মন যে মানে না
মন যে মানে না
কুসুম, পুস্পর বড়দি | কুসুম দেখতে খুবই সুন্দরী, কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ, এক ঢাল লম্বা চুল | সেখানে পুস্প হয়েছে ছিমছাম গড়নের দেখতে | তার চেহারায় সৌন্দর্য্য না থাকলেও একটা মিষ্ট লালিত্য আছে | তার সাথে আছে একটা মিষ্টি স্বভাব | খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে পুস্প |
বাড়িতে একমাত্র কুসুমই পুষ্পকে পছন্দ করতো না | তার কোথাও মনে হতো, পুষ্প তার ভাগের সব ভালোবাসা টুকু কেড়ে নিয়ে নিচ্ছে | বাড়িতে বাবা দুই বোনের জন্য শাড়ী পছন্দ করে নিয়ে আসলে পুষ্পর জন্য আনা শাড়িটাই পছন্দ হতো কুসুমের, সে শাড়ির দাম যতই পুষ্পর শাড়ির দামের চেয়ে বেশি হোক না কেন | পুষ্পর খেলনা পুতুলগুলো পর্যন্ত ইচ্ছে করে নষ্ট করে দিয়ে বলত, " আমি জানিনা পুষ্পর খেলনা কোথায় ?? "
বাবা মায়ের সব টুকু ভালোবাসা পাওয়ার চাহিদা থেকেই নিজের মনের অন্দরমহলে এক বিশেষ কুঠুরিতে পুষ্পর জন্য সে ঘৃণা পুষে রেখেছিলো | সেই ঈর্ষা কখন যে নিজের অজান্তেই দাবদাহে পরিণত হোলো, তা সে জানতেও পারলো না | পুষ্পকে কুসুম সহ্যই করতে পারে না, কিন্তু নিজের চেহারায় সে তার হিংসাত্মক প্রতিফলন কখনো ফুটিয়ে তোলেনি | মনের অবচেতনে পুষ্পকে সে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে করতো | তার মনে হতো, পৃথিবীর সব ভালোটুকু শুধু পুষ্পর জন্য বরাদ্দ করেছেন ভগবান | তাই পুষ্পর ভাগের সব টুকু কেড়ে নেওয়ার তীব্র অভিলাষা মনের গভীরে পোষণ করে রাখতো সে | কত সময় গেছে, পুষ্পর বই খাতা পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছে, পুষ্পর আঁকা কত ছবিতে রঙ ঢেলে সেই ছবি নষ্ট করে দিয়েছে | পুষ্প সব বুঝতো, কিন্তু তার প্রতি তার বড়ো বোনের এই তীব্র হিংসের কথা সে কাউকে জানতে দেয়নি |
এইভাবে বাল্যকাল, কৈশোর কাটিয়ে দুই বোন যৌবনে পা দিলো | কুসুম কলেজ পাশ করেই লেখাপড়া থামিয়ে দিলো | কিন্তু পুষ্প মাকে জানালো, "আমি আরও বেশি পড়াশোনা করবো মা | আমি এখানেই থামবো না | "
কিন্তু এরই মধ্যে পুষ্পর জন্য এক সম্বন্ধ এল | পাত্র অনিমেষ পেশায় ডাক্তার, কোনো এক আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে মার্জিত, ভদ্র পুষ্পকে দেখে ভালো লেগেছিলো তার | তাই মাকে দিয়ে পুষ্পর সাথে তার বিয়ের কথা পাড়তে পাঠিয়েছিল |
কিন্তু পুষ্প জানতো, তার দিদি কুসুম এই বিয়ে কিছুতেই মানতে পারবে না | বড়ো বোনের সম্বন্ধ না এসে ছোট বোনের সম্বন্ধ আসলে এমনিই সমাজে দশ কথা হয় | তার উপরে কুসুম যে ভীষণ ঈর্ষাকাতর, সেটাও জানা পুষ্পর | ছেলেবেলায় তার প্রিয় পুতুল, তার প্রিয় বই, প্রিয় জামা কাপড় যেমন করে কেড়ে নিত কুসুম, আর কেড়ে নিতে না পারলে নষ্ট করে দিতো, এক্ষেত্রেও সেরকমই কিছু করবে | তার চাইতে অনিমেষের সাথে মনে বাঁধা পড়ার চেয়ে পিছনে সরে এসে কুসুমকে জায়গা করে দিলো সে |
অনিমেষ পুষ্পকে জিজ্ঞেস করেছিল, "কুসুম তো আমার পছন্দ নয়, তবে কুসুমকে কেন আমার স্ত্রী বানাতে চাইছেন আপনি ?? "
পুষ্প বলেছিল, "আমার দিদির মনের অন্দরমহলের খোঁজ আমার চেয়ে বেশি কেউ রাখে না | আমি জানি, আপনি আমার দিদিরই বেশি পছন্দের | আর আমি এখন আপনাকে কেন, কাউকেই বিয়ে করতে পারবো না | আমি এখনও অনেকটা পড়াশোনা করবো, তারপরে চাকরি পাবো, তার পরে বিয়ের জন্য ভাববো | "
এর পরে অবশ্য আর কথা এগোয়নি এই ব্যাপারে | অনিমেষ আর কুসুমের বিয়ে হয়ে গেলো বিনা বাধায় | কুসুম এবারও খুব খুশি | সে প্রতিবারের মতো এবারও পুষ্পর পছন্দের মানুষটাকে কেড়ে নিতে পেরেছে |
পুষ্প দিদির বিয়ের পরে বাইরে পড়তে চলে গেলো | তার সামনে তখন বিস্তর পথ পেরোনো বাকি | এদিকে অনিমেষের সাথে সুন্দর গুছিয়ে সংসার করছে কুসুম, তবুও মনের অন্তরালে একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি মারে, "পুষ্প কী অনিমেষের সাথে ঘর বাঁধার চেয়েও ভালো কিছুর সন্ধান পেয়েছে ?? নাহলে এতো হেলায় অনিমেষকে সে প্রত্যাখ্যান করলো কী করে ?? "
অনিমেষকেও সে বার কয়েক প্রশ্ন করেছে, "পুষ্পকে বিয়ে করতে চেয়ে আমায় বিয়ে করে সুখ পেয়েছো তুমি ?? পুষ্পকে না পেয়ে আমায় বিয়ে করলে কেন?? আমাকে তো নাও বিয়ে করতে পারতে?? "
অনিমেষের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন ছিল | তার মনে যে পুষ্পই জায়গা করে নিয়েছিল বেশি, সেটা কাউকেই সে বলতে পারেনি | শুধু স্ত্রীর মন রাখার জন্য প্রতিবারই তার জবাব হতো, "বিয়ের জন্য একটি মেয়ের দরকার ছিল আমার, সেটা তুমি, পুষ্প বা অন্য কেউও হতে পারতো | পুষ্পকে দেখে ভালো লেগেছিলো বলে এই নয় যে, পুষ্পকে বিয়ে করতে না পারলে আমি মরে যেতাম | পুষ্প নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিল অনেক বেশি, সেখানে তোমার বাবা মা তোমার বিয়ের জন্য তৎপর ছিলেন, তাই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম | এর পিছনে আর কোনো কারণ খুঁজতে গেলে তোমারই অযথা সময় নষ্ট হবে | "
অনিমেষকে খুব বেশি কিছু আর বলত না কুসুম | কারণ, রাসভারী অনিমেষ কুসুমকে না চাইতেই অনেক সুখ দিয়েছে | শুধু তার উপরে স্ত্রীয়ের কর্তৃত্বটাকে সে কোনোদিন আস্কারা দেয়নি | তাই, অনিমেষের দেওয়া এই সুখ, প্রাচুর্য, আর সামাজিক সম্মানটাকে পাওয়ার জন্যই কুসুম তার মনের ঈর্ষাটাকে দাবিয়ে রেখে দিতো |
এর মধ্যে বিয়ের প্রায় বছর তিন পার হয়ে গেছে কুসুমের | বর্তমানে সে সন্তানসম্ভবা | কিন্তু সন্তান ধারণের প্রথম দিক থেকেই সে শারীরিক ভাবে ভীষণ দুর্বল | তার জন্য ভালো পুথি, পথ্য সব কিছুরই ব্যবস্থা করলো অনিমেষ | কিন্তু ছেলে প্রসবের সময় কুসুমের এক দিকের অঙ্গ অসাড় হয়ে গেলো |
ততদিনে পুষ্প লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য প্রস্তুত করছে নিজেকে | এই অবস্থায় অনিমেষ ঠিক করলো, তার ছেলের দেখাশোনার জন্য আয়ার ব্যবস্থা করবে | কিন্তু বাধ সাধলেন কুসুম, পুষ্পর মা কামিনী দেবী | তিনি বললেন, "নিজের মাসি থাকতে কেন আমার নাতি বাইরের লোকের কাছে মানুষ হবে ?? আমার নাতির দেখভাল পুষ্পই করবে | "
অনিমেষ বলল, "তা হয় না মা | পুষ্পর নিজের একটা জীবন আছে | আমার আর কুসুমের সন্তানের জন্য পুষ্প কেন তার জীবন নষ্ট করবে ?? পুষ্প সবে লেখাপড়া শেষ করেছে | এবার সে চাকরি করবে, তারপরে তার নিজের একটা বিবাহিত জীবন থাকবে | আমাদের সন্তানকে মানুষ করতে গেলে তো ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে !! কত স্বপ্ন আছে ওর চোখে !! "
কুসুম তার গভীর মনের ইশারা পেলো | সেই অন্তরালের অন্দর থেকে কেউ যেন কুসুমকে বলে উঠল, "এবার পুষ্পর সুখ ই সুখ | পুষ্প চাকরি করে সাবলম্বী হবে, তারপরে অনিমেষের থেকেও বেশি ভালো কাউকে বিয়ে করে তোর চেয়েও বেশি সুখে থাকবে | পুষ্পকে এক্ষুনি থামা | দিয়ে দে নিজের ছেলেকে পুষ্পর কোলে | "
মনের আওয়াজ পেতেই কুসুম তার স্বামীকে বলল, "তাতে কী হয়েছে ?? পুষ্প আমার ছেলের জন্য এটুকু ত্যাগ করতে পারবে না ?? নিজের মাসি থাকতে কেন আমার ছেলে বাইরের লোকের কাছে বড়ো হবে ?? "
তারপরে পুষ্পর হাত দুটো ধরে বলে, "আমার ছেলেটার মা হবি না তুই ?? নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমার ছেলেটাকে ফেলে দিবি তুই ?? নিজের ছেলে বলে কোলে টেনে নিবি না বোন ?? "
পুষ্প মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারে, তার দিদির এখানেও কোনো চাল আছে | কিন্তু সেই চালের কুলকিনারা সে করতে পারে না | আর তাছাড়া সত্যিই তো, ওইটুকু ছেলের মুখের দিকে তাকালে তখন মায়ায় পড়েই যেতে হয় |
তাই সে তার দিদি আর জামাইবাবুকে বলল, " আমার কোনো আপত্তি নেই অনিকেতকে মানুষ করায় | কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে, অনিকেত আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকবে, এই বাড়িতে নয় | মাঝেসাঝে এখানে বেড়াতে আসবে মাত্র, বাকি সময় আমার সাথে আমার বাড়িতেই থাকবে | "
অনিমেষ প্রথমে আপত্তি করেছিল পুষ্পর এমন শর্তে, কিন্তু পরে সেই শর্ত সে মেনে নেয় | কারণ, পুষ্প অনিমেষকে বুঝিয়ে ছিল, "আপনাদের বাড়িতে থাকলে আমার দিদি আমাকে আর আপনাকে নিয়ে কুৎসিত সম্পর্কের চিন্তা করতে পারে, যেটা আমি মেনে নিতে পারবো না, আমার আত্মসম্মানে লাগবে | তার চাইতে আমার সাথে আলাদাই থাকুক অনিকেত | আপনি বরং দিদির চিকিৎসায় মন দিন | অনিকেতকে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, ওর জন্য আমি আছি | "
তারপরে আগামী পাঁচ বছর মাতৃস্নেহ দিয়ে অনিকেতকে বড়ো করে তুলেছে পুষ্প | নিজের চাকরি জীবন, সংসার জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে সে এই পাঁচ বছরে অনিকেতের মা হয়ে উঠেছে |
নিজের বাড়ি, নিজের বাবা, নিজের মায়ের প্রতি কোনো টানই নেই অনিকেতের | সে তার জীবনে পুষ্পকে ছাড়া কিছু বোঝেই না | অনিমেষকে যদিও বাবা বলে ডাকে মাঝেসাঝে, কুসুমকে তো কোনোদিনই মা বলে ডাকে না সে | পুষ্প অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনিকেতকে, তার আসল মা কে, কিন্তু শিশু মন ভালোবাসার দাঁড়িপাল্লায় বরাবর পুষ্পর ভালোবাসার ওজনই পেয়েছে বেশি, তাই তার কাছে পুষ্পই তার আসল মা, তার গোটা পৃথিবী |
এদিকে, অনিমেষের নিরলস প্রচেষ্টায় কুসুম আস্তে আস্তে তার শরীরে জান ফিরে পায় | তার অসাড় শরীরে আবার সঞ্চালনের সৃষ্টি হয়, সে একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করে |
এবার তার মনের মধ্যে নতুন উঁকি, "আমার ছেলে আমায় মা না ডেকে পুষ্পকে কেন মা বলে ডাকবে??
যে মানুষটা ছোটবেলা থেকেই ছোট বোনের ভাগের সব টুকু ছল করে কেড়ে নিয়েছে, সে আজ কী করে নিজের ভাগের মাতৃত্ব দিয়ে দেবে পুষ্পকে !!
তাই সে জেহাদ ঘোষণা করলো | সুস্থ হয়েই পুষ্পর বুক থেকে কেড়ে নিলো অনিকেতকে | ছোট্ট অনিকেত খুব কাঁদলো, খুব বায়না করলো তার যশোদা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য, কিন্তু কুসুমের মন ভিজলো না |
অনিমেষ বোঝানোর চেষ্টা করলো নিজের স্ত্রীকে, "যে শিশুটি জ্ঞান হবার অনেক আগে থেকেই পুষ্পর ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে, তাকে এভাবে হঠাৎ করে কেড়ে নিয়ে আসা যায় না !! এটা অনিকেত ও পুষ্প দুজনের কাছেই শাস্তি স্বরূপ !! "
কিন্তু কুসুম তো শাস্তিই দিতে চায় পুষ্পকে | সে চায়, পুষ্প কষ্ট পাক অনিকেতকে হারিয়ে | পুষ্পর প্রাণের সব কিছু কেড়ে না নিলে যে তার মন কিছুতেই মানবে না !! এ কথা সে অনিমেষকে বোঝায় কী করে !!
অনিকেতকে কুসুম বলপূর্বক নিয়ে তো আসলো নিজের কাছে, কিন্তু নিজের করতে পারলো না কিছুতেই | অনিকেত শুধু তার মা মানে পুষ্পমাকে খুঁজে বেড়ায় | পুষ্পর প্রতি অনিকেতের এই আকুলতা আরও যেন হিংস্র আর ক্রুদ্ধ করে তোলে কুসুমকে |
সেই ক্রোধে অন্ধ হয়ে একদিন নিজের সন্তানের গলাতেই বিষ ঢেলে দেয় কুসুম | দুধের সাথে ইঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেয় সে অনিকেতকে |
অনিমেষ আর তার শ্বশুরবাড়িতে খবর পৌঁছায়, অনিকেত অসুস্থ, দুধ খাওয়ার পরেই সে বমি করতে করতে নেতিয়ে পড়েছে | খবরটা দিয়েছে স্বয়ং পুষ্প | সে সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিল কাকতালীয় ভাবে |
সে তার দিদির স্বভাব জানে | পুষ্পর সাথে ঈর্ষা করতে গিয়ে সে যে নিজের সন্তানেরও ক্ষতি করতে পারে, সে কথা পুষ্পর জানা আছে | আর তাছাড়া, সে এ বাড়িতে আসার পরে দেখেছে, কুসুমের হাতে দুধ খাওয়ার পরেই অনিকেত নেতিয়ে যায়
বাড়ি শুদ্ধ লোক যখন চেপে ধরে কুসুমকে, অনিমেষ যখন পুলিশে খবর দিতে উদ্যত হয়, তখন স্বামী অনিমেষের কাছে একা ঘরে কুসুম স্বীকার করে তার অপরাধের কথা | পুষ্পর প্রতি তার ঈর্ষা এমন ভয়ঙ্কর যে, নিজের সন্তানকে হত্যা করতেও তার মন কাঁপেনি এতটুকুও | পুষ্পকে দুঃখ দিতে গিয়ে অনিকেতকেই পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো তার মন !!
স্বামীর পায়ে ধরে বলেছিল কুসুম, "দোহাই তোমার, আমাকে পুলিশে দিও না যেন !! এ লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকবো কী করে ?? "
অনিমেষ ছেলের চিকিৎসা শুরু করে | দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে অনিকেতের জ্ঞান ফেরে | এ যাত্রায় সে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়, কারণ, তার দুধ খাওয়ার সময়েই পুষ্প এসে হাজির হয়েছিল তার কাছে |
কুসুম তাকে মারধোর করতো বলে ভয়ে ভয়ে দুধের গ্লাসটা মুখে দিলেও দু তিন ঢোক গেলার পরেই পুষ্পকে দেখে সে দুধের গ্লাস ফেলে দিয়ে দৌড় লাগায় তার আসল মায়ের কাছে | পুষ্প যে তার পরিত্রাতা !! কিন্তু সত্যিই যে সেই সময় পুষ্প অনিকেতের পরিত্রাতা হয়ে এসেছিলো, সে একমাত্র ঈশ্বরই জানতেন |
অনিমেষ কাউকে কুসুমের সত্যিটা জানালো না | সমাজ সংসারে এমন খবর ছড়িয়ে গেলে "মা" শব্দটার উপর থেকেই যে ভরসা উঠে যাবে সবার !! তার চাইতে কুসুমের অপরাধ চেপে রাখাই সঠিক বলে মনে করলো অনিমেষ |
কিন্তু কুসুমকে শাস্তি দেওয়া থেকে সে বিরত রইল না | কুসুমকে সে কাশীর টিকিট কেটে দিয়ে বলল, "তুমি এখন থেকে কাশীতে গিয়ে থাকবে | লোকে জানবে তুমি হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছো | প্রত্যেক মাসের প্রথম তারিখে তোমার নামে টাকা পৌঁছে যাবে | কিন্তু তুমি কোনোদিন আর এই সংসারে ফিরে আসবে না | অনিকেতের তুমি কেউ হও না | তোমার ছায়াও যেন অনিকেতের ত্রিসীমানা স্পর্শ না করে | আমার কথার অন্যথা যদি করেছো, তবে জেলের ভাত খাওয়ার জন্য তৈরী থাকবে | আজ থেকে তুমি আমার আর আমার ছেলের কেউ নও | "
কুসুম কেঁদে ভাসালো অনিমেষের পা ধরে, কিন্তু অনিমেষ তার সিদ্ধান্তে অটল | সে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে কুসুমকে, " তুমি সংসারে থাকার জন্য, স্ত্রী, মা হবার জন্য উপযুক্ত নও | আমি আমার সন্তানের হত্যাকারীর সাথে ঘর করতে পারবো না | আর তোমার সাথে অনিকেতকেও থাকতে দেবো না এক মুহূর্ত | তুমি ওর জন্য বিষধরী নাগিন ছাড়া আর কিছুই নও | "
কাশী যাবার আগের দিন রাত্রে কুসুম গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলো | মৃত্যুর ফাঁস গলায় জড়ানোর আগে সে অনিমেষকে লিখে গেলো ছোট্ট একটা চিঠি,
প্রিয়তমেষু,
জানি, এমন সম্মোধন আমার মতো অপরাধীর কাছে তুমি আশা করো না | তবুও আজ চলে যাবার আগে তোমায় কিছু কথা বলে যেতে চাই | ছোট বেলা থেকেই ভগবান আমাকেই সবকিছু বেশি দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন, পুষ্পর চাইতেও অনেক কিছু বেশি ছিল আমার | সেই বেশির মধ্যে একটি বেশি ছিল পুষ্পর প্রতি আমার ঈর্ষা | আমার ঈর্ষাকাতর মন কখনো আমার ছোট বোনকে মেনে নেয়নি | আমার মনে হয়েছিল, পুষ্প আমার ছোট বোন হয়ে এসেছে আমার ভাগের সব টুকু কেড়ে নিতে | তাই ওর কেড়ে নেওয়ার আগেই আমিই ওর সব কিছু কেড়ে নিতাম, কেড়ে নিতে না পারলে নষ্ট করে দিতাম |
আমার মনের সেই তাড়না আজও একই রকম আছে | আমার মন মানতেই চায়না পুষ্পর সুখ, তাকে কষ্ট দেওয়াই আমার মনের কাজ | তাই তো পুষ্পকে কষ্ট দিতেই আজ অনিকেতের মুখে বিষ ঢালতে আমার হাত কাঁপেনি | আমি এমনই পাষন্ড !!
তুমি ঠিকই বলেছো, আমার মতো নাগিন অনিকেতের জীবনে না থাকাই ভালো | এমন নাগিনকে স্থানান্তরিত করে কী লাভ বলো ?? এ নাগিন বেঁচে থাকলেই যে নিজের অজান্তেই বিষ ঢালতে ছুটে আসবে তোমাদের জীবনে | এই নাগিনের মন যে বাঁধন ছাড়া, সম্পর্ক ছাড়া, গরলে পরিপূর্ণ !!
তাই, এই বিষাক্ত মন নিয়ে চললাম অনন্তের সন্ধানে | পুষ্পকে বোলো, অনিকেতের সত্যিকারের মা যেন সে হয় | মাসি নয়, তোমার বিবাহিতা স্ত্রী, আর অনিকেতের মা হয়ে সে যেন আমার উপরে কৃপা করে | সে যদি তোমায় বিয়ে করে, তবে জানবো, পুষ্প তার দিদির অপরাধ মাফ করেছে | পুষ্পকে বোলো, ছেলেবেলার তার সেই পছন্দের পুতুল, বই, জামাকাপড় ফেরত দিতে না পারলেও, বড়ো বেলায় তার অনিমেষ আর অনিকেতকে আমি তার কাছে ফেরত দিয়ে গেলাম | সে যেন তোমাদের গ্রহণ করে তার জীবনে |
তোমরা সবাই ভালো থেকো, আনন্দে থেকো | আমি চললাম আমার এই বিষ মন নিয়ে | মন যে মানে না তোমাদের ছেড়ে যেতে, তবুও বিদায় ....
ইতি --
তোমার অপরাধী স্ত্রী
কুসুম "
বিশাল ঘরের মধ্যে ঝুলন্ত কুসুমের শরীরের সামনে কুসুমের চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে অনিমেষ, পুষ্প আর সাথে বাড়ির অন্যান্যরা |
এ কেমন মনের অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়েছিল কুসুম, যে, তার শেষ পরিণতি এমন হতে হোলো !! উত্তর নেই কারোর কাছেই, তবুও নিস্তব্ধ ঘরে উত্তর খুঁজে চলেছে সবাই .......
----------------------------------------------------------------
সমাপ্ত