বিল্বপত্রাঞ্জলি
বিল্বপত্রাঞ্জলি
"শিশু-চিতা বড্ড খেলতে ভালোবাসে, মা-চিতা জানে সেটা খুব ভালো করে। তাই বাচ্চাদের সাথে দস্তুরমতো ছোটাছুটি করে খেলা করে..." এইপর্যন্ত এসে শৈবলিনী থেমে যায়, কারণ আজ গল্প শেষের আগেই মেয়ের ভাত শেষ। ভাতের শেষ গরাসটা দলা পাকিয়ে থালার কানায় হাত চাঁছপোঁছ করে কাঁচিয়ে নিয়ে মেয়ের হাঁ-মুখে গুঁজে দেয় শৈবলিনী। মেয়ের গালে মৃদু টোকা দিয়ে শৈবলিনী আবার শুরু করে, "আর এদিকে বাবা-চিতা তো রেগে অস্থির। সকাল থেকে শুধু শুধু খেলে বেড়ালে হবে? খেলে বেড়ালে কি পেটটা ভরবে? রোদ চড়ে যাচ্ছে, সারাদিনের খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করা নেই? শিকার করা নেই? বাচ্চারা মানে শিশু-চিতারা খাবে কি? বড্ড ছোট তারা, মা এনে দিলে তবে খায়...", মা'কে থামিয়ে দিয়ে বিলু মানে শৈবলিনীর চার বছরের মেয়ে বলে ওঠে, "থিক আমাল মতো? মা থাইয়ে দিলে তবে থায়?" শৈবলিনী মেয়েকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় আসনের ওপরে, আর ডান হাতে এঁটো থালাটা তুলে বাঁ-হাতে মেয়ের নাকটা নেড়ে দিয়ে হাসিমুখে আধো আধো বোলে মেয়েকে আদরে অবগাহন করিয়ে বলে, "হ্যাঁত্তো, এদ্দম আমাল বিলুর মতো!" বিলুও মায়ের কথায় ঘাড় দুলিয়ে হাসে।
বনেদি যৌথ পরিবারের মেজো বউ শৈবলিনী। যদিও এনামে তাকে কেউ আর ডাকে না। পরিবারের সকলের কাছে সে মেজো বউ, মেজো বৌদি, মেজো গিন্নী, মেজো কাকি, মেজো জ্যেঠি ইত্যাদি সম্পর্ক অনুসারে। আর তার স্বামী তাকে একান্তে শৈব বলেই ডাকে। তার স্বামী মিহির পরিবারের মেজো ছেলে। সব ব্যাপারেই তার মতামত গৌণ, কেবলমাত্র তার সরকারি চাকরির সুবাদে এবং তার শ্বশুরবাড়ির সম্পন্ন অবস্থার দৌলতে, তার ভাগের দায়-দায়িত্ব পালনটাই মুখ্য। তবে তাতে করে শৈবলিনী বা মিহিরের তেমন কোনো আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র যৌথ পরিবারের ছোট বা বড় যে কেউই হোক না কেন, যদি একবারও উচ্চারণ করে, "বিইয়েছে তো ঐ এক মেয়ে ছা, তার আবার এতো গরব...", তখনই শৈবলিনী ফেটে পড়ে। বিয়ের দশ বছর পরে মা হওয়া শৈবলিনী তখনই রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে, বিরক্তিতে সত্যিকারের মা-চিতা হয়ে ওঠে। তার শিশুকন্যা বিলু তার কাছে কেবলই সন্তান, তার লিঙ্গভেদে ভয়ানক আপত্তি শৈবলিনীর। অবশ্য শৈবলিনীর নির্বিবাদী স্বামী মিহির রাতে দরজার খিল দিতে দিতে হাসিমুখে বলে, "রাগ করো কেন শৈব? লোকের কথায় কান দিও না। পাঁচজনের পাঁচকথা বলা স্বভাব। তারা তো বলবেই, তাদের মুখ কি তুমি বন্ধ করতে পারবে? আমি তো তোমাকে কখনো কিছু বলিনি। বিলু আমাদের সন্তান, একমাত্র সন্তান। বিলুই আমাদের সব। আমাদের যাকিছু আছে, সবই তো বিলুর জন্যই!" শৈবলিনী ঠোঁটে আঙুল রেখে স্বামীকে কথা বন্ধ করে চুপ করে ইশারা করে, অর্থাৎ বিলু তখনও ঘুমোয়নি। মিহির বিরাট লম্বা-চওড়া খাটের একপাশে শৈবলিনীর গা ঘেঁষে বসে। তারপর প্রায় শৈবলিনীর কানে মুখ ঠেকিয়ে বলে, "শৈব, আজ একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স করিয়ে দিলাম, বুঝলে? আমার অবর্তমানে যাতে তোমার আর আমার বিলুর কোনো অসুবিধা না হয়।" তড়াক করে উঠে বসে শৈবলিনী স্বামীর মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরা ধরা কাঁপা গলায় বলে, "একদম আজেবাজে কথা বলবে না।" মিহির স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে ধরতেই বিলু লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, "মা, তুমি বাবাতে বালোবাতবে না। থালি থালি আমাতে বালোবাতবে।" মিহির আর শৈবলিনী সশব্দে হেসে উঠে দুজনেই হাত বাড়িয়ে তাদের চার বছরের একমাত্র কন্যাসন্তানটিকে হৃদয়ের সমস্ত স্বত্বা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। কী অপরূপ পরিবারের ছবি!
এভাবেই হেসে খেলে চলছিলো বৃহত্তর যৌথ পরিবারের দু'মহলা বাড়ির এককোণে মিহির আর শৈবলিনীর একখণ্ড ছোট্ট সংসার। বিলুর বয়স এখন চার থেকে চোদ্দো। লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো। খুব সুন্দর তার গানের গলা। আর বছর কয়েক বাদে মিহির চাকরি থেকে অবসর নেবে। শৈবলিনীর বাবা-মা গত হবার আগে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বিলুর নামে দানপত্র করে গেছেন। মিহির বা শৈবলিনী অবশ্য এসব কথা বিলুকে জানায়নি, কারণ এসব বৈষয়িক ব্যাপার বোঝার ক্ষেত্রে বিলু এখনও যথেষ্ট ছোট। আর কেমন যেন শৈবলিনীর মনে হয় যে মেয়ে বোধহয় জাগতিক বিষয়-আষয় ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুটা উদাসীনও বটে। বিলু মানে বিল্বপত্রাঞ্জলি মাধ্যমিক দেবে সামনের বছরে। বন্ধুরা ভারি ক্ষেপায় তাকে অতবড়ো একটা নাম বলে। বিলু মিষ্টি করে হাসে কখনো, আবার কখনো চুপচাপ থাকে, কোনো উত্তর দেয় না। বেশিক্ষণ ধরে উত্ত্যক্ত করলে বন্ধুদের থামাতে বিলু বলে, "মা সরস্বতী পূজার মন্ত্র পড়তে পড়তে আমার নাম রেখেছে। শুনিসনি সরস্বতী মন্ত্র?" বিলুর বন্ধুরা থেমে যায় বিলুর কথায়। মুখ টিপে হাসাহাসি করে বিলুর আড়ালে। বিলু এমনই। কোনো কথাই যেন মেয়েটা গায়ে মাখতে শেখেনি। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলো। বিলু নিজের স্কুলে তো বটেই, জেলাতেও একেবারে ফার্স্ট, এমনকি রাজ্যভিত্তিক তালিকাতেও কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রথম কুড়িজনের মধ্যেই বিলুর নাম। যারা এতদিন আড়ালে-আবডালে বিলুকে দুঃ-ছিঃ করেছে, তাদের মুখে কালির পোঁচ ঢালা, নিন্দুকের মুখে তালাচাবি। শৈবলিনীর অনেক স্বপ্ন ছিলো মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে, তবে এতোটাও ভাবেনি হয়তো। মেয়ের সাফল্যে মিহির মুচকি মুচকি হেসে বলে, "শৈব, তোমার প্রার্থণা মা সরস্বতী নিজকানে শুনেছেন।" শৈবলিনী গলবস্ত্র হয়ে ঠাকুরঘরে পেতলের সরস্বতী মূর্তির সামনে ধূপ-ধুনো ঘুরিয়ে প্রণাম করে। বিল্বপত্রাঞ্জলি ক'দিন পরেই কলকাতায় পড়তে চলে যাবে।
বিলুর কলকাতায় পড়তে যাবার দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। শৈবলিনীর ব্যস্ততার সীমা পরিসীমা নেই। সব গোছগাছ সারে আর মা সরস্বতীকে স্মরণ করে একমনে, "বিলু আমার অনেক বড় মানুষ হয় যেন মা। অনেক নাম হয় যেন!" "কইগো, হলো? বিলুর জন্য নতুন দু'সেট সালোয়ার আর একজোড়া নতুন জুতো নিয়ে আসি চলো। শহরে গিয়ে আমার মেয়ের যেন মাথা হেঁট না হয় সঙ্কোচে... গাঁইয়া ভূত বলে...", মিহিরের হাসি মাখামাখি গলার স্বরে শৈবলিনীর সম্বিত ফেরে। কপালে দু'হাত ঠেকিয়ে সরস্বতীর উদ্দেশ্যে চট করে প্রণাম সারে শৈবলিনী, "বিলু আমাদের তেমন মেয়েই নয় যে পাঁচজনের কথা গায়ে মাখবে!" খুব সত্যি কথাই বলেছে শৈবলিনী, তবুও হাসিমুখেই বলে মিহির, "দুষ্ট লোকের অভাব নেই দেশে, মেয়ের কান ভাঙাতে কতক্ষণ?" দু'জনের কথোপকথন আর এগোতে পারে না। বিলু হাজির, "বাবা, আমাকে কিছু বাড়তি খাতা কিনে দাও বরং। হঠাৎ ফুরোলে আমার অসুবিধা হবে। আমি তো পড়তে যাচ্ছি বাবা, বেড়াতে যাচ্ছি না।" মিহির আর শৈবলিনী মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো... অর্থাৎ বিলু তাদের কথোপকথন পুরোটাই শুনেছে। শৈবলিনীর বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো, "আজকালকার দিনে এমন মেয়ে ক'জন বাপ-মায়ের ভাগ্যে জন্মায়?"
বিলু কলকাতায় চলে গেছে দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে আরও কয়েকমাস। সামনেই তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। একেবারে যেন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। বিলু ভয়ানক ব্যস্ত এখন পড়াশোনা নিয়ে। বাড়িতে আসবে না সামনের ছুটিতে। বাবা মা'কে জানিয়ে দিয়েছে। অঙ্কে ডুবেছিলো বিলু। রাত প্রায় দশটা বাজে। দপ্তরী দিদিকে দিয়ে হস্টেল সুপার ম্যাডাম ডেকে পাঠালেন বিলুকে। বিলু অবাক হলো, এত রাতে ম্যাডাম ডাকছেন কেন? বই-খাতা বন্ধ করে বিলু দপ্তরী দিদির পেছন পেছন এসে সুপার ম্যাডামের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। ম্যাডাম দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে ছোড়দা... মানে বিলুর জ্যেঠুর ছেলে আর মালতী মাসী... বিলুর মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিলু ওদের দেখে অবাক। সুপার ম্যাডাম বিলুর পিঠে হাত রাখলেন, "বিল্বপত্রাঞ্জলি, তোমাকে এখনই বাড়িতে যেতে হবে। তৈরি হয়ে না
ও।" বিলু বুঝেছিলো গুরুতর কিছু ঘটনা ঘটে গেছে... ছোড়দা আর মালতী মাসীর থমথমে মুখ দেখেই। এবারে বুঝতে চাইলো কী ঘটেছে? বড় বড় দুই চোখ মেলে তাকালো সুপার ম্যাডামের মুখের দিকে। ম্যাডাম হিমশীতল কন্ঠে বললেন, "তোমার বাবা আর নেই। আর দেরি কোরো না।" বিলুর পায়ের তলায় প্রবল ভূমিকম্প। মাথাটা একমুহুর্তের জন্য টলে গেলো। তারপর পায়ে চটিটা গলিয়ে আর একটা চাদর গায়ে দিয়ে কেমন একটা উদভ্রান্তের মতো অসহায় দৃষ্টি ফেলে সোজা হস্টেল গেটের দিকে পা বাড়ালো।
বাবার পারলৌকিক কাজকর্ম মিটতে মিটতে প্রায় দিন পনেরো। বিলু নির্বাক হয়ে গেছে। মায়ের সাথে দুই-একটি কাজের কথার বাইরে আর কোনো কথা হয়নি। বাকিদের সঙ্গে তো চিরকালই বিলুর দূরত্ব... তেমন কথাবার্তা আন্তরিকতা নেই। বিলুর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক চার মাস আগে বিলুর পিতৃবিয়োগ একটা দুরূহ ঘটনা নিঃসন্দেহে, তবুও বিলু এও জানে যে আপাতত ভালো রেজাল্ট করা বড় দরকারি... যত দুরূহই হোক না কেন! বিলু ফিরে চললো হস্টেলে। পরীক্ষা দিতে হবে। ভালোভাবে পাশ করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে। বিলু আবার ডুবলো তার বই-খাতার পাতায় পাতায়। পরীক্ষা হয়ে গেলো। বিলু যথারীতি ভালো রেজাল্ট করলো, তবে বিলুর নিজের মনের মতো নয়। শৈবলিনী ততদিনে সামলে উঠেছে স্বামীর শোক। বিলুর সঙ্গে বৈষয়িক আলোচনায় বসলো শৈবলিনী, "বিলু মা, আমি জানি তুমি আরও লেখাপড়া করতে চাও। তবে আমি বলি কি লেখাপড়া মন চাইলে তুমি পরেও করতে পারো, আপাতত বাবার চাকরিটা নাও। চাকরি থাকতে থাকতেই তোমার বাবা চলে গেছেন, তাই সরকারি নিয়মে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক একজন সদস্যের এই চাকরিটা প্রাপ্য। তুমি আঠেরো পার করলে, এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছো, সুতরাং আমি চাই তুমি এবার বাবার চাকরিটা নাও। আমি অফিসে সব যোগাযোগ করে কথাবার্তা বলেছি। তুমি আরও পড়াশোনা করতে চাইলে ওনারা তোমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন।" সুতরাং বিলুর আর প্রথাগতভাবে ডিগ্রি কলেজে গিয়ে পড়া হলো না। বিলু চাকরিতে জয়েন করলো। বাবার চাকরি। মেয়ে এবং বয়সে সদ্যতরুণী বলে বাবার অফিসেই চাকরির প্রথম পোস্টিং পেলো বিলু। এমনকি তার বসার ব্যবস্থাও হলো বাবার টেবিলেই। অফিসের ছোট থেকে বড় সবার প্রিয়পাত্র ছিলো বিলুর বাবা মিহির। কাজেই বিলুও হাবেভাবে স্বভাবে সকলের মন জয় করে নিলো। দেখতে দেখতে একমাস পার হলো অফিসে। কিছু কিছু কাজ শিখেছে বিলু। বাবার টেবিলে বসে কাজ করতে করতে বিলু টেবিলের ড্রয়ার খোলে। কত পেন! সব বিলুর পুরনো পেন। বিলুকে নতুন পেন কিনে দিয়ে বাবা নিজে তার মানে এই পুরনো পেনগুলোই ব্যবহার করতো। বিলুর বুকটা টনটন করে উঠলো বাবার জন্য। সেদিন অফিসে বিলু টিফিনের সময় বাবার আলমারি খুললো। কত সব ফাইল। সবই অফিসের। বিলুর বাবা খুব পরিপাটি গোছানো স্বভাবের মানুষ ছিলো। আলমারির ভেতরে ছোট লকারেও কয়েকটা ফাইল। তবে একটা ফাইল অন্যরকম দেখতে। টকটকে লাল ভেলভেটের। অফিসের অন্য ফাইলগুলোর মতো ম্যাটমেটে রঙের নয়। কৌতূহল হলো খুলে দেখার। ফাইলের ফাঁস বাঁধা ফিতেটা টেনে খুললো বিলু। ওপরেই একটা বিলুর ছোটবেলার ফটো। অনেক কাগজ। অনেক ভাঁজ করা, কিছু আবার খোলা। আরো অনেক ছবি। সব বিলুর। একটা একটা করে দেখতে লাগলো বিলু। হঠাৎ বিলুর মাথাটা টাল খেয়ে গেলো, চোখ অন্ধকার। পায়ের তলায় ভূমিকম্প। বাবার জন্য!
******
শৈবলিনী অনেকক্ষণ ধরে ভিজিটিং রুমে বসে আছে। বিলুর সাথে একবার মাত্র দেখা করবে। একবার মেয়ের মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইবে বিলুর এমন এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের রহস্য কী? কেন বিলু সব ছেড়ে, চাকরি ছেড়ে, ঘর-বাড়ি ছেড়ে, মা'কে ছেড়ে এমন সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিলো? এক একটা মিনিট যেন এক একটা যুগ। শৈবলিনী ঘুরে তাকালো পেছনে পায়ের শব্দে। বিলু... বিলু এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের সামনে। সাদা কাপড়ে মোড়া তরুণীদেহ, মাথায় সাদা কাপড়ের চাদর ঘুরিয়ে ঢাকা দেওয়া ঘোমটার মতো করে। শৈবলিনী হতবাক। উঠে দাঁড়ালো। বিলু মৃদু গলায় ধীরেধীরে বলে, "কী জানতে চাও?" শৈবলিনীর ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছে শুধু। কথা আওয়াজ হয়ে ফুটলো না। বিলু ঠিক তেমন ধীরেধীরেই বলে, "বাবার দোষ কী ছিলো? এতোবড় শাস্তি সহ্য করে গেলো সারাটা জীবন? কাউকে কিচ্ছু বুঝতে না দিয়ে? আমার বাবা হবার যোগ্যতা একমাত্র বাবারই ছিলো... বিল্বপত্রাঞ্জলি নামের ভার তাই আমি আর বহন করতে চাইনি। তুমি ফিরে যাও। আর কখনো আসবে না। এটা নিয়ে যাও।" হাত বাড়িয়ে একটা কাগজের খাম শৈবলিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিলু আর একমুহূর্তও দাঁড়ায় না। শৈবলিনী শুধু পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিলুর... মানে সিস্টার মিহিরকন্যার চলে যাওয়া দেখে। এই সঙ্ঘে বিলুর সন্ন্যাসিনী জীবনের আশ্রমিক নাম সিস্টার মিহিরকন্যা। শৈবলিনীকে এবার ফিরতে হবে।
পদ্মপাতার উপর জল যেমন অস্থির শৈবলিনীর শরীরের ভেতর মন আজ তেমন চঞ্চল। তার আত্মা আজ যখন পরমাত্মার খোঁজে চেতনে-অবচেতনে তার নিজেরই মুখোমুখি হয়েছে তখন সে কেনইবা প্রতিপক্ষের মতো প্রশ্ন করবে না? অনুশোচনার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে না? অথবা জীবন সায়াহ্নে বিগত সময়ের হিসেব-নিকেশের মুখোমুখি দাঁড় করাবে না? শৈবলিনীর বিছানার ওপরে ইতস্ততঃ ছড়ানো কয়েক টুকরো কাগজ... তার বিপথগামিতা ও মিথ্যাচারের দলিল হয়ে। শুধুমাত্র শৈবলিনী নিজে জানতো না যে সে সেই প্রথমদিনেই মিহিরের কাছে ধরা পড়ে গেছে। মিহিরের বাবা হবার ক্ষমতা ছিলো না। জানতো না শৈবলিনী। কিন্তু কেন জানে না সে শুধুমাত্র সরল সাদামাটা লোকটির সন্তানের জননী হতে মন চায়নি বলেই দিনের পর দিন গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়েছে, নানা পন্থায় মা হওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এদিকে মিহির যে ডাক্তারের কথা শুনে কখন নিজের পরীক্ষা করিয়েছে, সেটা জানতে পারেনি শৈবলিনী। বড়লোক বাবা শৈবলিনীর বিয়ে তার গরীব মেধাবী প্রেমিকের সঙ্গে দেননি। উল্টে স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই শৈবলিনীর লেখাপড়া ছাড়িয়ে সরকারি চাকুরে ভালোমানুষ মিহিরের সঙ্গে সাত-তাড়াতাড়ি শৈবলিনীর বিয়ে দিয়ে দেন। সরল মানুষটি শৈব বলতে অজ্ঞান! আর শৈবলিনী কপটতা আশ্রয় করে বিল্বমঙ্গলের অপেক্ষা করেছে। একটি দিন, একটি মিলন, হিসেব-নিকেশ সেদিনও করেছিলো শৈবলিনী। বিয়েতে বাবার দেওয়া পনেরো ভরির সাতনরি হারটা আর জড়োয়ার সেটটা দিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলো গরীব অথচ উচ্চাশায় পরিপূর্ণ বিল্বমঙ্গলকে। সঙ্গে আর কখনো দেশে না ফেরার প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছিলো বিল্বমঙ্গলের থেকে। বিল্বমঙ্গলের সঙ্গে একদিন আচমকা দেখা হয়েছিলো শৈবলিনীর বিয়ের পরে পরেই। মিহিরকে লক্ষ্য না করেই বিল্বমঙ্গল ডেকেছিলো শৈবলিনীকে, "লীনা?" বাধ্য হয়েছিলো শৈবলিনী মিহিরের সঙ্গে তার পরিচয় করাতে, "স্কুলের সহপাঠী... আসলে নামটা বড় বলে বন্ধুরা লীনা বলতো।" ব্যাস, ঐটুকুই। কথা আর এগোয়নি। তবুও শেষপর্যন্ত শৈবলিনী ঐটুকু সূত্র থেকেই ধরা পড়ে গেলো। আজ ভাবতে বসেছে শৈবলিনী, "আচ্ছা, বিলুর নাম অন্যকিছু রাখলেও কি ধরা পড়তুম... মেয়ের কাছে বা মিহিরের কাছে?" ফ্যানের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে হলদে হয়ে যাওয়া কাগজে মিহিরের মেডিকেল রিপোর্ট আর বিলুর প্রত্যেক বছরের একটা করে ছবিতে নাকের তলায় কালো কালিতে আঁকা গোঁফের রেখা। ছবিতে বিলুর মুখের পাশে একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন আর লেখা "বিল্বমঙ্গল নাটক জমজমাট।" মিহির কখনো বুঝতেই দেয়নি? শৈবলিনীও কখনো আন্দাজও করেইনি? কর্কশস্বরে কোথাও পেঁচা ডাকলো, "ক্যাঁওওওও"... শৈবলিনী শুনলো, "কী আশ্চর্য!"