ভোদো ডাক্তার
ভোদো ডাক্তার
সকাল থেকে মুসল ধারায় বৃষ্টি পরে চলেছে। বিধাতা যেন আজ সৃষ্টি ভাসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে । আকাশ এমন মেঘাছন্ন হয়ে কালো করে আছে যে সকাল নয়টা তেই যেন অন্ধকার নেমে এসেছে ।
এদিকে গোমড়া মুখে "কে কে কেমিক্যালস" এর গোডাউন ঘরে বসেছিল পরিমল । এই বৃষ্টির জন্য আগে থেকে ঠিক করে রাখা মাল বাহী কর্মচারীদের মধ্যে মাত্র দুজন সময় মতো হাজির হয়েছে । বাকিরা আটকে পরেছে বৃষ্টির এই মহা তাণ্ডবে । কলকাতার লাল বাজারের নিটক এই "কে কে কেমিক্যালস" প্রতিষ্ঠিত কেমিক্যালস কোম্পানি হিসাবে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করে আসছে।
আর সেই সুবাদেই কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে মেডিকেল ক্যাম্পের মতো বড়ো একটা টেন্ডার তারা আদায় করতে পেরেছিল । তাই প্রতিটি ক্যাম্পে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় মেডিসিন ও মেডিকেল ইকুপমেন্ট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের ।
মনে "কে কে কেমিক্যালস" এর।
আর সেই দায়িত্ব পড়েছিল পরিমলের উপর ।
কারণ সেই ছিল এই "কে কে কেমিক্যালস" এর দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার । এই পরিমলের তত্ত্বাবধানেই সব অর্ডারের ডেলিভারি হয়ে থাকে। কিন্তু এই ক্যাম্পের অর্ডার কোয়ান্টিটি বড়ো হওয়ার জন্য ও মেডিকেল কলেজের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পের ডেলিভারিতে স্বয়ং পরিমলকে হাজির থাকার কড়া আদেশে দেয়া হয় "কে কে কেমিক্যালস" এর কর্তৃপক্ষের তফর থেকে।
ক্যাম্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে বেশ কয়েক দিন আগেই । অনেক জায়গা তে আয়োজিত মেডিকেল ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পরিমল দায়িত্ব নিয়ে নিন উপস্থিত থেকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে সঠিক সময় ।
আজকে হুগলি জেলার বন্দিপুর গ্রামে আয়োজিত ডেমিক্যাল ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট ও মেডিসিন পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল তাদের। কারণ পরের দিন থেকেই সেখানে বসবে মেডিকেল ক্যাম্প। তাই আজ যে ভাবে হোক তাদের সেখানে এই ক্যাম্পের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো পৌঁছে দিতেই হবে । কিন্তু এই অঝোর ধারায় বৃষ্টি সব গণ্ডগোল করবে বুঝি এবার । কোনো ভাবে যদি তারা আজ বিফল হয় তাহলে কোম্পানির ইমেজ খারাপ হবে ও আগামী সময় হয়তো এই টেন্ডার তাদের হাতে আর আসবে না । আর এমন যদি ঘটে তাহলে পরিমলের চাকরি যাবে তা অবধারিত ।
এই কথা গুলো মনে মনে ভেবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল পরিমল । একটা গগন ভেদি বজ্রপাতের শব্দে যেন সংবিধ ফিরে পেয়ে চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে পরিমল ।
সামনে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী কর্মচারী দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিমল বলে। এই বৃষ্টি আজ আর কমার না । যে ভাবে হোক আমাদের আজ সন্ধ্যার মধ্যে বন্দিপুর ক্যাম্পে ডেলিভারি পৌঁছে দিতেই হবে । তাই বাকিদের আশার অপেক্ষা না করে তোমরা লরিতে মাল লোডিংয়ের কাজ শুরু করো ।
আমিও তোমাদের সাথে হাত লাগাছি ।
এই কথা বলে মনে মনে একটু হাসলো পরিমল ।
পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নামায় । এই কোম্পানির সুপারভাইজার হয়ে আজ তাকে মজুরদের হাতে হাতে কাজ করতে হচ্ছে ।
যাই হোক কাজ তো শুরু করা হলো ।
যেখানে দশ জন কর্মচারীর এই কাজ করার কথা সেখানে তারা তিন জন মিলে কাজ শুরু করে । কাজের গতি ও ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে পরিমল তাদের লরি ড্রাইভার রতনকে কাজে সাহায্য করার কথা জানায় । রতন রাজি না হতে চাওয়াতে অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের আশ্বাস দিয়ে রতনকেও দলে টেনে নেয় পরিমল ।
এক্সট্রা টাকার কথা শুনে রতনও তাদের হাতে হাতে কাজ শুরু করে ।
এদিকে ঘড়ির কাটা দৌড়তে থাকে ।
বৃষ্টি সত্যি কমলো না ।
তাই বাকি মজুররা আসতে পারল না । তাতে যা হবার তাই হলো ।
যে কাজ সম্পন্ন করতে সময় লাগার কথা দুপুর অব্দি ।
তা সম্পন্ন করতে গড়িয়ে গেল বিকাল । তাই যেখানে বিকালের মধ্যে তাদের মাল ডেলিভারি করার কথা সেখানে তাদের বেড়োতে বেড়োতে বেজে গেলো সন্ধ্যা সাতটা।
ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কর্ণধার ডাক্তার শমিক বেশ কয়েক বার কল করলে পরিমল তাকে রাতের মধ্যে মাল পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ক্ষান্ত করেন এবং বৃষ্টির দোহাই দিয়ে একটু আপলোজি চেয়ে নেয় । যেন সে উপর মহলে কোনো ভাবে কমপ্লেইন না করে ।
কলকাতার রাস্তার একটা বিশেষত্ব ছিল আদিকাল থেকেই।
এমনিতেই কলকাতার রাস্তা ট্রাফিকের জন্য বিশ্বসেরা তো ছিলই । তার উপর বৃষ্টি হলে ট্র্যাফিক জ্যাম যা হয় তাতে অনায়াসে "গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে" নাম তুলতে পারে কলকাতা ।
কেন যে এটা ব্যাপারটা কারোর চোখে পড়ে না তা বুঝতে পারিনা ।
সন্ধ্যা সাতটায় বেরিয়ে সেই কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের সাথে মোকাবিলা করে বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া ডানকুনি হাইওয়ে তে পরতে পরতে ঘড়ির কাটা ঢলে পড়ল রাত নয়টার কোলে ।
তারপর গাড়ি ছুটলো তার সচ্ছল গতিতে । এবার মনটা বেশ খুশি খুশি লাগতে শুরু করলো পরিমলের । এই ভাবে চললে রাত এগারোটার মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে তাদের গন্তব্যে তে ।
সারাদিনের পরিশ্রান্ত খাটাখাটনির জন্য বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল পরিমল ।
আর সেটা স্বাভাবিক বটেই । কারণ এই পরিশ্রমের অভ্যাস তার ছিল না । ড্রাইভারের পাশের আসনে বসার জন্য সুন্দর মিষ্টি যাওয়ার পরশ পেয়ে চোখটা আপনা থেকেই যেন বুঝে এলো তার । গাড়ি তখন নালিকুল হাইওয়ে ছেড়ে এবার ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তায় পরেছে ।
এই কাঁচা রাস্তায় দিয়ে তিন কিলোমিটার গেলে আসবে বন্দিপুরের মেডিকেল ক্যাম্প । হাতের ঘড়ি তখন বলছে রাত সাড়ে এগারোটা । তার মানে আর বেশিক্ষণ না । তাই পরম তৃপ্তির সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখটা ভালোভাবে বুঝিয়ে ফেলল পরিমল ।
কিন্তু বিধাতা হয়তো চাইছিলো অন্যকিছুই ।
কারণ গাড়ি সেই রাস্তায় কিছু সময় এগিয়ে যাওয়ার পরেই । একটা ঝাকুনি অনুভব করে ধড়মড় করে চোখ খুলে নড়েচড়ে বসলো পরিমল ।
দেখে যে গাড়ি থেমে গেছে ; চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ।
ধান মাঠের উপর দিয়ে রাস্তা তাই আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে । দুই দিকে ধূ ধু করছে ফাঁকা বিস্তর ধান জমি রাস্তার উভয় দিকেই ।
মেঘলা আকাশে চাঁদ ঢেকে রাখার জন্য অন্ধকারটা বেশ ভালোই গাঢ় হয়ে উঠেছে।
আধো ঘুম থেকে জেগে উঠে একটা ঘোড় ঘোড় ভাব কাজ করছিল পরিমলের চোখেমুখে । তাই এতক্ষণ ড্রাইভার রতনের দিকে তাকানো হয়নি তার । রতনের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় পরিমল ।
সে দেখলো যে রতন নিজের বুকে হাত দিয়ে ভয়ানক ভাবে হাঁপাচ্ছে । সে দৃশ্য এমনি যেন এখনই তার চোখ গুলো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসবে। যেন মরণ টান উঠেছে তার ।
তখনি মনে পড়ে গেল পরিমলের , হ্যাঁ রতনের তো হাঁপানির সমস্যা আছে । রতনের ওই বিকৃত মুখ দেখে পরিমল ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো ।
রতন তোমার ইনহেলার কোথায় ?
অনেক কষ্টে রতন বলে । বাবু বৃষ্টির জন্য তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে আজ বাড়িতে ফেলে এসেছি ।
এবার কি হবে। মনে মনে ভাবে পরিমলে ?
গাড়ি ভর্তি মেডিসিন তারা নিয়ে গেলেও ইনহেলার কিন্তু তাদের সাথে ছিলো না।
কথায় বলে না , যা তোমার দরকার টা আছে দরিয়া পাড়।
তাই এই খোলা মাঠের মাঝে এতো রাতে কোনো দোকান পাওয়া তো স্বপ্নের কথা।
কি যে হচ্ছে সকাল থেকে কিছুই বুঝতে পারছে না পরিমল।
সে যখন সুপারভাইজার তখন কর্মচারীদের দায়িত্ব ও তো তার।
সত্যি এই বৃষ্টি কি জ্বালাতনে ফেলল আজ পরিমল কে ।
সকালের পরিশ্রমে সে নিজে এতটা কাহিল হয়ে পড়েছে । আর রতন তো হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও তারই মতো সমান পরিশ্রম করেছে । তার তো কষ্ট আরো বেশি ।
তাই সে মানা করেছিল আমাকে লোডিংয়ের কাজে না নামার জন্য । এই দোষ তো আমারই ।
মনে মনে নিজেকে একটু অসহায় বোধ করলো পরিমল ।
কিন্তু সে কি করবে এখন , এই ফাঁকা রাস্তায় আলো পর্যন্ত নেই।
সে মেডিসিন শপ পাবে কি ?
তাদের মেডিসিনের মধ্যেও সব থাকলে ইনহেলার তো নেই । কোন কিছু না ভেবেই লরি থেকে নিচে নেমে পরে পরিমল । ওই অন্ধকারের মধ্যেই কপালের উপর ভরসা করে একটু আসার আলোর উদ্দেশে।
গাড়ি থেকে নিচে নেমে চারিদিকে একবার ভালো করে তাকালো পরিমল । নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না তার । চারিপাশে ফাঁকা মাঠ ছাড়া আর কিছুই নেই । পরিমল বুঝে গেলো যে কিছু সাহায্য পাওয়ার আশা নেই এখানে । তাই যা করার তাকেই করতে হবে এখন ।
তাই হতাশ হয়ে রতন কেমন আছে দেখার জন্য গাড়ির দিকেই চলল পরিমল ।
এই টুকু সে বুঝে গিয়েছিলো যে এখানে যা করার তাকেই করতে হবে। কিন্তু গাড়ির দিকে যাওয়ার পথে একান্ত অত্যন্ত দৈব ক্রমে সে একটা আলোর উৎস দেখতে পেলো ।
সেই আলো দেখে সত্যি মনের কোন ক্ষীণ আসার আলো জাগলো পরিমলের ।
সেই আলো যেন নিকষ কালো আকাশের বুকে একটা নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে ।
সত্যি এ ছিল সম্পন্ন অপ্রত্যাশিত । পরিমল দেখলো কাছেই একটা দু চালার ঘর এবং তার বারান্দায় উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ।
চোখের ভুল ভেবে পরিমল দুই চোখ ভালো করে মুছে আবার তাকিয়ে সেই উজ্জ্বল আলোকে ভালো করে দেখলো ।
সত্যি বলতে সে আশা করেনি । আর একটু আগেই সে ভালো করে দেখেছে চারিদিক । কিন্তু কোনো আলো সে দেখতে পায়নি ।
যেন পরিমলকে অসহায় অবস্থায় দেখে কেউ জ্বালিয়েছে এই আলোর।
পরিমল মন কে বোঝালো হয়তো অন্ধকারে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার জন্য পরিমল লক্ষ্য করেনি সেই আলোর উৎস কে। শুধু তাই না সেই দু চালার ঘরের সামনে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল পরিমলের । যা ওই উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে জানান দিচ্ছে তার অক্ষর বার্তা ।
আর তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে " ভোদো ডাক্তারের চিকিৎসালয় " ।
পরিমল সেই সাইনবোর্ড পরে নিজের অজান্তেই একবার চোখ দুটো দুই হাত দিয়ে ভালো করে মুছে নিলো । সে ভুল দেখছে না তো ।
না ভুল তো না এই তো পরিষ্কার লেখা আছে " ভোদো ডাক্তারের চিকিৎসালয় " ।
মনে ডাক্তার খানা !
নিজের মনেই বলে উঠলো পরিমল ।
কিন্তু রাতেও ডাক্তার খানা খোলা কটা বাজে তখন সেই সব মাথায় ছিল না পরিমলের । সেই ডাক্তার খানার দেখা পেয়ে সে দৌড়ে গিয়ে পৌঁছে গেলো সেই চিকিৎসালয়ের খোলা দরজার সামনে ।
একটা দু চলার ঘরে নিয়ে ছিল এই ডাক্তার খানা ; সামনে মাটির দাবা ওয়ালা বারান্দা । আর সেই ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরের আলো বাইরে বেরিয়ে দরজার মুখ সহ গোটা দাবা বারান্দা আলোকিত করে রেখেছিল ।
দরজার সামনে দাড়াতেই ঘরের ভিতর থেকে একটা গম্ভীর অথচ শান্ত কন্ঠ ভেসে এলো
ভিতরে আসুন ;
পরিমল কিছু বুঝে ওঠার সময় পেলো না । সে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে দেখলো বছর আসির এক বৃদ্ধ বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে । আর তার সামনে টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখা অজস্র হোমিওপ্যাথি আসুধের বাক্স ।
পরিমল কিছু বলার আগেই সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ ভোদো ডাক্তার বলে ওঠে ।
আমি সব জানি ; তাই সময় নষ্ট করে কিছু বলার দরকার নেই ।
কথা শেষ করেই টেবিলের উপর থেকে একটা ওষুধের সিসি তুলে নিয়ে পরিমলের হাতের দিকে উঁচিয়ে দিয়ে ভোদো ডাক্তার বলল ।
তাড়াতাড়ি গিয়ে এই পুরো শিশির লিকুইটা তোমার ড্রাইভারকে খাইয়ে দাও । বেশি দেরি করো না ।
পরিমল হাতে ওষুধের সিসি টা শক্ত করে ধরে আমতা আমতা গলায় টাকার কথা তুলতেই ; ভোদো ডাক্তার বিরক্ত প্রকাশ করে ভয়ানক বাজখাই গলায় শাসন করার ভঙ্গিতে বললেন । তাড়াতাড়ি যাও আর গিয়ে আসুধটা খাইয়ে দাও ।
না হলে দেরি হয়ে যেতে পারে ।
পরিমলের মানসিক অবস্থা তেমন কিছু ভালো ছিলনা । তাই সে আর কোনো কিছু বোঝারও চেষ্টা করলো না ।
আর কোনো কথা না বলে পরিমল দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ভোদো ডাক্তারের ঘর থেকে । আর গাড়িতে পৌঁছে সে আগে রতনকে সেই মেডিসিন টা খাইয়ে দিলো ।
তার কিছু সময় পর একটু স্বাভাবিক হলো রতন । গাড়ির সিটে বসেই পরিমলের দিকে তাকিয়ে রতন বললো তুমি আমাকে বাঁচালে পরিমল দা।
কিন্তু এটা তুমি কি দিলে আমাকে ?
এতো তাড়াতাড়ি এতটা ভালো অনুভব করছি । সামান্য হাঁপানিতেও আমি ইনহেলার নেওয়ার পরও ঘণ্টা খানেক সময় লাগে স্বাভাবিক হতে । আজ তো ভেবেছিলাম আমি আর বাঁচবো না ।
তখনও পরিমল যেন ঘোড়ের মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে ছিল । তাই রতনের কোনো কথার উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতিতে ছিলনা সে । তাই নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পরিমল বললো ।
তুমি এবার গাড়ি চালাতে পারবে রতন।
গাড়ি চলতে শুরু করল মিনিট কুড়ির মধ্যে তারা পৌঁছে গেলো বন্ধিপুর মেডিকেল ক্যাম্পের সামনে।
মাল খালাস করতে করতে ভোরের আলো ফুটে গেলো। ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারবাবু ডাক্তার শমিক পথের প্রতিকূল অবস্থা ও রতনের শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনে খুব বেশ ব্যস্ত হয়ে পরেন এবং তৎক্ষণাৎ রতনকে পরীক্ষা করার জন্য ক্যাম্পের ভিতর নিয়ে যান।
বেশ খানিক্ষন রতনকে পরীক্ষা করার পর বাইরে বেরিয়ে পরিমল কে ডেকে ডাক্তার শমিক জিজ্ঞাসা করলেন ।
আচ্ছা পরিমল বাবু পরীক্ষা করে রতনের মধ্যে তো আমি অসুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না। আপনি যেমন হাঁপানির কথা বর্ণনা করলেন ; তাছাড়া রতনের মুখে যা শুনলাম । তার উপর ইনহেলার ছিল না ; সেখানে তো তৎক্ষণাৎ হস্পিটালাইস করতে হতো রতনকে । কিন্তু ওকে দেখে তো কোনো ব্লকেট আছে বলে মনে হলো না। শুধু তাই না ; তার থেকে বড়ো কথা হলো ওর যে কোনোদিন হাঁপানি ছিল তাও মনে হলো না আমার ।
কিন্তু রতনের মুখ থেকে শুনলাম আপনি একটা মেডিসিন দিয়েছিলেন ওকে । আর সেটা খেয়ে নাকি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে রতন ।
কি ছিল সে মেডিসিন ?
যা খেয়ে অমন অবস্থা থেকে রতন ক্ষনিকেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো । ওই হাঁপানির টান যা ইনহেলার কাবু করতে পারেনা সেখানে খানিকক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলো রতন ।
ব্যাপারটা কি বলুনতো ? সন্দেহের সাথে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার শমিক ।
আসলে ডাক্তার শমিক নিজেও খুব অবাক ও হতচকিত হয়ে উঠেছিল এই কাণ্ড দেখে । ডাক্তার শমিক উত্তরের অপেক্ষায় এক ভাবে পরিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য একটু অস্বস্থি বোধ করে আমতা আমতা করে পরিমল উত্তর দেয় ।
আসলে আপনাদের ওই ভোদো ডাক্তার আমাকে এই ওষুধটা দিয়েছিলেন ।
এই কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বিস্ময় কণ্ঠে ডাক্তার শমিক বললেন ।
কি ?
কি বললেন ; ভোদো ডাক্তার ।
পরিমল কথার উত্তরে বলে ;
হ্যাঁ ।
ভোদো ডাক্তারের চিকিৎসালয় বড় সাইভোর্ড দেখেই তো আমি ছুটে গেলাম । এতো রাতে যে উনি সেখানে ছিলেন সত্যি তা রতনের ভাগ্য । না হলে ধূ ধূ ধান মাঠের মাঝে যে আমি যে কি করতাম কে জানে ।
তার উপর এই ওষুধের জন্য কোনো টাকাও নেননি ভোদো ডাক্তার বাবু ।
ডাক্তার শমিকের চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে বদলে যেতে দেখে একটু হতভম্ব হলো পরিমল । সেই মুখের পরিবর্তনে আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের ছায়া দেখে অবাক হলো পরিমল । ডাক্তার হয়ে আরেক ডাক্তারের নাম শুনে এমন আকস্মিক ভাব পরিবর্তনের কোনো কারণ খুঁজে পেলো না সে ।
পরিমল কিছু প্রশ্ন করার আগেই ডাক্তার শমিক তীর বেগে মেডিকেল ক্যাম্পের তাবুর মধ্যে চলে গেলো ।
পরিমল ভারি অবাক হলো ।
ব্যাপারটা কি ?
কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না পরিমল।
গ্রামের মানুষের খুব ভোরে উঠে পরে । তাই গ্রামের কিছু মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিল সেই সময় ও পরিমলের সাথে ডাক্তার বাবুর সব কথা বার্তাই তারা শুনছিল । তখন সেই গ্রামবাসীর মধ্যে একজন প্রবীণ ব্যক্তি পরিমলের দিকে এগিয়ে এসে বলল । বাবু আপনি ঠিক বলেছেন কাল রাতে আপনাকে ওষুধ ভোদো ডাক্তারি দিয়েছে ।
আর এই ডাক্তার বাবুর আপনার কথা শুনে ওই ভাবে চলে যাওয়ার কারণ হলো । আজ ডাক্তার বাবুর মনের অবিশ্বাসের কালো চাদরটা আপনার মুখে ভোদো ডাক্তারের কথা শোনার ফলে এক ধাক্কায় সরে গেছে ।
আপনাকে বলি শুনুন ।
আসলে এই ভোদো ডাক্তার আজ থেকে অনেক বছর আগে মারা গেছে । আমাদের বন্দীপুর গ্রামের এই ভোদো ডাক্তারের চিকিৎসালয় ছিল ঠিক আপনি যেখানে দেখেছেন সেখানেই । এই গ্রামের গরিব মানুষদের কাছে সেটা ছিল ভগবানের ঘর।
এই ভোদো ডাক্তার তার সারা জীবনটা গরীব দুস্থ মানুষদের সেবার জন্যই অর্পণ করে দিয়েছিল । তার হাতের চিকিৎসায় বড় বড় প্রাণহানি কারক রোগও সেরে যেতো । শহর থেকে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও ভোদো ডাক্তার এই গ্রামেই রয়ে যায় শিকড়ের টানে । তার মধ্যে টাকার কোনো লালোসা ছিল না । শুধু ছিল সেবা করার এক আগোঘ ইচ্ছা । তাই গ্রামের মানুষ ভগবানের চোখে দেখত ভোদো ডাক্তারকে ।
কিন্তু একদিন এই গ্রামে এক ভয়ঙ্কর মোড়কের প্রকোপ পরে । রাত দিন এক করে সেবা করতে করতে শেষে নিজেই সেই রোগের আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ভোদো ডাক্তার । তাও কোনো গ্রামবাসীকে মরতে দেয়নি তিনি মোড়কের কবলে ।
সব থেকে অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটে । ভোদো ডাক্তারের মৃত্যুর সাথে সাথেই ওই ভয়ানক মোড়ক ও যেন বিদায় নেয় এই গ্রামের থেকে । তার মৃত্যু যেন জীবন দান করে যায় এই গ্রামকে । ভোদো ডাক্তারের মৃত্যুতে গ্রামের মানুষও খুব হতাশ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ।
ভোদো ডাক্তার মারা গেলেও এই বন্দীপুর গ্রামে জীবন মৃত্যুর কোনো সংশয় দেখলে আজও দেখা দেয় আমাদের ভোদো ডাক্তার । তাই সময়ের কাটা এগিয়ে গেলেও আমাদের বন্দীপুর গ্রামে দরকার পড়েনি কোনো বড় হাসপাতালের বা কোনো মেডিকেল ক্যাম্পের ।
এই কথা গ্রামের ছোট থেকে বড় সবার মুখে মুখে প্রচলিত । আর এই ডাক্তার বাবুও গ্রামের মানুষের মুখে এই ভোদো ডাক্তারের কথা শুনে কৌতুক ও হাসিতে ফেটে পড়েছিল একদিন । আমাদের গ্রামবাসীদের মুখে ভোদো ডাক্তারের কথা অত্যন্ত অতিরঞ্জিত ও ভ্রান্ত বলে মনে হয়েছিল ওনার । তাই আজ সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একজন বাইরের মানুষের মুখে ভোদো ডাক্তারের উপস্থিতির কথা শুনে তার অবিশ্বাসী মন উত্তেজনায় উথাল পাথাল হয়ে উঠেছে । তাই উনি গ্রামবাসীর চোখে চোখ না মেলাতে না পেরে তাবুর মধ্যে পালিয়ে বাঁচলেন ।
তাই বলছি বাবু আপনি ঠিক দেখেছেন । ভোদো ডাক্তার এই গ্রামের ধন্নন্তরী । তার কাছে এই গ্রামের মানুষ তার আপনজনের সমান । তাই মৃত্যুর পরেও সে করে চলেছে তার সেবার কাজ । যারা তাঁকে দেখেছেন তারা তার সাহায্য পেয়েছেন । আর তাদের মাঝেই বেঁচে আছেন তিনি ।
আমরা গ্রামবাসীরা শুধু একটাই কথা জানি , জীবন মৃত্যুর ডাক যখন ভোদো ডাক্তার এসে তখন ।
পরিমল তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রতনের দিকে তাকিয়ে একটা কথা মনে করে । পরিমলের কানের সামনে শুধু একটাই কথা ধ্বনিত হতে থাকে ।
তাড়াতাড়ি গিয়ে তোমার ড্রাইভারকে অসুধটা খাইয়ে দাও ।
তাই তো তিনি কি করে জানলেন রতনের কথা । সব কিছু গুলিয়ে যেতে থাকলো পরিমলের।
অস্ফুট কন্ঠ পরিমল বলে উঠলো " ভোদো ডাক্তার " তোমায় প্রণাম ।
2707 word
31/10/2025 আক্ষরিক সাহিত্য পত্রিকাতে পাঠিয়েছি ।

