Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Others

5  

Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Others

নিঠুর সমাজ

নিঠুর সমাজ

13 mins
1.0K


খুব সকালেই শোবার ঘরের ঠিক পাশে অনিমা কামীমার বাড়িতে অনেক মানুষের চেঁচামেচি আর গোলমালে অপুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দেখে ,তার মা দিদিদের মুখ থমথমে চোখে জল।

অপু মা কি জিজ্ঞেস করে "কী হয়েছে মা! কামীমার বাড়িতে এত গোলমাল কীসের!"

মা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "প্রকাশ ঠাকুরপো কাল রাতে গোপনে বাড়িতে এসেছে, পাওনাদার গুলো সব এক একটা অমানুষ, লাঠি সোটা নিয়ে সদরের দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে ঢুকেছে, টাকা না শোধ করলে পিটিয়ে মারবে।শোবার ঘরের কপাটে খিল লাগিয়ে ওরা সব ঘরের ভিতরে ।"


প্রকাশ কাকুর স্ত্রী অনিমা কামীমা অপুকে ভীষণ ভালোবাসে স্নেহ করে। আর তার বড় মেয়ে কৃষ্ণা অপুর সমবয়সের বন্ধু,একই সঙ্গে তখন তারা ক্লাস ফাইভে পড়ে।


দুঃখে হতাশায় অপুর চোখে জল, ভীষণ ভয়ে কেমন অজানা আশঙ্কায় তার পা যেন টলমল করছে।

ভয়ার্ত্ত মুখে বলে "আমি দেখে আসব মা!"

মা নমিতা নিষেধ করে বলে,"তোর বাবা সকালেই অনিমাদের বাড়ি গেছিল, ওদের হাবভাব ভালো নয়, শরৎ বাবুকে তোর বাবা খবর দিতে গেছে।"


শরৎ মন্ডল, গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি,সচ্ছল শিক্ষিত সৎ মানুষ, স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর কোন রাজনৈতিক দল করেন না।এখন সামাজিক আর সাংস্কৃতিক কাজ নিয়ে থাকেন। গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে।


একটু পর অপুর বাবা হরিনাথ বাড়ি এলেন, তিনি স্কুল শিক্ষক, মুখচোখে উদভ্রান্ত আতংকিত চাহনি। একটু যেন আশান্বিত। মাকে বলল," শরৎ দা এসেছেন যখন নিশ্চয় একটা সুরাহা হবে।"

অপু আর থাকতে পারে না, ছুটে পাশেই অনিমা কামীমার বাড়ি গেল।শোবার ঘরের ভিতর থেকে আতঙ্ক গ্রস্থ অনিমা কামীমা ও ছেলে মেয়েদের কান্না আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চব্বিশ পঁচিশ জন মানুষ তাদের কারো হাতে লাঠি আবার কারও হাতে লোহার শবল। তাদের মুখচোখ উগ্র চন্ডাল, শোবার ঘরে ধাক্কাধাক্কি করছিল। 

শরৎ মন্ডল মশাইয়ের উপস্থিতিতে যেন আক্রোশ আক্রমনের উগ্র ভাব একটু হলেও কমেছে।

প্রকাশ কাকু বড় উচ্চআকাঙ্খী, ছোট খাটো এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অন্য ভায়েদের মত সেও কলকাতায় কাজ করত।গ্রামে অনিমা আর তার তিন মেয়ে,এক ছেলে থাকত। প্রকাশ সপ্তাহে এক দিন গ্রামে আসত। কাজ ছেড়ে দু বছর হল ধান কারবারের ব্যবসা শুরু করে।গ্রামের চাষীদের কাছে ধান কিনে রাইস মিলে পাঠাত।প্রতি বস্তা ধান ষাট কেজি, বস্তা প্রতি সে কমিশন বা লাভ পেতো দেড় থেকে দুটাকা ,ধানের দাম বাড়া কমার উপর তা নির্ভর।

 

অপুর বাবাকে গর্ব করে প্রকাশ কাকা বলত,

"দাদা তুমি হাইস্কুলের শিক্ষক,বারো বছর চাকরী করে মাসে কত পাও! চারশো!"

বাবা বলত "না রে তিনশো আশি।"

প্রকাশ কাকা বাবাকে বলত "আমি যদি তেমন বাজার পাই।এক সপ্তাহে যদি দুই লরি ধানের কারবার করতে পারি ,হাসতে হাসতে চারশো টাকা লাভ আসবে।"

সালটা তখন উনিশশো একাত্তর কি বাহাত্তর।

এই ধানের কারবার করতে করতে তার দশ হাজার টাকা মূল্যের ধান ,রাইস মিলে দিলেও পাওনা টাকা বার বার তাগাদা দিয়ে সে পাচ্ছিল না।গ্রামের চাষী শুনবে কেন ! তারা রাইস মিল চেনে না,গ্রামের ধান ব্যাপারী প্রকাশকে চেনে ।পাওনাদারদের বার বার টাকার জন্য তার কাছে আনাগোনা বাড়তে থাকায়, ব্যবসা সাময়িক বন্ধ করে, গ্রাম থেকে সে গা ঢাকা দেয়।

গতরাতে বাড়ি এসেছিল, স্ত্রী ছেলে মেয়েদের সংসারের কিছু খরচ গোপনে দিতে।আগেও ক বার গোপনে এসেছিল,পাওনাদারদের নজর পড়েনি বা তারা সবাই সংগঠিত হয়ে আক্রমন করার আগেই ভোড় ভোড় গ্রাম ছেড়ে সে পালিয়েছিল। আজ পারে নি।এক প্রহর রাত থেকেই পাওনাদারা তার বাড়ির ঘিরেছিল।

আজ একটা হস্তেনেস্ত করবেই।টাকা আদায় করবে বা মেরে ওর হাড়গোড় ভাঙ্গবে।প্রহারের মাত্রা বেশি হলে ভবলীলা সাঙ্গ। গন ধোলাইয়ে মৃত্যু হলে, শাস্তির ভয় থাকে না।জন আক্রোশ, বহু মানুষের হিংসা তান্ডব,কে দোষী কে বা নির্দোষ প্রমাণ করা কঠিন ! গ্রামের মানুষ হলেও সামান্য ধান চুরির অপরাধে সন্তোষ বাগ্দীকে গ্রামের জানাশোনা মানুষ গুলোই এমন মার মেরেছিল। বেচারা মারা যায়।সে তো এই ছ মাস আগের ঘটনা। তাই প্রকাশ কাকা ,অনিমা কামীমা ও তাদের ছেলে মেয়েদের অবস্থা কী করুন ,অনুমান করা যায়।

শরৎ বাবু আসাতে অনেকেই একটা ফয়শালা রফায় আসতে চায়।যারা মনে করে মারধর বা খুন করে হয়ত আক্রোশ ক্ষোভ মেটে, লাভ হয় না,বরং পুলিশের হয়রানি কিছুদিন হতে পারে। শরৎ বাবু তখন ষাট বছর ,অভিজ্ঞ মিতভাষী বিচক্ষন মানুষ ।উনার মেধা ও বিচার যুক্তিযুক্ত ও বাস্তব সম্মত আর নিরপেক্ষ।

 শরৎ বাবু বড় চাষী,তারও কিছু টাকা প্রকাশের কাছে পাওনা ছিল। তবে সবারই একক ভাবে দু চার শো টাকার বেশী কেউ পাওনা ছিল নয়।তখন চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা ধানের বস্তা। কেউ পাঁচ বস্তা কারও সাত বা দশ বস্তা ধান,চাষীরা প্রকাশকে বিক্রি করেছে।এক সপ্তাহের মধ্যেই ধানের টাকা প্রকাশ মিটিয়ে দিতো।এবার ছমাস হতে চলল, সামনে পূজোর খরচ। চাষ করে চাষীবাসীদের হাত খালি।সে যুগে দুশো টাকারও ভালো দাম,বিশেষত গ্রামের গরিব চাষীবাসীদের।

শরৎ বাবু বললেন, "কেউ প্রকাশের গায়ে হাত দেবে না।ব্রাহ্মণের ছেলে,আমি যতটুকু জানি ও প্রতারক নয় ,ওর সমস্যা শুনতে হবে। দরকারে আরও সময় দিতে হবে।হিংসা কোন সমাধান নয়,লাভও হয় না।সাময়িক উত্তেজনা,পরে অনুতপ্ত হতে হয়। সন্তোষ বাগ্দীকে যারা সামান্য এক বস্তা ধান চুরির অপরাধে মারছিলে, মরে যাবে হয়ত ভাবো নি! ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী যারা তাদের কী আজ অনুতাপ হয় না!"

দুচার জন বাদে সবাই বলল, "কথা দিচ্ছি শরৎ দা ওর গায়ে কেউ আমরা হাত তুলবে না।তবে দাদা আমরাও তো গরীব, আমাদের টাকাটা কীভাবে আদায় হয় আজই আপনাকে একটা মীমাংসা ওর সঙ্গে আমাদের করে দিতে হবে।"


শরৎ বেশ আত্মবিশ্বাসী বললেন, "আমি সাধ্য মত তোমাদের কথা ভাবব।"


এরপর শরৎবাবু অনিমা কামীমার শোবার ঘরের দরজায় আস্তে ঠোকা মেরে বলে,"প্রকাশ আমি শরৎ দা বলছি,তুমি দরজা খোলো,আমি থাকতে কেউ তোমার গায়ে হাত দেবে না।"


শরৎ মন্ডলের কথার দাম আছে, তাই সহসা শোবার ঘরের কপাট খুলে অনিমা কামীমা ছুটে আগে বেড়িয়ে এসে শরৎ মন্ডলের পা দুটো জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "ওকে বাঁচান,না হলে আমাকে চার ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনাহারে মরতে হবে।"


শরৎ মন্ডল আচমকা দশ পা পিছিয়ে গিয়ে কেমন হতচকিত হয়ে বলে,"এ কী করছ বৌমা!তুমি ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে, আমি চাষা সদগোপ আমার পায়ে হাত দিয়ে আমাকে পাপীর ভাগি করোনা।"

অনিমা কামীমার কোন হেলদোল নেই,সমানে হাউ হাউ করে কাঁদছিল।চার ছেলে মেয়ে যাদের বয়স দুই থেকে দশ এগার বছর তারাও ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হল।প্রকাশ কাকু আর বের হয় না।শরৎ বাবু ঘরে ঢুকে কী বললেন কে জানে। অপু দেখল মাথা নিচু করে প্রকাশ কাকা ঘর থেকে বের হল ।

সেদিনের ফয়শালা হল,প্রকাশ তার গ্রামের বাড়ি বেচে পাওনাদাদের টাকা মিটাবে। সে এক কুখ্যাত রাইস মিলের নাম করে প্রকাশ জানাল ,সেখানে ধান বিক্রি করে একটু বেশী লাভ পেতো, সেই লোভে ধান দিতো ।তার প্রায় দশ হাজার টাকা ঐ মিলে আটকে আছে।বার বার তাগাদা দিলেও তার টাকা সে পায়নি।একদিন রাত অবধি থাকতে বলে, সব টাকা মিটিয়ে দেবার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ঐ মালিকের এক কর্মচারী তাকে গোপনে সর্তক করে বলে,

"বাবু আপনি টাকার মায়া ছাড়ুন,প্রানে বাঁচতে হলে লুকিয়ে পালান। আরও কজন ধান ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের টাকা পাওনা হলে বার বার তাগাদা দিয়েছিল।এই ভাবে রাত অবধি পাওনা টাকা সব মিটিয়ে দেবে এই আশ্বাসে বসিয়ে রেখেছিল।আর তাদের কোন হদিশ মেলে নেই। যতদূর জানি আমার মিল মালিক, পোষা গুন্ডা মন্তান দিয়ে তাদের খুন করে রাইস মিলের চিমনীতে ফেলে গুম করে দেয়,তাদের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।"

প্রকাশ অসহায়ভাবে বলে"ঐ কর্মচারী আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত, আমি খুব বিশ্বাস করতাম। তাই ভয়ে তার পরামর্শ মত পায়খানা যাবার নাম করে আমি পালিয়ে আসি, আর যাই নেই।"

শরৎ মন্ডল বললেন "আমিও এমন শুনেছি,কিন্তু কোন প্রমাণ নেই ।আর ঐ মিলের মালিক খুব প্রভাবশালী ,বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ওঠাবসা।ক বছরে ওর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠার একটা রহস্য তো আছেই। এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু সে দ্বায়িত্ব গ্রামের চাষীবাসীরা নেবে না।তুমি বেশী লাভ করতে গিয়ে সব হারিয়েছ। কী ভাবে ওদের টাকা শোধ করবে বলো!"

প্রকাশ বলে,"আমার কিছুই নেই,এখন ব্যান্ডেলের কাছে একটা পাটকলে লেবারের কাজ করি।যা পাই আমার সংসারের খরচ হয় না"

গ্রামের মানুষ আবার হিংস্র হয়ে উঠছিল, প্রকাশ ভয় পেয়ে বলে,"শরৎ দা আপনি বলুন,আপনি যা বললেন তাই করব! কান ধরে সবার পায়ে ধরতে রাজি।"

শরৎ বাবু বললেন "ঐ সব করে কারও লাভ নেই টাকা শোধ হবে না। তুমি বরং তোমার এ গ্রামের বসত বাড়িটা বেচে দাও।যা টাকা পাবে ধার শোধ করো,এ গ্রামে তোমার আর সম্মান নেই,তুমি ভালো ঘরের ছেলে,তুমি গ্রাম ছেড়ে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে তোমার কর্মস্থলে চলে যাও।"

প্রকাশ কেমন চুপচাপ মাথা নামিয়ে কিছু ভাবছিল। তার উত্তরের ভরসা না করে অপু দেখল, "অনিমা কামীমা এ প্রস্তাবে রাজি।বলল,

"এ বাড়ী এ গ্রাম ছেড়ে আমরা চলে যাব।আমার স্বামীর যেন কোন ক্ষতি না হয়।"

প্রকাশ কাকা বলল,"আমার পরিবারের স্বার্থে আমি সবেতেই রাজী।"


বাড়ির দাম কিন্তু কত কেউ নায্য বলে না,কেউ কেউ দাম কমিয়ে দুই কেউ তিন হাজার টাকা বলে। শেষে শরৎ মন্ডল বললেন "এ বাড়ীর দাম মিনিমাম চার হাজার টাকা, কেউ না নিলে আমি কিনে নেবো।"

তখন এক পাওনাদার প্রকাশের প্রতিবেশী চার হাজার দিতে রাজী।কিন্ত তাতে তো পাওনাদার দের দাবী মিটবে না!প্রকাশে কাছে তাদের পাওনা পাঁচ হাজার টাকার কিছু বেশী।

এবার শরৎ বাবু গ্রামের মানুষদের ভৎসনা করে বললেন "এই লোকটার দশ হাজার টাকা, এক গুন্ডা মস্তান মেরে দিল,চাইতে গেলে মৃত্যুর ভয়,তার লোকবল আর রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে,তাই তার কোন অসুবিধা নেই। আর তোমরা কেউ দুশো কেউ চারশো টাকার জন্য একে মারতে এসেছ, খুন করতে চাও !"

কয়েকজন বলল,"ঠিক আছে যতটা শোধ হয় ঐ টাকায় করুক, যার যত পাওনা,সেই অনুপাতে বাড়ীর বিক্রির টাকা ভাগ হোক।"


 সেই শর্তে গ্রামের মানুষ প্রায় আশি শতাংশ টাকা পাবে, বাকী কুড়ি শতাংশ ছেড়ে দিতে রাজি। শরৎ বাবুর ভাগে পাওনা তিনশো টাকা,সেটা সবটাই অপুর অনিমা কামীমার হাতে আগাম তুলে দেওয়া কথা জানালেও বাকীরা সে পথে যায়নি।

প্রকাশকে, শরৎ মন্ডল আরও তার নিজের পাঁচশো টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয় । সেটা আগামী পাঁচ মাসে, প্রতি মাসে একশ করে, সে গ্রামের মানুষ হিসাবে সাহায্য করবে।


বাড়ি বিক্রি রেজিস্ট্রেশন,টাকার লেনদেন সব এ ঘটনার চার দিন মধ্যেই সম্পন্ন হয়।গৃহহীন প্রকাশ কে আর একটা দিনও থাকতে দিতে রাজী নয়।এ বাড়ীর নতুন মালিক সুদেব রায়।

অপুর বাবার খুড়তুতো ভাই প্রকাশ কাকা,যেদিন চিরকালের মত তার পূর্ব পুরুষদের জন্ম ভিটে ছেড়ে সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।অপু ভীষণ কেঁদেছিল। আর অপুর মা শোকে পাথর হয়ে অনিমা আর তার চার ছেলেদের বুকে জড়িয়ে কী ব্যাকুল ভাবে কেঁদেছিল। অপুর যখন মামার বাড়ির দাদুর, মৃত্যুর সংবাদ তার মামা হঠকারিতায় নিয়ে এসেছিল,সেদিনের মায়ের, বাবা হারানোর করুন কান্নাও,এ দিনের কান্নার কাছে বড়ই ম্লান ,ছোট্ট অপুর মনে হয়।

শুধুমাত্র আত্মীয় বা নিকট প্রতিবেশী নয়।অনিমা কামীমার যেমন অপুদের প্রতিটি ভাইবোনদের ভীষণ ভালোবাসত,স্নেহ করত।অপুর মা নমিতাও অনিমার চার ছোট ছোট শিশু সন্তানদের নিজের সন্তানের মত ভালোবাসত। তারা আর্থিক দুর্বল ছিল। তাই অনেক সময়ই তারা নমিতা জেঠিমার রান্নার ঘরে পাত পেড়ে খুশী মনে খেতো। বিশেষত বিভিন্ন উৎসব পার্বনে তাদের অপুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকতই।

হরিনাথ ততটা ধনী বা সচ্ছল ছিল না।তবু তাদের বিদায়ের দিন,প্রকাশকে দু শো টাকা দিয়ে বলে "কোনদিন যদি অভাবের কারনে বৌমা, ছেলে মেয়েদের মোটা খাবার আর পোষাকের সমস্যা হয়,লজ্জা না করে আমাকে বলবি।আমার সাধ্য মত সহযোগিতা করব।"

প্রকাশ কাকু ভীষণ আত্মসম্মানী ছিল।তাই সেই যে গ্রাম থেকে বের হল আর জীবনে এ গ্রামে পা দেয়নি।শরৎ বাবুর প্রতি মাসে একশো করে পাঁচ মাসের তার প্রতিশ্রুতি দিলেও, সে আর সেই অর্থ নেয় নি।কোথায় থাকে, কি করে, জানা ছিল না।প্রকাশ কাকু, কামীমা অপুর সহপাঠী তাদের বড় মেয়ে কৃষ্ণা বাকী আরও ছোট দুই বোন এক ভাই, সাত বছরের অদিতি,পাঁচ বছরের রতন, আর দুই বছরের শুভ্রা, এদের কোন খবর গ্রামের মানুষ জানত না।

গ্রাম ছাড়ার দিন অপুর স্পষ্ট মনে পড়ে অনিমা কাকীমা আর তার ছেলে মেয়েরা কেউ কাঁদেনি। মুখ চোখ হতাশায় শোকে কাতর, অজানা আশঙ্কা চোখে জল ছিল না।গ্রামেকে তারা ভালোবাসত।প্রকাশের অন্য ভাইরা গ্রামের বাড়ি তাকেই বেচে দিয়ে, কবে সেই গ্রামের মায়া কাটিয়ে কলকাতার শহরতলির কোন বস্তিতে বাসবাস করত।প্রকাশ শহরের ছোট খাটো কাজ ছেড়ে দিয়ে,তার কিছু জমানো টাকা নিয়ে গ্রামে ফেরে অনেক স্বপ্ন নিয়ে।ধানের কারবার শুরু করেছিল।

দুবছর মাথায় নিঃস্ব হয়ে, লজ্জা অপমান মাথায় নিয়ে গ্রাম ছাড়ে। কিছু টাকা পরিশোধ না করার অপরাধে। আর তার দ্বিগুণ বেশী টাকা প্রতারিত করে সে যুগের প্রতিষ্ঠিত ধনী এক রাইস মিলের মালিক ,রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট, যারা বাহাল তবিয়তে সুখে সাচ্ছন্দে আর সসম্মানে জীবন কাটায় নিরাপদে নির্ভয়ে ।

প্রকাশের পুরোন দিনের বাপ ঠাকুরদার বাড়িটা ক্রয় করে পরে ভেঙ্গে প্রতিবেশী সূদেব রায় তার খামার বাড়ি করেছিল। কোন দাঙ্গা হিংসা খুন ধর্ষন ছাড়াই অনিমা কামীমারা গ্রাম হারা বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তু হয়ে কোথায় হারিয়ে যায়। পৈতৃক বাড়ি ধুলিসাৎ হয়।

প্রায় তার ছ সাত বছর পর,অপু তখন গ্রামের স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারী বিজ্ঞান নিয়ে পাশ করে কলকাতার সিটি কলেজে গনিত অনার্স নিয়ে ভর্তি হল। হোস্টেলে থাকত। প্রতি শনিবার, সে হাওড়া স্টেশন থেকে বিকালে বর্ধমান গামী লোকাল ট্রেন ধরে গ্রামের বাড়ি ফিরত।সোমবার সকালে আবার ট্রেন যোগে হাওড়া হয়ে কলকাতায় তার হোস্টেল ফিরত।

একদিন বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎই ব্যন্ডেলে ট্রেন যখন দাঁড়াল,এক মহিলা ট্রেনে উঠে পাকা কলা বিক্রির করছে,মোটা কথায় রেল হকারী। ঠিক যেন অনিমা কামীমার মত।তবে একটু বয়স হয়েছিল একটু শীর্ন অবসন্ন,মাথার সিঁথিতে সিঁদুর নেই।সেই লম্বাটে মুখ, ফর্সা, লম্বা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির মত।শরীর চেহারা রোগা, টিকলো নাক চোখ, নিচের ঠোঁটের বাম দিকে বড় কালো তিল।

অপু আবেগ তাড়িত হয়ে ডাকে " কামীমা ও কামীমা!"


কোন উত্তর পায় না। 


তারপর আবার ডাকে, "অনিমা কামীমা' আমি অপু চিনতে পারছ না!"


এবার ঐ মহিলা তাকালো,কেমন যেন চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকেই নেমে গেল।ট্রেনটা একটু পর ছেড়েছিল। কিন্তু অপুর নিশ্চিত বিশ্বাস ঐ মহিলাই তার অনিমা কামীমা ।


বাড়িতে অপু এই অভিজ্ঞতার কথা বললে। মা বলে "তোর অনিমা কামীমা হয়ত লজ্জা দুঃখে তোর সাথে পরিচয় করতে চায় নি।তোর বাবা কার মুখে শুনেছিল, প্রকাশ ঠাকুরপো মারা গেছে। সে তো দুবছর হতে চলল।"

তারপর অপুর মায়ের মুখ কেমন দুঃখ বেদনায় খানিকক্ষন নীরব ,গভীর ভাবে কিছু স্মৃতিমন্থন করছিল। শেষে ভারাক্রান্ত মনে বলল,"বেচারীর ভাগ্যে এই ছিল! ছোট বেলা তোকে কী ভীষণ ভালোবাসত। যাক আর দেখা হলে পরিচয় করতে হবে না।ওতে ওর কষ্ট হবে, আবার ট্রেন থেকে লজ্জায় নেমে পালালে ওর ক্ষতি।"

এরপর অপুর নজরে তার অনিমা কামীমা একবার এসেছিল। তবে অপু আর ডাকাডাকি করেনি। তার অনিমা কামীমার শরীর তখন আরও ক্ষীণ দুর্বল, দারিদ্র্যতা তাকে গ্রাস করেছিল। এর দেড় বছর পর তখন অপু থার্ড ইয়ার।একদিন সোমবার নটায় বর্ধমান হাওড়ায় লোকাল ট্রেন থেকে নেমে সে প্লাটফর্ম ধরে হাঁটছিল,কলকাতার বাস ধরবে একটু ব্যস্ত। 

একটা মেয়ে বছর চৌদ্দ পনের জীর্ণ পোষাক শীর্ন চেহারা, হঠাৎই তাকে প্রনাম করে বলে "অপু দা ভালো আছো?"

অপু ভালো করে তাকিয়ে চিন্তা করছে কে মেয়েটি, এবার সে লাজুক মুখে বলল,"আমি অদিতি চিনতে পারছ না!"

অপু লজ্জিত হয়ে বলে "হ্যাঁ এবার বুঝেছি বোন,তুই অনেক বদলে গেছিস, তবে তোর এত ফর্সা রং , আর কপালে কাটা দাগটা দেখে অন্তত চেনা উচিত ছিল। তোরা কেমন আছিস! কামীমা খবর কী!"

" মা খুব অসুস্থ, কিডনি দুটোই খারাপ। ব্যান্ডেলের এক বস্তি বাড়িতে থাকে।"

"মায়ের শরীর কতদিন খারাপ!"

"ছমাস হয়ে গেল, তার আগে মা লোকাল ট্রেনে আর ব্যান্ডেলের প্লাটফর্মে কলা বেচত,আমি এইটে পড়তাম। "

"এখনে কী করছিস !"

"ভিক্ষা করি,ব্যান্ডেল হাওড়ার লোকালে আর হাওড়ার প্লাটফর্মে সকাল থেকেই ভিক্ষা করি,রাতে বাড়ি যাই। মাকে বোন দেখভাল করে।"

অপু দুঃখে কিছুক্ষণ নীরব থাকে, পরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে" তোর দিদি, রতন ওদের খবর কি ?"

"রতন তো মারা গেছে!"

বিষ্ময়ে হতবাক অপু বলে "বলিস কী! কি করে মরল!"

"একদিনের জ্বরে হঠাৎই মারা গেল। ওর শোকে বাবা কেমন আনমনা মনমরা হয়ে গেল, একদিন ডিউটি থেকে ফেরার সময় ট্রেনে কাটা পড়ল।"

"অপুর কেমন যেমন মনের ভিতরটা কষ্ট হচ্ছে।কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে ছাত্র তবু মানি ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা অদিতিকে দিতে যায়।

"অদিতি বলে দাদা তুমি তো পড়াশোনা করো,চাকরী করো না।এত টাকা দিলে তোমার অসুবিধা হবে না!"

অপু বলে,"সে তোকে ভাবতে হবে না। তুই এক কাজ কর, শনিবার আমি বিকাল পাঁচটায় বড় ঘড়ির নিচে থাকব,তুই আসবি।কামীমাকে বলে আসবি,সেদিন তুই আমার সাথেই আমাদের বাড়ি যাবি।"

"তোমাদের কথা খুব মনে হয়,জেঠু জেঠিমা সব ভালো আছে! "

"সব ভালো,কৃষ্ণার খবর কী বললি না তো !"

"ওর কোন খবর নেই, বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন

বাবা যে পাটকলে কাজ করত, ঐ চটকলে বাবার এক বন্ধু আমাদের বাড়ি আসত। বাবা মারা যাবার পর আমাদের অনেক সাহায্য করত। 

তিন বছর আগে মা তখন সুস্থ ব্যান্ডেল প্লাটফর্মে কলা হকারি করত।বাবার ঐ বন্ধু কৃষ্ণা দির একটা বিয়ের যোগাযোগ করে,দিদির তখন ষোল বছর, বারাসতের একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়।তখন ছেলেটারও বয়স কম দেখতেও সুন্দর। সে ডকে কাজ করত ।

কিন্তু গত দুবছর দিদির কোন খবর নেই, আসে না। ওরা যে ঠিকানা দিয়েছিল মা দুবার সেই ঠিকানায় গেছিল, ওখানকার স্থানীয়দের কথায়,জামাইবাবুর নামে কেউ নেই,কোনদিন ছিল না।মা দুঃখে এখনও কাঁদে ,বলে বাবার ঐ বন্ধুকে বিশ্বাস করে এ বিয়ে দিয়ে ভীষণ ভুল করেছে।"

"তোর বাবার বন্ধুর সাথে পরে কোন কথা হয়নি! "

"ওরা ঠিকানা আমরা জানি না।চুঁচড়া বাড়ি বলত, আর আসে না। রবিন কাকু নামেই জানতাম।"

অপু বলে " ভিক্ষা করে কত পাস!"

"যেমন যেদিন, কোনদিন দশ টাকা কোনদিন পনের আবার আরও বেশি ,হেসে বলে আজ তো তুমিই পঞ্চাশ টাকা দিলে । আমাদের চলে যায়, তবে মায়ের চিকিৎসা করতে পারি না"বলতে বলতে চোখে জল আসে,"মা কদিন বাঁচবে কে জানে। মা মরলে আমরা কী করব কোথায় দুবোন থাকব জানি না।" অদিতির দুচোখ জলে ভরে যায় ,মাথা নামায়।

অপু বলে "শনিবার তোকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। বাবা মা কে সব বলব।দরকারে তোরা সবাই আমাদের গ্রামে ফিরে যাবি।"

"অদিতির আশায় চোখ আনন্দে চিক চিক করে। আমি মাকে বলব,আর শনিবার তোমার সাথে যাবো।"

সেদিন আর অপু দেরি করেনি। কলেজের তাড়া ছিল। কিন্তু শনিবার অপু অদিতির জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে ছিল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। পাঁচটায় অদিতিকে আসতে বলেছিল ,কিন্তু সাতটা পাঁচের ট্রেন না ধরলে গ্রামের লাস্ট বাস বর্ধমান থেকে পাবে না।তাই আর অপেক্ষা করতে পারেনি।অপুর ভীষণ দুঃখ আফসোস হয়। ভাবছিল কামীমা আবার অদিতিকে তার সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে কিনা!

অদিতির সাথে দেখা, আর সব কথা অপু বাড়িতে বললে,তার বাবা মা দুজনেই রাজী হয়,"ওদের সবাই কে নিয়ে আসবি,না হলে সংসারটাই হারিয়ে যাবে। তিনটে মানুষকে ঠিক খাওয়াতে পারব।"

দরকারে অদিতির সাথে ওদের বাড়ি যাবার কথাও অপুকে তার মা নমিতা বলেছিল।অপুর দাদা ব্যাঙ্ক চাকুরে, এখনও বিয়ে হয়নি।বাবার আরও চার বছর শিক্ষকতার চাকরী আছে। তিন দিদির ভালো বিয়ে হয়েছিল ।অপুদের এখন সচ্ছলতা ছিল।

পরের সোমবার অপু যখন বর্ধমান থেকে ট্রেন উঠল, অভ্যাস মত এক দৈনিক খবরের কাগজ কিনে নিয়ে পড়ছিল। হঠাৎই এক খবরে সে চরম দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল তার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে,শরীর খারাপ লাগছে।চরম হতাশায় দুঃখে দুচোখ জলে ঝাপসা।

 

খবরটি শিরোনাম ছিল "অজ্ঞাত পরিচয় ধর্ষিতা নাবালিকার মৃত্যু।" পরে নিচে লেখা "গত শুক্রবার রাতে হাওড়ার স্টেশন চত্বরে এক অর্দ্ধ নগ্ন নাবালিকাকে অচেতন আবস্থায় রেল পুলিশ উদ্ধার করে। তার বয়স আনুমানিক চৌদ্দ পনের বছর।তাকে হাওড়ার সদর হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছিল।গতকাল রাতে হতভাগ্য নাবালিকাটি মারা যায়। সব চেষ্টা ও পরিশ্রম ডাক্তারবাবুদের ব্যর্থ হয়। সুত্রের খবর মেয়েটি ট্রেন ও প্লাটফর্মে ভিক্ষা করত। সেদিন সন্ধের পর কিছু কুখ্যাত সমাজবিরোধী তাকে গণধর্ষণের পর হাওড়ার স্টেশন চত্বরে ফেলে পালায়। মেয়েটির রং ফর্সা, কপালে বাম দিকে কাটা দাগ আছে। কেউ সনাক্ত করতে চাইলে নিন্ম ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।--- "

শেষ অংশ আর অপু পড়তে পারেনি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy