STORYMIRROR

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Drama Classics Others

3  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Drama Classics Others

অরণ্যা

অরণ্যা

7 mins
23


ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজটার উপর ঝুঁকে পড়ে ক্রসওয়ার্ড পাজেলটারদিকে তাকিয়ে ছিল অরণ্যা ও তার বাবা ঋষিকেশ বাবু। এইটা তাদের বাবা মেয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা মজার নেশাও বলা যেতে পারে । 


বন্ধু বান্ধব বলতে তেমন কেউ ছিল না অরণ্যার । ছোটবেলা থেকেই একা থাকতেই বেশি পছন্দ সে । তাই ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত তার বন্ধু বর্গ বলতে কিছু নেই । তার বাবাই তার জীবনে সব থেকে বড় বন্ধু । তাই যতক্ষণ সে তার বাবার সঙ্গে থাকতো। ততক্ষণ তার মুখে হাসি আনন্দ উচ্ছাস উদ্ভাসিত হয়ে থাকতো ।


রবিবার বাড়িতে খবরের কাগজ দিয়ে গেলেই অরণ্যা ও তার বাবা ঋষিকেশ বাবু হাতে পেন্সিল নিয়ে বসে পড়তেন সেই দিনের কাজগের ক্রোসওয়ার্ড পাজেল সমাধান করার জন্য । 



কালক্রমে সেই দিন তাদের ড্রয়িংরুমে রাখা পেন্সিল খানা জানিনা কিভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে গা ঢাকা দিলো । অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরেও সেই  পেন্সিল বাবাজিকে আর উদ্ধার করা গেলো না । অবশেষে সেই পেন্সিলের অন্তর্ধানের দুঃখ কে মেনে নিয়ে ঋষিকেশ বাবু অরণ্যাকে তার ঘর থেকে একটি পেন্সিল নিয়ে আসতে বলে ; সেই পাজেলের সমাধান উদ্ধারে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। আর অরণ্য তার ঘরের দিকে পা বাড়ায় পেন্সিল আনার জন্য ।


নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে পেন্সিল বার করতে গিয়ে অরণ্যা একটা ফোল্ড করা সাদা কাজগ দেখতে পায় তার ব্যাগের ভিতর । 


এই কাগজ টা তো সে রাখেনি ব্যাগের মধ্যে। তাহলে এই কাগজটা কি ভাবে এলো এখানে। অবাক হলো অরণ্যা । কৌতুহলের সাথে ফোল্ড করা কাগজটা খুলে ফেলে অরণ্যা , আর চকিতেই হতবাক হয়ে যায়  কাগজটার দিকে তাকিয়ে । 


অরণ্যা দেখে সেই কাগজে নিপুণ হস্তে আঁকা রয়েছে তারি একটা ছবি । কলমের জাদুতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই ছবি । ছবিতে অরণ্যা বসে আছে ক্লাস রুমে আর তার মুখে খেলা করছে এক অকৃত্রিম হাসি । 


ছবির ঠিক নিচে লেখা আছে , আমি তোমাকে এই ভাবেই দেখতে চাই " বন্ধু " ।


এক ভাবে তাকিয়েই রইলো অরণ্যা সেই ছবিটার দিকে । নিজের ছবি দেখে যেন আপনিই মোহিত হলো সে । 


অন্য দিকে অরণ্যার দেরি দেখে তার বাবা ডাক দিলেন । কিরে কোথায় গেলি তুই ? পেন্সিলটা নিয়ে আয় ।তাড়াতাড়ি করে সেই কাগজটা আবার ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে পেন্সিল নিয়ে চলে গেলো অরণ্যা । 


সেই দিন অরণ্যা তার বাবার সাথে একসাথে বসে ক্রসওয়ার্ড পাজেল  সমাধান করলেও  , মনটা যেন তার একটু আনমনাই রইলো সারাটা দিন । 


আর সারাদিন ধরে সে ভাবলো এই কাগজে আঁকা ফটো খানা তার ব্যাগে কি ভাবে এলো , আর কেই বা রাখলো । এমনি না না বিধ প্রশ্নের ভিড় ঘিরে ধরলো তাকে ।


রাতে শোবার আগে ছবিটার দিকে আবারও একবার তাকালো অরণ্যা । পরম যত্নে সে একবার হাত বুলিয়ে দিল ছবিটার উপর । সত্যিই সে এই ভাবে মন খুলে হাসেনি কতদিন । তাই বারবার চেয়ে চেয়ে সে দেখতে থাকলো তার সেই হাসি মুখের আঁকা ছবিটার দিকে । 

এই ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেলো । যে ওই ছবির তুলির টান অরণ্যার মনেও দাগ কেটেছে গভীর ভাবে ।



তবে অরণ্যা ভালোই বুঝতে পারলো ; যে তার কলেজেই কেউ তার অলক্ষে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়েছে কাগজে আঁকা তার এই ছবি খানা ।


এরপর এই ভাবেই চলতে থাকে অরণ্যার সেই সাদা কাগজে আঁকা তার ছবির প্রাপ্তি ।  অরণ্যার অজান্তে না জানি কি ভাবে তার ব্যাগের মধ্যে রেখে দিত কেউ এক টুকরো সাদা কাগজ । আর সেই সাদা কাগজে আঁকা থাকতো অরণ্যারই ছবি । এমনি জাদু ছিল সেই পেন্সিলের টানে ; যেন সেই সাদা কাগজেও জীবন্ত হয়ে উঠতো অরণ্যার সেই ছবি । এমনি ছিল সেই ছবির সৃষ্টি কর্তার হাতের জাদু । 


এই ছবি মাঝে মধ্যেই পেতে থাকে অরণ্যা । কখনো ছবিতে সে ক্লাস রুমে বসে , নয়তো লাইব্রেরি তে পড়ায় মগ্ন । এই ভাবে নানান ভঙ্গিতে অপরূপ সুন্দর হাতের টানের ছবি একের পর এক পেতে থাকে অরণ্যা।  শুধু অরণ্যা এটাই জানতো না ; কে এই ভাবে ছবি  আঁকছে তার আর কেনই বা আঁকছে । 


আর প্রতিবারেই ছবির নীচে লেখা থাকতো  " ভালো থেকো বন্ধু" ।


এই ভাবে ছবি আঁকার পালা চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস । আজও অরণ্যা জানে না যে কে এই ভাবে এঁকে চলেছে  তার ছবি । আর সেই ছবি ক্রমাগত উপহার দিয়ে চলেছে তাকে । আসতে আসতে যেন সেই অজানা অগ্যত মানুষটার প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পরেছিলে অরণ্যা । এখন সে নিজে প্রতীক্ষায় বসে থাকতো কখন তার সেই অজ্ঞাত বন্ধু পাঠাবে তার আঁকা ছবি । 


সারা কলেজে খুঁজেও অরণ্যা জানতে পারেনি সেই মানুষটি কে । যে তার অলক্ষে প্রতিনিয়ত নজর রেখে চলেছে তার উপর । তাও কোনো ভাবেই অরণ্যা পৌঁছতে পারতো না ; তার সেই বন্ধুর কাছে ।


যেহেতু কলেজ কোনো বন্ধু ছিল না অরণ্যার । তাই ক্লাস না থাকলে কলেজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে ফাঁকা সময়টা কাটাতো সে ।


এমনি একদিন অফ পিরিয়ডে অরণ্যা কলেজের লাইব্রেরি রুমে ঢুকেই দেখতে পায় ; যে লাইব্রেরিয়ান একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে বেশ জোরের সাথে অনেক কথা শুনিয়ে বকাবকি করে যাচ্ছেন । আর সরল সাদাসিধে ছেলেটা এক মনে মুখ বুঝে শুনে যাচ্ছে লাইব্রেরিয়ানের সব কথা । 


লাইব্রেরি রুমে সম্ভবত অরণ্যা কে ডুকতে দেখেই ওই ছেলেটি হাত দিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটা সাদা কাগজকে যেন অতর্কিতে ঢেকে ফেলল।

আর এই দৃশ্যটা কিন্তু নজর এড়ালো না অরণ্যার।


এবার মন দিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কথা গুলো শুনতেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো অরণ্যার কাছে ।

