রক্তপলাশ
রক্তপলাশ
নিঝুমপুর। যেন মর্ত্যলোকে এক টুকরো স্বর্গের নিঃশ্বাস। যেমনি প্রজাবৎসল রাজা-রানী, তেমনি কর্তব্যপরায়ণ প্রজারা। এই দেশের রাজারই একমাত্র মেয়ে আত্রেয়ী। বড়ো আদরের। মা-বাবার নয়নের মণি। সবে আট বছর বয়স তার। কিন্তু ইতিমধ্যেই বহুপ্রকার রাজবিদ্যায় আশ্চর্য রকমের পারদর্শী সে। রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তে কুয়াশার মতো পাহাড়ের মাথায় মহারাজের প্রাসাদদুর্গ। দুর্গপ্রাঙ্গনের উদ্যানে, রক্তপলাশে সজ্জিত জোড়া-বেণী দুলিয়ে যখন গুল্ম থেকে গুল্মে ছোটাছুটি করে বেড়ায় আত্রেয়ী, তখন বাগানের বহুরঙা প্রজাপতিগুলোর সাথে বিশেষ পার্থক্য করা যায় না তার। কিন্তু একদিন গোল বাধলো ওই রক্তপলাশ নিয়েই।
প্রতি শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে ত্রয়োদশী, এবং কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী থেকে একাদশী, দ্বিপ্রাহরিক স্নানের পর নিজের হাতে মেয়ের চুল শুকিয়ে দু'পাশে দুটি বেণী করে, সে দুটি রক্তপলাশ দিয়ে সাজিয়ে দেন রানীমা। একটি দাসী রক্তপলাশ সরবরাহ করে এই উপলক্ষে। শয্যাপার্শ্বে একটি রেকাবে রাখা থাকে ফুলগুলি।
আর চারদিন পরেই দেবী মুণ্ডমালিনীর আবাহন। সেদিনও রানীমা মেয়ের চুল শুকিয়ে বেঁধে দেওয়ার পর অভ্যাসমতো হাত বাড়িয়েছেন রেকাবটির দিকে, এবং চমকে উঠেছেন সাথেসাথেই। রেকাব শূন্য। একটি ফুলও সেখানে নেই। আত্রেয়ী সামনে থেকে বলে ওঠে, "কী হলো, মা? চুল বাঁধতে বাঁধতে থেমে গেলে কেন?"
মেয়ের কথা কানে যায় না রানীমার। তাঁর মন যেন কু গাইতে শুরু করেছে। রাজ্যে পলাশ গাছ অনেক। পলাশের প্রাকৃতিক রঙই লাল। কিন্তু রক্তপলাশ একটু ভিন্ন ধরনের ফুল। সমস্ত রাজ্যে একটাই গাছ তার। কোনো নির্দিষ্ট ঋতুতে নয়, রক্তপলাশ বারোমাসই ফোটে সেই গাছে। সাধারণ পলাশের সাথে তার পার্থক্য হলো, সাধারণ পলাশের লাল রঙের মধ্যেও একটু হলুদের আভাস থাকে, যে কারণে তার নাম বনানীর অগ্নিশিখা। কিন্তু রক্তপলাশ দেখলে মনে হয় যেন ফোঁটা ফোঁটা টাটকা রক্ত দিয়ে তৈরি তার শরীর। গাঢ়, তাজা রক্ত। জীবন্ত লাল। ফুলটার পাপড়ির গায়ে হাত দিতে ভয় হয়, পাছে সেই রক্তলাল মাখামাখি হয়ে যায় আঙুলে।
এহেন রক্তপলাশের রেকাব আজ শূন্য! যা কিনা শুধুমাত্র রাজকুমারীর কেশবিন্যাসের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়! ভীষণ রাগান্বিত হয়ে সরযূবালা নামের সেই কিঙ্করীকে তলব করেন তিনি।
সে উপস্থিত হলে, প্রচুর তিরস্কার সহযোগে তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ব্যাখ্যা চান রানীমা। পলকে কালিমাবৃত হয়ে যায় তরুণী পরিচারিকাটির মুখ। নীচুকন্ঠে, নতমস্তকে সে জানায়, নিয়মমতোই পুষ্প সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সে আজও গিয়েছিল রক্তপলাশ বৃক্ষের কাছে। কিন্তু সেই বৃক্ষে আজ একটি ফুলও ছিল না।
"থামো!" গর্জে ওঠেন রানী, "অপরাধ প্রকাশ্যে আসার পর অসত্যভাষণ করতে লজ্জা করে না? রক্তপলাশের গাছ শূন্য-- এমন অদ্ভুত কথা কেউ শোনেনি এই নিঝুমপুরে। এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। জানো না, স্বয়ং দেবী ছিন্নমস্তার আশীর্বাদে এই বৃক্ষ কখনো শূন্য হয় না? এমনকী এটাও তোমার কাছে জ্ঞাত যে, এই রাজবংশে ভূমিষ্ঠ হওয়া প্রত্যেকটি কন্যার যৌবনপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ওই রক্তপলাশ ফুল দিয়ে তার কেশবিন্যাস করা হয়। এত কিছু জেনেও অম্লানবদনে এই প্রাকৃতিক সত্যকে অস্বীকার করতে তোমার মুখের রেখা যে একটুও কাঁপছে না, এটা দেখে সত্যিই পরিচারিকা পদে তোমাকে বহাল রাখতে আর প্রবৃত্তি হচ্ছে না।" এতদুর বলে, নিঃশব্দ হস্তসঞ্চালনে তাকে বিদায় দিয়ে, অন্তঃপুরের কঞ্চুকীকে ডেকে পাঠান রানীমা। সে উপস্থিত হলে কঠিন গলায় আদেশ করেন, "তুমি এই দন্ডে তোমার বিশ্বস্ত কোনো অনুচরকে পাঠিয়ে রক্তপলাশ গাছটি পরীক্ষা করে দেখে আসতে বলো। এবং তারপরে তার বক্তব্যের আনুপূর্বিক বিবরণ আমার কাছে উপস্থিত করো।"
কঞ্চুকী নীরব সম্মতি জানিয়ে চলে গেলে, দুয়ারপ্রান্তে উপস্থিত সর্বক্ষণের দাসীটিকেও কক্ষ পরিত্যাগ করতে আদেশ করেন রানী। আত্রেয়ী এতক্ষণ সম্পূর্ণ নীরব ছিল। মায়ের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ পেয়ে মুখ ফোটে তার। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত এই অসামান্য কন্যা নিচুস্বরে বলে ওঠে, "মা, রক্তপলাশের গাছ শূন্য। তার মানে তো--" মেয়ের কথা শেষ করতে না দিয়ে তার মুখ চেপে ধরেন রানীমা। আশ্বাসের সুরে বলে ওঠেন, "সরযূ শুধুমাত্র নিজের চর্মরক্ষার তাগিদে ওই কথা বলেছে। নেহাৎ কোনো পুরুষের হাতে রাজনন্দিনীর কেশসজ্জার উপাচার বাহিত হওয়াটা অনিয়ম, না হলে কঞ্চুকী মারফৎই ফুলগুলি আনতে পাঠাতাম। সে একবার খবর নিয়ে আসুক, তারপর অন্য কোনো দাসীকে দিয়ে আনতে পাঠাবো। হয়তো একটু বিলম্ব হবে, তবে নিয়মমতোই তোমার চুল আজও সেজে উঠবে রক্তপলাশের থোকায় থোকায়।"
রাজকন্যার কণ্ঠস্বর থেকে সন্দেহ দূর হয় না। চিন্তিত সুরে সে বলে, "পন্ডিতমশাই কিন্তু বলেছেন, রক্তপলাশের গাছ তখনই শূন্য হয়, ধরে নিতে হয় যে যখন নিঝুমপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিন্নমস্তা--"
পুনরায় মেয়ের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে রানীমা বলেন, "এ নিয়ে অনর্থক দুশ্চিন্তা ক'রো না, মা। দেবী ছিন্নমস্তা সর্বদাই নিঝুমপুরের উপর কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করে চলেছেন।"
আত্রেয়ী নীরব হয়ে যায় এরপর।
একটুক্ষণ পরে ফিরে আসে কঞ্চুকী। তার মুখ তমসাচ্ছন্ন। গম্ভীরকন্ঠে সে জানায়, তার অনুচরদের একজন গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছে সেই রক্তপলাশের বৃক্ষ, এবং সেটা বাস্তবিকই শূন্য। কঞ্চুকী অবশ্য সেই কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেনি। বরং আরো দুইজন অনুচরকে পাঠিয়েছে বিষয়টা যাচাই করতে। তারা আর কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে।
"আমি তাদের সাথে দেখা করবো।" দৃঢ়স্বরে বলে ওঠেন রানীমা। কঞ্চুকীর আপত্তিসূচক মুখভঙ্গিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, কন্যার কেশবিন্যাস অর্ধসমাপ্ত রেখেই উঠে যান তিনি। ঊষর চোখে খোলা জানলা দিয়ে পিতার সাম্রাজ্যের দিকে চেয়ে থাকে আত্রেয়ী।
********
আজ এই অসময়ে ঈশান কোণে মেঘের ঘনঘটা দেখে চোখ কুঁচকে যায় সুজনের। লক্ষণটা ভালো নয়। অসময়ে বৃষ্টি মানে ফসলের সর্বনাশ। দেবী ছিন্নমস্তার ভ্রুকুটির মতো অন্ধকার হয়ে আছে আকাশের একটা পার্শ্ব। ঠিক সেই সময় বহুদূর থেকে হনহন করে একটি মনুষ্যমূর্তিকে এই দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে সুজন। রৌদ্রের তাপ এখনো ভালোই বিরাজমান, তাই মুখটা একটু তুলে একটা হাতকে চোখের উপর আড়াল হিসেবে ব্যবহার ক'রে সামনের দিকে তাকায় সুজন। একটি আগন্তুক। পরনে একটি নানা রঙের তালি দেওয়া পোশাক। কাঁধে সেইরকমই একটা ঝোলা। চুল উস্কোখুস্কো, জটাজুট পূর্ণ। এই অঞ্চলের ত্রিসীমানায় কখনো এমন মানুষ দেখেনি সুজন। লোকটি তার দিকেই সটান এগিয়ে আসছে। চোখের উপর থেকে হাত নামিয়ে নেয় সে।
ওদের দুজনের মধ্যে তখনো কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান, তার মধ্যেই লোকটা গলা তুলে জিজ্ঞাসা করে, "এদেশে ছিন্নমস্তার মন্দিরটা কোথায় বলতে পারো?" অদ্ভুত কর্কশ অথচ সুরেলা কন্ঠস্বর।
ছিন্নমস্তার মন্দির! সেখানে কী দরকার এই লোকটির? সে মন্দির যে...
লোকটি বেশি ভাবার সুযোগ না দিয়েই পুনরাবৃত্তি করে তার প্রশ্নের। সুজন কিঞ্চিৎ দিশেহারা বোধ করে। দেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরের নাম যে এমন অকালে-অসময়ে উচ্চারিত হতে পারে, এ ধারণা ছিল না তার। তার হাত দুটি যেন আপনা থেকেই সঞ্চালিত হয় দক্ষিণের পাহাড়ের দিকে। যার মাথায়, প্রাসাদদুর্গ থেকে অনতিদূরেই অবস্থান করছে দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির, এবং সেই কিংবদন্তী রক্তপলাশ বৃক্ষ।
লোকটি আরো কয়েক পা এগিয়ে আসে। তার অমার্জিত শ্মশ্রুগুম্ফের মাঝখানে চোখ দুটি যেন এক অদ্ভুত জীবনশক্তিতে জ্বলে ওঠে। সুজনের কাঁধে একটা হাত রাখে আগন্তুক। দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে, "এক অনন্য আচারক্রিয়া সম্পাদনের লক্ষ্য নিয়ে আমি আজ এসেছি। তুমি কি হবে আমার সেই পবিত্র আচারের সঙ্গী?"
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ে সুজন। তারপর বিনাবাক্যে অনুসরণ করতে শুরু করে সেই অচেনা ব্যক্তিকে।
*********
আচমকা চোখদুটো খুলে যায় আত্রেয়ীর। এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। কিন্তু সে কী দেখল সেই ঘোরের মধ্যে? একরাশ কালো আঁধারের ঘূর্ণিপাক বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে অগ্রসর হচ্ছে এই প্রাসাদদুর্গের দিকেই! ছোটছোট পা গুলিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঘর থেকে প্রায় উড়ে বেরিয়ে যায় আত্রেয়ী।
বেরোতেই মাতৃদেবীর সাথে সংঘর্ষ হয়। "মা!" রুদ্ধশ্বাসে ডেকে ওঠে রাজকন্যা। রানীমা দুহাত দিয়ে আগলে নেন তাকে। বুকের কাছে ধরে ফিসফিসে সান্তনাস্বরে বলেন, "কিছু হয়নি মা, কিচ্ছু হয়নি। এত উতলা হয়ো না।"
"রক্তপলাশ গাছটা কি--"
"ও কথা এখন থাক। চলো, বরং একবার পোশাক প'রে তৈরি হয়ে নাও।"
"কোথায়, মা?"
"দেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরে!" বলতে গিয়ে গলাটা সামান্য কেঁপে ওঠে রানীর।
কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি কেঁপে ওঠে তাঁর বাহুপাশে আবদ্ধ আত্রেয়ী। জন্ম থেকে একবারও সেই মন্দিরে পদার্পণ করেনি সে। কুমারী মেয়েদের পক্ষে জায়গাটি যে অত্যন্ত বিপদসংকুল একথাই শুনে এসেছে বরাবর। যদিও তার সঠিক কারণটা জানতে পারেনি কোনোদিন। কিন্তু আজ হঠাৎ তার মা...
তোর চিন্তায় বাধা পড়ে মাথার ওপর মায়ের চুম্বনের স্পর্শে। মৃদুস্বর শোনা যায় তাঁর, "এসো, আমি তোমায় প্রস্তুত করে দিই।"
ঘরে এসে তার পালকের মতো সূক্ষ্ম মসলিনের কাপড় সরিয়ে তাকে অনাবৃত করে দেন রানীমা। তারপর তাকে নিয়ে চলেন প্রসাধনকক্ষে। দ্বিতীয়বার স্নান করিয়ে, চুলগুলি আলতোভাবে মুছে, একখন্ড রক্তাম্বর পট্টবস্ত্র দিয়ে তাকে সাজিয়ে দেন তিনি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, যে মা কেশবিন্যাস সুসম্পন্ন না হলে দুর্গ থেকে এক পাও বের হতে দেন না আত্রেয়ীকে, সেই মা-ই আজ তাঁকে নির্দেশ দিলেন চুল সম্পূর্ণ খোলা রাখতে। শরীর থেকে যত্নে খুলে নিলেন শেষ অলংকারটি পর্যন্ত। নিরাভরণ আত্রেয়ীকে নিয়ে, অসংখ্য দুর্গ-অলিন্দ পেরিয়ে রানীমা এগিয়ে চললেন সিংহদুয়ারের দিকে।
আগন্তুকটির পিছনে মোহাচ্ছন্ন ভাবে হাঁটছিল সুজন। পাহাড়ের এই পথটা নেহাত কম নয়। সেই দুপুরে যাত্রা শুরু করেছে তারা, এখন দিনমণি প্রায় অস্তাচলে। বাড়িতে তার বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। সুজনের একার পরিশ্রমেই চলে তাদের একফালি সংসার। তবে সম্প্রতি সুজনকে সংসারী করার যে বাসনা নিয়ে তার মা বদ্ধপরিকর হয়েছেন, তাতে কতদিন এই সংসারটাকে যে আর নির্ঝঞ্ঝাট রাখা যাবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আগন্তুকটি আগে আগে চলেছে, সুজন চলেছে পিছেপিছে। যেতে যেতেই
মাঝে মাঝে সম্মুখবর্তীর অস্পষ্ট গলা শুনতে পাচ্ছে সে, "দ্রুত চলো। লগ্ন বয়ে গেলে, আর সুযোগ মিলবে না।" সুজনের কর্ণকুহরে এই নির্দেশ প্রবেশ করছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু চলার গতি তার অবিশ্বাস্য দ্রুত। ক্রমেই নতিশীল পর্বতগাত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটি মন্দিরের চূড়া।
**********
পাহাড়ের গা বেয়ে একাকী হেঁটে চলেছে একটি নারীমূর্তি। উদ্বৃত্ত বস্ত্রাঞ্চলে তার মুখমন্ডল সম্পূর্ণ আবৃত। চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু তার পদচারণা মধ্যে মিশে আছে সূক্ষ্ম রাজগৌরবের চিহ্ন।
রানীমা ফিরে চলেছেন প্রাসাদের দিকে। তার দু চোখে সঞ্চিত হয়েছে অকুল অশ্রুবাষ্প। কোনোমতে ওষ্ঠাধর একত্রে প্রচন্ড দৃঢ়তার সঙ্গে চেপে রেখে তিনি এগিয়ে চলেছেন। তাঁর বুকের ভিতর ধিকিধিকি জ্বলছে চরম পাপবোধ, এবং অনুশোচনার কালো আগুন। স্বহস্তে নিজের একমাত্র কন্যাকে দেবী ছিন্নমস্তার ক্ষুধানলে সমর্পণ করে এসেছেন তিনি। এই দিন যে আসে সহস্রাব্দে একবার। আর আত্রেয়ীর এমনই ভাগ্য, ঠিক তার বেলাতেই...
কঞ্চুকির দুই অনুচর ফিরে এসে জানিয়েছিল রক্তপলাশ বৃক্ষ যথার্থই নিস্পুষ্প। ভয়ে দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে রানী ছুটে গিয়েছিলেন রাজপণ্ডিতের কাছে। ঘটনা শুনে তাঁর মুখভঙ্গি দেখে রানীর মনে হয়েছিল বোধকরি নিঝুমপুরের উপর বজ্রপাতের ইশারা পেয়েছেন তিনি। বহুপ্রাচীন একটা পুঁথি খুলে, কিছুক্ষণ স্বগত পাঠ করে নিয়ে, গম্ভীর, চিন্তাক্লিষ্ট গলায় পন্ডিত বলেছিলেন, "আজ সেই অভিশপ্ত দিন ফিরে এসেছে সহস্রাব্দ পরে। দেবী ছিন্নমস্তা জেগে উঠেছেন। নররক্তের পিপাসায় উন্মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। এ তারই লক্ষণ।"
"তাঁর এই পিপাসা নিবৃত্ত করার উপায় কী, পন্ডিতমশাই?"
"নিঝুমপুরের এ এক প্রাচীন ঐতিহ্য। যখনই দেবীর এই পিপাসার্ত মূর্তি উপস্থিত হয়, নিঝুমপুরে উদিত হয় এক অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তি। এক আগন্তুক। কিংবদন্তী হলো, সে নাকি স্বয়ং মহাকালের অনুচর। এই রাজ্যেরই কোনো একজন বাসিন্দাকে বশীভূত করার মাধ্যমে দেবীর পদপ্রান্তে বলি সমর্পণ করে সে। সেই ব্যক্তি ছাড়া বাকি সকলের চর্মচক্ষে সে থাকে অদৃশ্য।"
"তার মানে, আজ আমাদের রাজ্যের কোনো এক হতভাগ্য প্রজাকে মৃত্যুবরণ করে নিতে হবে, দেবীকে তুষ্ট করার জন্য?"
এর উত্তরে ম্লান হেসেছিলেন রাজপন্ডিত। সে হাসির মধ্যে লুকানো ছিল রানীমার অজ্ঞতার প্রতি করুণা। গাঢ়স্বরে তিনি বলেছিলেন, "না, সেই প্রজাটির স্মৃতিভ্রংশ হবে, কিন্তু মৃত্যু হবে না।"
"তবে তো--"
"বলি হিসেবে অন্য কিছু গ্রহণ করবেন দেবী ছিন্নমস্তা। এটাই রীতি।" রানীমার নির্বাক প্রশ্নের উত্তরে রাজপন্ডিত বলে চলেছিলেন, "দেবী ছিন্নমস্তা গ্রহণ করেন সমস্ত রাজ্যের সবচেয়ে মহামূল্যবান সম্পদটিকে। রাজ্যের... ভবিষ্যতকে।"
"আত্রেয়ী...!" শ্রাবণ নেমেছিল রানীর দু'চোখ বেয়ে।
"সময় কিন্তু বেশি নেই রানীমা। বলি না পেলে দেবী ছিন্নমস্তা ক্রুদ্ধ হয়ে ছারখার করে দেবেন গোটা রাজ্য। খরা, বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ হয়ে উঠবে নিত্যসঙ্গী। দাহ করার জন্য শ্মশানযাত্রীও হবে অমিল। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। মেয়ের প্রাণ রক্ষা করবেন, না প্রজাদের।"
"মহারাজের সাথে একবার--"
"আপনি যদৃচ্ছা আলোচনা করুন রানীমা। শুধু মনে রাখবেন, আপনার সময়, আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত।"
এই কথার পর আর ভাবার সময় পাননি রানীমা। প্রজাকল্যাণের কথা তাঁর আগে ভাবা উচিত। তিনি তাদের রানী, মাতৃসমা। কাজেই চোখ মুছে নিয়ে, পন্ডিতের কাছ থেকে আনুষাঙ্গিক উপাচার বিষয়ে খুঁটিনাটি জেনে নিজের হাতে কন্যাকে সজ্জিত করে তিনি রেখে এসেছেন দেবী ছিন্নমস্তার পদপ্রান্তে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসার অজুহাত দিয়ে চুপিসাড়ে বেরিয়ে এসেছেন মন্দিরচত্বর ছেড়ে। যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক দেখে নিয়েছেন শূন্য রক্তপলাশ গাছটাকে। সেই সময় একবার মনে হয়েছে গাছটির নিচে যেন অন্ধকার কিছু ঘন হয়ে জমাট বেঁধেছে। অবশ্য সেটা উৎপীড়িত মাতৃহৃদয়ের বিভ্রমও হতে পারে।
**********
দেবী ছিন্নমস্তার বিগ্রহের সামনে নিমগ্নচিত্তে পদ্মাসনে বসেছিল আত্রেয়ী। মা এমনটাই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। তিনি ফিরে আসবেন খুব শীঘ্রই। কী যেন উপাচার সংগ্রহ করতে গিয়েছেন। তারপর শুরু হবে পূজা। এমন অদ্ভুত পূজার কথা কখনো শোনেনি রাজকন্যা। পুরোহিতবিহীন এ কেমন পূজা? হাজারটা জিজ্ঞাস্য ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কিন্তু আপাতত চুপ করে বসে মনকে একাগ্র করার চেষ্টা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তমসা ঘনীভূত হতে থাকা মন্দির গর্ভগৃহে, দেবতার বেদীর কাছে আচমকাই একটা নড়াচড়ার আভাস পেয়ে সচকিত হয়ে ওঠে আত্রেয়ী। চোখ দুটিকে ক্রম-ঘনায়মান অন্ধকারের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বিগ্রহবেদীর দিকে সতর্ক সন্ধিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সাথেসাথেই, বিগ্রহের পাদদেশ থেকে একটি কৃষ্ণাম্বর পরিহিত মূর্তি উঠে দাঁড়ায়। একটানে সরিয়ে ফেলে মুখের আবরণ। এই আধো-আলোকেও সেই মুখ চিনতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়না রাজকন্যাকে। বজ্রাহত কণ্ঠে সে বলে ওঠে, "মহাপন্ডিত...! আপনি...?"
একটা ক্রূর হাসি হেসে রাজকন্যার পরম পূজনীয় শিক্ষক এগিয়ে আসেন তার দিকে। কণ্ঠস্বরের কামার্ততাটা যথাসম্ভব দমন ক'রে, দক্ষ নটের মতো শান্ত গলায় বলেন, "আমি আর আমাতে নেই, রাজকুমারী! স্বয়ং মহাকালের বশীভূত আমি এখন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ীই করছি সবকিছু। তাঁর নির্দেশেই, তোমাকে অর্ঘ্য হিসেবে দিতে হবে দেবী ছিন্নমস্তার চরণপ্রান্তে। তবে তার আগে, মৃত্যুর পর যেন তোমার আত্মা কোনোভাবেই স্বর্গলাভ না করে, সেই ব্যবস্থা করা আবশ্যক। নতুবা দেবীর ক্ষুধা মিটবে না। কিন্তু তুমি নিষ্পাপ শিশু। তোমার মনকে কলুষিত করা সম্ভব নয়। অগত্যা শরীরটাকেই।... আহ্! কতদিনের সযত্ন লালিত বাসনা আমার...! আর কাকতালীয়ভাবে ঠিক আজই রক্তপলাশের গাছ শূন্য..." কথা অর্ধসমাপ্ত রেখেই রাজকন্যার খুব কাছে সরে আসেন রাজপন্ডিত। তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছে আত্রেয়ী। তাঁর চোখের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছে বাসনা।...
হঠাৎ প্রকৃতির কোলে যেন প্রচন্ড অস্থিরতা, আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। যেন একটা আস্ত ঘূর্ণিঝড় এসে দাঁড়িয়েছে মন্দিরের দরজার সামনে। ছারখার করে দেবে যতো পাপ, যতো অন্যায়। আর সেই ঘূর্ণিঝড়ের সাথে সাথেই আসছে এক সৌম্যকান্তি যুবা। তার পাথরকুঁদে গড়া শরীরে দুবেলার কায়িক পরিশ্রমের ছাপ। মুখমন্ডলে চকচক করছে স্বেদবিন্দু। দমকা হাওয়ায় ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসে চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে মুখের চারপাশে। এতক্ষণের রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কের পর এই প্রথম যেন গলায় স্বর ফোটে আত্রেয়ীর। চিত্কার করে কেঁদে ওঠে সে। রাজপন্ডিত তার দিকে হস্তপ্রসারিত অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে। অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন পুরো বিষয়টা। যুবাটি সহজাত বিক্রমে কক্ষে প্রবেশ ক'রে, অবলীলাক্রমে শূন্যে তুলে ধরে রাজপন্ডিতের কৃশকায় শরীরটা। সামান্য প্রতিরোধ করার অবকাশটুকুও পাননা তিনি। পরক্ষণেই সেটি সশব্দে আছড়ে পড়ে ভূতলে। আবার তাকে পালকবৎ নিজের হাতে তুলে নেয় যুবকটি, আবার সবলে নিক্ষেপ করে ধরণীপৃষ্ঠে। তারপর আবার, তারপর আবার। বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোটা যেন সারা বিগ্রহের গায়ে পরম যত্নে মাখিয়ে দেয় রক্তচন্দনের প্রলেপ।
সেই অদ্ভূত ধ্বংসলীলা থেকে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরিয়ে নেয়নি আত্রেয়ী। নির্বাক, নিস্পৃহ চোখে সে তাকিয়ে ছিল। কার্যক্রম সমাপ্তিকালে যখন একপার্শ্বে দাঁড়িয়ে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে যুবকটি, রাজকন্যা এগিয়ে যায় সেই মানুষটির দেহাবশেষের দিকে, যাকে সে এতদিন শিক্ষাগুরু হিসেবে পরম শ্রদ্ধার জায়গায় উপবিষ্ট করিয়ে রেখেছিল। তাকে সে স্পর্শ করে না। কেবল তার মুখমন্ডলের অবস্থান আন্দাজ করে নিয়ে একদলা নিষ্ঠীবন পরিত্যাগ করে তার ওপর। তারপর ধীর, শ্রান্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে আসে মন্দিরচত্বর ছেড়ে।
*********
দুর্গের পিছনের দরজা আর মন্দিরের সংযোগকারী পথটি দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে আসছিলেন রানীমা। প্রাসাদে ফিরেই, কোনো এক অজ্ঞাত খেয়ালে রাজপণ্ডিতের কাছে সেই প্রাচীন পুঁথিটি একবার চেয়ে নিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে পাঠাগারে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে রাজপন্ডিতের অনুপস্থিতি আবিষ্কার করে এক অজানা আশঙ্কায় সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে যায় তাঁর। কোনোরকমে খুঁজে খুঁজে পুঁথিটি উদ্ধার করে পড়তে শুরু করেন একের পর এক পৃষ্ঠা। নিঝুমপুরের ইতিবৃত্ত। বেশিদূর যেতে হয় না, রক্তপলাশ সংক্রান্ত অধ্যায়টি পাওয়া যায় কিছু পরেই। কিন্তু সেখানে লেখা অক্ষরগুলি দেখে চোখের সামনে ঘন অন্ধকারের পর্দা নেমে আসে তাঁর। তিনি বারবার পড়েন বর্ণগুলি। বারবার বারবার। কিন্তু সেগুলো বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয় না। এইতো... এইতো এখানে স্পষ্ট লেখা আছে, রাজপরিবারের গুরুতর অনিষ্টচিন্তাকারী কেউ ছদ্মবেশে রাজ-সান্নিধ্যে অবস্থান করলে, দেবী ছিন্নমস্তার সতর্কবার্তা-স্বরূপ রক্তপলাশের গাছ শূন্য হয়ে যায়। এর কোনো নির্দিষ্ট দিন নেই। অনিষ্টচিন্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে যে কোনো দিনই এটা হতে পারে। সাথেসাথেই বিদ্যুচ্চমকের মতো সমস্ত বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে রানীমার কাছে। কালবিলম্ব না করে পুনরায় প্রাসাদ পরিত্যাগ করেন তিনি।
আচ্ছন্ন ভাবে প্রাসাদদুর্গের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল আত্রেয়ী। আচমকাই যেন প্রবল সংঘর্ষ হয় কার সাথে। পরক্ষণেই দুটি কোমল হাত একরাশ নিশ্চয়তার আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে তাকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরে ওঠে তার শির-ললাট। এই নিয়ে দিনের দ্বিতীয়বারের মতো মায়ের বাহুবন্ধনে নিরাপত্তায় আবদ্ধ হয় রাজকন্যা আত্রেয়ী।
অকস্মাৎ সেই দমকা ঘূর্ণিঝড়টা বেষ্টন করে ফেলে দুটি প্রাণীকে। মেয়েকে বুকের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে নিয়ে, রানীমা সভয়ে বলে ওঠেন, "এ কী! একী অশৈলী ঘটনা!"
"ভয় নেই, মা!" আত্রেয়ীর কন্ঠে আত্মবিশ্বাস, "এ যে মহাকাল। আমার... আমাদের সকলের রক্ষাকর্তা। সে আসে... সে সত্যিই আসে... কিন্তু বলি দাবি করতে নয়, মানবতাকে পাপাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে।"
ঝড়টা একবার পাকসাট খেয়েই দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যাওয়ার পর, মা-মেয়ে দুজনেরই দৃষ্টি চলে যায় অদূরস্থিত রক্তপলাশ বৃক্ষটির দিকে। পুষ্পভারে নত হয়ে আসা গাছটির শাখা-প্রশাখা থেকে যেন টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে, প্রকৃতির নিজের বুকের রক্ত।...