Aniruddha Basu

Romance Others

4.2  

Aniruddha Basu

Romance Others

ফিরে দেখা

ফিরে দেখা

42 mins
1.3K


পর্ব - ১


"করিয়া সন্যাস বৈকুণ্ঠের অধীশ্বর,

সে রাত্রি আছিলা প্রভু কণ্টকদ্বার।।

করিলেন প্রভু মাত্র সন্যাস গ্রহণ,

মুকুন্দেরে আজ্ঞা হৈল করিতে কীর্তন।।"


প্রভুর মতো সেদিন রণদীপও চেয়েছিল ঘর ছেড়ে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে। সুপর্ণা চলে যাবার পর সংসারটাই ওর কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। রোজ অফিস থেকে ফিরে আসার পর একা পেয়ে ফ্ল্যাটটা যেন ওর শ্বাসরোধ করতে চাইতো। সংসারের প্রতিটা জিনিসই ওর সামনে যেন সুপর্ণা হয়ে এসে দাঁড়াতো। তখন ওর মনে হতো এই ঘর, বাড়ি, চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। 


কিন্তু কোথায় যাবে? 

"কোথায় যাবে?" এই কথাটা চিন্তা করলেই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠতো চারিদিকে অনন্ত নীল জলরাশি, আশ্রম ঘেঁষা সারিবদ্ধ নারিকেলবীথি আর আশ্রমের সান্ধ্য ঘণ্টাধ্বনি। 

সুপর্ণা তখন রণদীপের কাঁধে মাথা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃদু ঢেউ খেলে যাওয়া সেই গভীর জলরাশির ওপর চাঁদটা এঁকে বেঁকে দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছিল। সুপর্ণা সেদিকে চোখ রেখে বলেছিল,

"দীপ, শুনেছি সংসার সীমান্তে বাণপ্রস্থ কাটাতে মানুষ আগে বনবাসে যেত। সংসারে আমরা যেদিন হাঁফিয়ে উঠবো, সেদিন বাকি জীবনটা আমরা এখানে এসে কাটাবো, কেমন?"


সুপর্ণা চলে গেছে আজ প্রায় তিন বছর হতে চললো। শেষের দিকটায় সে হাঁফিয়ে উঠেছিল। হয়তো সেজন্য রণদীপই বেশি দায়ী। সুপর্ণার চাকরিতে প্রতিপত্তি সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সুপর্ণার সাফল্য তার পৌরুষে যেন চাবুক মারতো। তাই তার সাফল্যের সঙ্গে সুপর্ণা নিজেও একদিন রণদীপের জীবনে অসহ্য হয়ে উঠলো। 


তারপর একদিন সুপর্ণা চলে গেল। রণদীপ কোনোদিন ভাবেনি যে সুপর্ণা তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাই সে যখন চলে গেল তখন রণদীপের সমস্ত ব্যক্তিত্বের লড়াই যেন ভেঙে পড়লো। একা ফ্ল্যাটে বসে প্রায়ই সে ভাবতো, কোথাও চলে যাবে। 


কিন্তু চলে সে যেতে পারেনি। চিরপরিচিত এই শহরের মায়া কাটিয়ে আজও সে কোথাও যেতে পারেনি। নিজেকে আরও বেশি কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে সে সুপর্ণাকে ভুলতে চেয়েছে। সব কিছু চাপিয়ে অবুঝ মনটা তবুও মাঝে মাঝে হাহাকার করে ওঠে। ওর সমস্ত শাসন, নির্দেশ অমান্য করে সে আকুল হয়ে ওঠে। রণদীপ তখন হাল ছেড়ে দিয়ে মনের নির্দেশে বিবাগী হয়ে পড়ে।


গতকাল ওর জীবনে সুপর্ণা এসেছিল। সকাল থেকে অনেক বুঝিয়ে সে মনকে বশে আনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যখনই সে লাগাম আলগা করেছে তখনই সে আবার অবাধ্য হয়ে উঠেছে। রণদীপ চেম্বারের খোলা জানালা দিয়ে দূরের ময়দানের দিকে তাকিয়েছিল। অবুঝ মনটা আকুল হয়ে বললো,

'রণদীপ, আমি আর পারছি না। কটা দিন আমায় একটু মুক্তি দাও। এই শহর ছেড়ে আমায় কোথাও একটু নিয়ে চলো।'


রণদীপ মনকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,

'যদি সে আমায় কাল ফোন করে বলে, "দীপ, আমায় ফিরিয়ে নাও। আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবো না।" আমি না থাকলে তার সেই ফোন ধরবে কে?'


মনটা বলে উঠলো, 'কেন মিছে খোয়াব দেখ? সে আর কোনোদিনই তোমার কাছে ফিরে আসবে না।'


রণদীপের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। সত্যিই তাহলে সে আর কোনোদিনও ফিরবে না? রণদীপের জন্য কি এতটুকুও তার ব্যথা নেই? রণদীপ ভাবলো,

'যত জ্বালা যন্ত্রণা কি কেবল আমার? থাক ও সুখে। আমিই কোথাও চলে যাবো।'


আর ঠিক তখনই রণদীপের চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই নীল জলরাশি, টালির চাল, গেরুয়া আশ্রম আর সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি। কিন্তু না। যেখানে সুপর্ণার স্মৃতি আছে সেখানে সে কিছুতেই যাবে না। কলকাতা থেকে সে পালাতে চাইছে তাকে ভোলবার জন্য, তার স্মৃতি বয়ে বেড়াবার জন্য নয়। সুপর্ণা তার জীবনে আসার আগে সে পাহাড়কে ভালোবাসতো। অনন্ত, সুবিশাল, সুউচ্চ তুষারাবৃত হিমালয়, ঋষিদের তপোভূমি হিমালয়, রহস্যময় হিমালয় নিরন্তর তাকে ডাকতো। আজও স্বপ্নের মধ্যে সে তাকে ডাকে। সেই ডাককে আর উপেক্ষা করতে চায় না সে।


"সাহেব, আপনি কি এখন বেরোবেন?"


রণদীপের ভাবান্তর হলো। ও খাস বেয়ারার দিকে তাকালো।


"কিছু বললে?"

"আপনার কি বেরোনোর দেরী আছে?"


রণদীপ উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর থেকে এ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে বললো,


"না, এবার বেরোবো। তুমি সব গুছিয়ে রাখো।"


রণদীপ লিফ্ট থেকে নেমে কার পার্কিং স্পেসে চলে এলো। ড্রাইভার তাকে দেখে সেলাম ঠুকলো। সে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি ধর্মতলার দিকে নিয়ে যেতে। ধর্মতলা বাস গুমটির কাছে নেমে সে ড্রাইভারকে বললো,


"গাড়িটাকে আমার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়ে চাবি নিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাও।"

"আপনি এখন বাড়ি ফিরবেন না স্যার?"

"না। ক'দিনের জন্য একটু কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে তোমায় ফোন করবো।"


ড্রাইভার অবাক হলো না। কারণ মাঝে মধ্যেই রণদীপকে টুকটাক অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে যেতে হয়। সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।


রণদীপ উত্তরবঙ্গের টিকিট কাউন্টারে এসে খোঁজ নিতে অনায়াসেই একটা টিকিট পেয়ে গেল।



পরদিন সকালে রণদীপের যখন ঘুম ভাঙলো, বাসটা তখন মহানন্দা পেরিয়ে পাহাড়তলীর বিশাল শহরটায় প্রবেশ করছে। বাসের জানালা থেকে পর্দাটা সরাতে দেখলো রোদ বেশ চড়ে গেছে। মহানন্দার ক্ষীণ জলধারায় কিছু লোক স্নান করছে। রণদীপ হাতঘড়িতে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। 


তেনজিং নোরগে যাত্রী নিবাসে বাসটা এসে দাঁড়ালো। সবার পেছনে রণদীপ এ্যাটাচি কেস হাতে নিয়ে নামলো। এই এ্যাটাচি কেসে ছোটখাটো ট্যুরের জন্য তার যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রাখা আছে। 


যাত্রী নিবাসের দোতলায় এসে একটা রিটায়ারিং রুম বুক করে রণদীপ একটু গড়িয়ে নিলো। গত রাত্রের স্বল্প পরিসরের ঘুমে শরীরটা ক্লান্ত লাগছিল। বেলা বাড়তে রণদীপ স্নান সেরে হালকা জলখাবার ও এক কাপ কফি খেলো। এইবার শরীরটা অনেক সতেজ লাগলো। 


রণদীপ ঘরে চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্ট্যান্ড থেকে একটা রিক্সা নিয়ে সে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক প্রাঙ্গনে ঢুকে একটা কোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজাটা খুলে গেল। গায়ে চাদর জড়ানো সৌম্য চেহারার মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক বিস্ময়ের চোখে ওর দিকে তাকালেন।


"রণদীপ? তুমি হঠাৎ? এসো এসো, ভেতরে এসো। কোথা থেকে আসছো?"


রণদীপ উত্তর দেবার আগেই ভদ্রলোক ভেতর দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় কাউকে ডাকলেন।


"কোথায় গেলে গো? কে এসেছে দেখো!"


রণোদীপ ভেতরে ঢুকে সামনের বৈঠকখানার ঘরটায় চলে এলো। সামনে রাখা বেতের একটা চেয়ারে বসে বললো,


"অপরেশদা, ক'টা দিন কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?"


অপরেশ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,


"তার মানে?"

"কলকাতায় আর ভালো লাগছিল না। তাই ক'দিনের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।"

"কোথায় যাবে সে বিষয়ে কিছু ঠিক করে বেরোওনি?"

"নাঃ। আর সেই জন্যই তো তোমার কাছে এলাম।"


অপরেশের বউ কেয়া এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন। রণদীপ হাসিমুখে ওনার দিকে তাকালো। এই মহিলাই ওর বাল্যকালের সেই কেয়াদি। রণদীপ লক্ষ্য করলো যে কেয়াদির সামনের দিকের চুলে পাক ধরেছে। 

কেয়াদি স্নেহ মাখানো গলায় বললেন,


"তাহলে ক'দিন এখানেই থেকে যা না!"

"না গো কেয়াদি। তা হয়না। ঘরের মধ্যে আর ভালো লাগছে না বলেই তো বেরোলাম।"


অপরেশ ওর কথায় সমর্থন করে বললেন,

"না না, তুমি ভালোই করেছো। বেশির ভাগ মানুষই এখন ভীষণ ঘরকুনো হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে ঠিকই করেছো।"


অপরেশের একথায় রণদীপের বুকের কোথাও যেন একটু চিনচিন করে উঠলো। কিন্তু সে মুখের হাসি বজায় রেখে বললো,


"কই, তুমি কিছু বললে না তো?"


কেয়া চলে যেতে যেতে বললেন,

"তোমরা কথা বলো। আমি ওর জন্য একটু জলখাবার করে আনি। আর দীপ, তুই কিন্তু দুপুরে খেয়ে যাবি।"

"আরে না না, ওসব ঝামেলা কোরো না। আমি এখনই চলে যাবো।"


অপরেশ টেবিল থেকে একটা রাইটিং প্যাড নিয়ে তাতে কিছু লিখছিলেন। এইবার স্ত্রীর পক্ষেই কথা বললেন।


"তা কি করে হয়? কতদিন পর কেয়া তার বাল্যসাথীকে পেয়েছে। ওর শখ আহ্লাদটাকেও তো দেখতে হবে। আর আমি যে ট্যুর প্রোগ্রাম করে দিচ্ছি, সেটা লাঞ্চের পরই তোমায় শুরু করতে হবে।"


কেয়াদির স্নেহের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে রণদীপ যখন সিকিম ট্র্যান্সপোর্টের বাসে চেপে বসলো ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো বাজে।



পর্ব - ২


অপরেশদার কথা অনুযায়ী গেজিং পৌঁছতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। রণদীপ তাই আরাম করে পা ছড়িয়ে সিটে হেলান দিলো। পাশের সিটে এক বয়স্ক নেপালী লোক প্রায় ওর গায়ের ওপর এসে বসলো। রণদীপ জানালার দিকে সরে এসে বাইরের দৃশ্যে চোখ রাখলো। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে এই দিনটিতে সুপর্ণা ওর জীবনে এসেছিল। মনে মনে রণদীপ বললো,


'একবারের জন্যও কি আজকের এই দিনটির কথা তোমার মনে পড়ছে না? মনে পড়ছে না তোমার দীপের কথা? একই শহরে থেকেও একটি বারের জন্যেও তার কোনো খবর নিলে না? তুমি শুধু তার ওপরটাই দেখলে? ভেতরে যে তুমি তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেলে। ঠিক আছে। আমার ভুলের মাশুল আমিই বয়ে বেড়াবো।'


রণদীপের চোখের পাতাদুটো ভিজে এলো। রাস্তার পাশে প্রবহমান রঙ্গিত ওর চোখে ঝাপসা লাগছিল। 

কালিম্পঙের রাস্তা পেরিয়ে বাসটা গ্যাংটকের চওড়া রাস্তা ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। কিছুদূর যাবার পর বাস গ্যাংটকের রাস্তা ছেড়ে ব্রীজ পেরিয়ে রঙ্গীতের অন্য পারে চলে এলো। ড্রাগনমুখী প্রবেশদ্বার বলে দিল যে 'তোমরা এখন লামাদের দেশে।'


শাল, সেগুন আর বাদাম গাছের ভেতর দিয়ে রঙ্গিত ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে গেছে। অন্য পারে ওপরের ঢাল বেয়ে রঙ্গিতের কোলে নেমে এসেছে সবুজ চায়ের বাগান। সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রণদীপের চোখ দুটো কখন যে বুজে এসেছিল তা সে টেরই পায়নি। হঠাৎ কাঁধে ঝাঁকুনি খেয়ে ও ধড়মড় করে উঠে বসলো। অল্পবয়েসী একটা নেপালী মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে উঠে বসতে দেখে সে হিন্দিতে বললো,

"সাব, ওই সিটটা আমায় ছেড়ে দাও।"


রণদীপ তার কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারলো না। সে তো টিকিট কেটেই বাসে উঠেছে ও নম্বর দেখেই সিটে বসেছে। ফ্যালফ্যাল করে ও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। 

সালোয়ার কামিজের ওপর একটা ঢাউস সোয়েটার পরেছে মেয়েটা। কাঁধছাপানো একমাথা কালো চুলের গোছা সামনের দিকে পড়ে যেন লকলক করছে। নাকে ঝকঝক করছে একটা লাল চুনী। রণদীপ মনে মনে বললো, 

'এ যে কাঞ্চনসুন্দরী!'

কাজলমাখা ছোট ছোট চোখদুটো কুঁচকে সে আবার হিন্দিতে বললো,


"কি হলো? শুনতে পাচ্ছ না বুঝি? ওই সিটটা আমাকে ছেড়ে দাও।"


রণদীপ পকেট থেকে টিকিটটা বার করে হিন্দিতে বললো,

"এই যে দেখো আমার টিকিট। এই সিটটা আমার।"


রণদীপের কথায় মেয়েটা ঝাঁঝিয়ে উঠলো,


"হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমারই সিট। আমাকে দয়া করে একটু বসতে দাও। নইলে ঝাঁকুনির চোটে উল্টি করে ফেলবো।"


বমির ভয়ে রণদীপ তাড়াতাড়ি সিট ছেড়ে উঠে পড়লো। ওর পাশের সিটের নেপালী লোকটাও পরের স্টপেজে নামবে বলে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটা ধপ করে জানালার ধারের সিটটায় বসে পড়লো। তারপর খিলখিল করে হাসতে লাগলো। রণদীপ মেয়েটির সঙ্গে দূরত্ব রেখে ভয়ে ভয়ে পাশের সিটে এসে বসলো। মেয়েটা হাসতে হাসতে হিন্দিতে বললো,


"কি হলো সাব, ছেড়ে দিতে হলো তো? উল্টির নাম শুনেই চমকে গেলে?"


রণদীপ কোনো কথা না বলে একটা সিগারেট ধরালো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বাসটা একটা ছোট শহরে ঢুকেছে। এখানে একটা আধঘন্টার স্টপেজ আছে। রণদীপ বাস থেকে নেমে বাইরে এলো। বড় বড় সাজানো দোকান আর হোটেলের পসরা নিয়ে সেজে উঠেছে শহরটা। চারিদিকে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এক উপত্যকার পুরোটা জুড়েই এই পাহাড়ি শহর। রণদীপের মনে হলো এই শহর গ্যাংটককেও টক্কর দিতে পারে। কি নাম এর? এক দোকানের সাইনবোর্ডে শহরের নাম লেখা আছে - 'জোড়থাং'। 


রণোদীপ পায়ে পায়ে সামনের ব্রীজটার দিকে এগিয়ে এলো। বহু ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া মোটা কেবল তার ধরে রেখেছে এই ঝুলন্ত ব্রীজকে। ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে রণদীপ নীচে রঙ্গিতকে দেখতে পেলো। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। ও ব্রীজ থেকে শহরের দিকে তাকাতে একটা আলোর মালা দেখতে পেলো। একবার মনে হলো, এই সুন্দর শহরটায় ক'টা দিন থেকে গেলে কেমন হয়? কিন্তু রাস্তায় মানুষের ভিড় দেখে ওর সেই ইচ্ছেটা পরক্ষণেই উবে গেল। 


ব্রিজের মুখে বসে থাকা অল্পবয়সী গার্ডটির কাছে গিয়ে সে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো,

"ভাই, এখন থেকে গেজিং যেতে আরো কতক্ষণ সময় লাগবে?"


ছেলেটা ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে পরিস্কার বাংলায় বললো,

"আপনি কোথা থেকে আসছেন?"


রণদীপের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। সে স্বাভাবিক স্বরে বললো, 

"কলকাতা থেকে।"

"আমার বাড়ি যাদবপুরে।"

"আচ্ছা।"


রঙ্গিত যেদিক দিয়ে নেমে এসেছে সেদিকের পাহাড়চূড়ার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ছেলেটি বললো,

"ওই ওপরে দেখুন, কতগুলো সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে। ওটাই গেজিং। এখন থেকে এখনও প্রায় তিন ঘন্টা মতো লাগবে। আপনি গেজিং যাবেন?"

"হ্যাঁ, সেরকমই তো ইচ্ছে আছে।"

"তাহলে রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে গেলেই ভালো করবেন।"

"কেন, একথা বলছেন কেন?"

"এখান থেকে গেজিংয়ের রাস্তাটা ভালো না। অনেক জায়গাতেই প্রচণ্ড ধস নেমেছে। কাল রাতেও একটা গাড়ি খাদে পড়ে গেছে। তাই বলছিলাম যে কাল সকালে গেলেই ভালো করতেন।"


রণদীপ ছেলেটির কথায় হেসে বললো,

"ভাটপাড়ার এক বিখ্যাত জ্যোতিষী আমার আয়ু গণনা করে বলেছে যে আমি আশি বছর বাঁচবো।"


ছেলেটি রণদীপের কথায় দমে গিয়ে বললো,

"পাহাড়ের কোথায় যে মৃত্যুফাঁদ লুকিয়ে থাকে, তা কোনো জ্যোতিষীই বলতে পারে না।"


রণদীপ ওর কথায় কান না দিয়ে চারধারের পাহারশ্রেণী দেখতে লাগলো। হঠাৎ এক জায়গায় ওর চোখ আটকে গেলো। রঙ্গিতের অন্য পারে বহু পেছনে অবস্থিত সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা দেখিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,

"ওই পাহাড়ের মাথায় যে আলোগুলো জ্বলছে, ওটা কোন জায়গা?"


ছেলেটি সেদিকে তাকিয়ে বললো,

"ওটাই তো দার্জিলিং। তার সামনে একটু নিচুতে ওই যে নীল আলো দেখছেন, ওটা হলো লেবং। রাত্রিবেলা লেবং থেকে এই জোড়থাংকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়।"


রণদীপ পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিল। হর্নের শব্দ শুনে ছেলেটি বললো,

"আপনার বাস বোধহয় এবার ছাড়বে।"


রণদীপ ছেলেটির পিঠে হাত রেখে বললো,

"আসি ভাই।"

"ফেরার সময় জোড়থাংয়ে একটা দিন থাকবেন। আমি আপনাকে সব ঘুরে দেখাবো।"

"ইচ্ছে রইলো ভাই।"


রণদীপের ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগে গেলো। আসলে বাংলার বাইরে কোনো বাঙালীর সঙ্গে আলাপ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগে। কিন্তু বাসে ফেরার পথে তার মনে হলো, 'যাঃ! ছেলেটার নামটাই তো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। যদি সত্যিই ফেরার পথে একদিন এখানে থাকি, তাহলে তাকে খুঁজে পাবো কি করে?'

একবার মনে হলো ফিরে গিয়ে ছেলেটির নামটা জেনে আসে, কিন্তু আবার হর্নের আওয়াজ শুনে সে চটপট বাসের দিকে পা চালালো। যাত্রাপথের নাম-না-জানা সহযাত্রীদের ভিড়ে ছেলেটি বুঝি হারিয়েই গেল।



পর্ব - ৩


বাসে ফিরে রণদীপ দেখলো কাঞ্চনসুন্দরীর ঢাউস ব্যাগটা ওর সিট দখল করে আছে। সে ওর দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বললো,

"ব্যাগটা নিজের কোলে রাখো।"


রণদীপের কথা শুনে সে কটাক্ষে ওর দিকে তাকালো। ভাবখানা যেন রণদীপ ব্যাগটা ওঠাতে বলে বড় অন্যায় করে ফেলেছে। যাই হোক, ব্যাগটা উঠিয়ে নেওয়াতে রণদীপ নিজের সিটে গিয়ে বসলো। বাস এবার নয়াবাজার ছাড়িয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠতে লাগলো। এর মধ্যেই চারিপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। পাহাড়ের গভীর অরণ্যপথে পাক খেয়ে উঠতে উঠতে রণদীপ রঙ্গিতের কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। একটু ঝুঁকে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কিছুই আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।


রণদীপ সিটের পেছনে মাথা রেখে চোখ বুজিয়ে রইলো। সুপর্ণার হাসিমাখা মুখটা মনের মাঝে ভেসে উঠলো। সুবর্ণরেখার নীল জলে দাঁড়িয়ে ও যেন উচ্ছলভাবে হাসছে। ঘাটশিলার এই ছবিটা রণদীপের খুব প্রিয় ছিল। আর আজ সে কোথায়!!

রণদীপ তার মনটাকে চাবুক মারলো। আবার সেই সুপর্ণার চিন্তায় বিভোর! মনকে বললো,


'তোমাকে নিয়ে বাপু আর পারা যায় না। অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করো না! মনে করো চাঁদিপুরের সেই নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ সমুদ্রতট। দুপাশে ধূ ধূ বালিয়াড়ি। জ্যোৎস্নারাতে তুমি একাকী বসে ছিলে বালির ওপর। চারিদিক চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল। তোমার সামনে সমুদ্রের ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছিল। তোমার মনে হয়েছিল যে অসীম, বিশাল সাগর বুঝি তোমায় গ্রাস করে ফেলবে। তুমি ভয়ে পালিয়ে এসেছিলে। 

অথবা মনে করো না, বেতলার জঙ্গলের সেই দুপুরবেলাটা। জঙ্গলপথে একা হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলে। একটা ছোট টিলার মাথায় একটা ভাঙা গড় দেখে তুমি ওপরে উঠে এলে। গড়ের সিঁড়ি বেয়ে তুমি ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে। আর অমনি তোমার চোখ আটকে গেল বহমান ঔরাঙ্গায়। ঔরাঙ্গার অন্য পারের সবুজ দ্বীপ আর ছোট ছোট গ্রামগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। দেখতে দেখতে তুমি মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলে। 


হঠাৎ একটা শিশু তোমার পেছনে কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিল। তুমি ভয়ে চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালে। গড়ের ভাঙা আলসে থেকে সেই মুহূর্তে ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়েছিল একটা সুন্দর ময়ূর। অথবা...

কিন্তু আর না। এবার আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি বরং একটু ঘুমিয়ে নিই।'


রণদীপের বেশ শীত করছিল। সে এ্যাটাচি কেস থেকে একটা গরম চাদর বার করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। তারপর সিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো।


ঘুমটা যখন বেশ গভীর হচ্ছে তখন কারো হাতের ধাক্কায় সে আবার চমকে জেগে উঠলো। 

ইশ! কি কাণ্ড দেখেছো! ঘুমের ঘোরে তার মাথাটা কাঞ্চনসুন্দরীর কাঁধের ওপর গড়িয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি মাথা সরিয়ে নিতেই সে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো। নিজের কাঁধটা দেখিয়ে হিন্দিতে বললো,


"এ সাব, এটাকে কি বিছানা পেয়েছো? ঠিকঠাক নিজেকে সামলে বসতে পারো না?"


রণদীপ লজ্জিত মুখে বললো, "সরি।"


তারপর সে নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে দেখলো যে কাঞ্চনসুন্দরী তার ব্যাগের অর্ধেকটা রণদীপের কোলে চালান করে দিয়ে নিজেকে হালকা করেছে। ওর আর প্রতিবাদে যেতে ইচ্ছে করলো না। চোখদুটো আবার বুজে এলো।


কতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কেটেছিল রণদীপের মনে নেই। হঠাৎ বাম বাহুর ওপর একটা জোর চিমটি খেয়ে এক মুহুর্তে তার সমস্ত ঘুম পালিয়ে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ও "উঃ" বলে চিৎকার করে উঠলো। বাহুর কাছটা বেশ জ্বালা করতে লাগলো। সেই জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে বিস্মিত চোখে সে কাঞ্চনসুন্দরীর দিকে তাকালো। মনে মনে বললো,

'কি মেয়ে রে বাবা! এ তো দেখছি অনায়াসে মানুষ খুন করতে পারে!'

রণদীপের বিস্ময়ভরা চোখে চোখ রেখে কাঞ্চনসুন্দরী হিসহিস করে বললো,


"কি ব্যাপার সাব? মেয়ে দেখলেই বুঝি কমজোরী হয়ে যান? আপনার কি লজ্জাশরম নেই?"


রণদীপ দেখলো আশপাশের সিট থেকে লোকজন ওকে দেখছে। লজ্জায়, অপমানে ওর কান দুটো লাল হয়ে উঠলো। কাঞ্চনসুন্দরী এক ঝটকায় ওর কোল থেকে নিজের ব্যাগটা টেনে এনে দুটো সিটের মাঝখানে রাখলো। রণদীপও যথাসম্ভব উল্টোদিকে চেপে বসলো। 


অন্ধকার থেকে হঠাৎই বাসটা আলোর ঝলসানির মধ্যে এসে থামলো। ঘড়িতে তখন বাজে প্রায় রাত সাতটা। অনেকেই বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে চা পান করতে লাগলো। তাদের দেখে রণদীপও নেমে এলো। এক ভাঁড় চা নিয়ে ও ড্রাইভারের কাছে এসে দাঁড়ালো। হিন্দিতে তাদের মধ্যে কথোপকথন হতে লাগলো। রণদীপ জিজ্ঞেস করলো,


"গেজিং পৌঁছতে আরো কতক্ষণ লাগবে?"

"এখন থেকে আরো এক ঘন্টা তো হবেই।"

"ওখানে থাকবার জন্যে হোটেল পাওয়া যাবে?"

"হ্যাঁ, তা পেয়ে যাবেন। আপনি বেড়াতে এসেছেন বুঝি?"

"হ্যাঁ।"

"সিকিম খুব সুন্দর রাজ্য। যেখানে আমরা রয়েছি এখন, সেটাও খুব সুন্দর জায়গা।"

"এই জায়গার নাম কি?"

"রেসি।"


রাস্তা থেকে নিচে একটা গোল জায়গা আলো দিয়ে সাজানো। সেদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ড্রাইভারটি বললো,

"ওই দেখুন, রেসি হট স্প্রিং। এর জল থেকে ওষুধ তৈরি হয়।"


রণদীপের ওসব এখন আর ভালো লাগছিল না। দুদিনের ক্লান্তিতে শরীরটা অবসন্ন লাগছিল। ওর উৎসাহের অভাব দেখে ড্রাইভার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। রণদীপও বাসে উঠে নিজের সিটে এসে বসলো। কাঞ্চনসুন্দরী তখন ব্যাগ থেকে কিছু বার করে মুখে পুরে জাবর কাটছিল। ওকে দেখে রণদীপের ভুলে যাওয়া রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সে দূরত্ব বজায় রেখে নিজের সিটে চুপচাপ বসে রইলো। 


বাসের পেছন দিক থেকে কোরাস গান ভেসে আসছিল।

"মুক্তির মন্দির সোপানতলে

কত প্রাণ হলো বলিদান,

লেখা আছে অশ্রুজলে।

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা

বন্দীশালার এই সোপানতলা।"


শিলিগুড়িতেই ওদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। চন্দননগর থেকে বঙ্গদুলালরা চলেছে জোংরি হয়ে গোচালা অভিযানে।


রেসি থেকে রাস্তা খুব খারাপ। রাস্তায় মাঝে মাঝেই ধস নেমে রাস্তাকে করে তুলেছে জরাজীর্ণ। ড্রাইভারকে খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছিল। সামনের একটা ধস পেরোনোর সময় বাসটা খুব ডাইনে বাঁয়ে দুলতে লাগলো। তারপর একটা নরম জায়গায় পড়ে চাকা আটকে গেল। ইঞ্জিনটা কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ করে থেমে গেল। ড্রাইভার সবাইকে নামতে বলাতে রণদীপ বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাসের হেড লাইটের আলোয় দেখলো যে একটা বড় ধস পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে এসেছে। বাঁদিকটায় খালি নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।


পাহাড়ি নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে বহু নিচ থেকে একটা কলকল ধ্বনি ভেসে আসছিল। রণদীপ বাঁ দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখার চেষ্টা করলো। কোথায় সে? নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে রণদীপ রঙ্গিতকে খুঁজে পেলো না। 


বাস ধসের জায়গাটা পেরিয়ে আসার পর আবার যাত্রীরা যে যার জায়গায় উঠে বসে পড়লো। মহারাণী কিন্তু সিট ছেড়ে নীচে নামেননি। রণদীপ বাসে উঠে দেখলো যে তিনি তখন রাজকীয় ভঙ্গিতে তাঁর 'সিংহাসনে' বসে লোকজনের উঠে আসা দেখছেন।


ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। ভাগ্যিস কেয়াদি জোর করে তার এ্যাটাচি কেসের মধ্যে অপরেশদার একটা সোয়েটার আর মাঙ্কি ক্যাপ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন! সেগুলোর যে এত তাড়াতাড়ি প্রয়োজন হবে কে ভেবেছিল!


রাস্তা এখন আরো খারাপ। বাসটা ভয়াবহভাবে কখনো বাঁয়ে, কখনো ডাইনে হেলে পড়ছিল। কাঞ্চনসুন্দরী এখন আর দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। বাসের ঝাঁকুনির তালে তালে মাঝে মাঝেই সে রণদীপের বুকে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। নিজেকে সামলে নিতে না নিতেই আবার এসে ঢলে পড়ছিল। 

কিছুক্ষণ পরেই ওরা গেজিং পৌঁছে গেল। 


বাস ছেড়ে বাইরে আসতেই রণদীপের শরীরে যেন একটা কাঁপুনি উঠলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ও চারিধারে চোখ বোলালো। অপরেশদা বলেছিল গেজিংয়ে রাতটা কাটিয়ে পরদিন পেলিং যেতে। রাস্তার উল্টোদিকে একটা হোটেল দেখে যাবার জন্য ও পা বাড়ালো। আর ঠিক তখনই তার সামনে একটা জীপ এসে থামলো। জীপের ড্রাইভার "পেলিং, পেলিং" বলে চিৎকার করতেই রণদীপ স্থির করলো যে গেজিংয়ে এক রাত নষ্ট না করে সে একেবারেই পেলিং চলে যাবে।




পর্ব - ৪


জীপটা আগে থেকেই প্রায় ভর্তি ছিল। রণদীপ কোনোমতে পেছনের দিকে একটা জায়গা পেলো। জীপ ওপর থেকে আরো ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। রণদীপ এ্যাটাচি কেসটা বুকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো। 


জীপের সামনের দিকটা কথাবার্তা আর হাহা-হিহিতে সরগরম হয়ে রয়েছে। রণদীপ সুযোগ বুঝে একবার হিন্দিতে চিৎকার করে বললো,

"ড্রাইভার-জী, পেলিং এলে একটু বলে দেবেন।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, বলে দেব।"


কিছুক্ষণ পরেই ওরা পেলিং পৌঁছে গেল। রণদীপ জীপ থেকে নেমেই থমকে দাঁড়ালো। কাঞ্চনসুন্দরী!! ওঃ, ওই তাহলে এতক্ষন কলকল করে কথা বলছিল! 

কাঞ্চনসুন্দরী ওর ঢাউস ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নৃত্যের তালে ছুটে চলে গেল। রাস্তার ধারের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে নীচের বাড়িগুলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল। 


"সাব, আপনি কোথায় যাবেন?"

ড্রাইভারের গলা শুনে রণদীপ পেছন ফিরে তাকালো। তারপর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে তাকে দেখালো। ড্রাইভার সেটা দেখে ওপরের একটা বাড়ি দেখিয়ে বললো,

"ওটাই হোটেল কাবরু। আমার নাম দীপক প্রধান। কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলবেন।"


রণদীপ পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে দীপকের হাতে দিল। দীপক জীপের হেডলাইটের আলোয় চিঠিটা মেলে ধরলো। 

ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে সোয়েটার পরেও রণদীপ শীতে কাঁপতে লাগলো। সামনে পাহাড়ের ঢালে আবছা কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পেছনের ফেলে আসা অন্ধকার রাস্তায় একটা আধখোলা দোকান থেকে নিওন লাইটের আলো ঠিকরে এসে পড়েছে।


দীপক প্রধান ফিরে এসে রণদীপের হাত থেকে এ্যাটাচি কেসটা নিয়ে বললো, 

"আসুন সাব।"


রণদীপ ওর পিছন পিছন হোটেলে এলো। দুপাশের ঘরগুলো এখন জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে আছে। পাহাড়মুখী শেষ ঘরটা রণদীপকে দেওয়া হলো। ছিমছাম, সাজানো গোছানো ছোট্ট ঘরটা এক নজরেই তার ভালো লেগে গেল। দীপক বললো,

"বাথরুমে গিজার আছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে একটু আরাম করে নিন। আমি একটু পরে আপনাকে ডিনার পাঠিয়ে দিচ্ছি।"


রণদীপ স্মিত হেসে হাতজোড় করে বললো,

"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।"


দীপক বিগলিত হয়ে বললো,

"আপনি স্যারের বন্ধু, আমাদের অতিথি। আপনার কোনো ব্যাপারে অসুবিধা হলে তক্ষুনি আমাকে বলবেন।"

"নিশ্চয়ই বলবো।"


দীপক প্রধান চলে যাবার পর রণদীপ জামাকাপড় ছেড়ে গরম জলে স্নান সেরে নিলো। তারপর রাতের খাবার খেয়ে পরিস্কার বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিলো।



দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে রণদীপের ঘুম ভেঙে গেল। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো বাইরে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। দরজা খুলতেই কম বয়সী একটা নেপালী ছেলে ওর ঘরে ঢুকে এলো। 


"সকাল থেকে দু-তিনবার এসে ফিরে গেছি সাব। আপনার ব্রেকফাস্ট আনবো কি?"


এই ঠাণ্ডার মধ্যে ছেলেটা স্রেফ একটা গেঞ্জি পরে আছে। রণদীপের ওর দিকে তাকিয়ে শীত করতে লাগলো। ও ভালো করে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে বললো,

"এক ঘন্টা পরে দিও।"


দরজা খুলে বারান্দায় পা রেখেই রণদীপ থমকে দাঁড়ালো। সামনে নীল আকাশের গায়ে সদর্পে দণ্ডায়মান শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা! কাবরু আর পান্ডিম মনে হচ্ছে যেন ওর হাতের মুঠোয়। হাত বাড়ালেই ওখান থেকে মুঠো মুঠো বরফ কুড়িয়ে নেওয়া যাবে। অবাক বিস্ময়ে রণদীপ প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। 


ব্রেকফাস্ট সেরে রণদীপ ওপরে উঠে এলো। ইচ্ছেটা রাস্তায় একটু বেড়িয়ে আসা। সে গতকালই জেনেছে যে এখানে বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে রাস্তায় বেরোতে হয়। ছাদ থেকে ও বরফঢাকা পাহাড়গুলোকে আরো কাছ থেকে দেখতে পেল। 


কিন্তু ছাদে পেতে রাখা চেয়ারগুলো দেখে রণদীপের আর রাস্তায় বেরোতে ইচ্ছে করলো না। একজন চেয়ারে বসে মাথায় সোয়েটার চাপা দিয়ে সম্ভবত রোদ পোয়াচ্ছে। রণদীপ গুটি গুটি চেয়ারগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা পেছন ফিরে তাকালো।

কাঞ্চনসুন্দরী!!

রণদীপকে দেখেই সে তীরের বেগে সেখান থেকে চলে গেল। রণদীপ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।

ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে একটা চেয়ারে সে গা এলিয়ে দিলো। ঠাণ্ডার মধ্যে রোদ্দুরটা বেশ ভালোই লাগছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘার ছোট বড় পাঁচটা শৃঙ্গ এখন থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। মাঝখানের শৃঙ্গ থেকে বাঁদিকের শৃঙ্গের নিচ পর্যন্ত একটা হিমবাহ নেমে এসেছে। বাঁদিকের দ্বিতীয় শৃঙ্গটার নীচে ওটা কি খাদ? কাবরুর প্রকৃতিটা রণদীপের অদ্ভূত লাগলো। সারা গায়ে কোনো বরফ নেই। কঠিন, কালো পাহাড়ের মাথায় সাদা চুলের মতো কিছুটা বরফ ছড়ানো। দেখলে মনে হয় কেউ যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথা থেকে খানিকটা বরফ তুলে এনে কাবরুর মাথায় ছড়িয়ে দিয়েছে। 

আচ্ছা, রজতশুভ্র পান্ডিমের মাথাটা এমন তীক্ষ্ণ ও ছুঁচালো হলো কি ভাবে? ওর মাথায় একটা পাখিও মনে হয় ঠিক মতো পা রাখার জায়গা পাবে না।

পান্ডিমের পেছনে কে যেন একটা উঁকি মারছে?


"সাব, আপনার কিছু লাগবে কি?"

রণদীপ বিরক্তির সঙ্গে ছেলেটির দিকে তাকালো। ভারী বেরসিক তো! বেজার মুখে সে বললো,

"এক্ষুনি তো ব্রেকফাস্ট করলাম। এখন আর কিছু লাগবে না।"

"না, মানে, জানতে চাইছিলাম আপনার কোনো ড্রিঙ্কস লাগবে কি না?"


রণদীপ হঠাৎ তৃষ্ণার্ত বোধ করলো। নাঃ, ছেলেটা রসিক বটে। কখন কি দরকার সেটা ভালোই জানে। সে জিজ্ঞেস করলো,

"বিয়ার পাওয়া যাবে?"

"হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।"


ঠাণ্ডার মধ্যে রোদ্দুরে গা এলিয়ে দিয়ে বিয়ার খাওয়ার যে এত তৃপ্তি, রণদীপ আগে তা জানতো না। একটু নেশা চড়লে ওর মনে হলো বিয়ারের ক্যানটা হাতে নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া থেকে একটু পায়চারী করে এলে কেমন হয়? অথবা যেমন করে ও সুপর্ণার পরশ নিত, তেমন করে যদি পান্ডিমকে ছোঁয়া যায়? সুপর্ণার কথা ভাবতেই মনটা আবার হু হু করে উঠলো।

'ওঃ, সুপর্ণা তুমি কোথায়? আমি যে তোমার একটা ছবি আঁকতে চাই। যে ছবিতে তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার ওপর বসে তোমার নিটোল পা দুটিকে রাখবে পান্ডিমের মাথায়। তোমার মুখটা থাকবে আকাশের দিকে তোলা আর তোমার হাতদুটোকে ছড়িয়ে দেবে নীল আকাশের গায়ে। কিন্তু তুমি না এলে যে আমি ক্যানভাসের ওপর রং বোলাতে পারছি না। তুমি আসবে না? সত্যিই কি তুমি আর আসবে না? কিন্তু সুপর্ণা, একদিন যে তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে যে আমায় ছেড়ে কখনো চলে যাবে না। কি হলো তোমার সেই কথার? তুমি মিথ্যেবাদী সুপর্ণা! তুমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারো না! তুমি হেরো! তোমার ভালোবাসা হেরে গেছে!' 


"সাব, রাত্রে ঠিকমতো ঘুম হয়েছিল তো?"

রণদীপ মনে মনে বললো, 'কে বাওয়া, এত দরদী বন্ধু আমার?' তারপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।

"ও, দীপক-জি! বসুন বসুন। হ্যাঁ, রাতে ভালোই ঘুম হয়েছিল।"


দীপক প্রধান একটা চেয়ার টেনে বসলো। তারপর হাসিমুখে বললো,

"আচ্ছা সাব, অপরেশ স্যার আপনার কে হন?"

"কোন স্যার?"

"অপরেশ স্যার।"

"উনি আমার বন্ধু।"

"অপরেশ স্যার খুব ভালো মানুষ। যখন আমার এই হোটেলটা ছিল না, তখন উনি আমার বাড়িতে এক সপ্তাহ হোম স্টে করেছিলেন। আমার জীপ নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতেন। দরকার হলে আপনিও আমার জীপ নিতে পারেন।"

"ধন্যবাদ দীপক-জী। কিন্তু আমার এক জায়গায় বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশি ভালো লাগে।"


দীপক প্রধান হেসে বললো,

"যা আপনার মর্জি। আপনার লাঞ্চ কি ঘরেই পাঠিয়ে দেব?"

"হ্যাঁ, ঘরেই পাঠিয়ে দিন।"


রণদীপ স্নান সেরে খাবার খেয়ে নিল। পাটভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে, গায়ে শাল জড়িয়ে সে আবার ছাদে উঠে এলো। রোদে পিঠ দিয়ে বসে আরেকটা বিয়ারের ক্যান খুললো।




পর্ব - ৫


পাহাড়ের তলা থেকে মেঘ উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এখন অনেকটাই অনেকটাই ঢেকে দিয়েছে। সামনের সবুজ পাহাড় থেকে সুতোর মতো একটা নদী নীচে ঝরে পড়ছে। অসংখ্য ছোট ছোট পাখি আকাশ জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাঁদিকের পাহাড়টার মাথায় একটা সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো গুম্ফা হবে। 


"সাব, রুমের চাবিটা কি আপনার কাছে?"


রণদীপ পেছন ফিরে দেখলো বক্তা এক শিশুক্রোড়ে সিকিম জননী। ডোরা কাটা লুঙ্গির ওপর রঙচঙে সোয়েটার পরা। কোলের বাচ্ছাটার মুখটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছে। ফর্সা তুলতুলে মুখ, ছোট্ট ছোট্ট চোখদুটো পিটপিট করছে। রণদীপ চাবিটা এগিয়ে দিল। 


একটু পরেই সিকিম জননী ফিরে এলো। চাবিটা রণদীপকে ফিরিয়ে দিয়ে হিন্দিতে বললো,

"সাব, আপনি অপরেশ-জীর বন্ধু?"


রণদীপ মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তরে বললো,

"হ্যাঁ। কিন্তু আপনার পরিচয়?"


মহিলা একটু ইতস্তত করে মুখ নিচু করে বললো,

"আমি এ বাড়ীর বউ।"


রণদীপের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

"আচ্ছা, তার মানে আপনি দীপক-জীর স্ত্রী?"

"জী সাব। আপনি তো কাল রাতে এসেছেন?"

"হ্যাঁ।"

"মুনিয়া আপনার কথা বলছিল।"

"কে মুনিয়া?"

"দীপক-জীর বোন, যার সঙ্গে কাল আপনার বাসে দেখা হয়েছিল।"


রণদীপ মনে মনে বললো, 

'ওরে বাবা! মানে সেই কাঞ্চনসুন্দরী দীপক প্রধানের বোন!! এ যে খোদ বাঘের...থুড়ি, বাঘিনীর গুহায় এসে আশ্রয় নিয়েছি!'


ভয়ে ভয়ে সে বাঁদিকের বাহুর ওপর একটু হাত বুলিয়ে নিলো। ওর হাবভাব দেখে দীপকের বউ হাসতে লাগলো। তারপর বললো,

"ওর ওপর রাগ করবেন না সাব। ও মেয়েটাই অমনি। কিন্তু যখন থেকে শুনেছে যে আপনি অপরেশ-জীর বন্ধু, তখন থেকেই আর লজ্জায় আপনার সামনে আসতে পারছে না।"


কথা শেষ করে দীপকের বউ ছাদের আলসে দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করলো, 

"মুনিয়া, একটু ওপরে আয় তো!"


কিছু পরে মুনিয়া ওর বৌদির পিছন পিছন এসে রণদীপের সামনে দাঁড়ালো। ওর বৌদি বললো,

"যা, সাবের কাছে মাফ চা।"


রণদীপ এবার লজ্জিত হয়ে পড়লো। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

"আরে, মাফ চাওয়ার মতো কিছু করেনি ও। আপনারা বসুন বরং।"


কাঞ্চনসুন্দরী নীল জিন্সের ওপর একটা লাল উঁচু গলার সোয়েটার পরেছে। মুখটা নিচু করে সে মেঝেতে পায়ের আঙুল ঘষছিল। বৌদি বসতে বললেও সে দাঁড়িয়েই রইলো। রণদীপ বললো,

"মুনিয়া বসো।"


এইবার সে ভীরুপায়ে বৌদির পাশে গিয়ে বসলো। দীপকের বউ রণদীপকে বললো,

"সাব, আপনাকে দেখছি সকাল থেকে সেই একই জায়গায় বসে আছেন। কোথাও ঘুরতে যাবেন না?"


রণদীপ খালি বিয়ারের ক্যানটা চেয়ারের নিচে নামিয়ে রেখে বললো,

"ঘুরে বেড়াতে আমার ভালো লাগে না।"


মুনিয়া হঠাৎই মুখর হয়ে উঠলো।

"সাব তো শুধু মদ খেতেই ভালোবাসে।। বেড়াতে যেতে পছন্দ করে না।"


কথাটা ওর মুখ ফসকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর কথা শেষ হতেই দীপকের বউ ওকে জোরে ধমক দিলো,

"মুনিয়া, ভদ্র ভাবে কথা বল।"


মুনিয়া চেয়ার থেকে উঠে নিচে পালিয়ে গেল। রণদীপ মনে মনে ভাবলো,

'কে বলে আজ সে লজ্জা পেয়েছে? লজ্জা তো ওর অলংকার নয়, ওর প্রকৃত অলংকার হলো রাগ।'


দীপকের বউ লজ্জিত হয়ে বললো,

"সাব, ওর হয়ে আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি। দীপক-জী ফেরার পর ওর জন্য কড়া দাওয়াইয়ের বন্দোবস্ত করছি।"


রণদীপ উতলা হয়ে বললো,

"না না, এরকম একেবারেই করবেন না। মনে হয় ওর স্বভাবটাই এরকম।"


দীপকের বউ চলে গেল। রণদীপ চুপ করে বসে রইলো। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। কাবরুর মাথায় শেষ আলোটাও এক সময় মিলিয়ে গেল। চারিদিক জুড়ে সন্ধ্যা নামলো। রণদীপ ঘরে ফিরে এলো। গরম কম্বলের মধ্যে ঢুকে অসমাপ্ত উপন্যাসটা পড়তে লাগলো। 


এক নাগাড়ে বেল বাজতে থাকায় রণদীপের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্তির সঙ্গে কম্বলের ভেতর থেকে হাতটা বার করে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। এখনো দিনের আলো পরিস্কার হয়নি। এমন সাত সকালে চা নিয়ে এলো? কিন্তু ও তো বেড টী চায়নি। 


বেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে বিছানায় শুয়েই হাঁক দিলো,

"কে তুমি? কি চাই?"

ওদিক থেকে কোনো উত্তর এলো না। কিন্তু বেলটা ক্রমাগত বেজেই চলেছে। রণদীপ বিরক্তির সঙ্গে বিছানা ছাড়লো। শীতে কাঁপতে কাঁপতে পাঞ্জাবীর ওপর সোয়েটারটা চাপিয়ে নিলো। তারপর রাগের সঙ্গে সজোরে ও দরজাটা খুললো এবং বিস্ময়ে চমকিত হলো। সামনে দণ্ডায়মান কাঞ্চনসুন্দরী! আর তার মাথার পেছনে ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে তুষারশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা! রণদীপ মনে মনে তারিফ করে বললো, 

'কি অপূর্ব ফ্রেম!"


মুনিয়া হাত তুলে নির্দেশ দিলো,

"আমার সঙ্গে এখন বাইরে চলো।"

"কোথায়?"

"ওই যে দূরের মাঠে, যেখান থেকে সূর্য ওঠা দেখা যায়। এক্ষুনি সানরাইজ হবে। তুমি চলো আমার সঙ্গে।"

"তুমি যাও মুনিয়া। আমার ওসব ভালো লাগে না।"

মুনিয়া কঠিন গলায় বললো,

"শোনো সাব, আমাদের এখানে যারা আসে, তারা কিন্তু বেড়াতেই আসে। সারাদিন ধরে তারা প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়ায়। তোমাকেও তাই করতে হবে। তোমাকে আমার সঙ্গে এখন যেতেই হবে।"


রণদীপের কোনো আপত্তিই টিঁকলো না। বাধ্য ছেলের মতো শালটা গায়ে জড়িয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত সে কাঞ্চনসুন্দরীর পিছন পিছন সেই সুদূর মাঠে চলে গেল। মাঠ পেরিয়ে তারা পায়ে হাঁটা পথ ধরে সামনের পাহাড়ে উঠতে লাগলো। কিছুদূর যাবার পর রণদীপ দাঁড়িয়ে পড়লো। পাহাড় চড়া অভ্যেস নেই তো, তাই হাঁফিয়ে গেছে। কাঞ্চনসুন্দরী পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো,

"কি হলো, এসো! সূর্য যে উঠে গেল!"


রণদীপের করুণ অবস্থা দেখে সে ফিরে এসে দ্বিধাহীনভাবে তার হাতটা ধরে বললো,

"এসো, রাস্তার দিকে চোখ রেখে সাবধানে চলে এসো। দেখো, আমার হাত ছেড়ে দিও না যেন!"


আবার শুরু হলো তাদের পথ চলা। সরু, খাড়াই পাহাড়ি শুঁড়িপথ ধরে কিছুদূর চলার পর রণদীপ আবার হাঁফিয়ে পড়লো। রাস্তার পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে সে বললো,

"আমি আর পারছি না। চলো ফিরে যাই।"


কাঞ্চনসুন্দরী তার পা দুটোকে বাচ্ছা মেয়ের মতো দাপিয়ে বললো,

"এসো না! আর একটুখানি পথ তো! এক্ষুনি সূর্য উঠে যাবে।"


দীর্ঘশ্বাস ফেলে রণদীপ আবার চলতে শুরু করলো। চারিদিকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর গা ছমছম করতে লাগলো। পাহাড় চড়ে চড়ে পায়ে রীতিমতো ব্যথা করতে লাগলো। কিন্তু তাও নাছোড়বান্দা হয়ে ও পথ চলতে লাগলো। 


ওপরে উঠে এসে কাঞ্চনসুন্দরী রণদীপের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর তাকে হাত ধরে টেনে ওপরে তুলে নিলো। ওপরে উঠে রণদীপ একটা গুম্ফা দেখতে পেলো। তার ভেতর থেকে কোন বাদ্যযন্ত্রের গম্ভীর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ ভেসে আসছে। কাঞ্চনসুন্দরী ওকে সঙ্গে নিয়ে গুম্ফার পেছনে এসে দাঁড়ালো। 


সামনেই নীল আকাশের নিচে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশুভ্র চূড়ায় রং ধরেছে। রণদীপ মোহিত হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলো। এ সে কোথায় এসে পড়লো! এত কাছ থেকেও তাকে পাওয়া সম্ভব! আর ওই চূড়াগুলি কাদের? ওদের তো আগে দেখেনি রণদীপ! কাবরুর ডানদিকে দূর থেকে দূরান্তে ক্রমশ আবছা হয়ে গেছে এক একটি তুষারশৃঙ্গ। কোনোটির অতি তীক্ষ্ণ অবয়ব, কোনোটি খর্বাকৃতি, কোনোটি আবার শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত। নাম-না-জানা ওই পর্বতচূড়াগুলি কেমন যেন স্বপ্নের জগৎ বলে মনে হচ্ছে। 


রণদীপ এবার বাঁদিকে চোখ সরিয়ে আনলো। কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র গায়ে রঙের হোলি খেলতে খেলতে সূর্যটা একসময় পেমিয়াংচির দিক থেকে লাফিয়ে আকাশে উঠে বনবন করে ঘুরতে লাগলো। কি অপূর্ব দৃশ্য! লোকে বলে যে টাইগার হিলের সানরাইজ নাকি সেরা। কিন্তু আজকের এই অদ্ভূত সুন্দর সূর্যোদয় দেখবার পর রণদীপ সে ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হলো। 


রণদীপ মুখ ফিরিয়ে পাশের দিকে তাকালো। কাঞ্চনসুন্দরী বিজয়িনীর মত তার দিকে তাকিয়ে এখন হাসছে। ফর্সা মুখে সূর্যের ছটা পড়ে নাকছাবিটা আরো রক্তাভ হয়ে উঠেছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো কপালে পড়ে চোখদুটোকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রণদীপ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

"আজকের দিনটা আমি কখনও ভুলবো না। আর তোমাকেও না।"



পর্ব - ৬


সূর্যোদয়ের পর ঘুরে ঘুরে রণদীপ গুম্ফাটা দেখলো। নামার সময় একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনসুন্দরী তাকে নিচের সবুজ উপত্যকাটা দেখালো। আর দেখালো পাহাড়ী ঢালে ছবির মতো সাজানো ওদের ছোট্ট পেলিং। রং বেরঙের বাড়িগুলো ওখান থেকে খেলনার মতো দেখাচ্ছিল।


ঢালু রাস্তায় কাঞ্চনসুন্দরী দূর থেকে দূরে চলে যেতে লাগলো। আর মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখে নিচ্ছিল রণদীপ ঠিকমতো আসছে কিনা। পাহাড়ের নিচের সবুজ মাঠটায় পৌঁছনোর পর রণদীপ ওর নাগাল পেলো। হাঁফাতে হাঁফাতে ওরা মাঠের ওপরেই বসে পড়লো। কাঞ্চনসুন্দরী বললো,

"সাব জলদি চলো। ব্রেকফাস্ট করে আমরা ভাঙাকুঠিতে যাবো।"


রণদীপ তখনও হাঁফাচ্ছিল। ওর কথা শুনে আঁৎকে উঠলো। বললো,

"ওরে বাবা, না! আমি আর কোত্থাও যাচ্ছি না!"


ওর কথা শুনে কাঞ্চনসুন্দরী ফুঁসে উঠলো,

"কেন? আমার সঙ্গ ভালো লাগছে না বুঝি?"


রণদীপ নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো,

"আরে না না, তুমি ভুল বুঝছো। আসলে আমি এত হাঁটতে পারি না যে!"


কাঞ্চনসুন্দরী কপট রাগে উঠে দাঁড়ালো।

"ঠিক আছে, ঠিক আছে। যেতে হবে না আমার সঙ্গে।"


তারপর সে হনহন করে হাঁটা দিলো। রণদীপ ডাকলেও সে পিছন ফিরে তাকালো না। রণদীপ ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্রমশ সে দূরে মিলিয়ে গেল। রণদীপের তখনই ওঠার ক্ষমতা ছিল না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর সে হোটেলের দিকে রওনা দিলো। কিন্তু হোটেলে ফিরে কোথাও তাকে দেখতে পেলো না।  


স্নান সেরে রণদীপ ব্রেকফাস্ট করলো। তারপর বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপ করে বসে রইলো। মৃদু রোদ্দুরটা বেশ ভালোই লাগছিল। একটা পাহাড়ী ঈগল উড়তে উড়তে সামনের পাইন গাছটার মাথায় এসে বসলো। গাছের ফাঁক দিয়ে লোয়ার পেলিংকে দেখা যাচ্ছে। রণদীপ চোখ সরিয়ে ওপরের দিকে তাকালো। এখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া অন্যান্য শৃঙ্গগুলি কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে। একটু পরে রণদীপ ওপরে উঠে এলো। সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারী করে সে ছাদে এসে একটা চেয়ারে বসলো। 


হঠাৎই রণদীপ দেখতে পেলো যে রেস্তোরাঁর সামনের কাঠের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনসুন্দরী। ওর চোখে চোখ পড়াতে রণদীপ ওকে হাতের ইশারায় ডাকলো। সে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। সঙ্কোচবশে রণদীপ ওকে গলা তুলে ডাকতেও পারছে না। তাই নিজেই উঠে গিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। কাউন্টারে দীপকের বউ আছে। ওকে দেখেই সে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো। 

"আসুন সাব। সকালে সানরাইজ কেমন দেখলেন?"

"ভীষণ সুন্দর।"


রণদীপের গলা পেয়েই কাঞ্চনসুন্দরী বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রণদীপ তার মোক্ষম অস্ত্রটা ছাড়লো।

"ভাবী-জী, আমি কাল সকালেই চলে যাবো।"


রণদীপ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো তার অস্ত্রের তাৎক্ষণিক ফল। কাঞ্চনসুন্দরী দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরলো। তার চোখভরা বিস্ময়। 

"তুমি কালই চলে যাবে? তাহলে এখানে এসেছিলে কেন?"


দীপকের বউও অবাক হয়ে বললো,

"আপনি মাত্র একদিনের জন্য এসেছিলেন?"


রণদীপ ঠোঁট টিপে হেসে কাঞ্চনসুন্দরীর দিকে চেয়ে বললো,

"ইচ্ছে তো ছিল কিছুদিন থাকবো। কিন্তু একা একা বেড়াতে কি আর কারো ভালো লাগে?"

"তাহলে আমার সঙ্গে ভাঙা কুঠিতে চলো।"

রণদীপ ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

"কিন্তু তুমি তো সকাল থেকে আমার সঙ্গে কথাই বলছো না।"


দীপকের বউ দুজনের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

"আচ্ছা। তার মানে সকালে আবার একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেছে!"

"আপনাদের মুনিয়া তো কথায় কথায় ঝগড়া করে।"

"ওর কথায় একদম কান দেবেন না। মেয়েটা একটা পাগলী।"


কাঞ্চনসুন্দরী চলে যাবার আগে বললো,

"চটপট লাঞ্চ করে নাও। আমি এক্ষুনি আসছি।"


লাঞ্চের পর রণদীপ আর কাঞ্চনসুন্দরী রাস্তায় উঠে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। কাঞ্চনসুন্দরী এখন সাদা গাউনের ওপর দুধসাদা সোয়েটার পরেছে। লালচে চুলগুলোকে একটা একটা সাদা রিবনের সাহায্যে পেছনে টেনে বেঁধেছে। চলার পথে টুকটাক কথা হতে লাগলো।


"সাব, তুমি শিলিগুড়িতে থাকো?"

"না। আমি কলকাতায় থাকি।"

"তোমার সঙ্গে ভাবী-জীকেও নিয়ে এলে না কেন?"


রণদীপের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। রণদীপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

"ভাবী-জীর এসব ভালো লাগে না। তাই আসেনি।"


পাকা রাস্তা ছেড়ে ওরা এবার হালকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরলো। রাস্তা এখানে খুবই সংকীর্ণ। রণদীপ কাঞ্চনসুন্দরীর পিছন পিছন হাঁটছিল। কোথাও কোথাও পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে প্রবাহিত জলধারা ওদের চলার পথের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছিল। অনেকক্ষন হাঁটার পর ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়লো। দুজনে দুটো পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলো। একটু পরে ওদের সামনে একটা পাহাড়ী নদী পড়লো। কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওরা আবার জঙ্গলে প্রবেশ করলো। 


"আচ্ছা সাব, তুমি কখনো লেপচা দেখেছো?"

"না। কেন বলো তো?"

"তোমাকে আমি একটা লেপচা গাঁয়ে নিয়ে যাবো। লোয়ার পেলিং থেকে একটু দূরে সেই গাঁও।"


রণদীপ মনে মনে ভাবলো,

'এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল। এসেছিলাম কটা দিন নিজের মত করে কাটাবো বলে, আর এখন এই কাঞ্চনসুন্দরীর পাল্লায় পড়ে সারাদিন চরকির মতো ঘুরতে হচ্ছে। অথচ তাকে "না" বলার মতো মনের জোরও খুঁজে পাচ্ছি না। তার জন্যেই তো আজ সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার এক নতুন রূপ দেখলাম। কি করে তার সঙ্গকে আমি প্রত্যাখ্যান করি?'


কাঞ্চনসুন্দরী দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনপানে তাকালো। হেসে বললো,

"কি ভাবছো এত? ভাবছো মুনিয়া ফের আমাকে জ্বালাতে শুরু করেছে?"

"না। ভাবছি লেপচা গাঁয়ে কি আছে?"

"কি আছে? লেপচাদের ইতিহাস তুমি জানো?"


রণদীপ মজা করে বললো,

"না। জানি না। শুধু এটুকু জানি যে লেপচাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।"

কাঞ্চনসুন্দরী আবার হাঁটা শুরু করলো।

"তোমার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও সিকিমের সঙ্গে লেপচাদের গভীর আত্মীয়তা আছে।"

রণদীপ ওকে রাগানোর জন্য বললো,

"তাতে আমার কি?"


এ কথায় সত্যিই সে বেশ রেগে গেলো। বললো,

"তবে এসেছো কেন? অপরেশ-জী যখন এসেছিলেন তখন ওই গাঁয়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন।"


সামনেই এক বিশাল ভাঙা প্রাসাদ পড়াতে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। প্রাসাদের গা বেয়ে আগাছা গজিয়ে উঠেছে। ধসে যাওয়া প্রাসাদের জরাজীর্ণ কঙ্কালটা এখনও রাজসাক্ষী বহন করে চলেছে। চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে সেই ভগ্নদশা রাজপ্রাসাদ দেখে রণদীপের বহুকাল আগে পড়া এক কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো।


'চৌদিকে পাহাড় বেড়ি বাড়ি-গড়,

দুর্গম গহন কাটি,

করিয়া চত্বর, বসলো নগর

রাজার বসতবাটি।'


পাশে দাঁড়ানো কাঞ্চনসুন্দরীর দিকে তাকালো সে। তার মুখটা এখনও রাগে গম্ভীর হয়ে আছে। সকালে দেখা কাঞ্চনসুন্দরীর থেকে এ অনেকটাই আলাদা। রণদীপ বললো,

"এটাই বুঝি তোমার সেই ভাঙা কুঠি?"


কাঞ্চনসুন্দরী কোনো উত্তর না দিয়ে পথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া হাতের ছড়িটা দিয়ে সামনের আগাছার ওপর রাগ প্রকাশ করছিল। রণদীপ আবার বললো,

"এটা কত বছরের পুরনো হবে?"

কাঞ্চনসুন্দরী বিরক্তি মাখা মুখে বললো,

"বলতে পারবো না। চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।"

রণদীপ হেসে বলল,

"আচ্ছা বাবা, আর রাগ করতে হবে না। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, আমি সেখানেই যাবো। হয়েছে?"


কাঞ্চনসুন্দরী চকিতে হাসিমুখে হাত বাড়ালো।

"কথা দিলে?"

রণদীপ ওর হাত ধরে বললো,

"কথা দিলাম।"




পর্ব - ৭


কাঞ্চনসুন্দরী রণদীপের হাত ধরে সামনে এগিয়ে চললো। রণদীপ ওর হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বললো,

"এবার তো বলো, এই প্রাসাদ কত বছরের পুরনো?"

"তিনশো বছরেরও বেশি হবে।"

"তুমি কি করে জানলে?


কাঞ্চনসুন্দরী ওর সঙ্গে ছাদহীন একটা হলঘরে ঢুকে এলো। সম্ভবত কোনো এক সময় এটা প্রার্থনা কক্ষ ছিল। সেখানে এসে সে বললো,

"সবাই তাই বলে। সিকিমে সবার আগে লেপচারা এসেছিল। কিন্তু ওরা কবে, কোথা থেকে এসেছিল, সে কথা কেউ বলতে পারে না।"


প্রস্তরনির্মিত থামগুলো দেখতে দেখতে রণদীপ বললো,

"কেন? সবাই জানে যে লেপচারা তো তিব্বত থেকে এদেশে এসেছিল।"


কাঞ্চনসুন্দরী বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললো,

"হ্যাঁ, কেউ কেউ সেরকমই বলে বটে। আবার কারো কারো মতে ওরা বার্মা থেকে এসেছিল। কেউ বলে লেপচারা আসাম থেকে এসেছে। কিন্তু কোনো কথারই কোনো প্রমাণ নেই।"


রণদীপ এবার চপলতা ত্যাগ করে আলোচনার গভীরে প্রবেশ করলো।

"কিন্তু মুনিয়া, এমনও তো হতে পারে, যে লেপচারা সিকিমে আসার আগেও অন্য কেউ এসেছিল?"


কাঞ্চনসুন্দরী দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বললো,

"না সাব। লেপচারাই প্রথম সিকিমে এসেছিল। ওদের পর ভুটিয়া আর নেপালীরা এসেছে। যদিও সিকিমের প্রথম রাজা ভুটিয়া সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাঁর নাম কি ছিল জানো?"


পড়া-না-পারা ছাত্রের মত রণদীপ মাথা নাড়লো। কাঞ্চনসুন্দরী আরও উৎসাহিত হয়ে বললো,

"ফুন্ট সোগ নামগিয়াল। ১৬৪২ সালে উনি রাজা হয়েছিলেন। ইওকসাম ওনার রাজধানী ছিল।"


রণদীপ হাঁটতে হাঁটতে একটা বিশাল ভাঙা চার দেওয়ালের মাঝে এসে দাঁড়ালো। এক প্রান্তে পাথরের তৈরি এক বড়সড় বেদী। অন্য প্রান্তে বেঁটে বেঁটে কতগুলো পাথরের থাম। রণদীপকে সেদিকে তাকাতে দেখে কাঞ্চনসুন্দরী বললো,

"আমাদের দ্বিতীয় রাজা তেনসুং নামগিয়াল এখানে বসেই রাজ্য চালাতেন।"


রণদীপ চারিদিক দেখতে দেখতে বললো,

"কিন্তু তুমি যে বললে যে নামগিয়ালদের রাজধানী ছিল ইওকসাম?" 

"আমাদের প্রথম রাজধানী ওটাই ছিল। কিন্তু পরে যখন নেপাল আর ভুটান আমাদের দেশে বারবার হামলা করতে শুরু করলো তখন আমাদের দ্বিতীয় রাজা ইওকসাম থেকে রাজধানী উঠিয়ে এখানে নিয়ে আসে।"


রণদীপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশের ধ্বংসপ্রায় রাজপ্রাসাদটা দেখছিল। কাঞ্চনসুন্দরী হঠাৎই ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর অস্ফুটে বললো, 

"সাব....বিচ্ছু!!"


রণদীপ কিছু বুঝলো না। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে একটু ঘাবড়ে গেল। পায়ের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ায় হাতের ধাক্কায় সে কাঞ্চনসুন্দরীকে সরিয়ে দিল। ব্যথা লাগা পায়ের উপর চোখ যেতেই সে শিউরে উঠলো। একটা বড় সাইজের পাহাড়ী বিছে ওর জুতোর ওপর থেঁতলে গেছে। ওর একটা দংশনেই আজ রণদীপের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারতো। কথাটা ভাবতেই তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এরই মধ্যে কাঞ্চনসুন্দরী একটা পড়ে থাকা শুকনো ডালের আগা দিয়ে বিছেটাকে তুলে ফেলে দিলো। রণদীপ আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে কাঞ্চনসুন্দরীর হাত ধরে বাইরের পথে পা বাড়ালো।

"মুনিয়া বাইরে চলো। এই জায়গাটা খুব বিপজ্জনক।"


কাঞ্চনসুন্দরী হেসে বললো,

"সাব, তুমি মৃত্যুকে এত ভয় পাও?"


কাঞ্চনসুন্দরীর কথাগুলো রণদীপের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধলো। সত্যি, মৃত্যুকে সে কত ভয় পায়। সুপর্ণা চলে যাবার পর কতদিন সে মৃত্যুর কথা ভেবেছে। মেট্রো প্ল্যাটফর্মের তৃতীয় লাইনটা কতদিন ওকে ডেকেছে, কিন্তু জীবনের প্রতি মায়াটাকে সে কিছুতেই বিসর্জন দিতে পারেনি। মুনিয়ার কথায় তার চটক ভাঙলো।


"কি সাব, এত কি ভাবছো?"

"কিছু না। তোমার কাহিনী শোনাও।"

"কোন কাহিনী সাব?"


কাঞ্চনসুন্দরী হাঁটতে হাঁটতে বললো,

"আর কোনো কাহিনী নেই। চলো, নদীর ধারে বসে একটু বিশ্রাম করি।"


রণদীপ প্রাসাদের পেছনের ঘরগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

"ওই ঘরগুলো দেখবো না?"

"না সাব। তুমি আমাদের অতিথি। তোমার কিছু হয়ে গেলে সেটা আমাদের ভালো লাগবে না।"


রণদীপ কাঞ্চনসুন্দরীর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

"মুনিয়া, তুমি জানো, এখন থেকে কবে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল?"

"১৭৯৩ সালে রাজা হবার পর সুগফুদ নামগিয়াল টুমলিংয়ে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকে এই রাজপ্রাসাদ এখানে এভাবেই পড়ে আছে।"


একটু পরেই ওরা নদীর ধারে চলে এলো। কাঁকর বিছানো ফাঁকা নদীতটে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনসুন্দরী বললো,

"সাব, এখানে বসে একটু বিশ্রাম নাও।"


রণদীপ একটা পাথরের ওপর বসে চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো। রোদ্দুর এখন বেশ পড়ে এসেছে। নদীর ধারের ছোট ছোট আগাছাগুলোর মাথায় নানা রঙের প্রজাপতি উড়ছে। কাঞ্চনসুন্দরী ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে হাঁফিয়ে উঠেছিল। এখন সে ঘাসের উপর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে রণদীপের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। সুপর্ণা তখনও চাকরীতে যোগ দেয়নি। মাঝে মাঝে অফিসের ফাঁকে সে সুপর্ণার হাত ধরে ময়দানে চলে যেত। গাছের তলায় ঘাসের উপর মাথা রেখে ওরা দুপুরের নির্জনতা উপভোগ করতো। 


কাঞ্চনসুন্দরী মাথার নীচে হাত রেখে রণদীপকে দেখলো।

"এ সাব। কি এত ভাবছো?"

"কিছু না।"

"তুমি ঝুট বলছো। ভাবী-জীর কথা মনে পড়ছে, তাই না? আচ্ছা সাব, ভাবী-জীকে কেমন দেখতে?"


রণদীপ হেসে বললো,

"তোমার মতো এত সুন্দর সে নয়।"


কাঞ্চনসুন্দরী উঠে বসে শাসনের ভঙ্গীতে বললো,

"আবার ঝুট? সত্যি কথা বলো।"

"সত্যি বলছি।"


কাঞ্চনসুন্দরী হঠাৎই লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢাকলো।

"ধ্যাৎ! তুমি ঝুট বলছো। আমি মোটেই সুন্দর নই।"


রণদীপ তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

'তুমি শুধু সুন্দর নও, তুমি পেলিংকেও সুন্দর করেছো।'


রোদ পড়ে যাচ্ছে দেখে ওরা এবার ফেরার পথ ধরলো। জঙ্গলের পথ এখন অনেকটাই ছায়া সুনিবিড় হয়ে এসেছে। গাছেদের মাথায় পাখিরা কলরব করছে। চড়াই পথে হাঁটার সময় রণদীপ ক্লান্ত হয়ে পড়লে সকালের মতোই কাঞ্চনসুন্দরী ওর হাত ধরে চলতে লাগলো। ওর হাতের স্পর্শে রণদীপ যেন জীবনের পথে এগিয়ে চলার নতুন উদ্যম খুঁজে পেলো। 


ওপরে উঠে আসার পর রণদীপ ঘাসের উপর সটান শুয়ে পড়লো। এতটা পথ চড়াই ওঠার পর প্রাণটা যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ও চোখ বুজে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে লাগলো। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ঘুরছে বলে মনে হলো। কাঞ্চনসুন্দরী ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ওকে দেখছিল। রণদীপের মুখের ওপর ওর নিঃশ্বাস পড়ছিল। কাঞ্চনসুন্দরী ওর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

"সাব, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?"


ওর নিঃশ্বাসের মাদকতা রণদীপকে মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল। সেই জোয়ারে হারিয়ে যাবার আগে সে নিজেকে সামলে নিলো। উঠে বসে বললো,

"না, আমি ঠিকই আছি। একটু দম নিয়ে নিলাম।"

"চলো তবে, ঘরে ফিরি।"


রণদীপ মনে মনে বললো, 

'ঘর? কোথায় ঘর? আজ আমার আর ঘর বলে কিছু নেই কাঞ্চনসুন্দরী। তাই তো আমি ঘরছাড়া যাযাবরের মতো ছুটে বেড়াই, জীবনের থেকে পালিয়ে বেড়াই।'

"ও সাব, চলো না! অন্ধকার হয়ে এলো যে!"

"হ্যাঁ চলো।"


রণদীপ উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে এখন অনেকটাই সুস্থ মনে হলো। পা দুটো তাও অবসন্ন হয়ে আছে। ধীরে ধীরে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।




পর্ব - ৮


আজ সকালেও সে ঘুম ভাঙালো পাখি ডাকার আগে। রণদীপ ভাবলো, না জানি আজ আবার কোথায় কোথায় যেতে হবে, তার কি কি অত্যাচার সইতে হবে। তবে কোনো কোনো অত্যাচার কষ্টকর হলেও তা সইতে ভালো লাগে। যেমন বিয়ের পর সুপর্ণা ওকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে ওর সঙ্গে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর মর্নিং ওয়াক করতো। সেই সময় রোজ রোজ ভোরবেলায় ওঠা নিয়ে সুপর্ণার সঙ্গে ও কত অশান্তি করেছে। কিন্তু আজ যদি সুপর্ণা আবার সেই অত্যাচার করতো তাহলে সে আনন্দের সঙ্গে সেটা মেনে নিতো।


রণদীপ ছাদে উঠে দেখলো কাঞ্চনসুন্দরী একটা জীপের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো জিন্সের ওপর কালকের সেই সাদা সোয়েটারটা পরে আছে। তাকে দেখে ওর লালচে ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে যেন মুক্ত ঝরে পড়লো। হাত নেড়ে সে রণদীপকে ডাকলো। রণদীপ গাড়ির কাছে এসে দেখলো, দীপক ও তার বউ পিছনের সিটে বসে আছে। বউয়ের কোলে ওদের বাচ্ছাটা ঘুমিয়ে রয়েছে। কাঞ্চনসুন্দরী ও রণদীপ ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। রণদীপ দীপকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

"দীপক-জী, আমরা কোথায় যাচ্ছি?"


দীপক হেসে বললো,

"আমরা তো রিম্বিতে আমার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তারপর মুনিয়া আপনাকে খেচিপেরি লেক দেখাতে নিয়ে যাবে। তবে ইচ্ছে করলে আপনি আমাদের সঙ্গে রিম্বিতেও যেতে পারেন।"


কাঞ্চনসুন্দরী ওর দাদার কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠলো,

"আমরা রিম্বি যাবো না। তোর শ্বশুরবাড়িতে আমরা কেন যাবো রে?"


দীপকের বউ কাঞ্চনসুন্দরীকে চটানোর জন্য মুচকি হেসে বললো,

"ঠিকই তো। আমাদের সঙ্গে তুই যাবি কেন? তুই তো এখন সাবের সঙ্গে লটকে আছিস।"


বৌদির কথায় সে জ্বলে উঠলো। ঝটতি পেছন ফিরে বললো,

"ঈশ্! তোমার মত নাকি? তোমার বেহায়াপনার গল্প বলবো নাকি?"


রণদীপ আর দীপক ওদের কথা শুনে হাসছিল। দীপকের বউ যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। তারপর ননদকে তুষ্ট করতে বললো,

"তোকে খারাপ কথা কি বললাম রে? আমি বললাম যে তোর সঙ্গে সাবকে দেখতে খুব ভালো লাগে। কি সাব, আপনিই বলুন, আমাদের মুনিয়া খুব ভালো মেয়ে না?"


রণদীপ কোনো কথা না বলে কাঞ্চনসুন্দরীর চোখে চোখ রাখলো। রাগে ভরা সেই মুখটায় আস্তে আস্তে রক্তিম আভা দেখা দিল। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করলো। 


গাড়িটা এখন অনেকটাই নিচে নেমে এসেছে। বরফঢাকা পাহাড়গুলো এখন আর দৃশ্যমান নয়। সামনে আরেকটা পাহাড় তাদের আড়াল করে রেখেছে। অনেকক্ষন চলার পর ওরা রিম্বি এসে পৌঁছলো। জীপ থেকে নামার সময় স্থির হলো যে ফেরার পথে দীপকদের তুলে নিতে হবে। 


আবার ওদের যাত্রা শুরু হলো। রাস্তা এখন সোজা ইয়াকসামের দিকে চলেছে। সে রাস্তায় কিছুদূর যাবার পর জীপটা বাঁদিকের একটা রাস্তা ধরলো। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়। মাঝে মাঝে এক একটা বড় গাছ মাথা উঁচু করে সকালের রোদ পোয়াচ্ছে। সারাটা রাস্তা ওরা নানা কথায় মেতে রইলো। অবশ্য রণদীপ আর ড্রাইভার তামাং বেশির ভাগ সময়টাই শ্রোতা হয়ে রইলো। একসময় ওরা খেচিপেরি লেক পৌঁছে গেল। রণদীপ আর কাঞ্চনসুন্দরী নেমে গেল আর তামাং জীপের মধ্যেই রইলো।


জীপ থেকে নেমে ওরা কাঁচা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। পথের শেষে একটা লেকের সামনে এসে দাঁড়ালো। লেকের পরিস্কার, পান্নাসবুজ জল টলটল করছে। দুপাশের সবুজ বনানীর ছায়া পড়ে তাকে আরও রহস্যময়ী মনে হচ্ছে। কাঞ্চনসুন্দরী ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

"দেখেছো সাব, জলটা কি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। শুনেছি যে লেকের জলে একটা পাতা পড়লেও নাকি একটা পাখি সেটাকে ঠোঁটে করে তুলে ফেলে দেয়।"


রণদীপ লক্ষ্য করে দেখলো যে টলটলে ওই হ্রদের জলে কোথাও এতটুকু কুটো পর্যন্ত পড়ে নেই। ও জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সেই বিশেষ পাখিটিকে খুঁজতে লাগলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কাঞ্চনসুন্দরী প্রবাহিত রঙ্গিতের মতো কলকল করে হেসে উঠলো। রণদীপকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,

"তুমি কি বুদ্ধু নাকি? ও পাখিকে কি মানুষে দেখতে পায়? ও তো ঈশ্বরের পাঠানো পাখি। আর এই লেকের জল খুব পবিত্র। এখানে কেউ কোনো মানত করলে সেটা অবশ্যই পূরণ হয়।"


কাঞ্চনসুন্দরীর কথা শুনে ও জলের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের মধ্যে সুপর্ণার মুখটা ভেসে উঠলো। সে যে বড় অভিমান নিয়ে চলে গেছে। আমার অহংবোধ যে তার ভালোবাসাটাকে তছনচ করে দিয়েছে। সে কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে? 


"কি সাব, তুমি কিছু চাইলে?"

রণদীপ তার দিকে ফিরে তাকালো। সে কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রণদীপের ঠোঁটে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠলো। 

"বলোনা সাব, কি চাইলে?"

"আমি ঈশ্বরের কাছে আমাদের মুনিয়ার জন্য একটা খুব সুন্দর বর চেয়েছি। যে তাকে খুব সুখে রাখবে।"


কাঞ্চনসুন্দরীর মুখে এবার একটা অভিমানের ভাব ফুটে উঠলো। সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফিরে যাচ্ছিল। রণদীপ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললো। 

"কি হলো মুনিয়া?"


সে রাগের সঙ্গে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

"ছাড়ো আমার হাত!"


রণদীপ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালো। সে কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। রণদীপ তার পাশে গিয়ে বসতে সে নিজেকে কিছুটা দূরত্বে সরিয়ে নিলো। রণদীপ আর কথা বলার চেষ্টা না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাঠির ওপর ভর দিয়ে একটা লম্বামতো লোককে সে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো। রণদীপ তার মুখের গঠন আর বিশেষ ধরনের পোশাক লক্ষ্য করছিল। কাঞ্চনসুন্দরী তার অভিমান পর্ব সমাপ্ত করে রণদীপের কাছে ঘেঁষে এসে বসলো। লোকটাকে দেখিয়ে বললো,

"সাব দেখো, ওই হলো লেপচা।"

"বুঝলাম। কিন্তু তোমার কি হয়েছিল বলো দেখি?"

"ছাড়ো সেসব কথা। চলো, কাল তোমাকে লেপচা গাঁও দেখিয়ে আনি। গ্রামটা খুব বেশি দূরে নয়।"

ইয়াকসাম পৌঁছতে বেলা দুপুর হয়ে গেল। জায়গাটা রণদীপের একেবারেই ভালো লাগলো না। এখন থেকে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গগুলো দেখা যায়না। থাকার মধ্যে আছে শুধু কিছু দোকান পাট আর কয়েকটা হোটেল। ইয়াকসাম সিকিমের প্রথম রাজধানী। পুরোনো রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ লোকালয় থেকে খানিকটা দূরে। 


কাঞ্চনসুন্দরী বোল্ডারবিছানো সরু পাহাড়ী পথ দেখিয়ে বললো,

"এই রাস্তা ধরেই লামা লাৎসুন চেম্ব এখানে এসেছিলেন।"

"তিনি কে?"

"লাৎসুন চেম্ব তিব্বতের এক বৌদ্ধ লামা। তিব্বতে যখন লাল টুপিওয়ালা লামাদের সঙ্গে হলুদ টুপিওয়ালা লামাদের লড়াই চলছিল, তখন লাৎসুন চেম্ব তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। এখানে একটা গুম্ফা বানাবার কথাও ভেবেছিলেন। এখানে আসার পর আরো দুজন লামার সঙ্গে ওনার দেখা হয়েছিল। সেদিন থেকেই এই জায়গাটার নাম ইয়াকসাম, যার মানে তিন মহামানবের মিলনস্থল।"

"কিন্তু ইয়াকসাম তো তোমাদের রাজধানী ছিল। তার সঙ্গে লামাদের সম্পর্ক কি?"

"ওই সময় লামরাই তো গুম্ফা থেকে রাজা নির্বাচন করতেন। ওনারা যখন এক ধার্মিক নেতার খোঁজ করছিলেন তখন গ্যাংটকে ফুন্ট সোগ নামে এমনই এক নেতার খোঁজ পান তাঁরা। তিনিই আমাদের প্রথম রাজা ছিলেন। সিংহাসনে বসার পর তাঁর নাম হয় চোঙ্গিয়াল ফুন্ট সোগ নামগিয়াল।"


ঠাণ্ডার মধ্যে রোদে দাঁড়াতে বেশ ভালোই লাগছিল রণদীপের। হঠাৎই লুকিয়ে থাকা খিদেটা জানান দিতে ও বললো,

"এখানে কোনো খাবারের দোকান পাওয়া যাবে কি মুনিয়া?"


কাঞ্চনসুন্দরী খুব লজ্জা পেয়ে বললো,

"কি কাণ্ড! আমি তো খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসস্ট্যান্ডে চলো, ওখানেই হোটেল পাওয়া যাবে।"


কাঞ্চনসুন্দরীর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রণদীপ বললো,

"তোমরা রাজাকে 'চোগিয়াল' বলো কেন?"

"লেপচা ভাষায় 'চোগিয়াল' মানে হচ্ছে ধার্মিক রাজা।"

"আচ্ছা। আর 'নামগিয়াল' মানে কি?"

"নামগিয়াল হলো আমাদের রাজার পদবি।"


বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে কাঞ্চনসুন্দরী একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলো। রণদীপও তাকে অনুসরণ করে নামতে লাগলো। নীচে একটা ছোট্ট খাবারের দোকান পাওয়া গেল। রণদীপ আর কাঞ্চনসুন্দরী জানালার ধারের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। 


রণদীপ বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল কয়েকটা ইয়াক বা চমরী গাই পাহাড়ের ঢালের ঘন সবুজ ঘাসজমিতে চরে বেড়াচ্ছে। এরপর সে ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করলো। একটা টেবিলে কয়েকটা লোক বসে মদ খাচ্ছে। বারান্দায় বসে এক বয়স্ক মহিলা চুখা টানছিল। ওদের বসতে দেখে সে এগিয়ে এলো। কাঞ্চনসুন্দরী সম্ভবত নেপালী ভাষায় তাকে কিছু বললো। মহিলাটিও সেই একই ভাষায় উত্তর দিলো। মহিলাটি চলে যাবার পর সে বললো,

"রুটি আর সবজি ছাড়া এখন আর কিছুই পাওয়া যাবে না।"

"ঠিক আছে, ওতেই হবে।"

"না হলেও কিছু করার ছিল না। আমি দু প্লেট বলে দিয়েছি।"

"ভালো করেছো।"

"ইওকসামে একসময় আমরা খুব আসতাম। তোমাকে যে রাস্তাটা দেখালাম না, ওই রাস্তা দিয়ে জোংরি, গোচালা হয়ে হিমালয়ের অন্দরে যাবার রাস্তা আছে। আগে আমার দাদা আর তার বন্ধুরা ট্যুরিস্টদের নিয়ে ওখানে ট্রেক করে যেতো। তখন ওদের সঙ্গে আমি আর ভাবীও চলে আসতাম। তারপর ওদের ইওকসামে ছেড়ে আমরা ফিরে যেতাম।"


ওদের কথার মাঝে বয়স্ক মহিলাটি দুটো থালায় করে তিব্বতী রুটি আর আলু-ফুলকপির তরকারী এনে দিলো। সেই দিয়েই লাঞ্চ সেরে ওরা ফেরার পথ ধরলো। রিম্বিতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে এলো। জীপ থেকে নেমে ওরা পায়ে-হাঁটা গ্রাম্য পথ ধরে দীপকের শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছলো। 


সামনে রং-বেরঙের ফুলের টব দিয়ে সাজানো ছিমছাম ছোট্ট দোতলা বাড়িটিই হলো দীপকের 'শসুরাল'। সামনের উঠোনে একরাশ ভুট্টা শুকোচ্ছে। সেখানে ওরা ভালোই আদর যত্ন পেলো। 


জীপে উঠে ওরা নানারকম ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে লাগলো। তবে সবারই উদ্দেশ্য যেন কাঞ্চনসুন্দরী।

রণদীপ আড়চোখে তাকে লক্ষ্য করছিল। কখনও সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিল, কখনও বা তার মুখে ছিল গাঢ় অভিমানের ছায়া।




পর্ব - ৯


হোটেলে ফিরে আসার পর রণদীপের নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হলো। গায়ে কম্বল চাপিয়ে ও বারান্দায় গিয়ে বসলো। একটু আগেই সূর্য ডুবে গেছে। আকাশটা এখন আবিরের মতো লাল। এখনো অন্ধকার নামেনি। তবে বরফচূড়াগুলো এখন মেঘের আড়ালে। দূরের ধূসর পাহাড়টার নিচ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। সামনের সবুজ উপত্যকার ওপর একটা ধোঁয়াশার চাদর থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কতগুলো ছোট ছোট পাখি একটা ঝোপের ওপর লাফালাফি করছে। 

রণদীপের চোখদুটো বুজে আসতে চাইলো। ও ঘরে ঢুকে শরীরটাকে কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। 


হঠাৎ দরজা ধাক্কার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখে চারিদিক অন্ধকার। সে বিছানা ছেড়ে উঠে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। তারপর ঘরের দরজা খুলতে দেখলো কাঞ্চনসুন্দরী ও হোটেলের সেই ছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার হাতে খাবারের থালা। কাঞ্চনসুন্দরী তাকে টেবিলের ওপর থালাটা রাখার নির্দেশ দিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলো। ছেলেটা থালা রেখে চলে গেল। কাঞ্চনসুন্দরী বললো,

"তুমি তো রেস্তোরাঁয় এলে না, তাই আমরাই খাবার নিয়ে এলাম।"

"ক'টা বাজে এখন?"


কাঞ্চনসুন্দরী তার পরিচিত রাগের গলায় বললো,

"ন'টা বেজে গেছে, সে খেয়াল আছে? তোমার জন্য আমরা কেউই এখনো ডিনার করতে পারিনি।"


রণদীপ লজ্জিত হয়ে বললো,

"তুমি গিয়ে খেয়ে নাও। আমি ঠিক খেয়ে নেব।"

"তুমি আগে খাও। তারপর আমি যাবো।"


রণদীপ সেন্টার টেবিলটা কাছে টেনে নিল। প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, 

"এই খাবারগুলোর একটাকেও তো চিনতে পারছি না। এদের নাম কি?"

"এটা হলো টম ইউম স্যুপ উইথ কোকোনাট মিল্ক। আর এটা হচ্ছে লার্ব গাই থাই চিকেন সালাদ। এটা হলো ব্যাংকক স্টাইল ড্রাঙ্কেন নুডলস। আর এটা..."

"থাক থাক আর বলতে হবে না। এগুলোই মাথায় ঢোকাই আগে। আর থাই খাবারের সঙ্গে একটু চ্যাং বিয়ার হবে না...বা মেকং?"


শাসনের সুরে কাঞ্চনসুন্দরী বললো,

"থাই খাবারের নাম না জানলেও থাই মদগুলোর নাম তো বেশ ভালোই জানো দেখছি! যা দিয়েছি তাই চুপচাপ খেয়ে নাও!"


তারপর হঠাৎই সে চেয়ার থেকে উঠে রণদীপের পাশে এসে বসলো। গলায় একটা হতাশার সুর এনে বললো,

"সাব, তুমি কবে যাবে?"


রণদীপের ভেতরটা একটু চমকে উঠলো। 

"কেন?"


সে মাথা নিচু করে মেঝেতে পায়ের আঙুলটা ঘষতে ঘষতে বললো,

"না, এমনিই।"


রণদীপের হঠাৎ একটু রসিকতা করার ইচ্ছে হলো। সে বললো,

"আমি তো ভাবছিলাম যে এখানে থেকেই যাবো।"


কাঞ্চনসুন্দরীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে রণদীপের চোখে চোখ রেখে বললো, 

"সত্যি??"

"কখনো কখনো এমন মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরই ভাবছি, আমাকে খাওয়াবে কে?"

"কেন, আমরা খাওয়াবো।"


রণদীপ হেসে ফেললো। 

"তোমাদের হোটেলের তো তাহলে খুবই ইনকাম।"

"হোটেল থেকে আমাদের থোড়ি চলে। হোটেল তো অফ সিজনে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের এলাচের চাষ আছে। সেটাই আসল ইনকাম। বলো না সাব, সত্যি তুমি থাকবে? আমরা খুব ঘুরবো। হাঁটতে হাঁটতে একদিন আমরা হিমালয়ের অন্দরে চলে যাবো।"


রণদীপ অবাক চোখে এই নির্মল, সরল পাহাড়ী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ও সত্যিই তার কথাগুলো বিশ্বাস করে নিয়েছে। 


হঠাৎ সে রণদীপের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আশাহত গলায় বললো,

"ওঃ, আমি কি বোকা দেখো সাব। ভুলেই গিয়েছিলাম যে ওদিকে তোমার ঘরওয়ালী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।"


রণদীপের একবার মনে হলো যে কাঞ্চনসুন্দরীকে বলে,

'ওগো কন্যা, মিছেই তুমি ভাবছো! ঘর, ঘরওয়ালী কিছুই নেই আমার। সবই আমি নিজের দোষে, নিজের ভুলে হারিয়েছি। তাই তো ওই শহর ছেড়েও কিছুতেই তাকে ভুলতে পারি না।'


রণদীপ চুপ করে বসে আছে দেখে কাঞ্চনসুন্দরী তাড়া লাগালো,

"ও সাব, জলদি খেয়ে নাও। আমাদের সবাইকে ভুখা মারবে নাকি?"


রণদীপ তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলো। কাঞ্চনসুন্দরী এঁটো থালাবাটিগুলো নিয়ে চলে গেল। সে চলে যেতেই রণদীপের মনটা খুব ভারী হয়ে গেল। সত্যি, কত সহজে এরা মানুষকে আপন করে নিতে পারে। অথচ যে মানুষটা দু বছর ধরে অহরহ তাকে কাছে পেয়েছে, তাকে ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে, সে কত সহজেই আজ দূরে থাকতে পারছে। 


সুপর্ণার মুখটা আজ খুব মনে পড়ছে রণদীপের। মনে মনে বললো,

'সুপর্ণা, ভালোবাসা জিনিসটা কি তোমার কাছে এতই ঠুনকো যে সামান্য ইগো ক্ল্যাশের জন্য তাকে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়তে দিলে? তুমিই না একসময় বলতে, যে আমায় ছাড়া বাঁচতে পারবে না? সে সবই কি শুধু মুখের কথাই ছিল? মানছি যে দোষটা আমারই ছিল, কিন্তু তুমি কি আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারতে না? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারতে না?'


রণদীপ বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। কিছুতেই ওর আজ ঘুম আসছে না। একসময় সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। গায়ে ভালো করে চাদরটা জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আর তখনই ওর চোখদুটো অবাক বিস্ময়ে দূরের পাহাড়ের গায়ে আটকে গেলো। জ্যোৎস্নাধোয়া নিশুতি রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা মোহময়ী রূপধারণ করেছে। অনন্ত আকাশের বুকে তার রজতদ্যুতির ছটা ছড়িয়ে পড়েছে। রণদীপ ছাদের দিকে উঠে গেল। 


ছাদে পা রাখতেই সে আবার একটা চমক খেলো। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ছাদের কোণে ও কে দাঁড়িয়ে? রণদীপের দিকে পিছন করে সে সামনের পাহাড়চূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রণদীপ ভাবলো চলে যাবে কিনা। তারপর দ্বিধান্বিত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। একী! এ যে কাঞ্চনসুন্দরী!! এত রাত হয়ে গেছে, এখনো ও ঘুমোয়নি? কেন এখন পাহাড়ের দিকে ও অমনভাবে তাকিয়ে আছে? ওই পাহাড় তো তার আজীবনের সাথী। 

রণদীপ কাছে গিয়ে ডাকলো,

"মুনিয়া!"


কাঞ্চনসুন্দরী চমকে পেছন ফিরে তাকালো। একী! তার চোখে জল? তার কিসের ব্যথা, যার জন্য সে লোকচক্ষুর আড়ালে গোপনে অশ্রুপাত করে? একটা আশঙ্কায় তার বুকটা কেঁপে উঠলো। যে ভয় সে পেয়েছিল এ কি তারই প্রকাশ? 


মুনিয়া তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিয়ে ম্লান হেসে বললো,

"সাব তুমি? এখনও ঘুমোওনি?"

"ঘুম আসছে না। কিন্তু তোমার কি হয়েছে?"

"কই, কিছু না তো?"


রণদীপ শাসনের সুরে বললো,

"ছিঃ মুনিয়া, ঝুট বলো না।"


মুনিয়া কিছু না বলে দূরের পাহাড়টার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তারপর স্বপ্নালু গলায় বললো,

"এই পাহাড়ী মেয়েটার গল্প শুনবে সাব? শুনবে আমার জীবনের কাহিনী?"

"তুমি বললেই শুনবো।"





পর্ব ১০


কাঞ্চনসুন্দরী শুরু করলো তার অতীতের কাহিনী। সে রণদীপের হাত ধরে তাকে পাশের চেয়ারে বসালো। তারপর বললো,

"সাব, আজ সকালে তুমি ঈশ্বরের কাছে আমার জন্য একটা সুন্দর বর চেয়েছিলে, মনে আছে?"

"আছে।"

"এই মুনিয়াও কোনোদিন একটা সুন্দর ছেলেকে ভালোবেসেছিল। আমরা দুজন ওই খেচিপেরি লেকের জলে মানত করেছিলাম যে আমাদের একটা সুখের সংসার হোক। সুমন আমার দাদার খুব বন্ধু ছিল। ওরা দুজন একসাথে মাউন্টেনিয়ারিং পাশ করেছিল। তারপর দুজনে গাইডের কাজ করতো। ফরেনারদের সঙ্গে নিয়ে ট্রেক করে ওরা হিমালয়ের গভীরে চলে যেত। 


একবার তেমনই এক টীমের সাথে ওরা রাথং গ্লেসিয়ারে গিয়েছিল। ওরা সেখানে পৌঁছনোর কিছু আগে ওয়েদার খুব খারাপ হয়ে যায়। অনেকেই আর না এগিয়ে ফিরে আসার রাস্তা ধরে। কিন্তু সুমন এলোনা। ও একজন আহত ফরেনারকে নিয়ে রাস্তার মাঝখানে ফেঁসে গিয়েছিল। মানবতার খাতিরে সুমন তাকে ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারেনি। 


যখন ওয়েদার ভালো হলো তখন ওরা ফিরে গিয়ে দেখে, রাথং যাবার যে রাস্তায় সুমনরা আটকে ছিল সেই রাস্তাটা তুষারধসে ভেঙে নীচে পড়ে গেছে। বহু খুঁজেও ওদের আর পাওয়া যায়নি। দাদা বলে যে ওরা এ্যাভালাঞ্চের সঙ্গে নিচের খাদে পড়ে গেছে, কিন্তু আমি সেকথা বিশ্বাস করিনা। আমার মন বলে যে ও একদিন ঠিক ফিরে আসবে। সুমন যে আমাকে কথা দিয়েছিল যে আমরা একসাথে সংসার করবো। সাব তুমিই বলো, ওর কথা কি তবে মিথ্যে হবে? কিন্তু ও তো কোনোদিন মিথ্যে বলেনি।"


রণদীপ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলবে ভেবে পেলোনা। যে অবাস্তব বিশ্বাস নিয়ে ও আজও তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেই বিশ্বাস ভেঙে দিতে তার মন চাইলো না। কারণ ওই একই বিশ্বাসে ভর করে রণদীপ নিজেও কি কারো আসার অপেক্ষায় দিন গুনছে না? তাহলে কি সান্ত্বনা রণদীপ তাকে দেবে? তারা দুজনে যে একই পথের যাত্রী। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের কপালে দুঃখ ছাড়া বুঝি আর কিছুই জোটে না।


রণদীপ নীরবে কাঞ্চনসুন্দরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তার দুই গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। সে রণদীপের দিকে ঘনিষ্ট হয়ে এসে ভেজা গলায় বললো,

"সাব, আমাকে একবার রাথং যাবার ওই রাস্তায় নিয়ে যাবে? আমায় কেউ নিয়ে যায় না। তুমি নিয়ে চলো না। একবার খুঁজে দেখি তাকে পাই কিনা।"


রণদীপ এখন কথা হারিয়ে ফেলেছে। নিশুতি রাতে ও দূরের পাহাড়গুলোর দিকে চাইলো। জ্যোৎস্নায় স্নান করে সে এখন মোহময়ী হয়ে উঠেছে।রহস্যময়ীর ওই রূপের ছলনায় মোহিত হয়ে কত মুনিয়ার কত সুমন যে চিরতরে হারিয়ে গেছে কে বলতে পারে! সুমন এখন বরফের চাদরের নীচে চিরশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে, যে ঘুম তার আর কোনোদিনই ভাঙবে না। তবু কাঞ্চনসুন্দরী আজও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। 


হঠাৎই দূরের ওই অপূর্ব তুষারশৃঙ্গ, কাছের ওই কালো পাহাড়, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত এই উপত্যকা রণদীপের কাছে নিরস মনে হলো। কাঞ্চনসুন্দরীর উষ্ণ স্পর্শে সে কোনো স্পন্দন খুঁজে পেলো না। ওর প্রাণটা তার পরিচিত শহরে ফিরে যাবার জন্য হাহাকার করে উঠলো। সেই শহর, যেখানে সে তার সুপর্ণাকে হারিয়েছে। 


কাঞ্চনসুন্দরীর পিঠে হাত রেখে সে বললো,

"মুনিয়া, ঘরে চলো।"

"বলো সাব, আমাকে নিয়ে যাবে?"

"মুনিয়া, কাল আমায় ফিরতে হবে। পরের বার যখন আসবো তখন নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো।"

"কাল তুমি চলে যাবে?"

"যেতে তো একদিন হবেই মুনিয়া।"


কাঞ্চনসুন্দরী রণদীপের হাতটা ধরে বললো,

"না সাব, তুমি যেওনা। বলো সাব তুমি আমাকে রাথং গ্লেসিয়ারে নিয়ে যাবে।"


রণদীপ কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু তার মন আজ আর কোনো বাধাই মানতে চাইলো না। মনের তাগিদেই একদিন সে বিবাগী হয়েছিল, আর এবার সেই মনের টানেই সে ঘরে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠলো।


যাবার দিন কাঞ্চনসুন্দরীর কাছে বিদায় নেওয়ার মত মনের বল পেলো না রণদীপ। তাই সে ভোর হতেই জীপে উঠে বসলো। নেপালী ছেলেটা রুম থেকে ওর এ্যাটাচি কেসটা আনতে গেল। রণদীপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। গেজিং থেকে বাস ছাড়বে সকাল ৭ টায়। জীপ থেকে মুখ বার করে দীপক নামতে যাচ্ছিল, এমন সময় হাত বাড়িয়ে কাঞ্চনসুন্দরী এ্যাটাচি কেসটা রণদীপের কোলে তুলে দিলো। তারপর পরিচিত সেই ঝগড়াটে গলায় বললো,

"কি সাব, শেষে পালিয়ে যাচ্ছ?"


রণদীপ অবাক হয়ে ওকে দেখলো। ওর প্রথম দিনের সেই কথাটা মনে পড়ে গেলো। রণদীপ ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

"কি করবো? যদি মেয়ে দেখে কমজোরী হয়ে যাই? তাই পালিয়েই যাচ্ছি।"


দুজনেই হেসে ফেললো। দীপক ওর অনুমতি নিয়ে জীপে স্টার্ট দিলো। কাঞ্চনসুন্দরী রণদীপের হাত ছুঁয়ে বললো,

"সাব, আবার আসবে তো?"

"নিশ্চয়ই আসবো।"


জীপ চলতে শুরু করলো। পাহাড়ে তখন সবে রং ধরতে শুরু করেছে। কাঞ্চনসুন্দরী তখনও তাদের যাত্রাপথের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে। রাথংয়ের পথে যাত্রাসঙ্গী হিসেবে সে রণদীপকে নিতে চেয়েছিলো। চলমান জীপের দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই যাত্রা হয়তো তার কাছে স্বপ্নই থেকে গেল।


Rate this content
Log in

More bengali story from Aniruddha Basu

Similar bengali story from Romance