Sanghamitra Roychowdhury

Romance Inspirational

3.1  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Inspirational

হোক প্রায়শ্চিত্ত

হোক প্রায়শ্চিত্ত

6 mins
988


 একুশ বছরের জাহ্নবী, ভর্তি হয়েছে কলকাতার নামী একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তাদের বাঁকুড়ার বাড়ীতে ছোট্ট নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। মা, বাবা, বৃদ্ধা ঠাকুমা, ছোট দুই ভাই বোন। বাবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকুরে, বীরভূমে পোস্টিং। ওদের তিন ভাইবোনের লেখাপড়ার জন্য ওরা বাঁকুড়ার বাড়ীতেই থাকে। বাবা সপ্তাহান্তে বীরভূম থেকে বাঁকুড়ার বাড়ীতে চলে আসে। কাজেই বাড়ীর সব দায়িত্ব মা'কে একলাই সামলাতে হয়। তাও মা তাকে কাছছাড়া করতেই চায় নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েই বাবার অকাট্য যুক্তি মেনে নিয়েছে।


গত তিনবছর আগে একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো জাহ্নবী। বন্ধুরা তুলে কোনোরকমে ধরে ধরে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়েছিলো। জাহ্নবী বাড়ীতে এসে চুপচাপ শুয়েই ছিলো। কিন্তু তখনও ওর সারা শরীর পাকিয়ে উঠে দুলছে। খাট, বিছানা, ঘরবাড়ী সব চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। জাহ্নবীর মনে হোলো একটু বমি করতে পারলে শরীরের অস্বস্তিটা কমতে পারে। কলেজ থেকে বেরিয়ে অতগুলো ফুচকা খাওয়ার জন্যই সাথে সাথে চাপা অম্বল হয়ে গেছে। তবে বমি করার পরেও শরীরের অস্বস্তি আর মাথা ঘোরা কমলো না। সবে মঙ্গলবার, বাবার ফিরতে শনিবার। এতোদিন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। মা ফোন করে জানালো জাহ্নবীর বাবাকে। বড়োমেয়ে জাহ্নবী বাবার বড্ড আদুরে। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই, ছুটি ম্যানেজ করে বাবা বাঁকুড়ায় ফিরে এলো। বাবা এসে পৌঁছনোর আগেই মা জাহ্নবীকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে।



ডাক্তারবাবু চিন্তিত মুখে জানিয়েছে নার্সিংহোমে ভর্তি করার কথা। জাহ্নবীর মায়ের মনটা বড়ো কুডাক দিয়ে উঠলো। বেশীরকম খারাপ কিছু নয় তো? বাড়ীতে বৃদ্ধা ঠাকুমার কাছে দুই ভাইবোনকে রেখে মা বসে রয়েছে নার্সিংহোমে জাহ্নবীর কাছে। অনেক রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। সকালেই সব রিপোর্ট পেয়ে যাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবুর মুখটাও ভাবলেশহীন, বুঝতে পারছে না জাহ্নবীর মা ঠিক, মেয়ের অসুস্থতাটা কতটা গভীর। বাবা ফিরে সোজা নার্সিংহোমেই এসেছে। দু'জনেই একসাথে গিয়ে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলেছে। ডাক্তারবাবু ওদের বাড়ী ফিরে যেতে বলেছে। কোনো প্রয়োজন হলে বাড়ীতে ফোন করে খবর দেওয়া হবে। রাতটুকু অপেক্ষা করতে হবে, সব রিপোর্টগুলো আসুক।



অপেক্ষার রাত বড়ো দীর্ঘ হয়। ভোর না হতেই জাহ্নবীর বাবা মা নার্সিংহোমে এসে হাজির। সকাল নটার সময় ডাক্তারবাবু দেখা করবে। জাহ্নবীর বাবা মায়ের বুকের ভেতরে একটা হাপর চলছে যেন। কী শোনাবে ডাক্তারবাবু। ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর ছোঁয়ার আগেই জাহ্নবীর বাবা মা ডাক্তারবাবুর চেম্বারের দরজায়। ভেতরে যাওয়ার ডাক পড়লো। বসতে বলে ডাক্তারবাবু নিজের দু'হাত টেবিলে রেখে সোজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের দিকে। তারপর কেটে কেটে ধীরেধীরে বললো, "ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। জাহ্নবী প্রেগন্যান্ট।" মুহূর্তে জাহ্নবীর মায়ের দুনিয়া থেকে যেন সব অালো মুছে গেলো। থরথর করে কাঁপছে জাহ্নবীর মা। বাবা নির্বাক। মেয়েটার সুন্দর জীবনটা কী একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে? জাহ্নবীর মা আন্দাজ করতে পেরেছে, কী ভাবে কার সাথে ঘটে থাকতে পারে দুর্ঘটনাট। কিন্তু এখন উপায় নেই মুখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া, মেয়ের নিরাপত্তার প্রশ্নে। বিপদসীমা অতিক্রান্ত। এখন উপায়?




এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল চেষ্টা। কঠোর হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে মরিয়া জাহ্নবীর বাবা মা গিয়ে হাত পেতে দাঁড়াতে বাধ্য হোলো প্রতিবেশী পরিবারের কাছে। প্রতিবেশী ছেলে বিতনু আর জাহ্নবীর থেকে কয়েক বছরের বড়ো। তবে ছোট্ট থেকেই একসাথে বড়ো হয়েছে, পাশাপাশি, হেসে খেলে। মেয়ের বাবা-মা হয়ে বাধ্য হোলো সর্বনাশা পরিস্থিতি থেকে মেয়েকে বাঁচাতে। নিজেদের মান সম্ভ্রম বাঁচাতে। ভুল তো দু'জনেই করেছে। তবু দোষী সাব্যস্ত হোলো কেবল জাহ্নবী। থানা পুলিশ লোক জানাজানি এসবের ভয়ে গুটিয়ে আছে জাহ্নবীর বাবা মা। ছুটি নিয়ে বাঁকুড়ার বাড়ীতে জাহ্নবীর বাবা। বিতনুকে কোথাও পাঠিয়ে দিলো ওর বাড়ী থেকে অনেক দূরে। জাহ্নবী এই ধাক্কাটায় বড়ো বেশীরকম রিয়্যাক্ট করলো। দু-এক দিন গুম মেরে থাকার পরে একদিন রাতে জাহ্নবী নিজেদের বাড়ীর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লো। নীচে সার সার রাখা ক্যাকটাসের টবের ওপরে। জাহ্নবীর বড়ো প্রিয় ক্যাকটাসগুলো, দূর দূরান্ত থেকে সংগ্রহ করেছে। সেই ক্যাকটাসের কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত জাহ্নবীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হোলো।

তারপর হাসপাতাল থেকে শিফ্ট করিয়ে প্রাইভেট নার্সিংহোমে। জাহ্নবীদের পরিবারটা বাস্তবিক বড়ো এলোমেলো ছন্নছাড়া হয়ে পড়লো। জাহ্নবীর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার ফলে জাহ্নবীর অবাঞ্ছিত গর্ভ ও অবাঞ্ছিত সন্তানের দায় আর কাউকে নিতে হয় নি। এই স্বার্থপর লোভী দুনিয়ার আলো আর তাকে দেখতে হয় নি। জাহ্নবীর গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিলো। দীর্ঘ চিকিৎসা, নার্সিংহোমে রেখেই করিয়েছে জাহ্নবীর বাবা মা। ধীরেধীরে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও, মনটা আর সুস্থ হয় নি জাহ্নবীর।



জাহ্নবীর বাবা অনেক ধরাকরা করেও বাঁকুড়ায় পোস্টিং পায় নি। প্রচুর ছুটি নিতে হয়, রিটায়ার করার আর অল্পই কয়েকমাস বাকী। জাহ্নবীর একটা ছোট্ট ভুল, একটু অসতর্কতা, জাহ্নবীদের পরিবারটাকে তছনছ করে দিয়েছে। জাহ্নবীর পুরো পরিবার একটা বড়সড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে। তবে জাহ্নবীর আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েই গেছে। কয়েকদিন আগেই জাহ্নবী বাবার দাড়ি কামানোর ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলে। প্রাণে বেঁচে গেছে এবারেও। তবুও জাহ্নবীর বাবা আর অযথা ঝুঁকি নিতে চায় নি। তাই জাহ্নবীকে ভর্তি করা হয়েছে কলকাতার এই বেসরকারি হাসপাতালে, এটি একটি মানসিক হাসপাতাল।



জাহ্নবী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাবার্তা বলে না। মা'কে ছাড়া কাউকে ওর আর মনে নেই। নার্সদের কাছে মাঝে মাঝে মায়ের খোঁজ করে। বিকেলে হাসপাতালের বাগানে হাঁটতে নিয়ে যায় জাহ্নবীকে। কিন্তু ওর বেডের বাইরে আর কোথাও বোধহয় ওর ভালো লাগে না। এদিকে জাহ্নবীকে না হাঁটালে নতুন ডাক্তারবাবু খুব বকাবকি করে। কিন্তু জাহ্নবী শক্ত করে ধরে বসে থাকে বিছানাটা। অনেকদিন মা'কে দেখে নি জাহ্নবী, চোখদুটো জলে ভরে আছে। নতুন ডাক্তারবাবু খবর পাঠিয়েছে বাড়ীতে, দেখা করার জন্য। খবর পেয়ে সেদিনই জাহ্নবীর মা এসেছে মেয়েকে দেখতে। বাড়ীতে জাহ্নবীর মায়ের মনটাও হুহু করে সর্বক্ষণ মেয়ের জন্য। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো!



মা'কে জড়িয়ে ধরে বসে রয়েছে জাহ্নবী। চোখদুটো বন্ধ। মা একটু সন্দেশ এনেছে, খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জাহ্নবীর কোনো তাপ উত্তাপ নেই, যন্ত্রের মতো খেয়ে নিচ্ছে। অথচ আগে হলে কতকিছু বলতো, এটা যে ওর খুব প্রিয় সন্দেশ। মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জাহ্নবীর মায়ের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নতুন ডাক্তারবাবু এসে কখন যে পিছনে দাঁড়িয়েছে, বিন্দুমাত্রও বুঝতে পারে নি। সম্বিত ফিরলো ডাক্তারবাবুর গলার স্বরে। "কাকিমা, আমি কী প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ পেতে পারি না?" ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে চেয়ে আছে জাহ্নবীর মা, বিতনু সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের পাশের বাড়ীর বিতনু, জাহ্নবীর শৈশবের খেলার সাথী। পরনের অ্যাপ্রন আর গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ দেখে মনে পড়লো জাহ্নবীর মায়ের, সত্যিই তো, বিতনু তো বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজেই পড়তো। এতোদিন মনেই পড়ে নি একবারও। পড়া দেখিয়ে দিতো রোজ জাহ্নবীকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সময়। তারপর জাহ্নবী কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ছিলো। তখন বোধহয় বিতনু ফাইনাল ইয়ারের শেষে একদম। জাহ্নবীর মায়ের দু'চোখের কোল বেয়ে গড়ানো জল আজ বিতনু মুছে দিতে দিতে বললো, "ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই কাকিমা, শুধু একটা সুযোগ দাও আমাকে।"



জাহ্নবীর মায়ের মুখে কথা নেই, মাঝের সময়টাকে ভুলতে চাইলেই তো আর ভোলা যায় না। তবুও আরেকবার চেষ্টা করা যাক একটা নতুন শুরুর। জাহ্নবী তখন মায়ের কোলে মাথা রেখে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে, এখনো জাহ্নবী বোঝার ক্ষমতা ফিরে পায় নি যে ওর হারানো প্রেম আবার একবার ফিরে এসেছে। সেই সম্পর্কের অবশ্যই একটা সুযোগ পাওয়া উচিৎ। কে বলতে পারে যে বিচ্ছেদে হারিয়ে ফুরিয়ে যেতে বসেছে জাহ্নবী, সেই বিচ্ছেদ আবার পুনর্মিলন হয়ে জাহ্নবীকে জীবনের ছন্দে ফিরিয়েও আনতে পারে।



বিতনুর ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে আছে জাহ্নবী, আর বিতনু চায়ে চিনি মেশাচ্ছে। জাহ্নবী জানতে চাইলো, "তুমি তো ডাক্তার, তুমি বিতনুকে চেনো? খুব কষ্ট দিয়েছে আমাকে। ওকে একটু শাস্তি দিও তো!" বিতনু মাথা নেড়ে বললো, "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তুমি বিতনুর কাছে যেতে চাও?" একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জাহ্নবী বললো, "না না, বিতনুকে শাস্তি দিতে চাই। আমি তো তোমার কাছেই থাকবো। তুমি খুব ভালো, আমার সব কথা শোনো। বিতনুর মতো বাজে নও তুমি।" বিতনুর এটাই চরম প্রায়শ্চিত্ত! তার জাহ্নবীকে দুঃখ কষ্ট দেওয়া, কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার ফল!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance