Sandip Chakraborty

Abstract Romance

5  

Sandip Chakraborty

Abstract Romance

নীল রংয়ের সাঁকো/৫

নীল রংয়ের সাঁকো/৫

6 mins
607


নীল রংয়ের সাঁকো/৫


সন্দীপ চক্রবর্তী


ছেলেটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে গাছপালার ফাঁকে হারিয়ে গেল। আমার মন আবার স্বাভাবিক। কোনও অবসাদ নেই। বেশ বুঝতে পারছি, আমি পারব। অসিতদার সঙ্গে আমার দেখা হবে। আজকের মতো হঠাৎ দেখা যদি নাও হয় আমি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করব।


 একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। সকালে কিছু খেয়ে বেরোইনি। চা-ও না। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। কিন্তু এই কামরায় কোনও হকার আসছে না। প্ল্যাটফর্মে নেমে কিছু খেতে গেলে ট্রেন ছেড়ে দিতে পারে। অগত্যা চা আর লোকাল বেকারির বিস্কুট দিয়ে ম্যানেজ করতে হল। পুরুলিয়ায় নেমে আগে কিছু খেতে হবে। অনেকদিন ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাইনি। পুরুলিয়ার প্ল্যাটফর্মে কি পাওয়া যায় ফ্রেঞ্চ টোস্ট? বালিগঞ্জের বসু বাড়ির খাওয়া-দাওয়া একটু অভিজাত ঘরানার। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ছেলে। যাব শবরদের গ্রাম মৃগীচামিতে। আমি আর অভিজাত নই। খুব সাধারণ। প্ল্যাটফর্মে ফ্রেঞ্চ টোস্ট না পেলেও আমার কিছু যায় আসে না।


 

 

 ফাগুনকে ফোন করব বলে পকেট থেকে মোবাইলটা

বের করা মাত্র ওটা বেজে উঠল। শচীজেঠুর ফোন। অর্থাৎ মঞ্জুদি রিপোর্ট করে দিয়েছে। এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।--হ্যালো


 তুই শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলি অনি? তুই এরকমটা করবি আমি সত্যিই আশা করিনি।


 আমি তো তোমাদের জানিয়েই আসতে চেয়েছিলাম জেঠু। কিন্তু তুমি বললে, রতনকাকাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে। সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।


 কীসে অসম্ভব সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আগেকার দিনে লোকে বেড়াতে যেত চাকর-বাকর সঙ্গে নিয়ে। তাতে কাজকর্মে সুবিধাই হত।


 আগেকার দিনে যা হত এখন তা হয় না। এখন প্রাইভেসি একটা বড়ো ব্যাপার। আর তা ছাড়া, বেড়াতে তো আমি আসিনি জেঠু।


 তা হলে কী করতে গেছিস শুনি?


 

 

 বলতে পারো, বালিগঞ্জের বসু বাড়ির থেকে অনেক

বড়ো একটা ক্যানভাসে নিজেকে খুঁজতে এসেছি।


 খোঁজ না তুই নিজেকে। বাড়ির কাউকে সঙ্গে রেখে খুঁজতে আপত্তি কী?


 বাড়ির কেউ সঙ্গে থাকলে সে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে আমি ডিপ্রেশনের রুগি। আড়াল থেকে সবসময় নজর রাখবে আমার ওপর। জেঠু আই নিড স্পেস। আই ওয়ান্ট ফ্রিডম। এতগুলো লোকের ভালোবাসার অত্যাচারে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। কথা দিচ্ছি সময় হলেই আমি বাড়ি ফিরে যাব।


 ভালোবাসা যে অত্যাচার হয় সেটাও আজ তোর মুখে প্রথম শুনলাম। যাই হোক, তোর যখন পছন্দ নয় এই নিয়ে আর কোনও কথা আমি বলব না। আমি জানি তুই মৃগীচামিতে ফাগুন বলে মেয়েটার কাছে যাচ্ছিস। সে যা। তবে সামনের রবিবার অ্যাটর্নি সাহেবকে নিয়ে আমি একবার ওখানে যাব। ফাগুনকে কয়েকটা কথা বোঝানো দরকার। নয়তো তোর হঠাৎ কোনও সাইকোলজিক্যাল অ্যাটাক হলে বেচারি বিপদে পড়ে যাবে।



 শচীজেঠু কী বলতে চাইছে বুঝতে আমার অসুবিধে হল না। ওরা এসে আমার অসুখের কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে ফাগুনকে ভয় পাইয়ে দেবে। তারপর খুব সহজেই আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। না, সেটা আমি হতে দেব না। --আমার অসুখের কথা ফাগুন অনেকটাই জানে জেঠু। ফোনে এই নিয়ে আমাদের প্রায়ই কথা হয়। যেটুকু জানে না সেটা আমিই বুঝিয়ে দিতে পারব। তোমার প্রেসক্রিপশন আমার কাছে আছে। ওষুধের স্টক আছে একমাসের। ফুরিয়ে গেলে পুরুলিয়া টাউন থেকে আমি নিয়ে যাব। সুতরাং তোমাদের আসার দরকার নেই।


 আরে তোরা দুজনেই ছেলেমানুষ। তুইও বোঝাতে পারবি না, ফাগুনও বুঝতে পারবে না।


 আমি ছেলেমানুষ নই জেঠু। ফাগুনও ছেলেমানুষ নয়। তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি ফাগুনকে বলে রাখব একান্তই যদি কোনও সমস্যা হয় তা হলে ও যেন তোমায় ফোন করে।


 আই সোয়ার ইউ অনি। আমরা রবিবার যাব। ওইদিনটা থাকব। পরের দিন চলে আসব।


 


 বললাম তো দরকার হবে না। এরপরেও তোমরা যদি জোর করে আসো তা হলে কিন্তু আমি এখান থেকেও পালাব। এখন তোমরা জানো আমি কোথায় যাচ্ছি। এখান থেকে পালালে সেটাও আর জানতে পারবে না।


 শচীজেঠু ফোন রেখে দিল। ট্রেনের ঘটাং ঘটাং শব্দের মধ্যে স্পষ্ট টের পেলাম গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে কান্না। একটা জিজ্ঞাসা ঘাই মারছে বুকের ভেতর, আমি কি ঠিক করলাম? শচীজেঠুর সঙ্গে আমি কোনওদিন এরকম রূঢ় ভাষায় কথা বলিনি। কেন এত কঠিন হলে অনি? কেন দুঃখ দিলে মানুষটাকে? ট্রেন বোধহয় নতুন কোনও বাঁকে বাঁক নিচ্ছে। চাকার শব্দ একদম পালটে গেছে। বাবা-মা চলে যাবার পর আমার বেঁচে থাকার শব্দ যেমন পালটে গিয়েছিল। তখন শচীজেঠু আমাকে সদ্যোজাত শিশুর মতো আগলে রেখেছিল। অ্যাটর্নি আঙ্কলকে আমার তত কাছের বলে মনে হয় না। কিন্তু শচীজেঠু আমার খুব কাছের। অথচ আজ কত সহজেই শচীজেঠুকে বলে দিলাম, তোমার আসার দরকার নেই। বাতিল অকেজো জিনিসের মতো একটানে ফেলে দিলাম আমার সব থেকে কাছের মানুষটাকে। অজান্তেই আমার চোখের পাতা ভিজে গেল। মনে হল ভুল করেছি। ফোন করে ক্ষমা চাই। বলি, তোমরা রবিবারে এসো। ফাগুনকে কী বোঝাবে বোঝাও। তোমরা এলে আমি এখান থেকে পালাব না।


আমার ভুল হয়েছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।--- কিন্তু শচীজেঠুর নাম্বারে কল বাটন প্রেস করেও রিং হবার আগে লাইন কেটে দিলাম। না, আমি ফোন করব না। ক্ষমা চাইব না। শচীজেঠু দুঃখ পাবে। আমিও পাব। কিন্তু এই দুঃখ আমাকে মেনে নিতে হবে। কারণ জীবনে সৎ থাকতে হলে মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর হতে হয়। আজ যদি নিষ্ঠুর হব না বলে অসৎ হই তা হলে কাল হয়তো শচীজেঠুকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাব। সারা জীবন ধরে মানুষটাকে অসংখ্যবার চাবুক মারার থেকে একবার সামান্য একটু আঘাত করা ঢের বেশি যুক্তিসঙ্গত।


 

 ট্রেন পৌঁছে গেল পুরুলিয়ায়। প্ল্যাটফর্মে নেমে একটা বড়ো চায়ের দোকানে পাউরুটি আর ডিম আছে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ফ্রেঞ্চ টোস্ট হবে?


 বৃদ্ধ দোকানদার হেসে বললেন, কিনো হবেক লাই! খাব্যে না লিয়্যা যাবে?


 মনে হল কানে মধু ঝরে পড়ল। এখানকার মানুষ অদ্ভুত একটা সুর মিশিয়ে বাংলা বলেন। এদের বাংলা শব্দ উচ্চারণের ভঙ্গিও আলাদা। বললাম, খাব।


 বৃদ্ধ ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানানোয় মন দিলেন। আমার চোখ ওর দিকে। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কথা বললে বৃদ্ধ মাটির গন্ধ মাখা সুরে কথা বলবেন। আসলে আমার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী বলব? আমি কি সেই কথা জানি যা শুনলে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবে?


 এই লাও তুমার ফেন টোস্ট!


 পেটে অনেকক্ষণ থেকে আগুন জ্বলছে। প্লেটটা হাতে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলাম। ফ্রেঞ্চ টোস্টের পর চা। আগুন নিভল আপাতত। দোকানে অন্য কাস্টমার এসে গেছে। বৃদ্ধ এখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত। আজ আর কথা বলা হল না।


 আগে আমি সিগারেট খেতাম। গত তিন বছর খাইনি। নেশাও চলে গেছে। কিন্তু আজ আমার নিয়ম ভাঙার দিন। আজ থেকে জেলখানার নিয়ম আর খাটবে না। সিগারেট ধরিয়ে ফোন করলাম ফাগুনকে।


 আজ হঠাৎ দুপুরবেলায় ফোন! কী ব্যাপার?


 কারণ আজ আমি কলকাতায় নেই। পুরুলিয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।


 পুরুলিয়া স্টেশনে মানে! মাই গড! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?


 মনে হল এ প্রশ্নের উত্তর জানার পর ফাগুন বোধহয় বলবে, তুমি ফিরে যাও অনি। কিন্তু আমি ফিরে যাব না। অন্য কোথাও চলে যাব। এত বড়ো পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও আমি জায়গা পেয়ে যাব। কেউ না কেউ আমাকে জায়গা দেবে। তার জন্য হয়তো টাকা খরচ করতে হবে। করব। টাকা ছাড়া কী বা আছে আমার! এমন কিছু তো করিনি যার জন্য কেউ আমাকে ভালোবাসবে। ভালোবেসে ডেকে নেবে আমায়। বললাম, হ্যা ফাগুন, আমি পালিয়ে এসেছি। জানি তুমি পলাতক অনির্বাণকে তোমার কাছে থাকতে দেবে না। কিন্তু কী করব বলো! তোমার কাছে আসতে ইচ্ছে করছিল বলে এসেছি। তুমি যদি ফিরিয়ে দাও অন্য কোথাও চলে যাব।


 আমি তা বলিনি অনি। তুমি এখানে থাকবে এর থেকে আনন্দের আমার কাছে আর কী হতে পারে! কিন্তু শচীজেঠু আর অ্যাটর্নি আঙ্কলের কথা কি ভেবেছ? ওরা টেনশনে শেষ হয়ে যাবেন।


 ওদের কথা ভেবো না। আমি চিঠিতে কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি--সব লিখে এসেছি। তা ছাড়া,


শচীজেঠুর সঙ্গে ফোনে একটু আগে কথাও হয়েছে। ওদিকে কোনও সমস্যা আপাতত নেই।


 তা হলে এদিকেও নেই। চলে এসো। কীভাবে আসতে হয় তোমাকে বলেছিলাম। মনে আছে তো? নাকি কাউকে পাঠাব?


 থ্যাঙ্কস ফাগুন। আমি একাই যাব। কাউকে পাঠাতে হবে না।


(ক্রমশ)


  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract