Bisweswar Mahapatra

Romance Classics

4.2  

Bisweswar Mahapatra

Romance Classics

বংশপ্রদীপ

বংশপ্রদীপ

15 mins
811



এই প্রথম ছোটা চাঁদবিলায় এসে ঋদ্ধিমার মনটা আনন্দে মাতাল হয়ে উঠল৷

সেই বিয়ের পর থেকে ফ্ল্যাটবন্দী জীবনটা এক্কেবারে অতিষ্ট করে তুলেছিলো ঋদ্ধিমার জীবন কে৷

আজ সুদীর্ঘ দশ বছরের বিবাহিত জীবনে সুখের মুখ দেখেছে কিনা নিজে মনে করতে পারছে না৷

গ্রামের মেয়ে ঋদ্ধিমা দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করতে না করতেই বাড়ির সকলের চাপে ঋদ্ধিমাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়৷

আসল কথা ঋদ্ধিমার মায়ের কোন ভাই না থাকায় ঋদ্ধিমাদের দাদু তাদের বাড়িতেই তার বাবাকে গৃহ জামাতা করে রাখে৷

ঋদ্ধিমার বাবার ছোট্ট একটা প্রসাধনী দোকান,তা দিয়ে হয়তো সংসারটা চলতো না কিন্তু,দাদু বালিকা বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক হওয়ায় পেনশানে সংসারটা সচ্ছ্বল৷

আর ঋদ্ধিমারা তো শুধু নয়,ঋদ্ধিমার আরও দুই মাসী ও রয়েছে তাদেরও দেখভাল কিংবা আত্মীয়তার ও তো প্রয়োজন আছে কি'না।

তাই তারা সাত তাড়াতাড়ি করে এই বিয়েটাতে মনস্থির করে ফেলে৷

আর করবে নাই'বা কেন?

রীতেশ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,তায় আবার বাবা মারা যাওয়াতে মা ছেলের সংসার৷

ও দিকে আবার .বি.আই-এর মতো নামীদামি ব্যাঙ্কের মাস মাইনে ৷দেনাপাওনা নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য নেই বরং বলেছে আপনারা কোনটা পারবেন না আমাকে বলবেন আমি ব্যবস্থা করে নেব, তবে যারা বরযাত্রী হিসেবে এখানে আসবেন তাদের আপ্যায়নেও যদি আপনাদের আপত্তি থাকে সে কথা বলুন আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো আপনারা শুধু একটু দেখভাল করে দেবেন আর আপনারা সে কাজে কোন ক্রটি রাখবেন না৷তাতে আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে৷আমি মনে করি আপনারা তেমনটাও চাইবেনও না৷

এমন বিনয়ী পাত্র কে'বা হাতছাড়া করতে চায়৷

তাই বাড়ির সকলে ঋদ্ধিমাকে এক্কেবারে ছেঁকে ধরে৷

প্রথম দিকটায় নিমরাজী ঋদ্ধিমা আরও লেখাপড়া করতে চায় বলে জানিয়েছিলো কিন্তু,পরিশেষে সবার চাপেরমুখে পড়ে এ বিয়েটা সে করবে বলে মেনে নিয়ে ছিলো৷

পরিবার বা স্বামী ঋদ্ধিমার জীবনে অন্য মেয়েদের মতো দুর্ভাগ্য ডেকে আনেনি,তবুও ঋদ্ধিমার মনে কোন সুখ নেই৷আসলে বিধাতাই যে তার জীবনে দুর্ভাগ্যের বলিরেখা অঙ্কন করে দিয়েছে৷এহেন বিধি বাম জীবন নিয়ে ঋদ্ধিমা রীতিমতো ক্লান্ত অবসন্ন বোধ করে হাঁপিয়ে উঠতো৷মাঝে মাঝে মনে হতো জীবনটার এখানেই যদি পরি সমাপ্তি করা যেত!

ভাবলেও তেমন ভুল কোনদিনই করেনি৷বরং এমন মনে হলে নিজেকে আরও বেশী করে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে নিতো৷একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে কত আর কাজ থাকতে পারে৷তাই এক কাজ দু তিনবার করে জীবনযাপনটা প্রায় বাতিকে পরিনত হতে থাকল৷

ওদিকে আবার শ্বাশুড়ি মায়ের জ্বালাতনটা নেহাৎ কমও নয়৷বুড়ি বিয়ে বছর ঘোরা ইস্তক সেই যে গোমরা মুখি দেখেতো ঋদ্ধিমার গা-পিত্তি জ্বলে যায়৷

তাও যদি বুড়িটা কখনো মুখে মুখে একটুখানি ঝগড়াঝাটি করতো তাও ঝগড়াঝাটি করে মনকে হালকা করা যেত,সেটুকুরও জো নেই৷বুড়ির কোন রকম মনে কিছু এলে গাল ফুলিয়ে সোজা ঠাকুর ঘরে ঢুকে রাধামাধবের পায়ে সেই যে ফুল দেওয়া শুরু করে ঘন্টা বাজাতে থাকবে আর বন্ধ করার নামই নেবে না৷অথচ ঋদ্ধিমা খাওয়ার থেকে ওষুধ সব মুখের কাছে এনে মা মা ডাক পাড়বে তাতে যদি বুড়ি ঘুরে একটাও কথা বলতো —রেখে যাও বা অন্যকিছু৷না তা এই কয় বছরে একটি বারের জন্যও হয়নি৷বরং বুড়ির এই আচরণের জন্য বাড়ির কাজের লোককে ঋদ্ধিমা ছাড়িয়েই দিয়েছে৷যাতে শ্বাশুড়ি তার সঙ্গে একটু হাঁসিখুশি হয়ে কথা বলে৷তাতে তারও মনটা হাঁসিতে ভরে উঠবে৷না তা একেবারেই সম্ভব হয়নি,শুধু ঠাকুর ঘরের ঘন্টার ধ্বনির সময়টা বেড়েছে মাত্র৷ এভাবে শশ্মানের শান্তি বুকে বয়ে বেড়াতে যে কেমন লাগে যে ভোগে সে আর ভগবান ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনা৷

ঋদ্ধিমা বুকের ওপর পাষাণ চাপা দিয়ে সংসারের হালটা ধরে রাখে৷

আজ ঋদ্ধিমার সেইদিনটার কথা মনে পড়ে যায়—ঋদ্ধিমার কোন কারণে অ্যাসিড করে বমি হতে শুরু করে ৷ঋদ্ধিমা কাজের মেয়ের উপর রান্নার দায়িত্ব চাপিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই শ্বাশুড়ীমা এসে জিজ্ঞাসা করেছিল— বৌমা খুশির খবর নাকি?

উত্তরে যেই না বলেছে সেই থেকে মুখ গোমরা৷

এদিকে ঋদ্ধিমা মায়ের কথা মতো শ্বাশুড়িকে সমিহ করে চলে৷

বাপের বাড়ির গ্রামের কথা মতো কত না ঠাকুর দেবতার থান,মাদুলি,কবচ,ডাক্তার,ওঝা করেছে তার ইয়াত্তা নেই সে কথা কি ওই বুড়ি বুঝবে৷

বুড়ির শুধু একটা কিছু চাই ই চাই৷

আরে বাপু এ কি গাছের ফল যে ফলে আছে ঋদ্বিমা টুক করে গিয়ে ফলটা পেড়ে বুড়ির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে—" মা এই নাও "

আরে বাবা এই ফলটা ফলাতে হয়৷সে কথা কে কাকে বোঝাবে৷

সেই ক্লান্ত অবসন্ন ঋদ্ধিমা আজ ছোট চাঁদবিলায় এসে সবুজের নিবিঢ়তায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চায়৷ সেই ছোট বেলায় ওদের দাদুদের বাড়ির সবুজ পরিবেশ আর গ্রামের সোদামাটির গন্ধময় পথে প্রান্তরে বেড়ে ওঠা জীবন শহরের ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে যেন মুর্ছা যাচ্ছিলো,এখন সে যে কত তাজা তা বুঝিয়ে বলতে পারবে না৷

ছোট চাঁদবিলা সুবর্ণরেখার নিকটবর্তী মালভূমি অঞ্চল৷এখানে লালমাটির ছোট ছোট টিলায় জন্ম নিয়েছে শাল,সেগুন, পিয়াল,তমাল,মহুয়া,পলাশ আর কেন্দুর জঙ্গল৷তার হরিয়ালি আকাশ কে সেখানকার মানুষের মতো শান্ত ও নির্মল করে রেখেছে৷আর সেই জঙ্গলের মধ্যে শিষ দিয়ে যায় কত নাম না জানা পাখির দল৷তাদের শিস্ শুনে ঋদ্ধিমার এক প্রকার শিহরণ জাগে সে রীতেশ কে জড়িয়ে ধরে আদর খেতে চায়৷অথচ এ রকম অনুভুতি এর আগে কখনো যে হয়েছে সে কথাও মনে করতে পারছে না ঋদ্ধিমা৷

প্রকৃতি যে মানুষের মনে কত রকমের অনুভুতির সুর তুলতে পারে আজ তার পরশ পেয়েই বুঝতে পেরে উৎফুল্ল মেয়েটা

রীতেশের সুদীর্ঘ চাকুরী জীবনে অনেক গুলি লিভ জমা হয়ে পড়ে আছে৷কর্ম অন্তপ্রাণ রীতেশ সেগুলি ভুলেই যেতে বসেছিলো শুধু এ বারের যিনি ইমিডিয়েট বস সেই রিজিওনাল ম‍্যানেজার অপারেশান কুমার সাহেব তাদের ব্রাঞ্চে সারপ্রাইজ ভিজিটে না এলে মনেই করতে পারতো না।তিনি এসেছিলেন শুধুমাত্র ব‍্যাঙ্কের কাজ কর্ম ক্ষতিয়ে দেখার জন্য অথচ অল্প সময়ে ব্যাঙ্কের কাজের গতি দেখে অভিভুত হয়ে পড়ার সময় অন্যান্য কর্মীদের কাছ থেকে রীতেশের কথা জানতে পারেন। তার এই কর্মদক্ষতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আরও জানতে গিয়ে সেখানেই কথায় কথায় জানতে পারেন যে রীতেশ তার কর্ম জীবনে কামাইতো দুরের কথা,সে হাজার গন্ডা লিভ জমিয়ে ফেলেছে৷আর যদি কোন কাস্টমার অন্য স্টাফেদের কাছে কাজ পেতে গিয়ে একটু অসুবিধায় পড়েন তো- সে কারণে রীতেশ তাকে অনায়াসে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে সেই কাজের সমাধান করেন৷সেই কারণে ব্রাঞ্চের বেশীর ভাগ কাজেই রীতেশের হাত৷প্রত্যন্ত এলাকার ব্রাঞ্চ হলেও বি আই এর এই ব্রাঞ্চটি শিল্পনগরীর বড় ব্রাঞ্চকে বিট করে রেখেছে৷আসল কথা রীতেশের বিশ্বাসে মানুষ এখানে লেনদেন করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন৷ রীতেশ এই ব্রাঞ্চে জয়েনিং-এ আশার পর থেকেই কাস্টমারদের সঙ্গে গেট টুগেদার করে এই ব্যাঙ্কের সমস্ত প্রোডাক্টের খুটিনাটি বোঝাতেই দৈনিক টার্নওভারটা প্রায় পঁচিশ কোটি ছুঁয়ে ফেলেছে৷গ্রামাঞ্চলের ব্রাঞ্চের এই ব্যবসাও রীতেশের পরিচিতি করিয়ে দিয়েছে৷ এসে সে কথা মনে করিয়ে প্রায় একপ্রকার জোর করেই এই ছুটিটায় পাঠিয়ে দিয়েছে৷

কুমার সাহেব রীতেশ কে বলে— মিঃ সিনহা এভাবে চললে আমরা কিন্তু আপনাকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হবো৷

প্রথম দিকে কথাটা শুনে রীতেশ বোকা মুখে কুমার সাহেবের দিকে চেয়ে রইল৷কুমার সাহেব আবার কথাটা রিপিট করতে রীতেশ নিরবতা ভেঙে বলেছিলো আমার অপরাধ!

মিঃ সিনহা আপনার অপরাধ আপনি নিজের শরীরটাকে কি মনে করেন? আপনি লিভ গুলি নিচ্ছেন না কেন?আপনি কি ভেবেছেন সব লিভ বিক্রি করে টাকার পাহাড় গড়বেন৷আরে মশাই ও গুলো ব্যাঙ্ক কি আপনাকে বিক্রি করার জন্য দিয়েছে?আপনার মত দায়িত্ববান কর্মী যদি সে কথা না বোঝে তবে কে বুঝবে? আর আমরা আপনার কাছ থেকে এক প্রকার নিরলস পরিশ্রম নিতে নিতে এক সময় হঠাৎ করে মুখ থুবড়ে পড়ি আর কি?

আরে মশাই ছুটি গুলো নিজে একটু উপভোগ করুন৷

আসল কথা হল বিরাম কাজেরই অঙ্গ,তাতে কাজের গতি আসে৷আর আমরাও আপনার উপর নির্ভরতা কমাতে পারি৷

প্রথম দিকটায় কুমার সাহেবের কথা গুলো রীতেশের করলার ঝুসের মতো তেতো লাগতে থাকে৷

শান্ত স্বভাবের রীতেশের মনের শান্তি বিঘ্নিত করে মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করে তেঁতে ওঠে৷শরীরের রক্তপ্রবাহ এমন গতি বাড়িয়ে ফেলেছে যে স্রোতটা কখন কোনদিকে যাচ্ছে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে৷মনে হচ্ছে সে তক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে৷

কুমার সাহেব রীতেশের এই আরক্ত নয়ন আর নাক ফোলা দেখেই বললেন—চিল,জাস্ট চিল মিস্টার সিনহা৷আপনার কাজ নিয়ে আমার কোন সংশয় বা দ্বিধা নেই৷তবে,আপনি যদি একা সব কাজ দায়িত্ব নিয়ে করে চলে যান তো অন্য স্টাফ'রা পঙ্গু হয়ে যাবে৷আর কোন কারণে আপনার শারিরীক অবস্থার হঠাৎ যদি অবনতি হয় তবে এই ব্রাঞ্চের সমস্ত কর্মকান্ড পন্ড হয়ে যাবে৷তাই,আপনি নিজে পরিবারের সঙ্গে ছুটি গুলি উপভোগ করুন আর এদের কে আপনার অবর্তমানে কাজটার গতি ধরে রাখার দায়িত্ব দিন৷আমি বরং আপনার একটা ছুটির সিডিউল বানিয়ে আমাদের গেষ্ট হাউজ বুক করে আর যাতায়াতের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷

কুমার সাহেবের এবারের কথাটাতে রীতেশের শরীরে আস্তে আস্তে শীতলতা আসতে থাকল৷

নিজে মনে মনে ভাবতে থাকল—সত্যিই তো এতোদিন সে কতই না ভুল কাজ করেছে৷ অফিসের কাজের চাপে নিজের স্ত্রী ঋদ্ধিমার দিকে সে রকম নজরও দেওয়া হয়নি৷আবার নিজের কলিগরাও তার ভালো মানুষী আর কর্ম দক্ষতার ফায়দা তোলে৷কুমার সাহেব না বললে হয়তো সে সেটা বুঝতেই পারতো না ৷আর একাই সবার চাপ নিজের কাঁধে বয়ে চলতো৷এখন কথাগুলি নিজের মনে ভাবলে অবাক লাগে রীতেশের৷ কাজের চাপে জীবন কি একপ্রকার ভুলতেই বসেছিলো৷ অথচ ঋদ্ধিমা সেই শিথিল জীবন নিয়ে একদিনও উচ্চবাচ্য করেনি কেন? তাই নিয়ে বিস্ময় বোধ করতে থাকে সে!


কুমার সাহেব রিজিওনাল অফিসে পৌঁছে রীতেশ কে ফোন করে বলেছিল—মিঃ সিনহা তাহলে আপনার জন্য কোন হলিডে হোম বুক করবো?

প্রথম দিকটায় রীতেশ কিছু বলতে পারে নি৷পরে অবশ্য কুমার সাহেব কে সে বলল—স্যার, মনে যদি কিছু না করেন তো আমি এই বিষয়টা নিয়ে বাড়িতে স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে.......৷

ওহ্ ,শিওর,শিওর৷আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি বিবাহিত৷সেক্ষেত্রে পরিবারের মতামত থাকাটা অবশ্যই জরুরী৷মিঃ সিনহা তাহলে এক কাজ করুন,আপনি বরং বাড়িতে সবকিছু জেনে আমায় দিনক্ষনটা জানিয়ে দিলে আমি না হয় সে রূপ ব্যবস্থা নেবো৷

কুমার সাহেবের কথায় আশ্বস্ত হয়ে রীতেশ বাড়ি ফিরে কথাটা মাকে জানাল৷

রীতেশের মা কথাটা শুনেই বলল—আমায় বলছিস্ কেন?কথাটা বরং তুই বউমা কে গিয়ে বল৷

কথাটা শুনে রীতেশ মা কে বলল—কথাটা আমি ঋদ্ধি কে তো বলবই কিন্তু তোমাকেও তো আমাদের সঙ্গে যেতে হবে৷

না না বাপু তোরাই যা৷একে আমার বয়স হয়েছে,তায় আবার বাতের যন্ত্রনায় রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনা৷সেই শরীর নিয়ে কিনা আমি ভ্রমনে যাবো৷

তাহলে,তুমি কোথায় থাকবে মা?তোমার দেখভালই বা কে করবে?তোমার যদি আর ছেলেমেয়ে থাকতো না হয় তাদের কাছে তুমি যেতে পারতে৷

সেও তো অসম্ভব—

ও সব নিয়ে তুই ভাবিস নাতো বাপু,আমি ঠিক বাড়িতেই থাকতে পারবো৷তোরা বরং কটা দিন নিজেদের মতো করে বেড়িয়ে আয়৷

মায়ের কাছে একপ্রকার সম্মতি পাওয়ার পর রীতেশ ঘরের ভেতর গিয়ে হালকা হয়ে ঋদ্ধিমার কাছে গিয়ে বসে৷ঋদ্ধিমা এই সময়টা টেলিভিশানে একটু রিয়েলিটি শো গুলো দেখে৷

রীতেশ কে সোফায় বসতে দেখে ঋদ্ধিমা চা স্ন্যাক্স আনতে উঠে গেল৷সেই ফাঁকে রীতেশ খবরের চ্যানেলে ঢুঁ মেরে পুনঃরায় ঋদ্ধিমার চ্যানেলটাতেই রিমোট ফিক্সড করে রাখল৷

ঋদ্ধিমা ফিরে এলে রীতেশ তাকে কাছে বসিয়ে একে একে অফিসের সমস্ত ঘটনা বলতে থাকল৷সে মুখ বুজে সব শুনে গেল দেখে রীতেশ বলল—কই তুমি কিছু বললে না তো ঋদ্ধি?

আমি আর কি বলবো!

কি বলবে মানে!আমি কুমার সাহেব কে বলেছি বাড়িতে তোমাকে আর মা'কে জিজ্ঞাসা করে হোটেল বা হলিডে হোম আর ট্রেনের টিকিট বুকিং করার জন্য সবকিছু জানাবো৷এখন তুমি যদি সব শোনার পর বলো আমি কি বলবো তাতে নিজেকে কতোটা বোকাবোকা লাগে জানো!

আরে না আমি তেমন করে বলছি না৷আসলে তোমার অফিস তোমায় কতদিন ছুটি পারমিট করবে তার উপরে তুমিই তো প্ল্যান করতে পারো আর মাকে জিজ্ঞাসা করে নাও তিনি কোথায় যেতে চান৷আমায় কেন এরমধ্যে টানাটানি করা।আমার তো তোমাদের পছন্দগুলোই সবসময়ই পছন্দ।

আর তোমার বুঝি কোন ইচ্ছে নেই?

আচ্ছে তো৷আমার ইচ্ছেটা মনের গোপনে আছে তাকে বের করলে তোমার আবার যদি ছুটিটাই বাতিল হয়ে যায় সেই ভয়ে বললাম না৷

এ্যাই আমার সঙ্গে হেয়ালি করছো?

তা কেন?তোমার সঙ্গে হেয়ালি করতে আমার বয়েই গেছে৷আজ দশ দশটা বছর একটা মানুষের কাছে আর একটা মানুষ পড়ে আছে জড়ের মতো তার কাছে দশ বছর পর তার ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম দিচ্ছে দেখ৷

ঋদ্ধির গলায় অভিমানের সুর দেখেই রীতেশ বলল—ওহ্ অভিমান হয়েছে? আর অভিমান করতে হবে না বরং এবার বলেই ফেল কোথায় যেতে চাও আসমুদ্রহিমাচলের কোথায়?তাতে যতদিন ছুটি লাগে আমি কল্পতরুর মতো তোমার সব আশাপূর্ণ করে দেবো৷

ও আচ্ছা! তুমি তাহলে এবার সত্যিই ছুটি নেবে৷

আরে না আমি ছুটি নেবো তোমাকে কে বলেছে?আমিতো তোমাকে সে কথা বলিনি৷বরং কুমার সাহেব যে এবারে আমাকে ছুটি দেবে বলেছে, সেই কথাই তো তোমাকে বলেছি৷

ছুটি দেবে মানে?

এবার যদি আমি ছুটি না নিই তবে তিনি আমার ওয়ার্ক সাসপেন্স অর্ডারে সই করবেন বলেছেন৷

তাইতো তোমায় বলছি ছুটি যখন নিতেই হবে চলো দুরে কোথাও বেড়িয়ে আসি৷

দুরে!না-না,দুরে কোথাও গিয়ে লাভ নেই৷তাতে আমার বেড়াতেও ভাল লাগবে না৷কারণ ওই ব্যাগ প্যাক আনপ্যাক করাতেই সময় চলে যাবে৷তার চেয়ে আমরা বরং কাছে পিঠেই কোথাও যাবো৷তাতে ব্যাগ পত্তর বেশী বইতেও হবে না৷

তা কোথায় যাবে শুনি?

যদি দিন পাঁচ ছয়ের ছুটি পাও তো ওই তোমার আসমুদ্রহিমাচলই দেখবো৷তাতে মায়ের তীর্থ আর আমাদের ভ্রমন দুটোই সম্পন্ন হবে৷

মায়ের তীর্থ কথাটা শুনে রীতেশ হাসি ধরে রাখতে পারলো না৷সে হা-হা করে হেসে উঠল৷

তুমি যে কথাটা শুনে হাসলে?

হাসবো না?তোমার আগে মা-কেই তো কথাটা বলেছিলাম৷মা বলল আমাদের যেতে৷তাছাড়া মায়ের নাকি বাতের ব্যাথায় চলতে ফিরতে অসুবিধা হয় তাই বেড়াতে যাওয়ায় কোন ইচ্ছাই নেই৷

ওঃ,বুঝেছি! আমার সঙ্গে উনি যেতে চাইছেন না৷ ওনার মতলবটা কি?আমি বুঝি ওনার যত্নআত্তির করিনি?

তা কেন?তাই'বা তোমাকে কে বলল?আমি বললাম মায়ের হাঁটুতে নাকি অসহ্য ব্যথা হয় তাই তিনি যেতে পারবেন না৷তাছাড়া মাকে আমি বলেও ছিলাম তুমি আমাদের সঙ্গে না গেলে তোমার রান্নাবান্না দেখভালের অসুবিধা হবে৷কথাটা বলাতেই মা বলল ও নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না,তুই বরং বউমা কে নিয়ে ঘুরে আয়৷

আর তারপরে উনি কোনকিছু একটা বাঁধিয়ে বসে আমায় সারা জীবন গালমন্দ করুক আর কি৷

কথাটা ঋদ্ধিমা রীতেশ কে বলল৷

আজকাল তোমার কি হয়েছে বলতো ঋদ্ধি?তুমি আজকাল মা কে নিয়ে এরকম মন্তব্য করো কেন?

মা আর তোমার মধ্যে কি কোন সমস্যা হয়েছে?

আমার সমস্যা হতে যাবে কেন?আমি কি তোমায় কখনও সে কথা বলেছি?ওনারই কি সমস্যা বরং আমি বুঝতে পারি না৷আমি আর উনি এই এক বাড়িতে থাকি তবুও উনি আমাকে নিজের কাছে অচেনাই করে রেখেছেন৷

ওঃ এই কথা,তুমি আগে কই বলনি তো আমায়৷তাহলে ,কোন এক সময় মাকে আমি জিজ্ঞাসা করে নিতাম বিষয়টা কি?কেন তোমাদের এই দুরত্ব?আজ যখন জানলাম ঠিক দেখো আমি এর আসল রহস্য বের করে ছাড়বো৷তাছাড়া তুমি আমি ছাড়া মায়ের আর কে আছে বলো,যে মা আমাদের সঙ্গে রাগ করে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করবে?তুমি এটাকে হিংসে বলে মনে গেঁথে রেখোনা ঋদ্ধি৷দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে৷

তুমি ভুল ভেবেছো রীতেশ৷


4

মা আমায় হিংসে করে সে কথাটা আমি কখনোই মনে আনতে পারিনি আর তোমাকেও বলিনি ৷কিন্তু,কেন যে উনি আমার সঙ্গে কথাই বলেন না তাই ভেবে কুল কিনারা পাই না৷আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ না৷আমারও ইচ্ছে করে শ্বাশুড়ি বৌমায় মিলে একটু গল্প গুজব করি৷একটু দুজনে মিলে মার্কেটিং করি৷তা না সবকিছুতেই উনি দুরে দুরে থাকবেন আর আমি শুধু যন্ত্রনা বয়ে বেড়াবো৷কত সময় এসব সহ‍্য করা যায় তুমিই বলো।

এই নিয়ে তুমি মনে আর খেদ রেখোনা ঋদ্ধি আমি বরং মায়ের সঙ্গে তোমার কথা বলার রাস্তা খুঁজে বের করবো৷এখন তুমি বলো —তাহলে আমরা কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি৷

ও তুমি তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলে না৷

না,তা কেন?আমি তোমাকে কবে অবিশ্বাস করেছি বল?

তা না৷তবে তুমি আমায় বলো তোমার কতদিনের ছুটি?

কুমার সাহেবের যা ইচ্ছে তাতে সম্ভবত পনের থেকে কুড়ি দিনের ছুটি নিতে হবে না হলে আমায় ছাড়বে না৷জানো ঋদ্ধি, ভদ্রলোকের আসলে আমাকে ছুটিতে পাঠানো এই কারণে যে—আমাদের গ্রামাঞ্চলের এতো ব্রাঞ্চের মধ্যেও আমাদের ব্রাঞ্চ অপরেশানে কেন এতো অগ্রগামী৷উনি দেখতে চাইছেন কোন বে আইনি লেনদেন এর মধ্যে আছে কিনা৷

মানে?

মানেটা তুমি বুঝতে পারছো না ঋদ্ধি?উনি ম্যানেজম্যান্টে বেশ জাঁদরেল লোক,উনি বুঝতে চাইছেন ব্যবসার নাম করে ভেতরে ভেতরে ননপারফর্মিং এ্যাসেট তেরি করছি নাতো,সেটাই দেখবার জন্য৷

ননপারফর্মিং?

হ্যাঁ,আমরা কাস্টমারদের যে লোনগুলো দিচ্ছি সেগুলি ব্যাঙ্কে ফিরে না এলে তা ননপারফর্মিং এ্যাসেটে পরিনত হয়৷যা ব্যাঙ্কের উন্নতির পথে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে অর্থাৎ বেশি ননপারফর্মিং এ্যাসেট হলে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাবে৷তাই আমাকে সরিয়ে আমার কাজটার ওপর নজরদারি চালানো ও অন্য কর্মিদের ফাঁকিবাজী রোখাটাই ওনার উদ্দেশ্য৷

ও তাই!

হ্যাঁ ঠিক তাই উনি আমাকে একটু বেশী দিনের ছুটির জন্য আবেদন করে নিতে বলেছেন৷

তা হলে তো ভালই হল৷এবার আমি মস্ত একটা প্ল্যান বানিয়ে ফেলতে পারি৷

তাই করো৷তুমি কোথায় কতদিনের জন্য যেতে চাও আমায় জানিয়ে দাও.


5

অবশেষে ঋদ্ধিমা ট্যুরের প্ল্যানটা জানাতেই রীতেশ অফিসে গিয়ে কুমার সাহেব কে সব জানালো৷

কুমার সাহেব রীতেশদের ট্যুর প্ল্যানটা দেখে অভিভুত৷তবে তিনি একটু চিন্তিতও বটে৷রীতেশদের ভ্রমনের তালিকায় থাকা স্থানগুলির মধ্যে দিঘা,দার্জিলিং ছাড়া বি আই এর আর কোন হলিডে হোম বুক করতে পারবে না৷তাছাড়া পুরিতে যে হলিডে হোম আছে সেখানে তো রীতেশরা যাবেও না৷ আর একটা কথা রীতেশ অবশ্য বলেওছিল যে—দিঘাতে তারা মেরে কেটে একদিনই থাকবে৷এই দশ বারো দিনের যাত্রা পথটা ঋদ্ধিমাদের প্রায় সবুজেময় গ্রামকেন্দ্রিক হবে বলে ঠিক করেছে৷

যাই হোক কুমার সাহেব দিঘায় একদিন ও দার্জিলিং-এ চারদিন হলিডে হোম বুক করে দিয়েছেন৷আর বাদ বাকী অন্য কোন সহযোগীতা লাগলে রীতেশ কে জানাতে বলেছেন৷

এবার সময় এসেছে রীতেশ ঋদ্ধিমার সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার পালা৷যে ঋদ্ধিমা প্যাক আনপ্যাকের ঝামেলা নেবেনা বলেছিলো সেই তিনখানা ট্রলিব্যাগ ভর্তি জামা কাপড় শুকনো খাওয়ার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি ভরে নিয়েছে৷এখন শুধু গাড়ি নিয়ে বেরোনোর পালা৷

ঋদ্ধিমা কিন্তু বেড়াতে যাচ্ছে বলে শ্বাশুড়ি মা'কেও যাওয়ার জন্য জেদাজেদি করেছিলো তিনি অসম্মত হওয়ায় এই কয়েক দিনের জন্য পরিচিত এক কাজের মেয়েকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে যাচ্ছে৷সে এই কয়েকটা দিন এই বাড়িতেই থাকবে৷

ঋদ্ধিমা তার কাছে বাজারের টাকা পয়সা,

শ্বাশুড়িমার ঔষধ,ডাক্তারের ফোন নাম্বার সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে৷মেয়েটি অনেক আগেই এ বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে৷গাড়ির ড্রাইভারও এসে গিয়েছে৷ রীতেশ প্রথম বলেছিলো সে নিজেই গাড়ী চালাবে তারপর কি মনে করে কে জানে একজন ড্রাইভার কে ঠিকই করে ফেলল'৷রীতেশের এই গাড়িটা আজ বছর দুয়েক হোল অফিসের ফ্রিঞ্জ বেনিফিটের দৌলতে এ বাড়িতে এসেছে৷গাড়িটা রীতেশের ময়ূরপঙ্খী নাও৷একবার চলতে শুরু করা মানেই যেন হাওয়ায় ভেসে যাওয়া৷গাড়িটার এয়ার ব্যাগগুলো সুন্দর হওয়ায় গাড়িটা চালাতেও মজা লাগে৷


6

যাই হোক অবশেষে রীতেশ ঋদ্ধিমা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা'কে খবরাখবর দিতে বলল আর বিদায়ী অনুমতি চাইলো৷

রীতেশের গাড়ীটা এখন রাজ্য সড়ক ধরে দিঘামুখী হয়ে হুসহুস করে ছুটে চলেছে রীতেশ আর ঋদ্ধিমা পিছনের সিটে বসে সমুখপানে চেয়ে৷

একটা সময় দিঘা পৌঁছেও গেল৷হলিডে হোমের পার্কি লটে গাড়িটা লাগিয়ে দিয়ে তারা রিসেপশানে কথা বলে সমুদ্র স্নানে বেরিয়ে পড়ল৷দিঘা সংলগ্ন অঞ্চল বেড়ানোর পর তাদের গাড়ি এবার মোঘলমারী নব আবিস্কৃত বৌদ্ধ মহাবিহার দেখার উদ্দেশ্যে জলেশ্বর হয়ে এগিয়ে চলল৷ এখানে এসে রীতেশ রিদ্ধিমার মনের আশা ঠিক পূর্ণ হোল না তখন মোঘলমারীর স্থানীয় তরুন সংঘ পরিচালিত মিউজিয়াম থেকে জানতে পারলো শরশঙ্কা সরোবর ও ওড়িশি দুর্গ করমবেড়ার কথা৷সে গুলি দেখতে গিয়ে ঋদ্ধিমা আনন্দ উদ্দিপনায় রক্তিম হয়ে উঠছে৷তার এই উচ্ছ্বাস দেখে রীতেশ ড্রাইভার কে বলল—তরুণদা আপনি বরং এককাজ করুন,আপনি বরং বাসায় ফিরে যান৷আর এখান থেকে আজকে যদি বাসায় যেতে না পারেন তো আজকের রাতটা হোটেলে কাটিয়ে সকালে বাসায় চলে যাবেন৷এই টাকা কটা রাখুন৷বলে তরুণ ড্রাইভারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে অবশেষে ভসরাঘাট হয়ে তারা পৌঁছে গেল তপোবনের নিকটে থাকা রামেশ্বরম মন্দিরে৷সেখানে তারা সে রাতটা রাজ্য সরকারের অতিথিশালায় কাটিয়ে দিলো৷রামেশ্বরম মন্দিরের অদুরেই সুবর্ণরেখা নদীর কাঁচের মত স্বচ্ছ নীলজল ঋদ্ধিমার নয়নকে আকর্ষণ করল৷এ সময়টা নদী তার ভয়ালরূপ পরিত‍্যাগ করেছে।ঋদ্ধিমা এক দৌড়ে ছুটে গেল তার কাছে,আর আয়নায় যেন নিজেকেই আবিস্কার করল।এ এক অন্য ঋদ্ধিমা, যাকে এতোদিন খুঁজে পাওয়া যেত না কোনো আনন্দ উৎসবে,আজ তার শরীরের খাঁজে খাঁজে আনন্দ লহরী নাচতে থাকল।ঋদ্ধিমা শরীরের এমন মাদকতায় রীতেশকে আরও নিবিড় করে কাছে পেতে চাইল।অগত‍্যা সে রীতেশের কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে মুখে চুম্বন করতে থাকল।এতোদিন কাজের চাপে মধুচন্দ্রিমা না করতে পারা রীতেশও বুঝলো আউটিংয়ের একটা দরকার ছিল। তারা পুনরায় গাড়িতে ফিরে এসে পরবর্তী গন্তব্যের জন্য যাত্রা শুরু করল। রীতেশের গাড়ি ছাতিনাশোল,গোপীবল্লভপুর হয়ে চিল্কিগড় কনকদুর্গার মন্দিরে পূজা দিয়ে গিধিনী ফরেস্ট হয়ে ইতিহাস বিজড়িত চুয়াড় বিদ্রোহের আঁতুড়ঘর ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর দরজায় পৌঁছতে অতিথিশালা থেকে অভ‍্যর্থনা। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সে রাতটা সেখানে কাটিয়ে আবার যাত্রা।এই যাত্রাকালে প্রায় পথভ্র‍ষ্টের মতো তারা ছোট চাঁদবিলায় এসে পড়ে।এই যে পথের ভুল প্রথমে রীতেশদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। বিদেশ বিভুঁই তায় আবার মাওবাদী অধ‍্যুষিত এলাকা এখন কি হবে?রীতেশ যখন কথাগুলো ভাবছে তখন স্থানীয় একজন ওদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো আর জ্ঞিজ্ঞাসা করল-কি পথ হারিয়েছেন তো? ভয় নেই আজকের রাতটা এখানে কাটিয়ে নিন সকাল হলে তখন যেখানে আপনাদের গন্তব‍্য সেখানে যাবেন।কি বাবু ভয় করছে?এটা জঙ্গলমহল তো আপনার কেন?যে কোন মানুষেরই ভয় পাওয়ার কথা।একটা সময় তো এ এলাকাতে মনুষই আসতো না।এখন মানুষের নির্ভয় যাতায়াতে সবার হাতে কমবেশি পয়সা আসছে। পাড়ায় পাড়ায় অলিগলির মোড়ে মোড়ে দোকান পসারি আর বিজলী বাতি আমাদের জীবনের মানে বদলে দিয়েছে।আসুন বাবু আমাদের বাড়িতে আসুন।ভয়ে গা শিরশির করলেও রীতেশরা লোকটির পিছনে যেতে থাকল। সে রাত্রিটা রীতেশদের জীবনের অন‍্য অভিযান হয়ে রইল।পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যেই না বেরতে যাবে গৃহকর্তাএসে বাধা দিল আপনারা এখন কোথায় যাবেন বরং জলখাবার খেয়ে চলুন আমার সঙ্গে আমি আপনাদের এক অদ্ভুত জায়গা দেখাবো।প্রথমদিকটায় রীতেশরা মনে ভাবল আর কেন!তারপর গতরাতের বিশ্বাসে তারা লোকটির সঙ্গে গেল।লোকটি এবার তাদের কে যে জায়গায় নিয়ে এলো দেখেই তো ঋদ্ধিমা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেল।কেন্দুয়ার এই মালভূমি এলাকার বিলের পাশে সবুজ গাছের পাতা ডালপালা কে আড়াল করে শত সহস্র সারস সামখোলা আর বকের একনাগাড়ের ডাক আনন্দে বিভোর করে তুললে ঋদ্ধিমা তাদের দিকেই এগিয়ে গেল।ঋদ্ধিমার এই অপ্রত‍্যাশিত আগমনের জন্য তারা উড়ে গিয়ে আরও উঁচু ডালে বসল।রীতেশ এই সময়ে যেন কিশোরী ঋদ্ধিমাকে দেখল আর এই নৈসর্গিক ঘটনার স্বাক্ষী থাকল। 


7

একে একে কেন্দুয়া বার্ড ভিউপয়েন্ট, বেলপাহাড়ী, ধাংগিকুসুম জলপ্রপাত লখাইসিনী পাহাড় ডুংরি ফলস, আমলাশোল, কেতকী লেক, কাঁকড়াঝোড় হোম স্টে তে রাত্রি যাপন।তারপর দুয়াসিনি ফরেস্ট, গাদ্রাসিনি পাহাড় ও গুহা,চিতি পাহাড়,কনেসার হিল,লালজল গুহা দুর্গা মন্দির,ঝিলমিল,রানিবাঁধ,মুকুটমনিপুর, মাইথন, শান্তিনিকেতন পথে দার্জিলিং-এর পথে এগিয়ে চলল তাদের গাড়ি।

এই কয়েক দিনের ধকলটাও কম না তবু রীতেশরা শেষ পর্যন্ত শিলিগুড়ি এসে রীতিমতো একটা ড্রাইভার ধরেই দার্জিলিং এসেছে।কুমার সাহেব গেষ্ট হাউসের যে ঘরটা বুক করেছেন এককথায় রীতেশরা অভিভূত।ঘরটা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যাচ্ছে।যদি কোনো কারণে কুয়াশায় এলাকা টা ঘিরে না রাখে তো সোনার প্রলেপ মাখানো ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে তারা তাদের নয়ন সার্থক করবে,হয়েছিলো তাই।তাদের দার্জিলিং থাকা কালে প্রকৃতি কখনোই বিরুদ্ধে যায়নি বরং অনুকুলে থেকে এক অনন্য নৈসর্গিক পাহাড় কে তাদের সামনে উপহার দিয়েছে।

দার্জিলিং ভ্রমণ শেষ এবার ঘরে ফেরার পালা হঠাৎ কি জানি ঋদ্ধিমা বাচ্চামেয়ের মতোই ফুঁফিয়ে কাঁদছে রীতেশ রীতিমতো তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করল কিন্তু কোনো উত্তর পেল না।

দার্জিলিং থেকে বাড়ি ফেরার পথে তারাপীঠ ও তারকেশ্বরে পূজা দিতে ভুললেন না তারা।

আজ ঋদ্ধিমা বারান্দায় বসে তার অতীত স্মৃতিচারণ করছে আর শ্বাশুড়ি মনের খুশিতে বউমার মাথায় তেল লাগিয়ে চুল চিরুনী করে দিচ্ছে।আজ আর তার কোন ক্ষেদ নেই ঋদ্ধিমার উপর বরং সে অনেক বেশী খুশী দশবছরের পরে হলেও বউমা ঋদ্ধিমা তার কোলে যে বংশপ্রদীপ উপহার দিয়েছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance