Payel Guha

Romance Inspirational

4.9  

Payel Guha

Romance Inspirational

তুমি অনন্য

তুমি অনন্য

18 mins
4.8K



(১)


“কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা

চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে

কাছাকাছি আনো

নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!""



নিজের কাজ গুলো পোষ্ট করলে বারবার শুনতে, চালিয়ে দেখতে ওর বড্ড ভালো লাগে। গতকাল রাতের পোষ্ট করা ভয়েস ওভারটায় এখন ৯.৫k ভিউস্, চারশো শেয়ার! রিঅ্যাক্ট-ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আগের থেকে হাহা-রিয়্যাক্টের পরিমান কমেছে অনেকটা। কমতে কমতে দশে নেমেছে... প্রশান্তির হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে। এবার কমেন্ট বক্সে একটু উঁকি মারে সে।

‘অসাধারন দাদা'

‘ তোমার বাচনভঙ্গি যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়... কীভাবে পারো?'

‘কতদিন তোমার লেখার উপর পাঠ করছো না, আবার কবে আসবে...'


আরো কত কী! 


দাদা! ওই ডাকটা এখনো পিছু ছাড়লো না।

কতজন তো কোনোরকম সম্বোধন করে না। কমেন্ট গুলো টাচি হলেও ওর মনে হয়, কমেন্ট গুলোতে খুব সাবধানে সম্বোধনটা এড়িয়ে লেখা। 


নিজের প্রোফাইল পিকটা একবার দেখলো। দেড় মাস হয়ে গেল, চেঞ্জ করা হয়নি। চেঞ্জ করতে হবে‌। মনে মনে ভাবে। মায়ের কলেজ লাইফের হলুদ শাড়িটা পরে ছবিটা তোলা। ওর প্রিয় অবাধ্য কোকড়া চুল গুলো ঝাঁপিয়ে পরেছে কাঁধে, চোখের পাশ দিয়ে। চোখে গাঢ় কাজল। বড্ড প্রিয় ওর এই ছবিটা। তাই, চেঞ্জ করবে করবে করেও করা আর হয়নি।


এবার ঘড়িটা একবার দেখলো। দশটার দিকে এগোচ্ছে ঢিকঢিক করে। ফোনটা রেখে আয়নার সামনে গেল। চুড়িদার পরে রেডিই ছিল। এখন মুখে একটু ক্রিম লাগিয়ে কাজলটা তুলে নিল। মোটা করে চোখে লাগালো। কাজল জিনিসটা ওর বড্ড প্রিয়... একবার ভালো করে দেখলো চোখটা। প্রিয়া বলে, “বিশ্বাস কর, তোর চোখ দেখলে না খুব হিংসে হয়। কী সুন্দর বলতো!” খয়েরি চোখের বল, ঘন চোখের পাতায়, গাঢ় কাজলে ওর নিজের চোখটাকেই ওই বর্ষনমুখর দুপুরের মেঘ মনে হয়।


— কী রে! খেতে আয় অভি...


মায়ের ডাকে চমকে উঠল ও। সবে মাত্র ভ্রু দুটোর মাঝে ছোট কালো টিপটা দিয়েছিল। কুঁচকে গেল কপালের চামড়াটা, ভ্রুর মাঝের ভাঁজটায় বিরক্তি। 


— আহ্ মা! কতবার বলেছি আমাকে অভি বলে ডাকাটা ছাড়ো এই দেড় বছরে এটা ছাড়তে পারলে না!, বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরের বিছানায় পড়ে রইলো মোবাইলটা, স্ক্রীনটা তখন-ও জ্বলছে, তাতে একটা ফেসবুক প্রোফাইল, নাম— অনন্য সিকদার (অনু)। ডাকনামের জায়গাটায় আগে লেখা ছিল অভি...



(২)


—মা... অনু বলে ডাকো না কেন বলোতো?

— আরে বাবা, তুই জন্মের পর থেকে ওই নামে ডেকে যাচ্ছি। হয় নাকি এভাবে... কী দরকার বাবি, তুই আমার কাছে না হয় অভিই থাকলি!

— আমি যদি মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তাইলে কী আমার নাম অভি রাখতে মা? 


ছেলের কথায় কোনো উত্তর দিতে পারেন না মৈত্রেয়ী। ছোট থেকে বড়ো আদরে নিজে আর তার স্বামী ছেলেটাকে বড়ো করেছেন। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে চেয়েছেন, ছেলেটার যেন কোনো অভাব না থাকে। ছেলেটার সব আবদার যেন মিটাতে পারেন... উচ্চবিত্ত না হলেও অভাব তেমন ছিল না ভগবানের আর্শিবাদে। সব ভালোই চলছিল। ছেলেটা ছোট থেকে মেয়েলী ছিল বলে একটু কথা আশপাশ থেকে শুনতে হতো বটে। তবে তিনজনের সংসারটা ভালোই ছিল। তবে সব কেমন যেন বদলে গেল লাষ্ট চার বছরে।


তখন সবে কলেজ শেষ করে অভি একটা বেসরকারি ফার্মে কাজ পেয়ে ঢুকেছে। ওর বাইশ বছরের জন্মদিনের তোরজোড় করা চলছে। দু'দিন পরে জন্মদিন। প্রতি বছর অনন্যের জন্মদিন বেশ আড়ম্বরেই পালন করে ওর বাবা-মা। বাড়ির কিছু আত্মীয়-বন্ধুরা মিলে, বেশ একটা গেট টুগেদার হয়। আর প্রতিবার ওর বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “বল এবার তোর জন্মদিনে কী চাই?” অনন্যর বাবা উৎপটাং গিফট দিতে রাজি নয়। ওনার মতে ছেলের যেটা দরকার, ওটাই দেবো। সেবার-ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। অফিস থেকে ফিরে ছেলের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সেই এক প্রশ্ন। আর অভি-ও যেন তার প্রতিক্ষাতেই ছিল। এতোদিনের জমানো চাহিদাটা জানিয়েই দিল তার বাবাকে।


বাইরের ঘরে টিভি দেখছিলেন তখন অভির মা, মৈত্রেয়ী। আকস্মিক চিৎকার শুনতে পেলেন, “পড়াশোনা করিয়ে আমি তোমাকে এই বানিয়েছি? শুনে যাও, তোমার ছেলে কী বলছে! বাপের মান-সন্মান বাকি রাখার আর কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না!”


ছুটে যান উনি। কী এমন হলো যে এতো রাগত স্বরে কথা বলছে! ছেলের ঘরে ঢুকতেই তিনি শুনলেন,

— দেখো মৈত্রেয়ী, তোমার ছেলে এখন মেয়ে হবে। এইসব শিখতে ওকে পড়িয়েছি আমি। সারাটা জীবন রক্ত জল করে মুখে অন্ন তুলে দিয়েছি কী এভাবে মুখে কালি ছিটানোর জন্য?


মৈত্রেয়ী তখনও বুঝতে পারছিল না, কী বলছে এসব‌! মেয়ে হবে মানে? ছেলের দিকে তাকালে, দেখেন ছেলের চোখ দৃঢ় সংকল্প! 


— ক...কী হয়েছে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কী বলেছিস তুই তোর বাবাকে?


— আমি এস আর এস করবো।


মুহুর্তে থমকে গিয়েছিলেন তিনি। এস.আর. এস -এর অর্থ তিনি জানেন। অর্থ্যাৎ ছেলে সেক্স চেঞ্জ করবে! প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না, ওনার কী করা উচিত রাগ! নাকি অবাক। 


ছোট থেকেই নিজের ছেলেটার মধ্যে মেয়েলি ভাবটাই বড্ড বেশি ছিল। সব ছেলেরা যেখানে ক্রিকেট-ফুটবল-খেলনা কার, এই ধরনের খেলা নিয়ে মেতে থাকতো। ও ক্রিকেট খেললেও, ওর অ্যাট্রাকশন ছিল পুতুল; জ্যাঠতুতো বোনের সাথে খেলনা বাটি‌। যদিও তখন এসবকে গুরত্ব দেবার মতন কিছু পায়নি কেউ। খেলতেই পারে। ওর কন্ঠস্বরটাও নরম ছিল। অনেক বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়রা কানাঘুষো হাসাহাসি করতো। প্রথম প্রথম ভাবতেন বড়ো হলে ঠিক হবে। কিন্তু, এমন কিছু হবে তা হয়তো ভাবতে পারেনি। 


অভির বাবা কোনো ভাবেই মানতে পারেননি ছেলের এই সিদ্ধান্ত। তিনি রেগে বলেই বসলেন, “আমার বাড়িতে এসব করা চলবে না।"

— তবে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি চাই না আমার জন্য তোমরা হিউমিলিয়েট হও। ছোট থেকে ওটা তো শুধুই আমার।

ওর বাবা আরো রেগে গিয়েছিলেন, “মৈত্রেয়ী সেদিন ঝুমা বৌদি ঠিক-ই বলেছিল। ছেলের এবার বিয়ে দেওয়া দরকার। বিয়ে দিলে এসব ন্যাকামো ঘুচে যাবে।"


অভি মাঝের দুইদিন শান্ত-ই থেকেছিল। ও জানতো ওর এই সিদ্ধান্ত একটা ঝড় তুলবেই। কিন্তু এই কথাটা শুনে আর শান্ত থাকতে পারেনি, ও বলে ওঠে, “তোমাদের ঠুনকো সন্মানের জন্য দুই দুটো জীবনকে বলি চড়াতেও বাঁধে না তাই না? স্বার্থপর! দেখো বাবা, আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরবো না‌। আমি চলে যেতেই তো চাইছি... থাকো তোমার সমাজ নিয়ে তুমি।”

— কোথায় যাবে? ওই হিজরেদের পল্লীতে!


না! আর আটকে রাখা যায়নি। ওই কথা কাটাকাটির একঘন্টার মধ্যে মোটামুটি দরকারি জিনিসপত্র, জামা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিল ওই বাড়ি থেকে। সাথে ওর মা-ও... কী করবে! নিজের সন্তান তো! 


তারপর কেটে গিয়েছে চার-চারটে বছর। মা-ছেলের সংসার ,মা-মেয়েতে বদলালো। শুধু বাবার সাথে সম্পর্কটাই ঠিক হলো না...


একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু বলার খুঁজে পেলেননা মৈত্রেয়ী।



(৩)


বাসস্টপে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভি তথা অনু। সে যে নামেই ডাকা হোক। ও একটা রেডিও ষ্টেশনে এই একমাস হলো ঢুকেছে। এর আগে টুকটাক বিভিন্ন কাজ করেছে। আর ওর মা যেহেতু স্কুলে পড়াতেন, ওনার মাইনেতে মাঝের দুই বছর চলেছিল। এই তো ছ'মাস হলো ওর মা রিটায়ার করেছে। তবে এখন অসুবিধা হয় না। এখন এই রেডিওর চাকরি, একটা ইনষ্টিটিউশনে যুক্ত হয়েছে যেখানে অনাথ বাচ্চাদের ও পড়ায় সেখান থেকে কিছু টাকা আসে। তারপর আবৃত্তির অনুষ্ঠান... সঞ্চালনা— সব মিলিয়ে এক প্রকারে ছন্দে চলছে ওর জীবন। তবে আজ থেটে পাঁচ বছর আগে সব কিছু এমন ছিল না। তখন জানতো-ও না, সেদিন থেকে পাঁচ বছর পর ওর জীবনটা এতোটা স্বাভাবিক হবে! কল্পনাই করতে পারেনি।


ও যখন নিজের ট্রিটমেন্ট শুরু করছিল তখন ওর আগের চাকরিটা চলে যায়। না চলে যায় বললে হয়তো লোকে ভাববে ওর কোনো গাফলতিতে হয়তো চাকরি চলে গিয়েছে। কিন্তু, আদপে ওকে বের করে দেওয়া হয়। ওয়ান ফাইন মর্ণিং , মেল আসে। অজুহাত দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই করছে। ওর কাজে খুব একটা লাভ হচ্ছে না, তাই... ও বুঝেছিল... সবটা বুঝেছিল‌। আসলে ততদিনে ওর ট্রিটমেন্টের কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল। সাথে ও নিজের সাজ-পোশাকটাও বদলাতে শুরু করেছিল। এমনিতেই অফিসের সবাই এড়িয়ে চলতো। তারপর একদিন তো লাঞ্চ টাইমে কফি আনাতে গিয়ে ক্যান্টিনে দু'জন কলিগকে বলতে শুনেছিল, “দেখেছিস অবস্থা!”

— অফিসে ঢুকতেই অকওয়ার্ড লাগে। এটা কী গো অ্যাজ্ ইউ লাইক চলছে নাকি!

— সেই এতো ঠোঁট রাঙিয়ে মেয়ে সাজার শখ তো ট্রেনে তালি দিয়ে বেড়ালেই পারিস!

তারপর দু'জনের সন্মিলিত হাসির ফোয়ারা ওর গায়ে সিসা ঠেলে দিচ্ছিল!


“তোমার লিপষ্টিকের শেডটা কী গো?”, প্রশ্নটা শুনে বাস্তবে ফিরে এলো অনন‌্য।

আর হাসি পেয়ে গেল ওর। কী ভালো টাইমিং প্রশ্নটার। উনি হয়তো বুঝতে পারেননি ও কী! যদি বুঝতে পারতো তবে কী আর জিজ্ঞেস করতো? পাশে এসে দাঁড়াতো? সরে যেত... সবাই তো সরেই যায়। আচ্ছা, সমকামিতাও তো খুব সাধারণ একটা ব্যাপার, কিন্তু সমাজ এটাকে সহজ ভাবে গ্ৰহণ করতে পারে না কেন? সমকামিদের সবাই এতোটা সহজলভ্য ভেবে নেয় কেন?


ও এতগুলো দিনে এটা বেশ বুঝেছে, আমাদের সমাজ আসলে একটা বদ্ধকুয়ো। আর এতো এতো মানুষ হচ্ছে সেই কুয়োর ব্যঙ। আর কেউ যদি কুয়ো থেকে বেরোতে চায়, তাদের মেনে নিতেই পারে না... 

কারণ, যত আধুনিকতার প্রলেপ লাগুক গায়ে, যত-ই এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দিগন্ত বিস্তৃত সুযোগ আসুক না কেন, মনটা কী আর বিস্তৃত হতে পারল? ওটা এখন সেই কুয়োতেই আটকে আছে... থাকবেও...


প্রশ্নটার উত্তর আর ওর দেওয়া হলো না, বাস চলে এসেছে... উঠে গেল ও। 

পিছনে ফেলে সেই মেয়েটিকে, পিছনে ফেলে এ সমাজের দ্বিচারিতাকে।


(৪)


— টেবিলের উপর দেখ বিরিয়ানি ঢাকা রয়েছে।

— বিরিয়ানি! কে আনলো মা?, প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে উদগ্ৰীব হয়ে টেবিলে ঢাকা দেওয়া থালাটা হাতে তুলে নিল।

— প্রিয়া দিয়ে গিয়েছে। ও বানিয়েছে, তাই তোর জন্য আর আমার জন্য দিয়ে গেল।


ততক্ষনে অভি এক চামচ মুখে দিয়ে দিয়েছে।

— উম... দারুন বানায় কিন্তু ও!

— ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে।

— হ্যাঁ জানি তো!

মৈত্রেয়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তা চোখ এড়ায়নি অভির। ও আলতো হেসে বলে, “বড্ড বেকার সন্তান আমি। তোমাদের কোনো স্বপ্ন-ই পূরণ করতে পারলাম না।”

মৈত্রেয়ী চোখের জলটা মুছে উঠে গিয়ে অভির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, “তুই নিজের স্বপ্ন তো পূরণ করতে পারছিস। ওটাই সুখ আমাদের।"

— আমাদের? না তোমার?


সুখ! অভি জানে কত সুখ। ও বোঝে প্রতিটা বাবা-মা স্বপ্ন দেখে তার সন্তানকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখে ছেলে বড়ো হবে, চাকরি করবে, তারা বড়াই করে বলবে, “আমার ছেলে ওমুক জায়গায় কাজ করে", পছন্দমতো একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে... 

কিন্তু, কেউ হয়তো স্বপ্ন দেখে না, তার ছেলে মেয়ে হয়ে একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবে; সে ব উ নয়, জামাই আনার স্বপ্ন দেখবে। আর ও এটাও বোঝে, ওর মা সবটা মেনে নিলেও, মনের মধ্যে একটা ঘূর্ণি তার-ও ঘোরে... হয়তো ওটাই স্বাভাবিক! একদিকে ছেলে আর একদিকে নিজের স্বামীকে নিয়ে কী করে যে একজন নিজেকে সুখী বলতে পারে ও সত্যিই বোঝে না। কতদিন ও বলেছে মা'কে, “মা! তুমি বাবার কাছে ফিরে যাও। দেখো, লোকটা তো কোনো দোষ করেনি।”

— তা তুই কী দোষ করেছিস?

— মানুষটার তোমাকে দরকার!, ও বোঝে স্বামী-স্ত্রী মানে একসাথে সংসার ঠেলে যাওয়া নয়। একে অপরের পরিপূরক হয়। ও বোঝে মানুষের কতটা দরকার হয় একজন ভালোবাসার মানুষের... মা তো তাও ওকে পাচ্ছে, কিন্তু বাবা! লোকটা তো একদম একা!


কিন্তু ওর মা সবসময় বলে,“ আমি মা বাবি! তুই কী বুঝবি মায়ের জ্বালা! একজন নারী, একজন স্ত্রী যখন মা হয় তখন মা সত্ত্বাটাই সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। আমি আমার সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।”

ব্যাস! আর কিছু বলার পায় না। বলার থাকেও না।


খাওয়ার সেরে শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়। তবে এখনি ঘুমোনোর সময় হয়নি। এখন একটু সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটা, তারপর ব ই পড়া, তারপর ঘুম। ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল, রনি ভিডিও পাঠিয়েছে। ওহ্, এবার ওটা ছাড়তে হবে সোশ্যাল মিডিয়া তে। ছেলেটা বেশ করিৎকর্মা তো! আগামী পরশু হলো ভ্যালেনটাইনস্ ডে। তাই ওদের রেডিও চ্যানেল থেকে একটা সেগমেন্ট করবে, “হোয়াট ইজ্ লাভ!” রাস্তায় বেরিয়ে জনেজনে একটু জিজ্ঞাসাবাদ। ওটাই ঘসেমেজে এডিট করে দিল রনি। সন্ধ্যেতে ওকে দেওয়া হয়েছিল, এর মধ্যে এডিট করে দিয়েও দিল!


এই সেগমেন্টটার দায়িত্ব ওকে দেওয়ায় অফিসের বেশ ক'জন খুব একটা খুশি হয়নি। একজন তো সবিস্ময়ে বলে ওঠে, “অনু! মানে অনন্য!”

ও দেখেছে কিছু মানুষ, ওকে কেউ শুধু অনু ডাকে না, সাথে ওর ভালো নামটাও বলে। মাঝে মাঝে ভাবে, ওর কী নিজের ভালো নামটা ভুলে যাওয়ার অভ্যাস আছে? নাহলে নামটা বলে কী লাভ পায়!

সে আলাদা কথা, দু-একজন আপত্তি জানিয়েছিল। তবে শ্রী- দি সত্যিই ভালো‌। ওকেই দায়িত্বটা দেয়। বলে, “অনন্য, আমি চাই তুমিই এ কাজটা করো। আমি চাই তুমি দশ জনের সাথে কমিউনিকেট করো। সমাজের অকথিত ট্যাবু গুলো ভাঙো..." শেষ কথাটা ওই ঘরের বাকি সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল। 


এই অফিসেও কয়েকজন একটু দূরত্ব বজায় রাখে ওর সাথে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। তবে সবাই নয়।রনি, দেবজিৎ, গুনগুন, রিমি— ওদের সাথে ওর বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। দেবজিৎ আর ও মিলে বেরিয়েছিল। কলেজষ্ট্রীট, প্রিন্সেপঘাট, ময়দান এই ক'টা জায়গা টার্গেট করে গিয়েছিল। দেখা হলো বহু মানুষের সঙ্গে। একেক জন উত্তর দিয়েছে একেকরকম। আসলে একেক জনের গল্প-ও হয় একেক রকম‌ —যে প্রথমবার প্রেম করেছে তার কাছে ভালবাসার সংজ্ঞা আলাদা, যে ঠকেছে তার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা। আর যে ম্যাচিওর তার কাছে আলাদা....


সেগুলোই দেখতে বসলো ও।


(৫)


প্রশ্ন: হোয়াট ইজ লাভ্?


একেকজন দিয়েছে একেক রকম উত্তর। কারোর কাছে ভালোবাসা মানে, অজ্ঞাত এক অনুভুতি। যে অনুভূতির অর্থ বুঝতে কেটে যায় বছরের পর বছর। কেউ বলেছে, লাভ্ মানে লোকসান। এই গার্লফ্রেন্ড হবে তাকে গিফট দাও, টাইম দাও, এটা দাও, ওটা দাও— তারপর সেই চলে যাবে। বেশ বোঝা গিয়েছে এই ছেলে জব্বর একটা ছ্যাকা খেয়েছে। একটি মেয়ে, সে বিবাহিত, তিনি বলেছেন, ভালোবাসা মানে অভ্যাস। একজন বলেছে, ভালোবাসার কোনো মানে হয় না। একজন তো শাহরুখের ভক্ত, তার মতে, লাভ্ দোস্তি হ্যায়‌। একজন বলেছে, ভালোবাসা মানে চার অক্ষরের খিস্তি। সব শেষে যিনি বলেছেন, তার কথাটা ওর মনে লেগেছে, আরো একটা কারণ আছে, লোকটিকে থুড়ি বলা ভালো ছেলেটিকে ওর বড্ড চেনা চেনা লাগছে। তখন-ও লাগছিল। ওর মনে হলো ছেলেটাও চেনে ওকে। কিন্তু কোনোরকমে কথা বলেই যেন ছেলেটিও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। ছেলেটি ফর্সা। ক্লিন শেভ, গালে দাড়ির নীলচে রেখা ছাপ ফেলে রেখেছে। লম্বা বেশ। ওর নিজের হাইট পাঁচ সাত। ওর থেকে লম্বা, মনে তো হয় ছয়। ছিপছিপে গড়নের, চাকুরীজীবী বলেই তো মনে হলো। ফরমাল ড্রেসে ছিল। শেষ বেলার ময়দানে দেখা হয়েছিল। সে বলেছিল, “ভালোবাসা? ভালোবাসা একটা দুর্ঘটনা। যা একজীবনে বহুবার হতে পারে। তুমি তা আটকাতে পারবে না। তখন কোনো কিছুই তোমার হাতে থাকবে না। শুধু সেই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে থাকবে তোমার সামনে। সমাজ, নিয়ম সব কিছুকেই উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে তোমার... তুমি নিজেও তার হতে চাইবে। নাহলে যেন জীবনটাই বৃথা...”


কী ভালো বলল না! কী যেন নামটা বলল? নীলাভ্র! নীলাভ্র দে। 

নীলাভ্র! নীলাভ্র... নামটা খুব চেনা লাগছে। যা হোক মনে পড়ল না ওর এই মুহূর্তে। উল্টে ওর কথা গুলো বড্ড ওর মনে নাড়া দিয়ে গেল। মনে পড়ল, নীলাভ্রর চোখের দৃষ্টিটা। যেভাবে ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলল। মনে পড়তেই আবার-ও ওর বুকটা কেঁপে উঠলো। 


দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রেম! ভালোবাসা? এসব ওর জন্য কোথায়? না! ঘুমটা আসতে আসতেও উড়ে গেল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ও। চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে তার জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছিল। শীতল একটা ফাল্গুনী হাওয়া এসে ঝাপটা মারল ওর শরীরে। 

ভালোবাসা! বেসেছিল তো ভালো। লোলিত! একটা বছর টিকেও ছিল সম্পর্কটা। তার আগে অনুরাগ! কলেজে ওকে নিজের বেষ্টফ্রেন্ড মুখে বললেও ও আসলেই অনুরাগকে ভালবেসেই ফেলেছিল। তখন-ই তো ও বুঝেছিল আসলে ও কী চায়! 

আর উল্টোদিকের সবাই এটাও ওকে বুঝিয়েছিল, ওর অবস্থানটা। ও একজন পুরুষ। ও হাজার চাইলেও নারী হতে পারবে না... প্রেমিকা হতে পারবে না। ট্রিটমেন্ট করে শরীর বদলানো যায়। কিন্তু, ‘পুরুষ' হয়ে জন্ম নেওয়াটা তো আর বদলে দেওয়া যায় না। তাই, ও সব সময় ‘রূপান্তরিত নারী’, ‘সমকামী’ হয়েই থেকে যাবে— কখনো নারী হতে পারবে না। কখনো প্রেমিকা হতে পারবে না...


এ সমাজ ওকে নারী বলে মেনেও নেবে না...


(৬)



“তার বুকেও তো ভালোবাসা জমে!

সে-ও তো পারতো প্রেমিকা হতে...

সে'ও তো পারে আগল ভাঙা আদরের ভাগীদার হতে!


আগল ভাঙা আদরে আগলে সে,

অনাদর ফিরে আসে উড়োচিঠিতে।।”

                        — অনন্যা



— আচ্ছা তুমি সবসময় লেখার শেষে ‘অনন্যা’ লেখো কেন? তোমার নাম তো অনন্য!

হাসি পেয়ে যায় অভির। 

— এমনি

— এ কেমন কথা!

— কেন সত্যিই তো এমনি লিখি। আসলে অনন্য পরিচয়টার ভার থেকে বড্ড মুক্ত হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, আমি জানি আমাকে কেউ ‘অনন্যা' বলে মেনে নিতে পারবে না। তাই আমার কলমের নাম অনন্যা হোক!


ব‌্যস! কথাটুকু এখানেই আটকে যায়। সে আর কেন জানি কোনো উত্তর দেয়নি। অভি লেখাটা পোষ্ট করার পর মেসেজটা আসে। তারপর এই টুকু কথা... অভির এবার মনে পরেছে নীলাভ্রকে কোথায় দেখেছে। এই ফেসবুকে! ওর পোষ্টে মাঝে মধ্যে কমেন্ট করে। এর আগেও এক-দু'বার ম্যাসেঞ্জারে কথাও হয়েছিল। মনে আছে ওর।


আবার একটা পিং...

—আজ তোমাকে দেখার পরেও কথা বলার সাহস পেলাম না। তোমার চোখ দেখে মনে হলো চিনতে পারোনি, তাই আর...

অভি নোটিফিকেশন থেকে দেখলো মেসেজটা।ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারছে! এতোটাও মন দিয়ে ওকে কেউ দেখে! অবাক হলো ও। তারপর উত্তর দিল। 


— আসলে খেয়াল ছিল না। তুমি কথা বলতেই পারতে!


— আচ্ছা! তুমি কী সবার সাথেই মেপে মেপে কথা বলো? 

— উম! হ্যাঁ। নাহলে অনেকে ভাবে ‘গা ঢলাঢলি' করছি। অনেক ভেবে চলতে হয় বুঝলে! প্রাণ খুলে কথা বলতে হাজারবার ভাবতে হয়।

— ...


অভি এবার ফোনটা রেখে ঘুমিয়ে পড়বেই ভাবছিল। তখনি আবার পিং।

— তোমাকে না কিছু কথা বলবো ভাবছিলাম।

— হুম বলো! 

— দেখা করা যায়? 

— দেখা?

— তুমি কারোর সাথে দেখা করো না?

— হ্যাঁ করি...

— পরশু বিকেলে ময়দানে তাহলে দেখা হচ্ছে!

— পরশু! 

— তোমার অসুবিধা আছে?

— আমার প্রোগ্ৰাম আছে ওইদিন।

— আধঘন্টাও হবে না?

— আচ্ছা ঠিক আছে, পাঁচটায় তাহলে?

— থ্যাঙ্ক ইউ... তারপর একটা হার্ট ইমোজি।


অভির খটকা লাগে। কী ব্যাপার! ওর মনে অন্যরকম একটা আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে! কিন্তু সেটা উড়িয়ে দিচ্ছে ও বারবার। ওর মন একটা আশঙ্কার কথা ভেবে তিরতির করে কাঁপছে! ওমন তো নাও হতে পারে। ও কী আর সত্যিই নারী! অতো সুখ ওর কপালে কোথায়?



(৭)


“তা যত'ই তুমি দূরে ঠেলো আমায়, যত'ই ছিটাক সমাজ কালি।

তবুও আজ'ও আমি তোমায় ভালোবাসি... ভালোবাসি।"


ভালোবাসার দিন। মা ছাড়া আর কার কাছেই বা ভালোবাসা পেল ও! না বাবা ভালোবাসে। সে রাগ করলেও ও বিশ্বাস করে মানুষটা ওকে ভালোবাসে। তার বাইরে? 

ওর মনে আছে। ওদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো রথীন কাকু। মানুষটা ওর খেলার সঙ্গী ছিল। রিনি দিদির সাথে যখন খেলতো, ওদের রান্না বাটিতে করা কাল্পনিক রান্না খেয়ে কতো প্রশংসা করতো। কাকু ওদের সাথে বসে গল্প শোনাতো। বড্ড ভালোবাসতো কাকুকে। সেদিন মা খুব অসুস্থ ছিল। বাবা মা'কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, আর ওকে রেখে গিয়েছিল রথীনকাকুর কাছে। সেদিন দুপুরে কাকু... আজ'ও সেদিনে কথা মনে পড়লে সিগারেটের তামাটে গন্ধটা পায় ও। পেট গুলিয়ে ওঠে। সেদিন ভরসা করে রথীন কাকুর থেকে পালিয়ে রিনিদিদির কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু, সেদিন দুপুরে সে'ও...

বারো বছরের ছোট্ট ছেলেটি সেদিনই বুঝেছিল ভালোবাসা আর ভরসা বলে কিছু হয় না... কিছু না...


অনুরাগ! ওকেও তো ভালোবাসত। কিন্তু কী হলো! একদিন এসে ও বলল, “দেখ ভাই! আমার সাথে না মিশিস না। আসলে তুই তো একটু অন্যরকম। আমার গার্ল ফ্রেন্ড না তোর সাথে আমার এতো মেলামেশাটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। সো... প্লিজ..."


কত সহজে বলে দিয়েছিল সেদিন কথা গুলো! ওকে কেউ একটা মেয়ে,একজন নারী বলে ভাবতেই পারলো না। লোলিত? কত সহজে ওর হাত ছেড়ে দিতে পেরেছিল। কেন ব্রেকাপ হলো তা বলার প্রয়োজন বোধ অবধি করেনি। কারোর কাছে জবাবদিহি করতেও হয়নি। সবাই সবটা শুনে একটাই কথা বলেছিল, ‘ও ঠিক আছে...'

কীভাবে ঠিক থাকে সব? ও যে এতো স্বপ্ন দেখলো! একসাথে হাঁটা এতোগুলো পদক্ষেপ সব মিথ্যে হয়ে গেল! শুধুমাত্র ও ‘গে’ বলে? 

কারোর স্বাভাবিক কিছু প্রবৃত্তি যে সমাজ মেনে নিতে পারে না। তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। সে সমাজে আবার ভালোবাসার দিন! ভালোবাসতে জানে কেউ? 


নিজের কবিতাটা পোষ্ট করে এসব আকাশকুসুম ভাবছিল অভি ময়দানে বিরাট বটের ছায়ায় বসে। অনেক যুগল ওর চোখের সামনে ঘুরছে। খিলখিলিয়ে হাসছে...

আর ও ঝাপসা চোখে দেখছে সে সব। ঝাপসা কারণ চোখে ওর অজান্তেই বাষ্প জমেছে। 

ও চায় সামনের ওই মেয়েটার মতন দু'হাত ছড়িয়ে ছুটে বেরাতে। ও চায় একজন প্রেমিকের কাঁধে মুখ গুঁজতে। ও চায়, ও যখন হেঁটে যাবে কেউ আড়চোখে তাকাবে না। ‘ছক্কা', ‘হিজরে' ছুটে আসবে না। অফিসের কলিগরা এড়িয়ে যাবে না। রূপান্তরিত শব্দটা মুছে গিয়ে নারী হয়ে বাঁচবে!

বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল ওর। বড্ড ক্লান্ত লাগে।


— ওই চোখটায় জল মানায় না। 


কথাটা শুনে চমকে মুখ তুলে তাকায় অভি। দেখে এক দীর্ঘদেহী মানুষ তার হাতটা বাড়িয়ে ওর গাল বেয়ে পরা জলটা মুছিয়ে দিল।

ও ভীষণ অবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষন স্থির মূর্তির মতন তাকিয়ে থাকে তার দিকে।


— আজ'ও চিনতে পারছো না নাকি?

সামলে নেয় নিজেকে ও, নীলাভ্র! কিন্তু, এটা কেন করল? তার থেকেও অবাক হচ্ছে নীলাভ্র'র চোখ দেখে। ওর চোখ যেন অন্য কথা বলছে!



(৮)


— আব্বে শালা! তুই কী পেগলেছিস নাকি? ও ছক্কা ভাই! শেষে কী না... এ ভাই, তুই ষ্ট্রেট তো? নাকি ... 


— তুই সিওর ওই অনন্য বলে যাকে দেখালি তার প্রেমে পড়েছিস? না মানে আমাদের কলকাতায় কী মেয়ের অভাব পড়লো নাকি ভাই?


— আর তুই যে নিজেও গে তা তো বুঝিনি চাঁদু? এজন্যই শেলীর সাথে তোর ব্রেকাপ হলো তাই না?



কথা গুলো আরো একবার কানে বেজে উঠলো নীলাভ্রর। সাথে সাথে আরো একজনের কথা মনে পড়লো, সে বলেছিল, “জানিস, এই যাদের মেয়েলী স্বভাব... যাদের তোর ওই বন্ধুরা ছক্কা, হিজরে বলে! জানিস তো, ওদের মনটা কিন্তু একদম মেয়েদের মতোই হয়। শুধু ভুল খোলশে জন্মায়। তুই যে অনন্যর কথা বলছিস, খেয়াল করেছিস কখনো, ওকে লাল পাড় সাদা শাড়িতে কী সুন্দর লাগে! আর পাঁচটা মেয়ের সাথে কোনো পার্থক্য করা যায়? যায় না। তুই ওর মধ্যেকার নারীর প্রেমে পড়েছিস নীল। আমি তোকে বারন করবো না। ভালোবাসার কোনো বাঁধন হয় না।”

নীলাভ্র এর উত্তরে বলেছিল, “কিন্তু সবাই যে আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে।”

— আরো তুলবে।

— অ্যাঁ!

— সুপ্রিম কোর্ট আইন করে দিলে কী হবে, আমাদের সমাজ যে নিজের ধ্যান-ধারণায় চলে। তাকে বদলাবি কীভাবে? ওদের কত লড়াই করতে হয় বলতো? আর আজ যদি তুই তাকে ভালোবাসিস, ভাবছিস কীভাবে তোকে লড়াই করতে হবে না?


নীলাভ্র পাশে তাকালো। সপ্রশ্ন ও বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে ঘনকাজল কালো চোখ দু'টো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে অনেকক্ষন ধরে। সে একটু অবাক। হতভম্ব। হয়তো এর আগে তার চোখের জল নিয়ে এতোটাও চিন্তিত হয়নি।তাছাড়া বুঝতেও পারছে নীলাভ্র কেন এসেছে তার কাছে। 


বেলা পড়ে এসেছে অনেকক্ষন। সূর্যের শেষ লাল আভা সেলোফেন পেপারের মতন জড়িয়ে ধরেছে গোটা শহরকে।

ওই পেপারের একটু অংশ অনন্যর মুখটাকেও জড়িয়ে রয়েছে। কী যেন একটা বলে না এই সময়টাকে? ‘কনে দেখা আলো’! কী মিষ্টি লাগছে না অনন্যকে! লাল শাড়ি, কাঁধ ছাপিয়ে কোঁকড়া চুলগুলো যেন পাহাড়ি ঝর্ণা। বুকে একটা মোচড় টেন পেল ও।


মুখটা খুলেও আবার বন্ধ করে নিল নীলাভ্র। কথাগুলো বলার আগে আবার ভাবল, যা করছে ঠিক করছে তো? ও চায় না কাউকে ঠকাতে। আরো একবার তাকালো অনন্যর দিকে। বুকটার ধুকধুকানি একটু বাড়ল। ও বুঝেছে, পিছিয়ে আসার রাস্তা নেই। এখন আর কিছু ওর হাতে নেই...


— আমি ঠিক কীভাবে বলবো, কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। দেখো, হাতটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।


অভি অবাক। কী বলছে কী ছেলেটা! ওর'ও বুকটা দুরুদুরু করছে। ও যা আশঙ্কা করছে ওমন কিছু হবে নাকি! না না... ওসব ওর কল্পনা। ওভারথিঙ্ক! 

ছেলেটার দিকে একবার তাকালো। ওর'ই বয়সী নয়তো ছোট হবে একবছরের। শেষ বেলার সূর্যের লালচে আভা ওর গালে পিছলে একটা লালচে রঙ লাগিয়ে দিয়েছে। ব্ল্যাক রঙের শার্ট, জিন্স পরে এসেছে। বুকে একটা মোচড় টের পেল ও। বুঝতে পারছে অনন্য ওর কল্পনায় সাজানো মানুষটার সাথে বড্ড মিল এই সামনের মানুষটার। লোহিতের পর, এই দেড় বছর পর, আবারও কারোর প্রতি টান অনুভব করছে ও। 


নীলাভ্র বলা শুরু করলো, “আমার একটা প্রেম ছিল কলেজ লাইফে। চার বছরের প্রেম। কলেজ শেষ হবার পর আমি মাষ্টার্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তখন থেকে মিলির সাথে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল দিন দিন সেটা বাড়তে থাকে। আমি ঠিক সন্দেহপ্রবণ নই। কিন্তু, কেন জানি আমার মনে হতে থাকে ও আমাকে ঠকাচ্ছে। আমার চোখের আড়ালে কিছু একটা চলছে। আমার কিছু বন্ধুরাও আমাকে ইনফর্ম করছিল, ওকে মৃনাল বলে একজনের সাথে সিনেমা হলে দেখা যাচ্ছে, মলে দেখা যাচ্ছে... মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে চাইতাম না তাই ওরা আমাকে গাদা খানেক ছবি পাঠায়। মজাটা এটাই যে আমাকে সব জায়গা থেকে হাইড করে ছবি গুলো ছাড়া হচ্ছিল। দিব্যি আমাকে মুরগি করে প্রেম চলছিল। এসব দেখার পর তো আর এক সাথে থাকার মানে হয় না তাই না? তারপর কেটে গিয়েছে চার বছর। কোনো রকম প্রেম-টেম আমার মাথায় চাপেনি। চাপল এক বছর আগে। মিলির ছেড়ে যাওয়ার পর কোথাও গিয়ে মনে হয়েছিল, এসব ভালোবাসা-টালবাসা, প্রেম; সব মিথ্যে! নাটক! 

কিন্তু, ওই ওপরয়ালা, উপরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, উনি মুচকি হেসেছিলেন আমার অবস্থা দেখে। 



(৯)


— ওয়ান ফাইন মর্ণিং, ফেসবুক ঘাটছি বাসে বসে। কানে হেডফোন লাগিয়ে ভিডিও স্ক্রোল করে যাচ্ছি। হঠাৎ, একটা ভিডিও সামনে এলো। লাল পাড়ের সাদার উপর কালো চেক শাড়ি। কোঁকড়া চুল ঝাঁপিয়ে পড়েছে চুলের পাশ দিয়ে, মুখে একটা মিষ্টি হাসি। এতোটাই মিষ্টি যে প্রথম দেখার পর আমি পুরো ভিডিওটা শুনিনি, হা করে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর খেয়াল পড়তে, আবৃত্তিটা শুনলাম। অসাধারণ বাচন ভঙ্গিতে নিজের লেখা পাঠ করছিল। প্রেমিকা নিয়ে লেখা ছিল। প্রতিটা বাক্য এতো সুন্দর করে বলছিল যে, ওইদিন সারাটা সময় বারবার শুনে গেলাম। ফলো করা শুরু করলাম তাকে। আমি না বুঝতে পারিনি প্রথমে সে মেয়ে নয়। তারপর প্রোফাইল ঘাঁটতে গিয়ে বুঝলাম, পতঙ্গ হয়ে কোন আগুনে ঝাঁপিয়েছি।


জানো আমি না অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে। মাঝে তো তোমার সাথে কথাও বললাম। তোমাকে রোজ ফলো করে গেলাম। আর সময় নিয়ে নিজেকে অনুভব করার চেষ্টা করে গেলাম। কী চাই আসলে আমি? বন্ধুদের বললাম। একেক জন একেক রকম বলল। কেউ কেউ তো আমাকেই ডাউট করলো! আমি ষ্ট্রেইট কী না! বিশ্বাস করো আমি ষ্ট্রেইট, আমি যখন'ই তোমাকে দেখি আমার মাথায় থাকে না তুমি একজন পুরুষ আমার মতোই। আমার মতোই একটা ছেলে হয়ে জন্মেছো। তোমাকে যখন'ই দেখি, তোমার মধ্যে একজন নারীকেই দেখি। একজন পুরুষ যেভাবে এক নারীর প্রতি আর্কষিত হয়, তোমার প্রতিও আমি তেমনিই আকর্ষিত। বিশ্বাস করো!


এতোক্ষন একটা কথাও বলেনি অনন্য। ওর চোখ নিজের অজান্তেই জলে ভরে উঠেছে। ওর কোনো কথা বলার ক্ষমতাই নেই। কথা বলতে গেলেই একরাশ কান্নার দমক গলা দিয়ে উঠে আসবে। 


আলো কমে এসেছে। দূরের ভিক্টোরিয়া আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। গোটা মাঠ জুড়ে হালকা নীলচে রঙের মায়ার রাজ্য। গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। আর সাথে একটা গান, একজন গান গাইছে, আর তাকে ঘিরে দু'জোড়া কাপল হাতে হাত রেখে নাচ করছে...

“হয়তো তোমারি জন্য/ হয়েছি প্রেমে যে বন্য/ জানি তুমি অনন্য/ আশার হাত বাড়ায়..."

 এর মধ্যে উঠে দাঁড়াল নীলাভ্র। তা দেখে অনন্য'ও উঠে দাঁড়ায়। ওকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল নীলাভ্র। পকেট থেকে একটা গোলাপ বেড় করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় অনন্যা!"


অনন্যা! অবাক বিস্ময়ে সজলভরা চোখে তাকালো ও। নীলাভ্র মনে মনে ওই নামটাই দিয়েছে। 

কী বলবে অনন্য! কী বলবে? গোলাপের দিকে হাতটা বাড়ানোর ক্ষমতা পাচ্ছে না। 

কাঁপা পায়ে পিছতে শুরু করল ও। নীলাভ্র এবার অবাক হয়। না! অনন্য আজ কিছু বলতে পারবে না। চায়'ও না। বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভুতি তোলপাড় করে চলছে। কান্না পাচ্ছে! তার সাথে অদ্ভুত একটা আনন্দ'ও ঘিরে ধরছে ওকে। পিছন ফিরে ছুট লাগালো। নিজের অজান্তেই দু'হাত মেলে পাক খেল। ছুটছে ও…


পেরেছে! কারোর কাছে তো ও নিজে ‘নারী' বলে স্বীকৃতি পেল!

ও জানে না এরপর কী হবে? জানে না জীবন ওকে আর কী কী দেখাবে! জানে না, কতটা সত্যি নীলাভ্র! কিন্তু, এই মুহূর্তটা বড্ড দামী বড্ড...


মাঠের এক প্রান্ত থেকে এক গোছা লাল গ্যাস বেলুন সন্ধ্যার নীল আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আর মাঠের এপ্রান্তে লাল শাড়ি পড়া একটি মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, সে ছুটছে! দু'হাত মেলে। সে আজ বড়ো খুশি। ভালোবাসার দিনে কোনো এক স্বপ্নে দেখা মুহুর্ত বাস্তব হয়ে নেমে এসেছে…

ভেসে আসছে ক্ষীন ভাবে গানের লাইন,


“আমি যে দুরন্ত, দুচোখে অনন্ত/ঝড়ের দিগন্ত জুড়েই স্বপ্ন ছড়াই…"



© পায়েল গুহ





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance