আদী বাঙালি
আদী বাঙালি
গৃহস্থ বনেদী বাড়ির মেয়ে হলো চেতনা । জুতো সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ, গৃহস্থের সব রকমের কাজেই সে হলো পারদর্শী। সাথে রান্নবন্নাতেও তার ছিল জুড়ি মেলা ভার । একবার যদি কেউ চেতনার হাতের রান্না খেত । তাহলে সে আর কোনো দিনও ভুলতে পারতো না সেই খবরের অপরূপ স্বাধ। বিশেষ করে চেতনার নিজের হাতের বানানো শুক্তো পদটি ছিল সব রান্নার মধ্যে অন্যতম ও অভাবনীয়।
চেতনার এই রান্নার হাতের কেরামতির জন্য , তাদের পড়শীর কোনো অভাব ছিল না । তাই প্রতিদিন কোনো না কোনো ছুতোয় কেউ না কেউ ঠিক বাটি চালাচালি অবশ্যই করত চেতনার বাড়িতে । এই যেমন পাশের বাড়ির মালতী বৌদি সেদিন একবাটি আমের আচার চেতনার হাতে দিয়ে বলল । ওলো চেতনা এই নাও ভাই আজ একটু আমার আচার করেছিলাম । তাই চিনি সন্দেশের জন্য একটু নিয়ে এলাম । ওরা আমের আচার খেতে কতো ভালোবাসে । এই বলেই মালতী বৌদি বলে ওঠে । তোমার দাদা তো তোমার রান্নার খুবই প্রসংশা করে । বিশেষ করে তোমার হাতে বানানো শুক্তোর। কি যে তৃপ্তি করে খায় উনি তোমাকে কি আর বলবো। চেতনার বুঝতে আর অসুবিধা হলো না , যে মালতী বৌদি আমের আচারের বদলে তার হাতের শুক্তো খাওয়ার ফরমায়েশ দিয়ে গেলো ।
এই সব দেখে সিদ্ধার্থ মজা করে চেতনা কে বলতো । হ্যাঁ সত্যি আমার অন্নপূর্ণা তুমি । তোমার হাত ধরেই মনে হয় আদি বাঙালির প্রিয় ভোজন রোশিক পদ গুলো বেঁচে থাকবে আমাদের এই কৈবর্ত পাড়ার ঘরে ঘরে। তারপর হাসি মুখে একটু মজার ছলে সিদ্ধার্থ বলে । বলো দেখি আজ কোন পদের রান্নার ফরমায়েশ পেয়েছ তুমি । কারণ আমি বাজার যাইতেছি, বলো তবে কি কি উপকরণ আজি লাগিবে তোমার রান্না ঘরে । চেতনা মিষ্টি ভাবে একটু লাজুক হেসে বলল শুক্তো ।এই কথা বলার পর সিদ্ধার্থ ও চেতনা দুজনেই সমস্বরে হেসে ওঠে এক ওপরের দিকে তাকিয়ে।
আজ প্রায় তেরো বছর হয়ে গেল সিদ্ধার্থ ও চেতনার বিয়ের । সেই বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের বৈবাহিক জীবনে কোনো রকমের মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়নি । সিদ্ধার্থ সকালে বাজার করে এনে দিয়ে চলে যেতো তার কাপড়ের দোকানে । বাজারের মাঝে তার ছিল নিজের কাপড়ের দোকান । সেবনিজেই চলতো সেই দোকান খানা । সকালে গিয়ে সেই রাতে বাড়ি ফিরত সিদ্ধার্থ । অন্যদিকে সংসারের কাজ আর পাঁচ বছরের চিনি ও সাত বছরের সন্দেশকে নিয়েই কেটে যেতো চেতনার সারাটা দিন। আর তার সাথে নিয়ে পড়শিদের নানান রান্নার ফরমায়েশ ।
এই সব কিছুতে কিন্তু কোনো দিনও বিরক্ত হতো না চেতনা । যদি তার হাতের রান্না খেয়ে কেউ একটু তৃপ্তি পায় , তবে তা পাক না । তাতে ক্ষতি তো কিছুই নেই ।
এই ভাবেই হাসি খুশিতে কেটে যাচ্ছিল চেতনা ও সিদ্ধার্থের দৈনন্দিন জীবন । এমনি একদিন বিকালে চেতনা বাড়ির বারান্দায় বসে চিনি ও সন্দেশের মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে । ঠিক সেই সময় সিদ্ধার্থের এক দুর সম্পর্কের রাঙা পিসিমা এসে হাজির তাদের বাড়িতে । সিদ্ধার্থ নিজেও জানে না যে উনি ঠিক কি রকমের সম্পর্কের পিসিমা তার । যাই হোক বৃদ্ধা বিধবা সহায় হীন মানুষ উনি । তাই রাঙা পিসিমা এলে পরম যত্নে তাকে সাদর আমন্ত্রণ করে অনেক সেবা যত্ন করতো চেতনা।
এই রাঙা পিসিমা ও ছিলেন চেতনার হাতের উপাদেয় ও সুস্বাদু রান্নার একজন বড় ভক্ত। তাই একবার তিনি তাদের বাড়ি এলে এক সপ্তাহের আগে উনি ফেরার নাম পর্যন্ত করতেন না। রাঙা পিসিমাকে দেখেই চিনি সন্দেশ ঠাকুমা এসেছে বলে অকৃত্রিম আনন্দে দৌঁড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে রাঙা পিসিমার। ঠাকুমা বলতে চিনি সন্দেশ ওই রাঙা পিসিমাকেই চিন্ত । কারণ সিদ্ধার্থের বাবা মা মারা যান তার সেই শিশু কালেই । রাঙা পিসিমাও খুব ভালোবাসতো চিনি সন্দেশকে ।
রাঙা পিসিমা কে দেখে সাদরে আপ্রায়ন করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায় চেতনা । চিনি সন্দেশের মাথায় সস্নেহে হাত বুলোতে বুলোতে রাঙা পিসিমা বলেন । মা চেতনা, তোর হাতের রান্না খেতে চলে এলাম মা , অনেক দিন হলো তোমার হাতের মধুর রান্না খাওয়া হয়না। চেতনা বলে বেশ করেছেন পিসিমা। আপনার ভাইপোও এসে খুব আনন্দ পাবে আপনাকে দেখে । আপনি ছাড়া গুরুজন বলতে আমাদের মাথার উপর আর কে আছে বলুন ।
সিদ্ধার্থ রাতে বাড়ি ফিরে রাঙা পোসিমাকে দেখে বেশ রসিকতার সুরে বললো। তাহলে তোমার ভক্ত খাদ্য অনুরাগী রাঙা পিসিমা এসে গেছেন। তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই ।কাল থেকে রোজ তুমি তোমার হাতের খাদ্য নৈপুণতার প্রসংশা হাতে হাতে পাবে । এই বলে মুচকি হেসে সিদ্ধার্থ চেতনার উদ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলে । কাল কি কি আনতে হবে বাজার থেকে তার লিস্টটা যেনো চেতনা টেবিলে রেখে দেয় ।
পরের দিন সকালে সিদ্ধার্থ বাজার করে এনে দিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে চলে যায়। সিদ্ধার্থের রোজকার এই হাত খোলা অভ্যাসের জন্য ভালো উপার্জন থাকলেও তেমন সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি সে । তাতে অবশ্য চেতনার তেমন কোনো দুঃখ ছিল না । কারণ সবাইকে সাথে নিয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করত চেতনা। তাই এই নিয়ে সিদ্ধার্থ কে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেনি চেতনা।
সিদ্ধার্থের এনে দেওয়া বাজারের থলি থেকে প্রয়োজনীয় রান্নার উপকরণ গুলো বার করে নিয়ে বারান্দায় বসলো চেতনা। রাঙা পিসীমাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে চেতনা বলল, আসুন বসুন পিসিমা । আজ আপনার প্রিয় পছন্দের পদ শুক্তো রান্না করবো , তার জোগাড় নিয়েই বসেছি । পিসিমা হেসে বলে জানি মা জানি । আমার মা তো তুই , তুই ছাড়া কেই বা জানবে যে আমি কি আমি ভালোবাসি ।
তাপর রাঙা পিসিমা বলেন , তবে মা আমার একটা ইচ্ছা আছে জীবনে । আমিও সারাজীবন সংসারের সবার জন্য রেঁধে গেলাম কিন্তু তোর মত এতো সুন্দর শুক্তো কোনোদিনও রাঁধতে পারলাম না । কি যে জাদু আছে তোর হাতে ।
তাই আমার ইচ্ছা মরার আগে অন্তত পক্ষে একবার দেখে যাই তোর শুকতো রান্না করার প্রণালী খানা । পিসিমা মুখে এমন ধরনের কথা শুনে চেতনা বলে , বালাই শাট পিসিমা এমন বলছেন কেনো । আপনার কিছু হলে আমার চিনি সন্দেশ কাকে ঠাকুমা বলে ডাকবে । আর কোনোদিন এমন কথা যেনো না শুনি । আপনার মুখে ।
বরং আসুন আজ আপনার মনের ইচ্ছা টা পূর্ণ করে দিই।
তারপর চেতনা শুরু করলো রান্নার জোগাড়।
উপরকন - আলু , বেগুন , পটল , কাঁচকলা , গাজর , সজিনা ডাটা , উচ্ছে , বড়ি , রাঁধুনি , পোস্ত , সরষে , পাঁচ ফোড়ন, গুড়ো দুধ ।
প্রণালি - চেতনা প্রথমে সব সবজি গুলো ধুয়ে কেটে ফেলল । তারপর কড়াইতে তেল গরম করে একে একে সব সবজি গুলো ভেজে তুলে নিলো ।
তারপর কড়াইতে রাঁধুনী ফোড়ন দিয়ে ভেজে রাখা সব সবজি গুলো দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে , তাতে সরষে ও পোস্ত দিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে তাতে স্বাদ মত নুন মিষ্টি ও ভেজে রাখা বড়িগুলো দিয়ে দিয়ে দিলো ।
তারপর ভালো ভাবে সবজি গুলো সিদ্ধ হয়ে গেলে তাতে গুলে রাখা গুঁড়ো দুধটা দিয়ে পাঁচ মিনিট ফোটানোর পর । নামানোর আগে ভেজে রাখা রাঁধুনী পাঁচ ফোড়ন গুরোটা ছড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখলো চেতনা ।
তারপর কড়াইয়ের ঢাকা খুলতেই গোটা ঘর ভরে ওঠে সুস্বাদু লোভনীয় শুক্তোর গন্ধ । আস্তে আস্তে সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির বাইরে পর্যন্ত । পাশের বাড়ির মালতী বৌদি ও বুঝতে পারল যে আজ চেতনার হাতের শুক্তো আসতে চলেছে তাদের বাড়ি।
সিদ্ধার্থ ই বুঝি ঠিক বলেছে । চেতনার হাত ধরেই বেঁচে থাকবে আদী বাঙালির খাবার গুলো বাঙালির মধ্যে। যেই খবর আজ হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির সংস্কৃতির মতই বাঙালির জীবন থেকে । আধুনিকতার ঘেরাটোপে হারিয়ে যাচ্ছে সব ।
আমার গল্পের এই চেতনা হলো সেই ভোজন রসিক বাঙ্গালীর প্রতীক , বাঙালি রান্নার প্রতীক ।
দেখি এই গল্প পরে ঘুমিয়ে পড়া আদী বাঙালির চেতনা ফেরে কিনা ?
