গোপন অনুভূতি
গোপন অনুভূতি
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বাসে ওঠে কাজল। রবিবার বলে অন্য দিনের মতো বাসে অতটা ভিড় নেই। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি, আজ দেরি হয়ে গেছে। আসলে কয়েক দিন পর গানের পরীক্ষা, তাই বাচ্চা গুলোকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে এই রবিবার দিন টা একসঙ্গে চার চারটে বাড়ি গানের টিউশনি থাকে। কাজলের একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না, ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে বেশ কয়েকদিন পরে নেট অন করল। নেট অন করার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ফেসবুকের কতগুলো নোটিফিকেশন এল। এত নোটিফিকেশন দেখে কাজল ফেসবুক অন করল, ওকে ট্যাগ করে অনেকে কিছু ফটো ছেড়েছে। ফটো দেখতে দেখতে মনে পড়ল, গতকাল ওর এক স্কুলের বান্ধবীর ছেলের অন্নপ্রাশন ছিল। নিজের মনেই একটু হেসে নেয় কাজল, ওর সমবয়সী বান্ধবীদের কয়েক বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।
এই সব কথায় কথায় মনে পরল, কালকেই তো ওর জন্মদিন। আগামীকাল সাতাশ বছর পূর্ণ হবে,কাজল লক্ষ্য করেছে আজকাল বাবা কেমন কম কথাবার্তা বলে মনে হয় কিছু নিয়ে চিন্তা করে। আসলে বাবা মা দুজনেই খুব চেষ্টা করে ওর বিয়ের জন্য, প্রায় দু'দিন অন্তর পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসে। কিন্তু প্রতিবারই পাত্র ওকে দেখার পর কেউই পরে আর যোগাযোগ করে না। মুখে অনেক মানুষকেই কাজল বলতে শুনেছে, রুপ দিয়ে বিচার হয় না আসল বিচার তো গুন দিয়েই হয়। কিন্তু ওইসব কথা লোকে বলার জন্যই শুধু বলে।
“ আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী ” এই ধারণাটা সবাই মনের মধ্যে পোষন করে রেখেছে। তবে এইসব নিয়ে কাজল ভাবে না। দিব্যি আছে নিজের মতো করে, গান আর বাবা মা এরাই ওর জীবনে যথেষ্ট। কাজল জানে ও খুব কালো, কিন্তু তাতে কি? সেই জন্য তো কারো থেকে কোন অংশে কম নয়। তবে আশে পাশের মানুষরা ওকে কেমন অবহেলার চোখে দেখে, এটা সব থেকে বেশি খারাপ লাগে। কাজলের মা বাবার জন্য কষ্ট হয়, রাত জেগে বাবা মায়ের কথা ভেবে চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। তার ওপর বয়েসের ছাপ তো আছেই। পড়াশোনার সাথে গানের গলা খুব ভালো, সেই জন্য স্কুল-কলেজে প্রচুর নাম কাজলের। বাসটা খুব জোরে ব্রেক কষে,আর কাজল ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে।
সামনে তাকিয়ে কাজল দেখে বাসে একজন ছেলে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণের জন্য চমকে যায় কাজল, এই তো সেই রনজয় দা। কলেজের যে কোন ফাংশন হোক রনজয় আর কাজলের গান ছাড়া চলবেই না। দুজন যখন একসঙ্গে গান করতো সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। তবে কিছু মানুষকে কাজল বলতে শুনেছে, রাজপুত্রের পাশে কোথাকার শ্যাওড়া গাছের পেত্নী !!! কিন্তু মনে মনে এই সব নিয়ে কখনো মন খারাপ করেনি। বরং এটা ভেবেছে ভুল কিছু বলে না লোকে। তবে তাই নিয়ে কখনো আফসোস করে নি। আসলে মনের দিক থেকে মেয়েটা অনেক শক্ত, নিজের কালো রং টাকে কখনো খুঁত বলে মনেই করেনি। রনজয় মানুষটা খুব ভালো, একদম ফ্রি ভাবে মিশতো খুব মোটিভেট করত। কাজলের বেশ ভালো লাগতো কখনো কখনো মনে একটা আশাও জাগতো। তবে সেই আশা কে বেশি বাড়তে দেয়নি, এই ভেবে যে এটা কখনো সম্ভব নয়, পরে নিজেকেই কষ্ট পেতে হবে। তারপরে কাজলের জীবনে এসেছিল বিপুল, ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল কাজল কে।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে টা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল, বেশি কিছু না নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন। তবে স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে সময় লাগেনি, কলেজ শেষে দু'বছর পর যখন বিপুল কে বলেছিল বিয়ের কথা। মুখের উপর বিপুল বলে দেয়, “ বিয়ে?????? আমাদের সম্পর্কটা এতটাও গভীর নয় যেটা বিয়ে পর্যন্ত যেতে পারে কাজল। ”
প্রথমে কাজল একটু অবাক হয়েছিল, তবে তারপরে নিজেকে স্বাভাবিক করে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিপুল কে বলে, “ ওহ্ তাহলে আমাদের মধ্যে এতদিন কিসের সম্পর্ক ছিল?? তুমি যে আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলে ওগুলো সব মিথ্যে???? ” বিপুল নিজের চোখ মাটির দিকে নামিয়ে বলে, ” ভুল করে ছিলাম, এই কবছরে বুঝে গেছি আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বেশি কিছু নেই। আর তাছাড়া মানানো বলেও তো একটা ব্যাপার আছে তাই না? মা আমার বিয়ে ঠিক করছে, মেয়ে দেখা পায় হয়েই গেছে। তোমাকে আজকে এটা বলতেই এসেছিলাম। ”
কাজলের নিজেকে খুব ছোট লাগছিল, ভালোবাসা ভিক্ষা চাওয়ার কোন মানসিকতা ওর নেই। বুকের ভেতরটা ভেঙেচুর গেলেও হাসিমুখে অভিনন্দন জানিয়ে চলে এসেছিল। দুর্বল বা ভেঙে পড়ার মেয়ে কাজল না, মনের গভীরে কোথাও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট টা রয়ে গেছিল। তবে বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কিছুদিন পরেই নিজেকে শক্ত করে নেয়। তারপর তো অনেক বছর কেটে গেছে এখন বিপুলের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেনি, রাখতেও চায় না। মনে মনে ধরেই নিয়েছে গল্প-উপন্যাসের স্বপ্নে দেখা রাজকুমারের মত কেউ ওর জীবনে আসবেনা। এই বাস্তবটাকে মেনে নিয়ে নিজেই নিজেকে খুব ভালোবাসে। আর জীবনে গান নিয়ে কিছু করতে চায়।
যাইহোক রণজয় বাসে উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাজল কে দেখতে পেল। একগাল হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে এসে কাজলের পাশে বসলো। কাজল মিষ্টি হাসি দিয়ে হালকা গলায় বলে,,,,,,
কেমন আছো রনজয় দা? বেশ অনেকদিন পর দেখা হল !! এখন কি করছো?
ওরে দাঁড়া দাঁড়া এতো প্রশ্ন ! সব মিলিয়ে ভালোই আছি। কি আর করব বল গানের ফাংশন করে বেড়াচ্ছি। আর তুই কেমন আছিস?
আমিও বেশ আছি, হ্যাঁ গতবারের পুজোর সময় তুমি এসেছিলে তো আমাদের পাড়াতে দেখলাম।
সেকি ! তোকে তো আমি দেখিনি, কোথায় ছিলিস? সামনে আসিস নি কেন?
ও বাবা ! তোমার সব ফ্যানেরা তোমায় ঘিরে ছিল, তার মাঝে আমি গেলে চিনতেই পারছিনা।
বকিস না তোকে চিনতে পারব না? কলেজে আমাদের গানের জুটি ফেমাস ছিল, কি সুন্দর তোর গানের গলা। কিন্তু তোকে তো কোথাও দেখিনা? না মানে এখন যে সব শিল্পীরা গান করে তাদের তুলনায় তুই যথেষ্ট ভালো।
হাহাহাহা ! আমাকে আবার কে গানের জন্য অফার করবে? দু'চারটে টিউশনি করি ভালোই চলছে।
কিইইইইই? এত ভালো গানের গলা কে তুই শুধু টিউশনি এর মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিস?
ওসব ছাড়ো তো ! আমার কথা বাদ দাও। তোমার খবর বল বিয়ে করেছ?
বাদ দেবো কেন? শোন এটা রাখ, কাল সকাল দশটায় এখানে দেওয়া ঠিকানায় চলে আসবি।
কিন্তু???????
কোন কিন্তু না কাজল, যা বললাম তাই করবি। ঠিক আছে আমি আসলাম, সাবধানে বাড়ি যাস।
রণজয় এরপর পরের স্টপেজে নেমে যায়। এই প্রথম কাজল কারোর চোখে নিজের জন্য অবহেলা দেখল না, অন্য রকম একটা অনুভূতি হয় সত্যিই মানুষটা খুব ভালো। বাড়ি ফিরে আবার রণজয়ের কথা মনে পড়ছে, কেউ মন থেকে প্রশংসা করেছে ওর এটা ভাবতেই খুব ভালো লাগছে। রাতে খাওয়া সময় মা-বাবা আরও একটা পাত্রের কথা বলেন। তাদের সঙ্গে দেখা করার দিনও জানিয়ে দেন কাজল কে। বাবা মাকে কখনো কষ্ট দিতে পারেনা কাজল, তাই মুখের উপর কিছু বলে না। হাসিমুখে হ্যাঁ বলে দেয়। পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান করে তৈরী হয়ে নেয়, মা বলে হলুদ রং টা ওর গায়ে খুব মানায়। তাই হলুদ রঙের একটা কুর্তি পড়ে, সাদা পাটিয়ালি আর সাদা ওড়না গলায় ঝুলিয়ে নেয়। তখনই পায়েসের বাটি হাতে ঘরে এসেই কাজলের মা বলেন,,,,,,,
কি সুন্দর লাগছে তোকে! এই পায়েস টুকু খেয়ে নে কাজু।
মা তুমি পারোও বটে ! বুড়ি বয়সে আবার জন্মদিন।
কি যে বলিস না, বাবা-মার কাছে সন্তানরা কখনই বড় হয় না।
কাজল প্রাণভরে পায়েস খেয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। তারপর বসার ঘরে এসে বাবাকে প্রনাম করে,আজকে অবশ্য ওর বাবা একটু মুখে হাসি এনে ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেন। এইটুকু তে কাজলের মনটা খুশিতে ভরে যায়, মা বাবাকে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। দুটো বাড়ি টিউশনি করে রনজয়ের দেওয়া কার্ডের ঠিকানায় পৌঁছে যায়। তবে ভিতরে যাবে কিনা বুঝতে পারে না তাই বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পরে একটা অটো থেকে রনজয় নেমে আসে, রনজয় কে দেখে যেন কাজলের বুকে বল আসে। তারপর রনজয় নিজেই ওকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে আসে। কাজল ভিতরে গিয়ে দেখল, একজন ভদ্রলোক সোফার উপর বসে আছেন। রনজয় কাজল কে বলে,,,,,,,
উনি হলেন প্রকাশ বাসু, আমি ওনার হয়েই বিভিন্ন ফাংশন গান করি। আর প্রকাশ দা এ হল কাজল, দারুন গানের গলা শুনলেই বুঝতে পারবেন।
তাহলে একটা গান শোনাও দেখি। যদি ভালো লাগে সামনের প্রোগ্রামে তোমাকে রনজয়ের সঙ্গে গান করতে হবে।
গান কাজল বরাবরই ভালো গায়, কিন্তু একটু নার্ভাস লাগছে। রণজয় কাজলকে চোখের ইশারায় গান করতে বলে। কাজল এবার নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে “ আমারও পরানো যাহা চায় তুমি তাই ” গানটা গেয়ে ফেলে। গান শেষে চোখ খুলে দেখে প্রকাশ বাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। আর জোর গলায় বলে ওঠেন,,,,,,,,
তোমার গলায় তো মা সরস্বতীর বাস ! আমি আজকেই সব ব্যবস্থা করছি, সামনের মাসে একটা বড় ফাংশান আছে। রণজয়ের কাছে শুনেছি, কলেজে তোমরা একসঙ্গে খুব সুন্দর গান করতে। তাই তোমাদের প্রথমে জুটি হিসেবে গান গাওয়াতে চাই, দেখি কেমন হয়।
খুশিতে কাজলের মনটা ভরে ওঠে জন্মদিনে
র উপহার পাওয়া হয়ে যায়। প্রকাশ বাবুর সঙ্গে কথা বলার পরে কাজল আর রনজয় বাইরে বেরিয়ে আসে। কাজল অনেক করে মানা করা সত্ত্বেও রনজয় ওকে কিছুটা দূরে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে আসে। তারপর দুটো চায়ের ভাঁড় হাতে করে আনে, কাজল অবশ্য এরকম সাদামাটা ভাবে থাকতে খুব পছন্দ করে। তবে রণজয় যে এত সাধারন সেটা কখনো জানতে পারেনি। চায়ের কাপে একটু চুমুক দিয়ে কাজল বলে,,,,,,,,,,
ছোটখাটো ফাংশন করে তোমার চলে? না মানে....!
চলে বলতে কোন রকমে চলে যায়, বসে থাকার থেকে তো ভালো। এ ছাড়া তো আর কোন গুণই নেই , আর চাকরি ! হয়তো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়েদের হয়না।
রনজয়ের কথায় কাজল কেমন একটা আফসোস অনুভব করে। তবে বেশি কিছু বলে না, শুধু অল্প হাসে। আর তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠে।কাজলের আবার এই ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর লাগে। বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে সবার শুধু এই একটা দিনেই মনে পরে, আর বাকি দিনগুলো মরলো না বাঁচলো কেউ খোঁজ নিতেও আসে না। অগত্যা মুখে হাসি রেখে বেশ কিছুক্ষণ সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পালা চলে। দু'চারটে ফোন রাখার পরে কাজল একটু হাঁফ ছেড়ে নেয়। রণজয় চায়ের টাকা মিটিয়ে কাজলের সামনে এসে বলল,,,,,,,
কি হলো এত হাঁফাচ্ছিস কেন? যেন মনে হচ্ছে বাঘের তাঁড়া খেলি !
হাহাহাহা ! আসলে শুধু জন্মদিনের দিনই লোকের মনে থাকে বাকি দিনগুলো ভুলেই যায়।
কিইইই জন্মদিন !!!! কার জন্মদিন তোর?
কাজল খেয়াল করেনি, মুখ ফসকে জন্মদিনের কথা টাই বলে ফেলেছে। বুঝতে পেরে নিজেকে নিজেই একটু মনে মনে ভালো-মন্দ শুনিয়ে নেয়। আর কোন উপায় না পেয়ে রণজয়ের কথায় সম্মতি জানায়। তারপর ঘটে এক অবাক কান্ড ! রনজয় চায়ের দোকান থেকে দুটো বাবুজি কেক কিনে আনে। একটা কেক কাজলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,,,,,
সরি কাজল এর থেকে ভালো কিছু দিতে পারলাম না। তবে ট্রিট টা তোর পাওনা থাকল, পরবর্তীতে অবশ্যই দেবো।
কাজল আর কিছু বলে না।শুধু মনে মনে এটাই ভাবে, কিছু মানুষ সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়। সে যাই হোক সেদিন দুপুরে কাজল বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের অনেক রকমের রান্না করা পদ খায়। কিন্তু তারপরে তো বেশ দশ পনেরো দিন মত, রণজয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কাজল তো ধরেই নিয়েছিল মিথ্যে আশা করে লাভ নেই, হয়তো প্রকাশ বাবু অন্য কাউকে পেয়ে গেছেন। তবে সেদিন দুপুরে কাজলের এই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়, রনজয় ফোন করে জানায় আর ১৫ দিন পরেই গানের ফাংশন। এরপর থেকে প্রায় প্রত্যেক দিন সকালে রনজয় আর কাজল কে একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতে হতো। দেখতে দেখতে গানের ফাংশনের দিন চলে আসে, এই প্রথম কাজল কোন বড় মঞ্চে নিজের প্রতিভাকে তুলে ধরবে।
বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে মঞ্চে উঠেছিল। কিন্তু তাও কোথাও যেন একটু একটু ভয় করছিল। সেই মুহূর্তে অনুভব করে রনজয় ওর হাত ধরলো। কাজল জানে না, রণজয় জেনে কি না জেনেই ওর হাত ধরলো। তবে এটুকু বুঝতে পারে ওর হাতের স্পর্শে কেমন যেন ভরসা অনুভব করল। দুজনে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অসাধারণ একটা রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করলো। গান শেষে হলের মধ্যে হাত তালির আওয়াজ ভরে গেল। এরপরে আর ওদের দুজনকে বসে থাকতে হয়নি, একটার পর একটা ফাংশনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে হয়েছে। রনজয় আর কাজল এই জুটির নাম শুনলেই হল পুরো হাউসফুল হয়ে যেত। ধীরে ধীরে কাজল দের অবস্থা ভালো হতে লাগল। ফাংশানের টাকায় কাজল নিজের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলো। এইসবের মাঝে কাজল আর রনজয়ের সম্পর্কটাও একটু একটু করে গভীর হতে শুরু করে। কাজল সম্পর্ক টা কে বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু ভাবেনি, আর ভাবতেও চায়না। কিন্তু ওর প্রতি রনজয়ের ছোটো ছোটো খেয়াল রাখা গুলো বেশ ভালো লাগে।
এই ভাবে দেখতে দেখতে দু বছর কেটে যায়। সামনে একটা ফাংশন আছে, তার জন্য প্র্যাকটিস চলছে জোড় কদমে। এখন অবশ্য চারদিকে ওদের দুজনের অনেক নাম হয়েছে, তাই যেখানে সেখানে চায়ের দোকান পেলেই বসে চা আর বাবুজি কেক খেতে পারে না। একদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার আগে, একটা ক্যাফেতে দুজন দুজনার সামনে বসে আছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে রণজয় বলে,,,,,
শোন কালকে আমি প্র্যাকটিসে আসতে পারবো না। একটু কাজ আছে, তুই একটু ম্যানেজ করে নিস।
ম্যানেজ না হয় করব, কিন্তু কি কাজ? গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে যাবে বুঝি?
হাহাহাহা ! গার্লফ্রেন্ড না বল হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে যাবো। আসলে মা অনেকদিন ধরে খুব জোরা জুরি করছে। মায়ের তো মেয়ে পছন্দ হয়েই গেছে, সামনের মাসেই মনে হয় বিয়েটা হয়ে যাবে বুঝলি।
বিয়ে? তুমি আগে বলনি তো? কাজল চমকে উঠে বলে।
খেয়াল ছিল না বলা হয়নি, এবার যেতে হবে চল তোকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই।
হুম ঠিক আছে। অনেক অভিনন্দন তোমায়। মুখে একটা হাসি এনে কাজল বলার চেষ্টা করে।
রনজয় অল্প করে হাসির ছোঁয়া মুখে লাগিয়ে নেয়। কিছুদিন আগেই একটা গাড়ি কিনেছে রণজয়। কাজলেরও স্কুটি কেনার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ওর মা সব টাকা বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখছে। কাজলের আর বিয়ে করার কোন ইচ্ছাই নেই, বেশ তো আসছে বাবা-মা গান নিয়ে। তবে বাবা মায়ের মুখের ওপর কিছুই বলতে পারেনা। আর এই মুহূর্তে কাজলের কি হচ্ছে ও তো নিজেই বুঝতে পারছেনা, গাড়িতে যাওয়ার সময়ও চুপচাপ ছিল। এমনকি নামার পর শুধু একটা শুকনো বাই বলে বাড়িতে চলে আসে। সে দিন রাতে কাজল কারোর সাথে কথা বলেনি, শুধু ব্যালকনিতে চেয়ারে শান্তভাবে বসেছিল। মনের মধ্যে যেন একরাশ অভিমান ভিড় করে আসছে। পরের দিন সকালে প্রকাশ বাবু হঠাৎ ফোন করে জানিয়ে দেন, গানের প্র্যাকটিসে না আসতে। ফোন রেখে কাজলের মনে হয় ভালোই হল, মন খারাপের মাঝে একটু একা থাকতে পারবে। হ্যাঁ মন খারাপ কিন্তু কেন মন খারাপ কাজল বুঝতে পারছে না, হয়তো না বোঝার ভান করছে।
দুপুর অবধি চুপচাপ একা ঘরে বসে ছিল, খাওয়ার সময় শুধু মা বাবাকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য কোন রকমে খেয়ে নেয়। বিকেলের দিকে মা ঘরে এসে জানায় কাজলকে, আজকে মাসির বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। কাজল শুধু মাথা নাড়ে আর কিছুই বলেনা, সন্ধ্যে হয়ে আসলে চোখ মুখ ধুয়ে নেয়, তারপর আলমারি থেকে একটা সাদামাটা হলুদ রঙের কুর্তি আর সঙ্গে পাটিয়ালি পরে। চুলে একটা ক্লিপ লাগিয়ে দেয়, আর কানে দুটো ছোট ছোট ঝুমকো পরে। বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে তবে মুখ দেখে মনে হচ্ছে মনের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে গাড়ির আওয়াজ পেতে বুঝতে পারে মাসিরা চলে এসেছে। মন যতই খারাপ থাক হাসি মুখে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে ঘটে এক কাণ্ড ! দেখে রণজয় ওর মাকে সঙ্গে নিয়ে সোফার ওপর বসে আছে। কাজল একটু ঘাবড়ে যায়, এগিয়ে এসে রনজয় কে বলে,,,,,,,,
একি রণজয় দা তুমি এখানে? মেয়ে দেখতে যাওনি?
কাজলের কথা হয় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। রনজয়ের মা উঠে এসে, কাজলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,,,,,,,,,,
শোনো মেয়ের কথা ! এই মেয়েকে কে বোঝাবে? রণ তুই ওর সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বল। এখনো ছেলেমানুষই রয়ে গেল।
এই মুহূর্তে রণজয় কাজলের ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। কাজল একটু দূরে মুখটা কেমন ভার করে দাঁড়িয়ে আছে, এবার ধীরে ধীরে রনজয় একটু এগিয়ে এসে কাজলের হাতের উপর হাত রেখে বলে,,,,,,,,,,
কিরে মন খারাপ? চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব কেঁদেছিস? তোর এতটা কষ্ট হবে আমি ভাবিনি।
আমি কেন কাঁদতে যাব? আমি..........!!!!
রণজয় কাজলের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ একদম করিয়ে দেয়। তারপর নিজের হাতে কাজলের থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরে। কাজল তো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, শুধু চোখ দুটো ছল ছল করছে। রণজয় ভুরু কুঁচকে বললো,,,,,,,
তুই যে আমাকে মনে মনে এতটা আপন করে নিয়েছিস জানতাম না তো? আমি তো ভেবেছিলাম, তুই হয়তো না করে দিবি !!!!
কাজল কিছু বলতে পারেনা, সবকিছু ভুলে রনজয়ের বুকে আলতো করে মাথা রাখে। রণজয় কাজলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কাজল এবার অভিমানের সুরে বলে,,,,,,,
আমিই বা কি করে জানব? তুমি আমাকে নিয়ে এসব ভাবো। আমি তো ভেবেছিলাম আমরা শুধু বন্ধু.....!
পাগলী একটা ! কয়েকটা বছর ধরে তোকে নিয়েই তো স্বপ্ন দেখলাম। জানিস কাজু, কখন কিভাবে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নিজেই জানিনা। তোর মনের কথা বুঝতে না পারলেও, কালকে সন্ধ্যেতে যখন ক্যাফেতে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বললাম মুখটা দেখেই বুঝেছিলাম খুব কষ্ট পেয়েছিস। রাতে অনেক বার মনে হয়েছে ফোন করে তোকে জানিয়ে দিই, কিন্তু ভাবলাম না থাক। তোকে একটু সারপ্রাইজ দিই।
একটা প্রশ্ন করি?? জানি প্রশ্নটা হয়তো শুনতে কেমন লাগবে। তাও বলছি, সত্যিই আমাকে নিয়েও স্বপ্ন দেখা যায়?
কেন যাবেনা? লোকের মুখে নিজেকে সাধারণ শুনতে শুনতে ভুলেই গেছিস, তুই তো সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। তুই আমার প্রিয়তমা কাজু। আচ্ছা তুই আমায় বিয়ে করবি তো?
জানি না যাও.......!
ও বাবা ! আমার কাজু আবার লজ্জা পায়।
আর কিছু বলার বা শোনার বাকি থাকেনা। কাজল রণজয় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের মাঝে এখন শুধু নীরবতা বিরাজ করে, তবে মনে মনে দুজনেই দুজনকে বলে অনেকটা ভালোবাসি।