Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Inspirational

4.2  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Inspirational

আগুন পাখি

আগুন পাখি

11 mins
3.7K


"মামণি, চোখ বোজো, চোখ বোজো প্লিজ। এইত্তো, দ্যাটস্ লাইক আ গুড গার্ল! নাও, এবারে তোমার হাতদুটো বাড়াও দেখি আমার দিকে। এইতো, দেখি দেখি... উঁ উঁ উঁ..."

"অ্যাই, তুই কী করছিস বলতো? কী পরাচ্ছিস আমার হাতে?"

"মামণি, তুমি আর বড়ো হলে না গো! খালি ছটফট করো। আরে বাবা, আর ইট্টুউউউখানি..."

"থামালি তোর ইট্টুউউউখানি? হাসপাতাল থেকে ফিরে ফ্রেশ হওয়া নেই? খাওয়াদাওয়া নেই? বড্ড জ্বালাস। একটু টিভি সিরিয়াল দেখছি... তানা কোথায় এখনই মেয়ের যত কাজ পড়ে গেলো আমার হাত নিয়ে! কই কী করছিস দেখিতো?"

"না না, মামণি প্লিজ... আর একমিনিট, একমিনিট... তাকিওনা প্লিজ, মামণিইইই... এই এই এই ব্যাস্... নাও এবার চোখ খোলো। দেখো তো পছন্দ হয়েছে কিনা? আমি তো এইসব কেনাকাটিতে পাক্কা ঢ্যাঁড়শ! বলোনা মামণি... পছন্দ হয়েছে?"

মালিনী... অর্থাৎ মালিনী মৈত্র অপলকে তাকিয়ে আছে নিজের শীর্ণ শিরা বারকরা দুই হাতের দিকে। চোখদুটো এবার ভরে উঠছে টলটলে জলে। একী করেছে বুবুন? বুবুনের পোশাকি নাম পুণ্যতোয়া... ডাক্তার পুণ্যতোয়া রায় মৈত্র। রায়টা ওর বাপের বাড়ির পদবী। মালিনীর একমাত্র ছেলে অমুর বৌ। মালিনী ছেলের বৌকে স্নেহভরে "বুবুন"ই ডাকে। এমনকি তুই-তোকারিও করে। মালিনীর মেয়ে নেই। বুবুনই এখন মালিনীর মেয়ে। কী বোঝে মেয়েটা মালিনীকে! "এটা তুই কী করলি বলতো বুবুন? এমন কেউ করে? ইস্, নতুন চাকরি... এখন কোথায় পয়সাকড়ি জমাবি... তানয়, কোথাকার এক বুড়ি শাশুড়ির জন্যে আজ এটা আনছিস তো কাল ওটা আনছিস। একদম ঠিক নয় এগুলো!"

বুবুন তড়িঘড়ি বলে, "কোনগুলো মামণি? ইস্, তোমার একদম পছন্দ হয়নি না ডিজাইনটা? তাহলে বরং আমি কালকে হসপিটাল থেকে ফিরে তোমাকে নিয়ে গিয়ে পাল্টে তোমার পছন্দ মতো ডিজাইনের নিয়ে আসবো! কেমন?"

"আবার পাকামো? খুব পছন্দ হয়েছে আমার। কিন্তু আমি তো অন্য কথা ভাবছি, এতো দাম দিয়ে এখন এই সোনার বালাজোড়া আনার কোনো মানে হয়? লোকে বলবে ধুমসি বুড়ি শাশুড়ি ছেলের বৌকে সাদাসিধে পেয়ে ঘাড় মটকে সব সোনাদানা আদায় করছে!"

"খবরদার মামণি, খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু খালি ছেলের বৌ ছেলের বৌ করলে। আমি তোমার মেয়ে মামণি... আর তুমি আমার শাশুড়ি না, তুমি আমার মা... শুধু মামণি!" বুবুন একদমে বলে মালিনীর গলা জড়িয়ে ধরে গালে চকাস করে চুমো খেয়ে বলে, "মামণি, আমি স্নানটা সেরে আসি। তুমি আমার জন্য একটু বেশি দুধ বেশি মিষ্টি দিয়ে কড়া করে কফি করে দাও তো। উহ্, দু'টো ওটি ছিলো আজ মামণি। মাথাটা ধরে আছে একদম।"

মালিনী বুবুনের চিবুক ধরে চুমো খেয়ে বলে, "যা যা, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোক। আমি কফি করে আনছি। এইজন্যই বলি হাসপাতাল থেকে আগে সোজা বাড়ি চলে আসবি। তা নয়, দু-দুটো ওটি করে উনি চললেন মামণির জন্য বালা কিনতে!"

কফির জলটা বসিয়ে মালিনী নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক নয়নে। কী সুন্দর দেখতে বালাজোড়া! ঠিক বিয়ের সময় বাবা যেমন গড়িয়ে দিয়েছিলেন... মকরমুখী... পাঁচ আর পাঁচ দশভরির ফারফোর ফাঁপা বালায় কমললতা ডিজাইন... ঠিক সেইরকমই মোটা মোটা। অপুর বিদেশের ভর্তির খবর পাকা হতেই মালিনী নিজে গিয়ে স্যাকরার দোকানে বালাজোড়া বন্ধক রেখে দশহাজার টাকা চেয়েছিলো বলে দোকানি কী ঝাঁঝিটাই না মেরেছিলো মালিনীকে, "অ্যাঁ, বলেন কী? টাকা কী গাছে ধরে নাকি? নাড়া দিলেই পড়বে?" মালিনী থতমত খেয়ে চমকে উঠেছিলো। ওর জিভ গলা ঠোঁট সব শুকিয়ে উঠেছিলো। আমতা আমতা করে কোনোমতে ঢোঁক গিলে বলেছিলো, "টাকাটা আমার খুব দরকার... আমার স্বামী বিদেশে মানে আমেরিকায় পড়তে যাবেন। প্লেনভাড়ার টাকাটা জোগাড় না হলে..."! মালিনীকে বাকি কথা শেষ করতে না দিয়ে মধ্যবয়সী স্যাকরা দোকানি পানের ছোপ ধরা তরমুজের বিচির মতো কালো কালো দাঁত পুরো বত্রিশ পাটি দেখিয়ে বিশ্রিভাবে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠেছিলো, "ওওও, বাওয়া, শেষকালে নতুন বৌয়ের গয়না বন্ধক রেখে বিদেশে পড়তে যাওয়া? হরি হে মধুসূদন... আর কত দেখাবে ঠাকুর? ঘোর কলি..."! মালিনী মহা বিরক্ত হয়ে ফুঁসে উঠেছিলো, "তাতে আপনার কী? যদি বন্ধক না রাখেন তবে আমার গয়নাখানা দিয়ে দিন তো! শহরে স্যাকরার দোকানের অভাব নেই!" এবার চমকানোর পালা দোকানির। আপাতনিরীহ অল্পবয়সী বৌটির সাথে বোধহয় আর বেশি কথা বাড়াতে ভরসা পায়নি। মালিনীরও ক'দিন ধরে শরীরটা খারাপ। আর এই রোদের মধ্যে এ-দোকান ও-দোকান করতে ইচ্ছে হলো না। বন্ধকে অরাজি দোকানি। শেষপর্যন্ত তাই বিক্রি। অনেক দরদস্তুরের পরে সাড়ে সাত হাজার টাকা গুনে নিয়ে ছোট রুমালখানায় বেঁধে ব্লাউজের ভেতরে গুঁজে রেখে বাড়ি ফিরেছিলো মালিনী। বাড়ি বলতে বারোঘর এক উঠোনের ভাড়াটে বাড়ির একতলার কোণের দেড়-কামরার আস্তানা। বাবা ঘরবাড়ি দেখেননি। পাত্র উচ্চশিক্ষিত, আরো পড়তে চায়, মেয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে ভেবেই এককথায় রাজি হয়েছিলেন অপূর্বর সাথে মালিনীর বিয়ে দিতে। অপূর্ব মৈত্র... মালিনীর অপু। বড়ো ভালোবাসে মালিনী অপুকে। আমেরিকায় অত নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে যাবার সুযোগটা তাই হাতছাড়া করতে দিতে চায়নি মালিনী। অপুর পড়ার শেষে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি হবে, ভালো মাইনে হবে, তখন ছোট্ট একটা দু-কামরার বাড়ি করবে। নিজেদের বাড়ি। যদি এই কলকাতা শহরে সামর্থ্যে না কুলোয় তবে শহরতলিতে। সামনে কটা ফুলগাছ, পেছনে একটু সবজি বাগান ঘিরে পাঁচিলের মাঝ বরাবর সবুজ রঙ করা গ্রিলের গেট। মাঝখানে দ্বীপের মতো থাকবে অপূর্ব আর মালিনীর স্বপ্নের বাড়ি। দেখতে দেখতে অপুর যাবার দিন এসে গেলো।

অপুর প্লেন মাঝরাতে। কলকাতা থেকে দিল্লি। তারপর দিল্লি থেকে দুবাই, লণ্ডন হয়ে নিউইয়র্ক। ওখানেই ওর বিশ্ববিদ্যালয়। অপুর চেষ্টা থাকবে যত তাড়াতাড়ি পিএইচডি শেষ করে ফিরে আসতে পারে দেশে। বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা আর নাবালক ভাইকে রেখে যাচ্ছে একলা মালিনীর ভরসায়। মালিনীরও শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না কিছুদিন ধরে। সংসারে আর দ্বিতীয় কেউ নেই যে কাজেকর্মে একটু সাহায্য করবে। ওদের বিয়ের আগে অপুরা পাড়ার কোণের সস্তার ভাতের হোটেলটা থেকে দুবেলার খাবার নিতো। জলখাবারে মুড়ি চিঁড়ে বা বড়োজোর পাঁউরুটি। অপুর মা মারা যাবার পর থেকে এই ব্যবস্থাই চালু ছিলো। কে করবে নাহলে? বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট ছিলো না। মালিনী আসার পরে একটু একটু করে কদিনের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছে সংসার... রান্নাঘর... রাঁধাবাড়া, বাসনকোসন সব। অপু বা ভাই দীপু শুধু সকালে যাহোক একটু বাজার করে দেয়। বছর দুয়েক এভাবেই চলছে। অপুর সামান্য সামর্থ্য। ঐ শুধু কয়েকটা পার্ট টাইম ক্লাস কলেজে কলেজে, আর কয়েকটা ট্যুইশন সম্বল। বাবার যৎসামান্য পেনশন। কোনোমতে সংসারটা চালিয়ে নেয় মালিনী। এই টানাটানির সংসারে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন তো স্বপ্ন হয়েই থেকে যেতো অপুর মনে। কিন্তু মালিনীর কী সাহস! অপুকে প্রতিদিন স্বপ্ন ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। অপু জানেই না এখনো মালিনীর বালাজোড়া বিক্রি করে দেওয়ার গল্প। শুনলে হয়তো বেঁকে বসবে। বেঁকে বসতে পারে মালিনীর শরীর খারাপের কারণ জানলেও। মালিনী তাই চেপেই গেছে। অপু আগে ওদেশে পৌঁছোক, তারপরে ধীরেসুস্থে চিঠিতে লিখবে সব। তিন-চারটে বছরের তো ব্যাপার বড়োজোর। দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে ঠিক। অপুর যাবার আগের রাতটায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি দুজনেই... অজানা ভয় আর ভীষণ উত্তেজনায়। সারাটা রাত অপু মালিনীকে বুকে চেপে মিশিয়ে ধরে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, আর মালিনী প্রাণপণে কান্না সংবরণ করেছে। ভোরে উঠে পাঁচপদ রেঁধে অপুকে খাইয়েছে মালিনী। কে জানে বিদেশে বিভুঁইয়ে কী খেতে পাবে না পাবে? একটু পায়েসও রেঁধেছিলো। মালিনীর মা বলতেন, "সব শুভ কাজের দিনে একটু পায়েস রাঁধতে হয়।" বেরোবার আগে পায়েসের বাটিটা অপুর হাতে ধরিয়ে মালিনী সব দেখেশুনে নিচ্ছিলো শেষবারের মতো অপুর জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক গুছিয়ে দিয়েছে কিনা, কিছু বাদ পড়লো কিনা! পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়ে অপু একচামচ খেয়ে বাকিটা নিজে হাতে মালিনীকে খাইয়ে দিয়েছিলো। ঝাপসা চোখে ধরা গলায় দুজনেই দুজনকে শুধু বলতে পেরেছিলো, "সাবধানে থেকো।" মালিনীর বাবা ট্যাক্সি করে অপুকে নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন... জামাই আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে, গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছে মালিনীর বাবার। অপু ওখানে পৌঁছেই চিঠি দেবে, তাতেই ঠিকানা পাঠাবে। এখন উদ্বেগে বুকে হাত রেখে অপেক্ষা। অপুর ট্যাক্সি রাস্তার বাঁকে চোখের আড়াল হতেই মালিনীর গা'টা বড্ড পাকিয়ে উঠলো। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ছুটলো কলঘরে। হড়হড় করে বমি করে ফেললো মালিনী। দুমাস ধরে মাসিক আটকেছে... মা হতে চলেছে মালিনী। অপুকে জানায়নি। জানালে কিছুতেই যেতে রাজি হতো না। অপুকে খুব চেনে মালিনী... বৌ-ন্যাওটা। অপু ঠিকানা পাঠাক... প্রথম চিঠিতেই লিখবে মালিনী, আগে থেকে ভেবেই রেখেছে, একটু রোমান্টিক কায়দা করে জানাবে, "অপু, তুমি বাবা হয়েছো। আর মাস সাতেক পরেই তিনি এসে পড়বেন কোলে।" ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে নিজের ঘুপচি ঘরের টানটান বিছানায় শুয়ে পড়লো মালিনী। ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া একফালি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো মালিনী। দূর আকাশে প্লেনের আনাগোনার দিকে তাকিয়ে ভাবে মালিনী, "এরই কোনোটায় হয়তো আছে অপু! হে মা বিপত্তারিণী, আমার অপুকে সর্বক্ষ‍ণ রক্ষা কোরো।"

"মামণি, আমার নীল হাউসকোটটা কোথায় গো? খুঁজে পাচ্ছি নাতো! একটু দেখো না মামণি, প্লিজ!" কফিতে চিনি নাড়তে নাড়তে মালিনী আসে বুবুনের ঘরে। কফিমগটা বেডসাইড টেবিলে রেখে, বুবুনের হাউসকোটটা খুঁজে বার করে দেয় মালিনী, "তোরা সবাই একরকম... ভুলো আর অগোছালো। আমি চিরকাল বেঁচে থাকবো? নিজের জিনিস নিজেই কোথাও খুঁজে পাস না!" বুবুন হাউসকোটটা গলিয়ে নিয়ে মালিনীর দুই বাহু ধরে বসিয়ে দেয় নিজের খাটে, "মামণি, তুমিই গুছিয়ে রাখবে চিরকাল।" মালিনীর চোখদুটো জ্বালা করে উঠলো। কান্না লুকোতে উঠে গেলো, "দাঁড়া দাঁড়া, কফিটা খা, আমি একমুঠো ভাত বসিয়ে দিয়ে আসি গিয়ে যাই।" বুবুন, "ঠিক আছে", বলে গরম কফিতে চুমুক দিলো আয়েশ করে বসে। মালিনী রান্নাঘরে। আবার হারিয়ে গেলো অতীতে।

অপুর চিঠি আসতেই মালিনী উত্তরে সব গুছিয়ে লিখলো। সে চিঠির উত্তরে এমন এমন সব কথা লিখলো অপু, যে মালিনীর মুখ লজ্জায় লাল। যথাসময়ে মালিনী আর অপুর ছেলে ভূমিষ্ঠ হলো। মালিনী কিছুতেই বাপের বাড়ি যায়নি... শ্বশুরমশাইকে কে দেখবে? অপু তো তার ভরসাতেই বৃদ্ধ অসুস্থ বাবাকে রেখে গেছে! এরমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেলো। মালিনীর বাবা মা দুজনেই চলে গেছেন। অপুর বাবাও চলে গেছেন। দীপু বিএসসি পরীক্ষা দিয়েই নেভিতে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। মালিনী একলা হয়ে গেছে ছেলে নিয়ে। দেখতে দেখতে ছেলে অমলিন চার বছরের। অপুর চিঠি এলো, "মালিনী, আমার পিএইচডি শেষ হতেই একটা চাকরির অফার পেয়েছি। এদেশেই। তবে নিউইয়র্কে নয়। মন্ট্রিলে। জয়েন করেছি। একটা ছোট্ট বাড়িও নিয়েছি। তোমার স্বপ্নে যেমন ছিলো। আমি আসছি ছুটি নিয়ে। তোমাকে আর অমুকে নিয়ে চলে আসবো এখানে। ওদেশে আমাদের আর কী পিছুটান বলো? তোমার আমার... দুজনেরই বাবা মা'তো চলেই গেছেন। দীপুটাও নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে। তোমার দাদা দিদিরাও যে যার মতো আছে। মন বেঁধে নাও। আর তোমার আর অমুর পাসপোর্ট করিয়ে ফেলো। আমি আসছি। মাত্র কয়েকটা মাস আর। সাবধানে থেকো। অনেক ভালোবাসা অমুর আর তোমার জন্য। তোমার অপু।" চিঠিটা বোধহয় কয়েকহাজার বার পড়েছিলো মালিনী। অপু গেছে চার বছর সাতমাস। আসতে পারেনি বাবা চলে যেতেও। টাকা আর ছুটি... দুইই জোগাড় হয়নি। সেওতো সাড়ে তিন বছর হয়ে গেলো। অমু তখন সবে ছ'মাসের। অপুর চিঠি পাওয়ার পরদিন থেকেই ছোটাছুটি শুরু করলো মালিনী। অপুর পাসপোর্ট করিয়ে দিয়েছিলেন যে ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে, তাকেই গিয়ে ধরলো। কতদূর কী কাজ এগোলো দুদিকেই, দুজনেই দুজনকে চিঠিতে চিঠিতে জানাতে থাকে সেসব কথা।

অপুর ফেরার দিন হয়ে গেছে। ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর আগে। উনিশশো পঁচাশির জুন মাস। মালিনীর গোছগাছ তুঙ্গে। একলাই করতে হচ্ছে সব। পাসপোর্ট এসে গেছে। বাকি কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে... সেগুলো অপু এখানে পৌঁছেই করবে। মালিনী আর পেরে উঠবে না। জুনের তেইশ তারিখ রাতে শুয়ে মালিনী চোখ বুজে মনেমনে সব একবার ঝালিয়ে নিলো আগাপাশতলা। কী বাকি রইলো আর! খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মালিনী... অপু এতোক্ষণে মন্ট্রিল থেকে প্লেনে উঠে পড়েছে। মন্ট্রিল থেকে লণ্ডন হয়ে দিল্লি আসছে অপু এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে। অপুটা এসে পৌঁছলে শুধু একদিন একটু পুজো দিতে যাবে দক্ষিণেশ্বরে আর বড়বাজারে গিয়ে আরোকিছু সুতির কাপড়জামা কিনে নেবে। ওদেশে সুতির জিনিস অমিল বেশ। যতটা নিয়ে যাওয়া যায়। আর তো বোধহয় আসা হবে না কখনো দেশে... কার কাছে আসবে? সব পিছুটান তো আগেই ছিঁড়ে গেছে। অপু সব ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওদেশেই পাকাপাকি থেকে যাওয়ার। অমুকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মালিনী। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকেই অমুটা খুব ঘ্যানঘ্যান করছে। অকারণে বায়না করছে। ইস্, অমুর গাটাও ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে। আহা রে, সাতদিনের মাথায় ওদের নিয়ে অপুর আবার মন্ট্রিলে ফেরার কথা... এরই মধ্যে ছেলেটার আবার জ্বরজ্বারি বেধে বসলো? তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে পাড়ার মুখে নবীন কাকাবাবুর হোমিওপ্যাথি চেম্বার থেকে একটু ওষুধ নিয়ে আসতে গেলো মালিনী... অমুকে কোলে করে। জ্বরটা বেশ বেড়েছে। অপুর বাড়ি এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তো সন্ধ্যে গড়িয়ে যাবে। দিল্লি থেকে আবার প্লেনেই আসবে যদিও... তবুও সময়টা তো লাগবেই। অমুটা মালিনীর কাঁধে মুখটা গুঁজে রেখেছে। জ্বরে নেতিয়ে আছে একদম। চেম্বারের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে অমুকে কোলে নিয়ে বসে আছে মালিনী। নাম লিখিয়েছে। ডাক পড়েনি এখনো। মালিনী গুনে দেখছিলো আর ক'জন বাকি... চোখটা পড়লো চেম্বারের কোণে রাখা সেদিনের খবরের কাগজে। মন্ট্রিল - লণ্ডন - দিল্লি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান তিনশো ঊনত্রিশ জন যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে। চব্বিশ জন ভারতীয় যাত্রী ছিলো। কেউ বেঁচে নেই। অপুও তো এয়ার ইন্ডিয়ার ঐ প্লেনটাতেই আসছিলো! মালিনী অমুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে ভুলে গেলো মালিনী। এক লহমায় মালিনীর সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে আটলান্টিক সাগরের বুকে তলিয়ে গেছে। মালিনী অমুকে বুকে জাপটে ফিরে এলো ওদের ভাড়াবাড়ির দেড় কামরার আস্তানায়। শুরু হলো জীবনযুদ্ধের। হাসপাতালে আয়ার কাজ নিতে হলো, একটা একটা করে সব গয়নাও গেলো... নইলে সংসার চলবে কী করে? অপুর পাঠানো সামান্য জমাটুকু ব্যাঙ্কে থাক। হাল ছাড়েনি মালিনী, এখানে ওখানে ইন্টারভিউ দিয়ে চললো। শেষে একটা স্কুলে ঢুকলো... ক্ল্যারিকাল পোস্টে। তাই সই... অমুকে মানুষ করতে হবে তো!

দিন মাস বছর গড়ালো নিজের গতিতে। অমু মানুষ হলো। অনেক ভালো মানুষ হলো। ডাঃ অমলিন মৈত্র। কী হাতযশ! কী ভালো ডাক্তার! কী হতো এটুকুতেই সন্তুষ্ট হলে? মালিনীও তো বাধা দেয়নি। আর বুবুন তো ছেলেমানুষ... তখন সদ্য ডাক্তারি পাশ করে হাউসস্টাফ হয়েছে। কিন্তু মালিনী তো জীবন অনেক কঠিনভাবে দেখেছে! মালিনী কেন রাজি হলো অমুকে বিদেশে সেমিনার অ্যাটেণ্ড করতে দিতে যেতে? ঠিক ছয় বছর আগে... সেও এক মার্চ মাস, দু হাজার চোদ্দোর অভিশপ্ত আটই মার্চ। অমু নির্দিষ্ট সময়ে কুয়ালালামপুর থেকে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের প্লেনে চেপে বসেছিলো... বেইজিং যাবে। প্লেনটাই আকাশ থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলো? কোনো হদিস মিললো না? ছয়টি বছর পার। মালিনীর তরতাজা ছেলেটা কী হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো? ঝনঝনঝনাৎ... রান্নাঘরের মেঝেটা কাঁচের টুকরোয় ভর্তি। ছুটে এসেছে বুবুন... অমুর বৌ। ডাঃ অমলিন মৈত্র, কার্ডিওলজিস্টের স্ত্রী ডাঃ পুণ্যতোয়া রায় মৈত্র শাশুড়ি মালিনীকে বুকে জড়িয়ে শোবার ঘরে নিয়ে আসে।

মালিনী খাটে বসেছে। এতোদিনের অবরুদ্ধ কান্না আজ বুক ফেটে বেরিয়ে এসেছে। মালিনী কিছুতেই বুবুনকে হারাতে পারবে না। বুবুন মালিনীর পায়ের সামনে মেঝেতে বসে পায়ের কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছে পরম মমতায়। মালিনী কঁকিয়ে ওঠে, "বুবুন, তুই কিছুতেই যাবি না কোভিড ডিউটিতে। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কী নিয়ে থাকবো? কাকে নিয়ে বাঁচবো? অপু, অমু... তারপর তুই, শেষ পর্যন্ত তুই ছাড়া তো আর কেউ নেই আমার!" হাউহাউ করে কাঁদছে মালিনী। বুবুন বুঝলো ওর মামণি ওর ব্যাগে কোডিড এমার্জেন্সির ডিউটিতে যাবার অর্ডারটা দেখে ফেলেছে ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বার করতে গিয়ে। বুবুন একটা কথাও বলে না। আজ বুবুনের বড্ড অমুর কথা মনে পড়ছে। মালিনীকে বিছানায় শুইয়ে দিলো বুবুন ওষুধপত্র খাইয়ে। সারাটা রাত মালিনীর মাথাটা বুকে জড়িয়ে জেগেই প্রায় কাটালো বুবুন। সকালের দিকে একটু চোখটা লেগেই গিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠলো অ্যালার্মের আওয়াজে। আজ থেকে নতুন ডিউটি রোস্টার। ফ্রন্টলাইনার বুবুন... ডাক্তারদের বড্ড চাপ এখন। বুবুন দেখলো মালিনী আগেই উঠে পড়েছে। বুবুনের জন্য চা টোস্ট বানাচ্ছে রান্নাঘরে। বুবুন স্বস্তি পেলো। তৈরি হয়েই এসে মালিনীকে জড়িয়ে ধরে দু'গালে চুমো খায় বুবুন। "আসি আমি মামণি? সাবধানে থেকো আমার আগুন পাখি। তুমিই তো আমার সব, আগুন পাখি... এবারে একটু হাসো।" মালিনী বুবুনের চিবুক ছুঁয়ে চোখ বুজে মা দুর্গাকে স্মরণ করে, "আয় মা, সাবধানে কর্তব্যে থাকিস তুইও... দুগ্গা দুগ্গা!"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama