চাঁদের কাছে
চাঁদের কাছে


সাউথ ইন্ডিয়ান ডিলাইটে একটা ধোসার অর্ডার দিয়ে এসে বসলাম চেয়ার টেনে। এরা অর্ডার সার্ভ করতে নয় নয় করেও প্রায় আধ ঘন্টা লাগিয়ে দেয় কিন্তু যে একবার এখানকার ধোসার স্বাদ পেয়েছে সে আধঘন্টা কেন দু এক ঘণ্টাও হাসি মুখে অপেক্ষা করতে রাজি। আমার কলিগ বিভাস কলকাতার কি একটা যেন দোকানের নাম বলে, বলে সেখানের ধোসার স্বাদ নাকি অতুলনীয়; কিন্তু আমার তো বাপু সেই জন্ম থেকে আজ অবধি এই মেদিনীপুর ছেড়ে কোথাও বেরোনোই হল না, তাই এই শহরেই আমি অমৃতের সন্ধান করে নিই। আর সেই তাগিদেই তো আজকাল প্রায়ই স্কুল ছুটির পরে হানা দিচ্ছি এই রেস্তোরাঁটায়। শুনেছি বয়েস বাড়লে নাকি মানুষের নোলা বেড়ে যায়, আমার মধ্যেও কি তবে বয়েসের লক্ষণ প্রকট হচ্ছে আস্তে আস্তে!
দরজা ঠেলে তিনজন লোক ঢুকলো কথা বলতে বলতে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশেই মুখ তুলে তাকালাম আর তখনই তার দিকে চোখ পড়ল আমার, চোখের চেয়েও অবাধ্য আমার হৃৎপিন্ডটা পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে উঠে কোনখানে যে পড়ল কে জানে! সঙ্গে সঙ্গে মেনুকার্ডটা তুলে নিয়ে সিনেমায় দেখানো ভঙ্গি নকল করে মুখ ঢাকতে উদ্যত হলাম কিন্তু সিনেমায় দেখানো কৌশল যে সিনেমাতেই শুধু কার্যকরী হয়, বাস্তবে নয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম যখন সামনে এসে কেউ বললো, “ভালো আছেন?”
অগত্যা মেনুকার্ডটা নামাতেই হলো মুখের সামনে থেকে। শুষ্ক গলায় জবাব দিলাম, “হ্যাঁ ভালো আছি।”
“বসতে পারি?”
ভীষন বলতে ইচ্ছে করছিল যে না পারেননা, কিন্তু জানেনই তো না বলাটা সবার আসেনা, তাই বিরস মুখে বললাম, “হ্যাঁ বসুন।”
“থ্যাংক্স।
রোজই আসেন এখানে?”
“মাঝেমাঝে…”
“ওহ আচ্ছা, তাই বলুন। আসলে সংসারী মানুষেরা এভাবে একা একা তো সাধারণত কোথাও খেতে আসেনা…”
ঢঙ যত, কৌশলে জানতে চাওয়া হচ্ছে আমি বিয়ে করেছি কিনা। লোকটার কথার কোনো জবাব দিলাম না আমি, চুপ করে রইলাম। লোকটাও খানিক চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার হাজব্যান্ড কি করেন?”
বাহ্ চমৎকার, আগের কথাটায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানাইনি দেখে এখন নতুন পন্থা নিলেন! আমি কড়া গলায় বললাম, “আমি বিয়ে করিনি।”
“বিয়ে করেননি!”
“আজ্ঞে না।”
“কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম…”
“আপনি যাই শুনে থাকুন, যার কাছেই শুনে থাকুন ভুল শুনেছেন।”
“হুম তাই হবে বোধহয়।”
“বোধহয় নয়, তাইই।”
“আপনি রাগ করলেন?”
ন্যাকামো যত, এসব দেখে রাগবোনা তো কি আহ্লাদিত হবো! মুখে বললাম, “নাঃ ঠিক আছে।”
“আমি যাই এখন আমার কলিগরা অপেক্ষা করছে। ভালো থাকবেন।”
“আচ্ছা।” কি বলল কলিগরা অপেক্ষা করছে! কলিগ না ঠগবাজির স্যাঙাত? মিথ্যে বলার জায়গা পায়নি!
যাহ বাবা লোকটা আবার ঘুরে দাঁড়ালো কেন!
“মিতালি”
“বলুন।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“বলুন।”
“নাঃ কিছু না, থাক। আসছি। ভালো থাকবেন।”
“দাঁড়ান। কি বলতে এসেছিলেন বলুন।”
“বলছি যে এতদূর এগিয়েও আপনি পিছিয়ে গিয়েছিলেন কেন হঠাৎ করে? আমি তো জানলামই না আমার অপরাধটা কি ছিল!”
“দেখুন সোমনাথ আমি আর পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে মুখ খারাপ করতে চাইনা। যে জিনিসটা এক বছর আগেই চুকে বুকে গেছে তাকে নিয়ে আর না টানাটানি করাই ভালো।”
“ওকে। আয়াম সরি, ভালো থাকবেন।”
“বারবার ভালো থাকবেন ভালো থাকবেন বলে কি বোঝাতে চাইছেন? ভালো আমি আছি, আপনার মত ভন্ড লোকের হাত থেকে বেঁচে গেছি… এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে!” হে ভগবান আমি এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছি কেন! সব লোক আমার দিকেই তাকাচ্ছে...
“ভন্ড!”
“আকাশ থেকে পড়লেন মনে হচ্ছে! হ্যাঁ স্যার আপনার ঠগবাজির কথা আমরা জানতে পেরে গিয়েছিলাম আর তাই বিয়েটা ভেঙে দি। আর কিছু জানতে চান?”
“মিতালি…”
“বলে ফেলুন।”
“এতো লোকের সামনে জোর গলায় আমাকে এমন চমৎকার একটা উপাধি দিয়ে দিলেন, কিন্তু আমাকে ভন্ড বলার কারণটাও প্লিজ একটু বলে দিন তবে... জানতে চাই আমি।”
“লজ্জা করেনা আপনার? ভাঁওতাবাজি করে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন…
আপনার ভাগ্য ভালো আমরা পুলিশে জানাইনি…”
*******************************************************************************************
রোজ এই গেট খুলে ঘরে ঢোকার সময় বুকটা কেমন খাঁখাঁ করে ওঠে। মায়ের ছবিটার দিকে চোখ পড়লেই শূন্যতাটা যেন আরও বেশি করে খেতে আসে আমায়। আজ ছ’মাস হলে মা চলে গেছেন, শেষ দিন অবধি মা চেয়েছিলেন আমার নিজেরও একটা সংসার হোক, আমার নিজের বলতে কেউ থাকুক কিন্তু সত্যি বলতে আমার আর ক্ষমতা নেই নতুন করে কিছু সহ্য করার। ইচ্ছে তো আমারও করেছিল, কোনো একজন মানুষকে পেতে যার ওপর আমার অধিকার থাকবে, চিৎকার যাকে আমি দাবি করতে পারবো “আমার নিজের” বলে, কষ্ট হলে যার বুকে মাথা রেখে কাঁদবো আমি হুহু করে, আনন্দ হলে ছুট্টে গিয়ে যাকে জড়িয়ে ধরবো... আমার ভাগ্যে যে ভগবান এত সুখ রাখেননি তা তো আমি মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু ভগবানের কাছে আমার প্রশ্ন আমাকে এতো কষ্ট কেন দেন উনি? আজ সোমনাথের সাথে কেন দেখা হলো আমার! দেখা হওয়ার তো কোনো কারণ ছিলো না, তবে কেন হলো? আমি তো ওকে ভুলতে চেষ্টা করেছি প্রাণপণ কিন্তু ভগবান কেন তুমি আমাকে ভুলতে দিতে চাওনা ওই তিক্ত স্মৃতিটা! কেন! এখন ভীষন কান্না পাচ্ছে আমার, ভীষন… ঠিক যেমন আজ থেকে এক বছর আগের সেই রাতে কেঁদেছিলাম। বালিশ ভিজেছিল সারারাত। ওর আগেও তো পাঁচজনের সাথে সম্বন্ধ দেখা হয়েছিল কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তো কিছু মনে হয়নি; অথচ প্রথমদিনই ওর চোখ দুটো দেখে বুকের মধ্যে কেমন যেন উথাল পাথাল হয়েছিল। ছাদে দাঁড়িয়ে ওর সাথে একলা কথা বলার সেই সময়টুকু এক অন্যরকম ভালোলাগায় শিহরিত হয়েছিলাম সেদিন। এরপরও ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত মনে হতো যেন স্বপ্ন, সেই সাথে ভয়ও লাগতো… এই বুঝি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে! ঠিক যেমন করে বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল, পরিবর্তে মুখোমুখি হয়েছি হয়েছিলাম রুক্ষ বাস্তবের। এই শহরের বুকে একটা অষ্টাদশী মেয়ের পিঠে এসে চেপেছিল একরাশ দায়িত্বের বোঝা। মা আর দুই ছোটছোট ভাইবোনের দেখভাল করতে গিয়ে নিজের কথাই ভুলে গিয়েছিলাম, নিজের শখ আহ্লাদ চাওয়া পাওয়া সব কিছু। বাবা বেঁচে থাকতে বেড়াতে যেতাম প্রত্যেক বছর, বাবার বেড়ানোর নেশা ছিল খুব। সেই নেশাটাই সঞ্চালিত হয়েছিল আমার রক্তেও কিন্তু পরিস্থিতির চাপে কখন যেন নেশাটা অবদমিত হয়ে গেল আর নিজেকে আজীবনের জন্য বন্দি করে নিলাম এই ছোট্ট শহরটার বুকে কে জানে! সোমনাথ আমার জীবনে আসার পর আবার ইচ্ছে হয়েছিল নিজের খেয়াল রাখার, নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার। কিন্তু আমি যখন নিজের সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর তখনই হঠাৎ করে একদিন আমার ভগ্নিপতি সুশান্ত এসে বললো কালেক্টরীর কোনো ডিপার্টমেন্টেই সোমনাথ ঘোষাল বলে কেউ নাকি কাজই করেনা! বিশ্বাস হতে চায়নি সুশান্তর কথা। কিন্তু বিশ্বাস তো করতেই হয়েছিল, বাস্তবটা বোধহয় এমনই রুক্ষ। ভালোবেসে ফেলেছিলাম লোকটাকে, তাই ওর পর আর ইচ্ছে করেনি নিজের ভাগ্যের পরীক্ষা নিতে। উফফ ভীষন কষ্ট হচ্ছে আমার; বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে আজ বিকেলে দেখা ওর চোখ দুটো। কেন আজ আবার ভীষন ভাবে ইচ্ছে করছে ওই চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে!
*******************************************************************************
কাঁপাকাঁপা হাতে কলিংবেলের সুইচ টিপলাম, সোনা দরজা খুললো। আমাকে দেখে একটুও অবাক হয়নি কেননা প্রায়দিনই স্কুল করে কিছুমিছু খাবার কিনে নিয়ে চলে আসি ওর এখানে, ওর মেয়েটার সাথে অনেকক্ষণ খেলা করে তারপর বাড়ি ফিরি। বাড়ির কেই বা আর আছে আমার!
“সুশান্ত ফিরেছে রে?”
“হ্যাঁ এই মাত্র ঢুকলো।”
“কিছু কথা আছে ওর সঙ্গে।”
“কি ব্যাপারে?”
“বলবো সব। সুশান্তকে ডাক।”
সুশান্তকে ডাকার দরকার পড়লো না, সে নিজেই বেরিয়ে এলো ড্রইং রুমে, “আরে দিদি যে, ভালো আছেন?”
“হুম। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“হ্যাঁ বলুন না।”
“সোমনাথবাবু যে কালেক্টরীতে চাকরি করেন না এ কথা তোমাকে কে বলেছিল?
”
“সোমনাথ বাবু!”
“আরে ওই যে দিদির সাথে যার বিয়ে ফিক্সড হয়েছিল…” আমার হয়ে সোনাই জবাবটা দিয়ে দিল।
“ওহ আচ্ছা, কিন্তু এতদিন পর এই কথা!”
“আরে দিদি, ওর এক বন্ধু তো কালেক্টরীতে সার্ভিস করেন, তিনিই খোঁজ নিয়ে বলেছিলেন।”
“কিন্তু সুশান্ত ঐ বন্ধুটি তোমাকে সঠিক তথ্য দেয়নি?”
“মানে! কি বলছেন আপনি!”
“ঠিকই বলছি। সোমনাথবাবু ওখানেই চাকরি করেন আমি আজ নিজের চোখে দেখে এসেছি সুশান্ত।”
“মানে? আপনি এতদিন পর নিজে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন! আমাদের ওপর থেকে কি আপনার ভরসা উঠে গেছে?”
“না সেটা না মানে…”
“আমি সবই বুঝতে পারছি দিদি, সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়ার পর লোকটা আবার তোর ব্রেনওয়াশ করেছে না?”
“কি উল্টোপাল্টা বলছিস সোনা! সেদিন কাকতলীয় ভাবে দেখা হয়েছিল আর উনি এরকম কোন কথা বলেননি যেটাতে করে আমার ব্রেনওয়াশ করা যায়। তাছাড়া আমি একজন এডাল্ট এডুকেটেড মানুষ, যে কেউ চাইলেই আমার ব্রেন ওয়াশ করে দেবে নাকি?”
“একমিনিট, সোনা কি বললে? লোকটার সাথে দিদির দেখা হয়েছিল!”
“হ্যাঁ দিদির সাথে এই কয়েকদিন আগে রেস্টুরেন্টে লোকটার দেখা হয়, যেচে দিদির সাথে কথা বলে যায়।”
“মাই গড! ঘাঘু মাল...”
“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ সুশান্ত।”
“ওহ প্লিজ দিদি কিছু মনে করবেন না কিন্তু আপনি না বড্ড সরল। যে কেউ আপনাকে বোকা বানিয়ে চলে যায়। লেট মি ক্লিয়ার এভরিথিং।”
“কি ক্লিয়ার করবে তুমি?”
“দিদি আমি বলছি শুনুন, আপনার সাথে লোকটার দেখা হওয়াটা কাকতলীয় ছিল না। ও আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে ওয়াচ করে সেদিন প্ল্যান করেই গিয়েছিল কথা বলতে, দিয়ে এমন ভাবে আপনার ব্রেনওয়াশ করে যে আপনার মনে আবার সন্দেহ জেগে ওঠে। ও জানতো যে আপনি অল্প দিনের মধ্যেই ওর খোঁজে যাবেন অফিসে। আর কালেক্টরীতে রোজ কত মানুষের যাতায়াত, তাই অফিসে ঢুকে কোনো লোককে একটু ঘুষ খাইয়ে এরকম নাটক করা অসম্ভব কোনো ব্যাপারই না।”
“এগুলো একটু কষ্ট কল্পনা হয়ে যাচ্ছেনা সুশান্ত?”
“প্লিজ দিদি, আবার একবার ওই ঠগের পাল্লায় পড়ে ঝামেলা পাকাস না। ও তো তোকে লজিক দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে কি হয়েছে আসল ব্যাপারটা। বয়েস তো তোর কম হলো না, আর বিয়ে করে করবিটা কি? আমার বিন্তি কি তোর সন্তান নয়, ওর সাথে সময় কাটা, ওকে নিজের হাতে মানুষ কর।”
“আহ সোনা, তুমি এভাবে বলছ কেন দিদিকে! দিদি সহজ সরল মানুষ তাই এই সব জোচ্চরদের চিনতে পারেননা, কিন্তু আমরা তো আছি।
দিদি আমি কালই আপনাকে আমার সেই বন্ধুর সাথে কথা বলাব, আজ চাইলে আজই বলাতে পারি। আপনি নিজেই যাচাই করে নেবেন সব কিছু। এখন যাবেন ওর কাছে?”
“নাহ থাক, তোমাদের ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আমার জন্য তোদের আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হবেনা রে সোনা, কথা দিলাম।”
বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে। পাটা যেন উঠতে চাইছে না, ভীষন কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কি আমি এতো বোকা! সোমনাথ এতো কিছু কেন করবেন! আগেরবার সুশান্ত বলেছিল ওনার নাকি আমার টাকার দিকে নজর, হয়তো আরও অনেক মেয়েকে এভাবে ঠকান উনি। সবই তো মেনে নিলাম কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে আজ অন্য কারণে; আমার নিজের বোনও যে আমার অবস্থাটা বুঝলো না, ওরা ভাবছে আমি বিয়ে পাগল? আচ্ছা সংসারের সব দায়দায়িত্ব পালন করে এবার নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে চাওয়াটা কি অপরাধ! সোনা কি সুন্দর বলল বিন্তি তো আমার সন্তানের মত। সত্যিই আমি বিন্তিকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি কিন্তু সন্তান আর সন্তানের মতর মধ্যে যে অনেক পার্থক্য। আমি যতই করি দিনের শেষে কিন্তু বিন্তি সেই সোনার আঁচলই খুঁজবে আর আমি চিরকাল ওর মণিই থাকবো মা কোনোদিনও হতে পারবোনা। ওর ওপর আমার কোনো জোরও থাকবে না। আমারও তো ইচ্ছে হয় নিজের ওরকম একটা জোরের জায়গা পেতে। আচ্ছা সোনা কি কখনো ভুল করেনা? তখন কি সুশান্ত ওর ওপর বিরক্ত হয়! নিশ্চয় না; এদিকে আমার নিজের মায়ের পেটের বোনই আমার ওপর বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে এতো অল্পেই। এই কষ্টগুলো, এই অনুভূতি গুলো কাউকে বলে বোঝানো যায়না, কেউ বোঝেনা।
ফোনটা বোধহয় ফেলে এসেছি ওদের বাড়িতে, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার ফিরতে হলো। কলিংবেল বাজাতে গিয়েও থমকে গেলাম, ভেতর থেকে ঝগড়ার আওয়াজ আসছে, মনে হচ্ছে ঝগড়ার কারণ আমিই...
“তোমার দিদিকে বলিহারি, বয়েস তো বোধহয় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেল, এখনো কি বিয়ে করার শখ এতো!”
“তাতে আমি কি করব?”
“কিচ্ছু করতে হবে না, তুমি শুধু নিজের মুখটা বন্ধ রাখলেই হবে। তোমার দিদি বোকাসোকা মানুষ, মিষ্টি গলায় ভুজুং ভাজুং দিয়ে দিলে সুন্দর বিশ্বাস করে যায় তা না করে তুমি দিলে তো চটিয়ে!”
“দেখো আমার মাথা এমনিতেই গরম আছে আর গরম করিও না। আমার মাই তো সবথেকে বড় ভিলেন। মা এভাবে আমাদের বিট্রে না করলে এতো কিছু হোতইনা।”
“তোমার মায়ের কথা আর বোলোনা, তোমার দিদির বিয়ে ভাঙার পর এমন ভাবে তাকাতেন যেন আমার চেয়ে বড় ভিলেন আর কেউ নেই।”
“মা মারা যাওয়ার আগে অবধি তোমাকে সন্দেহ করে গেছে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার বাট ওই অতবড় বাগান সুদ্ধ বাড়িটা তোমার দিদিকে দিয়ে যাওয়ার কোনো মানে ছিল? তোমার দিদি একলা মানুষ সে বাড়িটা নিয়ে করবেটা কি! তোমাকে আর তোমার দাদাকে তো শুধু টাকার দিয়েই খালাস।”
“মায়ের গয়নার ভাগও তো দিদিকে দেওয়ার পেছনে কি যুক্তি ছিল বুঝিনা। পুরোটা আমাকে না দিক, আমার আর বৌদির মধ্যে ভাগ করে দিলেই হতো। দিদির তো গয়নার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“উফফ এখন এসব ভেবে লাভ নেই, এখন যা ভাবার সেটাই ভাবো। তোমার দিদি বিয়ে করে নিলে ওই বাড়ি গয়না কিচ্ছু পাবোনা আর। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার দিদির শখ দেখে, লোকটার অফিসে চলে গেছে নিজে খোঁজ নিতে তাও এতদিন পর!”
“এখন কি হবে গো? ও যদি তোমার কথা না মানে…!”
“ভাবতে দাও, বাট ওয়েট, আমরাই শুধু কেন মাথা ঘামাবো, তোমার দাদা তো ভাগ নেওয়ার সময় ছাড়বেনা আর ও তো বাড়িটা হাতানোর মতলবে আছে, সবই বুঝি আমি। জায়গাসহ বাড়িটার এখন মূল্য হবে প্রায় এক কোটি।”
“বলো কি!”
“ঠিকই বলছি। তোমার দাদাকে ফোন করি। দিদির বিয়ে ভাঙার আইডিয়াটা তো তোমার দাদারই ছিল, এবারেও সে কিছু উপায় বাতলাক।”
হে ঈশ্বর এসব আমি কি শুনলাম! আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। যে ভাইবোনকে মানুষ করতে আমি নিজের দিকে তাকাইনি কখনো তারাই আজ আমার সাথে এমন প্রতারণা করলো! এতো লোভ ওদের! আমার সম্বন্ধে এরকম চিন্তা করে আমার বোন! মাগো তুমি ঠিকই বলতে একটা বয়েসের পর নিজের মায়ের পেটের ভাইবোনও আর নিজের থাকেনা। তুমি ওদের ঠিকই চিনেছিলে তাই প্রাণপণে চেয়েছিলে আমার নিজের বলতে কেউ থাকুক… কিন্তু আমি এখন কি করবো? কোথায় যাবো? আমার তো আর কেউ রইল না। যাদের আমার পরিবার ভাবতাম তারাই এমন পেছন থেকে ছুরি মারলো!
আজ থেকে প্রায় বছরখানেক আগে কেউ আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিল সে নাকি কোনোদিনও বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছিল কিন্তু তার মায়ের জোরাজুরিতে সে আমাকে দেখতে আসে তারপর আমাকে দেখে তাঁর নাকি মনে হয় ঈশ্বর আমাকে তাঁর জন্য বেছে রেখেছেন বলেই এতদিন অন্য কাউকে জীবনে আসতে দেননি। ওরা বলেছিল এই লোকটা ঠগ, কথার জালে ভোলায় মেয়েদের কিন্তু আজ তো দেখে নিলাম আসল ঠগ কে? কথার জালে কারা ভোলায়, কাদের আমার টাকার দিকে নজর! আচ্ছা সে কেন বিয়ে করেনি এখনও? সেও কি আজও আমায় ভুলতে পারেনি? নাকি আমার ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছিল। সেদিনও তো কত অপমান করলাম রেস্টুরেন্টে, একবারও সে প্রতিবাদ করলো না কেন? অভিমানে!
আজ বোধহয় পূর্ণিমা, লাল হয়ে চাঁদ উঠেছে। কেউ বলেছিল বিয়ের পর ছাদে বসে জ্যোৎস্না দেখাবে আমায়। আচ্ছা আজ যদি তার কাছে গিয়ে বলি আমি তার সঙ্গে জ্যোৎস্না দেখতে চাই সে কি আমায় প্রত্যাখ্যান করবে? যদি বলি ওই চাঁদটার মত রাঙিয়ে দাও আমায়, সে কি আমায় তাড়িয়ে দেবে?
চাঁদের নির্দেশে সম্মোহিতের মত এগিয়ে চলেছি আমি আমার চাঁদের কাছে। একলা পথ চলতে চলতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি চাঁদ; তোমার বুকে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নিতে চাই, “প্লিজ আমায় ফিরিয়ে নাও সোমনাথ... ফিরিয়ে নাও…”
শেষ।