তান্ত্রিক বাবা
তান্ত্রিক বাবা
আমাদের আশেপাশে এমন অনেক কিছু ঘটে চলেছে যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলি। আমাদের ব্যস্তময় জীবনে সময় ও ধৈয্যের অভাবে একান্ত গুরুত্বহীন বলে মনে করি এই বিষয় গুলোকে। তাই আমরা একবারও জানতে চাইনা বুঝতে চাইনা খুঁজতে চাইনা সেই সব কারণ গুলোকে , যার জন্য সমাজের মাঝে থেকেও প্রকৃতি বিরোধী এই বিষয় গুলি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে অনন্ত ভাবে ।
আজ এমনি এক প্রকৃতি বিরোধী বর্তমান ঘটনার কথা তুলে ধরবো আপনাদের সামনে। আর এখানেই ফুটে উঠবে আজকের সমাজের উদাসীনতার পরিচয়।
আজকের দিনে পুরোনো বাড়ি বা ফাঁকা জায়গা প্রোমোটারদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা খুব দায়। যত মানুষের আনাগোনা বাড়ছে শহর ও আধা শহর অঞ্চল গুলির দিকে , ততই বেড়ে চলেছে প্রোমোটার রাজ। পুরোনো বাড়ি ভেঙে তৈরী হচ্ছে আকাশ ঝাড়ু সব বিল্ডিং। একই আড়াই কাটার জমিতে বাস করছে একই সাথে একাধিক পরিবার।
তাই এটা দেখে খুব অবাক লাগে , বৈদ্যবাটির মতো একটা এমন জনমানুষ সমাগম আধা শহরাঞ্চলে স্টেশন থেকে দুই মিনিট হাঁটা পথের দূরত্বে থাকা এই আড়াই কাটার জমির উপর বাগান ঘেরা তিন কামরার একতলা ঘর খানা কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে এতো দিন ধরে। যে বাড়িতে আনুমানিক ৫৪ বছরের উপর কেউ থাকে না। কোনোদিন এই বাড়িতে জন মানুষের সমাগম হয়নি , পড়েনি এই বাড়ির সদ্যদের পায়ের পদ ধুলো , পড়েনি শঙ্খ ধ্বনি, হয়নি কোনো পুজো। ৫৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এই ভাবে। এই বাড়ির অজ্ঞাত মালিকানা যাদের তারা আড়ালে থেকেই পরিচালনা করে চলেছে এই বাড়িটার। ৫৪ বছরের ও বেশি সময়ের পুরোনো এই বাড়িটা এখনো রয়েছে তার নবীন রূপে। আগাছা দূরের কথা তার বাগানের একটা ঘাসের ডগাও মাথা ঝারা দিয়ে ওঠার আগে তাকে নিজের রূপে ফিরিয়ে দেয় এই বাড়ির একমাত্র পরিচারক। বাড়িটি প্রতি বছর রং করা জানালা দরজা রং করা প্রতিটা ঘর পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা প্রতিদিনের কাজ সেই পরিচারকের। দিনের বেলা সে আসে আর দুপুরের মধ্যে চলে যায় কাজ শেষ করে।
যে বাড়িতে লোক বসবাস করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে সেই বাড়ির উঠানের পতিত জমি আগাছা উঠে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে যেতে দেখেছি আমি । আর এই বাড়িতে না থাকে কেউ , না এরা এই বাড়ি ভাড়া দেয় না নিজেরা থাকে। তাও বছরের পর বছর ধরে এই বাড়িকে এই ভাবেই যত্ন করে চলেছে। কোনো অজানা লোক এই বাড়ি দেখে বলবে না যে এই বাড়িতে কোন মানুষ থাকে না।
কিন্তু কেন ?
আমার বাবার ৫৪ বছর বয়স , উনিও সেই ছোট বেলা থেকে এই বাড়িকে এই ভাবেই দেখে আসছেন , আর আমিও এই বাড়ি কে এই ভাবেই দেখে আসছি আজ ৩০ বছর ধরে। রোজ রাতে অফিস থেকে এই বাড়ির পাস দিয়ে ফেরার সময় আমার মন বলে এই এতো গুলোর বাড়ির মাঝে এই পরিষ্কার পরিছন্ন বাড়িটি বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কত না কথা লুকিয়ে আছে তার মধ্যে যদি সে বলতে পারতো। এই সুন্দর বাড়ির প্রতি তো যে কোনো মানুষের টান আসাটা স্বাভাবিক। তাহলে কেন আজ পর্যন্ত থাকতে আসেনি এই বাড়িতে , কেন প্রোমোটারদের চোখ পড়েনা এই বাড়ির দিকে , কেন সবার চোখের এতো সামনে থেকেও অজ্ঞাত হয়ে থাকে এই বাড়িটি ,
কি তার রহস্য ?
এই উত্তরে খোঁজে বেশ কয়েক মাস ধরে ওই বাড়ির আসে পাশের অন্যান্য বাড়ির মানুষদের সাথে আমি কথা বলার চেষ্টা করি , ওই রহস্যময় বাড়ির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আশেপাশের কোনো বাড়ির কোনো মানুষ ই ওই বাড়ি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে একদমই রাজি হলো না। উপরুন্ত অনেকে এই সব প্রশ্ন শুনে খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করলো আমার সাথে। মোট কথা এই বাড়ির বিষয়ে কোনো কথাই কেউ বলতে চাইলো না। এই বাড়ি থেকে নিজেদের দূরে রাখাটাই পছন্দ করে তারা।
আর এই ব্যাপারটার জন্যই আমার কাছে আরো বেশি রহস্য জনক হয়ে উঠলো এই বাড়িটা ।
আমার বাবার মুখ থেকে এই বাড়ির বিষয়ে যে টুকু আমি জানতে পেরেছি তা লোক মুখে প্রচলিত। এই বাড়িতে নাকি কেউ কোনোদিন বসবাস করতে পারেনি , এই বাড়ির লোকেরা যখন এই বাড়িতে থাকার চেষ্টা করেন কোনো ভাবেই তারা নাকি এই বাড়িতে থাকতে পারেনি। না না রূপ ভৌতিক উপদ্রপে তারা এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর অনেক সাহসী মানুষেরা এই বাড়িতে থাকার চেষ্টা করে তারাও একই ভাবে হার মানে এই বাড়ির কাছে। এই ভাবে ভৌতিক বাড়িতে হিসাবে পরিচিতি লাভ করে এই বাড়ি খানা। এই সব কথা শুনে একবার এলাকার ক্লাবের ছেলেরা দল বেঁধে রাত কাটাতে যায় সেই বাড়িতে , কিন্তু এই বারেও প্রতিবারের মতো ক্লাবের ছেলেরা রাতের অন্ধকারেই পরিত্যাগ করে সেই বাড়ি। আর সেই থেকেই ওই বাড়ি রয়ে গেছে এই ভাবে একা নিঃসঙ্গ জন মানবহীন ভাবে। বাবার মুখে এই কথা শুনে আমি বড়ো অবাক হলাম ।
বাড়িটার যাই ইতিহাস থাক , আর যেই টুকু তথ্য আমি পেয়েছি এই বাড়ির সম্পর্কে। সেই থেকে এই বাড়িকে কোনো মতেই ভৌতিক বাড়ি বলে আমার মনে হয়নি। কারণ এই বাড়ি দেখে আমার মধ্যে কোনোদিনই কোনো রকমের ভীতির সঞ্চার হয়নি। বরং অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাত নয়টা দশটার সময় আমি রোজ ইচ্ছা করেই ফিরতাম ওই বাড়ির পাস দিয়ে । এক মুহূর্তের জন্য আমার কিন্তু এই বাড়ি দেখে কোনোদিন ভূতের বাড়ি বলে মনে হয়নি। তবে এই বাড়িতে কিছু তো একটা অলৌকিক শক্তি আছে যা শুধু এই বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ , কারণ এই বাড়ির জন্য আশেপাশের বাড়ির কোনো প্রতিবেশীর কোনোদিন কোনো প্রকার ক্ষতি বা অসুবিধা হয়েছে বলে আজ অব্দি কিছুই শোনা যায়নি। তাই প্রতিবেশীরাও এই বাড়ি নিয়ে কখনো মাথা ঘামাতোনা। তাই সেদিন আমি এমন ব্যবহার পেয়েছিলাম সেই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে।
আমার মধ্যে এই বাড়ির আসল গল্প আসল তথ্যটা জানার এক অদম্য ইচ্ছা যেন আমাকে পেয়ে বসলো। তাই আমি খোঁজ শুরু করলাম সেই বাড়ির লুকিয়ে রাখা রহস্যের।
অনেক মানুষের সাথে দেখা করে কথা বলে অবশেষে এমন একজন কে খুঁজে পেলাম যিনি ছিলেন সব থেকে প্রাচীন মানুষ। আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব রহস্যের খোঁজ শিক্ষিত মানুষের কাছে পাওয়া যায় না। ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে মস্তিস্ক , আমি ছিলাম সেই মস্তিষ্কের খোঁজে। কিছুদিন পর ওই এলাকার এক আদিবাসী বৃদ্ধের থেকে আমি জানতে পারি এক অদ্ভুত ঘটনা। ওই বাড়ির আশেপাশের বহুতল বাড়ির শিক্ষিত মানুষদের থেকে খারাপ ব্যবহার পেলেও। এই দরিদ্র বৃদ্ব কিন্তু সাবলীল ভাবে বলে চললো তার দেখা যুবা বয়সের সেই বাড়ির ভয়ানক অভিজ্ঞাতার কথা। বৃদ্ধের বর্তমান বয়স ৮২ বছর যেই সময়ের কথা তিনি বলে চললেন সেটা ১৯৩৬ সালের দিকের কথা তখন বৃদ্ধের বয়স বড়ো জোর ২২ বা ২৪ বছর। বৃদ্ধটি শুরু করলো তার গল্প আর আমি হারিয়ে গেলাম সেই বৃদ্ধের গল্পের মাঝে।
বৈদ্যবাটী এখন মোকরসোল হলেও , সেই সময় এই বৈদ্যবাটির প্রাকৃতিক রূপ ছিল সম্পন্ন অন্য রকম। পল্লী বাংলার চাপ ছিল তখন এই গ্রামের উপর পরিস্ফুষ্ট। চারিদিকে তখন ছিল বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের বাগানের মেলা। এখন চারিদিকে যে সব বাড়ি ঘর গজিয়ে উঠেছে। তখন তার দশ শতাংশ বাড়িও ছিলনা। আজকের যে রাস্তায় চলে বেড়াচ্ছে মোটরগাড়ি , সেই সময় এই রাস্তায় দিনে দুপুরে পর্যন্ত বাঘের দেখা মিলতো। শিয়াল আর হায়নার কথা তো বাদই দিলাম। আর যেই বাড়ির বিষয়ে জানার জন্য তুমি ছুটে এসেছো , আজ থেকে ৬০ - ৬৫ বছর আগে সেখানে ছিল বড়ো বড়ো তিনটে আমবাগান। দেখবে ওই বাড়ি থেকে খানিক দূরে এক ভাঙা পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ি আছে , আছে মানে ছিল বলা চলে। এখন শুধু তার সিংহ দরজার খানিকটা অংশই অবশিষ্ট আছে। ওই জমিদার বাড়ির তৎকালীন জমিদার বাবুর হাতেই ছিল এই সমগ্র আম বাগানের একচেটিয়া মালিকানা। সেই সময় সেই জমিদার বাড়ি সব সময় গমগম করতো , জমিদারবাবুর পরিবার এছাড়া ঠাকুর চাকর মালি সব সমেত জনা কুড়ি মানুষ বাস করতো এই জমিদার বাড়িতে।
এই আম বাগান তিনটে ছিল খুব ঘন অরণ্যে ঘেরা। তাই এই বাগানে বড়ো একটা কেউ যেতোনা। এখন যেমন লোকে আমের বাগান লিস নেয় , তখন তেমন ছিল না , কারণ তখন চারিদিকেই লোকের বাড়ি বাড়ি আম কাঁঠালের গাছের কোনো অভাব ছিল না। তাই সেই আম বাগান গুলো ওই ভাবেই জঙ্গল হয়েই পরে থাকতো।
আর এই ঘন আম বাগানের জঙ্গলের মধ্যেই বাস করতেন এক তান্ত্রিক বাবা। অনেকে অনেক রকম কথা বলতো ওনার বিষয়ে। কেউ বলতেন উনি পিশাচ সিদ্ধ পুরুষ , কেউ বলতো উনি তারাপীঠের বড়ো তান্ত্রিক , একাকী সাধনা করার জন্য তিনি নাকি এই ঘন জঙ্গলের মদ্ধস্ত বসবাস করেন লোক চক্ষুর আড়ালে, যাতে ওনার সাধনায় কেউ বাধা না দিতে পারে। এমনি তে সেই তান্ত্রিক বাবা বড়ো একটা জঙ্গল ছেড়ে বাইরে বেরোতেন না প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র সংগ্রহ করা ছাড়া। এই তান্ত্রিক বাবার ওই জঙ্গলে বসবাস নিয়ে জমিদার বাবুর ও কোনো আপত্তি ছিল না।
তান্ত্রিক বাবা সাধারণত একাই থাকতে পছন্দ করতেন , তাও অনেক সময় না না কারণে সাহায্যের জন্য যদি কোনো নারী না পুরুষ তান্ত্রিক বাবার কাছে চলেও যেত , তান্ত্রিক বাবা সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করতেন। এমনও শোনা গেছে তান্ত্রিক বাবার আশীর্বাদে অনেকের দুরারোগ্য ব্যাধিও সেরে যেত। তবে বেশি মানুষের আনাগোনা তিনি মটেই পছন্দ করতেন না। তাই বড়ো একটা কেউ তান্ত্রিক বাবার কাছে যেত না খুব দরকার না থাকলে।
এই ভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন। হঠাৎ এই বৈদ্যবাটি গ্রামে না না জায়গা থেকে বহিরাগত মানুষজনের সমাগম বেড়ে চললো। ফলে জনবসতি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে ওঠে। এর সাথেই জমিদার বাবুর কাছে আসতে থাকে জমি বিক্রয় করার প্রস্তাব। জমিদার বাবুর আমবাগান তিনটি ছিল একদম রেল স্টেশনের কাছাকাছি , মাত্র হেটে ২ মিনিটের ব্যবধানে। তাই সেই জমির দর ভালো উঠতে থাকে। এইদিকে জমিদার বাবুর আর্থিক অবস্থা সেই সময় হয়ে এসেছিলো খুবই খারাপ। কথায় বলে না " নামেই তাল পুকুর , কিন্তু ঘটি ডোবে না " সেই অবস্থা। এদিকে জমিদার বাবুর সেই বাগানের জমি প্রতি কাটা হিসাবে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠে গেলো। জমিদারবাবু তাই সেই লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না । কিন্তু জমি বিক্রয় করতে গেলে আগে সেই বাগান কেটে পরিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই জমিদার বাবুর আদেশে কিছু কাঠুরিয়ার দল বেঁধে শুরু করলো সেই ঘন আম বাগানের কলমশ্রী কে ধ্বংস করার কাজ। কাঠুরিয়ার কুঠারের আঘাতে মাটিতে শুয়ে পড়তে থাকলো একের পর এক বড়ো বড়ো গাছ । কিন্তু এই কাজে বাঁধ সাধলো এসে সেই তান্ত্রিক বাবা। যে তান্ত্রিক বাবা কোনো দিন ভালো ভাবে জন সমুক্ষে আসেনি , সেই তান্ত্রিক বাবা সোজা পৌঁছে গেলো জমিদার বাড়িতে। আর খুবই বিনম্র ভাবে বললো , এই জঙ্গল কাটিস না বাবা। আমি এক মহা সাধনায় লিপ্ত আছি যা এই গ্রামের উপকারের জন্যই করছি । জমিদার বাবুর মুখে নতুন জন বসতি স্থাপনের কথা কথা শুনে , তান্ত্রিক বাবা বলেন ঠিক আছে তাহলে আমি ওই জঙ্গলের যেই ভূমিতে আমার সাধনা করছি সেই ভূমির আশেপাশের জঙ্গল যেন না কাটা হয়। জমিদারবাবু সহ তৎকালীন সকল গ্রামবাসী তান্ত্রিক বাবাকে ভক্তি করতো। তাই মুখের উপর না বলার সাহস হলো না জমিদারবাবুর। তাই জমিদারবাবু তান্ত্রিক বাবাকে সেই প্রত্যাশাই দিলেন। যে ওনার সাধনার জায়গার আশেপাশের কোনো গাছ কাটা হবে না। এই শুনে হাসি মুখে আসস্থ হয়ে তান্ত্রিক বাবা চলে গেলেন।
জমিদার বাবু হয়তো তান্ত্রিক বাবাকে দেওয়া নিজের কথাই রাখতেন , কিন্তু বাঁধ সাধলো অন্য জায়গায়। জমি ক্রয় কারকদের এই কথা জানাতে তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হলো না। তাদের বাসস্থানের পাশে এক তান্ত্রিক তার কালা জাদুর কাজ করবে সেই জায়গায় তারা থাকতে পারবেনা। বরং তারা অন্যথা কোথাও জমির ব্যবস্থা করবে। এই বলে তারা চলে গেলো। জমিদার বাবু পড়লেন মহা বিপদে। তিনি ভেবে দেখলেন এমনিতে জমিদারির অবস্থা ভালো না ,তার উপর ওই জঙ্গল থেকে এক পয়সা লাভ হয়না। উপরন্তু হাতে আসা লক্ষি দূরে চলে যাচ্ছে। সেই জমির কাটা প্রতি ৫ হাজার পর্যন্ত দাম উঠে গেলো , তখনকার সময় সেই টাকা আকাশ ছোয়া । এবার জমিদার বাবু জঙ্গলে লোক পাঠালেন সেই তান্ত্রিক বাবার কাছে , বলে পাঠান তান্ত্রিক বাবা যেন ২ দিনের মধ্যে ওই জঙ্গল পরিত্যাগ করে চলে যান। উত্তরে তান্ত্রিক বাবা বলে পাঠান জীবন থাকতে এই জঙ্গল ছেড়ে উনি কোথাও যাবো না , যাও গিয়ে বলে দাও তোমাদের জমিদারবাবু কে।
জমিদারবাবুর মাথায় তখন টাকার ভুত চেপে বসেছে। আর সেই ভূত ভ্রষ্ট করে তুলেছে তার সকল প্রকার বুদ্ধিকে । তার মাথায় তখন চলছে তান্ত্রিক বাবা থাকলে এই জঙ্গল বিক্রয় হবে না। তাহলে হাতে কোনো টাকাও আসবে না।
তাহলে উপায় ?
তারপর কিছু একটা কথা ভেবে এক পৈশাচিক মুচকি হাসি খেলে যায় জমিদার বাবুর মুখে। আর সেই হাসি কোনো স্বাভাবিক হাসি ছিল না , সেই হাসিতে মিশে ছিল কোনো এক অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
সেদিন রাত ১২ টার পর জমিদার বাড়ি থেকে চার জন সন্ডা মার্কা লোক লাঠি হাতে প্রবেশ করলো সেই জঙ্গলের মধ্যে। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো জমিদার বাবুর কথা মতো সব কাজ সঠিক ভাবে করতে পারলে আমাদের আর সারাজীবন কাজ করে খেতে হবে না। পায়ের উপর পা তুলে চলবে আমাদের। তাই খুব সাবধানে কাজটা সারতে হবে আমাদের। এই সব কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে গেলো তান্ত্রিক বাবার সাধনা ভূমির কাছাকাছি। একটা মোটা আম গাছের আড়াল থেকে তারা দেখলো তান্ত্রিক বাবা হোমাগ্নি জ্বালিয়ে দুই চোখ বুঝে ধ্যানে বসে আছেন। এই দেখে ওই চার সন্ডা লোক গুলো বুঝলো এই সুযোগ , আর সাথে সাথেই তারা দৌড়ে গিয়ে একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেললো তান্ত্রিক বাবার মুখ। আর কাপড়টা এমন ভাবে জড়ালো যাতে কোনো ভাবে নিঃশ্বাস না নিতে পারে তান্ত্রিক বাবা । তারপর একজন খুব জোরে লাঠির এক ঘা কষিয়ে দেয় তান্ত্রিক বাবার মাথা লক্ষ্যকরে। এবার চার সন্ডা মিলে মুহূর্তেই ধরাশায়ী করে ফেললো তান্ত্রিক বাবা কে। নিজেকে আত্মরক্ষা করার কোনো অবকাশ পেলেন না তান্ত্রিক বাবা । তান্ত্রিক বাবার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলে একজন ধারালো চুরি বার করে দুভাগ করে কেটে ফেললো তান্ত্রিক বাবার গলার নলি খানা কে। চিরদিনের মতো নিঃস্তেজ হয়ে গেলো তান্ত্রিক বাবার শরীর। শুধু মুমূর্তের জন্য একবার দপ করে জ্বলে উঠে নিভে যায় হোমাগ্নির আগুনের কুন্ড খানা। যেন তান্ত্রিক বাবার জীবনের অবসানের সাথে চিরদিনের মতো নিভে গেলো সেই হোমাগ্নির অগ্নি কুন্ড। তারপর সেই চার সন্ডা পুরুষ মিলে সেই হোমাগ্নির কুন্ডের নিচেই মাটি খুঁড়ে সলিল সমাধি দেয় তান্ত্রিক বাবার দেহটাকে। তান্ত্রিক বাবার সাধের সাধনা ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার সমাধি ক্ষেত্র।
আমি বৃদ্ধকে এবার থামিয়ে প্রশ্ন করলাম , এই কথা আপনি কি ভাবে জানলেন ?
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললো এখনো যে আমার বলা বাকি , তার মধ্যেই তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। মনে হলো বৃদ্ধ ও যেন হারিয়ে গেছে আমারই মতো সেই ফেলে আশা স্মৃতি গল্পের মাঝে। এই বলে বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলো।
এর পরের দিন জমিদারবাবু ও সেই চার সন্ডা গোটা গ্রাম ময় রটিয়ে দিলো যে জঙ্গলের তান্ত্রিক বাবা হঠাৎ অন্তর্ধান হয়েছেন। তিনি হয়তো আবার সেই তারাপীঠে ফিরে গেছেন , গ্রামের সরল মানুষেরা সেই কথাই বিশ্বাস করলো। আর তারপর জঙ্গল কাটার কাজ ও সম্পন্ন হলো মাস দুয়েকের মধ্যে। ছয় মাসের মধ্যে গোটা বাগানের জঙ্গল বিক্রি হয়ে গিয়ে জমিদার বাবুর হাতে নগদ টাকা চলে এলো। তারপর শুরু হলো জনবসতি স্থাপনের কাজ। এক এক করে ঘর গড়ে উঠতে থাকলো সেই জমির উপর । কিছু দিনের মধ্যে বসে গেলো সেখানে জন বসতি।
আর তার কয়েক মাস পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। জঙ্গলের মধস্থ একটা জমির উপর বাড়ি তৈরী করার জন্য ভিত খুঁড়তে গিয়ে মিস্ত্রির কোদালে কিছু একটা ঠঙ করে লাগলো। বাড়ির মালিক সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন দেখাও খুঁড়ে তোলো কিসে লাগলো কোদাল , দেখো তুলে । শেষে দেখা গেলো এক নর কংকাল। এই হলো সেই জমি যা একদিন ছিল তান্ত্রিক বাবার সাধনা ক্ষেত্র , আর এখন তান্ত্রিক বাবার সমাধি ক্ষেত্র। এই দেখে জমির মালিক প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। সেই খবর জমিদারবাবুর কানে গেলে উনি এসে বলেন , সেই সময় ডাকাতেরা খুব খুন করতো আর জঙ্গলে লাস পুঁতে দিতো , ওহে মিস্ত্রি তুমি বাপু কংকালটা ফেলে দিয়ে কাজ শুরু করো। মিস্ত্রি তাই করলো , জমির মালিক ও আসস্থ হলো।
আর সেই দিন রাতেই ঘটলো এক মারাত্মক ঘটনা। হঠাৎ ই মাঝ রাতে নিজেদের ঘরে পাগলের চিৎকার করতে করতে মারা গেলেন গ্রামের চার জন গ্রামবাসী , আর তারা হলো সেই চার সন্ডা যারা তান্ত্রিক বাবাকে মেরে ফেলেছিলো। তারা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবুল করে গেছে তান্ত্রিক বাবাকে হত্যা করার কথা ও তান্ত্রিক বাবার কাছে করে গেছে বাঁচার আকুল নিষ্ফল আকুতি মিনতি।
সব থেকে দোষী ছিলেন জমিদার মশাই , তাই পরের দিন দেখা যায় উন্মাদ ভাবে জমিদার মশাই একই ভাবে তান্ত্রিক বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে সেই তান্ত্রিক বাবার সমাধি স্থানে গিয়ে ক্রমাগত মাথা ঠুকে ঠুকে নিজের কেউ কর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে চাইতে মাথা থেকে রক্ত বার করে অজ্ঞান হয়ে যান। আর সেই দিন রাতেই জমিদার বাবুর ভবলীলা সাঙ্গ হয়। এতো কষ্টে জমি বেচে উপার্জিত টাকা তাকে আর ভোগ করতে হলো না। অন্য দিকে জমিদার মারা যাওয়ার পর না না কারণ কে উপলক্ষ করে সেই উপার্জিত অর্থ শেষ হয়ে গেলো অল্প দিনের মধ্যে। কয়েক বছরের মধ্যে জমিদার বাড়ির বাকি লোকেরা চলে গেলো অনত্র। ফাঁকা পরে রইলো সেই জমিদার বাড়ি। প্রকৃতির নিয়মে বাস অনুপযুক্ত হয়ে উঠলো সেই বাড়ি।
আর সেই তান্ত্রিক বাবার সমাধি ক্ষেত্রে উপর প্রতিষ্ঠিত বাড়ি সম্পন্ন হলেও , না না বিধ উপদ্রোপের জন্য থাকতে পারলেন না সেই গৃহ মালিক ও আর পরিবার। সেই বাড়ি পরে রইলো খালি। সেখানে আবার সাধনা শুরু করলো মৃত তান্ত্রিক বাবার অতৃপ্তপ আত্মা । অনেক বার না না ভাবে চেষ্টা করেও কেউ সফল হলো না সেই বাড়িতে বসবাস করতে। কিন্তু জানিনা কি কারণে ওই বাড়ির গৃহস্বামী অনত্র চলে গেলেও , সমানে যত্নে রেখে দেয় এই বাড়িটিকে। তাই আজ যেমন রূপে দেখছো তুমি এই বাড়িটাকে , আজ থেকে ৬০ বছর আগেও এই বাড়ি ছিল এমনি নবীন । এই হলো আজকের এই ভৌতিক বাড়ির ইতিহাস , কেউ এই কথা বিশ্বাস করে , কেউ করে না। তবে এই তান্ত্রিক বাবার অতৃপ্ত আত্মা কোনো দিন কারোর কোনো ক্ষতি করেনি। উনি ওনার সাধনা ক্ষেত্রের মধ্যে ই সীমাবদ্ধ আছেন।
ওই বৃদ্ধের কথায় আমি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম সুদূর অতীতে। সত্যি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম আমি পুরো ঘটনাটা নিজের চোখের সামনে।
ওই বৃদ্ধ আরো এক কথা বলেন , যদি সেই সময় তান্ত্রিক বাবার কঙ্কালটা ফেলে না দিয়ে তারা পুড়িয়ে দিতো। তাহলে হয়তো তান্ত্রিক বাবা মুক্তি পেয়ে যেতেন। কিন্তু তারা তানা করে ফেলে দেয় সেই কংকালটা। তাই আজও মুক্তি পায়নি তান্ত্রিক বাবা , তার মোহো কাটাতে পারেনি তার প্রিয় সাধনা ক্ষেত্রের উপর থেকে। আজ রয়ে গেছেন তিনি এই খানেই। হয়তো থেকে যাবেন তিনি যুগ যুগ ধরে এই ভাবেই চিরন্তন হয়ে , কাটবে কত বসন্ত সময় চলতে থাকবে অনন্ত।

