মৌনতা
মৌনতা
এই সুমন ! এই !
হঠাৎ এমন ডাক শুনে কিছুটা বিব্রত হওয়ার কথা। অথচ গলার স্বরটা এতটা পরিচিত যে আমি বিব্রত হতে পারলাম না। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলাম স্নেহা অনেক জোরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে,তাঁর ঠোঁটে উচ্ছাস মাখা হাসি,যেন আমাকে থামাতে পেরে সে কোনো রাজ্য জয় করে নিয়েছে।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,” কিরে কতক্ষণ ধরে ডাকতাছি তকে ! কানে কি শুনস না ! বয়রা নাকি ? ”
“এখানে কি করছ ?”
“এই তো কোচিং করে বের হলাম। তুই এখানে কি ? আর তর কোনো খোজ খবর নেই কেনো বল তো ! কই থাকছ আজকাল !”
“তেমন কিছু না চাকরির জন্য একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম।”
“এই কি মনে হয় হবে ?”
“নাহ আপাতত কিছু মনে করছি না।”
“এটা কেমন কথা ! আচ্ছা হয়ে গেলে কিন্তু ট্রিট দিতে হবে ।”
“ হুম।”
“এই চা খাবি? সামনে একটা টং দোকান আছে,পিচ্ছি একটা ছেলে হেব্বি চা বানায়।”
“তুইও টং এ চা খাস নাকি ! ”
“এখন খাই ।”
“এইযে রতন মিয়া দুইটা চা দাও তো।“ স্নেহার গলার আওয়াজ শুনেই ওর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো,” আপা কেমন আছেন?”
“ এইতো ভালো।তুমি কেমন আছো?”
“ এইতো আছি আপা। অনেকদিন পরে আইলেন। বসেন।“ বলেই হাতে গামছা নিয়ে দুইটা টুল মুছে দিলো।
চা হাতে নিয়ে সুমন রতন মিয়া কে উদ্দেশ্য করে বললো,” এই যে স্যার একটু কষ্ট করে আমকে একটা সিগারেট দিবেন।”
রতন মিয়া বিব্রত ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,”আল্লাহ! আপনে আমারে স্যার ডাকতাছেন!”
স্নেহা হাসছে। সুমন সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,”কেনো স্যার ডাকলে অসুবিদা !”
“না না ।আমি ছোড মানুষ স্যার ডাকলে কেমন যেনো লাগে।”
সুমন হাল্কা হেঁসে চুপ করে গেলো। স্নেহা সুমনকে উদ্দেশ্য করে বললো,”জানিস আমরা বিদেশে চলে যাচ্ছি।”
সুমনের বুক যেন হটাৎ ধুক করে উঠলো।সে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো,”সত্যি নাকি?”
“আরে হ্যাঁ। এই খবরটা দেয়ার জন্য তোকে খুঁজে বেরাচ্ছি ।কিন্তু তুই তো উদাও হয়ে থাকিস,আমি তো ভেবেছিলাম তর সাথে বোধহয় আর দেখাই হবে না।”
“কবে যাচ্ছিস?”
“এই মাসের ২৫ তারিখ। মানে আর ১৫দিন বাকি আছে।”
“হুম,কোন দেশে যাচ্ছিস?”
“আমেরিকা।শোন কালকে আমি বাসায় পার্টি দিচ্ছি,সব বন্ধুরা আসবে। তুই ও আসবি কিন্তু।”
সুমন একমনে স্নেহার দিকে তাকিয়ে সিগারেটের শেষ টান দিচ্ছে।স্নেহা আবারো বললো,” কিরে এমন করে তাকিয়ে আছিস কেনো ! বলনা আসবি?”
“না। আমি একটু ব্যাস্ত।”
“এটা একটা কথা বললি ! ১৫ দিন পরে আমি চলে যাবো কোথায় আমাকে সময় দিবি,তুই উল্টা অজুহাত দেখাচ্ছিস ! আসতে হবে বলে দিলাম।”
“জোর করিস না স্নেহা আমি সত্যি ব্যাস্ত আসতে পারবো নারে।”
স্নেহা কিছুটা রেগে গেলো,তারপর শান্ত গলায় বললো,”একটা কথা বলবো সুমন?”
“বল”
“তুই কেমন জানি হয়ে যাচ্ছস।”
“কেমন?”
“তুই চুপসে গেছিস,সব সময় কেমন যেনো মুখ গোমরা করে থাকিস,আগের সেই উৎফুল্ল,সেই উচ্ছাস তোর মাজে এখন একদমই নেই। ”
সুমন হাল্কা করে হেঁসে বললো,”উঠি রে,কাজ আছে।“ ”চললাম রতন মিয়া।”
রতন মিয়া হাল্কা করে হাসলো। স্নেহা চুপ করে রতনের চলে যাওয়া দেখতে থাকলো।স্নেহা কি কাঁদছে ! না কাঁদছে না, চোখ ভর্তি জল কিন্তু একটি ফোটাও গড়িয়ে পরলো না ।কিছু কিছু মেয়ে বোধহয় অশ্রু ধরে রাখার অসীম ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে ।
সুমন মেসে এসে দেখে রুমে কবির ভাই বসে আছে। কবির ভাই খুব সাধারণ টাইপের একজন মানুষ। চাকরির জন্য শহরে আসা।সুমনকে দেখেই কবির ভাই একগাল হেঁসে বললেন, “আরে সুমন কেমন আছো ? কই ছিলা সারাদিন খুঁজে পাই না !”
“এইতো ভাই ভালো।একটা ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম। আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো আছি বেশ। চাকরির ইন্টারভিউ নাকি?”
“জী ভাই। আপনি কতক্ষণ ধরে বসে আছেন?”
“এইতো ঘণ্টা দুয়েক হবে।”
“আপনার অফিস নেই আজকে?”
“আজকে ছুটি নিয়েছি।মাসে ৩০দিন তো আর কাজ করা যায় না তাই ভাবলাম আজকে একটু ঘুরাফেরা করা যাক।”
“ভালো করেছেন। তা কোথায় কোথায় ঘুরলেন?”
“নাহ ঘুরা হয় নাই।বেতন পাই বাড়িতে টাকা পাঠাই দিছিলাম,এখন ছুটি নেয়ার পর দেখলাম হাতের অবস্তা ভালো না সব হিসাবের টাকা।”
“আচ্ছা। খালাম্মা ভালো আছে?”
“হা।আম্মার সাথে কথা হইছে একটু আগে,আম্মা অনেক খুশি ছোট বইনরে নাকি আজকে দেখতে আসছিলো ওদের অনেক পছন্দ হইছে।”
“আচ্ছা। কয় তারিখে বিয়ে?”
“এই খবরটাই দিতে আসলাম এই ৩০ তারিখেই বিয়ে।তুমি কিন্তু আগে আসতে হবে।অনেক কাজ আছে সাহায্য করতে হবে।”
“জী চেষ্টা করবো।”
“ চেষ্টানা আসতে হবে। আমি যাবো বিয়ের সাপ্তাহ খানিক আগে।টাকা পয়সার ব্যাপার স্যাপার আছে। এসব অবশ্য হয়ে যাবে।আমার বস অনেক উদার মনের মানুষ,উনারে একবার কল দিয়ে অবশ্য দাওয়াত দিয়েছি।কালকে গিয়ে টাকা পয়সার কথা বলবো।”
“উনি দিবে?”
“আরেহ দিবে দিবে। তাছারা উনার টাকা তো নিচ্ছিনা। দুমাসের বেতন এডভান্স নিবো।আর ফুফাতো ভাই বলেছে টাকা পঞ্চাশ হাজার দিবে।এতেই হয়ে যাবে।এতো বড়ো করে আয়োজন করছিনা,ছোট খাটো আয়োজন।শুধু নিজের মানুষদের নিয়ে।”
“আচ্ছা। আপনি বসেন আমি চা নিয়ে আসি।”
“আরেহ না না তুমি কেনো চা আনবে! আজকে আমি খাওয়াবো তোমাকে। চলো বাইরে চলো ।”
“না না ভাই সমস্যা নেই।”
“আরেহ পাগল চলো।”
কবির ভাই চায়ের সাথে পরোটার অর্ডার দিয়ে এসে সুমনের সামনে বসতে বসতে তাঁকে বললেন,”ইন্টারভিউ যে দিলে চাকরিটা কি হবে?”
“কিছু বুঝা যাচ্ছেনা কবির ভাই।”
“আরেহ এসব নিয়ে চিন্তা করবে না।একটা না হলে আরেকটা হবে।কখনো চাপ নিবে না।”
“চাপ না নিয়ে কি আর হয় কবির ভাই। আমাদের যে একটা পেট আছে।”
“এই একটা খাসা কথা বললে। আমাদের পেট না থাকতো তাহলে আর কোনো জামেলাই ছিলো না,পেটের জন্য মানুষ কতো কিছু করে কত কিছু হারায়।আমারেই দেখো কত সুন্দর নিজের মানুষ নিজের গ্রাম ছেড়ে এইখানে আইসা পড়ে থাকতে হচ্ছে।”
কথাটা বলেই কবির ভাই হালকা করে হেঁসে উঠলেন।
চা শেষ করে কবির ভাই বললেন,”পান খাওতো সুমন?”
“না ভাই। শুধু সিগারেট।”
“পান মুখে নিয়ে সিগারেট খেও,মুখে কোনো গন্ধ থাকে না।”
সিগারেট ধরাতে ধরাতে সুমন বললো,”পান খেতে পারি না ভাই।”
কবির ভাই পান চাবাতে চাবাতে সিগারেটে টান দিয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেঁসে বললেন,”এটাও ভালো দাঁত পরিষ্কার থাকবে।”
কবির ভাইকে বিদায় দিয়ে রুমে আসতেই মাসের মালিক আকবর সাহেব এসে রুমে ঢুকে মুখ বাঁকা করে ডাক দিলেন,”সুমন!”
”স্লামুয়ালাইকুম চাচা।“
“সুমন আজকে মাসের ১০ তারিখ।অথচ তোমার কোনো খোঁজ নাই।”
“জী চাচা আমি একটু সমস্যায় পড়ে গেছি ১৫ তারিখের ভিতর টাকা দিয়ে দিবো।”
“না না সুমন আমি অন্য একটা কথা বলতে এসেছি।”
সুমন চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো,”জী চাচা বলুন।”
“শুনো সুমন আমি তোমাকে নিজের ছেলের মতো করে দেখি।তোমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই,
সেই হিসেবে তোমার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। কিন্তু আমার ও একটা পেট আছে,পরিবার আছে।অথচ উপার্জন কি ! শুধু মাত্র এই মেসের ভাড়া। এটা দিয়েই টেনেটুনে কোনো রকম সংসার চলে। প্রতিটা টাকা হিসাবের। চাকরি চলে যাওয়ার পর তোমার কিছু সমস্যা চলছে এটা আমি জানি। কিন্তু আজ পাঁচ মাস ধরে তুমি সময় মতো ভাড়াটা দিতে পারছ না। তোমার অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। কিন্তু এই খারাপের ভারটা আমার পক্ষে সয্য করা সম্ভব হচ্ছে না।তোমার আন্টির পরিচিত একটা ছেলে এসেছিলো আজকে,এই রুমটা তাঁর পছন্দ হয়েছে। আটহাজার টাকা দিবে বলেছে।এখন তোমার আন্টিকে তো না করা যাচ্ছে না। তুমি এই মাসের টাকাটা দিতে হবে না। ওটা তোমার এডবান্স এর সাথে কাটাকাটি। আর তুমি নতুন একটা বাসা দেখো। মনে কিছু নিও না ,যদি বাসা না পাও আমাকে বলিও আমি খুজে দিবো।”
“সমস্যা নেই চাচা। আমি খুঁজে নিবো।”
সুমন আলমারি থেকে তাঁর মার শাড়িটা বের করে হাতে নিয়ে বসে আছে। মাকে শেষ এই শাড়িতে দেখেছিলো সে। সাতটা বছর মা তাঁকে আগলে রেখেছিলো জগতের নির্মম মানুষ গুলো থেকে। সুমনের কানে এখনো ভাসছে মায়ের সেই কান্না। প্রতিরাতে মা যখন ঘরে ফিরে চুপকরে বসে কান্না করতো,সুমনের ঘুম ভেঙে যেত,বুক কাপতো,অথচ কখনো সাহস হয়ে উঠেনি মায়ের চোখের জল মুছে দেয়ার।সুমন কি তাঁর মাকে ঘৃণা করে ! কোনো ছেলে কি তাঁর মাকে ঘৃণা করতে পারে? যদি জগতের সবচেয়ে খারাপ কাজ তাঁর মা করে থাকে তবেও কি সে পারবে ঘৃণা করতে? সুমনের মনে হতে থাকলো সেই অন্ধকার ঘরের কথা, মা চোখ বন্ধ করে সুয়ে আছে খাটে,গাঁয়ে ১০৩জ্বর।সে কি করবে বুজতে পারছে না। মাকে জিগ্যাস করছে,”মা কি হয়েছে তোমার? মা ও মা কথা বলো।”
মা চোখ বন্ধ করেই কাঁদছে।তারপর সুমন কে কাছে টেনে নিয়ে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন।সুমন ও কাঁদছে। মা বলছেন,”সুমন………আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা। আমি তোকে একটা ভালো পরিচয় দিয়ে যেতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
এর পর মা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে চুপ হয়ে গেলেন।সেই পুরোটা রাত অন্ধকার ঘরে মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলো সুমন ।
শারিটা একটা বেগে ঢুকিয়ে রেখে সুমন ঘড়িতে সময় দেখলো ১২টা বেজে গেছে। মুখ ধুয়ে নিয়ে সে বের হবে এমন সময় কবির ভাই এসে হাজির।
“এই সুমন । আরেহ এইতো আছো দেখছি,আমি আরো ভাবলাম তোমাকে পাবো কি না ! চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।”
“আপনি ! অফিসে যাননি?”
“আরে গিয়েছিলাম।শুনো আমি বসকে বলে এক মাসের টাকা এডবান্স নিয়ে নিয়েছি,আর আরেক মাসের টা বাড়িতে যাওয়ার সময় দিবে বলেছে।কিন্তু কাজ অনেক বাকি।”
“জী।এখন কি ছুটি নিয়ে এসেছেন?”
“আরেহ না,হাফ টাইমে বেরিয়ে এসেছি।তুমাকে কিছু কাজ করতে হবে আজকে।”
“কি কাজ?”
কবির ভাই পকেট থেকে দশ হাজার টাকা আর একটা লিস্ট বের করে সুমনের হাতে দিয়ে বললেন,”টাকা গুলো দিয়ে এই লিস্টের জিনিস গুলো কিনে নিয়ে আসতে হবে।আমি নিজেই যেতাম,কিন্তু অফিসের কারনে যেতে পারছি না।সে জন্য এই কাজ গুলো তোমাকেই করতে হবে।”
“আজকেই কি লাগবে? আমি একটু ব্যাস্ত ছিলাম।”
“আরেহ হ্যাঁ আজকেই লাগবে,তাছারা এখনো তো আরো অনেক কিছু বাকি আছে,সব কিছু তোমাকেই করতে হবে,আমি একা তো সব সামলাতে পারবো না তুমি সাহায্য করতেই হবে।”
কথাটা বলে কবির ভাই অনেকটা হন্তদন্ত করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সুমন টাকা গুলো বিছানায় রেখে চুপকরে বসে রইলো।
স্নেহা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ করে তাঁর কাদে হাত রাখলো রিপা।স্নেহা রিপার দিকে ঘুরে একটু হাসি দিলো। রিপা বললো,”অপেক্ষা করছিস কারো?”
“কই না তো।”
“মিথ্যে বলবি না,আমি কিন্তু তোর সব মিথ্যে ধরতে পারি।”
স্নেহা হাল্কা করে হাসলো।
রিপা আবারো বললো,”তুই জানোস সুমন আসবে না। তারপর ও!”
“কেনো আসবে না ! তোর কি মনে হয় সুমন কি আমাকে পছন্দ করে না?”
“জানা নেই।তবে যদি পছন্দ করেই থাকে তাহলে ও আসেনি কেনো?”
স্নেহা আরো কিছুটা নিরবতা পালন করল। এই মুহূর্তে একটা কথাই তাঁর মাথায় ঘুরছে,’সুমন কি তাঁকে পছন্দ করে !’
স্নেহার বাবার আওয়াজ শুনে স্নেহা হালকা কেঁপে উঠলো।স্নেহার বাবা আলতাব চৌধুরী স্নেহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,”কিরে এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছিস?”
“ভাবছি বাবা।”
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি মানুষ একা একা কীভাবে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে!”
“কে পারে? কেউ তো পারে না।”
“পারে বাবা আমি দেখেছি দু-জন মানুষ।”
“কে?”
“তুমি । তুমিও তো একা বেঁচে আছো।সেই ছোট থেকে দেখছি একা একা সব কিছু সামলে নিচ্ছ।মা মারা যাওয়ার পর থেকে তুমি অনেক একা হয়ে গেছ তাই না বাবা !”
“কে বলেছে আমি একা।আমি তোকে নিয়ে বেচে আছি,তুই আছস বলেই আমর কোনো একাকিত্ব নেই।”
“মা দেখতে কেমন ছিলো বাবা?”
“ঠিক তোর মতো।তুই একদম তর মায়ের মতো হয়েছিস।,আচ্ছা আরেকজন কে?”
“আরেকজন আমার বন্ধু সুমন, খুবই কম কথা বলে। ওর মা বাবা কেউ নেই, কেমন করে চলছে এসব কিছু কখনো বলে না। মাজে মাজে যখন কথা বলে তখন মনে হয় এই জগতের প্রতি তাঁর এক সমুদ্র পরিমাণ অভিযোগ । এই যেমন ধরো সেদিন একসাতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, হঠাৎ সুমন বললো,সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না জানিস তো!,কেউ কেউ মাটির চামচ মুখে নিয়ে ও জন্মায়। অথচ এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখি কারা বলতে পারবি? ”
আমি বললাম ,”অবশ্য়ই যারা কোনো চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে না।”
সুমন হালকা করে হেঁসে বললো,”না। আসল দুঃখী মানুষ হলো যারা একটা পরিচয় পর্যন্ত নিয়ে জন্মাতে পারলো না। ”
“আজ আসেনি সে ?”
“নাহ। তবে আমার মনে হচ্ছে সে আসতে পারে।”
“আসলে আমার সাথে দেখা করিয়ে দিস।”
“আচ্ছা।”
রাত ১১টা বাজে। স্নেহার ফ্রেন্ডরা সবাই চলে গেছে। স্নেহা ঘুমানোর চেস্টা করছে,কিন্তু কিছুতেই তাঁর ঘুম আসছে না। মনের মধ্য এক অজানা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঝড়ের প্রলেপ প্রতিটি মুহূর্তে আরো অস্তির করে তুলছে স্নেহাকে। এতো অপেক্ষা করার পর ও সুমন আসেনি। এখানে অস্বাভাবিক কিছুই নেই ,সে তো বলেই ছিলো সে ব্যাস্ত আসতে পারবে না। হয়তো সে জানেও না স্নেহার এই অপেক্ষা,এই মুহূর্তে স্নেহার প্রতি তাঁর একবুক অভিমান। জানবে কি করে তাঁকে তো কখনো বলাই হয়নি।তাই বলে কি সে জানবে না ! সে কি বুঝেনা কলেজে পা দেয়ার পর প্রথম তাঁকে দেখেই একটি মেয়ে মন উড়িয়েছে, তাঁর সামনে যাওয়ার আগে কতবার আয়নায় গুছিয়েছে নিজেকে, কত কত রাত উরিয়ে দিয়েছে তাকে ভেবে ভেবে। সেও কি কখনো স্নেহাকে ভেবেছে ? হয়তো ভেবেছে,হয়তো ভাবেনি। স্নেহা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি ফোন হাতে নিয়েই সুমনের নাম্বারে কল দিলো। ওপাশ থেকে সুমনের কন্ঠ ভেসে আসলো,”স্নেহা, কেমন আছিস ?”
“ভালো, তুই কেমন আছিস?”
“এই তো বেশ। তর পার্টি শেষ।”
“হ্যাঁ। সত্য একটা কথা বলবি সুমন ?”
সুমন এক মুহূর্ত নিরব থেকে বললো,”বল।”
স্নেহা নিশ্বাস টেনে নিয়ে শান্ত গলায় বললো,”আজ তর কোনো কাজ ছিলোনা তাই না ?”
সুমন গম্বির হয়ে বললো,”হ্যাঁ ছিলোনা।”
“তাহলে তুই আসলি না কেনো?”
“জানাটা কি খুব জরুরী?”
স্নেহা নিজেকে আরেকটু শান্ত করে নিয়ে বললো,“এতটা জরুরী যে এটা জানতে না পারলে ধারুন বৃষ্টির মৌসুমেও খরা দেখা দিবে আমার মনে।”
সুমন একদম চুপ হয়ে আছে।স্নেহা আবারো বলে উঠলো ,”কিরে কিছু বলবি না ?”
“আমি আসলে ভয় পাই। টাকাওয়ালা বড়লোক মানুষের পাশে বসলেই আমার অস্বস্তি বোধ হয়। আমি যে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র এই সমাজের চোখে। সেইসব মানুষের চোখে নিজের জড়তা কাটিয়ে তাদের সাথে মিশে যাওয়ার মতো এতটা সাহস আমি এখনো জোগাতে পারিনি স্নেহা। সেজন্যই আমি এসব এড়িয়ে চলি।”
“আমার পাশে বসলেও কি তোর অস্বস্তি বোধ হয়?”
“নাহ। আমার মনে হয় শূন্যতার এই শহরে তুই ই আমার সবচেয়ে প্রিয় । তবে আবার ভয় হয়, ভয় হয় নিজেকে নিয়ে।”
“আমি তর প্রিয় !”
“আমি আসিনি বলে তুই কি এখনো রাগ করে আছিস?”
“কোনো এক অজানা অদ্ভুত কারনে আমি তোর উপর রাগ করতে পারি না। আমার হয় শুধু অভিমান, সেও তোর কণ্ঠ শুনলে উড়ে যায় ধোয়া হয়ে।”
সিগারেট হাতে টং দোকানে বসে আছে সুমন। তাঁর ঠিক সামনে বসে আছে কবির ভাই । সুমন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সকালবেলার রোদ এক আকাশ হাহাকার,বেকারত্বের কাছে হেরে যাওয়া কালো ছাপ উড়িয়ে দিয়ে বের করে নিয়ে এসেছে সুমনের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা ফিকে হয়ে আসা হাসিটা। কবির ভাই চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,”আজ কি আবার ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসলে!”
“জী ভাই।”
“আগেরটা হয়নি ?”
“কি যে বলেন কবির ভাই,আগেরটা হলে কি আবার ইন্টার্ভিউ দিতাম!”
কবির ভাই হাসতে হাসতে বললেন,”আসলেই তো। আচ্ছা শুনো সুমন শহরের কাজ বলতে গেলে আমরা প্রায় গুছিয়ে নিয়েছি।আমি কাল চলে যাবো,যাওয়ার আগে একবার রাজন ভাইর সাথে অবশ্য দেখা করে যাবো,টাকাগুলো নিয়ে যেতে হবে।সময়তো আর বেশি নেই ৬ দিন বাকি।”
“আচ্ছা। রাজন ভাই মানে আপনার ফুফাতো ভাই!”
“হ্যাঁ।আচ্ছা তুমি কবে আসছো?”
“আমি সঠিক বলতে পারছি না ভাই।”
“এটা কোন ধরণের কথা ! তুমি না হলে আমি এতকিছু সামলাবো কি করে?”
“আসবো আরি ভাই। টেনশন করবেন না দেখবেন এমনি সব ঠিক হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা তাহলে কালকে আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে আসবে কিন্তু। এটা মিস করা যাবে না। আমি একটু নার্ভাস হলে সব কিছু গুলিয়ে যায়। তাই সব জিনিস্ব-পত্রের দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে হবে।”
“জী আচ্ছা ভাই।
সারাদিন কবির ভাইর সাথে ঘুরে সন্ধায় রুমে ফিরে সুমন কিছুটা অবাক হলো। স্নেহা বসে আছে তাঁর রুমে।সুমন রুমে ঢুকতেই স্নেহা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো,”কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ! কত গুলো কল দিয়েছি খবর আছে?”
সুমন একটু হেঁসে পকেটে হাত দিলো,পকেটে মোবাইল নেই।স্নেহা বললো,”কি হয়েছে মোবাইল পাচ্ছিস না?”
“নাহ।”
স্নেহা সুমনের দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,”ধর রুমেই ফেলে গিয়েছিলি,আমি তো ঠাট্রা করছিলাম।“
“তুই এসেছিস কতক্ষণ !”
“হবে ঘণ্টা খানিক।”
“কীভাবে আসলি ! এখানে তো মেয়ে আসা নিষেধ।”
“গেট খোলা ছিলো। একজন বেটে করে লোক অবশ্য জিগ্যাস করেছিলো কার কাছে যাচ্ছি তর নাম বলার পরে আর কিছু বলেনি।”
“চল বাইরে”
“এসেই যখন পরেছি তখন থাকি,যদি কিছু হয় তবে আমার জন্য সামলে নিস।এতটুকু জিনিস তো আমি দাবি করে নিতে পারি।”
সুমন কিছু বললো না।স্নেহার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। টানা টানা দুটি চোখ,কাজল দেয়ায় বোধহয় চোখদুটো সামান্য বড় দেখাচ্ছে।তাতে অবশ্য স্নেহাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
সুমন চেয়ার টেনে স্নেহার সামনে বসতে বসতে বললো,”কি মনে করে আসা?”
“তোকে মনে করে! কেনো আসা যায় না !”
“যায় তবে,কোনো কারণ আছে নিশ্চই!”
“একটা কথা বলতে এসেছি। কিন্তু এখন বলবো না। বলবো যাওয়ার সময়।”
“কেনো!”
“জানা নেই। শুধু মাত্র মনে হচ্ছে যাওয়ার সময় বলাটাই ভালো।”
“আচ্ছা।”
“তুই কি ব্যাস্ত ?”
“নাহ তেমন একটা না।”
“শুনেছি তুই চাকরির খোঁজে আছিস! হয়েছে?”
“নাহ হয়ে যাবে। তুই কবে যেনো যাচ্ছিস?”
“২৫ তারিখ। আর পাঁচ দিন পর।”
“যাওয়া কি একদম কনফার্ম ?”
“হ্যাঁ। আচ্ছা শোন বাবা বলেছিলেন তর সাথে দেখা করবেন।”
“আচ্ছা”
”দেখা করবি তুই বাবার সাথে?”
“যাবো একদিন।”
“এর মানে আসবি না।”
সুমন কিছু বললো না।স্নেহা আবারো বললো,
”একটা কথা রাখবি?”
“কি?”
“আমি চলে যাওয়ার দিন একবার আমার সাথে দেখা করবি?”
“আচ্ছা। আসবো।”
“সত্যি বলছিস?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা আমি চলে যাওয়ার পর কি আমাকে তোর মনে পরবে?”
“নাহ।”
স্নেহার চেহারার রং কিছুটা উড়ে গেলো ,এর মাজেই সুমন আবারো বলে উঠলো,”মনে করা হয় তাদের যাদের ভুলে যাওয়া হয়। তুই ভুলে যাওয়ার যোগ্য নয়।”
স্নেহা খানিকটা হাসলো। তাঁরপর চুপ হয়ে গেলো।সুমন ও চুপ রইলো সে যেন আর কথা খুজে পাচ্ছে না। স্নেহা সুমন এর দিকে তাকিয়ে বললো,”সুমন আমার হাতটা একটু ধরবি?”।
সুমন কিছু বললো না।বাকহীন ভাবে স্নেহার হাত ধরে বসে রইলো।স্নেহা সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,”দেখলি সুমন আমি ভয় পাইনি তোকে,তোর আসে পাশের মানুষ গুলোকে,তুই চাইলেই আমি মানিয়ে নিতাম।”
সুমন পাথর এর মতো স্নেহার হাত ধরে বসে আছে।লোডশেডিং হলো,পুরো ঘর অন্ধকার।স্নেহা কাঁদছে।সুমন কে জড়িয়ে ধরে শব্দহীন ভাবে কাঁদছে।অথচ সুমনের বুকে একদল শব্দ আঘাত করছে,মনে হচ্ছে এই বুঝি বুক ভেঙে বেরিয়ে এলো ধাবিয়ে রাখা আবেগ,সীমাহীন ভালোবাসা,অভিমান,অভিযোগ সবকিছু।জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পরছে স্নেহার মুখে। জ্বল জ্বল করে উঠছে স্নেহার চোখের জল গুলো।সুমন স্নেহাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আর তাঁর গোপন করা চোখের জল ঢেলে দিলো অন্ধকার রুমের নীরবতায়।
সুমনের ঠিক সামনে একটি চেয়ার টেনে তাঁর দিকে তাকিয়ে বসে আছেন আকবর সাহেব।তাঁর হাতে একটি সিগারেট।চোখে মুখে লেগে আছে কঠিন এক ছাপ।আকবর সাহের সিগারেট শেষ করে গলার স্বর নরম করে বললেন,”বাসা কি পেয়েছো সুমন?”
“জি না চাচা,তবে পেয়ে যাবো।”
“কাল তোমার রুমে কে এসেছিলো?”
“রুমে তো অনেকেই আসে। কার কথা বলছেন।”
“কার কথা বলছি তুমি ভালো করেই জানো।আমি মেয়েটার কথা বলছি,কাল একটা মেয়ে এসেছিলো তোমার রুমে। কে সে?”
“ওহ স্নেহা,আমার ফ্রেন্ড।” সুমন কথাটাকে উড়িয়ে দিতে চায়,স্নেহাকে নিয়ে সে কোনো রকম তর্কে যেতে চায় না,কিন্তু এ মুহূর্তে এটা সম্ভব না। কারণ রুমে মেয়ে আসা সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ।আর কোনো ভাবে লোক জানা-জানি হওয়া মানে হাজার রকম কথা বার্তা।আর সে এই ভুলটাই করেছে, এই মুহূর্ত এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।বরং নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হবে এই মুহূর্তটা পার করার জন্য।
“তুমি কি জানো না, রুমে মেয়ে নিয়ে আসা নিষেধ?”
“জানি চাচা।কিন্তু হুট করে কেউ চলে আসলে তো তাঁকে তাড়িয়ে দেয়া যায় না,তাই না!”
“তুমি কি জানো বাইরে তোমাকে নিয়ে এখন কি ধরণের কথা-বার্তা চলছে?”
“জানিনা ধারণা করতে পারছি। কিন্তু খুব বেশি জানতে চাইছি না।”
“তোমার মাজে কোনো ধরণের অনুশোচনা দেখছি না।”
“আমি তো কোনো অপরাধ করিনি চাচা।”
আকবর সাহেব উত্তেজিত হয়ে গেলেন,গলার স্বর কঠিন ও বড় হয়ে গেলো।“রুমে মেয়ে নিয়ে এসেছ আবার বলছো কোনো অপরাধ করোনি! আমার মান সম্মান কিছু রেখেছ! বাইরে লোক কি বলছে কোনো খেয়াল আছে ! সবাই বলছে রাস্তার ছেলেকে রুম ভাড়া দিয়েছি মাঘি নিয়ে আসে রুমে। যদি মেয়ে নিয়ে রুমে ডুকা অপরাধ না হতো তাহলে আমি তোমাকে ভাড়া না দিয়ে তো ঘর টাকে পতিতালয় ও বানাতে পারতাম।”
সুমন মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলো।ভাবছে তাঁর হয়তো কথা গুলো এভাবে বলা উচিত হয়নি।কিন্তু এখন সময় পেরিয়ে গেছে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
আকবর সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,”তুমি আজই এই রুম ছেরে চলে যাবে।কীভাবে যাবে জানি না।যেতে হবে। বিকেলেই আমি তালা লাগিয়ে দেবো। বজ্জাত কোথাকার !”
সুমন কোনো ধরণের প্রতিবাদ করলো না। নিরব ভাবে এগিয়ে গেলো ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই দেখতে পেলো একটি হলুদ খাম,পাশে একটি চিঠি রাখা।কে রাখলো ! সুমন এক মুহূর্ত ভাবতে চাইলো,কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে হলো না। সুমন চিঠিটা হাতে নিয়ে খুলতে খুলতে চেয়ারে বসলো।
চোখ বুলাতে লাগলো চিঠিটা তে………
সুমন,
জানি এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে তুই ভাবছিস না। তবে আমি ভাবছি। প্রতিটা মুহূর্তে আমি
তোকে ভাবার চেষ্টা করি।ভালোলাগে তোকে নিয়ে ভাবতে, ভাবতে ভালোলাগে আমরা
দু-জন খুব সাধারণ,খুব সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো। সবার মতো আমরাও হাতে
হাত রেখে পার করে দিতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা। মাজে মাজে কারণ ছারাই তাকিয়ে
থাকতে পারি একে অপরের দিকে।মাজে মাজে ভাবি যদি আমার ভাবনাগুলো সত্য হতো!
আফসোস আমাদের বাস্তবকল্পনা গুলো বোধহয় কখনো সত্য হওয়ার সাহস পায় না।ঠিক
যেমন আমি পাইনি। তোকে নিজের বলে দাবি করার মতো সাহস আমার হয়ে উঠেনি।
তোর উপর অধিকার খাটিয়ে কখনো কিছু বলা হয়নি,কখনো কিছু দেয়া হয়নি।খামে কিছু
টাকা আছে,আমি জানি তোর হাতের অবস্তা ভালোনা।আমার দেয়া উপহার হিসেবে টাকাটা
গ্রহণ করিস।একটা আবদার ও ছিলো।আমাকে কখনো ভুলে যাস না। আমি চাইনা আমাকে
তুই ভুলে যা,অতটা উদার মনের আমি হতে পারিনি যদিও আমি জানি তুই আমাকে কখনো
ভুলতে পারবি না।ভালো থাকিস সুমন।তোর একটা সুন্দর জীবন হোক এই কামনা করি।
ইতি
স্নেহা চৌধুরী
চিঠিটা শেষ করে সুমনের বুকে সামান্য চিনচিন ব্যাথা হতে শুরু করলো।এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হচ্ছে জগতের মাজে সে যেনো নতুন করে আবার একা হয়ে গেলো। সে তো একাই ছিলো,শূন্যতার হাহাকার ছাড়া কেউ নেই তাঁর।তবুও কি কেউ ছিলো! কেউ একজন তাঁকে নিয়ে ভাবতো,তাঁর দেখা পেলে ফুলের মতো হেলে দুলে হেঁসে উঠতো,হয়ে উঠতো আনন্দে আত্বহারা। আত্বহারা ! সেও কি কখনো স্নেহাকে দেখে আত্বহারা হতে পেরেছিলো? পারেনি। সে শুধু মাত্র দেখেছে একটি মেয়ে ঠিক কতটা ভালোবাসতে পারে। তাঁর ভালোবাসাকে প্রমান করে দিতে পারে প্রতিটি মুহূর্তে মুহূর্তে। আর সে সাহস করতে পারেনি কবুও সেই মেয়েটিকে নিজের করে নিতে। সে কখনো বলতে পারেনি মুখ ফুটে ,“এই নির্মম জগতে আমার একটা আশ্রয় চাই,আমাকে আশ্রয় দাও,আশ্রয় দাও তোমার বুকে।আমাকে জড়িয়ে ধরো,এতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরো যে আমি ভুলে যাই নিজেকে।আমাকে আগলে নাও নিজের ভেতর,আমি ক্লান্ত আমাকে মানসিক শান্তি দাও,আমাকে চুমু খাও।”
সুমনের ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তেই ছুটে চলে যেতে স্নেহার কাছে।নিজেকে ভেঙে চুরে বিলিয়ে দিতে তাঁর কাছে।সুমন খামটা হাতে নিলো।কিন্তু খুলে দেখলো না।খাম হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
সুমনের সামনে বসে আছে কবির ভাই।কবির ভাইর পাশে অনেক গুলো ব্যাগ গুছিয়ে রাখা, পাশের টেবিলে ২৫ তারিখ রাতের একটি ট্রেনের টিকিট কেটে রাখা।তাঁর কাদো কাদো অবস্থা।সুমন কবির ভাই দিকে এগিয়ে গেলো,”কি হয়েছে কবির ভাই? কোনো সমস্যা হয়েছে ! ইমারজেন্সি ডাকলে !”
কবির ভাই সুমনের দিকে করুন ভাবে তাকালো,তাঁর পর শান্ত গলায় বললো,“বিয়েটা মনে হয় আর হবে না সুমন।”কবির ভাই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। ঠিক করে কথা ও বলতে পারছে না না তাও বলা শুরু করলো,”রাজন ভাই এখন হঠাৎ করেই বলছে সে টাকা দিতে পারবে না।রিসেন্টলি নাকি তাঁর কোম্পানির অনেক বড়ো একটা লস হয়েছে । অথচ এদিকে বিয়ের ডেট এগিয়ে আসছে,আমি টিকেট কেটে রেখেছি আজ যাবো বলে,অথচ আমার কাছে একটা টাকাও নেই।আমি মুখ দেখাবো কি করে কিছুই বুঝতে পারছি না,সবাই আমার অপেক্ষা করছে আমি গেলে সব হবে অথচ……আমি কিছু বুঝতে পারছিনা সুমন আমার মাথা কাজ করছে না।”কবির ভাই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সুমন কবির ভাইকে শান্তনা দেয়ার শুরে বললো,”শান্ত হন কিছু না কিছু একটা ব্যাবস্তা হয়ে যাবে ঠিকই।” অথচ সুমন জানে টাকা পাবার অন্য কোনো জায়গা নেই কবির ভাইর।সুমন চুপ করে বসে সিগারেট জ্বালালো, একটা তুলে দিলো কবির ভাইর হাতে। চুপচাপ সিগারেট খেতে থাকলো দু-জন,কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না।তারপর সুমন ভাই অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে বললেন,”পৃথিবীটা অনেক নিষ্ঠুর।”
কথাটার কোনো উত্তর দিতে পারলো না সুমন।কবির ভাইকে বললো,”দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে আসছি ভাই।”
কবির ভাই কিছু বললো না।
সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সে আর রুমে ঢুকতে পারলো না, রুমের ভিতরে তাকিয়ে তাঁর চোখ শান্ত হয়ে গেছে।সিলিং ফ্যানের মাজে ধরি দিয়ে ঝুলে আছে একটি মানুষ,মানুষটি তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মুহূর্তেই গলায় পড়ে গেছে কালো দাগ। জলজ্যান্ত একটা মানুষ, যে একটু আগেও তাঁর সাথে কথা বলছিলো। বলছিলো জগতটা নিষ্ঠুর। জগতের নিষ্ঠুরতা তাঁকে গিলে নিলো মূর্তেই।
তিন-চার বার কল দেয়ার পর ওপাশ থেকে একজন মহিলার কন্ঠ ভেসে আসলো সুমনের কানে,”হ্যালো কে?”
“স্লামালাইকুম চাচি। আমি সুমন কবির ভাইর ফ্রেন্ড।”
“ওহ আচ্ছা।কবির কি ট্রেইনে উইঠা পরছে বাবা? সেই দুপুর থেইকা ওরে ফোন দেই ফোন ঢুকে না !”
সুমন নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বললো,“কবির ভাই জরুরী কাজে কয়দিনের জন্য অফিস থেকে বিদেশে যাচ্ছে।সেখানে ফোন নিয়ে যাওয়া নিষেধ।আজ সকালেই গেছে।আমাকে ১লক্ষ টাকা দিয়ে বলেছে আপনাকে পাঠাতে।”
“কই কাইলইতো আমার লগে কথা কইলো, বিদেশ নিয়া কিছু কইলো নাতো !”
“হঠাত করেই যাওয়া পরেছে চাচি এক্সট্রা কিছু টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে চলে গেছে।বিয়েতে মনে হয় আসতে পারবে না। আমি টাকাটা পাটিয়ে দিচ্ছি আপনি হাতে পেয়ে আমাকে কল দিবেন।”
“ওরে ছাড়া বিয়ে ! ”
“চিন্তা করবেন না চাচি কোনো সমস্যা হলে এই নাম্বারে কল দিবেন।”
“আইচ্ছা বাবা।”
সুমন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে একটি প্লেন উড়ে গেলো আকাশে দিয়ে। স্নেহা কি এই প্লেনে আছে ! সুমন এক পলকে তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে।বুকের ভেতর গভীর শুণ্যতা নিয়ে তাকিয়ে আছে।অজানা হাহাকার কুরে কুরে খেতে শুরু করেছে তাঁর মস্তিস্ক। গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে দু-ফোটা দুঃখ,একটি জীবনের সমাপ্তি।
সমাপ্ত