মালতীলতা
মালতীলতা
মাধবীলতার যখন বয়স সতেরো পেরিয়ে আঠেরো, তখন ওর এক বোন হলো... মালতীলতা। বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান। এই মালতীলতার জন্মের খবরে সবথেকে অখুশি হয়েছিলো মাধবীলতা। মুখ ফুলিয়ে হাঁড়ি করেছিলো... কতকটা লজ্জায়, আর বাকিটা হিংসায়। মালতীলতা অবশ্য শৈশব থেকেই কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিলো যে তার থেকে এই আঠেরো বছরের বড়ো দিদিটিকে তার একটু বাড়াবাড়ি রকমের তোষণ করেই চলতে হবে। আধো-আধো বোলেই সেই তখন থেকেই দিদির বেজায় ন্যাওটা হয়ে উঠলো ছোট্ট মালতীলতা। মাধবীলতাও এতো ছোট বোনটাকে একেবারে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারতো না, ঐ চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার মতো কোনোমতে লোকদেখানো ভালোবাসাটুকু ভালোবাসতো... অবশ্যই প্রবল আন্তরিক অনিচ্ছায়।
তারপর মালতীলতার বয়স যখন ঠিক সাত, তখন ওর দিদি মাধবীলতার বিয়ে হলো। খুব খুশি হয়েছিলো মালতীলতা, যখন দিদির যমজ ছেলেমেয়ে হলো বছর দুয়েকের মধ্যেই। মালতীলতার তখন সবে নয় বছর, ভাবতো, "আমার থেকেও ছোট এরা? ক'দিন বাদে নাকি এরা আবার আমায় মাসী ডাকবে!" খুশিতে ডগমগ মালতীলতা ভারী ব্যস্ত হয় বোনপো বোনঝিকে নিয়ে। তারপর ছ'টা বছর গড়াতে না গড়াতেই বাবা চলে গেলেন। পনেরো বছরের মালতীলতা তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তার বছর পাঁচেক পরে মাও চলে গেলেন হুট করে। মালতীলতা পাসকোর্সে বিএ পরীক্ষা দেবে তখন। দিদি তখন ঘোর সংসারী। এক মুহুর্তও সময় নেই দিদির নিজের সংসারের দায় দায়িত্বের বাইরে তাকান
োর। সুতরাং, মালতীলতা বাবা মায়ের বাড়ি আগলে একলাই রইলো। উপায় ছিলো না আর কোনো... নিজের দায়িত্ব পুরোপুরি নিজেই নেওয়া ছাড়া। তারপর অক্লান্ত খেটেখুটে পরীক্ষা দিয়ে, পাস করে একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে ফেললো মালতীলতা... ক্লার্কের। তখনও ঘোরতর সংসারী দিদির মোটেই সময় নেই বোনকে নিয়ে একতিলও ভাবার।
দিন মাস বছর যায় নিজের নিয়মে, নিজের গতিতে।জামাইবাবু গত হয়েছেন বেশ কিছুকাল। বর্তমানে দিদির দুই ছেলে-মেয়েই বিদেশে কর্মরত... সংসার-ধর্ম করে তারা ওখানেই থিতু হয়েছে বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে। ব্যস্তসমস্ত কেতাদুরস্ত যান্ত্রিক জীবন যাপনে তারা অতিমাত্রায় অভ্যস্ত। তাই তারা তাদের প্রৌঢ়া ও খানিক সেকেলে মায়ের দায়িত্ব নিতে অপারগ। সাফ জানিয়েছে তারা সেকথাই। অগত্যা কলকাতায় স্বামীর ভিটে... মানে তিন কামরার ফ্ল্যাটখানা আঁকড়ে একলাই পড়ে রইলো মাধবীলতা। খোঁজখবর বোনই রাখে... মানে মালতীলতা।
মালতীলতা নিজের এক সহকর্মীকে বিয়ে করবে ভেবেছিলো। অনেকদিনের মেলামেশা সম্পর্ক দু'জনের। তবে সেই হবু বর আবার কোনো অবস্থায়ই মালতীলতার দিদির দায়িত্ব নিতে দিতে চাইলো না তাদের নির্ঝঞ্ঝাট হবু সংসারে। হবু স্বামী রাজি হলো না বলে মালতীলতাও শেষমেশ সম্পর্কটাই ভেঙে দিলো। এখন তারা দুই বোনে আছে বাবা মায়ের বাড়িতে একসাথে। মাধবীলতা জড়িয়ে রয়েছে মালতীলতাকে। এতোদিনে বুঝেছে মাধবীলতা, মালতীলতার কাণ্ডের জোরটা যেন কিছু বেশিই আছে!