STORYMIRROR

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Romance Classics Others

3  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Romance Classics Others

প্রকৃতির পরশ

প্রকৃতির পরশ

9 mins
26


সময়টা ছিল আমার কলেজের প্রথম দিন । বেণীমাধব স্যার বাংলা ক্লাস নিতে এলেন । আর্টস কমার্স সাইন্স সব স্ট্রিমের ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসে বসেছিলাম সবাই । সেই দিনের ওই ক্লাসটি ছিল ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে পরিচয় করার । তাই সেই দিন বাংলার প্রোফেসর বেণীমাধব বাবু খুবই ধীরে সুস্থে রোল নম্বর অনুযায়ী ছাত্রদের নাম ডাকতে থাকেন । আর যাদের ওনার মনে ধরতে থাকে তার সাথে কিঞ্চিৎ গল্প করতে থাকেন নাম ডাকার ফাঁকে । 


আর সেই দিন উনি নাম ডাকার সময় দুই জন ছাত্র ছাত্রীর সাথে কথা বলেন তাদের নামের আক্ষরিক অর্থ নিয়ে । কারন ওই নাম দুটো বেণীমাধব বাবুর মনে ধরেছিল বড়ই । 


প্রথমে এক ছাত্রীর নাম ওনার খুব ভালো লাগে । সেই ছাত্রীর নাম ছিল প্রকৃতি । নামটা শুনে উনি বলেন , বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো তোমার মা " প্রকৃতি "। 


তার কিছু বাদেই আরো এক ছাত্রের নাম ডাকার সময় বেণীমাধব বাবু বলে ওঠেন , বাহ্ খুব সুন্দর তো তোমার নাম বাবা । সেই ছাত্রটিরনাম ছিল পরশ । ছেলেটি বেণীমাধব বাবুর মুখে এই শুনে একটু লজ্জিত হয়ে বসে পড়ল । 


তারপর নাম ডাকা সম্পন্ন হলে দুদে বাংলার ভাবুক প্রফেসর বেণীমাধব বাবু সেই ক্লাস রুমে বসে নিজের খেয়ালেই একটি কথা বলে উঠলেন । প্রকৃতি ও পরশ , দুইয়ে মিলে "প্রকৃতির পরশ"। খুব ভালো লাগলো নাম দুটো । এই বলে বেণীমাধব বাবু হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে সেই দুই ছাত্র ছাত্রীর দিকে । সেই দেখে ওই ক্লাসের সবাই হাসি মুখে তাকায় প্রকৃতি ও পরশের দিকে । পরশ আগাগোড়াই ছিল একটু লাজুক ধরনের , তাই সে লজ্জায় কোনো দিকে তাকাতে পারলো না । মাথা নিচু করে বসেই রইলো । তাই সে দেখতেও পেলো না , যে সেই ক্লাস রুমে হাজার জোড়া চোখের ভিড়ে এক জোড়া চোখ লজ্জা মাখা হাসি হাসি মুখে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পরশের দিকে । আর সেই চোখের দৃষ্টি যে কি বলছিল সেটা আর বোঝার অপেক্ষা রাখে না । আর সেই এক জোড়া চোখ ছিল "প্রকৃতির" । 


বেণীমাধব বাবুর একটি কথায় সেদিন সেই ক্লাস রুমে অঙ্কুরিত হয়েছিল দুটি হৃদয়ে ভালোবাসার কুঁড়ি । 


দুটি হৃদয় বলার কারণ , সেদিন শুধু একা প্রকৃতির মুখেই দেখা যায়নি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি , তার সাথে পরশের হৃদয়েও বেজে উঠেছিল ভালোবাসার ডঙ্কা। 


ক্লাস শেষ হয়ে গেলে প্রকৃতি ও পরশ চলে যায় পৃথক পথে । কিন্তু তাদের বন্ধুরা বেণীমাধব স্যারের বলা "প্রকৃতির পরশ" কথাটা নিয়ে সমানে রাগাতে থাকে তাদের । 


তবে একটা কথা বলতেই হবে প্রকৃতি আর পরশের এই ভালোবাসার পর্বে যেন ঈশ্বর ও যোগদান করে ছিলেন সমান তালে । যেনো ঈশ্বরও চাইতেন যে তাদের ভালোবাসার কুঁড়ি পরিস্ফুট হোক ।


কারণ পরের দিন কলেজে গিয়ে পরশ যখন তার পলিটিক্যাল সাইন্স অনার্সের রুমে গিয়ে বসে । তখন যেন নিতান্তই দৈব ক্রমেই সেই রুমে এসে হাজির হয় প্রকৃতি । মনে মনে পরশের হৃদয় প্রাণ পণে চাইছিল যাতে প্রকৃতির সাথে তার আবার দেখা হয় । তাই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে চোখের সামনে প্রকৃতিকে দেখে পরশের ভাবভঙ্গি পাল্টে গেলো । অবাক ও লাজুক চোখে সে তাকিয়ে রইলো প্রকৃতির দিকে। 


আসলে লাজুক ছেলেরা যেমন নিজের মুখে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না । ঠিক তেমনি এমন কোনো অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়লে তাদের মুখ চোখ কথা বলে অনেক বেশি । যেমন সকাল থেকে পরশ মনে প্রাণে চাইছিল প্রকৃতিকে দেখেতে। কিন্তু হঠাৎ প্রকৃতি তার সামনে এসে পরায় , পরশ লজ্জায় এমনি অস্বস্তিতে পড়েছে যে তার মুখ এখন বলে দিচ্ছে তার মনের কথা । তাই প্রকৃতিরও বুঝতে অসুবিধা হলনা পরশের মনের কথা। প্রাণচঞ্চল ও বন্ধুত্ব পূর্বক একগাল হাসি নিয়ে প্রকৃতি এগিয়ে যায় পরশের দিকে । 


আর দুজনেই পলিটিক্যাল সাইন্স অনার্সের ছাত্র ছাত্রী হওয়ায় , প্রতিদিন দেখা হওয়ারও আর কোনো অসুবিধা রইলো না তাদের । এই ভাবে এতটা কাছাকাছি এসে পরায় তাদের মনের মধ্য ভালোবাসার 

কুঁড়ি ডানা মেলার সুযোগ পেলো । 


প্রকৃতি ও পরশ হয়ে উঠলো একে অপরের ভালো বন্ধু । কিন্তু তাদের বন্ধুরা তাদের আর বন্ধু হিসাবে থাকতে দিলো না বেশি দিন । কারণ তাদের বন্ধুরাও তাদের দুজনের মনের কথা বুঝতে পেরে ক্রমাগত রাগাতে থাকতো । "প্রকৃতির পরশ" বলে বারে বারে তাদের ঠেলে দিত কাছাকাছি । উভয় পক্ষই লজ্জায় কেউ কাউকে কিছুই বলতে পারতো না মনের কথা । এই দিকে গোটা কলেজ জানতো যে প্রকৃতি ও পরশ একে অপরকে খুব ভালবাসে । তাই তাদের কাছের বন্ধুরা তাদের দুজনের নাম দিয়েছিল পিপি ( প্রকৃতি পরশ ) । 


এই ভাবেই দিন কাটছিল ভালই । প্রকৃতি আর পরশ সব সময় কলেজে একসাথে থাকতো , সব কাজ একসাথে করতো। কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতোনা বেশি দিন । এই ভাবে চলতে চলতে একদিন প্রকৃতি মুখ ফুটে বলেই ফেলল তার মনের লুকিয়ে রাখা ভালোবাসার কথা । 


পরশ যেন ঠিক এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল এতদিন ধরে । প্রকৃতির মুখে সেই প্রেম নিবেদনের কথা শুনে পরশ কেঁদে ফেলল । তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জলের ধারা । তারপর আকুল ভাবে প্রকৃতির হাত দুটো শক্ত করে ধরে পরশ বলল ; তোমার এই হাত আমি কোনোদিনও ছাড়বো না , কোনোদিনও না । সেই কথা শুনে শুধু মাত্র একটু মুচকি হাসলো প্রকৃতি। 


তারপর থেকে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা পরিবর্তিত হয় ভালোবাসায় । আরো কাছাকাছি এসে দুটি মন । সব সময় পরশ চেষ্টা করত প্রকৃতিকে খুশি রাখার । এমনকি প্রকৃতির পাশে থাকার জন্য ; পরশের বাড়ি থেকে তার বাবা সপরিবারে কাশ্মীর যাওয়ার সময় পরশ জোর জবরদস্তি ঝগড়া করে একা থেকে যায় বাড়িতে । কারণ প্রকৃতিকে ছাড়া সে একদিনও থাকতে পারবে না । এমনি পর্যায়ে সে ভালোবাসতো প্রকৃতিকে । 


কিন্তু এতো দিনের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্কে ভুলে পরশ এমনি মায়া গ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে ; প্রকৃতির বিষয়ে কতো গুলো জিনিস সে খেয়াল করতে ব্যার্থ হয়েছিল । 


কারণ সেই প্রথম দিন ক্লাস রুমে বেণীমাধব স্যারের "প্রকৃতির পরশ" কথাটা বলার পর পরশের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে ছিল প্রকৃতি । সেদিন কিন্তু ভালোবাসা শুধুই ফুটে উঠেছিল প্রকৃতির চোখে মুখে , হৃদয়ে কিন্তু না । 


প্রথম পলিটিক্যাল সায়েন্সের ক্লাসে প্রকৃতি কিন্তু পরশের মুখের ভাবভঙ্গিটাই লক্ষ্য করেছিল , পরশের হৃদয়টা না । 


এমনকি যেদিন প্রকৃতি তার মনের কথা জানালো পরশ কে , তখন প্রকৃতির ভালোবাসার কথা শুনে পরশ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও। সেই কান্না কিন্তু প্রকৃতির হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি । 


প্রকৃতির হাত ধরে পরশ কান্নারত অবস্থায় সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা দিলেও । প্রকৃতির হাত কিন্তু পরশের জলস্রতা চোখের দিকে ওঠেনি সেই জল মোছার জন্য । তার পরিবর্তে প্রকৃতি শুধু একটু হেসেছিল মুচকি ভাবে। 


সেই মুচকি হাসির মধ্যে লুকিয়ে রাখা প্রকৃতির অনেক না বলা কথার ইঙ্গিত তখন বুঝতে পারেনি পরশ । 


কিছু দিন বাদেই ছিল প্রকৃতির জন্মদিন । পরশ অনেক দিন ধরে তার নিজের পকেট মানি জমিয়ে জমিয়ে একটা সুন্দর প্ল্যান করে রেখেছিল প্রকৃতির জন্মদিন সেলিব্রেট করা নিয়ে । 


প্রকৃতির শরীর খারাপের জন্য সে কদিন কলেজে আসতে পারেনি । কিন্তু পরশ তার এক কাছের বান্ধবীর মারফত প্রকৃতিকে খবর পাঠায় । সে যেন জন্মদিনের দিন কলেজে অবশ্যই আসে। 


উক্ত সেই দিন সকালে উঠে পরশ সকাল সকাল চান করে মন্দিরে পূজো দিয়ে আশীর্বাদের ফুল ও প্রসাধ নিয়ে পৌঁছে যায় কলেজে । বাকি সব বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে সমস্ত প্রস্তুতি করে ফেলে সে প্রকৃতির জন্মদিনের সারপ্রাইজের। 


অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও প্রকৃতি আসছেনা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পরে পরশ । শুধুই আকুল চোখে সে চেয়ে থাকে কলেজের গেটের দিকে , এই বুঝি এলো প্রকৃতি । অনেক অপেক্ষার পর যখন প্রকৃতি কলেজের গেট দিয়ে ঢুকলো। তখন প্রকৃতিকে দেখে পরশের আনন্দ উচ্ছাসের চরম সীমায় উঠে পরক্ষণেই আবার বেদনায় ভূমি স্পর্শ করলো । 


পরশ দেখলো প্রকৃতি গেট দিয়ে ঢুকছে। আর সাথে একদল ছেলেমেয়ে আমোধ প্রমোদ করতে করতে আসছে তাকে ঘিরে । আর প্রকৃতির সারা মুখে কেক মাখানো মাথায় অভ্র , পুরো দস্তুর সেলিব্রেশনের মজায় তারা আচ্ছন্ন ছিল। আর যে ছেলেটি প্রকৃতির গলা জড়িয়ে অন্তরঙ্গ ভাবে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে সে যে শুধু প্রকৃতির বন্ধু না সেটা বুঝতে পরশের বাকি অসুবিধা হলো না । 


শুধু পরশের মনে ছিল কিছু প্রশ্ন । কিন্তু সেই প্রশ্ন করার আগেই পরশ তার উত্তর সেখানেই পেয়ে গেলো। 


প্রকৃতির সাথে আসা উল্লসিত দলটা এসে দাঁড়াল পরশের ই কাছে । প্রকৃতি সহ সবার মুখেই যেন এক অদ্ভূত ও বেঙ্গ মেশানো হাসি । আর সেই দলের সবার কৌতুক দৃষ্টি ছিল পরশের দিকেই। 


এবার প্রকৃতির গলা জড়িয়ে থাকা ছেলেটি পরশের দিকে তাকিয়ে দুপা এগিয়ে এসে প্রকৃতিকে উদ্যেশ্য করে বলে উঠলো । এই হলো তবে তোর গিনীপিক ; এই কথা বলে হাসিতে ফেটে পড়ল ওই ছেলেটি সহ ওই দলের উপস্থিত বাকি সকলে । হাসতে হাসতে ওই দলের মধ্যে একজন বলে উঠল , ভুল বলে ফেললি ভাই রাজা "এটাতো মুরগি রে" । 


এবার সেই ছেলেটি যে প্রকৃতির গলা জড়িয়ে ছিল , সে পরশের হাতে পুজোর ফুল প্রসাদ দেখে বলল । প্রকৃতি ওই দেখে তোর জন্য এই মুরগীটা মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে এনেছে । নে এবারতো এই বলোধটাকে আসল কথাটা বলে দে । বেচারা যে কিছুই বুঝতে পারছে না । 


পরশ এবার অনেক কষ্টে প্রকৃতিকে প্রশ্ন করলো । প্রকৃতি এই সব কি ? এরা কে , কি সব বলছে এরা ? 


প্রকৃতি এবার বেশ শক্ত কন্ঠে উত্তর দিলো । আসল কথা হলো আমি তোমাকে ভালো বাসিনা পরশ । এমন ভাবে প্রকৃতি কোনোদিন কথা বলেনি পরশের সাথে । আজকের প্রকৃতি যেন তার পরিচিত প্রকৃতি নয়  । 


পরশের হতভম্ব মুখ দেখে প্রকৃতি বলে ওঠে । এতো অবাক হওয়ার কিছুই নেই । আসলে আমি রাজাকে ভালোবাসি । 


রাজার সাথে আমার একটু ঝগড়া মতো হয়েছিল । রাজা বলেছিল ও ছাড়া নাকি আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড্ জুটবেটা । তাই ওকে জ্বালানোর জন্যই আমি তোমার সাথে প্রেমের নাটক করছিলাম । জানতাম যে রাজা এই খবর পেয়ে বেশি দিন এটা সহ্য করতে পারবে না ।

আমি জানতাম আজ আমার জন্মদিনের দিন রাজা আমার থেকে দূরে থাকতে পারবে না । আজ রাজা আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে । তাই তোমার সাথে প্রেমের নাটকটাও এখানেই শেষ হলো । 


তাদের এই কথোপকথনে গোটা কলেজ জড়ো হয়েছিল সেখানে । আর এই সব কথা শুনে সবাই মিলে হাসতে থাকে পরশের দিকে তাকিয়ে । আর পরশের পায়ের নিচের মাটি ভিজতে থাকে পরশের চোখের জলে । পরশের মত লাজুক ছেলেও আজ এত অপমানেও পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই মুখ নিচু করে ।

হাসতে হাসতে সবাই সেখান থেকে চলে গেলে। সেখানেই মাটির উপর হাঁটু গেরে বসে পড়ে পরশ ।ঠাকুরের পুজোটা হাতে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে সে । 


কলেজের শুরুর দিনটা মনে পরতে থাকে তার । "প্রকৃতির পরশ" এই কথাটা বলার সময় হয়তো বেণীমাধব বাবু বুঝতেও পারেননি । ওনার এই কথার ফলাফল কি হতে পারে ।  


তাই যা ফল হওয়ার ছিল তাই হলো । প্রকৃতির তো আর পরশের দরকার নেই । তাই শুধু প্রকৃতিই থাক । বিদায় নিক পরশ । 


"মা আমি জানি আমার চলে যাওয়ার পর আমার প্রিয় গল্পের বই গুলোতে তুমি নিশ্চয়ই হাত বুলোবে । তাই আমার সব কথা এই চিঠিতে লিখে রেখে গেলাম এই বইয়ের পাতায় । 


তোমরা সবাই ভালো থেকো । 


বিদায় নিলো "প্রকৃতির পরশ" 


চিঠিটা হাত থেকে মাটিতে পরে যায় পরশের মায়ের হাত থেকে । 


আর সমাপ্ত হয় "প্রকৃতির পরশ" ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance