বদ্ধ ঘরের অভিমানে
বদ্ধ ঘরের অভিমানে
অভিমানে চোখ দিয়ে জল আসছিল তরুলতার। বাবার কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট, মায়ের অসহায় চোখ দুটো মনে করেই তখন অয়নকে বিয়ে করার জন্যে মানা করতে পারেনি। দেবলিনা তো বলেছিল অয়ন দার মতো এতো ভালো ছেলে তুই পেতিস না। কিন্তু এখন কি পরিণতি! তরুলতা এই ভিনরাজ্যে সারাদিন একা ঘরে পড়ে আছে। অয়ন তো নিজের অফিসের কাজেই ব্যস্ত। ওদের দেখে কে বলবে সবে তিন মাস বিয়ে হয়েছে!
অয়নের পছন্দ অপছন্দ কোনোটাই মিলে না তরুলতার সাথে। অয়ন ঠিক যতটা চুপচাপ, গম্ভীর, নিজেকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। তরুলতা ততটাই বকবকে, প্রাণোচ্ছল, মিশুকে স্বভাবের।
বিয়ের পরে কয়েকসপ্তাহ যখন তরুলতা শ্বশুরবাড়িতে ছিল তখন ততটা একা লাগতো না। শ্বাশুড়ি মা, ননদ অয়ন্তিকা সবার সাথে মিলে দিব্যি দিন পেরিয়ে যাচ্ছিল। দিল্লীতে আসার পর থেকেই ও ভীষণ একা হয়ে গেছে।
সারাদিন অয়নের জন্যে অপেক্ষা করার পরে ও যখন ফিরে তখন হয়তো অপেক্ষার ক্লান্তিতেই তরুলতার চোখে ঘুম চলে আসে। আজকাল ওর প্রায়ই মনে হয় অয়ন ওর সাথে চিট করছে। নিশ্চয় ওদের অফিসের কোনো কলিগের সাথে ওর সম্পর্ক আছে। নেহাতই ওর শাশুড়ি মায়ের ইচ্ছেতে ওকে বিয়েটা করেছিল, না হলে রাত্রি আটটা দশটা অবধি কি এমন কাজ!
এই তো আজ সকালেরই কথা! ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছিল তরুলতার। যতক্ষণে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে নিয়ে এসেছে ততক্ষণে অয়ন কাকে একটা ফোন করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। ভাবটা এমন যেন দোষটা ওই করেছে দেরি করে উঠে!
ভেজা চোখেই দেবলিনাকে ফোনটা করলো তরুলতা। ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো গলায় দেবলিনা ফোনটা কানে নিয়ে বলল,
-"হ্যালো! এতো সকালে কি খবর রে!"
-"আমি আর এই মানুষটার সাথে ঘর করতে পারবো না রে দেবু... দিনদিন এখানে হাঁপিয়ে উঠছি। জানিস, আজও আমি টোষ্ট বানিয়ে যেই টেবিলে নিয়ে গেলাম ও ফোনটা কানে নিয়ে উঠে পড়লো। বেরোবার আগে বললও না আসছি বলে..."
দেবলিনার তখনও ভালো করে ঘুম কাটেনি। সকাল সকাল বেষ্টফ্রেন্ডের এরকম অভিযোগের ফোন পেয়ে গায়ের ঢাকাটা সরিয়ে উঠে বসে চোখ দুটো ঘষলো। গলাটা ঝেড়ে বলল,
-"হয়তো কোনো আর্জেন্ট কাজ ছিল অয়নদার... তাই বেরিয়ে গেছে। ফিরে এলে তুই জিজ্ঞাসা করে নিবি, তাহলেই তো হবে..."
আরো বেশি চটে গেল তরুলতা। বেশ চেঁচিয়ে বলল,
-"ফিরে আসার পরেও তার যেন কত সময়! সেই তো ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে খুটখাট করবে। জানিস দেবু, আমার মনে হয় তোর অয়নদার অফিসেরই কারোর সাথে অ্যাফেয়ার আছে... না হলে আমাকে এভাবে এভয়েড কেন করবে, বল তো!"
দেবলিনা হালকা বকুনি দিয়ে বলল,
-"তুই না ছেলেমানুষই রয়ে গেলি তরু... কি যে সব বলিস! অয়ন দা একটু কম কথা বলে, চুপচাপ থাকে তার মানেই কি.... তোর ভাবনাকে একটু লাগাম দে তো! এই জন্যেই বলে ফাঁকা মাথা শয়তানের বাসা! কাল স্কেচটা কমপ্লিট করেছিলি!"
তরুলতা বেজার মুখে বলল,
-"হ্যাঁ, ওই স্কেচটা কমপ্লিট করতে গিয়েই তো লেট হয়ে গেল... আর তারজন্যেই সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো। উনিও রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন..."
-"ওহ! তাই বল! তোর দেরি হয়ে গেছল তাই অয়ন দা ব্রেকফাস্ট না করে বেরিয়ে গেছে..."
অভিমানী গলায় তরুলতা বলল,
-"মোটেও না... এমনিতেই বা উনি আমার সাথে কতটুকু কথা বলেন! সারাক্ষণ তো ওই কাজ, কাজ আর কাজ! তুই তো জানিস দেবু, আমার কতদিনের ইচ্ছে ছিল প্যারিসে হানিমুনে যাবো... উনি আমাকে এত্তো ভালোবাসবেন.. কতো শপিং করবো, ঘুরবো, রোম্যান্টিক মুভি দেখবো আর এই মানুষটাকে বিয়ে করে আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে! জানিস, ওর ল্যাপটপে সব হলিউডের একশন মুভি, জেমসবন্ড...."
-"আরে তোর তো তবু বিয়ে হয়েছে, আমার তো বয়ফ্রেন্ডই জুটলো না..."
-"সেটা তোর নিজের দোষে! ওরকম টমবয়ের মতো চারদিকে ঘুরে বেরালে কে তোকে প্রপোজ করবে রে!"
এবার দেবলিনা একটু রেগে গিয়েই বলল,
-"এক্সাক্টলি, আমিও তোকে এটাই বলছি ওরকম ওভার রোম্যান্টিক ভাবনা চিন্তা সবার ভালো লাগে না। তুইও একটু অয়নদাকে বোঝার চেষ্টা কর। সবার ভালো লাগা, পছন্দ কি একরকম হয়! অয়নদা চুপচাপ, কম কথা বলে। সারাদিন অফিসে কাজ করে তোর মতো বকবক করার এনার্জি কোথায় পাবে বল তো! ঘরে বসে ঘোড়ার ঘাস তো আর কাটে না!"
ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে তরুলতা বলল,
-"আমি ঘোড়ার ঘাস কাটি! তুই এরকম বলতে পারলি দেবু! তুই ওর সাইডে না আমার সাইডে!"
দেবলিনা চটজলদি উত্তর দিল,
-"দেখ, আমি কারো সাইডে নই... তোর মাথার এই ফালতু চিন্তাভাবনা সরাবার জন্যেই তো বলেছিলাম আঁকাআঁকিটা আবার শুরু কর। দেখবি, ভালো লাগবে..."
রাগে গোঁ হয়ে রইলো তরুলতা। ওর মনে হচ্ছিল ওকে যেন কেউই বুঝতে চায় না। না এই অয়ন, না ওর বাড়িতে, না এই দেবলিনা! সবার কাছে ওই দায়ী! এই জন্যেই বলে ছেলেরা যতই অপরাধ করুক, সব সময় সব দোষ মেয়েদেরই হয়।
অনেকক্ষণ উত্তর না পেয়ে দেবলিনা বলল,
-"কি রে! বুঝলি আমি কি বলছি! কালারগুলো কিনেছিস! বড়দের কালারিং-এর উপরে একটা ভালো বই আছে। ইচ্ছে গেলে ওটা কিনতে পারিস। আমি দিদির কাছে দেখছিলাম। তোকে নামটা মেসেজ করে দেবো।"
মুখ দিয়ে শুধু একটা হুঁ আওয়াজ করলো তরুলতা। দেবলিনা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-"আমার আবার দুদিন পরেই সেই চাকুরির এক্সামটা আছে। উঠি এবার.. এরিথমেটিকটা একটু দেখতে হবে আজ। আর শোন, সন্দেহটা একটু কম কর, ভালোবাসাতে বিশ্বাস রাখতে হয় বুঝেছিস!"
ঠোঁট বেঁকিয়ে তরুলতা মনে মনে বলল ভালোবাসার যেন কত বুঝিস তুই! সেই প্রাইমারি থেকে একটা প্রেমও তো করতে পারলি না! তরুলতা তবুও তো ইউনিভার্সিটির একটা প্রফেসারের উপরে ক্রাশ খেয়েছিল। কি দেখতে ছিল প্রিয়াংশু স্যার! ছ'ফুট হাইট, শক্ত চোয়ালে হালকা দাড়ি, আর রিমলেশ চশমার কাঁচে নেশা নেশা চোখ দুটো দেখলে তো ও পাগলই হয়ে যেত। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, লুক্সেমবার্গ গার্ডেনে ঘোরা, শ্যন রিভারে বোটিং.... কতো কিছুর স্বপ্নই তো দেখেছিল! অয়ন ওকে তিনমাস হলো দিল্লিতে নিয়ে এসেছে, এখনো আগ্রা থেকেও ঘুরিয়ে নিয়ে আসার সময় পায়নি। সবই কপাল! না হলে তরুলতার মতো মেয়ের কপালে কি না এরকম গোমড়া একটা বর জুটে!
তরুলতাকে আবার নীরব দেখেই দেবলিনা বলল,
-"এই তুই না থাক তোর ওই মনখারাপ নিয়ে... আমি আর পারবো না.. রাখছি.."
বিপ দিয়ে ফোনটা কেটে গেল। এতোক্ষণ যেই কান্নাটা তরুলতার চোখে এসে আটকেছিল, দেবলিনার ফোনটা কেটে দেওয়ার পরে সেটাই এবার গাল বেয়ে নামতে লাগলো।
তরুলতার ঠাকুমা বলতো ওর মনটা ঘাসের মতোই নরম। তরুলতার বাবা টিভিতে নিউজ চ্যানেল দেখলেই ও উঠে পড়তো। মুখভারী করে বলতো ওসব খুন, জখম, রক্ত, মৃত্যু দেখলে ওর রাত্রে ঘুম আসে না। ছোটোবেলাতে কারো বকুনি না খেয়েও অদ্ভূত মন খারাপে তরুলতা কাঁদতো! বুঝতেও পারতো না কেন ওর মন খারাপ করছে! বাবা, মা, দিদি, ঠাকুমা সবার উপরে অভিমান করে একাই বসে থাকতো ওর পড়ার ঘরের জানালার সামনে। তারপরে খাতার মধ্যে আঁকতে আঁকতে ওর ভাবুক মন কোথায় যেন চলে যেত! কান্নারা কখন নিজের থেকেই থেমে যেত বুঝতে পারতো না! তাকিয়ে দেখতো ও খাতার মধ্যেই হয়তো এঁকে ফেলেছে নরম ঘাস, সবুজ বনানীর মধ্যে একটা ট্রি-হাউজ। তার নীচে হাত ধরে বসে আছে এক জোড়া ছেলেমেয়ে। আর ছেলে মেয়ে দুটোর ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে নাম না জানা কোনো পাহাড়ি নদী!
আজও খাতা কলম নিয়ে বসলো তরুলতা। ওদের বসন্তকুঞ্জের ডি-সিক্স কমপ্লেক্সের অ্যাপার্মেন্টে দশতলার জানালার কাঁচ দিয়ে ইঁট কাঠ কংক্রিটের শহরটা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না! নামেই বসন্তকুঞ্জ! না আছে পলাশের লাল রঙের ছোঁয়া আর না আছে কোকিলের কুহুতান। আজ তরুলতা আঁকতে বসলো পুরুলিয়ার কোনো অখ্যাত গ্রামের ছবি। দূরের পাহাড়, পলাশের বন, পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর পাথুরে উপত্যকা। মাঝে মাঝে তরুলতার একাকী মন এক ঝলক শান্ত বাতাস খোঁজার চেষ্টা করে এরকমই কোনো নিরিবিলি জায়গার ভাবনাতে। তখন ওর মনে হয় প্যারিসের নোটার-ড্যাম, রোমের কলোসিয়াম না হলেও চলতো... যন্ত্র আর কংক্রিটের এই দমবন্ধকরা জীবন ছেড়ে ও যদি অয়নের হাত ধরে পলাশের পাপড়ি ঢাকা নুড়ি ভরা নদী ঘাটেও ঘুরে আসতে পারতো তাহলেও হয়তো জীবনের অনেক কিছু না পাওয়ার বাসনা পূর্ণ হয়ে যেত।
****
অয়ন ওর অফিসের ক্যাবিনে বসে তাড়াতাড়ি সব ডিজাইনে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। ফাইনালই একবার সব দেখে নিয়ে এখনই ডিজাইনগুলো হেড অফিসে মেল করতে হবে। শঙ্খ এসে অয়নের পিঠে হাত রাখতেই একটু চমকে উঠলো অয়ন। হকচকিয়ে বলল,
-"আরে শঙ্খ দা তুমি! ছুটিতে ছিলে না!"
শঙ্খ আর অয়ন একই ডিজাইনার কোম্পানিতে কাজ করে। বয়সের বেশ পার্থক্য থাকলেও দুজনেই বাঙালি হওয়ার কারণে সম্পর্কটা ওদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। শঙ্খ মজা করেই প্রথমে বলল,
-"ছুটি তো ভায়া তোমার নেওয়ার কথা! নতুন বৌ ঘরে অপেক্ষা করছে.. আর তুমি এখানে অফিসে দশ ঘন্টা ডিউটি করছো!"
অয়ন ওর চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে ডিজাইনের প্রিন্ট আউটগুলো নিয়ে নিরস মুখে বলল,
-"আর বলো না! ওর সাথে দুটোর বেশি তিনটে কি কথা বলবে! সর্বক্ষণ অভিযোগ... টিভিতে নিউজ চ্যানেল কেন দেখবে! অ্যাপার্মেন্টে কেউ বাঙালি কেন নেই! বিন্দি দি ওর হিন্দি শুনে হেসেছে! ও কিভাবে কারো সাথে কথা বলবে! তারাও যদি হাসে! সারাদিন ওর ঘরের মধ্যে ভালো লাগে না... আমার ফিরতে কেন দেরি হয়! ছুটির দিনেও কি কাজ থাকে! সা
রাদিন অফিস করে ফিরে এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়, বলো তো!"
শঙ্খ হেসে বলল,
-"তোর বৌদি বলছিল তরু হিন্দী নিয়ে পড়েছে... তাহলে তো এখানের ভাষা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয় তেমন..."
-"আরে, হিন্দী নয়, সংস্কৃত... কি যে পড়েছে ওই জানে! ঘটে তেমন কিছু আছে বলে তো মনে হয় না! এই তো সেদিনে সরস্বতী পুজো করতে চাইলো.. বলছিল ওদের বাড়িতে না কি ছোটোর থেকে পুজো হতো! আমিও বললাম এখানে বাঙালি বামুন পাবো না, তুমি সংস্কৃত নিয়ে পড়েছো যখন নিশ্চয় মন্ত্রতন্ত্র জানো, তাহলে পুজোটা নিজেই করে নাও। তো সেই শুনে এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল আমি! একাই! যেন আমি যুদ্ধে যেতে বলেছি!"
-"তারপর? পুজো হলো!"
-"সে জানিনা, কিছু একটা করেছিল মনে হয়... আমার তো ছুটি ছিল না.. ঘরে গেলাম যখন ফল চিঁড়ে দিল..."
শঙ্খ হালকা ভাবেই বলল,
-"তাহলে তোর ভালোই... পুরুত বৌ একসাথেই পেয়ে যাচ্ছিস... টু ইন ওয়ান.."
ডিজাইনগুলো একটা নতুন ফাইলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে অয়ন বলল,
-"ধুর! ভিজে চিঁড়ের প্রসাদ দিয়ে শুকনো চিঁড়ের মতো ওমন মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে গলা দিয়ে পেরোয়!"
-"আমার মনে হয় তোর ঘরে আরেকটু বেশি সময় দেওয়া উচিৎ। তরু হয়তো অভিমানেই... মানে নতুন এসেছে, এখানের কিই বা জানে! আর তাছাড়া প্রতিটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে একটু সময় চায়..."
মুখ ভারী করে অয়ন বলল,
-"আরে ওর মতো সারাদিন ঘরে হিজিবিজি চিন্তা করলে তো আমার খেতে জুটবে না। জানোই তো স্যার এই প্রজেক্টটার পুরো দায়িত্বই আমাকে হ্যান্ডওভার করে দিয়েছে। তুমিও ছিলে না... ওকে আমার কাজের কি বোঝাবো বলো তো! ও ডিজাইনের কিছু বুঝে! ল্যাপটপ অন করতেও মনে হয় জানে না। সেদিন আমার ল্যাপটপে কি কি মুভি আছে দেখবে বলল আমি দেখতেও দিলাম, কিছুক্ষণ দেখে ঠোঁট উল্টে চলে গেল। মনে হয় ফোল্ডার খুলতেও জানে না। মুখেও তো সেটা বলতে পারতো... আজকের দিনে এরকম ব্যাকডেটেড! মানে সিরিয়াসলি আমার ওর সাথে ঘরে থাকতেই ভালো লাগে না... যতক্ষণ অফিসে কাটানো যায়, ততই ভালো.."
-"বুঝতে সবই পারছি। তবুও বলবো তরুর দিকটা তোর ভাবা দরকার। যতই ব্যাকডেটেড হোক, সারাদিন ঘরে একা থাকা মানে কতটা একঘেঁয়ে বলতো! এই কিছুদিন এসেছে, জলবায়ুর সাথে মানিয়ে নিতেও তো একটা টাইম লাগে। তোর বৌদিও সেদিন তোদের ফ্ল্যাট থেকে ফেরার সময় বলছিল তরু কথা বলতে এতো ভালোবাসে, একা একা কি করে যে থাকবে সারাদিন!"
অয়ন বিরক্তির স্বরে বলল,
-"অনেকেই তো বাড়িতে একা থাকে... তাছাড়া ওর যা মাথা এখানে করবেই বা কি! একটা ফোনও তো ঠিক করে ইউজ করতে পারে না। এই তো সরস্বতী পুজোর পরে মুখ ভারী করে সারাক্ষণ থাকছে দেখে একটা স্মার্টফোন কিনে দিলাম। কত করে বললাম তোমার ওই ছোটো ফোনটা এবার আপগ্রেড করো। ফেসবুকে একাউন্ট খুলে ওকে সব শেখাবারও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওই যে নাচতে না জানলে উঠোনের দোষ! আমাকে মুখের উপরে বলে দিল ওই সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট না কি মানুষকে আরো আনসোশ্যাল করে দেয়। ছোটো ফোনে ওপাশের মানুষটাকে দেখতে না পেলেও তার আওয়াজটা তো শুনতে পাওয়া যায়। চ্যাটের টাইপিং-এ না কি সেটুকুও প্রাণ নেই। তাহলেই বোঝো! ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে দাঁড়িয়ে এসব কথা কতটা হাস্যকর কে আর তাকে বোঝাবে!"
শঙ্খ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-"তরু কিন্তু একেবারে ভুল কিছু বলেনি। দেখ, যখন আমাদের মধ্যে এসব ফোন টোন ছিল না সামনে থেকেই কথা বলাটা বেশি প্রেফার করতাম। বাড়ি যাওয়ার জন্যেও কেমন মুখিয়ে থাকতাম। বাড়ি গেলেই বাড়ির সবার সাথে কত আড্ডা, গল্প... চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে মস্তি... ফোন হাতে আসতেই সেসব কোথায় হারিয়ে গেল! ওই ফোনেই সব কথা শেষ! খুব প্রয়োজনে কনফারেন্স কল! আর তুই দেখ এখন স্মার্টফোন হতে বাড়িতে, বন্ধুদের আর ক'বার মনে করে কল করা হয়! খুব প্রয়োজনে একটা হোয়াটসঅ্যাপ! ফেসবুকের পোষ্ট কমেন্টেই লোকদেখানি সামাজিকতা সারা হয়ে যায়!"
শঙ্খর কাছে অবশ্য তরুলতার সমর্থনে এতো কথা আশা করেনি অয়ন। তাই একটু ঝাঁঝের স্বরেই বলল,
-"তাই বললে কি হয় শঙ্খ দা! যুগের সঙ্গে মানিয়ে আমাদের সবাইকেই তো আপডেট হতে হয়! ওর ধারণা অফিসটাইমে ও যাতে আমাকে কল না করে সেই জন্যে আমি ওকে ওসব স্মার্টফোন হাতে দিয়ে মেসেজ করতে বলছিলাম। আমার কি মনে হয় জানো তো মেয়েটার মাথাতে কিচ্ছু নেই! মা যে ওকে কি দেখে পছন্দ করেছিল! এখন কিছুই যে পারে না সেটা ধরা পড়ে যেতে আবার এসব কায়দা করছে...."
শঙ্খ উৎসাহী স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
-"তাহলে ফোনটার কি হলো!"
-"কি আবার হবে! ঘরেই পড়ে আছে... সে তার ছোটো ফোনেই সন্তুষ্ট... তার বেশি অসামাজিক হতে সে পারবে না।" শেষ কথাগুলোতে তরুলতার প্রতি ব্যঙ্গোক্তিটা বেশ বুঝতে পারলো শঙ্খ।
অয়ন শঙ্খর চোখ মুখ দেখেই এবার প্রসঙ্গটা পালটে জিজ্ঞাসা করলো,
-"তা তুমি ছুটিটা এক্সটেন্ড করবে বলে হঠাৎ কাজে জয়েন করে দিলে যে..."
শঙ্খ কি একটা ভাবতে ভাবতে বলল,
-"তোর বৌদির শরীরটাও এখন একটু ভালো। মেয়েটার পরীক্ষা হয়ে গেলে কয়েকদিন ঘুরতে যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু চারপাশের যা পরিস্থিতি! মানে ভাইরাসটা নিয়ে সবাই এতো আতঙ্কিত! এখন আর কোথাও ঘুরতে যাওয়াটা ঠিক মনে হচ্ছে না..."
অয়ন সাথে সাথে বলল,
-"হ্যাঁ, চিনের থেকে ফ্রান্স, ইটালি সবজায়গায় যেভাবে ছড়াচ্ছে... এই তো খবরে বলছিল কালই কয়েকজন বিদেশ থেকে ফিরেছে ওদের শরীরেও..."
অয়নকে থামিয়ে দিয়ে শঙ্খ বেশ চিন্তিত স্বরে বলল,
-"আমাদের দিল্লিতেও তো বেশ কয়েকজনের শরীরে মিলেছে কোভিড-নাইন্টিন... তাই ভাবলাম এখনো সব ঠিক আছে যখন কাজে জয়েনটা করে দিই... তারপর এখানেও অন্যদেশের মতো সব লক-ডাউন করে দিলে তো ঘরেই...."
অন্যমনষ্ক ভাবে অয়ন বলল,
-"সেই তো শঙ্খ দা! বেশ চিন্তা হচ্ছে... কোথা থেকে কি যে ভাইরাস এলো! হাত পা গুটিয়ে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকা মানেও তো বিশ্রী ব্যাপার..."
অস্থির হয়ে শঙ্খ বলল,
-"আরে, বুঝছো না ইন্ডিয়ার মতো একশো তেত্রিশ কোটির দেশে যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, কে কার মুখে জল দেবে সেটারই লোক পাওয়া যাবে না! আমাদের এতো হসপিটাল, পরিকাঠামো, ডাক্তার, নার্স কি আছে বলো তো যে পেসেন্টদের আইসোলেশনে রাখবে!"
ভয়ার্ত গলায় অয়ন বলল,
-"ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে বিশ্ব মহামারি ঘোষনা করেছে... তুমি ছোটোবেলায় পড়েছিলে শঙ্খ দা, সেই যখন বাংলাতে প্লেগ হয়েছিল কিভাবে একটার পর একটা মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিল... মুখে আগুন দেওয়ার মতো লোক কাঠ কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না... সেই অধ্যায় আবার ফিরে আসবে না তো!"
শঙ্খর নিজের গলাটাও ভয়ে শুকিয়ে এলো। অয়নের কাঁধে হালকা হাত রেখে বলল,
-"এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না... তবে যে কোনো মুহূর্তে ভয়ঙ্কর দূর্যোগ নেমে আসতে পারে। কে যে তখন কোথায় গিয়ে ছিটকে পড়বো! তাই বলছি নিজেদের মধ্যে এসব ছোটো খাটো মান অভিমান ইগোর লড়াই বাদ দিয়ে এবার আরো বেশি বুঝদার হতে হবে.."
শঙ্খ চলে যাওয়ার পরে অয়ন ডিজাইনের মেলগুলো সেন্ড করে নিজের ক্যাবিনে চুপ করে বসে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো শঙ্খ দা কি তরুলতার সাথেই মান অভিমানের কথা বলে গেল! ইগো কি শুধু ওর একার আছে! ও ছেলে বলে শঙ্খ দা শুধুই ওর দোষ দেখতে পায়, তরুলতা মেয়ে বলেই হয়তো সবার কাছে সহানুভূতি পেয়ে যায়। অয়ন কি চেষ্টা করেনি তরুলতাকে বুঝে চলার!
এই তো কালকের কথা। করোনার ভয়াবহতা নিয়েই নানারকম আলোচনা চলছিল অফিসে। ভালো লাগছিল না অয়নের। একটু তাড়াতাড়িই ঘরে ফিরে গিয়েছিল। ভেবেছিল তরুলতার সাথে আলোচনা করে ঠিক করবে ওরা কলকাতা চলে যাবে কি না! কারণ দিল্লির অবস্থা দিন দিন বেশ ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় কি! অয়ন ঘরে যেতেই চুপচাপ ও দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল। মেয়েটা তো টিভিও দেখেনি, দেখলেও মুভি আর গান! হয়তো জানেই না এরকম মারনব্যাধি আমাদের ঘরের দরজায় উঁকি দিচ্ছে বলে!
যতক্ষণে অয়ন হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে বাথরুম থেকে বেরোলো টেবিলে ওর টিফিন রেখে নিজে কি সব খাতা পেন নিয়ে বসে গেছল তরুলতা! এরকম ও প্রায়ই করে। রোজ রোজ ওর কিসের জন্যে যে মুখ ভারী হয়ে যায় বুঝতে পারে না অয়ন! ছোটোর থেকেই ও এমনিতে মেয়েদেরকে কম বুঝে! মেয়েদের সাথে কম কথা বলে। তরুলতার সাথে বিয়ের আগে অবধি ওর জীবনের একমাত্র খুনসুটির সঙ্গী ছিল ওর বোন অয়ন্তিকা। ভেবেছিল তরুলতাও ওকে বোনের মতো বুঝবে! কিন্তু মেয়েটার যেন প্রথম থেকেই পাহাড় প্রমাণ অভিমান জমা হয়ে আছে। অয়ন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ও কি চায়! এই তো কাল কতরাত্রি অবধি শোবার ঘরে অপেক্ষা করে রইলো অয়ন, তারপরে উঁকি মেরে দেখলো তরুলতাকে, একইরকম খাতা নিয়ে ব্যস্ত। শেষে বিরক্ত হয়ে নিজেই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। এভাবে হয় না কি! ও একা আর কতো বুঝদার হবে!
মাঝে মাঝে তো অয়নের ভীষণ অবাক লাগে তরুলতার মতো একটা গেঁয়ো সেকেলে মানসিকতার মেয়েকে আজকের যুগে ওর মা ওর জন্যে কিভাবে পছন্দ করলো! ওর মা কি জানতেন না যে অয়ন দিল্লীতে একা থাকে। আর এই ভিনরাজ্যে একা সব দিক গুছিয়ে চলার জন্যে যুগের উপযুক্ত স্মার্ট মেয়ে চায়। এরকম আবেগে অভিমানে সারাদিন গোমড়া মুখে বসে থাকার জন্যে তো ও একটা পুতুলকে বিয়ে করলেও চলতো। তরুলতার মতো মেয়েকে অয়নের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যেই কি ওর মা সব সময় বলতো আমি যাকে পছন্দ করে দেবো দেখবি তুই তাকে নিয়ে সুখে থাকবি। বিয়ের পরেও অয়নকে বলেছিল দেখবি তরুকে নিয়ে কোনোদিন তোর আফসোস হবে না। এখন মনে হয় এর থেকে তো ও শঙ্খ দা বা ওদের অফিসের অরিন্দমের মতো এখানেরই কোনো অবাঙালি কর্মরত মেয়েকে বিয়ে করলে অনেক ভালো থাকতো। অন্তত সারাদিন ওই ভারী অভিমানী মুখটা দেখতে হতো না।
****
-"আরে বাবা, তাতে খারাপ কি হয়েছে! এই তো এতোদিন বলছিলি তিনি না কি সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকেন.. তোর জন্যে সময় দেন না... তো ভালোই তো হয়েছে, অফিস থেকে যখন তাকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম অপশন দিয়েছে সে ঘরেই থাকবে।"
ভারী গলায় দেবলিনাকে ধমক দিয়ে তরুলতা বলল,
-"মোটেও কিছু ভালো হয়নি। সারাদিন ওই কেজো লোকটাকে চোখের সামনে দেখলে আমার বিরক্তি আরো বেড়ে যাবে। ঘরে থাকলেই তিনি যেন কত আমাকে নিয়ে থাকবেন!"
দেবলিনা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলো,
-"তো তুই এখন কি করতে চাইছিস?"
-"আরে, বাড়ি যেতে চাইছি... ও থাকুক এই গুমোট শহরের বন্দী রুমে দমবন্ধ হয়ে... আমি বর্ধমান ফিরে যাবো। বাবা মা তোদের সবার সাথে গিয়ে থাকবো।"
দেবলিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-"কাকিমাকে বললি! রাজি হলেন!"
রাগে গজগজ করতে করতে তরুলতা বলল,
-"মা রাজি হচ্ছে না বলেই তো তোকে বলছি মাকে একটু বুঝিয়ে বল না... মা বলছে ওকে একা ফেলে রেখে এই খারাপ সময়ে আমার এখানে চলে আসাটা ঠিক নয়। আচ্ছা, তুই-ই বল তো আমি ওর কি কাজে লাগি! আর কবে ওর সাথে ছিলাম! সেই তো ও সারাদিন পড়ে থাকবে ওর যন্ত্রটা নিয়ে! আর আমি জানালার পাশে আমার খাতা নিয়ে...."
দেবলিনা আর কিছু অভিযোগ শুনতে না চেয়েই বাস্তব পরিস্থিতিটা খুব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করলো,
-"দেখ, সব কিছু ছেলেখেলা নয় তরু... আমার পরীক্ষা অবধি ক্যানসেল হয়ে গেছে। দূরপাল্লার বেশিরভাগ ট্রেন বন্ধ। তুই কিসে আসবি! তাছাড়া তুই দিল্লী থেকে এসেছিস শুনলে হয়তো দেখবি আমাদের পাড়ার ক্লাব থেকেও স্বাস্থ্য দপ্তরে অভিযোগ করে আসবে। সেই এখানে এসেও তোকে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে...."
কাঁদো কাঁদো স্বরে তরুলতা বলল,
-"আমাদের শ্রীপল্লিতেও এরকম করবে! কিন্তু আমি তো বিদেশ থেকে ফিরছি না... দিল্লী থেকে গেলেও আমাকে অসামাজিক ভাবে কেন থাকতে হবে!"
বিরক্তিভরা গলায় দেবলিনা বলল,
-"তোর কি মনে হচ্ছে সরকার প্রশাসন সবাই আমাদের সাথে মজা করছে! আরে, আমাদের ভালোর জন্যেই তো বলছে... শুধু তুইই কেন, আমরা সবাই হয়তো কিছুদিনের মধ্যে ঘরবন্দী হতে চলেছি... দেখতে পাচ্ছিস এতোদিন প্রিপারেশন নেওয়ার পরে আমার এক্সামটা অবধি অনির্দিষ্টকালের জন্যে পোষ্টপন্ড হয়ে গেল! সামনের কয়েকটা সপ্তাহ আমাদের জন্যে খুব ভাইটাল। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আগে কি আমরা একটু সাবধান হতে পারি না!"
-"দেবু, তুই এতো রাগ কেন করছিস! প্লিজ একটু আমার কথাটাও ভাব! অয়নের সাথে এইভাবে সবসময় ঘরের মধ্যে... ওর ওই বোবা মুখটা সারাক্ষণ দেখতে দেখতে কোনদিন হয়তো মাথাতে এতো রাগ উঠে যাবে যে হাতাহাতি হয়ে যাবে!"
তরুলতার কথা শুনে আর রেগে থাকতে পারলো না দেবলিনা। হাসতে হাসতে বলল,
-"সেটাই ভালো হবে... মারামারি, হাতাহাতি যা করার আছে এই হোম কোয়ারেন্টাইনের সুযোগে সেটা করেই ফেল..."
অনেকক্ষণ তরুলতা চুপ করে ফোনটা ধরে থাকতেই দেবলিনা আবার ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো,
-"বাস্তবটা তোর রঙ তুলি আর স্বপ্নের মতো সুন্দর নয় তরু... স্মার্টফোন না ইউজ করলেও খবর চালিয়ে দেখ কি মহামারি চলছে চারপাশে! হু হু করে বেড়ে চলেছে কো-ভিড নাইন্টিনে আক্রান্তের সংখ্যা, তোর স্বপ্নের হানিমুন প্লেস রোম আর প্যারিস হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। ইটালি, ইরান, ফ্রান্স, স্পেনে মৃত্যু মিছিল চলছে... আমাদের ইন্ডিয়ার পরিণতিও যে এরকম হবে না কে বলতে পারে!"
বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো তরুলতার। কাঁপা আওয়াজে বলল,
-"তুই তো জানিস দেবু, আমার ভালো লাগে না নিউজ চ্যানেলে ওই মৃত্যুর...."
ওকে থামিয়ে দিয়ে দেবলিনা বলল,
-"না চাইলেও আমরা বাস্তবটাকে তো অস্বীকার করতে পারিনা। তুই চোখ আর কান বন্ধ করে নিলেই তো পুরো পৃথিবীটা বন্ধ হয়ে যায় না!"
কথাটা যে দেবলিনা মিথ্যে কিছু বলেনি তা বুঝতে পারছে তরুলতা। ওদের বসন্তকুঞ্জের কমপ্লেক্সেও এখন যারাই আসছে হাতে স্যানিটাইজার, মুখে মাস্ক ব্যবহার করছে। এই তো সকালে ওদের কমপ্লেক্সে যখন সবজি দিতে এসেছিল তখনই ও সবার মুখে কেমনই আতঙ্কের ছাপ দেখেছিল! ওদের কমপ্লেক্সের গেটম্যান থেকে শুরু করে ওর ঘরের কাজের পরিচারিকা বিন্দি দিও মাস্ক ব্যবহার করছে। পরিবেশটা কেমনই থমথমে হয়ে গেছে। যেন কোনো বড় ঝড় যে কোনো মুহূর্তে আছড়ে পড়বে! প্রতিটা মানুষ ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে।
****
আজ বেশ অবাক হয়েই টিভির রুমে এসে তরুলতার পিছনে দাঁড়ালো অয়ন। তরুলতা এতো সকালে নিউজ চ্যানেল দেখছে! অয়ন নিজের চোখ দুটো ভালো করে ঘষলো। এখনো মনে আছে সেদিনের কথা। অয়ন টিভিতে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখছিল। তরুলতা জোর জোর পায়ে হেঁটে টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, "তুমি মানুষ না কষাই! এসব রক্ত, খুন দেখতে গায়ে কাঁটা দেয় না!"
মিনমিনে স্বরে অয়ন বলেছিল, "আরে, কাল বসিরহাটের কাছে ঘটেছে... আমি থোড়িই মার্ডার করেছি। খবর দেখবো না!"
বড়ো বড়ো চোখ করে কিছুক্ষণ রণচন্ডির মতো দাঁড়িয়েছিল তরুলতা। অয়নের মনে হয়েছিল স্বয়ং মা কালিই খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ত টিভিতে দেখায়নি, দেখাচ্ছিল তরুলতার দুটো চোখে। তারপর থেকেই অয়ন আর বাড়ির টিভিতে খবরের চ্যানেল চালাবার সাহস পায়নি।
কালকে অনেক রাত্রি অবধি অয়ন অফিসের কিছু পেন্ডিং কাজ ঘরের ল্যাপটপে কমপ্লিট করেছে। তারপরে সকাল সকাল এই চিত্র দেখে বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলো,
-"ইয়ে.. মানে তোমার শরীর ঠিক আছে তো?"
তরুলতা ওর দিকে ঘুরে তাকাতেই অয়ন দেখলো ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। ভয় ভয় করে অয়ন বলল,
-"বাইরে খুব খারাপ পরিস্থিতি। সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ইন্ডিয়াতেও চারজন মারা গেছেন। তোমার কষ্ট হচ্ছে যখন নিউজ কেন চালালে! আমিও তো এজন্যেই তোমাকে কিছু বলিনি।"
চোখের কোণ দুটো মুছে তরুলতা বলল,
-"আমি না দেখলেও তো কিছু বদলে যাবে না, বলো!"
আজ প্রথমবার তরুলতার চোখ দুটো দেখে কেমনই মায়া লাগছিল অয়নের। সত্যিই মেয়েটা খুব নরম মনের। সেই জন্যেই হয়তো ওর মনের মধ্যেও যা চলে কিছুই বলতে পারে না। অয়ন হালকা হেসে তরুলতার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে বলল,
-"চলো আজ একটা মুভি দেখি..."
হাঁ করে অয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো তরুলতা। মানুষটাকে ওর কেমনই যেন অচেনা লাগছে। অয়ন ওর সাথে মুভি দেখে সময় নষ্ট করতে চাইছে!
তরুলতা কিছু কথা বলছে না দেখে অয়নই আবার জিজ্ঞাসা করলো,
-"আচ্ছা, তোমার নিশ্চয় একশন মুভি পছন্দ নয়! কি দেখবে! রোম্যান্টিক না কমেডি!"
বলতে বলতেই তরুলতার পাশে গিয়ে বসলো অয়ন। তরুলতা প্রাণ ভরে একটা শ্বাস বুকে টেনে নিয়ে বলল,
-"তোমার যেটা ইচ্ছা..."
অয়ন হয়তো ওকে আশ্বস্ত করতেই বলল,
-"তুমি এতোবেশি চিন্তা করো না... দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে.. শুধু আমরা তো নই, বেশিরভাগ সবাই বাড়িতেই আছে... আর এভাবে নিজের বাড়িতে ইয়ে মানে অসামাজিক ভাবে কিছুদিন কাটাতে পারলেই আমরা আবার আমাদের সমাজটা ফিরে পাবো।"
এতো ভয় আর উদ্বেগের মধ্যেও অয়নের ওই অসামাজিক শব্দটা উচ্চারণ করার ধরণ দেখে হাসি পেয়ে গেল তরুলতার। মনে পড়লো কিছুদিন আগেই ও অয়নকে রাগ দেখিয়ে বলেছিল, "সারাক্ষণ ঘরে একা একা! কোনো বাঙালি পড়শী অবধি নেই! তারপরে তোমাদের মতো স্মার্টফোন হাতে স্মার্ট হতে গিয়ে আমি আর এর বেশি অসামাজিক হতে পারবো না!"
অয়ন বড়ো বড়ো চোখে ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েই ওকে আর অসামাজিক হবার জন্যে সেদিন জোর করেনি।
****
গত কয়েকদিন ধরে তরুলতার সাথে একই ছাদের তলায় একপ্রকার বন্দী হয়ে আছে অয়ন। মেয়েটাকে ও এতোদিন যতটা ব্যাকডেটেড মনে করতো ততটা যে নয় সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে। এই তো কাল অয়ন একটা নতুন পারফিউমের ওয়েবসাইট ডিজাইন করছিল। তরুলতা যে পাশের থেকে ওর ল্যাপটপের ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে ও খেয়াল করেনি। শেষে তরুলতা খাতার মধ্যে সুন্দর একটা ফ্লোরাল প্রিন্ট ডিজাইন এঁকে তার উপরে একটা মেয়ের ধোঁয়াশা ধরণের ছায়া করে বলেছিল, "দেখো এরকম করলে ভালো হবে না! পারফিউমের ফ্র্যাগনেন্সটা হাইলাইটেড হবে..."
বিষয়টা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করছিল অয়ন। তাই হঠাৎ একটা সুন্দর ডিজাইন সামনে পেয়ে বলে উঠেছিল, "এক্সিলেন্ট! ব্রিলিয়ান্ট হবে লোগোটা!"
তারপরেই অবশ্য তরুলতার খুশিতে ঝলমলে মুখটা দেখে মিইয়ে গিয়ে বলেছিল, "ইয়ে মানে তুমি! মানে তুমি আঁকলে এটা!"
তরুলতা হাসতে হাসতে বলেছিল, "হ্যাঁ আমি। আঁকতে তো আমি ছোটোর থেকেই খুব ভালোবাসি। অয়ন্তিকাও জানে।"
শেষের লাইনটা বলে যেন তরুলতা অয়নকে বোঝাতে চেয়েছিল এই তিনমাসে তোমারও জানাটা উচিত ছিল! না জেনে অন্যায় করেছো!
আর বেশি কিছু অবশ্য বলতে পারেনি অয়ন। কারণ প্রায়ই ওকে খাতা, স্কেচ নিয়ে বসে থাকতে আগেও দেখেছে অয়ন। তবে ও যে জানালার ধারে বসে বসে ছবি আঁকে সেটা কি করে জানবে!
তরুলতা অয়নের সামনে এসে গলা ঝেড়ে বলল,
-"এই যে, চাল, ডাল, মশলা সব ঘরে বাড়ন্ত... কমপ্লেক্সে তো জিনিস দিতে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। মার্কেট বন্ধ... আর কতদিন চলবে এভাবে!"
ঘোর কাটলো অয়নের। সত্যিই গত কিছুদিন ধরে ঘরের মধ্যে এইভাবে বন্দী জীবন কাটাতে কাটাতে ও বেশ বুঝতে পারছে তরুলতার মুখটা কেন দিনের শেষে ওইরকম ভারী হয়ে থাকে! কেন এতো অভিমান জমা হয় ওর মনে! কতটা বিশ্রী, একঘেঁয়ে, ক্লান্তিকর জীবন কাটাতে হয় ওকে এই চারদেওয়ালের মধ্যে একা একা! আর অয়ন অফিসে বসে ভাবে সারাদিন তো ঘরে তরু আরাম করছে! তারপরে এতো মান অভিমানের কি আছে!
চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে এবার বেশ জোরেই বলল,
-"বিন্দি দি তো আসা বন্ধ করে দিয়েছে, চা শেষ হলো... এবার কিন্তু একবেলা খেয়ে থাকবে। আমাকে দোষ দিও না। তিনদিন ধরে আমি বলছি..."
ইতস্তত করে ঘাড় চুললে অয়ন বলল,
-"তুমি কি খাতাতেই আঁকতে পারো! না ডিজিটাল মানে ল্যাপটপেও..."
তরুলতা অয়নের কাছে এতো সিরিয়াস একটা বিষয়ে কথা বলছে, কাল কি খাবে তার ঠিক নেই! সব জায়গাতে লকডাউন আর ও এখন তরুলতার আঁকার খবর নিচ্ছে! ভ্রু দুটো জোড়া করেই তরুলতা বলল,
-"কেন বলো তো! স্কুলে পড়ার সময়ে ডেস্কটপে পেন্ট করেছি... তবে আমি আবার একটু বেশি ব্যাকডেটেড কি না! ডেস্কটপের স্ক্রিনে আমার ঠিক পোষায়নি... মানে খাতা আর রঙ তুলিতে যেই তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা ওই ডিজিটাল ড্রয়িং-এ নেই..."
অয়ন আরেকবার কি যেন ভেবে বলল,
-"এই খারাপ সময়টা তো ঠিক পেরিয়ে যাবে। আবার দোকান, বাজার খুলবে। আমার অফিসও খুলে যাবে। তারপরে তুমি তো আবার এখানে সেই একা। মানে তোমার যদি ইচ্ছা থাকে তুমি আমাকে হেল্প করতে পারো। মানে ল্যাপটপে না পারলেও, খাতাতে করলেও আমার... "
বিরক্তির চোখে অয়নের দিকে তাকিয়ে তরুলতা বলল,
-"ল্যাপটপে পারবো না কখন বললাম! ভালো লাগে না তেমন সেটাই বলছিলাম..."
-"না, ইয়ে মানে সেদিন তোমাকে ল্যাপে মুভিগুলো দেখতে দিলাম... তুমি কিছু না বলে উঠে গেলে তাই ভাবলাম হয়তো!"
হো হো করে হেসে ফেলল তরুলতা। বলল,
-"সে তো তোমার কাছে দেখার মতো মুভি ছিল না তাই... কোনো বই পড়তে ভালো না লাগলেই কেউ বুঝি নিরক্ষর হয়ে যায়!"
ক্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইলো অয়ন। হাতে একটা চুটকি বাজিয়ে তরুলতা বলল,
-"সেটা তো পরের কথা... বলছি যে চা পাতা শেষ হলো। চাল, চিনি, ময়দা সব বাড়ন্ত... তাড়াতাড়ি কিছু ব্যবস্থা না করতে পারলে মিসেস আহুজা, মিস গুপ্তাদের মতো এবার আমাদেরও একবেলা খেয়েই থাকতে হবে... সেই মতো রেডি হও।"
বর্তমান পরিস্থিতিটা ভাবলেই অয়নের বুকের ভিতরটাও কেমন যেন করে! মনে হয় ওরা সত্যিই বাঁচবে তো। এইভাবে ইঁট পাথরের বন্দী দেওয়ালে করোনার থাবাতেই ওদের জীবনটা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না তো!
****
একই ঘরে চব্বিশ ঘন্টা কাটাবার সূত্রে ভালো করেই তরুলতা অনুধাবন করেছে এরকম ক্যাবলা ছেলের আর যাইহোক গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে না। অয়নের জীবনে ওই প্রথম আর ওই শেষ। এমনকি প্রথমদিকে অফিসের কোনো কলিগ ফোন এলেও কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করেছে তরুলতা। দুয়েকটা কাজের উত্তর ছাড়া কিছুই বেরোয়নি অয়নের মুখ থেকে।
এরকম ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও তাই তরুলতা যেন আগের থেকে অনেক বেশি শান্ত আর নিশ্চিন্ত। ঘরে খাবার না থাকলেও মনে বিশ্বাস আছে এই বিপদের দিন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে। সরে যাবে ঘন কালো মেঘ, হেসে উঠবে সূর্যের আলো।
-"আচ্ছা তরু, তোমার কাছে লুডো আছে!"
অয়নের এমন পাগলের মতো প্রশ্নে ভ্রু দুটো জোড়া করে তরুলতা বলল,
-"লুডো! লুডোতে কি হবে! ঘরে খাবার নেই তাই লুডো ছিঁড়ে খাবে!"
গাল দুটো ফুলিয়ে অয়ন বলল,
-"লুডো কেন খাবো!"
-"তবে কি আজ থালা, ঘন্টা বাজাবার মতো এবার লুডো খেলো কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তোমার সরকার! মানে ঘরে বসে লুডো খেললে ভাইরাসটা পালাবে বলেছে!"
গম্ভীর হয়ে অয়ন বলল,
-"সরকার শুধু আমার কেন! তোমারও তো... আর থালা, ঘন্টা, শাঁখ বাজাবার মধ্যে তো খারাপ কিছু ছিল না। শুধু ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে নয়, আজ আমরা শাঁখ বাজিয়ে নিজের নিজের ঘরে বসেই একে অপরকে বলেছি পাশে আছি। মহাভারতের যুদ্ধনিনাদের মতোই ধরো এটা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা। একে অন্যকে বলা অসামাজিক হয়েও আমরা সমাজবদ্ধ আছি। সবার এই একতাতেই একটা বিশ্বাস যেন মনের মধ্যে কাজ করেছে হয়তো এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।"
অয়নের কথাটা কাটবার মতো যুক্তি খুঁজে পেল না তরুলতা। ও চুপচাপ আছে দেখে অয়নই আবার বলল,
-"এমনিই আজ লুডোটা দেখে... মানে ইচ্ছে হলো... সেই কোন ছোটোবেলায় খেলেছি তো..."
তরুলতা এতক্ষণে বুঝতে পারলো লুডোর কথা অয়ন কেন বলছে! বকুনি দিয়ে বলল,
-"না বলে অন্যের জিনিসে হাত দিতে নেই তুমি জানো না!"
হকচকিয়ে গিয়ে অয়ন বলল,
-"আসলে অফিসের একটা ফাইল খুঁজতে গিয়েই লুডোটা পেলাম.... তুমি ওখানে তোমার জিনিস রেখেছো বলে জানতাম না। আসলে সারাদিন ঘরেই বসে আছি তো, তাই ভাবলাম.."
অয়নের মুখটা দেখে অনেক কষ্টে হাসিটা চাপলো তরুলতা। কে বলবে অয়ন গম্ভীর, চুপচাপ, গোমড়া মুখো একটা ছেলে! তরুলতার তো এই ক'দিন ওকে সর্বক্ষণ দেখে ক্যাবলারাম বলেই মনে হয়েছে।
****
-"আরে, এখানেও সব পৌর শহরে লকডাউন চলছে। কি বিশ্রী অবস্থা! সবাই আতঙ্কে প্রহর গুনছি। জানিনা কি হবে! এইভাবে ঘর বন্দী হয়ে ক'দিন কাটানো যায় বল তো! দোকান, বাজার সব বন্ধ। রাস্তায় বাস ট্রেন নেই। যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর জন্যে আমরা সব যমপুরীতে বসে অপেক্ষা করছি।"
এই প্রথমবার দেবলিনা এতো চিন্তিত গলায় কথা বললেও তরুলতার গলাতে ও একটুও উদ্বেগ দেখতে পেল না। বরং তরুলতা হাসিমুখেই বলল,
-"হয়তো এটাও প্রয়োজন ছিল। কাছের মানুষগুলোর সাথে থাকা, প্রিয়জনদের পাশে বসে একটু সময় কাটানো... সম্পর্কগুলোও যে সময়ের অভাবে হাঁপিয়ে উঠে। খারাপ সময় ঠিক কেটে যাবে রে... দেখিস, আবার কর্মব্যস্ত হয়ে উঠবে আমাদের দেশটা।"
দেবলিনা ফোনেই কিছু অনুমান করে বলল,
-"তার মানে অয়ন দা আর তোর মধ্যে সব কিছু ঠিক হতে শুরু হয়েছে, তাই না!"
লাজুক স্বরে তরুলতা বলল,
-"আমি না মিথ্যেই ওকে সন্দেহ করতাম... ও তো এক নম্বর ক্যাবলা একটা! প্রেম কি করবে অন্য কারো সাথে! নিজের বিয়ে করা বৌয়ের সাথেই ভালো করে কথা বলতে পারে না!"
দেবলিনা এতো কিছু খারাপের মাঝেও একটুকরো ভালো টপিক পেয়ে ছাড়তে চাইলো না। বেশ আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল,
-"দেখ, আমি বলেছিলাম না অয়ন দার মতো ছেলে হয় না! তোদের বিয়ের সময় কিছুক্ষণ মাত্র কথা বলেই আমি এতোটা বুঝে গেছলাম আর তুইই পারিসনি!"
বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিয়ে তরুলতা বলল,
-"হ্যাঁ রে দেবু তুই ঠিকই বলতিস, আমি নিজের চোখ কান বন্ধ করে নিলেই তো বাস্তবটা বদলে যায় না... এখন আমি ওর সাথে বসে খবরও দেখি আর ও আমার সাথে বসে রোম্যান্টিক মুভিও দেখে... আর জানিস, কাল ও আমার সাথে বসে টানা তিনঘন্টা লুডো খেলেছে.... অয়ন একটুও গম্ভীর নয়। হি ইজ লাইক এ চাইল্ড... একদম বাচ্চাদের মতো। হেরে গেলেই বলছে চলো না আবার খেলি!"
দেবলিনা হাসতে হাসতে বলল,
-"তুই না ভীষণ শয়তান! নিজে তো দিব্যি হোম কোয়ারেন্টাইনে বরের সাথে প্রেম করছিস আর আমাদের সিঙ্গেলদের বুঝি এসব শুনে অনুশোচনা হয় না!"
-"এই জন্যেই তো তোকে এতোদিন বলেছি টমবয় ইমেজটা ছেড়ে প্রেম ট্রেম কর... আর প্রেম করতে না পারলে বল, ডাইরেক্ট ছেলে দেখছি.... তুই বললে অয়নকে বলেই দেখবো ওদের অফিসে তোর উপযুক্ত কোনো ছেলে আছে কি না! তাহলে আমরা দুজনেই এখানে...."
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো ওরা দুই বন্ধু ফোনের দুই প্রান্তে। একজন দিল্লীর বসন্তকুঞ্জে, অন্যজন বর্ধমানের শ্রীপল্লি। ওদের হাসির গুঞ্জনে কে বলবে বসন্তের বাতাসে করোনা এখনো বিষ বাষ্প ছড়াচ্ছে! মনের জোর এভাবেই যে হারিয়ে ফেলে সব বিভীষিকাকে। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতও ফিরে যায় সম্পর্কের এরকম উষ্ণ স্পন্দনে!
****
সকালের চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে আজ আবার বলল তরুলতা,
-"এই তোমার চা শেষ হলো... চাল, ডাল, চিনি, ময়দা সব বাড়ন্ত... কিছু ব্যবস্থা করতে না পারলে মিস গুপ্তা, মিসেস আহুজাদের মতো একবেলা খেয়ে থাকতে হবে এরপর থেকে..."
অয়নের হাসিটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। তরুলতা ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে বড়ো বড়ো চোখে বলল,
-"তুমি হাসছো! একে বিন্দি দি নেই... দেখতে পাচ্ছো কত কাজ! সারাদিন একা কি কষ্টে ম্যানেজ করছি তা আমিই জানি... আর আমার এতো কষ্টে তোমার হাসি পাচ্ছে!"
অনেক কষ্টে হাসিটা চেপে অয়ন বলল,
-"না ইয়ে মানে গত সাতদিন ধরে তুমি একই কথা বলছো... অথচ সময়ে চা, ব্রেকফাস্ট, দুপুরে ভাত, রাত্রে রুটি সবই সামনে চলে আসছে... তাই ভাবছি এটা তোমার ম্যাজিক না কি মায়ের!"
তরুলতা অবাক হয়ে বলল,
-"মায়ের! মা এখানে কোত্থেকে এলো!"
অয়ন হালকা হেসে চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে তরুলতাকে ওর পাশে সোফায় বসিয়ে বলল,
-"মা আমাকে বলেছিল আমার পছন্দে বিয়ে করলে দেখবি সারাজীবনে কখনো আফসোস করতে হবে না। মা বলতো বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এমন কিছু ক্ষমতা থাকে যেটা পৃথিবীর আর কোনো মেয়ের মধ্যে থাকে না। সেটাই এখন প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারছি তোমার এই ম্যাজিক দেখে...."
তরুলতা পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো অয়নের মুখের দিকে। অয়ন হেসে বলল,
-"তোমাদের হলো গিয়ে দ্রৌপদীর হেঁসেল... চাল, ডাল, চা, চিনি সব শেষ না বলে বাড়ন্ত শব্দের ব্যবহার করেই মনে হয় তোমরা বাড়িয়ে দিতে পারো। আমার মাও ঠিক এভাবেই বাবাকে পাঁচ দিন বলার পরেও যখন বাবা নুন, তেল আনতে ভুলে যেত তখনও দিব্যি মায়ের রান্না চলতো। তাই মনে হয় মা বলেছিল বাঙালি মেয়েদের মতো গুছিয়ে সংসার করতে আর কেউ পারে না। প্রয়োজনে সব কিছু হাতের কাছে যোগান দেওয়ার অদ্ভূত ক্ষমতা থাকে তোমাদের মধ্যে..."
অয়নের এতো প্রশংসা সামনে থেকে শুনে লজ্জাতে লাল হয়ে যাচ্ছিল তরুলতা। হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বলল,
-"ছাড়ো, স্নান করতে যাবো। তোমার চা ঠান্ডা হয়ে গেল... অনেক কাজ পড়ে আছে আমার... জানো তো, বিন্দি দি নেই।"
স্নান সেরে বেরিয়ে এসে তরুলতা অবাক হয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে বলল,
-"এ কি! তুমি আলু কাটতে বসেছো!"
অয়ন ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-"কেন! বিয়ের আগে তো আমিই কাটতাম... আজ ভাবলাম বাঙালি গৃহিনীদের ওই ম্যাজিক ট্রিকটা মানে বাড়ন্তের ট্রিকটা যদি শিখতে পারি!"
তরুলতা ইতস্তত করে বলল,
-"না মানে তবুও তুমি কেন! আমি তো করছিলাম..."
অয়ন ওর চোখে চোখ রেখে হেসে বলল,
-"তুমি যদি আমার ডিজাইনে হেল্প করতে পারো, আমি তোমার রান্নাতে পারিনা! সংসার তো দুজনেরই...."
তরুলতা ওর লজ্জা রাঙা মনে ভাবছিল, একটু সময় কত কিছু ভুলবোঝাবুঝি মিটিয়ে দেয়! করোনা না এলে ও চিনতেই পারতো না ওর সামনের মানুষটাকে!
****
অনেকদিন পর আজ লকডাউনের অর্ডার সরকার থেকে তুলে নিয়েছে। ভারত এখন করোনামুক্ত বলে ঘোষনা হয়েছে। এই প্রথমবার সবাই ছুটির শেষে খোসমেজাজে অফিসে জয়েন করছে। প্রতিদিনের গতানুগতিক কর্মজগতে ফিরে আসতে পেরে সবাই যেন খুশি। একমাত্র মুখ ভারী অয়নের। মনটা ওর পড়ে আছে তরুলতার কাছে। তাড়াতাড়ি এতোদিনের জমে থাকা কাজ সারবার চেষ্টা করছে। যাতে ওর জন্যে আরেকটু বেশি সময় নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।
এতোদিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর করোনাকে হারাবার উল্লাসে প্রতিটা অফিসে, স্কুলে, কলেজে আজ মিষ্টি খাচ্ছে সবাই। এতোদিন একে অপরের হাত ছেড়ে পাশে থাকার যে অঙ্গীকার পালন করেছে সবাই এবার একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে, হাত মিলিয়ে ভাগ করে নিচ্ছে জীবনের ছন্দ ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
শঙ্খ দা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে অয়নের ক্যাবিনে ঢুকে ওকে মনমরা দেখেই বলল,
-"কি রে! সবাই কতো আনন্দ করছে আর তুই এসেই কাজে বসে গেছিস!"
অয়ন ব্যস্ততার মধ্যেই কাজ করতে করতে বলল,
-"না, আসলে অনেকদিন ধরে সব কাজ জমা আছে তো, তাই..."
শঙ্খর চোখের দিকে চোখ মেলাচ্ছে না দেখেই শঙ্খ কিছু অনুমান করে অয়নকে জিজ্ঞাসা করলো,
-"তরুর সাথে সব ঠিক আছে তো! মানে তরু ভালো আছে তো!"
তরুলতার নামটাও যে অফিসের ভ্যাপসা গরমে একপশলা বৃষ্টির মতো ওকে ধুইয়ে দিতে পারে সেটা আজ প্রথম অনুভব করলো অয়ন। শঙ্খ দার কাছে কতবারই তো ওর কথা আলোচনা করেছে, কিন্তু এরকম লজ্জা তো আগে লাগেনি।
হালকা হেসে অয়ন মাথা নীচু করে বলল,
-"তুমি ঠিক বলেছিলে শঙ্খ দা... একে অপরকে জানার জন্যে, বোঝার জন্যে, মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সময়টার খুব প্রয়োজন... ব্যস্ততার দৌড়ে আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যায় স্থির ভাবে এক মুহূর্ত শ্বাস নেওয়ার কথা। প্রিয়জনদের হাতে হাত রেখে মান অভিমান ভুলিয়ে দেওয়ার কথা... করোনা নামের বিষাক্ত ভাইরাসটা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেল ঘরে নিজের আপনজনের সাথে ছুটি কাটানো, তাদের আবেগ, আব্দারগুলো বোঝার চেষ্টা করারও দরকার আছে..."
শঙ্খ অয়নের পিঠ চাপড়ে বলল,
-"আরেব্বাস! তুই তো জেমস বন্ড ছেড়ে বলিউডের রোম্যান্টিক হিরোদের মতো কথা বলছিস ভাই!"
অফিসের জানালার ফাঁকে রোদ ঝলমলে সকালটার দিকে তাকিয়ে অয়ন বলল,
-"সবই তরুর এফেক্ট! জানো শঙ্খ দা, ও ভীষণ ভালো... একটুও ব্যাকডেটেড নয়.. বরং এতো কিছু পারে আর জানে আমাকেও অবাক করে দেয়। ওর জন্যেই তাড়াতাড়ি করছি। যতটা সময় বাঁচিয়ে ঘরে যেতে পারি। তরু যে আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে।"
শঙ্খ হেসে বলল,
-"এই জন্যেই আমরা মানুষ... শত বিপর্যয়েও প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা বদলায় না। করোনার মতো ভয়ঙ্কর মহামারি আমাদের সাময়িক সময়ের জন্যে হয়তো হাত ছাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু মনের সম্পর্কগুলো বিপদে পড়ে আরো বেশি পোক্ত হয়ে উঠে।"
****
(এক বছর পর)
-"এই জায়গাটা তো আমি... মানে ঠিক এরকমই ট্রি হাউজ... জঙ্গল আর পাশের পাহাড়ি নদীটাও..."
তরুলতার কাঁধে হাত রেখে অয়ন বলল,
-"ফাইল খুঁজতে গিয়ে তোমার লুডোর সাথে তোমার আঁকার খাতাটাও সেদিন পেয়েছিলাম... তখনই ঠিক করেছিলাম আইফেল টাওয়ারে নিয়ে যেতে না পারলেও পরের বসন্তে তোমাকে আমি ঠিক উপহার দেবো পুরুলিয়ার লাল পলাশ...."
দুহাতের মুঠো খুলে এক রাশ পলাশ মেলে ধরলো অয়ন। খুশিতে ছলছলে হয়ে উঠলো তরুলতার চোখ দুটো। আবেগে ওর গলা বুজে আসছিল। কাঁপা স্বরে বলল,
-"গত বছরের সেই ঘরবন্দী দিনগুলো... এখনো মনে আছে তোমার! কি বিভীষিকাময়! তখন ওই আতঙ্কের মধ্যেও এতোকিছু ভেবেছিলে তুমি!"
তরুলতার মাথার খোঁপাতে পলাশ গুঁজে দিতে দিতে অয়ন ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
-"কেন ভাববো না বলো! আমাদের ভাবনার মধ্যেই যে বেঁচে থাকে আশার আলো! আর ওই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিই যে আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছে.... একে অপরের সাথে সময় কাটানোর মূল্যটা বুঝিয়েছে..."
দূরে পাহাড়ের কোলে ঝরে পড়ছে সূর্য কিরণ। পলাশের রঙে লাল হওয়া প্রান্তরের একদিকে ছুটে যাচ্ছে কাঁসাই নদী।
তরুলতা অয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম ঘাসের লতার মতোই ওর বুকে মুখ গুঁজে বলল,
-"সব কিছু খারাপের মধ্যেও কিছু ভালো থাকে, বলো!"
অয়ন তরুলতাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,
-"হ্যাঁ থাকে বলেই তো কালো মেঘ কাটিয়ে রোদ্দুর উঠে, তপ্ত পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির ফোঁটারা ঝরে... আর আমাদের সম্পর্কগুলো সঞ্জীবনির ছোঁয়া পেয়ে নতুন ভাবে বেঁচে উঠে... হাজার অভিশাপের রাত্রি কাটিয়েও ভালোবাসার অনুভূতিরা দীপ্ত কন্ঠে বলে তারা ছিল, আছে, থাকবে.