সবান্ধবে বান্ধবগড়
সবান্ধবে বান্ধবগড়
( ১ )
"তাহলে এ বছর পুজোয় তোরা কোথায় যাচ্ছিস ?", আলুর চপে একটা কামড় দিয়ে রণজয়কে জিজ্ঞেস করল মোহিত I
- ঠিক পুজোয় নয়, নভেম্বরে যাচ্ছি বান্ধবগড় I
- বান্ধবগড় মানে মধ্যপ্রদেশ ? একটু হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করল মোহিত I
- হ্যাঁ, কিন্তু তুই এটা শুনে এরকম মুষড়ে পড়লি কেন ?
- আসলে আমার বহু দিনের ইচ্ছা MP টা ঘোরার I এতো কিছু দেখার আছে এই স্টেট টায় I গোয়ালিয়র থেকে শুরু করে সাঁচি, বান্ধবগড় থেকে শুরু করে অমরকন্টক, খাজুরাহো থেকে শুরু করে পাঁচমাড়ি I উফ পুরো প্যাকেজ I
- তা অত হা-হুতাশ না করে চল না আমাদের সঙ্গে I আমরা তো মোটে তিন জন, তুই আর পৃথা গেলে আমাদেরও তো সঙ্গী জোটে I
- সে কপাল কি আর আমার আছে রে ? যতদিন না পর্যন্ত এই অফিস আমি ছাড়ছি ততদিন আমার আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে না I
- তার উপর তোর বস্-এর সাথেও তোর কি একটা ঝামেলা আছে না ?
- হ্যাঁ সে তো আছেই I সব সময়ে ওৎ পেতে থাকে কি করে সেই সেদিনকার প্রতিশোধ নেবে I সব মিলিয়ে আমার মধ্যপ্রদেশ যাওয়ার কফিনে শত পেরেক I
- কি আর করবি ? শুধু এটুকুই বলতে পারি, হাল ছেড়ো না দোস্ত বরং মাথাটা খাটাও জোরে I দেখ যদি ভেবে কিছু প্ল্যান বের করতে পারিস I
- তা দায়িত্বটা তুইও নে না I
- ওকে বস্, দেখছি কি করা যায় তোর জন্য I আজ উঠি I এই বলে চা-এর কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো রণজয় I
রাতে খেয়ে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাদে পায়চারি করতে করতে মোহিত এটাই ভাবছিলো যে মধ্যপ্রদেশের প্ল্যানটাকে কি ভাবে কফিন থেকে বের করা যায় I
পরদিন সকালে রণজয়ের ফোন পেয়ে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে ঠিক বিকেল চারটেয় কফি হাউস পৌঁছলো মোহিত I মিনিট দশেকের মধ্যে রণজয়ও এসে গেলো I কফি আর ফিশ ফিঙ্গার অর্ডার করে শুরু হ’ল মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণের চিত্রনাট্য রচনা I আজ আবার এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে চলেছে কফি হাউস I
রণজয়ই প্রথম শুরু করল, "আচ্ছা আগে বল তুই এই ট্যুরটার জন্য ঠিক কি কি করতে পারবি ? সেই বুঝে দর হাঁকা করা শুরু করব I
- তুইই বল তোর কি চাই I
- যদি বলি আমার ট্যুর-এর খরচটা তুই দে I সুযোগ সন্ধানী শয়তানের মত মুখের ভাব করে বলল রণজয় I
- মাফ কর বস্ I একে অফিসে গব্বর সিং তার উপর তুই যদি মোগ্যাম্বো হয়ে যাস তাহলে আমাকে তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না I বরং তোর জন্য আমি মাটন আফগানী অর্ডার করি ?
- ঠিক আছে, তোকে সস্তায় ছেড়ে দিলাম I এবার শোন মন দিয়ে I
এর পর মোটামুটি এক ঘন্টা ধরে প্ল্যান টা দাঁড় করালো দুজন মিলে I ব্যাস এবার শুধু প্ল্যান মাফিক কাজ হলেই কেল্লা ফতে I
( ২ )
রোজকার মত রাতের খাওয়া সেরে বৈঠকখানার আরাম কেদারায় গা-টা এলিয়ে দিলেন ধূর্জটিবাবু I চাকরকে একটা হাঁক দিয়ে বললেন বড় বাতিটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিতে I পুরো নাম ধূর্জটি প্রসাদ ভট্টাচার্য I অকৃতদার মানুষ I কলকাতার একটা জুতোর কোম্পানিতে প্রোডাকশন ম্যানেজার I আর্থিক দিক দিয়ে বেশ সচ্ছল I এমনিতে ভালো মানুষ হলেও পাড়ায় আর অফিসে বেশ কড়া মেজাজের লোক বলেই পরিচিতি আছে I আর হ্যাঁ, খেলার মাঠই হোক বা বাকযুদ্ধ হেরে যাওয়া ওনার একেবারেই না পসন্দ I এমনকি কারুর কাছে যদি কোনো অপ্রিয় কথা শোনেন তাহলে যত দিন না পর্যন্ত তার যোগ্য জবাব দিতে পারছেন ততদিন শান্তি পান না I অবশ্য আরো একটা নামেও ওনাকে লোকে চেনে 'রেকর্ড বাবু' I না, গিনেস বুকের রেকর্ড নয়, গ্রামোফোনের রেকর্ড I একটা ঘর ভর্তি হাজার খানেক রেকর্ড আছে ওনার কাছে I তার মধ্যে অনেক গুলোই বেশ দুষ্প্রাপ্য I ধূর্জটি বাবু অবশ্য এসবের বিশেষ ভক্ত নন I মাঝে মধ্যে একটু আধটু গান-টান শোনেন এই পর্যন্তই I এসবই আসলে ওনার বাবার সংগ্রহ I বাবার অবর্তমানে ওগুলো এখন ধূর্জটি বাবুর সম্পত্তি I বহুদিন ধরে পড়ে পড়ে ওগুলো নষ্ট হচ্ছে দেখে উনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন - "পুরণো রেকর্ড বিক্রি আছে I প্রকৃত কদরদার লোকেরা যোগাযোগ করুন"I মাঝে মধ্যেই লোকজন আসে রেকর্ড কিনতে I ইতিমধ্যে বেশ কিছু রেকর্ড ভালো দামেই বিক্রি করেছেন ধূর্জটি বাবু আরাম কেদারায় শুয়ে চোখটা প্রায় লেগে এসেছিলো এমন সময়ে ফোনটা বেজে উঠে ধূর্জটি বাবুর ঘুমের বারোটা বাজালো I অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে ফোন টা ধরলেন I
- হ্যালো
- ইটা কি ধূর্জটি বাবুর নাম্বার আছে ? হিন্দির সাথে বাংলা মেশানো উচ্চারণে প্রশ্ন ভেসে এলো ওপার থেকে I
- ধূর্জটি ভট্টাচার্য বলছি I
- নমস্তে হামার নাম সুন্দর লাল মাখিজা আছে I আমি নিউজ পেপারে আপনার এডভার্টাইসমেন্ট টা দেখে ফোন করছি I
যে বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরেছিলেন ধূর্জটি বাবু, রেকর্ড বিক্রির কথা শুনে তার কিছুটা কাটলো I তারপর বললেন -
- বেশ বলুন আপনার কোন রেকর্ড চাই I
- হামার যে রেকর্ড চাই ও যদি আপনি হামাকে দিতে পারেন তো আপনাকে ভি হামি খুশ করে দিবে I ও রেকর্ড হামি বহুত জাগা তে খুঁজেছি, পার কহি নহি মিলা I বলল মাখিজা I
- আচ্ছা ঠিক আছে আপনি বলুন না. যদি থাকে তবে আপনিই সেটা পাবেন আমি কথা দিচ্ছি I
- ১৯৩৮, শাহনওয়াজ খান I অউর যে গানা আছে ও হলো "করকে বয়াঁ তেরা নূর হো গয়ে হাম মশহুর" I
ইয়ে রেকর্ড চাই হামার I বোলেন আছে আপনার কাছে ?
- আপনি আধ ঘন্টা পড়ে আমাকে একবার ফোন করুন I আমি লিস্ট টা দেখে আপনাকে জানাচ্ছি I
- জি বহুত আচ্ছা I বলে ফোন টা ছেড়ে দিলো মাখিজা I
ফোনটা রেখে রেকর্ডের ঘরের দিকে ছুটলেন ধূর্জটি বাবু I মনে মনে বললেন, "মাল দার খদ্দের মনে হচ্ছে, রেকর্ড টা বেচতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যাবে I" ঘরে ঢুকে দেরাজ থেকে রেকর্ডের ডাইরিটা বের করলেন I ১৯২০ থেকে লিস্ট শুরু হয়েছে I এক এক করে নামতে নামতে ১৯৩৮-এ এসে থামলেন I পাতার নম্বর দেখে ওই বছরের পাতা টা খোলার আগে স্বর্গীয় বাবাকে স্মরণ করে মনে মনে বললেন, "বাবা তোমার উপর আমার পুরো ভরসা আছে, ওই রেকর্ড নিশ্চয়ই ছিল তোমার কাছে" I
পাতাটা খুলে দেখলেন ওই বছরের মোট পাঁচটা রেকর্ড রয়েছে লিস্টে I যার মধ্যে তিন নম্বরে রয়েছে শাহনওয়াজ খানের সেই গান যেটা মাখিজা কিনতে চেয়েছে I আনন্দের চোটে একটা হাত তালি দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পরক্ষণেই যা দেখলেন তাতে ওনার দুই হাত শূন্যেই থেমে গেল I গানের নামের পাশে পাতার ডানদিকে লাল কালিতে একটা কাটা চিহ্ন দেওয়া রয়েছে I এর মানে বাবার সংগ্রহে এই গান ছিল ঠিকই ধূর্জটি বাবু নিজেই সেটা বেচে দিয়েছেন I এবার বিক্রি হয়ে যাওয়া রেকর্ডের খাতাটা খুলে দেখলেন যে দু'মাস আগে সেটা বিক্রি হয়ে গেছে I ধূর্জটি বাবুর মনে পড়লো যে ভদ্রলোক এটা কিনেছিলেন তিনি কোনো নির্দিষ্ট রেকর্ডের খোঁজে আসেননি I লিস্ট দেখে এবং গানটা শুনে ওনার এটাই পছন্দ হয়েছিল I আরো মনে পড়লো যে তিনি ঠিক করেছিলেন রেকর্ডটা ২৫০-৩০০ টাকায় বেচবেন কিন্তু ভদ্রলোক নিজে থেকেই ৫০০ টাকা অফার করায় ধূর্জটি বাবু মহানন্দে সেটা দিয়ে দেন আর তার সাথে ভদ্রলোককে বসিয়ে এক কাপ চা-ও খাওয়ান I তো মোদ্দা কথা রেকর্ডটা ছিল কিন্তু এখন নেই I সুতরাং মাখিজাকে সরি বলা ছাড়া আর কিছু করার নেই I
কাঁটায় কাঁটায় আধ ঘন্টার মাথায় এলো মাখিজার ফোন I ফোনটা ধরেই ধূর্জটি বাবু বললেন,
- সরি মিস্টার মাখিজা, ওই রেকর্ড আমি দুই মাস আগেই বিক্রি করে দিয়েছি I
- হায় হায় হায়, ইয়ে আপনি কি করিয়েছেন ? ও রেকর্ড আপনি বিক্রি করিয়ে দিয়েছেন ? চূড়ান্ত হতাশ গলায় বললো মাখিজা I
- আমি দুঃখিত মিস্টার মাখিজা I কিন্তু আমি তো জানতাম না যে সে জিনিস আপনি কিনতে চাইবেন I তা ছাড়া রেকর্ডের প্রতি আমার নিজের খুব একটা আগ্রহ নেই I আর এমনিতেও আমি ওটা বেশ ভালো দামেই বেচেছি I
- ভালো দাম ? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আপনি কাইন্ডলি হামাকে বোলবেন ও রেকর্ড আপনি কোতো দামে সেল করিয়েছেন ?
- ৫০০ টাকা I বললেন ধূর্জটি বাবু I
শুনেই মাখিজার কণ্ঠ স্বরে একটা আকস্মিক পরিবর্তন এলো I এতক্ষণ যে নরম সুরে কথা বলছিলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত খানিক ধমকের ভঙ্গিতে মাখিজা বলল, "ও আনমোল রেকর্ড আপনি সির্ফ ৫০০ রুপয়ে মে বেচেছেন ? আপনি জানেন ও রেকর্ডের কীমত কি আছে ? ইসে কহতে হ্যা বান্দর কে গলে মে মোতিও কা হার I " এবার ধূর্জটি বাবু একটু ধন্দে পড়ে গেলেন I তাকে বাঁদরের সাথে তুলনা করায় তিনি যতটা না রাগলেন তার চেয়েও বেশি ওনার মনে হতে লাগলো তবে কি তিনি একটা মহা মূল্যবাণ জিনিস না জেনে জলের দরে বেচে দিয়েছেন ?
গলায় একটা নকল গাম্ভীর্য এনে ধূর্জটি বাবু মাখিজা কে জিজ্ঞেস করলেন,
- মানে আপনি কি বলতে চান, ওই রেকর্ডের দাম কত ?
- অব পুছকে কেয়া ফায়দা ? হামিই তো আপনাকে ফিফটিন থাউজেন্ড অফার করব ঠিক করিয়েছিলাম I বললো মাখিজা I
মাখিজার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থ হয়ে গেলেন ধূর্জটি বাবু I পর মূহুর্তেই ওনার মনে হল রেকর্ডটা বিক্রি হয়ে গেছে শুনে লোকটা এমনি এমনি দাম বাড়িয়ে বলছে না তো ? পরীক্ষা করার জন্য ধূর্জটি বাবু বললেন, "আচ্ছা আমি যদি ওই রেকর্ড আপনাকে এনে দিই তাহলে ওই দামই আপনি দেবেন তো?"
- "জরুর দিবো I আপনার কি মনে হোয় হামি আপনার সোঙ্গে তামাসা করছি ? আপনাকে হামি এক হফতা টাইম দিলাম I আপনি ক্যাইসে ভি হো ও রেকর্ড হামাকে এনে দিন, হামি আপনাকে পন্দরা নেহি বিস্ হাজার দিব I" বলল মাখিজা I ধূর্জটি বাবু জানিয়ে দিলেন উনি চেষ্টা করবেন I চেষ্টা যে তিনি করবেন এটা ওনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না I এক সপ্তাহ একটু খোঁজা খুঁজি করে যদি বিশ হাজার টাকা রোজগার হয় তাহলে মন্দ কি ? ঠিক করলেন এই এক সপ্তাহ অফিস ছুটির পড়ে বেড়িয়ে সে রেকর্ড খুঁজবেন I পরদিন অফিস পৌঁছে একে ওকে জিজ্ঞেস করে কয়েকটা জায়গার সন্ধান পেলেন যেখানে পুরোনো রেকর্ড বিক্রি হয় - ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ওয়েলিংটন, শোভাবাজার, ডোভার লেন আর HMV I ব্যাস তার পর থেকেই শুরু হল ধূর্জটি বাবুর রেকর্ড খোঁজার দৌড় I বেশ ভালো টাকাই সঙ্গে রেখেছিলেন যাতে কোথাও সে জিনিস পাওয়া গেলে সাথে সাথে হস্তগত করতে পারেন I এ দোকান সে দোকান আবার সেখান থেকে নতুন কোনো জায়গার সন্ধান পেলে সেখানে, এভাবে পাঁচদিন চলল কিন্তু সেই রেকর্ড ওনার কপালে জুটলো না I যে রেকর্ড নিজের বাড়িতেই ছিল সেটা জলের দরে বেচে দেওয়ার মতো যে বোকামি তিনি করেছেন তার জন্য নিজেকে মনে মনে যথেষ্ট ভর্ৎসনা তিনি করেছেন কিন্তু তাতে কাজের কাজের কিছু হওয়ার নয় I এদিকে মাখিজার দেওয়া সময়ের আর মোটে দুদিন বাকি আছে I ঠিক করলেন একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন I
( ৩ )
পরদিন অফিসে গিয়ে একটু তাড়াতাড়িই কাজকর্ম সারছিলেন I ঠিক করেছিলেন আজ একটু আগেই বেড়িয়ে পড়বেন I হঠাৎ একজন কর্মচারী এসে খবর দিল যে মোহিত গত পাঁচ দিন ধরে অফিসে আসছে না I অফিস থেকে ফোন করা হলে জানিয়েছে যে সে অসুস্থ কিন্তু গতকালই তাকে ধৰ্মতলায় ঘুরতে দেখা গেছে I এমনিতেই এই কদিনের পণ্ডশ্রম তার উপর হাত থেকে বিশ হাজার টাকা ফস্কে যাওয়ার উপক্রম এই সবের সাথে মোহিতের নামটা শুনেই আগের বছরের ১৫ই অগাস্টের কথাটা মনে পড়ে গিয়ে ধূর্জটি বাবুর রাগ সপ্তমে পৌঁছলো I আগের বছর অফিসে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময়ে কারুর সাথে ফোনে কথা বলছিলেন তিনি এমন সময়ে জাতীয় সংগীত শুরু হয় তাই তিনি উঠে দাঁড়াতে ভুলে যান I সর্ব সমক্ষে মোহিত ওনাকে উঠে দাঁড়ানোর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় ধুর্জটির বাবুর মনে হয় মোহিত তাকে অপদস্থ করেছে I আর সেটা এমন একটা বিষয় ছিল যে ধূর্জটি বাবু বিশেষ কিছু বলতেও পারেননি I এই ঘটনার পর থেকেই মোহিতের প্রতি একটা সুপ্ত ক্ষোভ রয়ে গেছে ধূর্জটি বাবুর মনে যা আজকে আবার নড়ে চড়ে উঠলো I ঠিক করলেন মিথ্যা অজুহাতে অফিস কামাই করার জন্য এই ব্যাটাকে আজই বরখাস্ত করবেন I এর পরে যদি মোহিত আর কথা না বাড়ায় তাহলে তো মিটেই গেলো আর যদি অফিসে এসে ধূর্জটি বাবুর কাছে কাকুতি মিনতি করে তাহলে তো আরোই ভালো I
দেরি না করে ধূর্জটি বাবু মোহিতের বাড়িতে ফোনটা করেই ফেললেন I একবার করে রিং হয় আর ধূর্জটি বাবু মনে মনে বলেন , " ধর, একবার ধর , তারপর দেখ কি হয়.." I ঠিক পাঁচবার রিং হওয়ার পরে একজন মহিলা ফোন ধরলেন I এই ব্যাপারটার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না কিন্তু এতে উনি সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন এমনটা হওয়ার নয় I কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে গলাটা একটু ভারী করে বললেন, "মোহিত আছে ? বলুন অফিস থেকে ফোন আছে I" মোহিত একটু দূরে বসেই জিলিপি খাচ্ছিলো I মোহিতের স্ত্রী পৃথা ফোনের রিসিভারটা হাত দিয়ে চেপে ইশারায় মোহিত কে বুঝিয়ে দিলো যে অফিস থেকে ফোন I তারপর রিসিভার থেকে হাত টা সরিয়ে বলল, "হ্যাঁ একটু ধরুন আমি ডাকছি I" মিনিট খানেক দেরি করে ফোন টা ধরলো মোহিত আর গলায় একটা মেকি অসুস্থতার ভাব এনে যতটা সম্ভব মৃদু স্বরে বলল,
- হ্যালো মোহিত চৌধুরী বলছি I
- ধূর্জটি ভট্টাচার্য কথা বলছি I শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ তা ঠিক কি অসুখ আপনার ? শুরু করলেন ধূর্জটি বাবু I মোহিত কি উত্তর দেয় সেটা শোনার কোনো আগ্রহ ওনার ছিল না বরং এর পরে কি বলবেন সেটাই ভাবছিলেন I গতকালের ধর্মতলার প্রসঙ্গটাই তুলবেন ঠিক করলেন I
এই ফোনটা আসবে মোহিত জানতো I তাই সব কিছু রেডি করেই রেখেছিলো I হাতের ইশারায় পৃথাকে গ্রামোফোনটা চালিয়ে দিতে বলল I
"আজ্ঞে ঠিকই শুনেছেন স্যার I" বলল মোহিত I একই সঙ্গে গ্রামোফোনটাও বেজে উঠলো I মোহিত কে মাঝপথে থামিয়েই শুরু করেছিলেন ধূর্জটি বাবু, "তো আপনি বোধ হয় কাল ধৰ্মতলায়...." কিন্তু তখনি একটা গানের আওয়াজ শুনে থেমে গেলেন I পরিচিত গান নয় কিন্তু গানের কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন I "করকে বয়াঁ তেরা নূর হো গয়ে হাম মশহুর" I যে গান তিনি এক হপ্তা ধরে গরু খোঁজা খুঁজছেন সেই গান কিনা বাজছে মোহিতের ঘরে !!! কয়েক মূহুর্ত দুজনে চুপ I তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে গলার স্বর আর বলার বিষয় ১৮০ ডিগ্রি বদলে যেখানে থেমেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করলেন ধূর্জটি বাবু I
- তা যা বলছিলাম, কাল বোধ হয় ধর্মতলায় ডাক্তার-টাক্তার দেখাতে এসেছিলেন I দেখলাম আপনাকে I
- আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার I
- বেশ বেশ I তা যেটা বলার জন্য ফোন করলাম, অফিস নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না I আমি অন্য কাউকে দিয়ে ঠিক সামলে নেবো I ডাক্তার যে কদিন বলে আপনি বিশ্রাম নিন I আমি না হয় দু একদিনের মধ্যে আপনার বাড়ি গিয়ে একবার খোঁজ নিয়ে আসবো I
- না না স্যার আপনি আবার কষ্ট করে... বলতে যাচ্ছিলো মোহিত I কিন্তু ধূর্জটি বাবু নিজে থেকেই জোর করে বললেন তিনি যাবেন কারণ এটা ওনার নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে I ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলো মোহিত I তারপর গুন্ গুন্ করে একটা গান গাইতে গাইতে আবার জিলিপির ঠোঙা টা তুলে নিলো I গ্রামোফোন টা তখনও বাজছিলো সেটাকে বন্ধ করে করে নিজের মনেই বলল, "কি গানের ছিড়ি..সাধে এ গান চলেনি I
( ৪ )
আজই বিকেলে বান্ধবগড় এসে পৌঁছেছে মোহিত, রণজয় এন্ড কোম্পানি I আগে থেকে ঠিক করে পূর্ণিমার রাতটাই বান্ধবগড়ের জন্য রেখেছিলো ওরা I জ্যোৎস্নার আলোয় গোটা জঙ্গল ভেসে যাচ্ছে I বনবাংলোর বারান্দায় বসে কফি আর পকোড়া খেতে খেতে মোহিত কে জিজ্ঞেস করল রণজয় -
- লাস্ট সিনটা কি করে ম্যানেজ করলি বল, এটা তো ভালো করে শোনাই হয়নি I
- লাস্ট সিনে ঝামেলা তো কিছু ছিল না, সেদিনের ফোনটার পরেই ম্যাচ পকেটে এসে গিয়েছিলো I বলে চলল মোহিত I তার তিনদিন পরেই স্যার এক গাদা ফল আর মিষ্টি নিয়ে বাড়ি এসে হাজির I আমি বেড রুমের সেটটা আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছিলাম I খাটের পাশের টেবিলে কিছু ওষুধ, ফল, একটা থার্মোমিটার, একটা জলের গ্লাস এইসব রেখেছিলাম I তিন-চার দিন শেভ করিনি এই সব আর কি I স্যার এসেই কিছুক্ষণ অপ্রয়োজনীয় কথা মানে আমি কেমন আছি, কি ওষুধ খাচ্ছি এসব জিজ্ঞেস করেই প্রয়োজনীয় কথায় চলে এলেন I আমিও বেশ কিছুক্ষণ খেলালাম, বললাম পারিবারিক জিনিস কিছুতেই দেওয়া যাবে না I তারপর দশ হাজার অফার করায় আর কথা বাড়ালাম না I
- টাকা কি দিয়ে দিয়েছে নাকি ? জিজ্ঞেস করলো রণজয় I
- হ্যাঁ সেই দিনই I সাথে করেই নিয়ে এসেছিলেন I কোনো রিস্ক নেননি I ও ভালো কথা, এই নে তোর রেকর্ড কেনার ৫০০ টাকা I
- মানে ? মোটে ৫০০ টাকা ? বাকিটা একাই হজম করবি নাকি ? মিস্টার রণজয় মাখিজার শেয়ারটা কি হবে ?
- না রে ভাবছি ফিরে গিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবো I চিটিং বাজি ব্যাপারটা ঠিক ধাতে নেই I তাছাড়া আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল ঘুরতে আসা সেটা যখন হয়েই গেছে তখন আর..
- হয়েছে হয়েছে স্বামী মোহিতানন্দ, আর কিছু বললে তোকে কিন্তু অমরকণ্টকেই রেখে যাবো I বলল রণজয় I
- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে আর বলছি না I কিন্তু ওদিকে যে ধূর্জটিবাবু তোর অপেক্ষায় থুড়ি মিস্টার মাখিজার অপেক্ষায় বসে আছে তার কি হবে ?
-কেন, সেই গানটা শুনিসনি ? বলে একটা গান ধরলো রণজয়। "বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে যত ভাবি ভুলে যাবো মন মানে না.. "
তারপরে দুজনেই এক সাথে হো হো করে হেসে উঠলো I