Sanghamitra Roychowdhury

Drama Horror Classics

3.8  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Horror Classics

সেলুলার জেলে

সেলুলার জেলে

6 mins
1.6K


বিমানসেবিকার মাপা ছন্দের প্রায় যান্ত্রিক ঘোষণায় অভীপ্সার শরীরে মৃদু ঝাঁকুনি। সিটবেল্ট বাঁধার নির্দেশ। অবতরণ আসন্ন। চোখটা বোধহয় ওর ভালোই লেগে গিয়েছিলো। খুব ভোরে উঠতে হয়েছে তো, তায় শেষ ডিসেম্বরের জাঁকানো কনকনে শীতে কাবু দক্ষিণবঙ্গ... এদিকে সকাল সাড়ে ছ'টার ফ্লাইটের রিপোর্টিং টাইম ভোর সাড়ে চারটে। তার থেকে আরো তিন ঘন্টা পিছোতে হবে। রাত দেড়টায় কাঁচা ঘুম ভেঙে তৈরি হয়ে ফ্লাইট ধরতে যাওয়া। ভোরে যতই ফাঁকা রাস্তা থাকুক না কেন, চুঁচুড়া থেকে দমদম পৌঁছতে কমবেশি একঘন্টা সময় তো লাগবেই। সেই হিসেবেই অমর্ত্য গাড়ি বলে রেখেছিলো। নিজেদের গাড়ি নেওয়া যাবে না। দশদিনের ট্রিপ। কাজেই কার-রেন্টাল, চেনাজানা। তা সে আবার চেনাজানা মানে এমন চেনাজানা, যে সাড়ে তিনটেয় রওনা হবার কথা, আর এদিকে সে রাত আড়াইটেয় গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। এবারে বেচারির ঘুম তাড়াতে অভীপ্সাকেই তাড়াহুড়োর মধ্যে দু-দু'বার চা করে খাওয়াতে হলো। অমর্ত্য তো হুকুম করেই খালাস। তখন থেকেই অভীপ্সার মেজাজটা সপ্তমে চড়ে বসেছিলো। তারপর আবার শেষমুহূর্তের প্যাকিং থেকে দরজা জানালা বন্ধ করে তালা লাগানো পর্যন্ত সবটাই অভীপ্সার দায়িত্ব। আর বাপ-বেটিতে কেবল ট্যুরিস্ট গাইড বুক, বাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিয়ে পড়ে আছে। পারেও বটে! অভীপ্সার প্রথম থেকেই এই ভোরের ফ্লাইটে আপত্তি ছিলো। কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্সির সেট করা প্রোগ্রাম। নড়চড় হবার জো নেই। ওদের রুটিনই মানতে হবে। অভীপ্সার রাতে ঘুম না হলে খুব কষ্ট হয়। সেই ঘুমটাই খানিকটা পুষিয়ে গেলো ফ্লাইটে বসে জাপানি কায়দার একটা শর্ট ন্যাপে। সিটবেল্ট বাঁধার আগে কব্জি উল্টে ঘড়িটা দেখে নিলো অভীপ্সা... ওরেব্বাবা, ঘন্টা দেড়েক ঘুমিয়েছে!

সবেমাত্র আগের দিনই স্কুল ছুটি পড়েছে। একদম ফুরসৎ পায়নি। এই দশদিনের ট্রিপ যথেষ্টই শ্রমসাধ্য। "যাকগে, কী আর করা যাবে", ভাবতে ভাবতেই প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো অভীপ্সা। মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে গেলো। নীচে বঙ্গোপসাগরের কোলে ছবির মতো বিছিয়ে আছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। অবশ্য পোর্টব্লেয়ারের দিকটাই ও দেখতে পাচ্ছে ওর সিট থেকে। সকালের ঝগড়া লাগবো লাগবো পরিস্থিতি ভুলে অভীপ্সা হাত বাড়িয়ে খামচে ধরলো অমর্ত্যর হাত। অমর্ত্যও অভীপ্সার ঘাড়ের পেছন দিয়ে কচ্ছপের মতো গলা বার করে বুঝলো বরফ গলে জল। অমর্ত্য ও অভীপ্সার বাইশ বছরের দাম্পত্যের সফল ফসল ওদের একমাত্র আঠেরো বছরের মেয়ে অভিষিক্তা। সে আবার সঙ্গীত অন্তপ্রাণ। সর্বক্ষণই কানে ইয়ারফোন গোঁজা। গান শুনছিলো মাথা নেড়ে নেড়ে। পোর্টব্লেয়ারের আকাশসীমা থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্যের সম্ভার দেখাতে বাবা মা'কে ডাকতে গিয়ে বাবা মায়ের রোমান্টিক ভঙ্গিমায় প্রকৃতিদর্শন দেখে মুচকি হেসে চোখ জানালার বাইরে ঘোরালো। স্বস্তিও পেলো, "গোটা ট্রিপ জুড়ে বাবা মায়ের ঝগড়ার সম্ভাবনা আপাতত জিরোর নীচে স্থিতিশীল মনে হচ্ছে।"

কাঁচা ঘুম ভেঙে ফ্লাইট ধরতে আসার বিরক্তি আর টেনশনের কালো মেঘ আপাতত অভীপ্সার মনের কোনো কোণেও আর নেই। পোর্টব্লেয়ারে নামার আগেই অভীপ্সার মন একেবারে ঝকঝকে পৌষালি রোদধোয়া নীলাম্বরী আকাশ। পৌঁছনোর দিনটায় দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে শুরু হবে ট্যুর অপারেটরের রুটিন অনুযায়ী বেড়ানো। প্রথমদিনে বিকেলের আগেই করভিন্স কোভ বিচে ঘুরে তারপর সন্ধ্যার আগেই সেলুলার জেলে যাওয়ার কথা ছিলো লাইট অ্যাণ্ড মিউজিক শো দেখতে। কিন্তু বাদ সাধলো বৃষ্টি। তার অযাচিত আগমনের কারণে বিচেই যথেষ্ট দেরি হওয়ায় সেদিনের সেলুলার জেল পরিদর্শন বাতিল করতে হলো। কারণ শোয়ের আগেই পুরোটা ঘুরে দেখে নিতে হবে। অত বিরাট এক চত্বর জোড়া ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত বা বিখ্যাত যাই হোক সেলুলার জেল আদতে... বর্তমানে দর্শণীয় বটে! তবে সেদিন অভীপ্সাদের হাতে অতটা সময় নেই। সুতরাং ট্যুর অপারেটর সেলুলার জেল পরিদর্শনের সঙ্গে শেষদিনের শপিং পর্বটি এক্সচেঞ্জ করে দিলো। এ একদিকে বেশ হলো। অভীপ্সার পরিবারের কেউ অত শপিংপ্রেমী নয়। আর বৃষ্টির সময়ে বুদ্ধি আর সামান্যকিছু টাকা খরচ করে দরাদরি করে অভীপ্সা বিচের আশ্রয়দাতা দোকানটি থেকেই মেয়ের, নিজের আর গিফটের জন্য কোরালের টুকিটাকি গয়নাগাটি কিনে নিলো। অমর্ত্য ওকে কিপটে বলে, তাতে অবশ্য ওর কিছু যায় আসে না। ঐ ঢাকঢোল পিটিয়ে শপিং ব্যাপারটা অভীপ্সার ধাতে পোষায় না। বিচ থেকে সবাই শপিং-এ গেলো। আর অভীপ্সার পরিবার হোটেলে ফিরে গেলো। পরেরদিন ভোরে আবার নীল আইল্যাণ্ডে যাওয়া। ওখানে দু'রাত, ওখান থেকেই সোজাসুজি হ্যাভলক আইল্যাণ্ড... সেখানেও দু'রাত। সুতরাং এই চাররাতের মতো জামাকাপড় এবং টুকিটাকি গোছগাছ করে নিতে হবে। বাকিটা লাগেজ পোর্টব্লেয়ারের হোটেলেই রাখা থাকবে। দুপুরেও বিশ্রাম হয়নি। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। অভীপ্সারা একটু আগেই ডাইনিং হলে পৌঁছলো। একদম ফাঁকা। শুধু একেবারে কোণের দেওয়াল-ঘেঁষা টেবিলের শেষপ্রান্তের চেয়ারে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। অদ্ভুত কায়দায় টুপিটা কপালের ওপরে নামানো। খুব চেনাচেনা লাগছে ভদ্রলোককে অভীপ্সার। ঠিক মনে পড়ছে না। খাদির পাঞ্জাবি ধুতিতে তো বাঙালিই লাগছে। হয়তো এয়ারপোর্টে বা ফ্লাইটে দেখেছে। পর্যটকই হবেন হয়তো। অভীপ্সাদের হোটেলেইতো আরো কয়েকটি বাঙালি ট্যুরিস্ট দল রয়েছে। তাদেরই কেউ হয়তো। তবুও খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অভীপ্সার চোখ চলেই যাচ্ছে বারবার করে ভদ্রলোকের দিকে। হলে একজন দু'জন করে লোক বাড়ছে, তবে বৃদ্ধ মানুষটি একলাই। অভীপ্সা অতটাও আলাপী গোছের নয় যে নিজে যেচে গিয়ে আলগা খাতির জমাবে। মেয়ের কান বাঁচিয়ে অমর্ত্য ফিসফিসিয়ে বলে, "দেখো, আবার এই মধ্যবয়সে আমার কপালটি ফাটিও না। কাকে দেখছো বলোতো তখন থেকে?" অমর্ত্য দ্রুত একবার ডাইনিং হলের এমাথা ওমাথা চোখ বুলিয়ে নিলো। সন্দেহজনক কিছুই ওর চোখে পড়লো না।

এর পরদিন থেকে ঝটিকা সফর শুরু হলো। দু'দিন নীল আইল্যাণ্ড, দু'দিন হ্যাভলক আইল্যাণ্ড, একদিন বারাটাং লাইমস্টোন কেভ, মাড ভলক্যানো, জারোয়া প্যাসেজ, একদিন রস আইল্যান্ড, একদিন নর্থ বে কোরাল আইল্যাণ্ড, চিড়িয়া টাপু এবং মেয়ের স্কুবা ডাইভিং ও ওয়াটার স্পোর্টস সেরে শেষ দু'দিনের একদিন পোর্টব্লেয়ারের সব মিউজিয়াম ও ফিশ অ্যাকোয়ারিয়াম। আর অবশেষে বিকেলে সেলুলার জেল পরিদর্শন এবং লাইট অ্যাণ্ড মিউজিক শো দেখা। তারপর ফেরার আগের রাতে নিউইয়ার পার্টি। এই প্ল্যান অনুযায়ী দৌড়ঝাঁপে এই ক'দিনের মধ্যে অভীপ্সার আর একবারও হোটেলের ডাইনিং হলে দেখা বৃদ্ধের সাথে দেখা হয়নি। ভুলেই গিয়েছিলো অভীপ্সা ভদ্রলোকের কথা। আবার ভদ্রলোককে অভীপ্সা দেখতে পেলো সেলুলার জেলে গিয়ে। সাভারকারের সেল দেখে শিহরিত অথচ বিষণ্ণ মনে সিঁড়ির দিকে এগোবার সময় মুখোমুখি ভদ্রলোককে দেখে অভীপ্সার আবার মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে ও ভদ্রলোককে। ঋজু টানটান মেদহীন দীর্ঘকায়, বয়স কত হবে?... কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। অভীপ্সা হাসবো কি হাসবো না ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোক পাশ দিয়ে পার হয়ে গেলেন। অবশ্য ভদ্রলোকের মুখেও কোনো পরিচিতের হাসিঝলক দেখেনি। বিকেল প্রায় শেষ। পা চালিয়ে দ্রষ্টব্য বাকিটুকু দেখা ও গাইডের মুখে শোনা ইতিহাসে মন দিলো অভীপ্সা মেয়ের হাত ধরে। ঝপ করে দিনের আলো ফুরোতেই শুরু লাইট অ্যান্ড মিউজিক শো। বিশাল চত্বরের সামনের দিকটায় দর্শকাসন। চারিদিকে বিশাল বিশাল লম্বা চওড়া ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিংগুলোর প্রাথমিক মোট সাতটি ব্লকের মধ্যে বেশিটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত... অক্ষত তিনটি বিশালাকৃতির ব্লকই কেমন ছায়াচ্ছন্ন এক পরিবেশ তৈরি করেছে। তিনটি তল জুড়ে দূরে দূরে সেলে জ্বলতে থাকা বাল্বের টিমটিমে হলদেটে আলোয় মায়াবী কুহকিনী পরিবেশ পরিপূর্ণ হলো লাইট অ্যাণ্ড মিউজিক শোয়ের আবহসঙ্গীত শুরু হতেই। রুদ্ধশ্বাস উপস্থিত দর্শককুল।

শো চলাকালীন দর্শকাসনে পিনপতনের স্তব্ধতা ভাঙলো মৃদু খচমচ আওয়াজে। অভীপ্সা বাঁদিকে তাকালো। কী কাণ্ড! ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে অভীপ্সার বাঁদিকের খালি চেয়ারটায় বসেছেন। চেয়ারটা একটু নড়বড়ে ছিলো। তাই প্রথম সারিতে হওয়া স্বত্তেও তখনো ফাঁকাই পড়েছিলো চেয়ারটা। ভদ্রলোক যে বসলেন... চেয়ার ভেঙে পড়বেন না তো আবার? অভীপ্সার ডানপাশে অমর্ত্য, তার ওপাশে মেয়ে অভিষিক্তা বসেছে। অভীপ্সা ডানদিকে ফিরে আশঙ্কার কথাটা অমর্ত্যকে বলতে চাইলো, কিন্তু বলা হলো না। শোয়ের ধারাবিবরণী চলছিলো তখন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ফাঁসির কথা বলা চলছিলো তখন... লাইট পড়েছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। সবাইয়ের সাথে অভীপ্সার চোখও সেদিকে। কিন্তু একী? এ কী দেখছে অভীপ্সা? ওর পাশে বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ফাঁসির মঞ্চের কাঠের পাটাতনের উপর? চট করে বাঁদিকে তাকালো অভীপ্সা। পাশের চেয়ারটি শূন্য। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে অভীপ্সার স্লাইড শোয়ের মতোই মনে পড়ে গেলো ভদ্রলোককে ও ঠিক কোথায় দেখেছে। অভীপ্সার বাপেরবাড়িতে বাবার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সাদাকালো ছবিতে দেখেছে ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক অভীপ্সার ঠাকুরদার বাবা। বিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকে কালাপানিতে অর্থাৎ আন্দামানে... ব্রিটিশ সরকারের সেলুলার জেল থেকে পালানোর চেষ্টার অপরাধে মাসখানেকের অকথ্য অত্যাচারের পরে বিনা বিচারে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়েছিলো বড়োবাবাকে। অনেক মুখ ঘুরে বড়োবাবার সেই দুঃসংবাদ বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলো। হ্যাঁ, ছোট্ট থেকে তাই শুনেই বড়ো হয়েছে অভীপ্সা। বড়োবাবা নামেই স্বাধীনতা সংগ্রামী ভদ্রলোকের পরিচয় অভীপ্সাদের পরিবারে। তাঁর ফাঁসির সময়ে অভীপ্সার ঠাকুরদা ভূমিষ্ঠও হননি। উনি পস্থুমাস শিশু ছিলেন... বড়োবাবার মৃত্যুর মাসখানেক পরে জন্মেছেন। তবে ছবিটি অবশ্য ছিলো তারও অনেক আগেকার। প্রতিশ্রুতিমান বড়োবাবার কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায়, একেবারে তরুণ বয়সের... বোর্ন অ্যাণ্ড শেফার্ডে তোলা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama