রক্ষাকর্তা
রক্ষাকর্তা
আজ অনেক দিন পর ঋতুকা দিদির সাথে দেখা হলো আদিত্যর । ভীষণ ব্যস্ত আদিত্য ঋতুকা দিদি কে চিনতে পারলে ও, ‘কেমন আছো ’ ‘কি করছো ’ রকমের কিছু সাধারণ প্রশ্ন করেই কাটানোর চেষ্টা করছিলো । একটা দরকারি ফোন আসার কথা আছে আদিত্যর চাইছিলো ও না বেশিক্ষন চলুক এই কথোপকথন । কিন্তু হঠাৎ ঋতুকা দিদির একটা অদ্ভুত প্রশ্নে একটু থমকে গেলো আদিত্য । ঋতুকা দিদি চলে যাচ্ছিলো , যাবার পথে হঠাৎ ঘুরে বললো , তোর বয়স কত হলো আদিত্য ? যুবক আদিত্য নিজের বয়স লুকোতে খুব একটা চাই ও না । সরাসরি বললো ২৫, কেন বলো তো ? তাহলে দাদুর শেষ ইচ্ছা টা পূরণ করার সময় ও এসে গেছে আদিত্য । দাদু র কথা মনে পরতে হঠাৎ ই বেশ খানিকটা অন্যমন্যস্ক হয়ে গেলো আদিত্য । হঠাৎ মনে পড়লো দাদুর সেই শেষ দিন গুলোর কথা , রাগ করে ছিল আদিত্য দাদুর উপর , তার মেনে চলা কিছু নিয়ম কানুন এর উপর । তার জীবন এর শেষ ২ মাস দেখা করেনি আদিত্য দাদুর সাথে । কিন্তু মনে মনে আজ ও সে দাদু কেই নিজের আইডল বলে মানে । মেনে চলে দাদু এর শেখানো সব রকম এর শিক্ষা কে । দাদুর সাথে ঋতুকা দির একটা ভীষণ ভালো রিলেসন ছিল । ঋতুকা দি আদিত্য দের নিজেদের কেউ নয় , শুধু মাত্রা দাদুর জন্য ই একসময় সে ভীষণ কাছের হয়ে গেছিলো আদিত্যর । আর দাদুর শেষ জীবন এ ঋতুকা দি এ ছিল এক মাত্রা সঙ্গী । “আদিত্য , কি হলো ?”, ঋতুকা দির কোথায় হঠাৎ সম্বিৎ ফিরলো আদিত্য র । বললো কি ছিল দাদুর শেষ ইচ্ছা ? ঋতুকা দি জানালো দাদু আদিত্য কে কিছু কথা জানাতে চেয়েছিলো , যেটা শুধু আমাকে বলে গেছিলো , কথাটা হয়তো আজ তোমার কাছে সে রকম ইম্পর্টেন্স পাবে না , কিন্তু দাদু কে দেয়া কোনো শর্ত পূরণ না করতে পারলে সত্যি আমার খুব খারাপ লাগবে । তাই বলতে চাই । আদিত্য খুব করুন স্বরেই বললো , কি কথা ঋতুকা দি ? এর পর ঋতুকা দি যা বললো সেটার আসল রহস্য জানতে গেলে আদিত্য র দাদু কে চেনা আর ঋতুকা দির সাথে আলাপ হবার ইতিহাস জানা ভীষণ দরকার ।
দাদুর সাথে ঘুরে বেড়াতে বরাবর ই ভালো লাগতো আদিত্যর । জীবন এর সব সমস্যার ই সঠিক সমাধান যেন সে দাদুর কাছেই পেত | আদিত্যর বাবা মা দুজন এই কাজ করতো , আদিত্য কে সময় বরাবর ই তারা খুব কম ই দিতে পারতো । তাই আদিত্যর বন্ধু , সঙ্গী যা ই ছিল শুধু দাদু । প্রতিদিন অন্ততঃ ২ বার করে সে দাদু কে ফোন করতো , আর সব ফোনের শেষেই আবদার থাকতো তাড়াতাড়ি আসার জন্য । কলকাতার তথাকথিত জনবহুল জায়গাতেই ফ্লাট কিনেছিলো আদিত্যর বাবা মা । নিজেদের অফিস ও সেখান থেকে খুব কাছেই ছিল । আদিত্য কে ও কলকাতা বেশ বড় স্কুল এ ভর্তি করে দিয়েছিলো তারা । স্কুল বাস করে প্রতিদিন স্কুল এ যেতে মজাই পেট আদিত্য । কিন্তু তাও কোথায় যেন একটু ফাঁক থেকেই যেত , যা আদিত্য কে দাদুর দিকে ভীষণ আকর্ষণ করতো । আসলে আদিত্য যে স্বপ্ন দেখতো বিশাল মাঠ , তার চার পাশে পুকুর , কত পাখির ডাক , সেখানে ভীষণ খেলায় ব্যস্ত আদিত্য কে । দাদু কিছু টা হলে ও আদিত্যর এই স্বপ্ন পূরণ করতো । দাদু এলে রোজ মর্নিং ওয়াক যাওয়া হতো, কত গল্প হতো , সাথে থাকতো ফুটবল খেলা । যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলতো আদিত্য , দাদুর সাথে ঘুরতে ঘুরতেই জীবন টাকে নতুন করে ভাবতে শিখতো সে । এরকম ই এক দিন মর্নিং ওয়াক এ গিয়ে ই ঘটেছিলো সেই ঘটনা ।
অন্যান্য দিনের মতোই মনের অজস্র প্রশ্ন নিয়ে দাদুর সাথে কথা বলছিলো আদিত্য । আর প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর পুরোপুরি বুঝতে না পারা অব্দি দাদু কে প্রশ্ন বানে অস্থির করে দিত সে । র ততোধিক ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিতো দাদু । প্রতিদিন ই কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতো আদিত্য , তারপর ভীষণ গভীর এ চলে যেত দাদু নাতির সেই আলোচনা । আর ফেরার সময় থাকতো দাদুর সেই সব বাণী যে গুলো লিখে রেখে সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে ভীষণ মন চাইতো আদিত্যর । সে দিন এর আলোচনা টা শুরু করেছিল আদিত্য ই । আগের রাতে বাবা মা এর ভীষণ ঝগড়া প্রতক্ষ্য করেছিল আদিত্য , তাদের অদ্ভুত এই জীবন যাত্রায় তারা ভীষণ খুশি বলেই এতো দিন জানতো আদিত্য , কাল ই হঠাৎ আবিষ্কার করলো সেটা সত্যি নয় । তাদের সেই আচরণ নিতে না পেরে আদিত্য অনেক রাত অব্দি জেগে ছিল কিছুতেই ঘুম আসছিলো না তার । আজ দাদু না ডাকলে মর্নিং ওয়াক যাওয়া ও হতো না । তাই দাদুর কাছে নাতির প্রথম প্রশ্ন ধেয়ে এলো এই ঝগড়া নিয়ে ই । র দাদুর উত্তর দেবার কৌশল থেকে এটা পষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো যে দাদু যেন তৈরি ই ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ।
নাতি : ঝগড়া কেন হয় ?
দাদু : ঝগড়া হলো এক রকম মনের অনুভূতির প্রকাশ দাদুভাই । কথা বলা ,খাওয়া ,ঘুমোনোর মতো এটা ও খুব স্বাভাবিক ঘটনা । শুধু এর প্রকাশ টা একটু অন্য রকম হয় ।
নাতি : এ কিরকম অনুভতি দাদু যাতে এক জন অন্যের ক্ষতি করতে চাই ?
দাদু : ভালো করে যদি ভাব দাদুভাই , মানুষের জীবন এ সাধারণত চার রকম অনুভূতি কাজ করে । ভালোবাসা , রাগ , ভয় , আর লোভ । এর মধ্যে শেষ এর তিন অনুভূতি মানুষ কে দিয়ে কি করাতে পারে বলা খুব মুশকিল । যদি রাগ এর কথাই বলি , যখন ছাত্র রা ক্লাস এ খুব দুষ্টমি শুরু করে , তখন মাস্টারমশাই খুব রেগে যান , র তাতে ভয় পেয়ে পুরো ক্লাস কিন্তু শান্ত হয়ে তার কথা শোনেন । তখন এই রেগে যাবার অনুভূতি কিন্তু ভালো কাজেই লাগলো । আবার এই মাস্টারমশাই যদি রেগে গিয়ে কোনো ছাত্র কে ভীষণ মারে , তখন কিন্তু তার রাগ টা অপরাধ হয়ে গেলো ।
নাতি : তাহলে বুঝবো কি করে কখন রাগ করা উচিত আর কখন নয় ?
দাদু : এই প্রশ্নের উত্তর তো সরাসরি দেয়া সম্ভব নয় দাদুভাই । এটা তোমাকে নিজেকেই বুঝতে হবে । আমি শুধু তোমাকে পথ দেখতে পারি ।
দাদুর উত্তর এ কোনো গল্পের শুরুর স্বাদ পেয়ে যেতেই , আবদার জুড়লো আদিত্য
নাতি : একটা উদাহরণ দাও দাদু আমি ঠিক বুঝে নেবো ।
হেসে ফেললো আদিত্যর দাদু , হারাধন চক্রবর্তী , স্কুল টিচার হিসাবে ভালোই নাম ছিল হারাধন বাবুর , টিচারী চলে যাবার পর এই নাতির সাথে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি । তাই তো বারে বারে দৌড়ে আসা এই কলকাতায় ।
দাদু : ঠিক আছে তোমাকে একটা গল্প বলছি দাদুভাই , হিন্দু পুরান মতে বলে দেবতারা হচ্ছে শান্ত আর ভালোবাসার প্রতীক , সেরকম অসুর রা হচ্ছে হিংসা বা রাগ এবং ঘৃণার প্রতীক । আর এই দেবতা দের দেবতা দেবাধিদেব মহাদেব ছিলেন দেবতা এবং অসুর দু জন এর ই ভগবান । তাই পুরান মতে বলে , রাগ এবং ভালোবাসা ২ টো কেই সমান ভাবে স্থিতিশীল রাখতে নাকি এক মাত্র তিনি ই পারতেন । এহেনো মহাদেব এর রাগ নিয়ে ২ টি ঘটনা কথিত আছে , যেখানে তিনি অন্যায় দমন করেছেন আবার কোথাও নিজে অন্যায় করে তা স্বীকার করেছেন এবং তা থেকে মুক্তির উপায় ও বাতলেছেন ।
নাতি : কি গল্প দাদু বলো ।
দাদু : একটি তে তিনি নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছেন প্রজাপতি দক্ষ কে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে , যেখানে তিনি অন্যায় কে শেষ করেছিলেন । অন্যদিকে তার এই রাগ নিজের ছেলে গণেশ এর মুন্ডচ্ছেদন করে দিলেও , তিনি নিজের হঠাৎ করে ফেলা অন্যায় কে স্বীকার করে অন্য রূপে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গণেশ এর জীবন ।
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ কিছু দেখে থেমে গেলো দাদু , যেটা আদিত্য র একেবারেই পছন্দ হলো না । কি হলো দাদু বলো । কোনো উত্তর পেলো না সে দাদুর কাছ থেকে । দাদু নাতির গল্প এতো সুন্দর একটা জায়গায় ছিল , সেখান থেকে হঠাৎ ছেদ পড়ায় বেশ বিরক্তি ই হলো আদিত্য । আর এক বার দাদু কে খোঁচাতে যাবে , এমন সময় দাদু নিজেই বলে উঠলো ,
দাদু: দাদুভাই এ গল্প নয় তোমাকে পরে বলা যাবে , মনে হছে আজ অন্য কিছু করার দরকার পরবে । তারপর একটু থেমে বললো তোমাকে এতদিন বলতাম , জীবন এ বিচিত্র পরিস্থিতিতেই মানুষের আসল পরীক্ষা হয় , মনে আছে তো ?
নাতি : তা তো মনে আছে দাদু । বিচিত্র পরিস্তিতেই মানুষ কতটা তার সাহস , সততা এবং শক্তির প্রদর্শন করতে পারে , তার উপর বিচার করেই একটা মানুষ এর চারিত্রিক দৃঢ়তা তৈরি হয় ।
সব কিছুই যেন খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলতো দাদু , তাই দাদু না বলা অব্দি আদিত্য কখনো ই বুঝতে পারবে না কেন দাদু গল্প ছেড়ে হঠাৎ এসব কথা বলতে শুরু করলো । যাই হোক , দাদু কে এরকম সিরিয়াস হতে সে আগে ও দেখেছে , এই সময় দাদু একটু কম কথা বলে । তাই চুপ চাপ দাদু র পিছন পিছন যেতে লাগলো আদিত্য । দাদু প্রশ্ন করলো , দাদুভাই তুমি উঁচু পাঁচিল এক লাফে টপকাতে পারবে ? প্রশ্ন টা অদ্ভুত লাগলে ও আদিত্য বললো কতটা উঁচু ? দাদু বললো “ধরে নে তোর মাথার সমান পাঁচিল ।” আদিত্য এমনিতেই ক্যারাটে তে এক্সপার্ট , লাফাতে ও অনেকটাই পারে সে , তাই গর্বের সাথেই দাদু কে জানালো সে পারবে ।
তারপর দাদু বললো যা বলছি চুপ চাপ শোন , কোনো প্রশ্ন করিস না , শুধু জেনে রাখ সামনের যে মেয়ে টিকে দ্রুত পায়ে যেতে দেখছিস ও বিপদে পড়েছে , কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না । বিপদের উৎস টা এখনো বুঝতে পারছিনা , মেয়েটি নিরাপদে বাড়ি যেতে পারে কিনা সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য । আর যদি বিপদ হয় তোর সাহায্য আমার লাগবে ।
কিরকম সাহায্য ?
দাদু জানালো ২ রকম সাহায্য লাগতে পারে , কিন্তু ২ টো ক্ষেত্রেই আমি তোকে ডাকবো তারপরেই তুই আসবি । শুধু হাতে ২ টো যতটা পারিস বড় সাইজ এর ইঁট নিয়ে থাকিস । আর এই পাঁচিল এর পিছনে এ থাকবি , আমি ডাকলেই চলে আসবি ।
একটা অদ্ভুত এনার্জি অনুভব করতে লাগলো আদিত্য । কিন্তু দাদু কেন এতো টা ভাবছে এই মেয়ে টি কে নিয়ে সেটা সে বুঝতে পারলো না । মেয়ে টিকে সে প্রতিদিন ই দেখে , আজ ও দেখছে কিন্তু আশ্চর্য্যজনক কিছু তার চোখে পড়লো না । দাদু যখন বলছে নিশ্চই কিছু দেখেছে তাই বলছে । কিছু প্রশ্ন না করে চুপচাপ পাঁচিল এর পিছনে চলে এলো সে । মেয়ে টিকে আদিত্য চেনে সামনের গলিতেই থাকে সে । খুব নিরীহ ভাবেই হেঁটে যাচ্ছিলো সে । কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়ছিলো না আদিত্য র । হঠাৎ কি মনে হলো পিছনে ফিরে দেখলো দাদু নেই । এতো তাড়াতাড়ি দাদু কোথায় চলে গেলো বুঝতেই পারলোনা সে । এখন দাদু কে ডাকা টা ও যাবে না । দাদু যতক্ষণ না তাকে ডাকছে ততক্ষন তার পাঁচিল এর পিছন থেকে মেয়ে টিকে দেখা টাই কাজ । সেটাই মন দিয়ে করতে লাগলো সে । মেয়ে টি হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে , বিভিন্ন ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করছে । আদিত্য এর থেকে ভালোই বড় হবে মেয়েটি । কোনো দিন ই সামনে থেকে ভালো করে মেয়ে টিকে দেখেনি সে , আজ ও তাকে পিছন থেকে দেখছে , তাই মেয়ে টি সুন্দরী বা কতটা ভালো দেখতে অনেক চেষ্টা করে ও মনে করতে পারলো না আদিত্য । এই ভাবে প্রায় ১০ মিনিট এর উপর কাটার পর যখন আদিত্য বিরক্ত হতে সবে শুরু করেছে , হঠাৎ দেখলো ১ টা সাইকেল ২ টো ছেলে যেন মেয়ে টাকে কোনো ভাবে নজর এ রাখছে । হঠাৎ করে দেখলে এক দম ই বোঝা যাবে না , কিন্তু যেহেতু আদিত্য অনেক্ষন ধরে দেখছে তাই সন্দেহ টা মনে দানা বাঁধলো । একটু পরে সেটা একদম প্রতিষ্ঠিত হলো যখন সাইকেল টি সবার নজর এড়িয়ে কিন্তু ধীরে ধীরে মেয়ে টির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো । দাদুর সন্দেহ যে সত্যি কিছু একটা ঘটতে চলেছে মেয়েটির সাথে সেটা বুঝতে পারছিলো আদিত্য । এই সময় দাদু পাশে থাকলে খুব ভালো হতো , আদিত্য সব বুঝে ও কি করবে বুঝতে পারছিলো না । দাদুর কড়া নির্দেশ আছে না ডাকলে যেন সে কিছু না করে ।
আদিত্য দেখলো সাইকেল টা এবার একটু দ্রুত এগিয়ে গেলো , মেয়েটির খুব কাছে গিয়ে সাইকেল চালানো ছেলে টি মেয়ে টিকে ডাকলো তারপর কিছু একটা বলছিলো । মেয়েটির চোখ মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো সে বেশ রাগ দেখাছে ছেলেটির প্রতি । রাগারাগি যত বাড়ছে পিছন এর ছেলে টি যেন পকেট থেকে কিছু বার করছে । আদিত্য কিছুতেই বুঝতে পারছিল না এই সময় ই দাদু কোথায় গেলো । কি করা উচিত তাও সে বুঝতে পারছিলো না । এমন সময় সে দেখলো রাগারাগি খুব বড় আকার ধারণ করেছে , অত সকালে রাস্তা ফাঁকা থাকায় কেউ তেমন সেটা দেখছিলো না একমাত্র আদিত্য ছাড়া । এর পর ই ঘটলো সেই মারাত্মক ঘটনা যার জন্য আদিত্য একেবারেই প্রস্তূত ছিল না । ঝগড়া হতে হতে হঠাৎ পিছন এর ছেলে টি একটা বোতল বার করে মেয়ে টির দিকে ছুঁড়তে গেছিলো , ঠিক সেই সময় কথা থেকে যেন একটা বিশাল বড় থান ইঁট পিছনের ছেলেটির মাথায় বিশাল জোরে লাগলো , এরকম হঠাৎ আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে বোতল তো ছিটকেই গেলো , আর সে গিয়ে পড়লো পাশের পুকুর এ । হঠাৎ করে নিজের বন্ধু কে এরকম হাবুডুবু খেতে দেখে সাইকেল থাকা ছেলে টি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো । সে সাইকেল টা ফেলে পালাবে না বন্ধু কে বাঁচাবে বোঝার আগেই আরও দুটো বড় বড় থান ইঁট তার মাথায় আর বুকে এসে পড়লো । তাল সামলাতে না পেরে সাইকেল সমেত সে ও গিয়ে পড়লো পাশের পুকুর এ । র তখন ই আদিত্য শুনতে পেলো দাদুর গলা, আদি তাড়াতাড়ি আই । পাঁচিল টপকে মেয়ে টির কাছে যেতে কয়েক মিলিসেকেন্ড নিলো আদিত্য । দাদু ততক্ষন এ মেয়ে টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । দাদু কে দেখলো পরে যাওয়া বোতল দিকে খুব কড়া দৃষ্টি তে দেখতে । এই বোতল এ কি আছে সেটা আদিত্য বুঝতে না পারলে ও মেয়ে টি যে ভয়ানক কোনো বিপদ হতে পারতো এই বোতল এ থাকা লিকুইড টা থেকে , সেটা আদিত্য ভালো করেই বুঝতে পারছিলো । দাদু হুকুম করলো , আদি মেয়ে টিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আই । র মেয়ে টিকে বললো , কোনো ভয় নেই মা , আমি তোমার সাথে পরে বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবো , এখন আমার এই নাতির সাথে ঘরে চলে যাও । এখুনি এখানে অনেক লোক চলে আসবে , আমি চাইনা এই ঘটনা তে তুমি জড়িয়ে এটা কেউ জানুক । বাড়ি যাও মা , কাল ই আমি তোমার কাছে যাবো ।
এই প্রথম মেয়ে টির মুখ সামনে থেকে দেখলো আদিত্য , বেশ ভালো দেখতে , কিন্তু ভীষণ এক আচমকা ভয় এ যেন একদম মুষড়ে গেছে । আদিত্য হাত ধরে টানলো মেয়ে টির । মেয়ে টি ও দ্রুত তার সাথে পা মেলালো , মেয়ে টির বাড়ি সেখান থেকে খুব দূরে নয় , পুরো রাস্তা টাই মেয়ে টি কোনো কথা বললো না , হয়তো অজানা কোনো আতঙ্কে সে চুপ মেরে গেছে একেবারে । ঘরে ঠোকার সময় শুধু একটাই প্রশ্নের উত্তর দিলে সে , যে তার নাম ঋতুকা , ঋতুকা ব্যানার্জী ।
ঋতুকা দির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আদিত্য যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলো , দেখলো সব কিছুই খুব সাধারণ হয়ে গেছে , ছেলে দু টির কোনো অস্তিত্ব সে দেখতে পেলো না । সাধারণ সকাল এ প্রতিদিন যা হয় সে রকম ই যেন সব কিছু ঘটছে । দাদু কে শুধু দেখতে পেলো আদিত্য পাঁচিল এর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে ।
আদিত্য ছুটে চলে গেলো দাদুর কাছে জিজ্ঞেস করলো ছেলে দুটোর কি হলো ? দাদু কোনো উত্তর না করে বললো চল এবার বাড়ি যাওয়া যাক । আদিত্য বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকলো , দাদু বললো আজ নয় দাদুভাই কাল ওই দিদির বাড়ি গিয়ে সব বলবো ।
পরের দিন দাদু আর আমি ঋতুকা দির বাড়ি গেছিলাম । ঋতুকা দির মা দাদু কে পেয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলো । দাদু মোটামুটি যা বললো , এই ছেলে দুটি কে শীতের কলকাতায় প্রায় ১৫ মিনিট ধরে পুকুর এর জলেই রেখে দিয়েছিলো দাদু , উঠতে গেলেই নয় ইঁটের বাড়ি না হলে লাঠির ঘা সহ্য করতে করতে তাদের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছিলো । অনেক ক্ষমা প্রার্থনা করার পর তাদের মুক্তি দেয় দাদু , কারণ তখন ই সেখানে কিছু চেনা লোকের বাইরে ও কিছু অজানা আর কৌতূহলী চোখ জড়ো হচ্ছিলো । যেটা বাড়তে দিতে দাদু চাইনি , সেই সাথে দাদুর সেই সারাজীবন মেনে আসা একটা অদ্ভুত নিয়মাবলী , “অন্যায় কে খতম করো অন্যায়কারী কে নয় ”, এই দুই অনুভূতি থেকেই দাদু মুক্তি দিয়েছে তাদের । ওরা ভীষণ বাচ্ছা ছেলে , চরম অপরাধ করলে ও বোধহয় চরম শাস্তি ওদের আমি দিতে পারতাম না । তবে মা ভয় নেই আমি বলছি ওরা আর এই ভুল করবে না । আমার এই সিদ্ধান্ত জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মা । ঋতুকা দি কাঁদতে কাঁদতে দাদু কে জড়িয়ে ধরলো । আমার বাবা দাদু কেউ নেই , আপনি ই আজ থেকে আমার দাদু আর বাবার জায়গা নিলেন । আপনি যাই সিদ্ধান্ত নিন সেটাই সঠিক ।
এর পর থেকে ঋতুকা দির সব সময় ই দাদুর সাথে দেখা করতে আসতো । এমন কি দাদুর শেষ জীবন এ যখন আদিত্য ও দাদু কে সময় দিতে পারতো না , তখন ঋতুকা দি নাকি সব সময় ই প্রায় দাদুর কাছেই থাকতো ।
এহেন ঋতুকা দি কে দাদু এমন কি বলে গেলো যা তাকে ২৫ বৎসর হলেই জানাতে বলেছিলো । খুব উৎসাহভরে ঋতুকা দির দিকে তাকিয়ে ছিল আদিত্য , ঋতুকা দির সেই রূপ আর নেই , অনেক টাই বুড়ি হবার দিকেই যাছে সে । মুখের মধ্যে মধ্যবিও সমাজের ছাপোষা নারীর কষ্টের ছাপ খুব ই স্পষ্ট । শুনেছিলাম একটি ছেলে আছে ঋতুকা দির , বর ছোট খাটো কোনো ব্যবসা করে ।আর ঋতুকা দি নিজে কিছু একটা কাজ করে । দাদু মারা যাবার পর থেকে শেষ ২ বছর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না তার সাথে । হঠাৎ ঋতুকা দি বললো “কথাটা বিশেষ কিছু নয় , আসলে সে দিন এর সেই ইতিহাস টা নিশ্চয়ই মনে আছে তোর “, বললাম “সে তো কোনো দিন ভুলতে পারবো না ঋতুকা দি ।”, “তাহলে এটা ও নিশ্চয়ই জানিস , এই পুরো ঘটনাটা তে যে আমি জড়িত সেটা এক মাত্র ৪ জন ই জানতো , যার মধ্যে ২ জন আর বেঁচে নেই , দাদু আর আমার মা ।” , আদিত্য ঘাড় নাড়লো । ঋতুকা দি বলতে থাকলো ,”দাদু সে দিন আমাদেরকে এই ঘটনার শেষ যা বলেছিলো সেটা পুরো সত্যি ছিল না । আমাকে পুরো সত্যি দাদুর মৃত্যুর ২ দিন আগে জানিয়ে ছিল । আর বলেছিলো তোকে জানাতে যখন তোর বয়স ২৫ বছর পেরিয়ে যাবে । না হলে তাঁর মরে ও শান্তি হবে না ।” আদিত্য বললো “কি হয়েছিল সে দিন ?”।
দিদি বলে চললো , “দাদু ওই ছেলে দুটি কে শুধু শুধু ছেড়ে দেয় নি । সেদিন যে দাদু বলেছিলো ওই ছেলে দুটি আর কখনো কোনো মেয়ে কে ই বিরক্ত করতে পারবে না , তার কারণ ছিল দাদু ওই অ্যাসিড এর বোতল থেকে পুরো অ্যাসিড টাই দু জন এর হাতের এর উপর ঢেলে দিয়েছিলো । তাতে ছেলে দু টির হাত প্রায় অখেজ হয়ে গেছিলো । আর এরকম নিষ্ঠূর হবার জন্য দাদু শেষ জীবন পর্যন্ত নিজেকে কিছুতেই মাফ করতে পারিনি । অনেক বার ছেলে দু টির বাড়ি গিয়ে দেখা করে এসেছে , কিন্তু কিছুতেই নিজের করা এই অন্যায় কে তিনি মানতে পারেন নি । কিন্তু শুধু আমার নাম জড়াবে না বলে কাউকে মন খুলে এই কথা বলতে ও পারেনি । ফলে দাদু কখনোই আর সেই প্রাণবন্ত হতে পারেনি । তোর সাথে মনোমালিন্য হবার কারণ ও ছিল এটাই ,তুই কিছুতেই আর আগের দাদু কে ফিরে পাসনি এই দিনের পর । যা তোকে ধীরে ধীরে আরো দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে দাদুর থেকে । ‘পারলে দাদু কে মাফ করে দিস তোর মনের মতো দাদু না হতে পারার জন্য ‘। এটাই ছিল দাদুর শেষ ইচ্ছা ।”
সব শুনে অনেক ক্ষণ চুপ করে ছিল আদিত্য । মনের মধ্যে তখন অনেক ঝড় চলছিল তার । কত ঝগড়া করেছে সে দাদুর সাথে আগের মতো স্বাভাবিক থাকতো না বলে , অথচ দাদুর মনের ভিতরে চলা এরকম এক কঠিন লড়াই কে সে কোনো দিন বুঝতেই চাইনি । ঋতুকা দি কে নিজের গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরছিলো আদিত্য । কান্নায় তার চোখ ভেসে যাচ্ছিলো । শুধু মনে হচ্ছিলো ফিরে এস দাদু , আমরা আবার যাই মর্নিং ওয়াক , আবার কোনো অজানা অচেনা কাউকে বাঁচানোর জন্য দু জন মিলে পরিকল্পনা করি । আর পাই জীবন এর এক অদ্ভুত জ্ঞান , যা তোমার কাছ থেকে সব সময় পেয়ে এসেছি , “জীবন এর সব রাস্তা পরিকল্পিত হয় না , মনের অদম্য ইচ্ছা ও অনেক সময় অজানা রাস্তা তৈরি করে দেয় ।”