STORYMIRROR

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Horror Classics Others

4  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Horror Classics Others

মুক্তি

মুক্তি

7 mins
25

রেল ক্রসিং সংলগ্ন টিনের দু কামরার ঘরে একা বসে বই পড়ছিলো সমাপন। এই দিন পনেরো হলো এই রেল ক্রসিংয়ে গেট ম্যানের চাকরি পেয়ে সে এসেছে এখানে । শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর যাওয়ার পথে কামারকুন্ডু স্টেশনের একটি শাখা ক্রসিং এটা। স্টেশন থেকে একটু দূরে হওয়ার জন্য । এই রেল ক্রসিংটা ছিল বেশ নির্জন। প্রায় সেখানে ১ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জন বসতি ছিলোনা। ফলে এখানে সমাপনের জীবন কাটতো প্রায় নির্বাসনের মতোই। দুই আড়াই ঘন্টা অন্তর অন্তর একটি করে ট্রেন যেত এই ক্রসিং দিয়ে। তখন গেট বন্ধ করে ফ্ল্যাগ হাতে লাইনের পশে গিয়ে দাঁড়াতো সে । এছাড়া বাকি সময়টা গল্পের বই পরেই কাটিয়ে dito সমাপন। 


এখানে এসে পর্যন্ত খুব একা একা লাগতো তার। তাও গেট বন্ধ হলে আটকা পড়া গাড়ির মানুষদের কথা বার্তা শুনে ও চোখের সামনে এতো মানুষের সমাগম দেখে নিজের মনকে সান্তনা দিতো সমাপন। যে সে একা নয়। কিন্তু একদিন সিগনালের গন্ডগোলের জন্য অনেক ক্ষণ ধরে গেট বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল তাকে। আর এই দেরি হওয়ার জন্য আটকে থাকা অন্যান্য গাড়ির লোকেরা অনেক ওকথা কুকথা শোনাতে থাকে সমাপনকে। এই ভাবে যখন মানুষদের চেঁচামেচি তুঙ্গে উঠলো। ঠিক তখন এক লরির ড্রাইভার নেমে এসে গম্ভীর গলায় চিৎকার করে সমাপনের পক্ষ নিয়ে কথা বলে চুপ করিয়ে দিলো সকল কে। সমাপন কৃতজ্ঞ চোখে একবার তাকালো সেই লরি ড্রাইভারটার দিকে। 


তারপরেই ট্রেনের হুইর্শাল শোনা গেলো কাছেই। আর গমগম শব্দ তুলে ছুঁটে চললো ট্রেন। কথা বলার অবকাশ না পেয়ে লরিতে উঠে পড়লো সেই উপকারী মানুষটি। সমাপন গেট খুলে দিতে সব গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো নিজের গন্তব্যে। আর যাওয়ার সময় সেই উপকারী লরি ড্রাইভারটি সমাপনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি ও বন্ধুত্ব পূর্বক হাসি হেসে ছোট্ট একটা সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেলো। 


এই ভাবে নৃত্য দিন যাতায়াতের পথে দেখা হতে হতে সমাপনের সাথে বন্ধুত্ব পূবক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওই লরি ড্রাইভারটির। ওই লরি ড্রাইভারটার নাম হলো সুলেমান। এই রুটেই সে লরি চালাচ্ছে আজ প্রায় ৫ বছর হলো। মাঝে মাঝেই রাত্রি বেলা ফেরার সময় সে সমাপনের সাথে গল্প গুজব করে তারপর বাড়ি ফিরত। দুজনের বয়স সমসাময়িক হওয়ায় বেশ একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। সমাপন ও একাকিত্বের জীবন থেকে মুক্তি পায়।  


একদিন রাত্রি বেলা সময় তখন ওই রাত ১০:৩০টা মতো হবে। এই দিকে সন্ধ্যা ৭তার সময়ই রাত বারোটার মতো নিস্তব্দতা নেমে আসে। সমাপন তখন সবে রাতের খাবার শেষ করে বাইরের উঠানে বাসন ধুতে এসেছে । এমনিতেই এই দিকে সন্ধ্যা সাতটার সময়ই চারিদিক নিঝুম হয়ে যায়। বিরাজ করে এক অপার্থিব নিস্তব্দতা। কিন্তু ওই দিন সেই নিস্তব্দতার মধ্যে একটা ছনছন শব্দ শুনতে পায় সে । ঠিক যেন মেয়েদের হাতের কাঁচের চুরির শব্দ। এখানে এতো রাতে মেয়ে কোথা থেকে আসবে। পুনরায় আবার যখন সেই ছনছন চুরির শব্দ শোনা যায়। এবার বাসন মাজা ফেলে উঠে দাঁড়ায় সমাপন। যেদিক থেকে চুরির শব্দটা আসছিলো। সেই দিকে একবার ভালো করে তাকায় সমাপন। তার চোখে পরে একটু দূরে একটা পরিত্যাক্ত ওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে একটা বছর ২৪ -২৫ এর যুবতী মেয়ে। তার হাতের লাল কাঁচের চুরি চাঁদের আলোয় জলমল করছিলো। হাত নেড়ে সেই মেয়েটি সম্ভবত সমাপনকেই ইশারায় ডাকছিলো। এই দেখে একটু অবাক হলো সমাপন। এতো রাতে মেয়েটি একা মেয়ে হাত নেড়ে ডাকছে। এটা মোটেই শুভ লক্ষন নয়। তাই সমাপন ঘরে ঢুকে ঘরের দরজা খানা ভিতর দিয়ে বন্ধ করে দেয়। 


তার পরের দিন রাতে বাসন ধুতে গিয়ে সেই একই ঘটনা আবার ঘটে। আবার সেই চুরির শব্দ। আর সেই মেয়েটির প্রানপনে হাত নেড়ে সমাপনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা। আজ এই একই জিনিস আবার দেখে সমাপনের মনে নিছক কৌতূহল জাগেমেয়েটির সম্পর্কে। কে মেয়েটি ? আর কি বা সে বলতে চায় ? 


আজ সমাপনও প্রতুত্তরে হাত নেড়ে মেয়েটিকে ইশারা করে। মেয়েটি তখন ইশারায় সমাপনকে সেই ব্রিজের নিচে আসার জন্য বলে। জানিনা সমাপনের কি হলো মেয়েটির সেই কথা সে ফেলতে পারলো না। হাতে একটা টর্চ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো ওই ব্রিজের উদেশ্যে । যদিও চাঁদের আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো তাও সে টর্চটা জেলেই রাখলো। 


সেই ব্রিজের নিচে পৌঁছেতেই সেই টর্চের আলো দেখে মেয়েটি সেই ব্রিজের একটা পিলারের পাশে লুকিয়ে পড়লো। অস্ফুট সুরে মেয়েটি বললো। আলোটা বন্ধ করুন দয়া করে। কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে। সমাপন বললো কিসের বিপদ। আর আপনি এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছিলেন ই বা কেন। এবার চাঁদের আলোয় ভালো করে মেয়েটিকে আপাদমস্তক দেখলো সমাপন। কি অপরূপ তার সৌন্দর্যোতা। যেন চাঁদের আলোকেও সে হার মানায়। যেন উচ্ছল যৌবন মেয়েটির সর্বাঙ্গ দিয়ে উছলে উছলে পরছে। মেয়েটি হয়তো বুঝতে পারে যে সমাপন তার সৌন্দর্যতায় আচন্নন হয়েছে। তাই একটু অবদারের সুরে মেয়েটি সমাপনকে বলে। আপনি আমার একটা কাজ করে দেবেন ? সমাপন একটু বিস্মিত হয়। তারপর আমতা আমতা করে বলে কি কাজ বলুন।  


এবার মেয়েটি সমাপনকে অবাক করে বলে ওই লরি ড্রাইভার সুলেমান আপনার বন্ধু। সমাপন উত্তর বলে হ্যাঁ। কেন আপনি ওকে চেনেন নাকি। উত্তর একটু শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় মেয়েটি বলে হ্যাঁ চিনি । সমাপন বলে তা কিছু দরকার আছে নাকি ওর সাথে আপনার। এই কথা শুনে মেয়েটি একটু মৃদু হেসে বলে ওঠে। দরকার তো ওর সাথে আমার অনেকই আছে। সমাপন বলে আপনারা বন্ধু বুঝি ? মেয়েটি বলে হ্যাঁ , বন্ধুই ছিলাম বটে। এই বলে থেমে যায় মেয়েটি। এবার সমাপন বলে , কি যেন একটা সাহায্যের কথা বলছিলেন আপনি। সেটাতো বললেন না । 


এবার সমাপনের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলতে শুরু করে । সে বলে তার নাম পরমা , এক সময় সুলেমান কে সে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য বেশ কয়েক মাস হলো তার সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছে সুলেমান। এই বলে সমাপনের অত্যন্ত কাছে ঘেঁসে এসে মেয়েটি বলে। আপনি একবার সুলেমান কে এখানে , এই ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে পারবেন। তাহলে আমার খুব উপকার হবে। সমাপন বলে এই কথা , সুলেমান এলেই আমি ওকে বলে আপনাদের মধ্যে সব ঝগড়া মিটিয়ে দেব। তখনি সমাপনের মুখে হাত চাপা দিয়ে মেয়েটি বলে ; খবদ্দার না। আমার নাম আপনি ওর সামনে করবেন না। তাহলে সে আমার কাছে আসতে চাইবে না। এই টুকু দয়া করুন আমাকে। এই বলে নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে পরমা। সমাপন বলে ঠিক আছে আপনি কান্না থামান। আমি আপনার নাম বলবোনা ; আর সুলেমান এলেই ওকে আমি নিয়ে আসব এই ব্রিজের নিচে। এবার আপনি বাড়ি যান অনেক রাত হলো। সমাপনের মুখে এই কথা শুনে নিস্পৃহ ভাবে মৃদু একটু হেসে মেয়েটি বলে "বাড়ি"। হ্যাঁ , ঠিক বলেছেন সত্যি বাড়িতে আমার জন্য সবাই খুব চিন্তা করছে। এই বলে পরমা সেই ব্রিজের পিছনের দিকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় । 


ঠিক তার পরের দিন রাতের বেলা সুলেমান আসে সমাপনের কাছে। এসে বলে বন্ধু কেমন আছো। অনেক দিন পর এলাম আজ জমিয়ে আড্ডা হবে। গল্প গুজব করে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সমাপন বললো চলো ভায়া আজ একটু হেটে আসি। সুলেমান বলে না ভাই আমাকে দেরি হয়ে যাবে। সমাপন বলে চলোনা এই কাছেই একটু হেটে আসি ১০ মিনিট মতো। সমাপনের জোরাজুরিতে রাজি হলো সুলেমান। সুলেমানকে সেই ব্রিজের নিচে নিয়ে গেলো সমাপন। সুলেমান জায়গাটা দেখে কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলো। তারপর সমাপনকে বললো। এখানে কি আছে ভাই , চলো আমরা ফিরি। সমাপন বলে একটু দাড়াও । তারপর সমাপন "পরমার" নাম ধরে ডাকতে থাকে। "পরমা" কোথায় গেলে তুমি ; দেখো আমি সুলেমান কে নিয়ে এসেছি । এই নাম শুনে সুলেমানের মুখ চোখ ভয়ে লাল হয়ে উঠলো। ভয়ভীত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে সমাপনকে বললো। পরমা কে ডাকছো কেন , কে পরমা। সমাপন বলে তোমার বন্ধু পরমা। সুলেমান বলে পরমা বলে আমার কোনো বন্ধু নেই , এখনই চলো এখন থেকে। 


ঠিক তখনি সেই ব্রিজের পিলারের পিছন থেকে বেরিয়ে আসে "পরমা।" কিন্তু আজ তার অন্য রূপ সেই সৌন্দর্যতার কোনো লেস মাত্র নেই। তার দেহের মলিন কাপড় ছিন্নভিন্ন মাথার চুল এলোমেলো। এক পা এক পা করে সুলেমানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বলে আমাকে চিনতে পারছো না সুলেমান। আজ থেকে ২ মাস আগে এই ব্রিজের নিচে আমাকে জোর করে ভোগ করে গলা টিপে চিরদিনের মতো শেষ করে দিয়েছিলে তুমি। এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে কি করে। কি ভেবে ছিলে তুমি আমার হাত থেকে তুমি বেঁচে যাবে। এবার তোমাকেও মরতে হবে। আর কোনো মেয়ের সর্বনাশ করতে আমি দেবোনা তোমায়। এই সব দেখে সুলেমান ছুঁটে পালানোর চেষ্টা করলেও ; তাতে সফল হতে পারলো না । সুলেমান পালানোর আগেই পরমার হাত পৌঁছে যায় সুলেমানের গলা পর্যন্ত। আর ভবলীলা সাঙ্গ হয় সুলেমানের। এই সব দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় সমাপন। জ্ঞান ফিরলে সমাপন দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে "পরমা "। আবার সেই সৌন্দর্যময় রূপে ; ঠিক যেমনটা সে দেখেছিলো গতকাল রাতে । পরমাকে দেখেই একটু আগে ঘটে যাওয়া সব কিছু মনে পরে যায় সমাপনের। ভয়ে আঁতকে উঠে পিছনের দিকে সরে যায় সে। পরমা এবার সমাপনকে বলে। তুমি আমাকে ভয় পেওনা বন্ধু। আমি তুমি আমার উপকার করেছো। আমি তোমার ক্ষতি করবো না। এই সুলেমান আমাকে আজ থেকে দুই মাস আগে রাস্তা থেকে তুলে এনে। আমার সর্বস্য ভোগ করে আমাকে মেরে ফেলে এখনই মাটির নিচে পুঁতে দিয়ে যায় । এই পিলারের নিচেই আছে আমার মৃত দেহ। তাই এই জায়গা ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারিনি। আমার মুক্তি হয়নি। তুমি আমার অনেক উপকার করেছো। আর একটা উপকার করো বন্ধু। আমার বাড়িতে গিয়ে আমার এই অবস্থার কথা জানিয়ে দাও। তাহলে আমি মুক্তি পাবো। এই কষ্টের জীবন আমার আর ভালো লাগছে না। আমাকে মুক্তি দাও বন্ধু আমাকে মুক্তি দাও। এই বলে হওয়ার সাথে মিলিয়ে যায় পরমা। আর একটা হালকা হওয়ার শিসের মতো শব্দ যেন সমাপনের কান ঘেঁসে বলে যায়। ভালো থেকো বন্ধু ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror