সখী ভালোবাসা কারে কয়
সখী ভালোবাসা কারে কয়
রিমঝিম এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে, ওর রেজাল্ট বেরোতে কয়েকটা দিন বাকী আছে এখনও। এখন জোর কদমে জল্পনাকল্পনা চলছে কোন কোন কলেজে ভর্তির ফর্ম ফিলাপ করা হবে, কোন কোন কলেজে তার পছন্দের বিষয়গুলিতে সব থেকে ভালো পড়াশোনা হয়। রিমঝিমের প্রথম পছন্দ অর্থনীতি এবং দ্বিতীয় পছন্দ সমাজতত্ত্ব, ও নিজেই ইন্টারনেটে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট সার্চ করে দেখছে এবং বাবা-মাও খোঁজ নিচ্ছে বিভিন্ন চেনা পরিচিতজনের কাছ থেকেও। ও নিজেও ওর এইচএসের শিক্ষক/শিক্ষিকাদের সাথে আলোচনা করছে। আর এর সব কিছুই নির্ভর করছে রেজাল্ট কেমন হয়, পার্সেন্টেজ কেমন থাকে, বিভিন্ন কলেজের কাট অফ মার্কস্ কেমন থাকবে তার উপর। সুতরাং এত কিছু চিন্তার চাপ নিয়ে রিমঝিম গুম হয়ে আছে, কিছুতেই যেন ওর স্বস্তি নেই।
এইরকম চাপ মাথায় নিয়ে কারুর বিয়েবাড়ীতে যেতে ইচ্ছে করে? কিন্তু রিমঝিমকে যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই বিয়েবাড়ীতে.......ছোট পিসিমণির বাড়ী, ছোট পিসিমণির ছোট ননদের বিয়েতে....ওবাড়ীতে ছোট পিসিমণিকে হাতেহাতে একটু সাহায্য করার জন্য, ছোট পিসিমণি ওবাড়ীর একমাত্র বৌ, শাশুড়ি বয়স্ক ও অসুস্থ। সবকিছু পিসিমণিকে একাহাতেই সামলাতে হচ্ছে, একা একা আর পেরে উঠছে না। ছোট পিসিমণির বাচ্চাটাও খুব দুষ্টু, কিন্তু রিমঝিম ওকে খুব ভালো করে সামলাতে পারে। তাছাড়া ছোট পিসিমণির সাথে রিমঝিমের সম্পর্কটা শুধু পিসি-ভাইঝি নয়, দুজনের বয়সের পার্থক্য মাত্র আট বছর এবং রীতিমতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাই ছোট পিসিমণির কথা রিমঝিম ফেলতে পারলো না। কয়েকদিনের জন্য রিমঝিমকে বাবা পৌঁছে দিয়ে এলো বর্ধমানে ছোট পিসিমণির বাড়ীতে। বিয়েতে বাবা-মা এলে ফুলশয্যার পরেরদিন রিমঝিম ফিরে যাবে বাবা-মায়ের সাথে।
প্রথমে রেজাল্টের চিন্তায় আসতে ইচ্ছে হয়নি ঠিকই, তবে আসার পর বেশ ভালোই লাগছে, যার বিয়ে সে রিমঝিমের থেকে তিন-চার বছরের বড়, সবে অনার্স ফাইনাল ইয়ার শেষ করেছে। বন্ধুর মতোই সম্পর্ক ওর সাথেও, বেশ হৈহৈ করে বিয়ে বাড়ীতে কাজকর্ম আচার অনুষ্ঠান চলছে সব, ছোট পিসিমণির ছেলে তো রিমঝিমের কাছে যেন যাদু মন্ত্রে শান্ত শিষ্ট এক্কেবারে।
ছোট পিসিমণির বাড়ীতে ছোট পিসিমণি, পিসেমশাই, পিসিমণির বৃদ্ধা শাশুড়ি, যার বিয়ে উপলক্ষে আসা সেই ননদ তিথি, পিসিমণির দুষ্টু মিষ্টি ছেলে কোকো আর বিয়ে উপলক্ষে গ্রামের বাড়ী থেকে আসা পিসেমশাইয়ের এক জ্যেঠতুতো ভাইপো দিবাকর। যদিও সে আবার কোলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে, কলেজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
এখন বিয়েবাড়ীর নানান খুঁটিনাটি, শেষ মূহুর্তের কেনাকাটি, বিয়েবাড়ীর জন্য ভাড়া করা লজে গিয়ে সাজানো গোছানোর তদারকি করা, আর দু-একটি দূরের আত্মীয় স্বজন যারা এসে পৌঁছেছে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা সবাই মিলে এসব করেই হুহু করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। রিমঝিমের মনটা একটু হালকাই লাগছে, রেজাল্টের জন্য দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, যা হবার হবে, বরং দুশ্চিন্তা করে কিছুই পাল্টানো যাবে না যখন চিন্তা ছাড়ো.....এই কথাটা যার বিয়ে সেই তিথি(ছোট পিসিমণির ননদ) আর কোলকাতায় পড়া দিবাকর(ছোট পিসিমণির জ্যেঠতুতো ভাশুরপো) বেশ সুন্দর করে বোঝাতে পেরেছে রিমঝিমকে, এখন বিয়েবাড়ীর আনন্দটাই উপভোগ করতে হবে জমিয়ে। কোকো তো সর্বক্ষণই রয়েছে রিমঝিমের কাছেই।
বিয়ের ঠিক আগের রাতে খাওয়া দাওয়ার সময় দিবাকর তো তিথির লেগপুলিং করতে করতে প্রায় তিথিকে কাঁদিয়ে ফেলেছে, এবার রিমঝিম তিথির পক্ষ নিয়ে একদম জবরদস্ত যুক্তিতে দিবাকরকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, দিবাকর তো হাঁ, ডিবেটে প্রত্যেক বার ফার্স্ট হওয়া মেয়ে, তাতে আবার সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে এতো সচেতন, কোনো কথাই সরছে না দিবাকরের মুখে, যুক্তিতে হেরে গেলো ঠিকই কিন্তু দিবাকরের মুগ্ধ দৃষ্টিতে রিমঝিমের কেমন যেন একটু অস্বস্তি করে উঠলো। এতো কিছু বলে ফেলার জন্য রিমঝিম "সরি" বলে ক্ষমাও চেয়ে নিলো দিবাকরের কাছে।
পরেরদিন ভোররাতেই শুরু হয়ে গেলো বিয়ের আচার অনুষ্ঠান একের পর এক, জাঁকজমক করে, সবাই মেতে রয়েছে, আনন্দ করছে, বিয়েবাড়ির এই হৈহৈ, ভিড়ভাড়, লোকজন বরযাত্রী আপ্যায়ন, কনেযাত্রীর তত্ত্ব তালাশ এই সবের মাঝে হৈহৈ করে কটাদিন পার হয়ে গেলো। একে একে সব আত্মীয়স্বজনরা বিদায় নিতে শুরু করেছে, রিমঝিমের বাবা-মা বাড়ী ফেরার সময় ছোট পিসিমণি খুব অনুরোধ করলো, আর তাই বাবা-মা রিমঝিমকে আরও দুদিন থেকে যাওয়ার জন্য বললো। আর কথা হোলো দিবাকর কোলকাতায় ফেরার পথে রিমঝিমকে চুঁচুড়ায় পৌঁছে দিয়ে যাবে কারণ বাবার পক্ষে দুদিন পর আরেকবার আসা সম্ভব হবে না, আর পিসেমশাইও সময় বের করতে পারবে না। সুতরাং সকলে আলোচনা করে এটাই সিদ্ধান্ত হোলো।
বিয়ে-বৌভাত মিটে যাবার পরে বাড়ীতে সব লন্ডভন্ড, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেসব গোছানো গাছানোয় রিমঝিম আর দিবাকর যথাসাধ্য সাহায্য করছে ছোটপিসিমণিকে, আরও দুটো দিন পার হয়ে গেলো দেখতে দেখতে। এবার রিমঝিম বাড়ী ফিরবে আর দিবাকর ওকে কোলকাতা যাবার পথে চুঁচুড়ায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। তাই নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে রিমঝিম দিবাকরের সাথে বাড়ীর পথে রওনা হোলো। বর্ধমান স্টেশন থেকে হাওড়া-গামী ট্রেনে উঠে বসলো দুজনে, সারাটা পথ দুজনেই দুটি ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই ব্যান্ডেলে পৌঁছেছে ট্রেন, দিবাকর বললো, "আর একটা স্টেশন পরেই নামতে হবে," ব্যাগপত্র নামানোর সময় রিমঝিম বললো, "স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে মা রাগ করবে, মা বাবা বলে দিয়েছে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আপনাকে একেবারে বিকেলে কোলকাতা ফিরতে।"
কথাবার্তার মাঝেই ট্রেন চুঁচুড়া স্টেশনে এসে থামলো আর দিবাকরও খুব বেশী আপত্তি না জানিয়েই নেমে পড়লো রিমঝিমের সাথে, চুঁচুড়া স্টেশনে।
তারপর অটোয় করে রিমঝিমের বাড়ীর গলির মুখে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার সময় হয়ে গেছে প্রায়, রিমঝিমের মা সবাইকে খেতে দিয়ে দিলো। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে বসে আলাপ আলোচনা চললো বেশ খানিকক্ষণ রিমঝিমের কলেজে ভর্তি বিষয়ে, কোন কলেজে রিমঝিমের পছন্দের বিষয়গুলি সবচেয়ে ভালো পড়ানো হয়......এইসব বিষয়ই দিবাকরের নখদর্পণে। রিমঝিমের মা বলেই ফেললেন দিবাকরকে, "রিমঝিমের রেজাল্ট আউট হলে অবশ্যই তুমি এইসব ব্যাপারে রিমঝিমকে একটু সাহায্য কোরো।" দিবাকরের উত্তর, "নিশ্চয়ই" তারপর আরও টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলে আবার আসবে রিমঝিমের রেজাল্ট আউটের পরে কথা দিয়ে বিদায় নিলো দিবাকর।
কাগজে দিয়েছে পরেরদিন রিমঝিমের রেজাল্ট বেরোবে, রিমঝিম ভীষণ নার্ভাস, টেনশন করছে খুব। সন্ধ্যের দিকে রিমঝিম শুনলো মা কারুর সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে, রিমঝিমের একদম ভালো লাগছে না, মা জোরে জোরেই কথা বলছে, তাই রিমঝিম আওয়াজ ভালো না লাগায় পাশ কাটিয়ে ছাদে চলে গেলো। একটাই চিন্তা এখন ওর, সকাল দশটা কখন বাজবে, কখন রেজাল্ট জানতে পারবে, আর পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে কিনা।
রাতে ভালো ঘুমই হয় নি, তার ওপর ভোররাতে ঝড়বৃষ্টিতে ইলেকট্রিক লাইনে ও ইন্টারনেট লাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে রিমঝিমদের পুরো অঞ্চল জুড়ে। কীভাবে রেজাল্ট জানতে পারবে তাই নিয়ে রিমঝিম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে, মোবাইল টাওয়ার পর্যন্ত ঠিক করে কাজ করছে না। বাবা খুব চেষ্টা করছে কোনোভাবে যদি জানা যায় রেজাল্ট, আজ আর বাবা অফিস যেতে পারবে না এইজন্য।
বেলা প্রায় বারোটা বাজে, রিমঝিমের বাবা ওর স্কুলে জানতে যাচ্ছে রেজাল্টের খবর, এমন সময় ওদের সদর দরজায় কড়ানাড়ার খটখটানি, ভারী বিরক্ত সবাই, এসময় আবার কে? রিমঝিমের মা তো দরজা খুলে অবাক! দিবাকর? কি ব্যাপার? একগাল হেসে বললো, "পেট পুরে মিষ্টি খাওয়াতে হবে, মেয়ের এই দুর্দান্ত রেজাল্ট!" ওরা তো হতবাক, রিমঝিমের কান্না থেমে গেছে, কীসব বলছে ছেলেটা?
দিবাকর আগেরদিন সন্ধ্যেবেলা ফোন করে যে কত কথা বললো রিমঝিমের মায়ের সাথে, তারপর তো রিমঝিমের রোল নাম্বারটাও জেনে নিলো রেজাল্ট যাতে দিবাকর নিজেই দেখে নিতে পারে, কারণ ভুলে গিয়ে কেউ যদি রেজাল্টটা তাকে না জানায়, তাই এই ব্যবস্থা। এখানে এসে ও এইমাত্র জানলো যে রিমঝিমরা এখনও রেজাল্ট জানতে পারে নি এতো দুর্যোগের কারণে। যাইহোক এখন তো জানা হয়ে গেলো, এবার আর সমস্যা নেই, প্রায় বিরানব্বই শতাংশ নম্বর, খুব ভালো ভাবেই ভর্তি হতে পারবে, শুধু যেখানে যেখানে ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম আছে সেখানে একটু ভালো করে পরীক্ষা দিলেই কোনো সমস্যা হবে না।
রেজাল্ট জানার পর রিমঝিমের মুখে হাসি ফুটেছে, মা-বাবার দুশ্চিন্তাও কমেছে, সবাই মিলে আনন্দ করে মিষ্টি খাওয়া হোলো, দুপুরের খাওয়া দাওয়াও হোলো আর দিবাকরও ওদের পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। পরেরদিন থেকে ফর্ম ফিলাপ শুরু, কীভাবে ফর্ম ফিলাপ করতে হবে রিমঝিমকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে দিবাকর বিদায় নিলো, সন্ধ্যের ট্রেনে। নিজের মোবাইল নাম্বারটা রিমঝিমকে দিয়ে বলে দিলো অনলাইনে ফর্ম ফিলাপ করতে বসে যদি কোনো রকম কোনো অসুবিধা হয় তবে সাথে সাথে যেন রিমঝিম দিবাকরকে ফোন করে সমস্যার কথা জানায়।
পরেরদিনই রিমঝিমের পছন্দের প্রায় সবকটি কলেজের ফর্মই ফিলাপ করা হয়ে গেলো নির্বিঘ্নেই।
দু-একটি বাকি রইলো, আর যে যে কলেজে ভর্তির পরীক্ষা আছে তাদের তারিখটাও জানা হয়েছে, এই পর্যন্ত কথা রিমঝিম ফোন করে দিবাকরকে সন্ধ্যের মধ্যেই জানিয়ে দিলো। বিকেলে রিমঝিমের মনে হোলো, সত্যি দিবাকর না থাকলে ও সেদিন কখন যে রেজাল্টটা জানতে পারতো কে জানে!
রিমঝিমের বাড়ীতে খুশীর বন্যা, সব কলেজের ভর্তির লিস্টেই রিমঝিমের নাম রয়েছে, এখন তো সবাই মহাধন্ধে, কোথায় ভর্তি হলে সবরকমের সুবিধা হবে। বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সব কলেজেরই যথেষ্ট সুনাম, সুতরাং আবার আলোচনা দিবাকরের সাথে। দিবাকরের মত প্রেসিডেন্সি অথবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ভালো, একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেতে পারলে অনার্স শেষ করে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তির বাড়তি সুযোগটুকু মেলে। এবার ভর্তি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে সেটা বাছাই রিমঝিম মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করুক।
যাতায়াত এবং অন্যান্য দিক সব বিবেচনা করে ঠিক হোলো রিমঝিম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবে। সেই মতো ছোট পিসিমণির বাড়ীতে এই ভর্তির সুখবরটা জানিয়েছে রিমঝিম নিজে আর ওর মনে হোলো দিবাকরকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় ভর্তির সিদ্ধান্তটা, তারপর কী মনে করে পিছিয়ে এলো রিমঝিম, ভাবলো না থাক। বাবা-মাতো দিবাকরকে জানাবে নিশ্চয়ই, ও আর এখন ফোন করবে না আলাদা করে, কী জানি যদি রিমঝিম নিজে থেকে হঠাৎ ফোন করলে দিবাকরের পড়াশোনার ব্যাঘাত হয়ে বিরক্ত হয়, দরকার নেই বাবা ঝামেলায় গিয়ে।
বেশ কিছুদিন হোলো রিমঝিমের ক্লাস শুরু হয়েছে, ভীষণ মনোযোগী রিমঝিম প্রথম থেকেই, ইতিমধ্যেই বিভাগীয় প্রফেসররা রিমঝিমকে চিনে গেছেন, বন্ধুরা ওকে সমীহের নজরে দেখছে, মহাখুশি রিমঝিম। মাঝে মাঝেই দিবাকরের কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে আর দিবাকরের শান্ত, দৃপ্ত, ঋজু, বলিষ্ঠ চেহারা..... উজ্জ্বল দুটি চোখের বিস্ময়কর দৃষ্টি, ভরাট কন্ঠস্বর আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব.... এসব মনে পড়লেই আজকাল রিমঝিমের হৃদপিন্ডটা যেন একটু বেশিই জোরে রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে সর্বাঙ্গের সমস্ত ধমনীতে। কানদুটো গরম হয়ে ওঠে রিমঝিমের, আর শরীরটা যেন পালকের মতো হালকা হয়ে যায়।
খুব ইচ্ছে করে দিবাকরকে ফোন করে রিমঝিম দিবাকরের মন্দ্র গম্ভীর গলার স্বরটা শোনে। কিন্তু দিবাকরের সামনাসামনি হলে ভীষণ ভালোলাগা মেশানো লজ্জা রিমঝিমকে ঘিরে ধরে বলয়ের মতো।
দেখতে দেখতে কয়েক মাস পার, দিবাকরের রেজাল্ট বেরোনোর পর ও এমফিলে ভর্তি হয়েছে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রীট ক্যাম্পাসে অর্থাৎ রিমঝিমের প্রেসিডেন্সির একদম পাশেই বলা যায়। বাবার অনুরোধে দিবাকর কয়েকবার এসেছে রিমঝিমদের বাড়ীতে, এসেছে পড়াশোনায় সাহায্য করতে, দুজনের বিষয় যেহেতু একই সে কারণে বেশ সাবলীল আলোচনা চলে দুজনের। তবে কখনো দিবাকর আলাদা করে রিমঝিমের সাথে কিছু কথা বলে নি, তাই রিমঝিমও কখনো আলাদা করে কথা বলতে পারে না, অনেক ইচ্ছে হলেও।
সরস্বতী পুজোর দিন ছোটপিসিমণিরা এসেছে, আর দিবাকরও এসেছে, সারাদিন হৈহৈ, হাসিঠাট্টা, মজা করে দারুন, সন্ধ্যেবেলা সবাই ফিরে গেলো। দুদিন ছুটি ছিলো, দিবাকরের একটা ছোট্ট মেসেজ পেলো সেদিন রিমঝিম, নেক্সট কলেজ কবে? রিমঝিমের সংক্ষিপ্ত রিপ্লাই , তেরো তারিখ থেকে।
রিমঝিমের মনটা কেমন উথালপাথাল হয়,সবসময় দিবাকরকে মনে পড়ে, এমনকি কখনো সখনো পড়া শোনাতেও মনঃসংযোগের ঘাটতি পড়ছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না, কিন্তু নিজেও এর কোনো সদুত্তর পাচ্ছে না।
টানা সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ক্লাস করার পর রিমঝিম ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর, হনহনিয়ে চলেছে, যাহোক কিছু খেয়ে বা কিনে নিয়ে হাওড়াগামী বাসে উঠে পড়বে। কী কান্ড, কলেজের গেট থেকে বেরোতেই একদম দিবাকরের মুখোমুখি রিমঝিম। জিন্স পাঞ্জাবী আর অবিন্যস্ত চুলে দিবাকরের ধীরস্থির পৌরুষে ভরপুর উপস্থিতিতে রিমঝিমের হৃদয়-তন্ত্রীতে ইমনকল্যান, জলতরঙ্গ বাজছে যেন আজ রিমঝিমের সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে, তবু্ও শান্ত দীঘির মতো স্থির-অচঞ্চল স্থাণুবৎ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়! নীরবতার গ্লেসিয়ার ভাঙলো দিবাকর, "ভীষণ খিদে পেয়েছে, চলো কিছু খাওয়া যাক, কফি হাউসে বসে।" ছায়ার মতো রিমঝিম দিবাকরকে অনুসরণ করলো, দুজনেই চুপচাপ, কারুর মুখে কোনো কথা নেই, দিবাকর দুজনের জন্য ফিশফ্রাই, চিকেন কাটলেট আর কফি নিলো। দুজনেই খাচ্ছে ধীরে ধীরে, মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়লেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে, আর কফি হাউসের গমগমে কোলাহলের মাঝে চলছে নীরব আলাপন হয়তো বা দুটি তরুণ প্রাণে। খাওয়া শেষ হয়েছে, বাড়ী ফিরতে হবে এবার রিমঝিমকে।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রীট মোড়ে এসে দিবাকর ট্যাক্সি ধরলো, সময় ও ভিড় বাঁচিয়ে একদম হাওড়া স্টেশনে রিমঝিমকে পৌঁছে দিয়ে আসতে। রিমঝিম এবার ভাবছে, আচ্ছা এই দেখা হওয়াটা কী কাকতালীয় ছিল? দিবাকরের হাবেভাবে কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলো না রিমঝিম।
ভাগ্যক্রমে জ্যামবিহীন রাস্তায় মিনিট কুড়ির মধ্যেই ভিড় থিকথিকে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছে গেলো দুজনে, সাড়ে পাঁচটার বর্ধমান লোকালের ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে দিবাকর রিমঝিমকে নিয়ে।
ট্রেন ঢুকে গেছে প্ল্যাটফর্মে, রিমঝিম ট্রেনে উঠে জানালার পাশেই সিট পেয়েছে বসার। ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে, দীর্ঘ হুইসেল বাজছে, ট্রেনটা দুলে উঠেছে, তখনই দিবাকর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা গাঢ় কালচে লাল রঙের গোলাপের কুঁড়ি বার করে রিমঝিমের হাতে দিয়ে মৃদু গম্ভীর গলায় বললো, "হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে," ট্রেনের পাশে পাশে দিবাকর হাঁটছে, রিমঝিম অস্ফুটে কিছু বললো, ঠোঁটদুটো নড়লো যেন শুধু।
ট্রেন গতি বাড়িয়েছে, চলে যাচ্ছে রিমঝিমকে নিয়ে, আর প্ল্যাটফর্মটা জনারণ্যে একাকী দিবাকরকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে।
দূরত্ব....সে তো শুধু স্থানিক অবস্থানের, কিন্তু ঐ লাল গোলাপের রক্তরাগ রাঙিয়ে দিয়েছে দুটি নবীন মনকে একত্রিত করে, হয়তো চিরকালীন করে! দিবাকরের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত, "........সখী ভালোবাসা কারে কয়......." আর স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে.....রিমঝিম কলিং !