পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Drama Classics

4  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Drama Classics

ছেলেবেলা

ছেলেবেলা

11 mins
931


রেলগাড়ি থেকে রাজবাঁধ নামক ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশনে নামলো সুপ্রতীক। প্রায় দশ বছর পর সুপ্রতীক আবার এলো এই রাজবাঁধ গ্রামে। পশ্চিম বর্ধমান জেলার অন্তর্গত এই রাজবাঁধ গ্রামটি কে ছোট্ট এক আধা শহরাঞ্চল বলা চলে ।


এই গ্রামেই এক সময় স্থায়ী ভাবে বাস করতো সুপ্রতীকরা। এই রাজবাঁধ গ্রামেই ছিল তাদের পৈতৃক বাড়ি । সুপ্রতীকের গোটা ছেলেবেলা কেটেছে এই রাজবাঁধ গ্রামের মাটিতেই ।

কত হাসি মজা খেলাধুলা করে কাটিয়েছে সুপ্রতীক এই রাজবাঁধ গ্রামের অলিতে গলিতে। কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে গোটা রাজবাঁধের আনাচে কানাচে। তাদের পৈতৃক বাড়ি খানা ছিল তার জীবন । গোটা বাড়ি ময় সে দৌড়া দৌড়ি করে বেড়াতো। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়ির ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতো। সব সময় তার চিৎকারে বাড়ি খানা সরগরম হয়ে থাকতো। কিন্তু সেই সব আজ দূরের কথা। আজ আর এই সব স্মৃতির কোনো অস্তিত্ব বেঁচে নেই সুপ্রতীকের মনের অন্দর মহলে। আজ থেকে দশ বছর আগে যে সুপ্রতীক কে আমরা দেখেছিলাম ; তার সাথে আজকের সুপ্রতীকের মধ্যে অনেক ব্যবধান। আর ; আজ সুপ্রতীক যে আবার এই রাজবাঁধ গ্রামে দশ বছর পর ফিরে এসেছে । তার পিছনেও আছে অন্য একটা কারণ । 


সুপ্রতীকের বাবা রমেশ বাবু ছিলেন দুর্গাপুর সাবডিভিশনের উর্দ্ধতন অফিসার। আর রাজবাঁধ গ্রামের পৈতৃক বাড়িতেই বংশ পরম্পরা ধরে বসবাস করে আসছেন ওনারা। এখন এই বাড়িতে শুধু রমেশ বাবুরাই থাকেন। এই বাড়ির সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল রমেশ বাবুরও। তাই দুর্গাপুরের কর্মস্থল থেকে থাকার জন্য কোয়াটার পাওয়ার পরেও রমেশ বাবু রোজ রাজবাঁধ থেকেই অফিস যাতায়াত করতেন। নিজের এই পৈতৃক বাড়িতেই থেকেই সব থেকে বেশি আনন্দ ও শান্তি অনুভব করতেন রমেশ বাবু ।


কিন্তু ; একদিন রমেশ বাবু সময়ের অনেক আগেই মন মরা করে বাড়িতে ফিরে এলেন। সুপ্রতীক ও সেদিন বাড়িতেই ছিল। শরীর খারাপের জন্য সেদিন সে স্কুল যায়নি । রমেশ বাবুর সহধর্মিনী রমলা দেবী ওনাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন। কি হয়েছে কিগো এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এলে আজ। তারপর রমেশ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যান রমলা দেবী। তিনি দেখলেন যে রমেশ বাবুর মুখটা আষাঢ়ের কালো মেঘের মতো হয়ে আছে। সেই দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন রমলা দেবী। রমেশ বাবু বাড়িতে ঢুকে কোনো কথা পর্যন্ত বলেন না। তারপর রমলা দেবী রমেশ বাবু চেপে ধরেন কি হয়েছে জানার জন্য। রমেশ বাবু ধীর কণ্ঠে বলেন অফিস থেকে আমার প্রমোশন হয়েছে। রমেশ বাবুর মুখে প্রোমোশনের কথা শুনে রমলা দেবী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। কিন্তু শুধু রমেশ বাবুই চুপ করে বসে থাকেন। রমলা দেবী রমেশ বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখেন যে ওনার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মানে রমেশ বাবু কাঁদছেন। সেই দেখে বিস্মিত হন রমলা দেবী। রমেশ বাবুকে এবার তিনি খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞসা করেন । সত্যি করে বলতো কি হয়েছে তোমার ; এমন ভাবে কাঁদছো কেন তুমি ? তখন রমেশ বাবু রমলা দেবী কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে ওঠেন। তারপর রমেশ বাবু বলেন ; রমলা প্রোমোশনের পর আমার বদলি পাটনা শহরে হয়ে গেছে। সেখানেই আমাদের চলে যেতে হবে সপরিবারে ; আমাদের এই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে। আমারদের এই পৈতৃক বাড়ির সাথে কত স্মৃতি কত আবেগ জড়িয়ে আছে আমার। আমার ছোট ছেলেবেলা আমার বাবা মায়ের সাথে কাটানো সময় , তোমার সাথে কাটানো সময় , আমাদের সুপ্রতীকের ছোট থেকে বোরো হওয়া সবই কিছু তো এই বাড়িকে ঘিরেই বলো। এই সব মায়া কাটিয়ে কিরে যাই বলতো ; এই বলে আবার কাঁদতে থাকেন রমেশ বাবু। রমলা দেবী রমেশ বাবুকে বোঝাতে থাকে। আর এই পুরো দৃশ্য তা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে ও শোনে সুপ্রতীক।


কথা গুলো শুনে ঠিক রমেশ বাবুর মতোই মনটা খারাপ হয়ে যায় সুপ্রতীকেরও। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে তারও। কিন্তু সে বাবার কাছে গিয়ে ; নিজেকে শক্ত করে বলে কি হয়েছে বাবা তাতে। যদি আমরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়েও থাকি । যেখানে আমরা একসাথে থাকবো সেখানেই আমাদের সব স্মৃতিও বেঁচে থাকবে আমাদের সাথেই। রমেশ বাবু বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেন সুপ্রতীক কে।


সুপ্রতীক এই কথা বললেও ; মনের ভিতর কি যে কষ্ট হচ্ছিল তার সে শুধু সেই জানতো। ছোট বেলা থেকে সে জানে তাদের এই বাড়িটাকে , এই রাজবাঁধ গ্রামকে। তার বন্ধু বান্ধব খেলার সাথী চেনা জায়গা সব কিছু। কিন্তু আজ এই সব কিছু ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে দূরে। মনটা ভারী হয়ে আসে সুপ্রতীকের। তিন দিন পর যখন রমেশ বাবু তাদের সেই পৈতৃক বাড়ির গেটে তালা বন্ধ করছেন পাটনার উদ্যেশে রহনা দেওয়ার জন্য। ঠিক সেই সময় সুপ্রতীককে আর যেন ধরে রাখা যায় না। সুপ্রতীক কিছুতেই যাবে না এই বাড়ি ছেড়ে । কান্নায় সে ভেঙে পরে ; রমেশ বাবু প্রায় জোর করেই গাড়িতে তোলেন সুপ্রতীক কে। গাড়ির জানলা থেকে দেখতে থাকে সুপ্রতীক তাদের দোতলা সেই পৈতৃক বাড়ি খানা কে। সেই ব্যালকনি খানা যেখানে বসে রোজ খবরের কাজগ পড়তেন রমেশ বাবু। আসতে আসতে মিলিয়ে যায় সেই বাড়ি সেই ব্যালকনি খানা সুপ্রতিকের চোখের দৃষ্টি থেকে । চোখের জল যেন আরো ঝাপসা করে তোলে সুপ্রতীকের চোখের দৃষ্টি।


তারপর কেটে গেছে দশ দশটি বছর। আর এই দশ বছরে পরিবর্তন ও হয়েছে অনেক কিছু । আজ সুপ্রতীক পড়াশোনা সম্পন্ন করে কর্ম জীবনের যোগদান করেছে। একটা বড়ো

আই টি কোম্পানিতে কাজ পেয়ে ; এখন সে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। তাই রমেশ বাবুর এখনো তাদের সেই পৈতৃক বাড়ির উপর টান থাকলেও ; সুপ্রতীকের স্মৃতিতে রাজবাঁধ গ্রাম ও তাদের পৈতৃক বাড়ির ছবি অস্পষ্ট হয়ে প্রায় মুছে যেতে বসেছে ।


রমেশ বাবু রিটায়ারমেন্টের পর রাজবাঁধ গ্রামে তাদের সেই পৈতৃক বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বললে ; প্রতিবারি সুপ্রতীক ওনাকে চুপ করিয়ে দেন। 

সুপ্রতীক বলে ওখানে আমাদের কি আছে যে তুমি ফিরে যেতে চাও ওখানে। রমেশ বাবু তখন বলেন ; বাবা সুপ্রতীক ওখানে আমাদের কি আছে আর কি জিনিস যে তুমি ভুলে তা একদিন তুমি ঠিকই বুঝতে পারবে । সুপ্রতীক রমেশ বাবুকে বলেন রাখোতো এই সব কথা বরং রিটায়ারমেন্টের পর তোমরা আমার কাছে মুম্বাইয়ে এসে থাকবে। কারণ মুম্বাই তার কর্ম ক্ষেত্রের জন্য সেখানেই সুপ্রতীক পাকাপাকি ভাবে থাকা শুরু করতে হবে। তাছাড়া তার পক্ষে মুম্বাই থেকে পাটনা যাতায়াত করাটাও খুবই অসুবিধার হয়ে উঠছিলো।


সুপ্রতীকের মুখে এমন ধরনের কথা শুনে মনে মনে খুব কষ্ট পায় রমেশ বাবু। এমন কি রমলা দেবীও সুপ্রতীকের হয়েই পক্ষেই মত নেন। নিজেকে বড়ো একা বলে বোধ করেন রমেশ বাবু ।


রমেশ বাবুর রিটায়ারমেন্টের আর বেশি দিন বাকি ছিলো না। তাই সুপ্রতীক রাজবাঁধ গ্রামে রমেশ বাবুর পুরোনো বন্ধু পরিতোষ গাঙ্গুলি কে কল করে ; তাদের ওই পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করার জন্য একটা খরিতদার দেখতে বলেন। এই পরিতোষ বাবুই এই দীর্ঘ দশ বছর ধরে খেয়াল রেখে চলেছে তাদের এই পৈতৃক বাড়ির রমেশ বাবুর অনুরোধে । এই বাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে রমেশ বাবুর চরম অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুপ্রতীক ও রমলা দেবীর যৌথ চাপেই এই পৈতৃক বাড়ি বিক্রির বিষয়ে মত দিয়ে হয় রমেশ বাবুকে ।


তারপর একদিন রমেশ বাবুর বন্ধু পরিতোষ বাবুর ফোন আসে। পরিতোষ বাবু ফোনটা রমেশ বাবুকেই করেন । অনেক দিনের পুরোনো বন্ধুর সাথে কথা বলা আর খবর দেওয়া দুটোই হবে এই ভেবে । পরিতোষ বাবু প্রথমে কুশল মঙ্গল কথাবার্তা শেষ করে আসল কথায় আসেন। পরিতোষ বাবু জানায় তাদের পৈতৃক বাড়িটা কেনার জন্য একজন খরিতদার পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি বলছেন বাড়িটা কিনলে সাতদিনের মধ্যেই কিনবে ; আর ভালো দাম দিতেও উনি রাজি । তাই রমেশ বাবুকে দু একদিনের জন্য আসতে হবে রাজবাঁধ গ্রামে । বাড়ি বিক্রির কার্য সম্পন্ন করার জন্য । রমেশ বাবু শুধু চুপ করে শুনছিলেন পরিতোষ বাবুর সব কথা। পরিতোষ বাবু বলেন ; যিনি বাড়িটা কিনছেন তিনি নাকি মস্ত বড়ো ব্যবসাদার । বাড়িটা ভেঙে নাকি তিনি বড়ো ফ্লাট বাড়ি বানাবে বলছেন। এই কথাটার শোনার পরেই রমেশ বাবুর চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে ওঠে। রমেশ বাবু গম্ভীর গলায় পরিতোষ বাবুকে বলেন ; আমার শরীর ভালোনা তুমি এই বিষয়ে একবার সুপ্রতীককে কল করে কথা বলে নাও , সেই যাবে রাজবাঁধ। এই বলে রমেশ বাবু ফোনটা কেটে দেন।


রমলা দেবী সেই সময় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সবে ঘরে এসেছেন । ফোনটা রাখতেই রমলা দেবী জিজ্ঞাসা করেন রমেশ বাবুকে। শরীর খারাপ বললে যে ; কি হয়েছে তোমার । আর কে ফোন করেছিল এখন ?


রমেশ বাবু বলেন ও কিছু নয়। পরিতোষ ফোন করেছিল ; আমাদের রাজবাঁধের বাড়িটার জন্য একজন ভালো খরিতদার পেয়েছেন। সে নাকি আবার সাত দিনের মধ্যেই কিনতে চায় বাড়ি খানা ; ভালো দাম ও নাকি দিতে চায়। তাই দুদিনের জন্য যেতে বলছে রাজবাঁধ। আমার শরীর ভালোনা তাই সুপ্রতীক কে কল করতে বললাম। ওই গিয়ে সব কাজটা করে আসুক ; তারপর একটু করুন সুরে রমেশ বাবু বললেন " তোমরা তো তাই চাও "।


রমেশ বাবু রমলা দেবী কে বলে দেন ; তিনি যেন সুপ্রতীক কে ফোন করে বলে দেয় রাজবাঁধ গিয়ে বাড়ি বিক্রির কাজটা সম্পন্ন করে আসতে। তারপর চেয়ার থেকে উঠে তিনি চলে যান নিজের ঘরে।


আজ সেই কাজ সম্পন্ন করতেই রাজবাঁধের স্টেশন চত্বরে দশ বছর পর পা পড়লো সুপ্রতীকের। স্টেশন থেকে নেমে বাইরে গিয়ে একটা রিক্সা ডাকলো সুপ্রতীক। রিক্সা ওয়ালা কে কোথায় যাবে বলে দিতে ; সে রিক্সা চালানো শুরু করে। আর সুপ্রতীকের চোখ চলে যায় সামনের রাস্তার দিকে। যতই রিক্সা এগিয়ে যেতে থাকে ; ততই যেন সুপ্রতীকের মন চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। তার স্মৃতির পাতায় যেন ভেসে উঠতে থাকে দশ বছর আগের মুছে যাওয়া দৃশ্য গুলো।


সুপ্রতীক দেখে ; এই রাস্তা দিয়ে বাম দিকে গেলেই আসবে তাদের স্কুল। রোজ পায়ে হেটে স্কুলে যেত সে এই রাস্তা দিয়েই। কিছু দূর যাওয়ার পর রিক্সা ওয়ালাকে থামতে বলে সুপ্রতীক ; রিক্সা ওয়ালা রিক্সা থামিয়ে বলে ওঠে বাবু এখনো অনেকটা পথ বাকি যে। সুপ্রতীক বলে ; না আর দরকার নেই আমি চলে যেতে পারবো। এই যে বললো সুপ্রতীক বললো " আর দরকার নেই আমি চলে যেতে পারবো " তার মানে সুপ্রতীকের সব কিছু পরিষ্কার মনে পরে গেছে।

তাই আজ সেই পরিচিত পথে আবার নিজের পায়েই চলতে চায় সে । মনের আনন্দে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পায়ে হেটে এগোতে থাকে সুপ্রতীক। কিছুদূর যেতেই সামনে পড়লো সুনীল ময়রার দোকান। ভালো মনে আছে রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় তার সব বন্ধুরা মিলে টাকা দিয়ে জিলিপি খেত এখান থেকে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর পড়লো মোর পুকুর ; এই পুকুরে কতই না চান করেছে সে তার বন্ধুদের সাথে। তারপর পুরোনো অনেক লোকজন চিনতে পেরে ডেকে কথা বলতে লাগলো সুপ্রতিকের সাথে ; খোঁজ খবর নিতে লাগলো তার বাবা মার । এই ভাবে ধীরে ধীরে আবার যেন ফিরে আসতে থাকলো সেই দশ বছর আগের সুপ্রতীক। এই ভাবে চলতে চলতে তাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে যায় সে ।


সুপ্রতীক একবার তাকিয়ে দেখে তাদের সেই পৈতৃক দুতলা বাড়িটার দিকে। দশ বছরের গভীর অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন বাড়িটা। বাড়িটাও যেন সুপ্রতীকের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছিলো অনেক কথা । আর দেখতে চাইছিলো এই দশ বছরের জমিয়ে রাখা ব্যথা গুলো । পরিতোষ বাবুর তত্ত্বাবধানে থাকার জন্য ; বাড়িটা পরিষ্কার পরিছন্ন থাকলেও ; এই বাড়ির একাকিত্বের ছাপ কিন্তু স্পষ্ট হয়েই ছিল। সুপ্রতীকের মনে হলো যদি এই বাড়ি কথা বলতে পারতো । তাহলে না জানি কতইনা অভিযোগ জানাতো আজ।


সুপ্রতীকের মনে পরে গেলো এই গেটের সামনে দাঁড়িয়েই একদিন সে এই বাড়ি থেকে না যাওয়ার জন্য কি পরিণামে কান্নাকাটি করেছিল। রমেশ বাবু জোর করে গাড়িতে তুলে ছিলেন তাকে। সেই সুপ্রতীক আজ দীর্ঘ দশ বছরের মধ্যে একবারও আসেনি এই বাড়িতে। তাহলে সেই দিনের ওই কান্না কি মিথ্যা ছিল সুপ্রতিকের ? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে সে। তাপর সুপ্রতীক গেট খুলে বাড়ির উঠানে পৌঁছে যায় । ঢুকেই সে দেখতে পায় তাদের সেই কুয়ো তলা খানা । এখানেই তার মা রোজ তাতে স্নান করতো। সামনের বারান্দার দিকে তাকিয়ে মনে পরে যায় ; যে এই বারান্দার চাতালে বসে তার মা তাকে ভাত খাইয়ে দিতো রোজ স্কুল যাওয়ার আগে। এক ঝলকের জন্য সুপ্রতীক যেন দেখতে পেলো যে তার মা তাকে ওই বারান্দার চাতালে বসে খাইয়ে দিচ্ছে । সে যেন শুনতে পেলো তার মা বলছে " নে বাবা লক্ষি সোনা আমার , তাড়াতাড়ি খেয়ে নে "।


চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে সুপ্রতীকের। যেদিকে সে তাকায় ছেলেবেলার স্মৃতির বাণে বিদ্ধ হতে থাকে সে। এই গোটা বাড়ি ময় ছুটে ঘুরে বেড়াতো সে। যে দিকে সে তাকায় একটা করে দৃশ্য ভেসে উঠে বির্দিন করে তার হৃদয় । তারপর দুতলার ব্যালকনিতে গিয়ে সুপ্রতীক দেখতে পায় সেই আরাম কেদারাটা যেখানে বসে রোজ কাগজ পড়তো তার বাবা। চোখটা যেন ভিজে এলো সুপ্রতিকের ।


সুপ্রতীক দেখে আজ এই বাড়ি ফাঁকা পরে আছে। যেখানে সারাদিন গমগম করতো এই বাড়ি ; সেখানে আজ যেন মুখে কুলুপ টি এঁটে বসে আছে এই বাড়ি । আর চোখের জল বাঁধ নামলো তার। সমস্বরে কেঁদে মুখে হাত দিয়ে সেই আরাম কেদারাতেই বসে পরে সে। খানিক ক্ষণ ধরে কাঁদার পর । পকেট থেকে ফোন বার করে কল করে সে। ফোনের ওপর থেকে রমেশ বাবু বলে ওঠেন ; বলো বাবা সুপ্রতীক। সুপ্রতীক কোনো কথা না বলতে না পেরে শুধু কেঁদে ওঠে। সেই শুনে রমেশ বাবু বলেন কি হয়েছে বাবা আমাকে বলো।


সুপ্রতীক কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে ওঠে ; তুমি ঠিক বলেছিলো বাবা এই বাড়িতে আমার ছেলেবেলাটা রয়ে গেছে , তুমি রয়ে গেছো , মা রয়ে গেছে। এই বাড়ি তুমি বিক্রি করোনা বাবা। সুপ্রতিকের মুখে এই কথা শুনে ; ফোনের ওপর থেকে রমেশ বাবুও বলে কান্না স্নাত গলায় বলে ওঠেন । বাবা সুপ্রতীক ওখানে যে আমার ছেলেবেলাটাও রয়ে গেছে , তোমার বড়ো হওয়ার স্মৃতি রয়ে গেছে , তোমার মায়ের সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি রয়ে গেছে । তাহলে একবার ভাব আমার কত কষ্ট হয়েছিল যখন তোমরা বাড়িটা বেঁচে দেওয়ার কথা বলেছিলে আমাকে। তাই আমি আমার শরীর খারাপের বাহানা করে তোমাকেই পাঠিয়ে ছিলাম রাজবাঁধ।


কারণ আমি জানতাম আমার বিশ্বাস ছিল ওখানে না গেলে বুঝতে পড়তে না যে কি জিনিস তুমি ভুলে আছো এতো দিন ধরে। আমাদের ফেলা আশা দিন ফেলে আসা স্মৃতি ফেলে আসা সময় বড়োই মায়ার হয় বাবা । দূর থেকে তা বোঝা যায় না ; যতক্ষণ না তুমি তার কাছে যাচ্ছো ।


তারপর রমেশ বাবু বলেন বাবা সুপ্রতীক আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছি বাবা । এই শহরে কর্ম জীবনের ব্যস্ততার ভীড়ে জাঁতাকলে পিষে পিষে খুবই ক্লান্ত আমি । আমার শেষ জীবনটা তাই আমাকে ওই মায়ায় ভরা আমাদের পৈতৃক বাড়িতে কাটাতে দাও বাবা । আমাকেও আবার আমার ছেলেবেলার স্বাদ পেতে দাও , আমাকে থাকতে দাও ওই ফেলে আসা মধুর স্মৃতির ভীড়ে । চোখের জল মুছে সুপ্রতীক বলে তাই হবে বাবা , তাই হবে । এই বলে ফোনটা কেটে দেয় সুপ্রতীক ।


ঠিক তার তিন দিন পর একটা ছবি আসে রমেশ বাবুর হোয়াটসঅ্যপে । রমেশ বাবু সেই ছবি দেখে পুনরায় কেঁদে ফেলেন । এইবার কিন্তু সেই কান্না দুঃখের ছিলো না । সেই কান্না ছিল অকথ্য আনন্দের পরিতৃপ্তির কান্না । কারণ রমেশ বাবুর মোবাইলের হোয়াটসঅ্যপে যে ছবিটা এসেছিল সেটা পাঠিয়েছিল সুপ্রতীক । আর ছবিটা ছিলো তাদের সেই পৈতৃক বাড়ির ছবি । সেই বাড়ি দশ বছর আগে ছিল ঠিক তেমনি দেখাছিল এই ফটোতে। সুপ্রতীক এই তিনে বাড়িটাকে পরিষ্কার করিয়ে সারিয়ে রং করে একদম তেমন করে তুলেছ ঠিক যেমন ছিলো সেই বাড়ি দশ বছর আগে । রমেশ বাবু ফোন হাতে চেয়ার থেকে উঠে ফোনের স্ক্রিনের উপর দিয়েই পরম যন্তে হাত বোলাতে থাকেন বাড়িটার ছবির উপর । আর চোখ দিয়ে পরতে থাকে বাঁধ ভাঙা জলের ধারা ।


তারপর আরো একটা মেসেজ আসে রমেশ বাবুর হোয়াটসঅ্যপে । ঠিক বাড়ির ছবিটার নিচে ফুটে ওঠে লেখাটা । তাতে শুধু তিনটি শব্দ লেখা । রমেশ বাবুর চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এসেছিল , তাই লেখাটা পড়তে পারছিলেন না তিনি । চোখের জল মুছে রমেশ বাবু লেখাটা পড়েন । তাতে লেখা ছিলো " কবে আসবে বাবা " । সেই লেখাটা পড়ে রমেশ বাবুর মুখ ভরে ওঠে অকৃত্রিম এক হাসিতে । 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama