Mukulika Das

Romance Tragedy Classics

4.6  

Mukulika Das

Romance Tragedy Classics

মা

মা

8 mins
2.4K



তুলাই বলটা নিয়ে আপন মনে খেলছে,আজ চিৎকার করছে না,কাঁদছে না।কাঁদবে কেন,মা যে সাতগ আছে।নীলিমা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, অনেকটাসময়।কি সুন্দর তুলাইকে দেখতে,চোখদুটো একদম ওর বাবার মতো,গালগুলো কি সুন্দর ফর্সা আর লাল।তবে হাসিটা একদম নীলিমার মতো।নীলিমার হাসিটা এতো সাধারণ, এতো সাবলীল যে শত ভিড়ের মাঝেও আলাদা করে তা নজর কাড়ে।নীলিমার এই হাসিতেই পাগল হয়েছিল অতনু, অথচ আজ!


 - আপনি নীলিমা সরকার?


চমকে উঠে নীলিমা,বয়স্ক মতন এক লোক।এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান মনে হয়।


 - বলছি মা,তুমি...

 - হুম,আমিই নীলিমা।

 - ও বুঝি নয়ন।

 - হুম।

 - খুব মিষ্টি দেখতে,ওর বাবা আসেনি।


কি বলবে নীলিমা,ওর বাবা তো আসেনি,কেন আসেনি,কি জানাবে?


 - বুঝেছি মা,কিছু বলতে হবেনা।তবে তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে,আসলে ফাদার একটু বাইরে গিয়েছেন কিনা!

 - ওহ,আজ ফিরবেন না।ফোনে তো আজকের কথাই হয়েছিল।

 - হুম,কিন্তু একটা বাচ্চার কেস চলে এসেছে হঠাৎ,তাই সকাল সকাল বেড়িয়ে গিয়েছেন।তবে বিকেলের আগেই ফিরবেন,আইনি কাজগুলো সেরেই।তোমাকে ঘন্টা দুয়েক বসতে হবে।

 - বেশ,আমি আছি।

 - একটা কথা বলবো মা।

 - বলুন।

 - এই ধরণের বাচ্চারা খুব সেনসেটিভ হয়,অল্পতেই খুশি আবার অল্পতেই রাগ।এদের সামলানো ও খুব মুশকিল।বলছি,হঠাৎ করে নয়ন পারবে তো?

 - কি করবো ফাদার,আমার যে আর উপায় নেই।

 - বুঝি মা,মেয়েদের সংসারই আগে।তবে তুমি কিন্তু এখন একজন মা ও।পারবে থাকতে!

 - পারবো।

 - বেশ।পারলেই ভালো।বোসো তুমি,আমি তোমাদের লাঞ্চটা একটু দেখছি।


নীলিমার এই পারবো কথাটাতে খুব অবিশ্বাস আজ।পারবো বললেই কি পারা যায়।নীলিমার খুব কষ্ট হচ্ছে,তুলাইয়ের মুখটা এতো মায়াবী,একদম অতনুর মতোন।নীলিমা দেখে তুলাই খেলতে খেলতে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।কে বলবে ওর বয়েস সাত,বোধবুদ্ধি এখনোতো সেই তিন বছরের বাচ্চার মতো,কখনো কখনো তারও কম।ওকে কোলে ওঠিয়ে মাটিতে বসে নীলিমা,মাথা হাতড়ে দিতে থাকে।মায়ের গন্ধ পেয়ে,তুলাই আরো আঁকড়ে ধরে নীলিমাকে।আঁচল দিয়ে ছেলের কপালের ঘাম মুছতে থাকে,মুখ গড়িয়ে পড়া লালা মুছে দেয় নীলিমা।চোখ আজ হঠাৎই বাঁধ মানেনা,তুলাইকে রেখে,ও কিভাবে যাবে!


প্রথম যেদিন তুলাই হলো সবাই কি খুশি,অতনু পুরো নার্সিংহোম মিষ্টি খেয়েছিল সেদিন।অতনু,অতনুর মা,অতনুর বাবা সবাই ছেলে চেয়েছিলো,হয়েওছিল তাই।তারপর ঘটা করে অন্নপ্রাশন, কোনো আত্মীয়পরিজন বাদ ছিলোনা।


 - আহা নীলিমা,কি হয়েছে রে তোর ছেলেটা দেখতে।একদম রাজপুত্তুর।

 - এই আনন্দী নজর দিবিনা ছেলের ওপর একদম,বলে দিচ্ছি।আমার নাতি কিন্তু!

 - আহাগো দিদি,নজর কোথায় দিলাম।অমন ছেলে দেখলে মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেড়িয়ে আসে গো।


 সেই তুলাই ধীরে ধীরে বড়ো হয়।চিৎকার, দুষ্টুমিতে বাড়ি মাতিয়ে রাখে।অথচ ওর বুদ্ধি বাড়েনা।তিন বছরের একটা বাচ্চা,অথচ হাজার বোঝালেও বোঝেনা বাড়ির বাইরে বেড়োতে হয়না,যেটা সেটা মুখে দিয়ে দেয়।ছাদে উঠলে ধাক্কা দিয়ে দেয় ঠাকুমাকে।

 - কি দস্যি ছেলে গো তোমার বউমা।হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে।

 - এখনো তো ছোট মা।

 - কি আর ছোট গা,এমনি বুদ্ধি তো নাই,শয়তানি বুদ্ধি ষোলআনা।

নীলিমা ভাবে,ও বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে।


কিন্তু বড়ো হতে হতে কিছুই পালটায় না।সেই একি পরিস্থিতি। বরং দুষ্টুমি আরো বাড়ে।স্কুলে ভর্তি করানো হয়,কিন্তু রোজ রোজ কমপ্লেন।হঠাৎ রেগে যাওয়া, যাকে তাকে ধরে মারা এমনকি টিচারদের ছাড়েনা।অবশেষে স্কুল থেকেও ছাড়ান।


 - আমি তো বুঝতে পারছিনা তুলাই এমন কেন করছে।তুমি কি ওকে সামলে রাখতে পারোনা।

 - আমি থাকলে তো কিছু করেনা গো,শান্ত হয়েই থাকে।অন্যদের কাছে গেলে কি যে হয়।

 - পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা অথচ তার বুদ্ধি দেখো,কিছুই মনে রাখতে পারেনা ঠিকঠাক। কার সাথে কি কথা বলতে হয় জানেনা, যখন তখন রেগে যায় -এসব কি!আমার তো চিন্তা হচ্ছে,এভাবে ছেলেকে মানুষ করবো কি করে।

 - একবার ডাক্তার দেখাইনা তুলাইকে,অনেকসময় বুদ্ধি দেরি করে হয় কিছু বাচ্চার।ডাক্তার না দেখালে..

 - হুম।


অবশেষে ডাক্তার জানান দেয়,


 - অটিজম,তবে আপনারা লাকি যে আপনার বাচ্চা ঠিকঠাক চলতে ফিরতে পারে,অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটাও পসিবল হয়না ।এ ধরনের বাচ্চারা স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতন নয়,তাদের বোধবুদ্ধি দেরি করে হলেও তাদের আবেগটা কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি।তাই ওকে অন্যভাবে, একটু আলাদা যত্নে বড়ো করতে হবে।অনেকটা আদর আর সময় দিয়ে।যদি সঠিক পরিচর্যা পায়,একদিন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে ও।


বাড়ি ফিরে সেদিন ছিল খাঁ খাঁ শুন্যতা।


 - হায় রে আমার কি সব্বনেশ হলো রে,শেষ পয্যন্ত এমন ছেলে পেটে ধরলি হতভাগী।আমার অতনুর কি হবে গা,হায় ভগবান....

 - নীলি,তুমি নয়নকে ঘুম পাড়িয়ে দাও যাও।


সেই রাতে তুলাইকে ধরে কত যে কেঁদেছে নীলিমা তা যদি অতনু দেখতো,সারারাত বাড়ির বাইরে ছিল অতনু।এমনটা আগে কোনদিন করেনি,এই অতনুকে কত্ত বছর ধরে চেনে নীলিমা।কলেজের প্রেম গড়িয়েছে বিয়ে অব্দি।যদিও অতনুর মা বাবা আরো সুন্দর মেয়ে চেয়েছিলেন,তবুও নীলিমার সেই হাসি অতনুকে বাধ্য করেছিল সারাজীবনের মতোন করে নেওয়ার জন্য।আজ সেই অতনু একধাক্কায় অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে।

মাঝরাতে যখন বাড়ি ফিরলো অতনু,গা দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ।অতনু জানে,এটা তার ভুল নয়,নীলিমার ও নয়,তবুও কোত্থাও না কোত্থাও তাদেরই যেন হার।


তারপর ধীরে ধীরে তুলাইয়ের ভালোবাসা কমতে লাগলো সংসারে,এখন আর কেউ ওর খাওয়া ঘুমানোর খোঁজ নেয়না।ওর চিৎকার অসহ্য হলে মেরেও দেয় দু-তিনটা।নীলিমা অফিসে গেলে ওকে দরজা বন্ধ করে রেখে দেয়,অন্ধকার ঘরে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়।ধীরে ধীরে তুলাই আরো খারাপের দিকে যেতে লাগলো।খেলাধুলো কিচ্ছু করেনা,খায়না,শুধু জিনিসপত্র ভেঙে চিৎকার করতে থাকে।


 -বউমা এমন পাগল ছেলে থাকলে ঘরে কেউ কেমনে থাকে গা।ও ছেলের আশা ছেঁড়ে দেও।

 - মা কি বলছেন আপনি এসব।

 - আহা,সাধে কি বলি।কিন্তু ওর কি আশা বলো,তার চেয়ে আরেকটা বাচ্চার কতা ভাবো দিকিনি,আর হা এবার পরীক্ষা করে তবে বাচ্চা নেবা।

 - আপনি কি বলছেন আপনি জানেন,এমন নির্দয় হলেন কবে থেকে।

 - আহ,মোলো যা।অমন পাগল নাতি দেখলি কার মাতায় বা ঠিক থাকে।আমার অতনু তো সুস্থ সবল,তোমারই কোনো গলদ বৌমা।

 - আমার তুলাই পাগল না,ও এই বাড়িরই ছেলে।আমি ওর মা,ওকে ফেলে দেব কি করে?আপনি পারতেন?

 - বালাই ষাট, তিনটে বাচ্চার মা গো আমি।তোমার মতোন বয়েসে তুলাই আমার আঁচল ধরে আকুলে যায়।তোমার মতন হা-ভাতের ঘর থিকে তো আর আসিনি গা,তোমার গলদেই আজ আমার সংসার, অতনু সব ছাড়খার হয়ে যাচ্চে।পারো তো অই বাচ্চাকে বিদেয় দেও আর নতুন করে ভাবো।আর যদি ওই বাচ্চে নে অফিস ছেড়ে সারাদিন আদিখ্যেতা করে মরতেই হয়,তো অন্য জায়গা গিয়ে মরগে যাও।নেহাৎ ভালো মানুষ দেখে, নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতেম।মরণ!বুড়ো ধামড়া ছেলে আবার ঘুম পাড়াতে হয়,গা জ্বলে যায়।


নীলিমা কি বলবে জানেনা,যে সংসারে আট বছর ধরে আছে।সেই সংসার থেকে এটাই প্রাপ্য ছিল।নয়নের নিষ্পাপ চোখটা কি ওরা দেখেনা,ওর ঠাম্মা ঠাম্মা ডাকে কি ওদের মন গলেনা।এতো পাত্থর মানুষ হয়!সবটাই বুঝি স্বার্থ! তুলাই আর পাঁচটা ছেলের মতো পড়াশোনা করবেনা,অফিস যাবেনা,ফাস্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবেনা।বাবা মা বড়ো করে বলতে পারবেনা যে আমার ছেলে ডাক্তার বা অফিসার কোনো অফিসের।তাই বলে কি নয়নের কোনো দাম থাকবেনা।নাম কিনবে তাই দিয়েই কি সন্তানের দাম বিচার হয়!


অতনু এখন আর সংসারে মন দেয়না,কি জানি ওর আর কিছুতেই মন নেই।ঠিকঠাক রাতে ফেরেনা,খায়না আর যদিও ফেরে মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে।


তবে পরশু একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল।অফিসে অনেক কাজ জমা পড়ে যাওয়ায় নীলিমাকে অনেকক্ষণ থাকতে হয় অফিসে।রাতে বাড়ি ফিরেই দেখে অতনু দরজার সামনে বসে।


 - একি,তুমি আজ এতো তাড়াতাড়ি।

 - তোমার ফোন কোথায়?

 - আমার কাছেই,কেন?

 - কতবার ফোন করেছি দেখেছো?

 - কেন গো,আসলে...কি হয়েছে?


 অতনু হঠাৎ খুব শক্ত করে ধরে ওর হাতটা, এই অতনু হাত ধরে কতবার বাসে উঠিয়েছে,কতবার রাস্তা পার করিয়েছে,সে ছোঁয়া ছিল কত নরম!আজ অতনু অনেক বেশি রূঢ়,কঠোর।


 - অতনু আমার খুব লাগছে,আস্তে।

 - দেখো।


 নীলিমা দেখে মা বিছানায় শোয়া।হাতে ব্যান্ডেজ।


 - এ কি! কি হয়েছে!মা...

 - থাক আর আদিখ্যেতা করে ঘুম ভাঙাতে হবেনা।তোমার গুণধর ছেলে আজ মাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।ধাক্কা দিয়েছে সিঁড়ি দিয়ে,হাতের ওপর দিয়ে গিয়েছে দেখে রক্ষা।যদি মাথা ফেটে যেতো।

 - তুলাই ছাদে তো যায়না।ও কিভাবে...

 - আমি এভাবে পারছিনা নীলি,এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

 - তুমি তো জানোই তুলাই...

 - এই নাও,একটা সেচ্ছাসেবী সংস্থার ঠিকানা।একটা মিশন এটা চালায়,ওখানকার ফাদাররা এমন বাচ্চাদের দেখাশোনা করে এবং সবাই ভালো...

 - মানে,এসব কি বলছো তুমি অতনু!

 - তুলাই ওখানে থাকবে।

 - না না অতনু এমন বোলোনা।ও যে আমাকে ছাড়া ঘুমোতে অব্দি পারেনা,ভাতটাও মেখে খাইয়ে দিতে হয়।দেখোনা কেমন অশান্ত হয়ে যায় আমাকে ছাড়া,কেমন করে থাকবে গো ও।স্নান করে চুল আঁচড়ে দিতে হয় এখনো,খাতায় আমাকে ছাড়া আঁকিবুকি পর্যন্ত করেনা।কেমন করে ফেলে আসবো গো,আমি পারবোনা পারবো না।

 - তবে আমাকে কি করতে বলো,আমি কি মা কে ফেলে আসবো?দুজনকে একসাথে ঘরে রেখে যাওয়া...

 - আমি থাকি ঘরে,মা কে কিচ্ছু করতে হবেনা।আমি দেখভাল করবো দেখো।কাউকে জ্বালাবেনা,কিচ্ছুটি করবেনা।ওকে নিয়ে আমি ছাদের ঘরটায় থাকবো।নীচে অব্দি নামতে দেবোনা।

 - এটা কোনো সমাধান না নীলি,তাকিয়ে দেখেছো নিজের দিকে,এভাবে চলতে থাকলে...আমরা আমাদের মতোন করে কবে গুছিয়ে নেবো বলতে পারো?

 - ও তোমার ছেলে নয়?কেমন করে তুমি এমন বলতে পারলে বলো,বলো আমাকে।তোমাকে বাবা করে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে কি একটুও মায়া হয়না!

 - আমি কি পাথরের!আমার কি কষ্ট নেই!কিন্তু আমাদের মতন স্বাভাবিক মানুষেরা ওকে কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারবোনা।সেদিন রাগের মাথায় যখন হাত তুললাম,তুমি জানোনা আমি কত কষ্ট পেয়েছি।

 - বুঝে গিয়েছি অতনু।মাঝে মাঝে ভাবি অস্বাভাবিক ও না আমরা।নিজেকে আর কোনদিন বাবা বলে পরিচয় দেবেনা।মনে মনে একটু লজ্জিত হও।

 - নীলি!

 -তোমার পা ধরে এইটুকু চাইলাম,ঘরের ছেলে ঘরছাড়া করে সুখী তোমরা তাইনা।বেশ,তাই হবে।তুলাই থাকবে না,আর কোনদিন আসবেনা।কোনদিন না।


সেদিন অতনু শুধু মায়ের ভাঙা হাতটাই দেখেছিল,ওর চোখে পড়েনি তুলাইয়ের পিঠে কালশিটে দাগগুলো।অন্ধকার ঘরে আটকে থেকে জ্বরে ভোগা ছেলেটাকে কোলেও তুলে নেইনি নীলিমা ছাড়া।


 - নীলিমা সরকার।

 - হুম,ফাদার।

 - আসুন,ফাদার জোসেফ এসে গিয়েছেন,কিছু ফর্মালিটি রয়েছে,ওসব পুরো করতে হবে।


তুলাইকে রেখে আসবার আগে,নীলিমা একবার পেছন ফিরে তাকায়।তুলাই ঘুমোচ্ছে।কাছে গিয়ে মুখ থেকে আঙুলটা বের করে কপালে একটা চুমু আঁকে।তুলাইয়ের ফোলা ফোলা গালগুলো,লাল হয়ে রয়েছে।নীলিমা আর থাকতে পারেনা,দৌড়ে বেড়িয়ে আসে।গেটের বাইরে ট্যাক্সি ধরে।


সারারাস্তা নীলিমা জানেনা অনবরত জল পড়েছে চোখ দিয়ে,সারারাস্তা কানে বেজেছে,

 - মাম্মাম,আমলা কই যাই?

 -মাম্মাম আমাকে তোলে নাওনা।

 - মাম্মাম...


ঘরে এসে নীলিমার সব ফাঁকা লাগে,আজ কোনো শব্দ নেই।শব্দ করার জঞ্জালটা আজ বাড়িছাড়া। তুলাইয়ের খেলনাগুলো পড়েই আছে।নীলিমা ওগুলো পাগলের মতোন গোছাতে বসে।তুলাইয়ে গায়ে দেওয়ার কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে কি যেন খোঁজে।ওর আঁকিবুঁকির খাতাটায় হাত বুলোতে থাকে,তুলাইয়ের ফেলে রাখা কালকের জামাটা তাতে তুলাইয়ের গাঁয়ের গন্ধ খোঁজে।


দুপুরে শাশুড়িকে খাইয়ে দিয়ে, নীলিমা আবার তুলাইয়ের ঘরে আসে।আজ এঘর থেকে শুধু মাম্মাম আওয়াজ আসছে।কই তুলাই তো নেই...সবটাই মনের ভুল।

ছাদে তুলাইয়ের তিনচাকার সাইকেলরিকশাটা পড়েই আছে,তুলাই তো এটা ছাড়া থাকতেই পারেনা।এটা যে দিয়ে আসা হয়নি!


ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দিন কাটে নীলিমার,


আচ্ছা তুলাই খেয়েছেতো,ও কি এখন ঘুমোচ্ছে।আমাকে ছাড়া ঘুমোতে পারবে তো? ঘুমের মধ্যে যদি আবার স্বপ্ন দেখে।যদি অন্ধকারে ভয় পায়,মাম্মাম করে চিৎকার করবে তো।যদি খেলতে খেলতে ব্যথা পায়।


এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে হয়,রাত হয়।


অতনু আজ অনেকটাই সাবলীল, মা ও ছেলে মিলে গল্প জুড়েছে।

নীলিমা কার সাথে গল্প করবে!

তুলাই নেই তো!


 রাত বাড়ে,অতনু ততো ঘনিষ্ঠ হয় নীলিমার।

 - মন খারাপ করোনা নীলি,তুলাই ভালো থাকবে।

 - তাই!তুমি খুব জানো ওকে না!

 - জানি কষ্ট হচ্ছে,আমারও কি...

 - আহা!

 - আমরা কি নতুনভাবে শুরু করতে পারিনা!

 - আমিও তাই ভাবছি।

 - তবে এসো...

 - চুপ,আমি তুলাইয়ের ঘরে যাচ্ছি।


অতনু হা করে তাকিয়ে থাকে।

রাতে তুলাইয়ের বিছানা আর বালিশে নীলিমা ঘুমে তলিয়ে যায়,স্বপ্নে সে খেলে,হাসে আর তুলাই ওকে কতো আদর করে!


পরদিন খুব সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ে নীলিমা,অতনু তখনো ঘুম।

 - কোত্থাও যাও বৌমা,সক্কাল,সক্কাল।

 - যেখানে যাওয়া দরকার।

 - মানে?

 - আপনি না মা,বোঝেন না!


 কিছু বলার মতোন পায়না অতনুর মা।


অবশেষে ফাদার জোসেফের কাছে পৌঁছায় ও।


 - নয়ন কেমন আছে?

 - কাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছে না,না ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে।ভালো হয়েছে মিসেস সরকার আপনি এলেন।

 - মিসেস সরকার না,নীলিমা।

 - ওহ।

 - নয়ন কোথায়?

 - ওই ঘরে, সারাদিন শুধু মাম্মাম আর মাম্মাম।


দৌড়ে যায় নীলিমা,একছুটে। খুব জোরে আঁকড়ে ধরে তুলাইকে।

 - মাম্মাম আমি আল দুত্তু করবোনা।আমাকে আমাকে নিয়ে যাও,বালি যাবো।

 - আমি কোত্থাও যাবোনা সোনা,আর কোত্থাও না।

 - মাম্মাম কাঁদেনা,বোকারা কাঁদে মাম্মাম।

 - হুম হুম।

 - মাম্মাম আমাকে ভাত দিবে,আমি...

 - চুপ কর সোনা চুপ কর।

 - তুমি আবাল তলে যাবে।আমার ভয় লাগে মাম্মাম...

 - না রে সোনা কোত্থাও যাবোনা।


তুলাই মায়ের বুকে মুখ ঘষতে থাকে,আর অনবরত কেঁদেই চলেছে নীলিমা।কাল সারাদিন ধরে এটাই তো খুঁজছিল ও।


 নীলিমা এখন এই সংস্থার সদস্যা, বলতে গেলে আরো দশটি বাচ্চার মা এখন।অফিস আর এই সংসার নিয়ে ওর সময় কেটে যায়।মাঝে মাঝে অতনু আসে,কিন্তু নীলিমা আর ফিরতে চায়না। মাতৃত্বের কাছে বাকি সবটা আর ফিকে লাগে।


ফাদার জোসেফ অবাক হন,বারবার।আর মনে এটা ভেবে বিস্মিত হন-মেয়েদের সব হার শেষে জিত বুঝি একটাই,

মাতৃত্ব।মায়েদের আসলে একটাই জাত।তার কাছে বাকি সবটা অনেক মূল্যহীন,অনেক তুচ্ছ।













Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance