কাঠের ঘোড়া
কাঠের ঘোড়া
- দাদা ওদিকে যাবেন না , পুলিশে হেব্বি ক্যালাচ্ছে......
বাইকটার গতি কমিয়ে কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল একটা বছর কুড়ির তরুন । আমি থমকে গেলাম । আচ্ছা জ্বালাতনে পড়া গেল দেখছি ! গতকাল একটা কাজ নিয়ে বেলডাঙা এসেছিলাম । হঠাৎ করে যে এভাবে দ্বিতীয় বারের জন্য লকডাউন চালু হবে তা আন্দাজ করতে পারিনি । গতকাল কাজ সারতে সারতে রাত হয়ে গেল । বাড়ি ফেরার জন্য কোন টানা যানবাহন পেলাম না । রাত্রিবেলায় কেটে কেটে আসার রিস্ক নিলাম না । খুব ভোর ভোর বেরোলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ভেবে নিয়ে সেখানেই এক বন্ধুর মেসে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম । তারপর ভোরে উঠে রাস্তায় এসে বুঝলাম কি ভুলটাই না করেছি ! একটা পোল্ট্রি মুরগীর গাড়ী পাকড়াও করে বহরমপুর ঢোকার মুখে ভাকুড়ী মোড় পর্যন্ত এসেছি । রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান । রাস্তার ধারে একটা অর্ধেক ঝাঁপ নামানো চায়ের দোকানে চা বিস্কুট খেতে খেতেই রঘুনাথগজ্ঞে আমার পাশের বাড়ির এক বন্ধুকে ফোন করে বাইকটা আনতে বললাম । সে জানালো এইবেলা আসতে পারবেনা , বিকেলে আসবে । আমি বললাম -
- এতক্ষন আমি কি করব?
- স্বর্নময়ীতেই তো আমার ছোট মাসীর বাড়ি , ওখানে চলে যা আমি ফোন করে দিচ্ছি আর তোকেও মেসোর ফোন নম্বরটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি ।
অসহায়ভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি-টাড়ি পাওয়া যায় কিনা !
- আর এক কাজ করতে পারিস ডাক্তারখানা তো খোলা আছে , একটা ডাক্তার দেখিয়ে নিতে পারিস । হাতে প্রেসক্রিপশন থাকলে রাস্তায় পুলিশে ধরলেও কিছু বলবেনা ।
বিরক্তিতে মাথাটা চিড়বিড় করে উঠল । দাঁত চিবিয়ে ক'টা গালি দিলাম ওকে । ও হেসে বলল -
- ঠিক আছে তোকে ডাক্তার দেখাতে হবেনা , আমি হাতের পাঁচ আমার প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে যাচ্ছি । তুই মাসীর বাড়ি চলে যা তোকে ওখান থেকেই তুলব ।
ফোনটা কেটে দিয়ে কি করব ভাবতে ভাবতে তালবাগানের ভিতর দিয়ে স্বর্ণময়ীর উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম । ভেবেছিলাম ভিতরের রাস্তায় পুলিশ থাকবেনা , কিন্তু তার মাঝেই এই বিপত্তি !
কয়েকজন দৌড়ে এদিকে আসছে দেখে আমিও দৌড়ে একটা পকেট গলিতে ঢুকে পড়লাম । দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক একটা বাড়ির দরজা থেকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । কাছাকাছি যেতেই দরজাটা পুরোটা খুলে দিয়ে বললেন -
- আসুন আসুন ভিতরে আসুন ...
মনে হলো আমার শ্বশুর তার একমাত্র জামাইকে ডাকছেন । আমি থমকে দাঁড়াতেই তিনি বললেন-
- আমাদের কিন্তু করোনার দু'টো ডোজই নেওয়া আছে.... অসুবিধা নেই চলে আসতে পারেন । পুলিশ কিন্তু এখনই যাবেনা ।
আমি মুখে মাস্ক পরে আছি বটে কিন্তু পুলিশ যদি জিজ্ঞেস করে বাইরে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছি তাহলে কি উত্তর দেব ? আর শুনে তারাই বা কি বলবেন এই সব সাতপাঁচ ভেবে তাদের মুখোমুখি আর হতে চাইলাম না । বললাম -
- আমিও নিয়েছি ।
- ভেরী গুড ! চলে আসুন ইয়ংম্যান ।
মনে মনে ভাবলাম - মন্দ কি ! সময়টা এখানেই কাটানো যাক । আমার বন্ধুর ঐ ছোটমাসির বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা আমার এক্কেবারে ছিল না । ওর ঐ মুটকি মতোন ছোটমাসতুতো বোনের সঙ্গে আমার বিয়ের যে চেষ্টা ও আগে করেছিল তা আমার তখনই মনে পড়েছিল ।
ভাইরাসের জন্যই হয়ত ঘরে ঢুকেই হাত পা ধোয়ার ব্যবস্থা ভদ্রলোক করে রেখেছেন । আমি মাস্কটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হাত পা ধুতে শুরু করলাম । ভদ্রলোক বোধহয় ঘরে ঢুকেছেন । একটা রিনরিনে গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম ।
- বাবা তোমার এই সময় যাকে তাকে ঘরে আনতে একটুও ভয় করেনা ?
- আ...হা ছেলেটা খুব ভালো....
- তুমি চেনো ওকে ?
- চিনি না তবে এবার চিনে নেব । আরে এতোদিন মানুষদের নিয়ে কাজ করলাম । কে কি রকম মানুষ তা আমি একবার দেখলেই চিনে যায় ।
- হ্যাঁ তুমি ঐ ভাবো আর সবাই তোমাকে ঠকায় !
- তুই একটু চা-টা করে নিয়ে আয় তো মা আমরা ড্রয়িংরুমে বসছি ।
আমি রুমাল বার করে হাত মুখ মুছছিলাম , ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বললেন-
- আসুন । বসুন এখানে । আমি ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দিই ।
সিলিং ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে উনি নিজেও উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসলেন । তারপর বকবক করা শুরু করলেন । আর তার ফাঁকে ফাঁকে আমার সম্বন্ধে জেনে নিতে লাগলেন ।
ভদ্রলোকের এখানেই জন্ম । নাম অমল কর্মকার । চাকরি করতেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পদে । চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন । চাকরির মেয়াদ শেষ হলে অবসর জীবন কাটাতে এখানেই ফিরে এসেছেন ।
এই সময় কাপ প্লেটের টুং টাং আওয়াজে আমার মেরুদন্ড সোজা হয়ে ওঠে । চোখ গিয়ে পড়ে সামনের দরজার দিকে । একটা মেয়ে ট্রেতে চা বিস্কুট নিয়ে ঢোকে । চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় । আমি হাঁ করে দেখি উদাসীনতার মোটা খোলস পড়ে থাকা এক অতীব সুন্দরীকে । যেন কয়েক খন্ড কালো মেঘ ব্যর্থ হয়েছে সূর্য্যকে ঢেকে রাখতে । ঠিকরে বেরোচ্ছে আলোকদ্যুতি !
- বাবা কথা বলতে খুব ভালোবাসে , কিন্তু এই মহামারীতে সে উপায় হচ্ছেনা বলে রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই জ্বালাচ্ছে ।
অমলবাবু হো হো করে হেসে উঠলে আমার ঘোর ভাঙ্গে । মেয়েটা আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল বলে মনে হওয়ায় উত্তর দিতে গিয়ে দেখি সে ততক্ষনে প্রায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ।
অমলবাবু বললেন-
- বনানী চলে গেলি মা ? আয় আমার পাশে বসলে একটু বস ।
- ঠিক আছে বাবা । আমি পাশের ঘরে আছি । কিছু দরকার হলে বোলো ।
মেয়েটা আমার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ।
- আমার মেয়ে ।
- ও...
- ওর মায়ের মারা যাওয়া এই... তিনবছর হলো ।
বুঝতে পারলাম অমলবাবু তার মেয়ে বনানীর সম্বন্ধে কিছু বলবেন , যা শোনার জন্য মনে মনে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছি ; তাই কিছু বলে আর তার কথা বলায় ব্যাঘাত ঘটালাম না ।
বনানীর বিয়ে হয়েছিল এক ইন্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে । একবার একটি পাওয়ার হাউস পরিদর্শনের সময় শট-সার্কিট লেগে আগুন ধরে যায় । আর তাতেই ছেলেটা মারা যায় ।
****************"*************
এখন প্রায় সন্ধ্যে । দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে ঘুমটাও হয়েছে খাসা । আমার বন্ধু আমার ভাবনা মতোই আজকে আমাকে নিতে আসেনি । কাল আসবে বলে জানিয়েছে । তবে আমি যে তার ছোটমাসির বাড়ি না ওঠে এক অপরিচিতর বাড়ি আছি তাতে খুব উদ্বেগ প্রকাশ করছিল । ওর মেসোরও দু'বার ফোন করা হয়ে গেল । প্রথমবারে কোথায় আছি তাই জেনে নিয়েছিলেন । দ্বিতীয়বারের ফোনটাতেই আমার ঘুমটা ভাঙল । তিনি যা জানালেন তা কিভাবে নেব সেটাই ভেবে পাচ্ছিনা ।
অমলবাবু আমাকে মিথ্যে কথা বলেছেন ।
বনানী যথার্থই সুন্দরী । কলেজে পড়ার সময় অনেক ছেলেই তাকে পাবার জন্য লাইন দিয়ে থাকত । কিন্তু বনানীর পছন্দ ছিল এক মাস্তান ছেলেকে । লুকিয়ে ওরা মন্দিরে বিয়েও করেছিল বলে শোনা যায় । অমলবাবু গোবেচারা টাইপ মানুষ । এক ইন্জিনিয়ার ছেলে তার ভয়কে কাজে লাগিয়ে বনানীর ইচ্ছা না থাকলেও বনানীর ফাইনাল পরীক্ষার আগে বিয়ে করে নিয়ে ফুরুৎ । এদিকে মাস্তান ছেলেটা হন্যে হয়ে খুঁজে বনানীদের প্রায় তিন বছর পর খুঁজে পায় । এক পাওয়ার হাউসের ভিতরে বনানীর স্বামীকে খুন করে । ওখানকার লোকে ওকে ধরে পুলিশে দেয় । এখন ও জেলে খাটছে ।
আমাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝানো হয় বনানী ভালো মেয়ে নয় , আমি যেন এখানে না থেকে তাঁদের বাড়ি যায় ।
আমি নিজের মতো করে গোটা ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখি । বনানীর মতো শিক্ষিতা একজন এখনকার মেয়েকে ওর বাবা জোর করে একবার বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও আবার বিয়ে দেবেন এটা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না । হয়তো মাস্তান ছেলেটাই বনানীকে জোর করত । সেই রটিয়ে ছিল বিয়ের গুজবটা । আর অমলবাবুকেও খুব একটা দোষী বলে মনে হয় না । একটা বাবা তার মেয়ের হতভাগ্যের কথা কি করেই বা বলবে !
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ডাইনিং-এ বাবা মেয়েতে গল্প করছে । আমাকে দেখে কথা থামিয়ে অমলবাবু বললেন -
- আরে আসুন ইয়ংম্যান এতো ঘুমালে হবে ? ভুঁড়ি বেড়ে যাবে যে !
- না আসলে কাল রাতে ভালো ঘুম........
- বাবা আমি তোমাদের জন্য চা করে আনছি ।
বলে উঠে চলে গেল বনানী । আগের মতোই আমার দিকে একবারও তাকাল না । ওর এই উপেক্ষাতে আমি একটু মিইয়ে গেলাম । আবার ভাবলাম ওর এই উপেক্ষা ছিপ দিয়ে যারা মাছ ধরে সেসব দক্ষ মাছশিকারীদের মতো নয় তো !
- বসুন ।
আমি বসলে উনি উনার মুখটা আমার কাছাকাছি এনে বললেন-
- দেখুন কার যে কাকে কখন ভালো লেগে যায় তা আমরা কেউ জানিনা । আজকের সকালবেলাতেও না আপনি আমাদের চিনতেন না আমরা আপনাকে । কয়েকঘন্টা আলাপে আপনাকে আমাদের ভালো লেগে গেল তাই থেকে যেতে জোর করলাম । আর আশা করি আপনারও আমাদের ভালো লেগেছে বলেই আপনার বন্ধুর মাসির বাড়ি না গিয়ে আমাদের এখানে থেকে গেলেন ।
- হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই অবশ্যই ।
- আপনাকে একটা গোপন কথা না বলে পারছিনা......
- হ্যাঁ বলুন না..
গোপন কথা শোনার ভঙ্গিতে কান খাড়া করলাম ।
- আমরা একটা টাইম মেশিন পেয়েছি ।
আমি তো শুনে অবাক । ভাবলাম তিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা বলবেন আর আমি একটু ভাব নেব । তাতো নয় শেষে কিনা টাইম মেশিন ! ঘরবন্দী থেকে থেকে এদের মাথাটা গেছে । নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম । অমলবাবু কিন্তু উৎসাহ হারালেন না ।
- আমার একটু মর্নিং ওয়াক করা অভ্যাস আছে বুঝলেন । গতবছর লকডাউনের ঠিক এই সময় মাস্ক টাস্ক পরে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে প্রতিদিনের মতো একটু অন্ধকার থাকতেই আমি বেরিয়ে ছিলাম । বাড়ি ঢোকার মুখে মনে হলো আমার বাড়ির গলি থেকে একজন অপরিচিত লোক বেরিয়ে গেল । লোকটার গায়ের পোশাক একটু অন্যরকম মনে হলো । যেন ঠিক এই সময়ের নয় । বেলা ন'টার সময় মোড়ের কাছে মুদিখানার দোকানে কয়েকটা জিনিস কিনতে গিয়ে শুনলাম একটা অপরিচিত লোক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিল , আর ওর মুখে মাস্কও ছিল না বলে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে । আমার কেমন সন্দেহ হলো । বাড়ি ফিরেই গলি দিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেলাম । ওদিকে খুব একটা কেউ যাওয়া আসা করেনা । ওখানটায় বেশ খানিকটা রেলের ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে আর তারপরেই রেললাইন । ঐ ফাঁকা জায়গাটায় একটা অদ্ভুত ধরনের জিনিস দেখতে পেলাম । বেশ বড়ো স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ কাঁচের গোলক । তিনটে স্ট্যান্ডের সাহায্যে জিনিসটা দাঁড় করানো আছে । ভিতরে একটা চেয়ার , আর অনেক কিছু যন্ত্রাংশ । আমি আমার মেয়েকে খিড়কির দরজা খুলে জিনিসটা দেখাই । ভালো করে দেখে ঐ মত দেয় যে ওটা টাইম মেশিন ।
এতদূর শোনার পর আমার মনে উৎসাহের সৃষ্টি হয় । বলি-
- তারপর ওটা নিয়ে কি করলেন?
- মাস্ক না পরার অপরাধে ঐ বেচারি কে যে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে তা আমি বুঝতে পারি । ও আর কি করে জানবে যে আমাদের পৃথিবী এখন একটা ভাইরাসের মোকাবিলায় নাজেহাল ! জিনিসটা দেখে পাড়ার কোন ছেলে যদি নষ্ট করে দেয় ভেবে বাবা মেয়ে মিলে জিনিসটাকে খিড়কীর দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসি ।
- সে লোকটা আর আসেনি ?
- নাঃ আমরা টানা প্রায় একসপ্তাহ দোতলার বারান্দা থেকে নজর রেখেছিলাম কিন্তু সেরকম কাউকেই দেখতে পাইনি । আমার মনে হয় লোকটার কথাবার্তা শুনে পুলিশের সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ওকে আর ছাড়েনি ।
- কিংবা ছেড়ে দিলেও হয়তো এই জায়গাটা আর চিনতে পারেনি ।
কখন যে বনানী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি । কথাটা সেই বলল ।
টেবিলে চা রাখলে অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে চা খেতে শুরু করি । আমি বললাম -
- জিনিসটা চালিয়ে দেখেছেন ?
- নাঃ সে সাহস হয়নি । গত একবছর অনেক পড়াশুনা করেছি , ইউটিউব দেখেছি । তাতে বুঝতে পেরেছি টাইম মেশিন বানানো অসম্ভব নয় ।
- কিভাবে ?
চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে অমলবাবু বললেন -
- থিওরি অফ রিলেটিভিটি , ওয়ার্ম হোল থিওরি থেকে শুরু করে অনেক রকম মতবাদ আছে । আমি আমার মতো করে বুঝিয়ে বলছি । এই যে মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে দেখছেন এটাকে বন্ধ না করে আপনি কি অবস্থায় থাকলে ফ্যানটাকে গতিহীন বলে মনে হবে ?
একটু ভেবে নিয়ে বললাম-
- আমিও যদি ফ্যানের গতিতে ঘুরতে থাকি ।
- বাঃ দারুন বুদ্ধি আছে তো আপনার !
বেশ একটু গর্ব গর্ব ফিলিংস নিয়ে আড়চোখে বনানীর দিকে একবার তাকালাম । বনানী মুখে একটু হালকা হাসি নিয়ে একটা চেয়ারের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ।
- আরেকটা ক্ষেত্রে এটা হতে পারে যদি সময়টাকে খুব স্লো করে প্রায় থমকে দেওয়া যায় ।
- মানে!
চমকে উঠে প্রশ্ন করলাম আমি ।
- আচ্ছা আমরা ক্যামেরা দিয়ে যে ভিডিও তুলি তাতে এফপিএস বলে একটা জিনিস আছে সে সম্বন্ধে আপনার ধারনা আছে ?
- হ্যাঁ ফ্রেম পার সেকেন্ড ।
- ভেরি গুড । এক সেকেন্ড ভিডিওতে চব্বিশ থেকে ত্রিশটা ইমেজ লাগে । যাদের স্লো মোশন ভিডিও দরকার তারা হয়তো একশোটা ইমেজ কাজে লাগায় । এখন দেখুন সলিড বলে তো কোনো জিনিস হয়না..........
- মানে?
- মানে আমরা যাকে সলিড বলে মনে করি তাকে তো আমরা ভাঙতে পারি । একসময় মনে করা হতো সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা অণু । তারপর আমরা জানলাম পরমাণুর কথা । যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রায় সবটাই ফাঁকা । পদার্থের মূল ভর থাকে নিউক্লিয়াসে । খুব ছোট্ট জায়গায় । এখন তো কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা চলছে । এতে.....
- আমার মোটামাথায় অতকিছু ঢুকবেনা।
উনাকে থামিয়ে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললাম আমি । উনারা দুজনেই হেসে উঠলেন ।
p>
- আচ্ছা আচ্ছা সহজ করে বলছি । পদার্থকে ভেঙে যেমন বিশাল এক শূণ্যতা পাচ্ছি তেমন সময়কে ভেঙে শূণ্যতা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয় । যে শূণ্যতা দিয়ে কোন যানকে সেরকম গতি দিতে পারলে আমরা অতীত বা বর্তমানে চলে যেতে পারব । যাই হোক আর না বকে চলুন একবার দেখে আসবেন যন্ত্রটা ।
দোতলার একটা ঘরের তালা খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম । সত্যিই একটা টাইম মেশিন আছে সেখানে । উনারা নিজেরা যা বুঝেছেন তাই আমাকে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন । সব শুনে আমি ভিতরে ঢুকে মেশিন চালিয়ে দেখব বলে জোর করতে লাগলাম । উনারা দু'জনে মিলে বুঝিয়েও আমাকে নিরস্ত করতে পারল না । আসলে অনেক সময়ই বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসেই অনেক অসাধ্যসাধন করা সম্ভব হয় । অমলবাবুর চেয়ে বনানীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে মনে মনে বললাম তোমার উপেক্ষার জবাব আমি এভাবেই দেব ।
টাইম মেশিনটার ঢাকনা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম । মেশিন চালনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো শরীরে একটা বিদ্যুতের শক খেলাম । বনানীর ফ্যাকাসে মুখটা ভগ্নাংশ হতে হতে শেষে শূণ্যে মিলিয়ে গেল ।
*******************************
শরীরটা ঝিমঝিম করছে । কানটা ঝাঁপ ধরে আছে । চোখের সামনের দৃশ্যটা ঝাপসা থেকে আসতে আসতে স্পষ্ট হয়ে উঠল । পড়ন্ত বিকেলের মরা আলোয় দেখতে পেলাম একটা জংলা মতো জায়গায় এসে পড়েছি । একটু ধাতস্থ হয়ে টাইম মেশিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম । বাইরে বেরোতেই দমকা নোনা হাওয়ায় ক্ষনিকের জন্য একটু বেসামাল হয়ে পড়লাম । পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখি কিছুটা দূরে সীমাহীন জলরাশি প্রচন্ড রাগে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে । এখান থেকে সেই গর্জন শুনতে পাচ্ছি । মনে হয় আমি একটা নির্জন দ্বীপের সমুদ্র তটে এসে পড়েছি !
আমি কোথায় এসেছি কোন যুগে এসে পড়েছি তার কিছুই জানিনা । আমাকে কিছুটা সময় নিয়ে আগে বুঝতে হবে । প্রথমে কয়েকটা গাছের ডাল ভেঙে আমি যন্ত্রটা আড়াল করলাম । তারপর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কিছুটা দূরে একটা বড়ো গাছ নির্বাচন করলাম । যেখানে উঠে আমাকে পরবর্তী কাজ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
ছোট ছোট ঝোপের আড়ালে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে বড়ো গাছটার তলায় এসে পৌঁছালাম । খুব সাবধানে গাছের মগডালে চড়ে বসলাম । ততক্ষনে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন ডাক ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে । জোনাকি তার লন্ঠন জ্বেলে ইতিউতি উড়ে বেড়াচ্ছে । সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে একটা পাঁচিল ঘেরা শহর । শহরের মাঝখানে একটা সুবিশাল কাঠের ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে । তার সামান্য কিছুটা দূরে মশাল জ্বালিয়ে অনেক লোক জড়ো হয়ে আছে । ভালো করে দেখে বুঝলাম ওরা নৃত্য করছে । একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে ঢাকের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে । হঠাৎ করে আমার কাঠের ঘোড়ার একটা ইতিহাস মনে পড়ল । এটাই কি তবে 'ট্রোজান হর্স' ! আমি কি তবে ট্রয়যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতির সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি ! এক দারুণ রোমাঞ্চে আমার শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল । ঘোড়াটার পেটে কি এখনও লুকিয়ে রয়েছে গ্রিকসেনারা ! যারা রাত্রি হবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে । বাকি সৈন্যরা ফটকের বাইরে না জানি কোথায় লুকিয়ে আছে ওদের ইশারার অপেক্ষায় !
হঠাৎই মনে হলো আমার চারপাশ ঘিরে রয়েছে অনেক জোড়া চোখ ! প্রচন্ড চমকে উঠে হাত ফসকে নীচে প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম ! প্রায় প্রত্যেকটি ডালে বসে রয়েছে দশ বারোটা করে গ্রীকসেনা । তাদের কারো হাতে বল্লম , কারো হাতে তরোয়াল । আমার কাছের লোকটা একটা তরোয়াল আমার হাতে দিয়ে হিসহিসে গলায় বলল -
- শালা এবার পেচ্ছাব পেয়েছে বললে কেটে রেখে দেব ।
আমি এখন হাসিকান্নার উর্দ্ধে অবস্থান করছি । মা-বাবার মুখটা মনে পড়ছে শুধু ।
আমার চোদ্দগুষ্ঠীর ভাগ্য যে আমার পোষাকটা এদের নজরে পড়েনি ! সামান্য সন্দেহে ওরা এক সেকেন্ডও সময় নেবেনা আমার গর্দানটা কেটে ফেলতে । আমি যার বদলে এসে তরোয়ালটা হাতে নিলাম সে ফিরলে যে আমার কি হবে তা ভেবে পাচ্ছি না ! শুধু একটা জিনিসই মনে হতে লাগলো ' বাঁচবি তো পালা ' ।
খুব ধীরে ধীরে সন্তর্পনে টিকটিকির মতো শরীরটাকে নীচে নামাতে শুরু করলাম । কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা । যার হয়ে আমি প্রক্সি দিচ্ছি সে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে । গাছে উঠছে না । মনে হয় বকাটা সেও শুনেছে । একটু ইতস্তত করে ' যা আছে কপালে ' বলে আমিও নীচে নেমে এসে দাঁড়ালাম ।
সে ভদ্রলোক আবার আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল-
- ঐখানে একটা যন্তর দেখলাম ।
ওর নিশানা টাইম মেশিনটার দিকে ।
আমি তো মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেলাম । বললাম-
- তাই নাকি চল দেখি ।
- দলনেতাকে জানাতে হবে না ?
- দলনেতা এখন যেতে পারবেনা , ব্যস্ত আছে , চল আমিই যাই ।
ওকে সামনে হাঁটতে দিয়ে আমি পেছন পেছন চললাম । দু'একটা প্রাণী আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে সড়সড় শব্দ তুলে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে । আমি তরোয়ালের বাঁটটা শক্ত করে চেপে ধরলাম । টাইম মেশিনটার কাছাকাছি আসতেই সামনের লোকটার মুখটা বামহাতে চেপে ধরে মাথার পেছনে তরোয়ালের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম । মুখে একটা অস্ফুট আওয়াজ করে লোকটা পড়ে গেল ।
নিজের মনে দারুন সাহস অনুভব করলাম । চাঁদের ম্লান আলোয় লোকটার পোশাক খুলে নিয়ে নিজের গায়ে পড়ে নিলাম ।
মনে হলো আমি একটা সুযোগ পেয়েছি ইতিহাস পরিবর্তন করার । ছল-চাতুরীর সাহায্য নিয়ে যেমন যুদ্ধে জয়লাভ গ্রীকদের মানায় না , তেমন দশবছরের উপর বুক চিতিয়ে লড়াই করা ট্রোজানবীরদের সঙ্গে করা অন্যায়টাও মেনে নেওয়া যায়না ।
কি এমন সেই সুন্দরী নারী যাকে পাওয়ার জন্য দশবছরের এই লড়াই ! তাকে দেখতে পাওয়ার একটা সুযোগও যেন হাতের কাছে পেয়ে গেলাম ।
বড়ো গাছটা পেরিয়ে অনুমান করে ট্রয়নগরীর মূল ফটকের দিকে অন্ধকার সাঁতরে এগোতে লাগলাম । উদ্দেশ্য ট্রয়বাসীদের জানিয়ে দেওয়া যে ঘোড়াটা কোনো উপহার নয় , এটা গ্রীকবীর ওডিসিয়াসের নেতৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধে ব্যর্থ স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের এক ছলনামাত্র ।
প্রায়ান্ধকারে দিশাহীন ভাবে ঘুরে ঘুরে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করলাম । জংলী আগাছা ও কাঁটা জাতীয় ঝোপঝাড়ের আঘাতে আমার দুই পা রক্তাক্ত হয়ে পড়েছে । একটু দম নিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম । তখনই নজরে পড়ল কয়েকটা বড়ো গাছের উপর থেকে জ্বলে ওঠা সাংকেতিক আলো । কিছুক্ষনের মধ্যেই সমুদ্রের জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বেড়ে গিয়ে শয়ে শয়ে জাহাজ এসে তীরে ঠেকতে লাগলো । উত্তেজনায় আমি পায়ের ব্যাথা ভুলে গেলাম । গ্রীকসেনারা পিঁপড়ের দলের মতো একটা নির্দিষ্ট দিকে ছুটে চলেছে । আমি ঐ স্রোতে গা ভাসালাম । ইতিহাস আমার আর পরিবর্তন করা হলোনা । কিন্তু ফিরে যেতেও পারছিনা । এর শেষ দেখার নেশায় পেয়েছে ।
ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লাম শহরের ভিতর । ঘুমন্ত ট্রোজানদের ঘরে ঢুকে অকাতরে হত্যা করে চলেছে গ্রীকসেনারা । চারিদিকে রক্ত দেখে আমি শিউরে উঠলাম । রাজবাড়ীতে পা রাখার পূর্বেই রাজা প্রিয়মকে হত্যা করা হয়েছে । একটা সদ্যোজাত বাচ্চার নিথর দেহ পড়ে আছে রাজার কাছে । সেই যে যুবরাজ হেক্টরের সন্তান তা অনুমান করলাম ।
করিডোর দিয়ে কয়েকজন সেনা এক নারীকে ঘিরে বার করে আনছে । অসামান্য রূপবতী সে নারী ! ইনিই যে হেলেন তা আমাকে কাউকে বলে দিতে হলোনা । করিডোরের ধারে ধারে রাখা মশালের আলোকবৃত্তে হেলেনের রূপ যেন ঝলসে উঠতে লাগল । আমি ঐ দলটার সঙ্গ নিলাম । যুবরাজ প্যারিস যে বেঁচে নেই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । সে বেঁচে থাকতে তার প্রেমিকাকে ঘর থেকে বার করার স্পর্ধা যে কারোর নেই তা আমি ভালোই বুঝেছি । এখন একটা প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছে আমার মনে , হেলেন কি তার আগের স্বামী মেনেলাউসের সঙ্গে আর মানিয়ে নিতে পারবে ?
একটা দুষ্টবুদ্ধি মাথায় চেপে বসল। মনে হলো হেলেনকে যেনতেনভাবে টাইম মেশিনের কাছে নিয়ে যেতে পারলেই সাথে করে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারব ।
কিন্তু কিভাবে সেটা করব বুঝে উঠতে পারছিনা ।
কিছুসময় যেতেই দেখলাম আমাদের তিনজনের হাতে হেলেনের দায়িত্ব দিয়ে বাকি সবাই শহরটা লুটপাটের নেশায় মেতে উঠেছে । শুনেছিলাম বটে মেনেলাউসের ভাই অ্যাগামেমনন ভাইয়ের বৌ উদ্ধারের চেয়ে ট্রয়নগর অধিকারের উদ্দেশ্যেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন । ফটক থেকে বেরিয়ে আসতেই হেলেনের কানে কানে বললাম-
- আপনি অন্য কোথাও যেতে চাইলে বলুন আমি আপনাকে সাহায্য করবো ।
আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল হেলেন। এই সময় আমার হৃদস্পন্দনের যা অবস্থা তাতে যে বর্ষাকালের ব্যাঙদেরকে তুড়ি মেরে হারিয়ে ফেলবে এটা নিশ্চিত ।
আমার সঙ্গী দুজনের একজন একটা মশাল নিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে । আরেকজনের হাতে বল্লম । হেলেন ওদের দুজনের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলে মনে হলো আমি উনার মনের ইচ্ছা বুঝতে পারলাম । সামনের জনের থেকে মশালটা চেয়ে নিয়ে সজোরে দিলাম এক লাথি বসিয়ে , আর অন্যজনের পেটে সজোরে কনুই বসিয়ে দিলাম । আচম্বিতে দু'জনেই কুপোকাৎ ! হেলেনের হাতটা ধরে ছুট লাগালাম টাইম মেশিনটার দিকে । বিশাল একটা ভাব চলে এসেছে আমার শরীরে ।
টাইম মেশিনটার কাছে আসতেই চমকে উঠলাম । আরো একটা নারীমূর্তি আমাদের পথ আগলে রেখেছে ।
হেলেন থমকে দাঁড়িয়ে নমষ্কারের ভঙ্গিতে আগত নারীকে বললেন -
- দেবী আফ্রোদিতি আপনি এখানে ?
দেবী আফ্রোদিতি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -
- হে ভবিষ্য মানব এ তুমি কি করতে যাচ্ছো ! ইতিহাস পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা কোরোনা । হেলেনের রূপ দিয়েছি আমি । তুমি যদি তার রূপেই মজে থাক তাহলে তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিই আমি পৃথিবীর সকল প্রেমিক পুরুষের চোখে তার প্রেমিকাকে হেলেন রূপেই ধরা দিই । তুমি কি তা ভুলে গেছ ? তুমি ফিরে যাও তোমার সময়ে । হেলেনকে দিয়ে যাও আমার বন্ধু দেবী নিয়তির হাতে ।
আমি চুপচাপ টাইম মেশিনের ঢাকনা খুলে ভিতরে এসে বসলাম। ততক্ষনে গ্রীকসেনারা দুর্বার গতিতে এদিকেই ছুটে আসছে । তাদের গগনভেদী উল্লাস চাপা পড়ে গেল মেশিনটার ঢাকনাটা লাগিয়ে দিতেই । একটা বল্লম উড়ে এসে আমার সামনেটাতেই মাটি গেঁথে থরথর করে কেঁপে উঠলো । আমি দেরি না করে বর্তমানে ফেরার স্যুইচ অন করে দিলাম ।
*******************************
শরীরে একইরকম অনুভূতি নিয়ে অমলবাবুর ছোট ঘরটিতে ফিরে এলাম । ধীরে ধীরে একটা মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠল । শুনতে পেলাম একটা রিনরিনে গলা ।
- বাবা বাবা ও ফিরে এসেছে ।
অমলবাবু ছুটে ঘরে প্রবেশ করলেন ।
মেশিনের ঢাকনাটা খুলতে খুলতে শুনতে পেলাম -
- এতোক্ষন কোথায় ছিলে ! টেনশনে আমাদের যে কি অবস্থা হয়েছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা । এই দেখো টেনশনে তোমাকে আবার তুমি বলে ফেললাম ।
- না না ঠিক আছে আমি আপনার ছেলের মতোই তো...
বনানীর দিকে চোখ যেতেই দেখি তার চোখটা জলে ভরে আছে । ঠোঁট দুটো অল্প অল্প কাঁপছে ।
আমি ক্যাবলার মতো একটু হাসতে যেতেই সে একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল ।
বিদ্যুৎ চমকের মতো আরেকটা জিনিস যেটা আমার খেয়ালে এলো সেটা হলো বনানীর মুখটা হুবহু হেলেনের মতো ! না না রূপের দেবী আফ্রোদিতি আমাকে কথাটা বলার পরে যে বনানীর চেহারায় পরিবর্তন হয়েছে তা কিন্তু নয় ।
**************************
আমাকে আমার বন্ধু আর নিতে আসেনি । আসার প্রয়োজন ও নেই । আমার মা বাবা গাড়ী ভাড়া করে নিতে এসেছেন । সঙ্গে এনেছেন আশীর্বাদের আংটি ।
ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছেন । অমলবাবু হৈ হৈ করে তার টাইম মেশিন পাওয়ার গল্পটা মা বাবাকে বলছেন ।
হ্যাঁ আপনাদেরকেও যে কথাটা বলা হয়নি সেটা হলো টাইম মেশিনের মালিক টাইম মেশিন নিয়ে গেছেন । আমি আর অমলবাবু থানায় গিয়ে খোঁজ করতেই তার খোঁজ পেয়েছিলাম । ভদ্রলোক গ্রেপ্তারের কয়েকদিনের মধ্যে ছাড়া পেয়েছিলেন বটে কিন্তু পরে আবার গ্রেপ্তার হন । পরের কারনটা বেশ মজাদার । উনি গোটা শহর চষে যেখানে পাচ্ছিলেন গান্ধীজির ছবি জোগাড় করছিলেন । শেষে যখন গান্ধী মূর্তি ধরে টানাটানি শুরু করেন তখন পুলিশ তাকে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করেন । আমি আর অমলবাবু থানায় টাইম মেশিনের কথা গোপন করে বলেছি উনি আমাদের দূর সম্পর্কের রিলেটিভ হন এবং তার ব্রেইনের একটু সমস্যা আছে । আপনারাও অনেকে হয়ত তাকে দেখে থাকবেন । ভদ্রলোকের চোখগুলো গোল গোল আর কানদুটো বেশ বড়ো ।
আমি আর বনানী এখন ঘরে বসে গল্প করছি। আমি অভিমানী গলায় বললাম -
- তুমি আমার দিকে একবারও তাকাতে না কেন বলতো ?
- কে বলল তাকাতাম না ? তাকাতাম-ই তো ।
- কি করে ?
- আমাদের মানুষের চোখের দৃষ্টি কত ডিগ্রী কোণ পর্যন্ত দেখতে পায় জানো ?
- কত ?
- একশো আশি ডিগ্রী । তোমরা ছেলেরা চোখের তারার নব্বই ডিগ্রী কোণে দেখাটাকেই দেখা ভাবো , কিন্তু আমরা মেয়েরা চোখের দৃষ্টির পুরো সুবিধা নিই ...
আমি গদগদ হয়ে বনানীর গালে একটা টুসকি মেরে বললাম -
- ওরে আমার হেলেন সুন্দরী...
- তা মশাই আপনি কে ? মেনেলাউস না প্যারিস ?
ঘরের দরজার বাইরে থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো-
- স্যরি স্যরি আমি তোমাদের কথা শুনে ফেলেছি কিন্তু একটা কথা না বলে পারছিনা , তোমরা যে যাই হও যুদ্ধ টুদ্ধ বাধিও না । যুদ্ধ চালানোর মতো আমার ট্যাঁকের জোর ও নেই আর কোনো স্পনসরও পাব না ।
বাড়িটা সকলের সমবেত হাসিতে গমগম করে উঠল ।
********************************
ছবি সৌজন্য : গুগল