আসলে লাইব্রেরিয়ানের ওই ছেলেটির উপর এতো চিৎকার করার কারণটা হলো ; যে ছেলেটি

লাইব্রেরি রুমে বসে ছবি আঁকছিল । আর এটাই তার অপরাধ যে সেই ছবিটি ছিল একটি মেয়ের । তাই লাইব্রেরিয়ান ছেলেটিকে এতো বকাঝকা করছিল । 


এই সব কিছু দেখে শুনে অরণ্যার কেমন যেন একটু অদ্ভূত লাগলো ব্যাপারটা । ছেলেটি লাইব্রেরিতে বসে একটি একটি মেয়ের ছবি আঁক ছিল ; অরণ্যা কে আসতে দেখে সেই ছেলেটি বোকা খেতে খেতেও হাত দিয়ে আড়াল করলো টেবিলে পরে থাকা ছবিটাকে । এদিকে বিগত কয়েক মাস ধরে অরণ্যা পেয়ে চলেছে একের পর এক তার ছবি । 


এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে একে একে দুই করতে বেশি সময় লাগলো না অরণ্যার ।


এদিকে লাইব্রেরিয়ান সেই ছেলেটিকে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলে । অরণ্যা পরক্ষণেই এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাতে চাপা দিয়ে রাখা কাগজটা তুলে নিল নিজের হাতে। আর সেই কাগজের দিকে একবার চেয়ে তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে লাইব্রেরিয়ান স্যারকে বলল । 


স্যার ক্ষমা করবেন আসলে আমিই ওকে এই ছবিটা আঁকতে বলেছিলাম ; তাই ও ছবিটা এঁকেছে আমারই কথায় । তাই দয়া করে আপনি ওকে আর কিছু বলবেন না । 


লাইব্রেরিয়ান স্যার অরণ্যাকে বড়ই স্নেহে করতো । তাই অরণ্যার অনুরোধে এই বারের মতো ক্ষমা করে দেন সেই ছেলেটিকে । 


 এই সব কান্ড দেখে ওই ছেলেটি কিন্তু সেই ভাবেই লজ্জায়  মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কারণ আজ সে ধরা পরে গেছে অরণ্যার কাছে । আর অরণ্যা যে খুব সিরিয়াস ধরনের মেয়ে সেটা জেনেই সে কখনো নিজের হাতে অরণ্যার আঁকা ছবি গুলো তার হাতে দিতে পারেনি । অরণ্যা কে অন্তর থেকে ভালোবেসেই সে তার অজান্তে ছবি গুলো রেখে দিতো অরণ্যার কাছাকাছি ; আর নিজেকে রাখতো গোপনে ।


তাই আজ হাতে নাতে ধরা পরে গিয়ে অপরাধীর মতো চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো সে । সে জানতো না যে অরণ্যা কি ভাবছে তার বিষয়ে , এই দ্বিধা দ্বন্দ্বে যেন আরো বেশি নুইয়ে পরে  সেই ছেলেটি ।


অরণ্যা এবার তাকায় সেই ছেলেটির দিকে । ছেলেটির নিষ্পাপ চোখের ভাষায় বুঝি পড়ার চেষ্টা করছিল সে । এবার অরণ্যা টেবিল থেকে সেই সাদা কাগজটা তুলে নিয়ে সেই ছেলেটির হাতে দিয়ে এক মুখ অকৃত্রিম হাসি এনে বলে । ছবিটা তো অসম্পূর্ণ বয়ে গেলো "বন্ধু" । এই ছবিটা কি আমাকে সম্পূর্ণ করে এঁকে দেবে তুমি।


অরণ্যার মুখে এই কথা শুনে অবাক হয়ে যায় সেই ছেলেটি । ছেলেটির নিষ্পাপ চোখে গড়িয়ে পরে জলের ধারা । অরণ্যা ওই ছেলেটির মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলে ওঠে ; আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে না তোমায় । 


তারপর ছেলেটির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে অরণ্যা তার কানে কানে বলে আমি কি " বন্ধু হতে পারি তোমার" ।


তারপর দুজনে মিলে একসাথে হেসে ওঠে । আর সারাজীবন সেই হাসি অক্ষুন্ন রয়ে যায় অরণ্যার মুখে ।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama