড়িয়ে মড়িয়ে অতবড়ো বাড়িটার দুটো মাত্র ঘরে। সময় সবেতেই বড়ো প্রলেপ দেয়। মৈনাকের বাবা মায়ের শোকেও প্রলেপ পড়েছে কিছুটা। আজকাল নির্মলেন্দু আর নূপুরকে বাজার দোকান কোথাও যেতে দেয় না। টুকটুক করে নিজেই করে। অনুপমাও রান্নাবান্নার জন্য একটি মেয়েকে বহাল করেছে। নিজেও রান্নাঘরের ধার মাড়ায় না, নূপুরকেও মাড়াতে দেয় না। বছর ঘুরে গেল। নূপুর শাশুড়ির পাশে বসে সিরিয়াল দেখছিল। মনটা ওর পিছিয়ে গিয়েছিল। আফশোষ হলো, "অমন করে দোলনার খোঁটাটা না দিলেই হতো মৈনাককে!" কলিং বেলের আওয়াজ শুনে অনুপমা নিজে নিজেই গেল দরজা খুলতে। নূপুরকে উঠতে দিল না।




অনুপমা গিয়ে ওপর থেকে নূপুরকে ডেকে নিয়ে এল। কাঁদছিল নূপুর, অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তারপর কিছুদিন পরে খুব চেনা পরিচিত কয়েকজন আর নূপুরের বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে নূপুরের সাথে দেবমাল্যর রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল। এবারে কন্যাপক্ষ নির্মলেন্দু, মৈনাকের বাবা, অর্থাৎ নূপুরের শ্বশুর। দেবমাল্য নূপুরকে বিয়ে করে নিজের ফ্ল্যাটে দমদমে নিয়ে সংসার পাতল। আর নির্মলেন্দু আর অনুপমা বোধিবৃক্ষের ছায়ার মতো আগলে রাখল নূপুরকে, নূপুরের সংসারকে।




দেখতে কুড়ি বছর পার। নূপুর আর দেবমাল্যর দুই মেয়ে, যমজ। উত্তরপাড়ায় আর দমদমে যাতায়াত করেও নূপুর আর দেবমাল্য গুছিয়ে সংসার করেছে।

অনুপমা আর নির্মলেন্দু দুজনেই মারা গেছে, মাস কয়েকের আড়াআড়িতে। নূপুরের বাবা মাও দাদার সংসারে। তবে নির্মলেন্দু অনুপমার উত্তরপাড়ার বাড়ি নূপুরের নামে। বাড়িটা অনেকবছর সংস্কার হয় নি। নূপুররা ঠিক করেছে দমদমের ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে আসবে। মেয়েরা দুজনেই পড়াশোনার খাতিরে অন্য শহরে। উত্তরপাড়ার বাড়ির রেনোভেশন শেষ হতেই চলে এল নূপুররা উত্তরপাড়ায়। সব সুন্দর করে সাজানো গোছানো হয়েছে ঠিকই, তবে আগের মতই রেখে। শুধু পুব দক্ষিণের বারান্দাটা ফাইবার গ্লাস দিয়ে ঘেরা হয়েছে। আর দোলনাটাকে রং করানো হয়েছে, জং পড়েছিল। সেবার ছুটি শেষে মৈনাক জম্মুতে ফিরে যাওয়ার পর মৈনাকের বাবা মা আর একদিনের জন্যও দোলনাটায় বসে নি। তারপর তো কতকিছু হয়ে গেল। আচমকা সবকিছু ওলটপালট।




পুব দক্ষিণের ঘেরা বারান্দার দোলনাটায় নূপুর রাখল অনুপমা আর নির্মলেন্দুর একটা বাঁধানো ছবি। কোলে ছোট্ট মৈনাককে নিয়ে। নূপুর আঁচল দিয়ে ছবিটাকে মুছে দিয়ে দোলনাটা একটু দুলিয়ে দিল। নূপুর একদৃষ্টে সোজা তাকিয়ে আছে ঝুলন্ত দোলনাটার দিকে। ছবির তিনটে মানুষের মুখে বয়স থমকে দাঁড়িয়ে। কার কত বয়স? কে করবে সে হিসেব? কী অপার্থিব ভালোবাসার দ্যুতি ছবির মানুষ তিনজনের মুখে! সত্যিই তো ভালোবাসার কী কোনো বয়স হয়? নাহলে কেন এখন এই কুড়ি বছর পরে নূপুরের মনে পড়বে মৈনাকের চওড়া বুক, উজ্জ্বল চোখ, কোঁকড়ানো চুল, টিকলো নাক, স্মিত হাসি, মৃদু গম্ভীর গলার স্বর, তীব্র আশ্লেষের আলিঙ্গন, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য সেই চুম্বন? ভালোবাসার বয়স হয় না যে, তাই হয়তো!! দুটো ঝাপসা চোখে নূপুর দোলনাটা দুলিয়ে দিল আবার। বয়সবিহীন অনন্ত ভালোবাসা দুলছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics