শখের বৈঠক খানা
শখের বৈঠক খানা
দাদুর মুখে "বৈঠক খানা" কথাটা প্রথমবার শুনে দাদুকে প্রশ্ন করে সপ্তষী ।
দাদু বৈঠক খানা মানে কি ?
সপ্তষীর এই দাদু হলো আঘরলাল মিশ্র অরফে আমাদের গল্পের অঘোরবাবু । এই অঘোরবাবু এক সময় ছিলেন বর্ধমান পোস্ট অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন শ্রেনীর কর্মচারী । প্রত্যন্ত দৃঘল গ্রামের সামান্য পোস্ট মাস্টারের পদ থেকে কর্ম জীবন শুরু করে বর্ধমান শহরের বড় পোস্ট অফিসে এই উর্ধ্বতন পদ অবধি তিনি উঠতে পেরেছিলেন ,ওনার এই ৪৬ বছরের কর্ম জীবনে ।
এখন তিনি কর্ম জীবন থেকে অবসর প্রাপ্ত হয়ে জমিয়ে এসে বসেছেন ওনার কোন্নগরের গঙ্গার তীরবর্তী পৈতৃক বাড়িতে। চাকুরী জীবনের গোড়ার দিক থেকেই অঘোরবাবুকে কাটাতে হয়েছে অজ পারাগার সব গ্রাম গঞ্জ গুলোতেই । এই না না জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করার সুবাদেই অঘোরবাবু বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও ভরে উঠেছিল সমান তালেই। গ্রাম গঞ্জের না না ধরনের প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক ভাবে অর্জিত সেই জ্ঞানের ঝুলির শেষ নির্যাস পর্যন্ত তিনি বর্ষিত করতেন ওনার অত্যন্ত স্নেহের একমাত্র নাতি ও তাহার ক্ষুদে বন্ধু দিগোকের কাছে । এই ছোট্ট ক্ষুদের দল ছিল অঘোরবাবুর খুবই প্রিয় ও নিত্যদিনের গল্পের শোনার শ্রোতা।
আমাদের এই অঘোরবাবুর প্রকৃতি ছিল অনেক তা আমাদের প্রিয় গল্পের চরিত্র তারিণী খুড়োর মতোই। আর তারিণী খুড়োর মতোই বুড়োদের কোম্পানি একদম পছন্দ ছিলোনা। তাই এই খুদেদের কোম্পানি নিয়েই তিনি জমিয়ে তুলতেন ওনার বিকালের বৈঠকে খানা।
তাই রোজ বিকালে এই ক্ষুদে বাহিনীর দল এসে হাজির হতো অঘোরবাবুদের গঙ্গার তীরবর্তী পূব দক্ষিণ খোলা বাগানের মধ্যবর্তী বাঁধানো গোল চাতালের উপর । অঘোরবাবু খুব শখ করে বাগানের মধ্যবর্তি জায়গায় বানিয়েছিলেন এই বসার চাতালটা। গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত এই মনোরম পরিবেশের মধ্যে সেই গোল চাতালের অপুরুপ এক সান্নিধ্য ছিল । সেই চাতালের মাথার উপর ঠিক গোল ছাতার মতো অনুকরণে ছিল গোল ছাদ , যা খান ছয় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো খুটির উপর দার করানো ছিল ; এমনি ছিল তার ভঙ্গি। ঠিক আগেকার দিনে মাটির চাতালের উপর যেমন বাঁশের খুঁটির উপর গোল করে খরের চাল করা হতো । এও ছিল ঠিক তেমনি ।
এখানেই রোজ বিকালে বসতো অঘোরবাবুর গল্পের আসর। আজও তাই সময় মতো অঘোরবাবুর গল্পের শ্রোতা সেই ক্ষুদে বাহিনী এসে উপস্থিত ওই খোলা গোল চাতালের উপর।
অঘোরবাবু এসে সেই গোল চাতালে গল্পের শ্রোতাদের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসার সাথে সাথেই সপ্তষী বলে ওঠে ।
দাদু আমরা রোজ কেন এখানেই বসে গল্প শুনি । আমাদের ছাদের উপরও তো অনেক জায়গা সেখানে আমরা বসিনা কেন ?
সপ্তষীর এই প্রশ্নের উত্তরে সদা হাস্যময় অঘোরবাবু অকৃত্রিম হাসি মুখে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন । আমার যে রোজ এই খোলা বাগানের মাঝে এসে বসে গল্প করি , তার কারণ এটাই হলো আমাদের "বৈঠক খানা"।
দাদুর মুখে এই নতুন কথাটা শুনে সপ্তষী আবার ও প্রশ্ন করে অঘোরবাবুকে ।
দাদু "বৈঠক খানা" মানে কি ?
এই প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই যেন অঘোরবাবুর সদা হাস্যময় ভাবটা হারিয়ে গিয়ে বিবর্ণ হয়ে পরে ওনার মুখ । খোস গল্প করার মেজাজটা হারিয়ে গিয়ে যেনো একটু ভয়ভীত হয়ে পড়েন অঘোরবাবু । নিজের মনেই যেন বাগানের চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিলেন তিনি । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার সেই হাসির ভাবটা যেন এক প্রকার জোর করেই মুখে এনে অঘোরবাবু সকলকে উদ্যেশ্য করে বললেন ।
চলো তাহলে তোমাদের আজ আমি বৈঠক খানা নিয়ে একটা গল্প বলি। আর গল্প হলো একদম সত্যি ও আমার নিজের এক অভিজ্ঞত।
সপ্তষী তখনি বলে উঠলো ভূতের গল্প কি দাদু ?
অঘোরবাবু উত্তরে একটু অন্য মনস্ক হয়ে মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। তারপর আঘারবাবু কিছু ক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে বোধয় গল্পটা মনের মধ্যে সাজিয়ে নিলো। তারপর অঘোরবাবু শুরু করলেন ওনার গল্প,,,,,,
সময়টা ছিল আমার চাকরি পাওয়ার একদম গোড়ার দিকের ঘটনা। বর্ধমান জেলার দৃঘল গ্রামের পোস্ট অফিসে পোস্ট মাস্টারের চরকি পেয়ে আমি মাস দুই হলো আমি সেখানে নতুন উদ্দমে কাজ করছি। শুরু থেকেই আমি একটু কাজ পাগল ছিলাম। যা চিঠি নিয়ে বিলি করতে বেরোতাম , তা যতক্ষন না শেষ হতো আমি ফিরতাম না। তাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও আমি পিছু পা হতাম না। কারণ আমি জানতাম যে এই চিঠি গুলো শুধু চিঠি না , এগুলো মানুষের আগেব , আনন্দ , দুঃখ ,স্নেহের বার্তা বহন করছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। এই নিয়ে পোস্ট অফিসের উর্ধতন কর্মচারীরা ও আমার সহকর্মীরা আমাকে অনেক সাবধান করার পরেও আমি ওদের কথা শুনতাম না। গ্রামের মোড়ল মশাই অনাথ বাবু আমাকে খুব ভালোবাসতো , উনিও পর্যন্ত আমাকে বুঝিয়ে ছিলেন গ্রামের পথে বেশি রাত পর্যন্ত এক ঘোড়া ভালো নয়।
কিন্তু আমি আমার কাজ তাকেই বড়ো বলে মনে করতাম , তাই আমি আমার মতোই কাজ করতে থাকি। কিন্তু এই সব প্রবীণ ব্যক্তিদের কথা না শোনার ফল আমি হাতে নাতেই পেলাম কিছু দিনের মধ্যে।
একদিন আমি চিঠি বিলি করতে বেড়িয়েছি , দিনটা ছিল বাদলার , চিঠিও বেশ ভালোই ছিল বিলি করার জন্য। সকাল থেকে বৃষ্টির জন্য বেরোতে পারলামনা , দুপুর তিনটের পর আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই আমি বেড়িয়ে পড়লাম সাইকেল আর কাঁধে চিঠির ঝোলা নিয়ে। সেদিন চিঠি বিলি করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেলো। আর এই সব গ্রামে রাত তাড়াতাড়ি মানে। লাস্ট চিঠিটা বিলি করে , আমি এবার ফেরার পথ ধরি। আজ গ্রামের বেশ শেষ প্রান্তের দিকে পৌঁছে গিয়েছিলাম , কারণ শেষ চিঠিটা গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকেই ছিল। ব্যস্ততার মাঝে ঘড়ি দেখার সময় পাইনি একদম , ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত নয়টা বাজতে আর মিনিট ১০ মতো বাকি। ঘড়ির দিক থেকে চোখ তুলতে না তুলতেই , গগন ফাটানো শব্দ করে খুব নিকটেই একটা বাজে পড়লো কোথায়। আকাশের মেঘ আরো ঘন হয়ে এলো। আমি গতিক ভালো না বুঝে সাইকেলে চড়ে যেই খানিকটা এগিয়েছি , অমনি আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় শুরু হলো বৃষ্টি। গ্রামের শেষের দিকে ঘরবাড়ি কম , আমি বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি সামনে শুধু ধুধু মাঠ।
কোথায় যাবো , কি করবো এই ভাবছি। হঠাৎ সামনের মাঠের উপর আলোর উৎস দেখতে পেলাম। তারপর ভালো করে দেখে বুঝলাম , মাঠের উপর একটা পাকা ইটের ছোট বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমি এগিয়ে গেলাম ওই বাড়িটার দিকে। কাছে গিয়ে দেখি সাদা রং করা এক কামরা বাড়িটা হলো এক বৈঠক খানা। কারণ বাড়ির সামনে বড়ো একটা ফলকে বড়ো বড়ো করে লেখা ছিল " শখের বৈঠক খানা "। দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম সেই বৈঠক খানার আলোক উজ্জ্বল ঘর খানার দিকে। ভিতরে গিয়ে দেখি সেই ঘরে জানা সাত আট মাঝ বয়স্ক ব্যাক্তি বসে গল্প গুজব করছেন। আমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম বৃষ্টির ছাট আরো বাড়তে আমি ঘরের মধ্যেই ঢুকে পরি। আমি যে ঘরে ঢুকলাম , তাতে যেন তাদের কোনো ভুরুক্ষেপ ই নেই। আমাকে যেন তারা কেউ দেখতেই পেল না। তারা ছিল তাদের গল্পে মত্ত। এবার আমি দু পা আরো এগিয়ে যেতে তাদের গল্পের বিষয় বস্তু টা ভালো করে কানে আসে আমার। তারা বলছেন আজ একুশ বছর পর আবার আমাদের বৈঠক খানা স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে। হারাধন একমাত্র ব্যক্তি যে সেই দিন রাতে আমাদের এই শখের বৈঠক খানায় অনুপস্থিত ছিল। তাই সেই ভয়ঙ্কর দিনে যে বজ্র পাত পরে ছিল আমাদের এই বৈঠক খানার উপর , তাতে আমরা সবাই মারা গেলেও হারাধন একমাত্র বেঁচে যায়। সেই থেকে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে আমাদের এই শখের বৈঠক খানা , কিন্তু আজ সেই দিন এসেছে , আজ আমাদের মাঝে আসতে চলেছে আমাদের সেই বন্ধু হারাধন। এই কথাটা বলে আনন্দে উল্লাসে হাস্তে শুরু করে দিল সেই বৈঠক খানায় বসে থাকা মানুষ গুলো।
কিন্তু কি কথা বললো এই ব্যক্তি , ২১ বছর আগে ওরা মারা গেছে বজ্রাঘাতে।
তার মানে এরা সবাই প্রেতাত্মা , বুকের মধ্যে ঢেকির পার পড়তে থাকে আমার। এই দিকে বাইরে তুমুল বৃষ্টি পড়ছে , সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছি , এমন সময় দেখি বৈঠক খানার সামনে একটা একটা মানব মূর্তি এগিয়ে আসছে বৈঠক খানার দিকে। প্রবল বর্ষণের মধ্যে ভালো ভাবে ওই ব্যক্তির মুখটা বোঝা যাচ্ছিলো না। আর আমিও যেন অনেক চেষ্টা করেও পালাতে পারলাম না সেখান থেকে। ওই মজার কাছেই অনড় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আর সম্মোহিতের মতো দেখতে থাকলাম সেই লোকটির দিকে , সেই বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে সেই লোকটি বৈঠক খানার দরজার দিকে। লোকটি এবার একদম আমার কাছে এসে পৌঁছে গেলো , আর আমাকে দেখতে পায়নি এমনি ভাব করে প্রবেশ করলো বৈঠক খানার দরজার ভিতর। বৈঠক খানার ভিতর প্রবেশ করতেই ঘরে থাকা অন্য ব্যক্তি গুলো উল্লাসে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু এরা করা আমার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো , তাকিয়ে দেখি ঘরের মধ্যে ওই আগুন্তুক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ৭ খানা কংকাল। এবার তারা তাদের খনা গলায় ওই আগুন্তুক ব্যক্তিতে সম্ভাষণ করে বললো , এসো হে হারাধন ভায়া এসো , বোরো সময় লাগালে ভাই আসতে। বন্ধুদের ছেড়ে কি ভাবে ছিলে তুমি এতো দিন। এই বলে আবার হাসিতে ফেটে পরে ওই কঙ্কাল গুলো। তাদের হাসিতে বৈঠক খানার ঘর যেন কেঁপে উঠলো। এবার সেই আগুন্তুক মানুষ টা আমার দিকে তাকালো , আমি অবাক হয়ে গেলাম ওই ব্যক্তিতে দেখে। এতো গ্রামের মোড়ল মশাই , মানে অনাথ মিত্র। দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললো , তোমার এখানে থাকার দরকার নেই মাস্টার তুমি এখনই ফায়ার যাও , আমি সেই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারালাম।
সকালে যখন জ্ঞান ফিরলো আমি পড়েছিলাম খোলা মাঠের উপর। পাশেই দেখি একটা ভগ্ন প্রায় ছোট বাড়ি। এখনো তার ফলকে লেখা শখের বৈঠক খানা খোদাইটা হালকা হলেও পড়া যাচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মতো পোস্ট অফিসে ফিরে আমি গেলাম গ্রামের মোড়ল অনাথ বাবুর বাড়ি। মনের মধ্যে তখন আমার কি চলছে আমি জানি। মনকে বোঝালাম কাল আমি দুঃসপ্ন দেখেছি। কিন্তু মোড়ল মশাইয়ের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কানে ভেসে এলো স্ত্রীলোকের কান্নার শব্দ। আমি দৌড়ে মোড়ল মশাইয়ের বাড়ির উঠানে যেতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে উঠানেও উপর রাখা আছে খাটিয়াতে শেষ যাত্রার জন্য সজ্জিত মোড়ল মশাইয়ের সব দেহ। আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না। কাল রাতের সব দৃশ্য আবার আমার মাথার উপর ঘর করে এলো। তার মানে কাল রাতের সেই সব ঘটনা সত্যি ছিল , সেগুলো তার কল্পনা বা স্বপ্ন ছিল না। মাথা ঘুরে মাটিতে বসে পড়লাম আমি , গ্রামের এক ব্যক্তি আমাকে ধরে নিলো , আমি শুধু তাকে একটাই প্রশ্ন করতে পারলাম
মোড়ল মশাইয়ের নাম কি হারাধন , উত্তরে লোকটি বলে হ্যা , ওনার বন্ধুরা অনেক ওই নাম ডাকতেন , এই টুকু শুনেই আমি জ্ঞান হারালাম।
তারপর থেকে আমি আর কোনোদিন সন্ধ্যার পর চিঠি বিলি করিনি।

