Humayra Jannat Mim

Abstract Romance

4  

Humayra Jannat Mim

Abstract Romance

সংসার

সংসার

14 mins
458



লেখনীতেঃ হুমায়রা জান্নাত মীম


আজ প্রায় ৮ বছর পর বিদেশ থেকে ফিরছে তুহিন। সেই সুবাদে তুহিনের পছন্দের সব রান্না করছে মীম। মীম তুহিনের বউ। তাদের বিয়ের দশ বছর হতে চললো। তুহিন এতদিন কাজের সুবাদে লন্ডন ছিল। টানা আট বছরে একবারও সে দেশে আসে নি। আসে নি বললে ভুল হবে। আসার চেষ্টা করেও আসতে পারে নি।

 মীম আনমনে রান্না করছে হঠাৎ কেউ ওকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে। মীমের বুঝতে বাকি রইলো না এটা তার মেয়ে মেহেরিমার কাজ। মীম আর তুহিনের সন্তান মেহেরিমা। মীম খুন্তি রেখে মেহেরিমাকে বলে,মেহু, কি ব্যাপার? স্কুল থেকে ফিরে হাত-মুখ না ধুয়ে এভাবে ঝাপ্টে ধরেছিস কেন?

দশ বছর বয়সী মেহেরিমা বললো, আম্মা, এটা তো আমার অভ্যাস। তুমি আমাকে বকছো?

" আচ্ছা, ঠিক আছে। যা হাত মুখে ধুয়ে একটা সুন্দর ড্রেস পড়ে আয়। আজ তোর আব্বা আসছে।"

নিজের আব্বা আসার কথা শুনে আনন্দে চোখ চিকচিক করে মেহেরিমার। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মেহেরিমা ওর বাবাকে কখনী বাস্তবে দেখে নি। সবসময় ভিডিও কলে ফোনে দেখেছে। বড্ড অভিমান হয় মেহেরিমার নিজের বাবার প্রতি। তার বান্ধবী নিতুর বাবাও তো বিদেশ। ওনি তো প্রতি তিন বছর পর বাড়ি আসেন। ওর বাবা কেন আসেন না? মেহেরিমার বড্ড বলতে ইচ্ছে হয়, সবার বাবা আসে তুমি কেন আসো না বাবা?

কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। কোথাও কথাগুলো যেন বাধা পেয়ে ফিরে আসে। তবে আজ মেহেরিমা বড্ড খুশি। আজ ওর বাবা আসবে। ওনাকে সামনা-সামনি দেখতে পারবে। অন্য সবার মতো জড়িয়ে ধরে আবদার করতে পারবে৷ কি মজা!


★★ রান্না শেষ করে গোসল করতে যায় মীম। গোসল শেষ করে তুহিনের পছন্দের রংয়ের একটা শাড়ি পড়ে। তুহিনের বেগুনি রং অনেক পছন্দ। আজ সে তুহিনের মনের মতো সাজবে। হাতে রেশমি চুড়ি। খোপায় বেলি ফুল। এসব দেওয়ায় মীমকে আজ একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে। ওকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না ও এক সন্তানের মা। এখন শুধু অপেক্ষা প্রিয়তমের আগমনের। জানালার পাশে বসে উঠোনের কদমগাছের দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো মীম। তুহিন আর তার বিয়ে এরেঞ্জ ম্যারেজ। তুহিন ছিল খুবই বন্ধুসুলভ। সাথে একজন কেয়ারিং হাজবেন্ড। তাই খুব অল্পদিনেই মীম তুহিন ও এই সংসারটাকে আপন করে নেয়। তুহিনের পরিবারে ওর মা,বাবা, মীম এবং ও। তুহিনের সাথে যখন মীমের বিয়ে হয় তখন তুহিন একটা আধা-সরকারি হাইস্কুলের একজন অস্থায়ী শিক্ষক। তবে পড়িয়ে তুহিন যা বেতন পেত তাতে সংসার চালানো খুব কষ্টকর ছিল। তার উপর তুহিনের বাবা ছিলেন ডায়বেটিস এর রোগী। ওনাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেকাপ করাতে হতো। সংসারের খরচ চালানোর জন্য তুহিন হন্যে হয়ে চাকরি খুজছিলো। কিন্তু আমাদের দেশের যা পরিস্থিতি সেই প্রেক্ষাপটে চাকরি ছিল সোনার হরিণ। তাই তুহিন স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি কোচিংও করাতো। ঘর থেকে বেরুতো খুব সকালে ফিরতো সন্ধ্যায়। মীমও তুহিনকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট করেছে। সে সংসারের চাহিদ পূরণের জন্য টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করতো। বাড়ির উঠোনে বিভিন্ন সবজির গাছ লাগাতো। তুহিনের মায়ের বয়স হয়েছিল। তাই সংসারের সকল কাজ মীমকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছিলো। এতে মীমের কষ্ট হলেও হাসিমুখে তা সামলে নিত। জগতে সাক্রিফাইস ছাড়া কিছুই হয় না। কোন কিছু অর্জন করতে গেলে সাক্রিফাইস করতে হবে। প্রিয় মানুষগুলোর জন্য সংসারের জন্য সব ধরণের সাক্রিফাইস করতে মীম প্রস্তুত। তুহিন যদি এত সাক্রিফাইস করতে পারে ওদের ভালো রাখার জন্য তাহলে সেও পারবে। মীমের এত কষ্ট দেখে তুহিন একদিন মীমের হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, আমাকে ক্ষমা করে দাও মীম। আমার জন্য তোমাকে এত কষ্ট করতে হচ্ছে। আমি তোমাকে সারজীবন ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ অব্দি তোমায় কষ্ট, অভাব- অনটন ছাড়া কিছুই দিতে পারি নি। আমি ভালো স্বামী হয়ে উঠতে পারি নি।


তুহিনের কথা শুনে মীম তুহিনের হাতে হাত রেখে বলেছিল, কষ্ট কি তুমি কিছু কম করছো তুহিন? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই পরিবারের জন্য খেটে যাচ্ছো। আমি তোমার স্ত্রী, তোমার বেটার হাফ। আমার এটা পবিত্র কর্তব্য সবসময় তোমার পাশে থাকা। দায়িত্ব শুধু একা তুমি নাও নি তুহিন আমিও নিয়েছি, তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব, তোমার বিপদে ঢাল হওয়ার দায়িত্ব। আমার ভালোবাসার মানুষটার জন্য আমি সব করতে পারি। আর কি হবে এত আরাম-আয়েশ করে? দুনিয়াটাই বা কয়দিনের? আজ আছে কাল নেই। তাই এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় একটু নাহয় কষ্ট করেই ফেললাম চিরস্থায়ী দুনিয়ায় সুখে থাকার জন্য। আমি তোমার মতো স্বামী পেয়ে সবচেয়ে সুখী তুহিন।


 সেদিন মীমের কথা শুনে তুহিন মীমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল অনেক্ষণ। তারপর একদিন মীমের কোলে মেহেরিমা এলো। বাবা হতে পেরে তুহিনের আনন্দের শেষ নেই। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবার সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে তার নামে থাকা জমিটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে সূদুর ইংল্যান্ডে পাড়ি জামালো। তখন মেহেরিমা ছিল দুইবছরের। যাওয়ার আগে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক সময় কাঁদলো। মীমকে জড়িয়ে ধরে কাদছিলো মীমও কাদছিলো।মীমের চোখের পানি তুহিনের শার্টকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। যাওয়ার আগে মীমের চোখে পানি মুছে দিয়ে বলেছিল, হুশ,পাগলী এত কাদে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। নিজের আর মা-বাবার, আমার মেহুপ্রিন্সেসের খেয়াল রেখো। 

তারপর মেহেরিমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, তোমার মাকে একদম জ্বালাবে না প্রিন্সেস। বাবা খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। আর আসার সময় তোমার জন্য অনেক অনেক গ্রিফট নিয়ে আসবে। ততদিন গুড গার্ল হয়ে থাকবে। 

তারপর মেহেরিমাকে মীমের কোলে দিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তুহিন। সবাইকে ছেড়ে যেতে কষ্টে ওর বুক ফেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু যেতে তো হবেই। যাওয়ার সময় মীম পেছন থেকে কাপা কাপা গলায় বলেছিল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। আমি কিন্তু আপনার অপেক্ষায় থাকবো প্রিয়তম!


কথাটা শুনে আর পেছনে তাকায় নি তুহিন। কারণ তাকালে যে আর যাওয়া হতো না। 

তুহিন বিদেশ যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তাদের সচ্ছলতা আসে। শুধু সচ্ছলতা নয় আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। তুহিন কাজ করে দেশে টাকা পাঠায়। তার নিজের খরচ বাদে বাকি টাকা জমিয়ে একটা হোটেল দেয়। হোটেলটা সময়ের ব্যবধানে হোটেলটা বড় হয়। এখন হোটেলটা লন্ডনের একটা বিখ্যাত হোটেল। এক সময়ের দারিদ্র্য তুহিন আজ কোটিপতি। সব আল্লাহর নেয়ামত। পরিবারের সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো তুহিন। এই আট বছরে তুহিন একবারও দেশে আসে নি। মীম অনেক বলেও ওকে আনতে পারে নি। আজ আট বছর পর আসছে। 


কলিংবেলের আওয়াজে মীম স্মৃতিচারণ থেকে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দেখে মেহেরিমা দরজা খোলছে। দরজা খোলতে তুহিনকে দেখে মেহেরিমা " আব্বা" বলে ডাকে। তুহিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। তার পর কপালে গালে চুমু দেয়। তার সে ছোট্ট প্রিন্সেস আজ কত বড় হয়ে গেছে। এতটা বছর যে মেহেরিমাকে ছাড়া সে কিভাবে ছিল তা তার আল্লাহ জানেন আর সে জানে। মেহেরিমাকে নিয়ে ঘরে আসে তুহিন। ঘরে ঢুকে সিড়িতে শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে থাকা মীমকে দেখতে পায় তুহিন। মীমকে দেখেই হার্টবিট বেড়ে যায় তুহিনের। আজ এত বছর সে তার প্রিয়তমাকে কাছ থেকে দেখছে। মেয়েটার চোখে ওর জন্য আকাশসম ভালোবাসার পাশাপাশি অনেক অভিমানও দেখছে তুহিন। তাই তো কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রুম থেকে দৌড়ে এলেও সিড়িতে এসে থেমে গেছে। মীমের কি জন্য অভিমান করেছে তা বুঝতে দেরি হলো না তুহিনের। অভিমানের কথা মনে হতেই মুচকি হাসে তুহিন। সাথে সাথে দৃশ্যমান হয় তুহিনের বাম গালের মাঝখানে পড়া টোলটা। যা দেখে আরেক দফা তুহিনের প্রেমে পড়ে যায় মীম।

তুহিন আসায় ওর মা-বাবা বেরিয়ে আসেন। এতদিন পর ছেলেকে দেখে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। মা-বাবাকে পেয়ে তুহিনও তাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে । রাতে সবাই গল্প করলেন, খাওয়ার সময় তুহিন তার বিদেশের বিভিন্ন কাহিনী বললো। কিন্তু আসার পর থেকে একবারও তুহিন মীমের সাথে কথা বলে নি। তা দেখে মীমের অভিমান আরো বেড়ে গেল। সে চুপচাপ সবার কথা শুনছিলো। প্রিয়তমা অভিমানের পাল্লা আগের থেকে ভারী দেখে আনমনে হাসলো তুহিন। আর মনে মনে বললো, আজ আমি তোমার সব অভিমান ভেঙে দেবো প্রিয়তমা। 


★★ রাতে সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহেরিমাকে আজ তুহিনের মা নিজের কাছে রেখেছেন মীম আর তুহিনকে স্পেস দেওয়ার জন্য। এত দিন মীমের সাথে মেহেরিমা ঘুমাতো। রুমে মীম কাপড় ভাজ করে রাখছে। তুহিন রুমে এসে আস্তে করে দরজা লাগালো।মীম আড়চোখে একবার তুহিনকে দেখে আবার কাপড় ভাজে মন দিল। তুহিন মীমকে পেছন থেকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আর নেশালো কন্ঠে বললো, প্রেয়সী তুমি কি জানো তোমাকে কাছে না পাওয়ার দহনে আমি কত রাত পুড়েছি? তোমার মায়ামাখা কন্ঠে কতদিন নিজের নাম শুনি নি। প্রবাসে এমন কোনো দিন যায় নি যেদিন তোমার কথা ভাবিনি। ভালোবাসি প্রিয়তমা। অনেক অনেক ভালোবাসি।


তুহিনের এমন ভালোবাসাময় কথা শুনে মীমের অভিমান মোমের মতো গলের গেলো। তবুও মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বললো, ছাড়ো আমায়। আমি কে তোমার? কেউ না। যদি কেউ হতাম তাহলে এত বছরে একবার হলেও আসতে।


তুহিন মীমকে আগের মতো জড়িয়ে রেখে বললো, কি করবো প্রেয়সী! এখানে এলে যে তোমারদের রেখে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করতো না। তাই এবার এসেছি তোমাদের আমার কাছে নিয়ে যেতে। 

" তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না। বাসো না বলেই তুমি আসার পর আমার সাথে একবারও কথা বলো নি।"


" কে বলেছে ভালোবাসি না? আমি আমার মীমরাণীকে যতটা ভালোবাসি তা আমার মীমরাণী জানেও না। আর আমি আসার পর দেখেছিলাম আমার একান্ত নারীটি অভিমানমাখা মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার সেই একান্ত নারীটি জানেও না যে তার ওই অভিমানমিশ্রিত মুখখানা তার প্রেমিক পুরুষকে কতটা পাগল করে দিয়েছিল। তার প্রেমিক পুরুষের যে তাকে দেখাই শেষ হচ্ছিলো না। কথা বলবে কি!"

তুহিনের কথা শুনে মীম লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

" তুমিও না। বুড়োবয়সে ভীমরতি ধরেছে।"


মীমের কথা শুনে তুহিন হা হা করে হেসে ফেলে।

তুহিন মীমকে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়।তারপর উঠোনে থাকা কদম গাছটার দিকে তাকিয়ে বলে, জানো মীম আমি যখন ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম তখন এই কদম গাছটা একটা চারা ছিল। এখন এটা বড় বৃক্ষ। ৮ বছর আগে আমিও সেই চারা গাছটার ন্যায় ছিলাম। আজ আল্লাহর রহমতে আমি এখন কদম বৃক্ষের ন্যায়। ধন্যবাদ মীম, তখন সেই অবস্থায় আমার পাশে থাকার জন্য। ধন্যবাদ মীম , আমার সংসারটাকে এভাবে আগলে রাখার জন্য।

তুহিনের কথা শুনে মীম তুহিনের কাধে মাথা রেখে বলে, ধন্যবাদ তোমাকেও তুহিন, আমার জীবনসাথী হওয়ার জন্য। ধন্যবাদ তুহিন, আমাকে এমন একটা সুন্দর সংসার দেওয়ার জন্য।

ভালোবাসা কখনো দারিদ্র্যতার কাছে হারে না যদি সেই ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষটা খাটি হয়!


  💗 সমাপ্ত💗ছোটগল্পঃ সংসার

লেখনীতেঃ হুমায়রা জান্নাত মীম


আজ প্রায় ৮ বছর পর বিদেশ থেকে ফিরছে তুহিন। সেই সুবাদে তুহিনের পছন্দের সব রান্না করছে মীম। মীম তুহিনের বউ। তাদের বিয়ের দশ বছর হতে চললো। তুহিন এতদিন কাজের সুবাদে লন্ডন ছিল। টানা আট বছরে একবারও সে দেশে আসে নি। আসে নি বললে ভুল হবে। আসার চেষ্টা করেও আসতে পারে নি।

 মীম আনমনে রান্না করছে হঠাৎ কেউ ওকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে। মীমের বুঝতে বাকি রইলো না এটা তার মেয়ে মেহেরিমার কাজ। মীম আর তুহিনের সন্তান মেহেরিমা। মীম খুন্তি রেখে মেহেরিমাকে বলে,মেহু, কি ব্যাপার? স্কুল থেকে ফিরে হাত-মুখ না ধুয়ে এভাবে ঝাপ্টে ধরেছিস কেন?

দশ বছর বয়সী মেহেরিমা বললো, আম্মা, এটা তো আমার অভ্যাস। তুমি আমাকে বকছো?

" আচ্ছা, ঠিক আছে। যা হাত মুখে ধুয়ে একটা সুন্দর ড্রেস পড়ে আয়। আজ তোর আব্বা আসছে।"

নিজের আব্বা আসার কথা শুনে আনন্দে চোখ চিকচিক করে মেহেরিমার। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মেহেরিমা ওর বাবাকে কখনী বাস্তবে দেখে নি। সবসময় ভিডিও কলে ফোনে দেখেছে। বড্ড অভিমান হয় মেহেরিমার নিজের বাবার প্রতি। তার বান্ধবী নিতুর বাবাও তো বিদেশ। ওনি তো প্রতি তিন বছর পর বাড়ি আসেন। ওর বাবা কেন আসেন না? মেহেরিমার বড্ড বলতে ইচ্ছে হয়, সবার বাবা আসে তুমি কেন আসো না বাবা?

কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। কোথাও কথাগুলো যেন বাধা পেয়ে ফিরে আসে। তবে আজ মেহেরিমা বড্ড খুশি। আজ ওর বাবা আসবে। ওনাকে সামনা-সামনি দেখতে পারবে। অন্য সবার মতো জড়িয়ে ধরে আবদার করতে পারবে৷ কি মজা!


★★ রান্না শেষ করে গোসল করতে যায় মীম। গোসল শেষ করে তুহিনের পছন্দের রংয়ের একটা শাড়ি পড়ে। তুহিনের বেগুনি রং অনেক পছন্দ। আজ সে তুহিনের মনের মতো সাজবে। হাতে রেশমি চুড়ি। খোপায় বেলি ফুল। এসব দেওয়ায় মীমকে আজ একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে। ওকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না ও এক সন্তানের মা। এখন শুধু অপেক্ষা প্রিয়তমের আগমনের। জানালার পাশে বসে উঠোনের কদমগাছের দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো মীম। তুহিন আর তার বিয়ে এরেঞ্জ ম্যারেজ। তুহিন ছিল খুবই বন্ধুসুলভ। সাথে একজন কেয়ারিং হাজবেন্ড। তাই খুব অল্পদিনেই মীম তুহিন ও এই সংসারটাকে আপন করে নেয়। তুহিনের পরিবারে ওর মা,বাবা, মীম এবং ও। তুহিনের সাথে যখন মীমের বিয়ে হয় তখন তুহিন একটা আধা-সরকারি হাইস্কুলের একজন অস্থায়ী শিক্ষক। তবে পড়িয়ে তুহিন যা বেতন পেত তাতে সংসার চালানো খুব কষ্টকর ছিল। তার উপর তুহিনের বাবা ছিলেন ডায়বেটিস এর রোগী। ওনাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেকাপ করাতে হতো। সংসারের খরচ চালানোর জন্য তুহিন হন্যে হয়ে চাকরি খুজছিলো। কিন্তু আমাদের দেশের যা পরিস্থিতি সেই প্রেক্ষাপটে চাকরি ছিল সোনার হরিণ। তাই তুহিন স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি কোচিংও করাতো। ঘর থেকে বেরুতো খুব সকালে ফিরতো সন্ধ্যায়। মীমও তুহিনকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট করেছে। সে সংসারের চাহিদ পূরণের জন্য টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করতো। বাড়ির উঠোনে বিভিন্ন সবজির গাছ লাগাতো। তুহিনের মায়ের বয়স হয়েছিল। তাই সংসারের সকল কাজ মীমকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছিলো। এতে মীমের কষ্ট হলেও হাসিমুখে তা সামলে নিত। জগতে সাক্রিফাইস ছাড়া কিছুই হয় না। কোন কিছু অর্জন করতে গেলে সাক্রিফাইস করতে হবে। প্রিয় মানুষগুলোর জন্য সংসারের জন্য সব ধরণের সাক্রিফাইস করতে মীম প্রস্তুত। তুহিন যদি এত সাক্রিফাইস করতে পারে ওদের ভালো রাখার জন্য তাহলে সেও পারবে। মীমের এত কষ্ট দেখে তুহিন একদিন মীমের হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, আমাকে ক্ষমা করে দাও মীম। আমার জন্য তোমাকে এত কষ্ট করতে হচ্ছে। আমি তোমাকে সারজীবন ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ অব্দি তোমায় কষ্ট, অভাব- অনটন ছাড়া কিছুই দিতে পারি নি। আমি ভালো স্বামী হয়ে উঠতে পারি নি।


তুহিনের কথা শুনে মীম তুহিনের হাতে হাত রেখে বলেছিল, কষ্ট কি তুমি কিছু কম করছো তুহিন? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই পরিবারের জন্য খেটে যাচ্ছো। আমি তোমার স্ত্রী, তোমার বেটার হাফ। আমার এটা পবিত্র কর্তব্য সবসময় তোমার পাশে থাকা। দায়িত্ব শুধু একা তুমি নাও নি তুহিন আমিও নিয়েছি, তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব, তোমার বিপদে ঢাল হওয়ার দায়িত্ব। আমার ভালোবাসার মানুষটার জন্য আমি সব করতে পারি। আর কি হবে এত আরাম-আয়েশ করে? দুনিয়াটাই বা কয়দিনের? আজ আছে কাল নেই। তাই এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় একটু নাহয় কষ্ট করেই ফেললাম চিরস্থায়ী দুনিয়ায় সুখে থাকার জন্য। আমি তোমার মতো স্বামী পেয়ে সবচেয়ে সুখী তুহিন।


 সেদিন মীমের কথা শুনে তুহিন মীমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল অনেক্ষণ। তারপর একদিন মীমের কোলে মেহেরিমা এলো। বাবা হতে পেরে তুহিনের আনন্দের শেষ নেই। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবার সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে তার নামে থাকা জমিটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে সূদুর ইংল্যান্ডে পাড়ি জামালো। তখন মেহেরিমা ছিল দুইবছরের। যাওয়ার আগে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক সময় কাঁদলো। মীমকে জড়িয়ে ধরে কাদছিলো মীমও কাদছিলো।মীমের চোখের পানি তুহিনের শার্টকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। যাওয়ার আগে মীমের চোখে পানি মুছে দিয়ে বলেছিল, হুশ,পাগলী এত কাদে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। নিজের আর মা-বাবার, আমার মেহুপ্রিন্সেসের খেয়াল রেখো। 

তারপর মেহেরিমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, তোমার মাকে একদম জ্বালাবে না প্রিন্সেস। বাবা খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। আর আসার সময় তোমার জন্য অনেক অনেক গ্রিফট নিয়ে আসবে। ততদিন গুড গার্ল হয়ে থাকবে। 

তারপর মেহেরিমাকে মীমের কোলে দিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তুহিন। সবাইকে ছেড়ে যেতে কষ্টে ওর বুক ফেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু যেতে তো হবেই। যাওয়ার সময় মীম পেছন থেকে কাপা কাপা গলায় বলেছিল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। আমি কিন্তু আপনার অপেক্ষায় থাকবো প্রিয়তম!


কথাটা শুনে আর পেছনে তাকায় নি তুহিন। কারণ তাকালে যে আর যাওয়া হতো না। 

তুহিন বিদেশ যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তাদের সচ্ছলতা আসে। শুধু সচ্ছলতা নয় আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। তুহিন কাজ করে দেশে টাকা পাঠায়। তার নিজের খরচ বাদে বাকি টাকা জমিয়ে একটা হোটেল দেয়। হোটেলটা সময়ের ব্যবধানে হোটেলটা বড় হয়। এখন হোটেলটা লন্ডনের একটা বিখ্যাত হোটেল। এক সময়ের দারিদ্র্য তুহিন আজ কোটিপতি। সব আল্লাহর নেয়ামত। পরিবারের সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো তুহিন। এই আট বছরে তুহিন একবারও দেশে আসে নি। মীম অনেক বলেও ওকে আনতে পারে নি। আজ আট বছর পর আসছে। 


কলিংবেলের আওয়াজে মীম স্মৃতিচারণ থেকে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দেখে মেহেরিমা দরজা খোলছে। দরজা খোলতে তুহিনকে দেখে মেহেরিমা " আব্বা" বলে ডাকে। তুহিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। তার পর কপালে গালে চুমু দেয়। তার সে ছোট্ট প্রিন্সেস আজ কত বড় হয়ে গেছে। এতটা বছর যে মেহেরিমাকে ছাড়া সে কিভাবে ছিল তা তার আল্লাহ জানেন আর সে জানে। মেহেরিমাকে নিয়ে ঘরে আসে তুহিন। ঘরে ঢুকে সিড়িতে শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে থাকা মীমকে দেখতে পায় তুহিন। মীমকে দেখেই হার্টবিট বেড়ে যায় তুহিনের। আজ এত বছর সে তার প্রিয়তমাকে কাছ থেকে দেখছে। মেয়েটার চোখে ওর জন্য আকাশসম ভালোবাসার পাশাপাশি অনেক অভিমানও দেখছে তুহিন। তাই তো কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রুম থেকে দৌড়ে এলেও সিড়িতে এসে থেমে গেছে। মীমের কি জন্য অভিমান করেছে তা বুঝতে দেরি হলো না তুহিনের। অভিমানের কথা মনে হতেই মুচকি হাসে তুহিন। সাথে সাথে দৃশ্যমান হয় তুহিনের বাম গালের মাঝখানে পড়া টোলটা। যা দেখে আরেক দফা তুহিনের প্রেমে পড়ে যায় মীম।

তুহিন আসায় ওর মা-বাবা বেরিয়ে আসেন। এতদিন পর ছেলেকে দেখে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। মা-বাবাকে পেয়ে তুহিনও তাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে । রাতে সবাই গল্প করলেন, খাওয়ার সময় তুহিন তার বিদেশের বিভিন্ন কাহিনী বললো। কিন্তু আসার পর থেকে একবারও তুহিন মীমের সাথে কথা বলে নি। তা দেখে মীমের অভিমান আরো বেড়ে গেল। সে চুপচাপ সবার কথা শুনছিলো। প্রিয়তমা অভিমানের পাল্লা আগের থেকে ভারী দেখে আনমনে হাসলো তুহিন। আর মনে মনে বললো, আজ আমি তোমার সব অভিমান ভেঙে দেবো প্রিয়তমা। 


★★ রাতে সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহেরিমাকে আজ তুহিনের মা নিজের কাছে রেখেছেন মীম আর তুহিনকে স্পেস দেওয়ার জন্য। এত দিন মীমের সাথে মেহেরিমা ঘুমাতো। রুমে মীম কাপড় ভাজ করে রাখছে। তুহিন রুমে এসে আস্তে করে দরজা লাগালো।মীম আড়চোখে একবার তুহিনকে দেখে আবার কাপড় ভাজে মন দিল। তুহিন মীমকে পেছন থেকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আর নেশালো কন্ঠে বললো, প্রেয়সী তুমি কি জানো তোমাকে কাছে না পাওয়ার দহনে আমি কত রাত পুড়েছি? তোমার মায়ামাখা কন্ঠে কতদিন নিজের নাম শুনি নি। প্রবাসে এমন কোনো দিন যায় নি যেদিন তোমার কথা ভাবিনি। ভালোবাসি প্রিয়তমা। অনেক অনেক ভালোবাসি।


তুহিনের এমন ভালোবাসাময় কথা শুনে মীমের অভিমান মোমের মতো গলের গেলো। তবুও মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বললো, ছাড়ো আমায়। আমি কে তোমার? কেউ না। যদি কেউ হতাম তাহলে এত বছরে একবার হলেও আসতে।


তুহিন মীমকে আগের মতো জড়িয়ে রেখে বললো, কি করবো প্রেয়সী! এখানে এলে যে তোমারদের রেখে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করতো না। তাই এবার এসেছি তোমাদের আমার কাছে নিয়ে যেতে। 

" তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না। বাসো না বলেই তুমি আসার পর আমার সাথে একবারও কথা বলো নি।"


" কে বলেছে ভালোবাসি না? আমি আমার মীমরাণীকে যতটা ভালোবাসি তা আমার মীমরাণী জানেও না। আর আমি আসার পর দেখেছিলাম আমার একান্ত নারীটি অভিমানমাখা মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার সেই একান্ত নারীটি জানেও না যে তার ওই অভিমানমিশ্রিত মুখখানা তার প্রেমিক পুরুষকে কতটা পাগল করে দিয়েছিল। তার প্রেমিক পুরুষের যে তাকে দেখাই শেষ হচ্ছিলো না। কথা বলবে কি!"

তুহিনের কথা শুনে মীম লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

" তুমিও না। বুড়োবয়সে ভীমরতি ধরেছে।"


মীমের কথা শুনে তুহিন হা হা করে হেসে ফেলে।

তুহিন মীমকে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়।তারপর উঠোনে থাকা কদম গাছটার দিকে তাকিয়ে বলে, জানো মীম আমি যখন ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম তখন এই কদম গাছটা একটা চারা ছিল। এখন এটা বড় বৃক্ষ। ৮ বছর আগে আমিও সেই চারা গাছটার ন্যায় ছিলাম। আজ আল্লাহর রহমতে আমি এখন কদম বৃক্ষের ন্যায়। ধন্যবাদ মীম, তখন সেই অবস্থায় আমার পাশে থাকার জন্য। ধন্যবাদ মীম , আমার সংসারটাকে এভাবে আগলে রাখার জন্য।

তুহিনের কথা শুনে মীম তুহিনের কাধে মাথা রেখে বলে, ধন্যবাদ তোমাকেও তুহিন, আমার জীবনসাথী হওয়ার জন্য। ধন্যবাদ তুহিন, আমাকে এমন একটা সুন্দর সংসার দেওয়ার জন্য।

ভালোবাসা কখনো দারিদ্র্যতার কাছে হারে না যদি সেই ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষটা খাটি হয়!


  💗 সমাপ্ত💗


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract