Payel Guha

Abstract Horror Thriller

3  

Payel Guha

Abstract Horror Thriller

লাবন্য

লাবন্য

15 mins
268


(১)


গঙ্গার একটা অনামী ঘাট এটা। কেউ আসে না। সকালের দিকে হয়তো এক-দু'জন আসলো স্নান সেরে গেল। কোনো এক আধ বুড়ো ধোপা জামা-কাপড়ের ঢাঁই নিয়ে কেচে চলে গেল। তারপর একা একা পরে রয় ঘাটটা।


তন্ময় এখানে এসে বসে থাকে মাঝে মাঝে ভর দুপুর বেলায়। দুপুর আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে আঁধার নামে। সবটা ও বসে বসে দেখে। গঙ্গার পাড়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সময় পাড় হয়ে যায় ও নিজে টের-ও পায় না।এক সময় সন্ধ্যে হয়ে যায়। মশা ঘিরে ধরে। তখন উঠে যায়। বেশীক্ষন তখন থাকাটা ভালো না। এখানে জুয়ার, মদের আসর বসে। যত সব অসামাজিক লোক জনদের আখড়া হয়ে যায় এই ঘাঁট। 


রোজকারের মতন আজ'ও এসেছে সেই ঘাটে। ঘড়িতে এখন তিনটে বেজে পাঁচ। কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে হাতের ঝাল মুড়ির ঠোঙা থেকে এক মুঠ নিয়ে মুখে পুড়ল ও। এটাই ওর রোজকার লাঞ্চ। গরীব পরিবারের ছেলে তন্ময়। ওর বাবা ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করতো। একদিন ট্রেনে উঠতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে পরে যায়। ব্যাস! সব শেষ। তখন ও কলেজে পড়তো। কলেজটা আর শেষ করতে পারেনি। সংসারের কাজে লেগে পরতে হয়। তারপর আজ একাজ, কাল সেকাজ করে, কোনো মতে সংসারটা চলছে,ওর আর ওর মায়ের। মা একটা ব্যাগের ফ্যাক্টরীতে কাজ করে এখন আগে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করতো। চলে যায় বেশ দু'জনের। ওর মা যদিও খুব হা-হুতাশ করে অভাব-অভাব করে। কিন্তু, ওর এসব মনে হয় না। চলছে তো! আর কী লাগে। 


ও এখন এই মহামারির পর, নতুন এক অনামী চানাচুরের কোম্পানির হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে বেড়ায়। আগে অন্য কাজ করতো। এই লকডাউনের পর, প্রথমে কোনো কাজ পাচ্ছিল না। পাঁচ-ছমাসের পর, ওর মা ব্যাগের কারখানায় ঢুকলো, আর ওর লেগে গেল এটা। ব্যাস! 

এখন সাত পাড়ার লোকের খ্যাদানি খেয়ে এই বিকেল বেলা করে এসে বসে গঙ্গার পাড়ে। তাও সবদিন হয় না। যেদিন কাছে পিঠে থাকে চলে আসে। বসে যায় কিছু সময়। এই এক-দু ঘন্টা ওর বড়ো লাগে। সংসার, জীবন — এসবের থেকে দূরে থেকে ভেসে যাওয়া। গঙ্গার উপর দিয়ে কত নোংর বয়ে যায়। কতদিন ভাবে ও নিজেকে সমর্পণ করে দেবে , কেন যেন মনে হয় তাতে ওর প্রাণ জুড়াবে। না ঠিক! আত্মহত্যার চিন্তা থেকে এসব ভাবে না। এমনিই মনে হয়। আসলে এই গঙ্গার পাড়ে আসলে মনটা অনেকটা হালকা হয়ে যায়। জীবনের লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই, লোকের খিস্তি, সব কিছুর থেকে যেন দূরে চলে যেতে পারে ও। যখন আঁধার নেমে আসে, তখন আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না, ড্রেনের মতন পুঁতি গন্ধময় জীবনটায়। যেখানে কিছুই নেই, ঘরে চাল নেই, পরার জামা নেই, অসুখে ওষুধ নেই, বেঁচে থাকার অর্থ নেই...


এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঠোঙাটা শেষ হয়ে গিয়েছে ও টের'ও পায়নি। কাগজটা মুড়িয়ে সিঁড়ির কোনায় ছুঁড়ে ফেলা উঠে দাঁড়ায়। একটা আলমোড়া ভেঙে সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাতটা ধুয়ে একটু জল খাবে বলে পা-টা বাড়াতে যাচ্ছিল। থমকে গেল। ওকি! ওটা কে? 


সিঁড়ির একদম নীচে একেবারে কোনায়, যেখানে বড়ো ঝাকড়া বাবলা গাছটার ছায়া পরেছে, ওখানে কে একটা যেন বসে আছে! এখানে তো কেউ থাকে না। আজ এতোদিন হলো এখানে আসছে...

আস্তে আস্তে নামতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে। গঙ্গার দামাল হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর চুল। শেষ সিঁড়িতে নেমে হাতটা ধুলো। তারপর আজলা ভরে একটু জল গলায় ঢাললো। এর মধ্যে বার তিনেক মা ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখেছে। জায়গাটায় গাছের ছায়াটা আঁধার করে রেখেছে। তার মধ্যে পাথরের মতন থম মেরে বসে রয়েছে মেয়েটা। অদ্ভুত! একটা মানুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার দিকে একবারও তাকালো না? চোখ নামিয়ে মেয়েটা কী দেখছে জলের মধ্যে?


রুমালে হাতটা মুছতে মুছতে মেয়েটির দিকে ঘুরেই দাঁড়ালো ও। ভালো করে দেখলো মেয়েটিকে। মেয়েটিকে দেখে প্রদম থেকেই ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। কেন যে হচ্ছে! ওহ! বুঝতে পেরেছে। ও অনেক রকম মানুষ দেখেছে। কালো গায়ের রং-এর মানুষ দেখেছে। ওর বাড়ির পাশেই থাকে পুঁটিরাম কাকা, পুরো কুচকুচে কালো। আবার সাদা মার্বেলের মতো মানুষ'ও দেখেছে। কিন্তু, এমন লালচে মানুষ একটিও দেখেনি। রোদে পুড়ে পুড়ে অনেকের গায়ের রং তামাটে হয় বটে। কিন্তু, এমন কালোর মধ্যে লাল মেশানো গায়ের রং দেখেনি ও। দেখলেই কেমন যেন করে ওঠে বুকটা। তারপর কত বড় চুল মেয়েটার! দাঁড়ালে তো মনে হয় পায়ের কাছে লুটোবে। বাবা! গায়ে ছাই রঙের কাপড় জাতীয় কী একটা জানি জড়ানো খুব অদ্ভুতভাবে। কে মেয়েটা? প্রবল কৌতুহল অনুভব করলো ও। অন্যদিন তো চুপচাপ বসে কাটায়। আজ একটা সঙ্গী পাওয়া যাবে, মেয়েটির পাশে বসে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিল ও।


(২)


— এই তুমি কে গো? কোথায় থাকো? কোথা থেকে এসেছো?


একসাথে পর পর প্রশ্ন ছুটে গেল মেয়েটির দিকে। তন্ময় পাশে বসার পরেও মেয়েটি একটুও নড়েনি, একটা বার-ও মুখ তুলে তাকায়নি। অদ্ভুত তো! যেন ওর পাশে বসে কোনো মেয়ে নয় পাথরের মূর্তি বসে রয়েছে। 


কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কে তুমি? আমি এখানে প্রায়-ই এসে বসি। একাই বসে থাকি। আজ তোমাকে দেখে ভাবলাম তোমার সাথে একটু আলাপ করি।”


তবু চুপ। কী রে বাবা! বোবা নাকি? মরে যায়নি তো?

কথাটা ভাবতেই বুকটা ওর ধক্ করে উঠলো। গঙ্গাপাড়ে বসে গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়ে গেল না তো? একবার আশপাশটা তাকালো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে একটা প্রাচীন বটগাছ তার বহু প্রাচীন ঝুড়ি ডাল-পালা ছড়িয়ে সাম্রাজ্য বিছিয়ে রয়েছে। তার নীচে মাটির ফেলে দেওয়া সরস্বতী, কার্তিক রাখা। এক পাশে পুরোনো এক কামড়ার বাড়ি। তার সামনে একটা কুয়ো। পুরো চত্বরটায় কোনো মানুষ তো দূর কুকুর-ও নেই। এমনকি অন্য দিনের মতন কাকের কীর্ত্তন'ও শোনা যাচ্ছে না। ও নিজের কাঁপা হাতটা বাড়াল, একবার ধাক্কা দিয়ে দেখবে বলে।


চকিতে মেয়েটির মুখ ফিরল ওর দিকে। তার শরীরের কোনো অঙ্গে কোনো রকম নড়াচড়া ছাড়াই হঠাৎ মেয়েটি ফিরালো ওর দিকে। আর মেয়েটির স্নিপলক, নিষ্প্রাণ চোখ তুলে তাকালো ওর দিকেই। আর তার চোখে চোখ পড়তেই ওর বুকটা কোনো এক অজানা কারণে ধক করে উঠল। লালচে কালো মুখটা, ভাবলেশহীন। চোখে যেন মৃত্যুর স্তব্ধতা। সবচেয়ে অদ্ভুত ওর চোখটা! খুব অদ্ভুত! খয়েরি, নীল চোখ হয় ও শুনেছিল। কিন্তু, লাল চোখ! চোখের মনি গাঢ় লাল। চোখটা দেখে তন্ময়ের বুকের রক্ত হিম সবার যোগাড়। ভয় পেলেও মেয়েটির চোখ থেকে নিজের চোখ সরাতে পারলো ও। তাকিয়ে রইল...


ওর ভয়টা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বুকের ঢিপঢিপটা আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগলো। আস্তে আস্তে অন্যরকম একটা অনুভুতি খেলে যেতে লাগলো। যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অতলে... উল্টোদিকের মানুষটার চোখের তীব্র তীক্ষ্ণতা বদলে যেতে লাগলো অদ্ভূত এক মায়ায়। 

ওর শরীরটাও যেন মেয়েটির মতন পাথুরে হয়ে গিয়েছে।বসে রয়েছে... বসেই রয়েছে কোনো এক অনন্ত অপেক্ষায়। 


তন্ময় দেখতে পেল, লাল বল দুটোর পাশের সাদা অংশ বদলে যেতে লাগলো কালোতে। ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো, অন্ধকারে জ্বলছে কোনো অঙ্গার...


কতক্ষন যে একভাবে বসে কাটিয়ে দিল ও টের-ও পায়নি। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়ার দমকে কেঁপে উঠলো ওর সারা শরীর। চমকে উঠলো ও। প্রথমে বুঝতে পারলো না ও কোথায়? এতো অন্ধকার কেন চারদিক। তারপর বুঝলো।

সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। এই ঘাটের আলোটা বহুদিন নষ্ট। ফলস্বরূপ, আলোর কোনো আভাস নেই ওর আশপাশে। 

অনেকক্ষন পর যেন ওর শরীরে শীতল গঙ্গার হাওয়া স্পর্শ করল। আরাম লাগছে বড্ড।কাউকে যদি হিটার চালিয়ে বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রাখার পর ঠান্ডা হাওয়ায় বের করলে যেমন লাগবে তন্ময়ের তেমন অনুভূতি হচ্ছে। যেন ওকে কেউ প্রেশার কুকারে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ওর খেয়াল পরল মেয়েটির কথা। পাশে তাকালো। কোথায়? চারিদিকে এতো অন্ধকার, ও কোনো মানুষের অস্তিত্ব তো টের পাচ্ছে না! উল্টে ওর সামনে জ্বলজ্বল করছে দুটো লাল বিন্দু্। যেন লাল দুটো জোনাকি... লাল জোনাকি? 


হঠাৎ ওর খুব ভয় লাগলো। মন বলল, সময় অনেক গড়িয়ে গিয়েছে। ওর বাড়ি যাওয়া উচিত। উঠে দাঁড়ালো ও। উঠে যেতে লাগলো সিঁড়ি ভেঙে। 

তবে কোনো এক টান মাধ্যাকর্ষণের মতন পিছু টানতে লাগলো। খুব ইচ্ছে করলো পিছন ফিরে তাকাতে। ওই বাবলা গাছ তলায় বসতে। মেয়েটি হয়তো ওখানেই আছে। মেয়েটিকে একা ফেলে চলে যাচ্ছে?


আবার ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ধমক দিল, “চলে যা এখান থেকে... চলে যা"।


চোখ বুজে সোজা মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেল তন্ময়।


গঙ্গার শেষ ধাপের কোণায় জ্বলে রইলো লাল টিমটিমে আলো জোনাকির মতন... 


(৩)


কখনো কখনো কিছু ঘটনা আমাদের মানসিক স্থিতিটাকে নাড়িয়ে দেয়। সারাটা সময় ওই ঘটনাটাই মাথায় ঘুরতে থাকে। প্রতিদিনকার এক ঘেয়ে শান্ত জীবনটা হয়ে ওঠে সমুদ্রের মতন। 


কিছু মানুষের সাথে দেখা হবার পর মন আবার অপেক্ষা করতে থাকে তার জন্য। যেন অবচেতন মন আবারও তার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। তন্ময়ের অবস্থাও তাই। 


সারাটা রাস্তা কীভাবে এলো বুঝতেই পারেনি। বাড়িতে আসার পর হাত-মুখ ধুয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। বড়ো ক্লান্ত... বড় ক্লান্ত লাগছে ওর। যেন কত না পরিশ্রম হয়েছে আজ ওর শরীরের উপর যেন বয়ে গিয়েছে বড়ো কোনো ধকল। কোথায় অন্য দিন তো এমন মনে হয় না। অন্যদিনের মতোই তো আজ কাটল। সত্যিই কী তাই কেটেছে? না তন্ময় জানে, আজকে ওই মেয়েটিকে দেখার পর থেকে কিছু একটা অন্যরকম প্রভাব পড়েছে ওর জীবনে। কীভাবে যেন কেটে গেল না মাঝের সময়টা? কী একটা যেন আছে মেয়েটির চোখে। কে মেয়েটি?


তন্ময়ের মা যে কখন ওর ঘরে ঢুকেছে ও টের-ও পায়নি। হঠাৎ মাথায় একটা শীতল স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালো ও। আর দেখলো ওর মা তড়িৎগতিতে হাতটা সরিয়ে নিল।


— একি বাবু? তোর তো জ্বর এসেছে। জ্বর বাঁধালি কী করে? এ তো পুড়ে যাচ্ছে শরীর।


তন্ময় অবাক হয়। জ্বর! কোথায় ওর তো কিছু মনে হচ্ছে না। 


—জ্বর? কোথায় না তো।

— না তো মানে? উনুনের মতন জ্বলছে তোর শরীর! হাত দিতেই পারলাম না‌ আর তুই বলছিস না তো!

অবাক হলো তন্ময়। কোথায় জ্বর জ্বর অনুভুতি তো হচ্ছে না। হ্যাঁ ক্লান্ত লাগছে বটে। তবে....


ওর মা ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। জলপট্টি দেওয়া শুরু করলো। কিন্তু, তার পরেও যখন রাতে জ্বর কমলো না, চিন্তায় পড়লেন তিনি।


— কাল ডাক্তার দেখাতে হবে তোকে।

— আরে কমে যাবে দেখো।

—সন্ধ্যে থেকে এখন রাত বারোটা এতোটা সময় এক ফোঁটা গায়ের তাপ কমলো না, আর তুই বলছিস কমে যাবে? কী বাঁধিয়ে এলি বলতো?

তন্ময় জানে ওর কিছু হলে মা বড্ড ভয় পেয়ে যায়। তাই আর তর্ক করলো না। ঠিক আছে যদি কাল গায়ে উত্তাপ থাকে, তবে না হয় যাবে।

— আর কাল তুই কাজে যাস না। সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরেই মনে হয় জ্বরটা এসেছে। 


মায়ের কথায় চমক ভাঙল ওর। আর সাথে সাথে মনের মধ্যে চলতে থাকা তোলপাড়টা আরো বাড়ল। তরাক করে উঠে বসে ও বলল, “না! কাল যেতেই হবে।”

— খবরদার না। এই শরীরে কোনো মতেই তুই যাবি না।

যাবে না! তবে তো... ওর তে মেয়েটিকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। কাল যে গঙ্গার ঘাটে ওকে যেতেই হবে। যেতেই হবে...


— যেতেই হবে আমাকে কাল।

— কেন? একদিন ছুটি নিতে পারবি না?

— না, গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল তন্ময়।



(৪)


দুটো লাল জোনাকি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মন বলছে ওটাই ওই মেয়েটি। ও যত এগোচ্ছে তত পিছিয়ে যাচ্ছে জোনাকি দু'টো। এভাবে চলতে চলতে কত পথ যেন এগিয়ে গেল ও টের পেল না। শেষটায় অস্থির হয়ে উঠে বলল, “কোথায় যাচ্ছো তুমি? কে তুমি? একটাবার সামনে এসো...”

একটা রিনরিনে কন্ঠের হাসি শুনতে পেল ও। হাসিটা শুনে ওর গায়ের লোম গুলো দাঁড়ায়ে গেল। বড়ো অদ্ভুত তো হাসিটা!


— এসো..., প্রথমবার শুনলো তন্ময় মেয়েটির কন্ঠ। 

— কে?

— আমি... এসো... আমি তো তোমার জন্যেই বসে রয়েছি। এসো...

তন্ময়ের বুকটা মুষড়ে উঠলো। মন বলল, যেতে হবে। ওকে যে করেই হোক মেয়েটির কাছে যেতে হবে। ওর জীবনে আর কিছু নেই। ওই একটাই লক্ষ্য...

— ক... কোথায় তুমি? 

— তোমার সামনেই আছি এসো...

ও কয়েক পা এগোলো। এক অমোঘ টান ওকে টানছে। ওই টান এড়ানোর ক্ষমতা তন্ময়ের নেই।


— তুমি কে বলোতো?নাম কী তোমার?

— তুমি যা বলবে আমি তাই...

— তাই?

— হ্যাঁ, এসো!


তন্ময় এক পা এগিয়ে হাতটা বাড়াতে যাবে। ওর পদক্ষেপটা শূন্যে পড়ল। তারপর ওর গোটা শরীরটাই যেন পতিত হচ্ছে। ও একটা তরলে গিয়ে পড়ল। ঘন একটা তরল। যেখানে পড়ে ও বুঝল এটা কোনো সামান্য তরল নয়‌। প্রচন্ড উত্তপ্ত তরলটি। ও সেখানে পড়তেই আসতে আসতে পুড়ে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেতে লাগলো। প্রথমে পা, তারপর কোমড়, বুক... গলা...

গলাটা নিশ্চিহ্ন হবার আগে একটা নাম ধরে চিৎকার করল ও, “লাবন্য....”



“বাবু... এই বাবু... বাবু... ওঠ্ না বাবু। কী হলো তোর?”


তন্ময় ধড়পড়িয়ে উঠেই মায়ের এই বিলাপ শুনতে পেল ও। তন্ময় হাপাচ্ছে। ওর প্রচন্ড গরম লাগছে। সারা শরীরে যেন পোড়ার যন্ত্রনা। সময় লাগলো ওর ধাতস্থ হতে। ও তবে স্বপ্ন দেখছিল? এটা স্বপ্ন! কী বিভৎস!


ধাতস্থ হতে সময় লাগলো ওর। দু'হাত মুখের উপর বুলালো ও। সারা শরীর জুড়ে ঝিমঝিমে ভাব ছড়িয়ে পড়ছে ওর। ক্লান্ত চোখে পাশে তাকাতে দেখলো মা কাঁদছে। মা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “ঠিক আছিস তো বাবা? কী হয়েছিল তোর?”

— ক... কিছু না।

— আমি বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোর শরীর পুরো মড়া মানুষের মতন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।, ওকে আবার ধরে চমকে বলল, ”এখনো তো! কী হয়েছে বাবু তোর?”

তন্ময়ের অবাক হবার পালা এবার, “আমার শরীর ঠান্ডা? কী বলছো? আমার তো প্রচন্ড গরম লাগছে মা!”


অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে তন্ময়ের মা। তার মন কু গাইছে। ছেলেটার কোনো বিপদ হবে না তো?


(৫)


ভূতে পাওয়া মানুষের মতন ছুটে এসেছে তন্ময়। মা সকালে কোনো ভাবে ওকে বেরোতে দিতে রাজি হয়নি। কিন্তু, যত সময় পেরোতে লাগলো, তত'ই ভিতরের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। ডাকছে ওকে কেউ। কেউ ওর জন্য অপেক্ষায় আছে। যেতে হবে ওকে যেতেই হবে।


দুপুরের কাঁটা বিকেলে গড়াতে না গড়াতেই মায়ের অগোচরে বেরিয়ে এসেছে তন্ময়। বটগাছের নীচ দিয়ে কুয়ো পার করে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সামনে চাইতেই ধক্ করে উঠলো ওর বুকটা। 


দু'টো লাল চোখ চেয়ে রয়েছিল পথের পানে।যেন ওর অপেক্ষাতেই। প্রথমে ভয় বুকে চেপে বসেছিল। কিন্তু, লাল চোখে চোখ পড়তেই ভয়টা বদলে গেল, হু হু করে উঠলো ওর বুকটা। ওর মনে হতে লাগলো এই গোটা পৃথিবীতে একমাত্র একজন ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। একমাত্র ওর জন্য... 

একজন প্রেমিক যে টানে তার প্রেমিকার দিকে ছুটে যায়। ওমন টানে তন্ময় এগিয়ে চলল লাল চোখের অধিকারিনীর দিকে। আজ'ও মেয়েটি এক'ই জায়গায় বসে রয়েছে। মেয়েটির পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটিরও মুখ ফিরল ওর দিকে। ওর চোখের দিকে তার চোখটিও নিবদ্ধ। 

বেলাশেষের রৌদ্রের লাল আভা এসে পড়েছে মেয়েটির লালচে মুখটায়। গাছের আঁধার মাখা রক্তাভ আলোয় যে কেউ মেয়েটিকে দেখলে হয়তো ভয় পেত। কিন্তু, তন্ময় মোহিত হলো কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। ওর চোখে বিহ্বলতা। ওর মন এখন শান্ত। কাল বাড়ি ফেরার পর থেকে যে অস্থিরতা ওকে ঘিরে ছিল, সব শান্ত... এই মেয়েটির কাছেই যেন আছে ওর কাঙ্খিত চির শান্তি। আচ্ছা, ও কী প্রেমে পড়ল এই অদ্ভুত মেয়েটার?


— তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো কোথায় থাকো?, ঘোর মাখা গলায় বলল তন্ময়।

মেয়েটি চোখটা নামাল। ওর চোখ আবার গঙ্গার ঢেউ গুলোয়। কিছুক্ষন সব চুপ। তন্ময় কী করবে বুঝতে না পেরে আবার প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল, তখনই দেখলো মেয়েটির হাতটা খুব ধীর গতিতে উঠছে। পিছন দিকটায় নির্দেশ করছে কিছু। হাত বরাবর তাকিয়ে যা দেখলো তাতে থমকে গেল ও। কী বলতে চাইছে মেয়েটা? ও কুয়োতে থাকে? তন্ময়ের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেয়েটির দিকে। আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে মেয়েটার হাত। 

‘ওহ্! কুয়ো কেন হবে, ও নিশ্চয়ই বলতে চাইলো, ও হয়তো ওদিক দিয়ে এসেছে। ও বাইরে থাকে। এলাকার বাইরে কী? এই ঘাটের মুখটার উল্টোদিকের রাস্তাটাই তো ষ্টেশনের রাস্তা‌। তাই হবে।”, মনে মনে নিজেকে বলল। ভ্রু দুটো আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল। মেয়েটি এখন আর ওর দিকে চেয়ে নেই। মাথা নামানো। তন্ময়-ও সামনের দিকে চাইলো। সূর্যের লাল রং ধুয়ে দিচ্ছে গঙ্গার বুক। আকাশে ছেঁড়া মেঘ গুলোতেও লেগেছে লাল রং। ওর মধ্যে একটা অস্বস্থি হচ্ছে। খুব অসহ্য রকম একটা গরম ঘিরে ধরেছে রয়েছে ওকে। আচ্ছা! আজ কী খুব গরম পরেছে? কিন্তু, গঙ্গা পাড়ে বসে এমন গরম লাগছে কেন? 


ও আশপাশটায় ভালো করে চাইলো। গাছপালা নড়ছে তবে ওর গায়ে হাওয়া লাগছে না কেন? ওর প্রাণটা একটা হাওয়ার দমকের জন্য উদগ্ৰীব হয়ে উঠলো। বিভৎস তাপ যেন ওর পাশ দিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যেন চুল্লির সামনে বসে আছে ও। চুল্লির ঢাকনা উঠলেই ওকে গ্ৰাস করে নেবে সর্বগ্ৰাসী আগুন।


ও পাশের মেয়েটির দিকে চাইলো। মেয়েটি কখন যেন ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে এক দৃষ্টে। আবারও ওর বুকটা কেঁপে উঠলো মেয়েটির লাল চোখে চোখ পড়তেই। ও খেয়াল করেছে, যখন'ই ওই চোখের উপর চোখ পরে প্রথমে বুকটা ঢিপ করে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে অপরিচিত একটা আবেশ ঘিরে ফেলে ওকে। তবে আজ আর তার চোখের দিকেই চেয়ে রইল না। মুখটা ভালো করে দেখলো। কালচে লাল মুখটা নিষ্প্রাণ, তবে মুখে যেন বাঁকা হাসি লেগে রয়েছে। এই মুখে নরম আলো পরে মায়াবী লাগছে। এক সর্বনেশে মায়াবীনি।


— তোমার নাম কী?

— তুমি যা বলবে আমি তাই...

চমকে উঠলো তন্ময়। এই কন্ঠটাই তো শুনেছিল রাতে স্বপ্নে। 

— যা বলবো তাই?

মেয়েটি নিষ্পলক চেয়ে রয়েছে। সেভাবে চেয়ে থেকেই যেন হাসল। 

—তবে তোমায় লাবন্য বলি?

মাথা নাড়ালো সে। তন্ময়ের মন আনন্দে নেচে উঠল। যেন মেয়েটি ওর প্রেম প্রস্তাব গ্ৰহণ করেছে। 


আলো কমে আসতে শুরু করেছে। আরো একটু পর অন্ধকার হয়ে যাবে চারপাশটা। 

মেয়েটি অনেকক্ষন চুপ ছিল। এই প্রথম নিজে থেকে বলল, “চলে যাও।”

— না।

— চলে যাও...

— না আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। আমার ভালো লাগছে। তোমার থেকে দূরে গেলেই অস্থির লাগে বড্ড। 


মেয়েটি তন্ময়ের চোখে চোখ রাখল। আর তন্ময়ের মনে হলো গরমটা যেন আরো বেড়ে উঠলো। শরীরে অল্প চিনচিনে জ্বলন টের পেল। মেয়েটি আবার বলল, ‘চলে যাও'

এবার অলঙ্ঘনীয় আদেশ! এর অমান্য করলেই যেন ঘনিয়ে আসবে কাল। তন্ময় মন্ত্রমুগ্ধের মতন উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে উঠে যেতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে।


ওর চমক যখন ভাঙলো, ও দেখলো ও দাঁড়িয়ে ওর নিজের বাড়ির দরজার সামনে। মাঝের রাস্তাটুকু ও কীভাবে এলো, টের-ও পায়নি।


(৬)


সেদিনও ওর শরীর বড্ড ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরে এসে কখন যেন ঘুমিয়েই পড়েছিল ও। ঘুম ভাঙল মায়ের কান্নায় আর এক পুরুষালি কন্ঠ শুনে। মা বলছে,“দেখো না রহমানভাইয়া, ছেলেটার আমার কী হলো?"

রহমান ভাইয়া তন্ময়কে উঠে বসতে দেখে অবাক হলেন, উনি এই মাত্র ওর শরীরের উত্তাপ দেখলেন থার্মোমিটারে, একশো পাঁচ। এতো টেম্পারেচার থাকলে তো কেউ এরম গড়গড় করে উঠে বসতে পারে না! 

— তুই উঠে বসলি যে?

— কেন চাচা! আমি তো ঠিক আছিস? তোর তো একশো পাঁচ জ্বর!

— জ্বর? কোথায় আমি তো কিছুই অনুভব করছি না।

থমকে গেল রহমান ভাইয়া। কিছুক্ষন তন্ময়কে জরিপ করে নিজের মনেই মাথা নাড়ালেন তিনি। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তন্ময়ের মা বলে উঠল, “ভাইয়া!”

— বাইরে আসেন ভাবি। 


তন্ময়ের মা এর মধ্যেই রহমান ভাইয়া কে আগেরদিনের গায়ের তাপ বাড়ার কথা, সকালে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সবটাই বলেছে। রহমান ভাইয়ার সবটা শুনে ব্যাপারটা মোটেও ভালো ঠেকছে নাহ বাইরে বেরিয়ে তন্ময়ের মায়ের দিকে চাইলেন তিনি।

— ভাইয়া, তোমার কাছে যদি ওষুধ থাকে ছেলেটাকে একটু...

— লাভ নেই ভাবি কোনো ওষুধে।

— মানে?

— ভাবি, আমি দেখেছি মাঝে মাঝে ও ওই বটতলার ঘাটে যায়। জানেন তো ভাবি, অনেক সময় কু হাওয়া লাগে। তুমি বরং বেটাকে নিয়ে কাল মসজিদে যাও। কাল শুক্রবার ভালো দিন। একটু পীর বাবার থেকে ঝেড়ে এসো ওকে। 

হতভম্ব হয়ে শুনলেন তন্ময়ের মা। কাল সন্ধ্যে অবধি অপেক্ষা করতে হবে‌। কিন্তু, ওনার মন এতো কু গাইছে কেন?


রাতে কিছু খেলো না তন্ময়। আজকেও আবার স্বপ্নে মেয়েটিকে দেখলো। মেয়েটি বলছে, “আজ তবে শেষ দেখা আমাদের?”

তন্ময় পাগলের মতন করছে আর বলছে , “তুমি কোথাও যাবে না লাবন্য। কোথাও যাবে না। আমি যেতে দেবো না। ধরে রাখবো... ধরে রাখবো..." 

একটা রিনরিনে হাসি শুনতে পেল ও। হাসিটা এতোটাই বাস্তব ছিল যে, ঘুম ভেঙে গেল ওর।


আজ আর মা'কে বলতে হয়নি। আজ'ও আর কাজে যেতে ইচ্ছে করেনি ওর‌। কিন্তু, যত ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগলো তত ওর অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। আর মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরে যেতে লাগলো, “ধরে রাখবো... ধরে রাখবো..."

ও জানে না কেন এমন করছে। কী আছে মেয়েটির মধ্যে? কিন্তু, নিজেকে সামলাতে পারছে না। যেন ওর কন্ট্রোল নিজের হাতে নেই। কিছুই যেন ওর হাতে নেই। এ কেমন অস্থিরতা। 


একটা সময় পর ঘড়ি জানান দিল, বিকেল তিনটে বাজে। বেরিয়ে পড়লো ও বাড়ি থেকে। ওর কেন যেন মনে হল এঈ শেষবারের মতন বেরিয়ে যাচ্ছে ও বাড়ি থেকে।


আজ'ও একভাবে শেষ সিঁড়িতে বাবলা গাছটার নিচে বসে রয়েছে ওর লাবন্য। লাবন্যকে দেখা মাত্রই ওর বুকটা হু হু করে উঠলো। তড়িঘড়ি সিঁড়ি ভেঙে নেমে মেয়েটির পাশে বসল।

মেয়েটি আজ আর পথের দিকে চেয়েছিল না। একদৃষ্টিতে প্রথম দিনের মতন জলের দিকে চেয়ে। আর আকাশ কালো হয়ে এসেছে। অন্ধকার যেন বেড়ে গিয়েছে দিনের বেলাতেও। 

— লাবন্য! 

তন্ময়ের ডাকে ফিরে তাকালো মেয়েটি। মুখে আগের মতোই একটা হাসি লেগে রয়েছে। আজ কেন জানি তন্ময়ের মনটা শান্ত হচ্ছে না। ও বলে উঠলো, “তুমি চলে যাবে?"

মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়াল। 

— তুমি যেও না।

— আমার সময় শেষ...

— তুমি যেও না প্লিজ, বলে হাতটা বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরতে গিয়েছিল। কিন্তু, মেয়েটি সরে গেল। তন্ময় তা পাত্তা না দিয়েই বলে চলল, “তোমার সামনে না থাকলে আমি বড্ড অস্থির অস্থির করি। কোথায় যাবে তুমি? যেও না।”

সেই স্বপ্নের মতন রিনরিনে হাসিটা শুনতে পেল ও। 

তন্ময়ের অস্থিরতা আরো বেড়েছে, মোহগ্ৰস্থের মতন বলতে লাগলো, “যাবে না... যাবে না তুমি। যাবে না। যেতে আমি দেবো না।ধরে রাখবো... ধরে রাখবো... ধরে রাখবো... ধরে রাখবো..." বলেই চললো। 

আবার হাসির শব্দ পেতে এবার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তন্ময় তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি যেন বড্ড আনন্দ পাচ্ছে ওর অবস্থা দেখে।


আকস্মিকভাবে তন্ময় হাত বাড়িয়ে মেয়েটির মুখটা দুইহাতের আজলায় ধরলো। ধরা মাত্রই ও বুঝল বড়ো ভুল করে ফেলেছে ও। একটা পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাঁপিয়ে পরার পর বোঝে সে ভুল করে ফেলেছে। 


ও টের পেল একটা স্যাঁতস্যাঁতে ত্বকের উপর হাত পড়েছে। কোনো সাধারণ মানুষের মতন নয় ত্বকটা। ত্বক নয়, যেন জ্বলন্ত লাভা দিয়ে তৈরি লাবন্য।

হাত থেকে ধীরে ধীরে যেন ছড়িয়ে পড়তে লাগলো সারাশরীর জুড়ে জ্বলন্ত লাভা। প্রচন্ড জ্বলন ওকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেতে লাগলো। একটা দেশলাই কাঠিতে আগুন দিলে যেমন ধীরে ধীরে পুড়তে পুড়তে বেঁকে যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তন্ময়ের শরীরটাও কালো হয়ে এলো। ওর আর্তনাদ ওই একলা পাড়ে পাক খেতে লাগলো। আর সাথে একটা হাসি। মেয়েটি এক দৃষ্টে দেখে যেতে লাগলো তন্ময়ের ছটফটানি। আর তত হাসতে লাগলো। আগুনে কোনো পতঙ্গ এসে পড়লে আগুন-ও হয়তো ওমন হাসতো। পতঙ্গটির বোকামো দেখে। অবহেলার হাসি...

তন্ময়ের তবু মেয়েটির দিকেই। ওর চোখ যন্ত্রনায় ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে অক্ষিকোটর থেকে। ওর চোখের মনির সাদা অংশ লাল হয়ে যেতে লাগলো। তারপর, চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে এলো রক্তের ধারা...

তন্ময়ের গলায় একটা ওঠানামা দেখা গেল। ও অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো শেষবারের মতন, “ল..ল..লা ব....ন্য” তারপরেই মুখ থেকে উঠে আসলো রক্তের স্রোত।


অন্ধকার নেমে এসেছে। মেয়েটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে লাগলো। থপ্ থপ্ শব্দ একলা ঘাটটায় অনুরণিত হতে লাগলো। যেন কোনো লিপ্তপদ বিশিষ্ট প্রাণী সিঁড়ি ভেঙে উঠছে। মেয়েটির চুল লুটিয়ে ঝাঁট দিতে দিতে চলছে ঘাটের ময়লা। একবার ফিরে তাকালো নিচের সিঁড়ির দিকে, নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে তন্ময়ের প্রাণহীন পোড়া দেহ। তারপর এগিয়ে গেল কুয়োর দিকে। 


© পায়েল




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract