এক প্লেট বিরিয়ানি
এক প্লেট বিরিয়ানি
বাস থেকে প্রায় ধাক্কা খেয়ে রাস্তার উপর এসে টাল সামলে সৌমাল্যের হাত টা ধরে নামলো রণিতা । মাথার উপর তখন সূর্য্য বাবাজীর আধিপত্য । আজ ওদের দুজনের পি এস সি ক্লার্ক এর মেইন পরীক্ষা ছিলো । রণিতার আশানুরূপ পরীক্ষা না হলেও সৌমাল্য এবার বেশ কনফিডেন্স এবার চাকরি টা বাঁধিয়েই ছাড়বে । আজ প্রায় ৩-৪ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মূল্য তো তাকে পেতেই হতো ।
...
সারাদিনের ক্লান্তিতে , অবসন্ন শরীরে বাসে এমন ধাক্কা খেয়ে রণিতা র মুড টা ঠিক ওই রাস্তার পাশের এগরোলের দোকানে স্টোভের উপর চাপানো, তেতে ওঠা চাটুর মতো হয়ে রয়েছে । রাগে লাল মুখ টার দিকে তাঁকিয়ে বড্ড হাসি পেলো সৌমাল্যর না না মজার হাসি নয় । একটা প্রাপ্তির হাসি। জীবনে সে আর কিছু পাক আর না পাক, এই যে পাগলী মেয়ে টাকে পেয়েছে যে ওর উপর হাজার রাগ দেখলেও কখনো ছেড়ে যায় নি। ভরসা দিয়ে সব সময় পাশে থেকেছে । আর ঠিক এর জন্যই আজ সৌমাল্য তার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় । না হলে নিজের আপন দাদা বউ দিদের কাছে সে একটা বোঝা । দিন রাত উঠতে বসতে কম খোটা শোনায় না তারা ।
তবে রণিতা ওর কষ্ট টা বুঝেছে । আসলে এই মেয়েটাও তো অভাগী । বাবা মা ছোট বেলায় মারা যাওয়ায় পর মামা মামীর সংসারে আছে সে, আর এইখানে ঠিক যেনো তার ঝিঁয়ের অধম অবস্থা ।
তারপরও নিজের যোগ্যতায় পড়াশুনা শেষ করে টিউশন করে , নিজের পায়ের দাড়ানোর অদম্য জীবন যুদ্ধে নেমেছে সে। ঠিক এই কারণেই ওদের দুইজনের ক্ষত টা ঠিক একই রকম । তাই হয়তো একে অপর কে ওরা এতটা বোঝে ।
- অমন হাদার মতো মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছিস কেনো ?
রণিতা র ঝাঁঝালো কণ্ঠে সম্বিত ফিরল সৌমাল্যর ।
সে থতমত খেয়ে বললো,
- না ইয়ে মানে.....
- কি ইয়ে ইয়ে করছিস? আমার খুব খিদে পেয়েছে সকাল থেকে এক কাপ চা ছাড়া আর কিছুই কপালে জোট নি ।
সৌমাল্য এক গাল হেসে বললো,
- আমারও ওই একই অবস্থা শুধু উপরী পাওনা , চায়ের সাথে দুটো মেরী বিস্কুট ।
ওদের একটাই ডেস্টিনেশন জগা দার ফাস্টফুড সেন্টার আর সেই বাঁধা ধরা এগরোল । মাঝে মাঝেই এইখানে আসে ওরা । আর এক সাথে একটা স্বপ্ন ভাগ করে খায় ।
এমন দুপুরে তেমন লোকজনের ভীড় না থাকলেও দু টো টেবিল জুড়ে ৩ টে লোক বসে আছে , তারা নিজেদের দুপুরের আহার সারছে। জগা দার দোকানে বিরিয়ানি খুব ফেমাস । কিন্তু বিগত ৪ বছরে ওরা একবারও সেটা খায় নি । ইচ্ছে করে নি তা নয় তবে পকেট সাথে দেয় নি তাদের। তাই কেউ কাউকে মনের কথা বুঝতে না দিয়ে একটা এগরোল দুইজনে ভাগ করে খেয়েছে ।
আজ অন্য দিনের থেকে পকেটে একটু বেশি টাকা আছে । এই ৯ দিন আগে টিউশনের টাকা পেয়েছে। প্রায় সব টাকা সংসারে দিয়ে দেওয়ার পরও শেষ ১৫০টাকা পড়ে আছে সৌমাল্যর পকেটে। আজ পরীক্ষা টা ভালো হয়েছে অনেক বছর পর মনে একটা ক্ষীণ আলো দেখা দিয়েছে । আজ সে রণিতা কে একটা গোটা এগরোল খাওয়াবে । মনে মনে ঠিক করে দোকানে অর্ডার দিতে যাবে এমন সময়।
রণিতা বললো,
- কি সুন্দর বিরিয়ানির গন্ধ আসছে । কতো বছর যে খাই না ।
সৌমাল্য থমকে গেলো ।
কথা টা বলে রণিতাও বেশ লজ্জায় পরে গেছে ওর চোখ মুখে সেটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । সকাল থেকে খালি পেট খিদের চোটেই কথাটা বলে ফেলেছে সে । আর বলেই লজ্জায় পরেছে।
কয়েক সেকেন্ডে র মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
- জানিস তো সমু এখন এই গন্ধ টায় আমার গা গুলিয়ে ওঠে ওই যে বিশেষ করে মিঠা আতরের গন্ধ টা ।
সৌমাল্য একটা উদাস নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার এই ভীষন অভিমানী প্রেমিকার দিকে , যে চালাকি করে নিজের ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়া গুলোকে লুকিয়ে ফেলতে পারে । আজ এই ৪ বছরের সম্পর্কে কিচ্ছু চায় নি মেয়েটা ওর কাছে ।শুধু বলে গেছে, " আমরা চাকরি পেলে আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ করবো একদিন দেখিস সমু"
মাঝে মাঝে পাঁচ টাকার বাদাম ভাজা, আর পঁচিশ টাকার একটা এগরোলের অর্ধেক খেয়েই ওদের সম্পর্ক টা আজও অটুট । কিন্তু আজকাল ফাইভ স্টার হোটেলে বসে আহামরি খাবার খেয়ে হাজার হাজার টাকার বিল উড়িয়ে দেওয়া মানুষ গুলোও একদিন
" আমাদের ঠিক আর একসাথে চলা যাচ্ছে না"
বলে ছেড়ে চলে যায় চিরতরে ।
- এই তোর হলো টা কি বলতো? অমন ভাবে তাকিয়ে দেখছিস কি?
আবার রণিতা র ধমক শুনে সৌমাল্য হেসে বললো,
- আরে সত্যি বলতে আমিও অনেক দিন খাই না চল আজ বিরিয়ানি হয়ে যাক ।
- মাথা খারাপ , এই খালি পেটে এখন যদি বিরিয়ানীর এক বিন্দু আমার পেটে পরে আমাকে হসপিটালে নিতে হবে । গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আমার , তুই জানিস না ?
বলেই দোকানের কাউন্টারে বসে থাকা জগা দাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- এই যে দাদা লঙ্কা ছাড়া একটা এগরোল বলে দিন না ।
ওকে থামিয়ে এগ রোলের অর্ডারটা ক্যানসেল করে সৌমাল্য রণীতার হাত ধরে সাইডে টেনে এনে বললো ।
- শোন , আজ আমার কাছে টাকা বেশী আছে । চল বিরিয়ানী খাই ।
- না রে তখন আমি .....
- আর কিছু বলতে হবে না । আমার এই রিকুয়েস্ট টা রাখ রুনু ।
তারপর দুইজনে দোকানের সামনে রাখা খাবারে চার্ট টা দেখতে থাকে । খাবারের নামের পাশে পাশেই দাম দেওয়া । এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানী ১৩০ টাকা । দাম টা দেখে সৌমাল্য একটা শুকনো ঢোক গিললো । তারপর অসহায় দৃষ্টিতে রনিতার দিকে তাকিয়ে
বললো,
- রুনু আমার কাছে সর্বসাকুল্যে ১৫০ টাকা আছে । এতে এক প্লেটের বেশী হবে না ।
- আমি তো বললাম চল এগ রোল খাই আজ বিরিয়ানি অন্য দিন হবে।
- কেনো এমন করছিস? আমরা কি এক প্লেট বিরিয়ানি ভাগ করে খেতে পারি না?
রণিতা মায়া ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
- মনে পড়ে তোর সেই প্রথম দিন গুলোর কথা এক কাপ চা আমরা ভাগ করে খেয়েছি আর এটা তো এক প্লেট বিরিয়ানি , অনেক বড় ব্যাপার ।
এই তো মাসের শুরু তোর হাত একদম ফাঁকা হয়ে যাবে । সেটা ভেবেই বলছিলাম আমি।
সৌমাল্য আবার সেই সহাস্য বদনে বললো,
- হাত ফাঁকা হলে তোর কাছ থেকে ধার নেবো ।
জগা দা কাস্টমারের বিল মেটাতে মেটাতে ওই দুটো ছেলে মেয়ে কে লক্ষ্য করছিলো অনেকক্ষণ ধরে ।
....
দোকানের একদম ভেতরের দিকে একটা টেবিল ফ্যানের কাছে ওদের বসতে দিলো জগা দা ।
সৌমাল্য দোকানের কর্মচারী ছেলে টিকে বললো,
- ভাই এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি দিন । আর সাথে একটা এক্সট্রা প্লেট । দেবেন ।
মিনিট পনেরো সময় লাগবে জানিয়ে ছেলেটি চলে গেলো । ছেলেটি একটু হাবাগোব মতন ।
সৌমাল্য এবার মুখ ফিরিয়ে বসতেই চোখে পরল , রণিতার চোখ দুটো ছল ছল করছে ।
ওর হাতের উপর হাত রেখে সৌমল্য জিজ্ঞেস করলো,
- রুনু কি হয়েছে কাদছিস কেনো বল আমাকে?
চোখের জল চুড়িদারের ওড়নায় মুছে সে বললো,
- গত পরশুদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি নিজের ঘরে বসে পড়ছিলাম । হঠাৎ মামী এসে জানালো । রাতে ওরা কেউ খাবে না তাই আমি যেনো শুধু নিজের জন্য দুটো রুটি বানিয়ে নিই।
পড়া শেষ করে রাত ৯.৪০ নাগাদ রুটি করতে গিয়ে নাকে বিরিয়ানির গন্ধ পেলাম । প্রথমে মনে হলো পাশের বাড়িতে করেছে। মাঝে মাঝেই গন্ধ আসে ওই বাড়ি থেকে । তাই ঠাট্টা করে মামাকি বলবো ভাবছিলাম দেখো আজও ওই বাড়িতে বিরিয়ানী হচ্ছে । তারপর মামার ঘরের পাশ থেকে যেতে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মামা, মামী, ভাই ,বোনদের কথা বলার শব্দ পেলাম । একটু দাড়িয়ে ভেজানো দরজার আড়াল থেকে দেখতে পেলাম । ঘরে চারজনে বসে জমিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছে । যাতে আমাকে ভাগ দিতে না হয় সেই কারণে, বড় ঘরে খেতে বসে নি ।
জানিস সমু , দুপুরে মামী মাপা রান্না করেছিলো একটা তরকারি অবধি ছিলো না । সেই রাতে আমি দুটো রুটি আর এক টুকরো পেঁয়াজ খেয়েছি । যদিও আমার কপালে রোজ অমন খাবারই জোটে ।
সারারাত ঘুমোতে পারি নি । এটা ভেবে কেনো আমার মা বাবা চলে গিয়ে আমাকে এই ভাবে একা ফেলে গেলো।
জানিস আমি হ্যাংলা নই রে। তবে, আমি খেলে কি মামা মামী দের বিরিয়ানী খুব কম পরে যেতো ?
বলতে বলতে চোখ ভিজে এলো রনিতার ।
না আজ আর কোনো সান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই সৌমাল্যর কাছে । কিন্তু সে মনে মনে পণ করলো সে তার রুনু কে পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবে ।
......
সামনে রাখা গরম প্লেটের বিরিয়ানির থেকে ধোঁয়া উঠছে।
বিরিয়ানির প্লেটে সরু চালের সাথে মিশ্রিত বিভিন্ন রকম মশলার গন্ধ যেনো ওদের খিদে আরও বাড়িয়ে দিলো।
কর্মচারী ছেলে টি হাবাগোবা হলেও, নিপুণ হাতে সে দুটো প্লেটে সমান ভাবে ভাগ করে দিলো এক প্লেট বিরিয়ানি।
শেষের ভাগ টা দেখে সৌমাল্য আর রণিতা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো তারপর সৌমাল্য কর্মচারী ছেলেটি কে বললো,
- একি এইখানে দুটো পিস মাংসো কেনো?
ছেলেটি মাথা চুলকে কি যেনো ভেবে বললো,
- এটা তো এসপেসাল বিরিয়ানি তাই ।
সৌমাল্য ব্যাস্ত হয়ে বললো,
- না না আমরা স্পেশাল বিরিয়ানী অর্ডার করিনি । ওটার দাম বেশী আমরা ১৩০ টাকার প্লেট টা দিতে বলেছিলাম ।
দূর থেকে টেবিলে কথোপকথন দেখে জগা দা উঠে এসে দাঁড়ালো ওদের কাছে ,
সৌমাল্য তখন বললো,
- দাদা আমাদের মনে হয় ভুল অর্ডার এসেছে । আমরা তো....
ওর কথা শেষ হওয়ার আগে জগা দা বললো,
- আরে ভাই এটা তোমাদেরই অর্ডার করা প্লেট। আমাদের দোকানের এটাই স্পেশালিটি ।
ও একটা ফাঁকি বাজ কর্মচারী কিছু জানে না।
বলেই কাজের ছেলেটিকে ধমক দিয়ে সরিয়ে সৌমাল্য আর রনীতার উদ্দেশ্যে বললো,
- তোমরা এবার শান্ত মনে খাও ।
খাওয়া শেষে করে দাম মিটিয়ে ওরা যেনো একটা পৃপ্তির হাসি নিয়ে দোকান থেকে বেরোলো সেদিন ।
জগা দা মুখে পান চিবোতে চিবোতে তাকিয়ে রইল ওদের চলে যাওয়ার পথে । জগা দার কর্মচারি ভলু মাথাটা বেশ করে চুলকে মালিকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
- এটা কি হলো দাদা ? ১৩০ টাকার বিরিয়ানী তে ওতো বড় বড় দুটো মাংস কেনো দিতে বললে তুমি আমাকে? ওটা তো এস্পেসাল না তাও মিথ্যে বলতে বললে।
জগা দা হেসে বললো,
- ভুল করে বলে ফেলেছি রে ভলু।
- হ্যাঁ এমন ভুল করতে থাকলে একদিন ব্যাবসা লাটে উঠবে এই আমি বলে দিলুম ।
জগা দা আবার হেসে বললো,
- নিঃস্বার্থ কিছু ভালোবাসার অনেক বড় বড় স্বপ্ন চোখের সামনে সংগ্রাম করে গড়ে উঠতে দেখলে এমন ছোটো ছোট দু একটা ভুল করতে হয় রে ।
আর এটা তো কেবল মাত্র "এক প্লেট বিরিয়ানি" ।
হাবা গোবা ভলু আবার মাথা চুলকে ভ্রু কুঁচকে মালিকের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো ।
দুপুরের রোদে তেজ টা কমেছে । একটু পরেই আর একটি ভীড় বাস এসে থামবে ওই চৌরাস্তায় অনেক অনেক টুকরো টুকরো স্বপ্ন নিয়ে ।